জানি দেখা হবে পর্ব ১৭+১৮

#জানি_দেখা_হবে ❤
Israt Jahan Tanni ✍
#Part_17
..
ধ্রুবদের বাসার ড্রয়িংরুমে বসে আছে তুরিনের বাবা। তুরিনের বাবা বেশ নিচু ভাবেই বসে আছে। এই বাড়িতে তিনি এ নিয়ে দুইবার এসেছেন। কিন্তু ভালোভাবে একবারও আসেন নি। দুইবারই তুরিনের অসৎ কার্যকলাপের কারনের উনাকে ডাকা হয়েছে। একপাশে দাড়িয়ে আছে তুরিন । তুরিনের বাবার পাশে বসে পান চিবুচ্ছেন তুরিনের মা। এতো কিছু শুনার পরেও উনার কাছে মনে হচ্ছে এটা কোনো বিষয়ই না, শুধুমাত্র ছেলেমানুষি।
..
ধ্রুবর বাবা হালকা কেশে বললেন..
– এক ঘরের দুটো মেয়ে, প্রথমটা হয়েছে লক্ষি.. আর দ্বিতীয়টা,,, সেটাকে কোনো বিশেষন দেওয়ার ভাষা আমার নেই। তুরিনের বাবা বললেন..
– দেখুন, আমি কি বলবো.. বলার মতো কোনো ভাষা আমার নেই। আসলে সবই আমার কপাল। আমি চেয়েছিলাম.. আমার দুইমেয়ে যেনো মানুষের মতো মানুষ হয়। কিন্তু আমি ব্যর্থ বাবা। আমি আমার মনের মতো করে ওদেরকে মানুষ করতে পারিনি।
ধ্রুবর বাবা বললো..
– কেন, আপনার বড় মেয়েতো অনেক ভালো। ওকে নিয়ে কথাটা বলা আপনার উচিত হয়নি।
– হ্যাঁ, বড় মেয়েটা মানে আমার তারা মা। খুব ভালো একটা মেয়ে। কিন্তু ওকে তো আমি মানুষ করিনি। ওর মা মারা যাওয়ার পর ওর মায়ের অভাব পুরন করার জন্য দ্বিতীয় বিয়ে করি। কিন্তু, মায়ের অভাব পুরন করাতো অনেক দুরের বিষয় , দুবেলা দুমুঠো ভাত পর্যন্ত ও ঠিকমতো পেতো না। তুরিন হবার পর, ওর অত্যাচার আরো বেড়ে গেলো। মেয়েটা নিরবে মামাকে খবর দিয়ে মামার সাথে চলে গেলো সেখানে। কোনো প্রতিবাদ পর্যন্ত করেনি। সেই যে গেলো.. মাঝে মাঝে আসতো আমাদের দেখতে, কিন্তু বাসায় আসলে ওরা মা মেয়ের জন্য একটু শান্তি পেতোনা। একটা দিনও থাকতে পারতোনা নিজের বাসায়। সোজা চলে যেতো যেখান থেকে এসেছে সেখানে। ছলছল কন্ঠে বললেন উনি।
.
তুরিনের বাবার কথায় রেগে গেলো তুরিনের মা। পানের পিকটা একটা পাত্রে ফেলে বললো..
– কি বলতে চাইছো তুমি? আমি তারাকে অত্যাচার করতাম? ওই তারা একটা জঘন্য মেয়ে। ওই আমাদের অত্যাচার করতো। আমরা নেহাত ভালো মানুষ ছিলাম, তাই কিছু বলিনি ওকে। কিছু করিওনি। নইলে ছোট থাকতেই গলা টিপে মেরে ফেলতাম।
– মারার আর বাকিটা রেখেছো কি? সেই ছোটবেলায় বাড়িছাড়া করেছো মেয়েটা। এখন বিয়ে হয়েছে, তাও তোমরা একটু শান্তিতে থাকতে দিলে না ওকে। কি ক্ষতি করেছে ও তোমাদের? কেন পরে আছো ওর পিছে? বেশ রেগে গিয়ে বললেন তুরিনের বাবা।
..
ধ্রুব এক কর্নারে দাড়িয়ে থেকে সবকিছু শুনছে। ইচ্ছে করছে এখনই ওদের মা মেয়ের মাথা ফাটিয়ে দিতে। কিন্তু ভদ্রতার খাতিরে সেটা করলো না ও।
তুরিনের করা খারাপ কাজগুলোর কথা শুনে রেগে ফেটে পরছে। অন্যদিকে তারার সাথে করা সমস্ত অন্যায়গুলোর কথা মনে হলে গা শিউরে উঠছে ওর। অনুশোচনায় ভেঙ্গে পরছে। আর দুরে থাকবেনা ও। কিছুক্ষন পরই গিয়ে নিয়ে আসবে তারাকে। দরকার হলে মাফ চাইবে। নিশ্চয়ই ফিরিয়ে দিবেনা নিজের স্বামীকে।
.
ওদের স্বামী স্ত্রীর কান্ডগুলো এতোক্ষন আড় চোখে দেখছিলেন ধ্রুবর বাবা। গম্ভীর কন্ঠে বললেন..
– আপনাদের তামাশা করার জন্য এখানে ডাকিনি। ঝগড়া করার ইচ্ছা হলে নিজের বাড়িতে গিয়ে করবেন।
– শুনুন বিয়াই সাহেব, আজকালের ছেলেমেয়েরা এইসব করেই। এটা কোনো অন্যায় না। ছেলেমানুষি। আপনি কোনো বাড়াবাড়ি না করে ওদের নিয়েই থাকুন। পান চিবুতে চিবুতে বললেন তুরিনের মা।
ধ্রুবর মা বললেন..
– বাড়াবাড়ি আমরা না, আপনি আর আপনার মেয়ে করেছেন আর এখনো করেই যাচ্ছেন। আপনারা আমার ছেলের জীবন নিয়ে এভাবে খেলা করবেন আর আমরা বারবারই মেনে নিবো? এইসব ভেবে থাকলে ভুল করছেন। মেনে তো নিবোই না, দরকার হলে পুলিশ এনে আপনাদের তিনজনকেই ধরিয়ে দিবো। ভদ্রমহিলাটি জমে গেলেন ধ্রুবর মায়ের কথায়। কিছু বললেন না।
..
তুরিনের বাবা অপরাধী গলায় বললেন..
– আমাদের এখন কি করতে হবে?
– আপনাদের মেয়েকে আপনারা নিয়ে যান, আমি খুব তারাতাড়িই ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিবো। পাশ থেকে ধ্রুব বলে উঠলো। তুরিনের মা চমকে গেলো। সাথে তুরিন ও। তুরিন বললো..
– এইসব কি বলছো তুমি? তুমি আমাকে ডিভোর্স দিবে? তুমি না আমাকে ভালোবাসো? আর আমরা তো দুজন দুজনকে ভালোবেসে বিয়ে করেছি তাইনা??
ধ্রুব মুখে কিছু বললো। সামনে এগিয়ে তুরিনের দুটো গালে ঠাসঠাস করে দুটো বসিয়ে দিলো সবার সামনে। তুরিন কেদে কেদে বললো..
– তুমি আবারও আমাকে মারলে?
– হ্যাঁ মেরেছি। কারণ তুই আমার জীবনটাকে নরক করে দিয়েছিস। আর ভালোবাসা? সেটার মানে তুই বুঝিস? তোর ওই পাপ মুখে এইসব কথা ভুলেও উচ্চারণ করবিনা তুই।
ধ্রুবর মা বললো..
– বাবা শান্ত হো তুই, কুকুরের সাথে সাথে তোকেও যে কুকুর হতে হবে এমন কোনো কথা নেই।
..
সবাই যখন তুরিনকে নিয়ে চলে যাচ্ছিলো তখন ধ্রুবর মনের মধ্যে কেমন যেন অস্থিরতা কাজ করছিলো। কিছু একটা বলতে যাবে তখনই তুরিনের বাবা এসে বললো..
– বাবা, চলেই তো যাচ্ছি, একবার যদি তারা মাকে ডেকে দিতে, একটু চোখের দেখা দেখতাম। ডেকে দাওনা একটু মেয়েটাকে..
তারার বাবার কথায় অবাক হওয়ার চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে গেলো ধ্রুব সহ ওর বাবা মা। ধ্রুব কিছু বলার আগেই ধ্রুবর মা এগিয়ে এসে বললো..
– তারা আপনাদের বাসায় নেই?
– নাতো, কেন কি হয়েছে?? কোথায় তারা?
– আপনাদের বাসায় যায়নি মেয়েটা? কোথায় গিয়েছে ও? ধ্রুবর বাবা উৎকন্ঠা বললো।
তারার বাবা কিছু বলতে পারছেনা। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। ধ্রুব বললো..
– মামার বাসায় যায়নি তো?
– না না, ওখানে থাকলে ওর মামা আমাকে ফোন করে জানাতো নিশ্চয়ই। কিন্তু হয়েছে কি আমার মেয়েটার?
.
ধ্রুব আকস্মিক রেগে গিয়ে তুরিনের সামনে গিয়ে দাড়ালো। বললো..
– তারাকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছিস?
তুরিন ভয় পেয়ে বললো..
– কিক কি বলছো? আমি কেন ওকে লুকাতে যাবো?
তুরিনের বাবা বেশ রেগে গিয়ে বললো..
– আবার কি করেছে ও আমার তারার সাথে?
– ওর কথায় তারাকে আমি বাসা থেকে বের করে দিয়েছি। পাশ থেকে ধ্রুব বললো।
ধ্রুবর বাবা মা সহ তারার বাবাও অবাক হয়ে গেলো। তুরিন আর তুরিনের মা অবাক হলোনা শুধু। কারণ ওরা তো সবটা জানে।
– তুই বের করে দিয়েছিস তারাকে? অবাক হয়ে বললো ধ্রুবর মা।
– হ্যাঁ, আমিই বের করেছি। শুধুমাত্র তুরিনের কথায়। ও জেদ করছিলো, ওকে না তাড়ালে ও নিজেই চলে যাবে বাসা থেকে। তাই।
– তাই এমন একটা অকর্ম করতে পারলি তুই?
– ভুল করেছি মা, খুব ভুল করেছি। ভাঙ্গা কন্ঠে বললো ধ্রুব।
– বাচ্চা হবে মেয়েটার। না জানি কোথায় কিভাবে আছে। এ কি করলি তুই? কিভাবে পারলি এটা করতে?
– আমি ওকে খুজেঁ বের করবো মা। যেভাবেই হোক, যেখান থেকেই হোক. ওকে আমি খোজে বের করবোই মা। ওর সাথে আমার দেখা হবে। কোথাও না কোথাও দেখা হবেই।
..
দেখতে দেখতে দুটো মাস পেরিয়ে গেলো। এই দুইমাসে ধ্রুব অনেক খোজেছে তারাকে। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে বারবারই। তবুও হাল ছাড়েনি ও। এখনো খোজেই যাচ্ছে।
আশার সাথে বসে গল্প করছিলো তারা। কিছুদিন হলো আশা এসেছে। কলেজ বন্ধ তাই এখনো বাসাতেই রয়েছে। আশার হটাৎ ফোন আসাতে ও চলে গেলো বেলকোনিতে। কথা বলছিলো নাকি ঝগড়া করছিলো বুঝতে পারছিলোনা তারা।। কথা শেষ করে এসে আবারও তারার পাশে বসলো ও। তারা হেসে বললো
– বয়ফ্রেন্ড?
– নাহ, বয়ফ্রেন্ড নাহ.. প্যারা।
– প্যারা???
– তা নয়তো কি? শুধু প্যারা দেয় সারাক্ষণ। শান্তি নাই একটুও।
– এতোই যখন প্যারা তাহলে প্রেম করতে গিয়েছিলে কেন? হাসতে হাসতে বললো তারা।
– গিয়েছিলাম কি আর সাধে, সারাক্ষণ পিছু পড়ে থাকতো। আর তখন তো জানতাম না এটার আরেক নাম যে প্যারা।
তারা কিছু বললো না। আশা বললো..
– আচ্ছা তারাপু, তোমাদের কি লাভ ম্যারেজ হয়েছিলো?
– তুমি জানো না?
– নাহ, তোমার ব্যাপারে শুধু আংশিক জানি। সবটা জানিনা। বলোনা লাভ ম্যারেজ হয়েছিলো কিনা?
– নাহ। মুচকি হেসে বললো তারা।
– ও তাহলে তোমাদের এরেঞ্জ ম্যারেজ।
– তাও না।
আশা এবার বেশ অবাক হয়ে গেলো । বললো
– লাভ ম্যারেজ ও না, এরেঞ্জ ম্যারেজ ও না। তাহলে কি?
তারার মুখটা এবার কালো মেঘে ঢেকে গেলো। বললো..
– আমার বিয়েটা শুধুমাত্র একটা দুর্ঘটনা ছিলো। তাই তো টিকেনি। একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো তারা। আশা আস্তে করে বললো..
– ভেঙ্গে পরোনা আপু, সব ঠিক হয়ে যাবে।
তারা কিছু বললোনা।
..
সীমা কিচেনে রান্না করছিলো। তারা আস্তে করে সেখানে গিয়ে দাড়ালো ওর পাশে। সীমা বলল..
– তোমাকে কতো করে মানা করেছি তারা, এখানে আসবেনা। তাও কেন আসো। তুমি অসুস্থ জানোনা।
তারা হাসলো। বললো..
– কিচ্ছু হবেনা আমার, ভাবী।
– তুমি কিভাবে জানো কিছু হবেনা? আর তাছাড়া বার আর সিঁড়ি দিয়ে নামা উঠাটাও তোমার জন্য এখন বিপদের। কিছুদিন কিচেনে আসাটা স্কিপ করো তারা। রান্নাবান্না করার জন্য পুরো জীবনটাই পরে আছে তোমার। শাসনের সুরে বললো সীমা।
তারা বললো..
– এর পর থেকে এমন আর করবোনা ভাবী।
– Ok..
..
তারা উপরে যাচ্ছিলো। ধাপে ধাপে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছে। আর দুটো ধাপ পেরোলেই উপরে পৌঁছে যাবে, এমন সময় আচমকাই পিছন থেকে ডাকলো আকাশ। আকাশের ডাকে সাড়া দিতে পিছনে ঘুরতেই পা পিছলে পরে গেলো তারা। উপর থেকে ছিটকে পরলো তারা। আকাশ একটা চিৎকার দিয়ে দৌড়ে এলো তারার কাছে। ততোক্ষনে সবাই চলে এলো। আকাশ কাঁদতে কাদতে অস্থির হয়ে যাচ্ছে আর বলছে..
– আমার কারণে এমন হয়েছে। আমি কেন ডাকতে গেলাম ওকে। তারা, এই তারা উঠো প্লিজ।
রক্তে গড়াগড়ি খাচ্ছে ফ্লোর। সীমা চেচিয়ে বললো..
– আকাশ ওকে এখনই হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে। তারাতা‌ড়ি গাড়ি বের করো। আকাশ দৌড়ে চলে গেলো গাড়ি বের করতে। সীমা গিয়ে তৎক্ষণাৎ আহাদকে ফোন করলো। আশা আর মা তারাকে পাজাকোল করে রক্তের কাছ থেকে সরালো। সবার চোখে পানি।
আকাশ এসে দুহাত দিয়ে তারাকে কোলে নিয়ে গাড়ির দিকে ছুটলো। সবাই পিছু পিছু যাচ্ছে।
..
রাত ১০:০০
প্রায় দেড় ঘন্টা হয়েছে তারাকে OT তে নেওয়া হয়েছে। এখনো ডাক্তার বের হবার কোনো নাম নেই। OT এর সামনে সবাই ঘুরাঘুরি করছে। সবার চোখেমুখে চিন্তার ছাপ। আকাশের চোখ দুটো ছলছল করছে পানিতে। আশা এসে ভাইয়ের পাশে দাড়ালো। বললো..
– কাদিস না ছোটভাই। সব ঠিক হয়ে যাবে।
– আমার জন্য, শুধু আমার জন্যই ওর আজ এ অবস্থা। কেদে কেদে বললো আকাশ।
আশা কিছু বললোনা। কি বলবে বুঝতে পারছেনা।
কিছুক্ষন পর OT থেকে ডক্টর বের হলো। আকাশ সহ বাকিরা ডাক্তারকে ঘিরে ধরলো। আকাশ বললো..
– ওর এখন কি অবস্থা? ও ঠিক আছে তো?
– মেয়েটার অভিভাবক কে? (ডাক্তার)
আহাদ আর ওর মা এগিয়ে গিয়ে বললো..
– আমরাই ওর অভিভাবক। বলুন কি হয়েছে?
– দেখুন, কিভাবে যে বলি, উনি বেশ বড়সড় আঘাত পেয়েছেন । যদিও আঘাতে উনার কোনো ক্ষতি হয়নি। কিন্তু …
– কিন্তু কি? উৎকন্ঠা হয়ে বললো আকাশ।
– উনার গর্ভে যে সন্তান ছিলো সেটি নষ্ট হয়ে গেছে। তবে উনি এখন ভালো আছেন। কিছুক্ষনের মধ্যেই আশাকরি জ্ঞান ফিরবে উনার। ডাক্তার নিজের চেম্বারে চলে গেলো। তবে থমকে গেলো আকাশ। কি বলে গেলো ডাক্তার? ওর বাচ্চাটা নেই? ওকে এখন কি জবাব দিবো আমি?
.#জানি_দেখা_হবে ❤
Israt Jahan Tanni ✍
#Part_18

কেবিনে শিফট করা হয়েছে তারাকে। বিছানায় হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে তারা। মুখটা মলিন হয়ে আছে ওর। কি যেনো ভাবছে।
ধীরপায়ে ওর দিকে এগিয়ে আসছে আকাশ। পায়ের শব্দে সামনে তাকালো তারা। আকাশকে দেখে একটা জোরালো হাসি দিয়ে উঠ বসলো ও। আকাশ বললো..
– উঠো না প্লিজ। এমনিতেই তুমি অসুস্থ।
– ও কিছুনা। আমি ঠিক হয়ে গেছি। ভাঙ্গা কন্ঠে বললো তারা।
পাশ থেকে চেয়ারটা টেনে বসলো আকাশ। আকাশের মুখটাও ঘন মেঘে ঢাকা। কাঁপাকাঁপা কন্ঠে আকাশ বললো
– আজ আমার জন্য তোমার এই অবস্থা। আমার কারনেই তোমার এতোবড় ক্ষতি হয়ে গেলো।
তারা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো..
– কি যে বলেন, ক্ষতি করতে যাবেন কেন? বরং আপনি আমার উপকারই করেছেন।
– উপকার করেছি?? তোমার বাচ্চাটাকে মেরে ফেলেছি আমি আর তুমি কিনা বলছো উপকার করেছি? অবাক হয়ে বললো আকাশ।
তারা বললো
– আপনি মারতে যাবেন কেন? আমিই তো অসাবধান ছিলাম। আর তাছাড়া ও বেচেঁ থাকলে কিবা পরিচয়ে বড় হতো ও? বাবার কথা জিজ্ঞাসা করলে কি উত্তর দিতাম ওকে? মিথ্যা বলতাম? মিথ্যা বলাটা কি খুব ভালো হতো? তারচেয়ে এটাই ভালো হয়েছে।
আকাশ কিছু বললো না। তারার চোখের দিকে তাকালো আকাশ। চোখদুটো ছলছল করছে ওর। সে চোখের পানিগুলো মুছে দিতে খুব ইচ্ছা করছে আকাশের। কিন্তু পারছেনা। আকাশ খুব বুঝতে পারছে তারার মনে এখন কি চলছে।
.
সারাদিন অনেক খোঁজাখুঁজি করে এই মাত্র বাসায় ফিরেছে ধ্রুব। কোথায় খুজেঁ পায়নি তারাকে। খুজতে খুজতে বেশ ক্লান্ত হয়ে গিয়েছে ও। তাই ড্রেস চেঞ্জ না করেই সোফায় বসে পরলো হাত পা ছড়িয়ে। মা নিজের ঘরে ছিলো। ধ্রুবর আসার শব্দে বাইরে বেরিয়ে এলেন উনি। ধ্রুবকে এমন ছন্নছাড়া অবস্থায় দেখে বুকটা ফেটে যাচ্ছে উনার। তারার চিন্তায় ঠিকমতো খায়না ছেলেটা। মা ধ্রুবর কাছে গিয়ে ওর পাশে গিয়ে বসলো। মাকে দেখে বললো
– তুমি কেন উঠে আসতে গেলে মা?
মা এই কথার কোনো উত্তর না দিয়ে বললো..
– তারার কোনো খবর পেলি বাবা?
– নাহ! একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো ধ্রুব।
– হাত মুখ ধুয়ে আয়। ভাত খাবি।
– খিদে নেই মা। তুমি খেয়েছো?
– না খাইনি। আর খাবোওনা। বেশ রেগে গিয়ে ছেলেকে বললেন উনি।
– রাগছো কেন মা? আর কতো রাত হয়ে গেছে এখনও খাওনি কেন?
– জানিনা কেন খাইনি। আর তুই না খেলে এখন থেকে আমিও খাবোনা। আমার চোখের সামনে তুই এভাবে কষ্টে থাকবি আর আমি তা দেখেও বসে বসে খাবো, এটা হবেনা। এটা আমি পারবোনা। বলতে বলতে কেদে দিলেন মা।
.
ধ্রুব এক হাত দিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে বললো..
– এইরকম বলছো কেন মা? আর আমি কষ্টে আছি কোথায়? এটা কোনো কষ্টই না মা। এর চেয়ে বেশি কষ্ট আমি তারাকে দিয়েছি যে। ছলছল করছে ধ্রুবর চোখ।
মা ছেলের চোখদুটো আচলে মুছতে মুছতে বললেন..
– তুই যা করেছিলি ভুল করেছিলি। তাই বলে এভাবে কষ্ট করবি। তুই তো নিজের ভুল বুঝেছিস বাবা।
– আমি কোনো ভুল করিনি মা। আমি যেটা করেছি সেটা সবটাই অন্যায় করেছি। জঘন্য অন্যায়। আর ভলই যদি করে থাকি তাহলে সেই ভুল বুঝেই বা কি করলাম মা। ওকে তো পাচ্ছিনা। কতো করে খোজছি , কতো জায়গায় খুঁজছি, কিন্তু সব জায়গাতেই ব্যর্থ হচ্ছি আমি।
– বাবারে, কেউ হারিয়ে গেলে তাকে খোঁজে বের করা সহজ.. কিন্তু কেউ যদি নিজেই হারিয়ে থাকতে চায়,,, তাকে খোঁজে বের করা অনেক কঠিন।
.
ধ্রুব মায়ের দিকে তাকালো। মায়ের চোখেমুখে হাহাকার ভেসে আসছে। মুখটা মলিন হয়ে আছে মায়ের। না খেয়ে থাকার চিহ্ন ভেসে উঠেছে মায়ের মুখে। তাই মুখে হালকা হাসির রেখা টেনে মাকে বললো..
– এখন এইসব বাদ দাও মা। খুব খিদে পেয়েছে। চলো খাবো একসাথে।
– চল বাবা।
– বাবা কোথায় মা?
– তোর বাবার শরীরটা ভালো লাগছেনা। তাই ঘুমিয়ে গেছে অনেক আগেই
– কি হয়েছে বাবার?
– বয়স হচ্ছে, কত কিছুই তো হবে এখন।
..
তারাকে বাসায় আনা হয়েছে কিছুক্ষন আগে। খুব আলতো ভাবে ধরে ধীরে ধীরে তারাকে নিয়ে বাসায় ঢুকলো আকাশ। তারাকে আনতে মাও হসপিটালে যেতে চেয়েছিলো। কিন্তু আকাশ মানা করেছে। ওই আনতে পারবে। তাই মা আর যায়নি। তারাকে নিয়ে বাসায় ঢুকার সাথে সাথে আশা চিৎকার করে বললো..
– তারাপু, চলে এসেছো।
তারা মুচকি হেসে সামনে এগুলো। বললো..
– হ্যাঁ বোন।
– খুব ভালো হয়েছে। এই কয়টা দিন বাসায় বোর হচ্ছিলাম। তুমি ছিলেনা তাই।
– আশা, মেয়েটা মাত্র এলো। আর তুই গল্প করা শুরু করলি। আগে ওকে বসতে দে। উপর থেকে বললো আকাশের মা। আশা আর আকাশ মিলে ধরে আস্তে করে সোফায় বসালো তারাকে। তারা বসতে পেরে যেনো বাচলো। এতোক্ষন খুব কষ্ট হচ্ছিলো।
আকাশ আশাকে উদ্দেশ্য করে বললো..
– ওর জন্য এক কাপ কফি নিয়ে আয়।
– না না, আমি এখন কফি খাবোনা । বাধা দিয়ে বললো তারা।
– কি খাবে তাহলে? চা খাবে?
তারা হাসলো। বললো..
– এখন কিছুই খাবোনা আমি।
– আচ্ছা ঠিকআছে, যখন খেতে ইচ্ছা করবে ভাবীকে নয়তো আশাকে বলো।
– আচ্ছা।
..
রাতের খাবার খেয়ে সবাই ড্রয়িংরুমে বসে টিভি দেখছে। শুধু আকাশ ছটফট করছে। তারা রুমে কি করছে খুব জানতে ইচ্ছা করছে ওর। কিন্তু জানতে হলে তো ওর রুমে যেতে হবে। আর এখন সবার সামনে, স্পেশাল্লি মায়ের সামনে দিয়ে ওর রুমে যাওয়াটা ভালো দেখায় না। কি না কি ভাবে। যতোই সময় যাচ্ছে ওর ছটফট শুধু বাড়ছে। কি করবে বুঝতে পারছেনা ও। বারবার তারার রুমের দিকে চোখ যাচ্ছে ওর। ব্যাপারটা সীমা বুঝতে পেরে বললো..
– এমন করছো কেন আকাশ? কিছু হয়েছে?
সীমার কথায় কিছুটা চমকে গিয়ে আকাশ বললো..
– কই, নাতো। আমার আবার কি হবে?
সীমা কিছুটা আন্দাজ করতে পেরে বললো..
– আকাশ..
– হ্যাঁ ভাবী বলো।
– বলছিলাম কি, আমরা সবাই তো এখানে,, ওদিকে অসুস্থ হয়ে পরে আছে তারা। একটু দেখে আসো তো ও কি করছে? কিছু লাগবে কিনা? কথাটা বলেই আকাশকে একটা চোখ মারলো সীমা। আকাশ একটা হিমালয় জয় করা হাসি দিয়ে বললো..
– এক্ষুনি যাচ্ছি ভাবী।
.
– তোর কষ্ট করে যেতে হবেনা। আমিই যাচ্ছি তারাপুর আছে। টিভি দেখা রেখে বললো আশা।
মুহুর্তেই আকাশের হাসিমুখটা ঘন মেঘে ঢেকে গেলো। হতাশ চোখে সীমার দিকে তাকালো। সীমা কি যেনো ভেবে বললো..
– তোর যেতে হবেনা আশা। তুই গেলে তোর পছন্দের সিরিয়ালটা মিস করবি।
– হ্যাঁ ঠিকই তো বলছে ভাবী। তোর যাওয়ার দরকার নেই। তুই বরং সিরিয়াল দেখ।
– হোক মিস, মিস হলে পরে নেটে দেখে নিবো। আর তাছাড়া, তুই ছেলে মানুষ, আপুর কিছু লাগলে তোকে তো লজ্জায় কিছু বলবেই না।
– আশা তো ঠিকই বলছে আকাশ। ওই যাক, তোর যেয়ে কাজ নেই। টিভির দিকে তাকিয়েই মা বললেন।
আশা চলে গেলো তারার রুমে। আকাশ আশাহত চোখে সীমার দিকে তাকালো। সীমা ইঙ্গিতে বুঝালো ওর কিছু করার নেই।
.
সীমার দিক থেকে চোখ সরিয়ে আশার যাওয়ার দিকে তাকালো আকাশ। ইচ্ছে করছে এখনই গিয়ে আশার মাথাটা ফাটিয়ে দেক, নয়তো নিজের মাথায় নিজেই হাতুড়ি পিটা করুক।
তারার রুমে ঢুকে আশা দেখলো তারা চোখ বন্ধ করে বিছানায় হেলান দিয়ে শুয়ে আছে। চোখগুলো বন্ধ থাকলেও চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পরছে ওর। আশা বেশ বুঝতে পারলো ও কাঁদছে। এই মুহুর্তে আশা কি করবে বুঝতে পারছেনা। তাই আবারও নিচে ব্যাক করলো ও। আশাকে চলে আসতে দেখে আকাশ খানিকটা রাগী স্বরে বললো..
– চলে আসলি কেন? ওকে দেখা হয়ে গেছে?
– তারাপু কাঁদছে।
– কাঁদছে! অবাক হয়ে বললো আকাশ..
– ওমা সেকি, কাদছে কেন? (সীমা)
– কেন কাঁদছে সেটা আমি কি জানি।
– চলোতো আকাশ, দেখে আসি, ও কেন কাঁদছে?
– হ্যাঁ ভাবী চলো।
..
উপরে গিয়ে রুমে ঢুকার মুহুর্তেই আকাশের কানে ধরে টানলো সীমা। আকাশ ব্যথায় ওউ করতে লাগলে সীমা বললো..
– কতোদিন ধরে চলছে এইসব ?
– কোনসব? না জানার ভান করে বললো আকাশ।
– এইজে, তারাকে লাইন মারা।
– কি বলছো ভাবী? তারাকে লাইন মারবো? তাও আমি? এই নানা, আমি এইসব করতেই পারিনা।🐸
– তাহলে তখন এইভাবে কিচিরমিচির করছিলে কেন?
– কিচিরমিচির তো মানুষে করেনা, পাখি করে।
– ফাইজলামো রাখো। ঠিক করে বলো,
– কি বলবো?
– তারাকে ভালোবাসিস?
সীমার এমন কথায় আকাশ কিছুটা লজ্জা পেলেও বললো..
– ভালোলাগে ওকে।
– ভীষণ?
– হুম।
.
সীমা আগেই কিছুটা আন্দাজ করেছিলো আকাশের হাবভাব দেখে। তারাকেও তার ভীষণ ভালো লাগে। কিন্তু সমস্যাটা অন্য জায়গায়।
আকাশ খেয়াল করলো সীমা কি যেনো ভাবছে। তাই বললো..
– কি এতো ভাবছো ভাবী?
আকাশের ডাকে ঘোর ভাংলো সীমার। বললো..
– তারা খুব ভালো একটা মেয়ে। ওকে আমারও খুব ভালো লাগে। কিন্তু ও যে বিবাহিত।
– সে বিয়ের কোনো ভিত্তি নেই ভাবী। আর ওর সেই তথাকথিত হাজবেন্ড তো আরেকটা বিয়ে করে সুখেই আছে। তা নাহলে তো ওকে আর এভাবে বের করে দিতোনা তাইনা?
– সে যাইহোক, এটা সহজ বিষয় না। যেভাবেই হোক, বিয়েটা তো হয়েছে। আর তাছাড়া ওর উপর দিয়ে যা ঝড় বয়ে যাচ্ছে, এইসবের পরে কি ও আবারও তোকে বিয়ে করতে রাজি হবে?
– বিয়েটা অনেক পরের কথা ভাবী। আগে ওকে রাজী করানোটাই ফ্যাক্ট।
যাইহোক, আগে ভিতরে চলো। দেখি ও কি করছে।
– হুম চলো।
.
To be Continued …..
To be Continued …..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here