জানি দেখা হবে পর্ব শেষ

#জানি_দেখা_হবে❤️
Israt Jahan Tanni ✍️
[অন্তিম পর্ব]

বিয়ের কাজ শেষ হয়েছে অনেক্ষন আগে। এইবার বউকে নিয়ে নিজ গন্তব্যে ফেরার পালা। তারার বাবার চোখদুটো ফুলে লাল হয়ে আছে, মেয়ের বিদায় বেলা নিজেকে আর সামলাতে পারেন নি উনি। বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে হাউমাউ করে কেদে ফেললো তারা। এই বাবাকে ছেড়ে যেতে একদমই ইচ্ছে করছেনা তারার। তারা ছাড়া আর কেউ যে নেই মানুষটার। এই বুড়ো বয়সে একা কিভাবে কি করবেন, ভাবতেই বুক ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে তারার। বাবাকে আকড়ে ধরে কান্নাকাটি করছে তারা, কিছুতেই মানানো যাচ্ছেনা ওকে। অনেক কষ্টে তারাকে সামলিয়ে গাড়িতে নিয়ে বসালো সীমা আর আশা। ওর পাশেই ধ্রুবকে বসানো হলো। ব্যস, এই গাড়িতে আর কাউকে উঠতে দেওয়া হলোনা।
আরেক গাড়িতে গিয়ে উঠলো ধ্রুবর বন্ধুরা আর কিছু মুরুব্বিসমেত ধ্রুবর বাবা।
আকাশ, সীমা আর আশা উঠেছে অন্য গাড়িতে।

গাড়ি চলছে নিজ গতিতে। আশা বসেছে ড্রাইভারের পাশের সিটে। আকাশ বসতে চেয়েছিলো সেখানে। কিন্তু আশার অনুরোধের কাছে হার মেনে পিছনের সিটে সীমার পাশে বসেছে ও।
কিন্তু বিপত্তি আরেক জায়গায়। কিছুক্ষণ পর পর আকাশের ঘাড়ে, পিঠে ইনফ্যাক্ট পায়েও কিছুটা শিরশির করে উঠছে, আকাশ বুঝতে পারছেনা এর কারণ। যখনই শিরশির অনুভূতি হচ্ছে ঠিক তখনই পিছনে ফিরে তাকাচ্ছে আকাশ, কিন্তু ফলাফল শূন্য, কাউকেই দেখছেনা সে। সীমা কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বললো
–উফফ আকাশ, কি হয়েছে? এভাবে ছটফট করছো কেন? শান্তিতে একটু বসতে পারছো না নাকি? এমনিতেই অনেকটা টায়ার্ড হয়ে আছি।
আকাশ অবাক হয়ে বললো
-যাক বাবা, আমি আবার কি করলাম।

আরো কিছুক্ষণ সময় পার হলো। এইবার শিরশিরানিটা বাড়তে লাগলো ক্রমাগত। নাহ, আর পারা যাচ্ছেনা। আকাশ খেয়াল করলো সীমা সিটে হেলান দিয়ে ঘুমের রাজ্যে চলে গেছে। আকাশ কিছুটা সচেতন হয়ে বসলো এইবার। শিরশির করার আসল কারণটা এবার উদঘাটন করেই ছাড়বে সে। কে আছে এই পিছনে সেটা এখনই সামনে নিয়ে আসবে আকাশ, কি হবে না হবে সেটা পরে দেখা যাবে।

কয়েক মুহুর্ত পার হলো। নাহ, এখন আর শিরশিরানিটা হচ্ছেনা। আকাশ সিটে হেলান দিয়ে বসলো। চোখদুটো বন্ধ করে কিছু একটা অনুভব করার চেষ্টা করছে সে। ঠিক সেই মুহূর্তে একটা হাতের স্পর্শ পেলো ঘারে, হাতটা আলতোভাবে ওর ঘারের উপর থেকে মাথার চুল বেয়ে উপরে উঠছে, আবার সেখান থেকে আলতো পরশে গাল বরাবর এগিয়ে আসছে। আকাশ আর দেরি করলোনা৷ খপ করে ধরে ফেললো হাতটা। খানিকটা শক্ত করে ধরায় কিছুটা ককিয়ে উঠলো হাতের মালিক।

আকাশের ঠোঁটের কোনে কিছুটা হাসির আভাস ফুটে উঠলো। কিন্তু মুহুর্তেই সে হাসিটাকে দমিয়ে নিয়ে হাতের ব্যাক্তিটাকে সামনে আনার জন্য জোরে টান দিলো সে।
টানের জোর এতোটাই ছিলো, যে নিজেকে সামলাতে না পেরে আকাশের উপরে গিয়ে ধপ করে পরলো নীলিমা৷

আকাশ আর নীলিমা কিছুক্ষণের জন্য থমকে গেলো। নড়তে চড়তে ভুলে গেলো দুজনেই। কারো মুখে কোনো কথা নেই। একজনের চোখ আরেকজনের চোখের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। নীলিমা একটা ঘোরের মধ্যে আছে। এই মুহূর্তে সে কি অবস্থায় আছে এটাও হয়তো ভুলে গেছে।
আকাশ আচমকা নীলিমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। টাল সামলাতে না পেরে পাশের সিটে গিয়ে ধপ করে পরলো নীলিমা। খানিকটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেছে সে।
প্রচন্ড তেজ দেখিয়ে খানিক চেচিয়ে বললো.
-কি হলো এটা?
-কি হয়েছে? শান্তভাবে বললো আকাশ।
-এভাবে ধাক্কা দিলেন কেন?
-যে যেমন করবে, সে তো তেমনটায় পাবে।
নীলিমা রাগে ফুসছে। আকাশ সেদিকে তোয়াক্কা না করে অন্যদিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বললো
–এখানে এসেছো কেন?
-ইচ্ছে হয়েছে তাই এসেছি। দরকার হলে আরো আসবো। আপনার কি?

আকাশ কোনো উত্তর দিলোনা। চুপচাপ বসে আছে। কিছুক্ষণ পর নীলিমা কাদো কাদো গলায় বললো
-বউ এর সাথে যে কাউকে আসতে হয় সে খেয়াল কি কারো আছে? একটা পরিচিত মেয়েমানুষ সাথে না থাকলে নতুন বউ এর যে কি পরিমান অসুবিধা হয় সেটা আপনি কিভাবে বুঝবেন।
আর আপনিই বা কেন, কেউই বুঝলোনা। তাইতো আমি নিজ দায়িত্বে ওর পাশে থাকার জন্য কারো অনুমতি ছাড়াই গাড়িতে উঠেছি।

আকাশ দাতে দাত পিষে বললো
-ওখানে সবাই তারার পরিচিত। কারো অনুমতি না থাকা স্বত্বেও এই বেহায়াপনাটা না করলেও পারতে।
কথাটা খুব গায়ে লাগলো নীলিমার। কিছুক্ষণ কড়া দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে থাকলো আকাশের দিকে।
নীলিমাকে এমন বাকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে আকাশ ভ্রু কুচকে বললো
-কি ব্যাপার? এভাবে তাকিয়ে আছো যে,
নীলিমা কিছু বললোনা, দাতে দাত চেপে হাতের পাচ আংগুল মুঠো করলো সে, চোখমুখ খিচে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে আকাশের পিঠে দিলো ঠাটিয়ে এক ঘুষি। আকস্মিক আক্রমনে হতবিহ্বল হয়ে গেলো আকাশ। প্রচন্ড বিস্ময়ে বিস্ফোরিত হয়ে শক্ত গলায় নীলিমাকে বললো…
-কি করলে এটা?
-অধিকার খাটাইছি। কথাটা বলে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বসলো নীলিমা। আকাশের মুখ থেকে আর কিছু বের করার মতো ভাষা হয়তো ছিলোনা। অথবা এইরকম একটা পরিস্থিতিতে কি বলবে সেটাও হয়তো বোধগম্য ছিলোনা, তাই সেও আর কথা বাড়ালোনা।

বাড়িটাকে জাকজমকভাবে সাজানো হয়েছে, এরুপ সাজের বহর দেখে তারার চোখদুটো চকমকে হয়ে গেছে। সে ভাবতেও পারেনি, ওর বিয়েটাকে এতোটা প্রায়োরিটি দেয়া হবে৷ তারাকে এভাবে বাইরে তাকিয়ে থাকতে দেখে ওর হাতদুটো মুঠোয় পুরে নিলো ধ্রুব। তারা চমকে তাকালো ধ্রুবর দিকে। ধ্রুব খেয়াল করলো তারার চোখদুটো ভিজে আছে। সে তারার চোখদুটো খুবই যত্নসহকারে মুছে দিলো। তারার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বললো
-বলেছি না, কাদবেনা কখনো, কাদছো কেন?
-কাদছিনা তো।
-এমন দিনে কাদতে মানা জানো না? আমি তোমার চোখেমুখে কখনো কান্নার চিহ্নটা পর্যন্ত দেখতে চাইনা।

তারা ফিরে তাকালো ধ্রুবর দিকে। মুখে সামান্য হাসি টেনে বললো
-আর কাদবোনা।
ধ্রুব তারার কপালে আলতো করে চুমু খেয়ে বললো
-লক্ষী বউ আমার।

বউকে বরন করে ঘরে আনা হয়েছে কিছুক্ষন আগে। আগেরবার বিয়েটা এমন পরিস্থিতিতে হয়েছিলো, কিভাবে বরন হয়েছিলো না হয়েছিলো কিছুই মাথাতে ছিলোনা। কিন্তু আজ বউ বরনে এতো এতো ফর্মালিটি করা হয়েছে, এগুলো করতে করতেই ক্লান্ত হয়ে গেছে তারা।
ধ্রুবর রুমে নেওয়া হয়নি তারাকে। আলাদা রুমে রেখেছে।
সীমা আর আশা মিলে নীলিমার সাথে গল্প করছে। ভাইয়ের বউ হিসেবে নীলিমাকে খুবই পছন্দ হয়েছে আশার। পাশেই বসে আছে নতুন বউ তারা। আকাশের মা এসে তারার বধুবেশে থাকা মুখটা দেখে প্রশান্তির হাসি দিলেন।

বাড়িতে অনেক গেস্ট আসলেও ওদেরকে এক সাইডে রেখে সীমা, আশা আর নীলিমা চলে গেছে ধ্রুবর রুমে। রুমে ঢুকেই ভিতর থেকে দরজাটা বন্ধ করে দিলো ওরা। আকাশের নজরে আসলো সেটা। সামান্য তেজ নিয়ে মিনমিন করে বললো
“যার যার চিন্তা, ওরা আছে নিজেদের থাকার জায়গা দখল নিয়ে”।

আকাশের মাকে নিয়ে ধ্রুবর মা গল্পগুজবে মশগুল। বিয়ে বাড়ি হওয়া স্বত্বেও ধ্রুবর মাকে কোনো কাজে হাত দিতে হচ্ছেনা। বাকিরাই সামলে নিচ্ছে সবকিছু। এমনিতেও বেশিরভাগ গেস্টরাই চলে গেছে বউ নিয়ে আসার পরপরই। কিছু কিছু গেস্ট, যারা দূর থেকে এসেছে তারাই রয়ে গেছে। যারা চলে গেছেন তারা বউভাতের দিন আবার আসবেন সেই কথায় হয়েছে।

তারাকে একা রেখে বেপাত্তা সকলেই। কেউই নেই কাছে। সীমা ভাবী, আশা ইনফ্যাক্ট নীল পর্যন্ত নেই ওর কাছে। ভাবতেই কান্না পাচ্ছে তারার। খুব একা লাগছে এই মুহূর্তে।
খাটের এক পাশে গুটিশুটি মেরে বসে আছে তারা। তখনই দরজা খোলার শব্দ পায় সে। ধীরে ধীরে সামনে তাকায় তারা। ধ্রুবর মা হাতে একটা ট্রে নিয়ে ভিতরে ঢুকছে। আকাশের মাও এসেছে সাথে। ওদেরকে দেখে নড়েচড়ে বসলো তারা। ধ্রুবর মা ট্রে থেকে খাবারগুলো নামিয়ে তারার সামনে রাখলো। একটা বাটিতে নুডলস এর স্যুপ নিয়ে এসেছেন উনি। চামচে স্যুপ নিয়ে তারার মুখের সামনে ধরে বললেন
-নে মা, খেয়ে নে।
তারা শান্তগলায় বললো
-খিদে নেই মা।
-খাবি এক থাপ্পড়। মায়ের মুখে মুখে কথা।

আকাশের মা তারার মাথায় হাত বুলালো। পরম স্নেহে বললো…
-খেয়ে নে মা। সারাদিন এতো ঝামেলার মধ্যে কি খেয়েছিস না খেয়েছিস। কতো ধকল গেছে আজ তোর উপর দিয়ে।
তারা উনাদের স্নেহময় অনুরোধ ফেরাতে পারলোনা আর।

রাত প্রায় ১১ টা। খাটের চারপাশের উপরের দিকে গোলাপ, ডালিয়া, হাসনাহেনা আর গাদা ফুল দিয়ে সুন্দর করে সাজানো হয়েছে, বিছানাতে গোলাপ ফুলের পাপড়ি দিয়ে লাভ শেইপ দেওয়া হয়েছে, আর লাভ শেইপের মাঝখানে বসে আছে তারা। মুখটা লজ্জাপতির মতো নেতিয়ে গেছে এখনই।
নীলিমা আর আশা দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে। ওদের দাবি পুরো পাচ হাজার টাকা, এই টাকাটা না পাওয়া পর্যন্ত এখান থেকে সরবেনা কেউ।
সীমা ধ্রুবকে নিয়ে এলো নিজের সাথে করে, উদ্দেশ্যে তারার কাছে নিয়ে যাওয়া। কিন্তু বাধা দিচ্ছে নীলিমা আর আশা। সীমা ওদের এমন কথায় বললো..
-প্লিজ বোনেরা আমার, এমনিতেই বেচারা এতোদিন খুব কষ্টে থেকেছে নিজের বউকে ছেড়ে। এখন এই মুহূর্তে আর ঝামেলা করোনা প্লিজ।
-এটা বললেতো হচ্ছেনা। আমাদের দাবী আগে পূরণ হোক, আমরা নিঃশব্দে চলে যাবো। নীলিমা স্পষ্ট করে বললো।
পাশ থেকে আশাও নীলিমার কথার সাথে তাল মিলিয়ে বললো…
-আমিও একমত নীল ভাবীর সাথে।
আশার কথায় ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো নীলিমা, সেই সাথে সীমাও খুব অবাক হলো। সে বললো..
-নীল ভাবী মানে?
-জেনেও না জানার ভান করোনা তো ভাবী।
সীমা হেসে ফেললো, নীলিমা কিছুটা লজ্জা পেলেও সেটা মুখে প্রকাশ করলোনা।

ধ্রুব আজ খুব সিরিয়াস, সে বললো
-তো তোমাদের দাবী পাচ হাজার টাকা?
-হুম। চুলের বিনুনি হাতের আংগুলে পেচাতে পেচাতে বললো নীলিমা।
-ওকে ফাইন। হাত পাতো..
নীলিমা আর আশা খুশিতে নাচতে নাচতে ধ্রুবর দিকে হাত পেতে দাড়ালো।
ধ্রুব ওর পকেট থেকে ওয়ালেটটা বের করলো। হাতে কিছু টাকা নিয়ে আগে নীলিমার হাতে পুরে ওর হাতটা বন্ধ করে দিলো, আর এর পর আশার হাতেও সেইম কাজটা করলো। নীলিমা হাতটা খোলে দেখতে যাবে কত দিয়েছে তার আগেই বাধ সাধলো ধ্রুব। সে বললো
-আমার সামনে হাত খোলা নিষেধ।
-মানে কি ভাইয়া? আপনি আমাদের ঠকিয়েছেন নাকি সেটা দেখতে হবেনা?
-ঠকায় নি এই বিশ্বাসটা রাখতে পারো।
-করিনা বিশ্বাস।
-না করলে আমার কিছু করার নেই। বলেই নীলিমাকে আকস্মিকভাবে টান দিয়ে দরজার সামনে থেকে সরিয়ে দিলো, এরপর হাসতে হাসতে ঢুকে গেলো রুমের ভিতরে। নীলিমা রাগে হুংকার করে বললো
-কাজটা ভালো হলো না কিন্তু।
ধ্রুব দরজা বন্ধ করতে করতে বললো..
-একদম সঠিক সময়ে সঠিক কাজ করেছি আমি।

ধ্রুব দরজা বন্ধ করা মাত্রই হাতের মুঠো খোললো আশা আর নীলিমা। টাকাগুলো দেখে দুজনেই একসাথে লাফিয়ে উঠে বললো..
“হুররে, পাচ হাজার টাকা”
সীমা ওদের আনন্দ দেখে বললো
-আড়াই হাজার করে?
-নাগো ভাবী, পাচ হাজার করে, দুজনকে দশ হাজার দিয়েছে।
সীমা প্রশান্তির হাসি হাসলো ওদের আনন্দ দেখে।

তারার খুব কাছে গিয়ে বসলো ধ্রুব। তারাকে গুটিশুটি অবস্থায় দেখে মুচকি হাসলো সে। তারার গালে হাতের ছোয়া লাগিয়ে শান্ত গলায় বললো
-বউ’
তারা শিহরিত হয়ে গেলো মুহুর্তেই। এই মাতাল করা কন্ঠটা মুহুর্তেই তারাকে মাদকাসক্ত করে দিলো। সে পরম আবেশে তাকালো ধ্রুবর দিকে। ধ্রুব দুইহাত দিয়ে ওর দুই গালে আলতোভাবে ধরলো। এই মুহূর্তে তারার মনের মধ্যে ঝড় বইছে। তারা নিজেকে কন্ট্রোল করলো। খাট থেকে নেমে দাড়ালো সে। ওকে এভাবে নামতে দেখে কিছুটা অবাক হলো ধ্রুব। সেও নেমে পরলো নিচে। বললো
-কি হয়েছে? কোনো সমস্যা? নেমে পরলে যে,
তারা কোনো উত্তর না দিয়ে হুট করে নিচে বসে ধ্রুবর পায়ে সালাম করলো। ধ্রুব তারাতাড়ি করে তারাকে দুহাত দিয়ে ধরে দাড় করালো। বললো..
-এটার কোনো প্রয়োজন নেই তারা।
-আমার কাছ থেকে সম্মান পাওয়াটা আপনার অধিকার। শান্ত গলায় বললো তারা।
-যেখানে ভালোবাসা থাকে, সম্মানটা সেখানে আপনা আপনিই চলে আসে। তুমি কি আমাকে ভালোবাসো না?
-খুব ভালোবাসি।
-তাহলে আলাদা করে সম্মান দেখানোর কোনো প্রয়োজন নেই বউ। আমার সম্মান তোমার ভালোবাসায়। দেবে কি সেই ভালোবাসা?
তারা তাকালো ধ্রুবর দিকে। ধ্রুব সেই চোখের ভাষা থেকে পেয়ে গেলো ওর করা প্রশ্নের উত্তর।
ধ্রুব জড়িয়ে ধরলো তারাকে, তারাও পরম আবেশে সেটা গ্রহণ করলো। আচমকায় তারাকে কোলে তুলে নিলো সে, কপালে মিষ্টি করে একটা চুমো দিয়ে তারার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বললো
-আজ তোমায় কে বাচাবে বউ।

হাতে এক কাপ কফি নিয়ে ছাদে উঠে আসলো নীলিমা। ঘুম আসছেনা চোখে। কেবলই মনে হচ্ছে, অধিকার না থাকা স্বত্বেও ও একটু বেশিই অধিকার খাটাচ্ছে আকাশের উপর। কিন্তু ভালোবাসায় তো জোর খাটানো চলেনা, তাহলে কি সে যা করছে অন্যায়? এটা ভেবেই মাথায় ব্যাথা করা শুরু হয়ে গেছে।

ছাদের এক কোনায় দাড়িয়ে কফিতে চুমুক দিচ্ছে সে। এতোটা রাতেও রাস্তায় অনেক কোলাহল, গাড়ির যান্ত্রিক আওয়াজ কানে এসে ঠেকছে ওর। সেই মুহূর্তেই কারো পায়ের আওয়াজ পেলো নীলিমা। কে এসেছে সেটা দেখার জন্য পিছনে ফিরে তাকালো, আকাশ এসেছে। মোটেও অবাক হলোনা নীলিমা। কারণ, তারার কাছে শুনেছে, অনেক রাত পর্যন্ত ছাদে থাকাটা আকাশের অভ্যাস।

নীলিমাকে ছাদে দেখে খানিকটা অবাক হলো আকাশ। সে স্বাভাবিকভাবে বললো
-এতো রাতে তুমি ছাদে কি করছো?
-ঘুম আসছেনা। তাই কফি হাতে নিয়েই এখানে চলে এসেছি।
আকাশ খেয়াল করলো, নীলিমা খুবই শান্তভাবে কথা বলছে। যেটা খুব অস্বাভাবিক লাগলো আকাশের কাছে।
-কিছু হয়েছে তোমার?
-নাতো। নরম গলায় বললো নীলিমা।

কিছুক্ষণ নিরব দুইজনই। এরপর নীলিমাই বলা শুরু করলো
-আসলে, আমি কিভাবে বলবো বুঝতে পারছিনা।
-কিছু বলতে চাও তুমি?
-হ্যাঁ। অন্যদিকে তাকিয়ে বললো নীলিমা।
-নির্দ্বিধায় বলতে পারো।
-আসলে এই দুইদিন আপনাকে অনেক জ্বালিয়েছি আমি। আমি নিজেও মানি, ভালোবাসায় জোরাজুরি চলেনা, তবুও আমি সেই ভুলটাই করেছি। আমি ফোর্স করেছি আপনাকে, যেটা অন্যায়।
আকাশ একভাবে শুনে যাচ্ছে নীলিমার বলা কথাগুলো। ওর মধ্যে কোনো এক্সপ্রেশন কাজ করছে কিনা সেটা বুঝার উপায় নেই।

নীলিমা আবারও বললো
-আপনাকে প্রথম দিন দেখেই আমার ভালো লেগে গিয়েছিলো, ভালোবেসে ফেলেছিলাম হয়তো। একতরফা ভাবে। আর আমি এখন মেনে নিচ্ছি, আমি অন্যায় করেছি।
-তো এখন কি করতে চাও? শান্ত গলায় বললো আকাশ।

নীলিমার চোখদুটো ভিজে গেছে। গলা দিয়ে কথা আসছেনা। তবুও নিজেকে সামনে বহু কষ্টে বললো..
-আমাকে ক্ষমা করে দিবেন। আপনাকে অনেক জ্বালিয়েছি তাই, আপনার উপর রামদা পর্যন্ত তুলেছি আমি।
এতোটুকু বলে নীলিমা থামলো। এরপর শক্ত গলায় বললো
-আগামীকাল চলে যাবো আমি। আর বিরক্ত করবোনা আপনাকে। আপনি ভালো থাকবেন।
আকাশ নীলিমার কথায় মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বোধক সম্বোধন জানালো। যেটা নীলিমাকে ভিতরে ভিতরে প্রচন্ডভাবে পুড়িয়ে দিলো।

নীলিমা আর কিছু বলতে পারলনা। এই মুহূর্তে এখানে থাকাটা খুবই কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে ওর কাছে। আর এক মুহূর্তও দেরি করলোনা সে। রুমে ফিরে আসার জন্য উল্টোদিকে ঘুরে দাড়ালো, যেইনা একপা একপা করে সামনে এগুবার জন্য পা বাড়াবে, ঠিক সেই মুহূর্তে ওর এক হাতে ধরে ফেলে আকাশ।
মুহুর্তেই থমকে যায় নীলিমা। প্রচন্ড বিস্ময়ে পিছনে ফিরে তাকায় সে। আকাশ একভাবে তাকিয়ে আছে ওর চোখের দিকে, নীলিমাও সেইদিক থেকে চোখ ফেরাতে পারেনি। কয়েক মুহুর্ত চোখে চোখে কথা বলে দুইজন। এক পর্যায়ে আকাশ নীলিমাকে নিজের দিকে হালকাভাবে টান দেয়। ফলশ্রুতিতে নীলিমা গিয়ে ঠেকে আকাশের বুকে।

নীলিমা অবাক দৃষ্টিতে তাকায় আকাশের দিকে। কি করতে চাইছে আকাশ সেটা বুঝতে পারছেনা সে।
এক পর্যায়ে আকাশ বলে,
-আমার ছোট্ট হৃদয়টাতে ভালোবাসার ফুল ফুটিয়ে কোথায় চলে যেতে চাও এখন?
-মানে? ঘোরের মধ্যে থেকে বলে নীলিমা।
-আমার সাদা কালো আকাশটা রঙিন করে দিয়ে কেন চলে যেতে চাইছো আবার? যেই নীলিমায় রাঙ্গিয়েছো আমার আকাশ, সেই আকাশ থেকে তোমাকে যেতে দিচ্ছিনা আমি। আমি তোমাকে আমার আকাশের নীল করে নিয়েছি। হবেনা আমার নীল আকাশ?

নীলিমা এই মুহূর্তে কথা বলার ভাষা যেনো হারিয়ে ফেলেছে। এ কি শুনছে সে? এটা কি সত্যি? নাকি ওর মনের ভুল?
যদি ভুল হয়, তাহলে সেই ভুলটাকেই আকড়ে ধরবে সে।
আকাশ একই মায়াভরা নয়নে তাকিয়ে আছে নীলিমার দিকে। নীলিমা এখনো ওর বাহুডোরে বন্দী।
আকাশ আবারও প্রশ্ন করলো…
–হবে কি আমার আকাশের নীল? আমি সেই নীলে রাঙ্গিয়ে নিতে চাই আমার আকাশটা।
-আমায় ভালোবাসেন? কাপা কাপা গলায় বললো নীলিমা।
-তখন থেকে ভালোবাসি, যখন ধ্রুব আমাকে বুঝিয়েছিলো ভালোবাসা কি। শুধু বুঝতে দেইনি।

নীলিমার হটাৎ কি হলো, সে দুইহাতে আকাশের বুকে কিল ঘুষি দিতে লাগলো একনাগাড়ে। আকাশ হাসতে হাসতে বললো
-আহ লাগছে তো।
-লাগুক, লাগার জন্যই তো দিচ্ছি। ভালোবসেও কেন আমাকে কষ্ট দিয়েছেন? কেন বলেন নি? কাদতে কাদতে বললো নীলিমা।

আকাশ আলতোভাবে জড়িয়ে ধরলো নীলিমাকে। পরম আবেশে বললো..
-একবার তুমি করে বলো প্লিজ।
নীলিমা তাকালো আকাশের দিকে। ঠোটের কোনায় হাসির আভা, চোখের কোনে বিন্দু পরিমান পানি।
ঠোটের হাসিটাকে আরেকটু গভীর করে আকাশকে আরো শক্ত করে ধরলো। কন্ঠে ভালোবাসার রেশ টেনে বললো
-ভালোবাসি, ভালোবাসি তোমায়।
আকাশ নীলিমার কপালে চুমো খেলো। বিনিময়ে আরো গভীরভাবে ওকে জড়িয়ে ধরলো নীলিমা।

আকাশ ওইভাবেই নীলিমাকে জড়িয়ে ধরে তাকালো রাতের আকাশের দিকে। আজ আকাশে প্রচুর তারার মেলা, সেখানে এক ফালি চাঁদ উকি মেরে আছে।
আকাশ এক হাতে নীলিমাকে জড়িয়ে ধরে আরেক হাত ওর মাথার চুলে বিলি কাটছে। আর একমনে সে বলে চলেছে..

“কষ্ট ছিলো আমার সাথী, দুঃখ ছিলো পাশাপাশি,
হার মানিনি আমি, করেছি বিশ্বাস
সাদা কালো আকাশে, বুনেছিলাম স্বপ্ন, গেথেছিলাম আশা..
জানতাম দেখা হবে,
পাবো, আমার ভালোবাসা।

আজ পেয়েছি সব, রাঙ্গিয়েছি মন..
নিয়েছি প্রশান্তির শ্বাস..
মনের নীলিমায় রাঙ্গিয়েছি আজ
আমার নীল আকাশ”

_________সমাপ্ত❤️——

[ভুলত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here