আমার আকাশ জুড়ে তুমি পর্ব ২

#আমার_আকাশ_জুড়ে_তুমি(২)
#জেরিন_আক্তার_নিপা

আশরাফ চৌধুরী মাথায় আইস ব্যাগ ধরে রেখেছেন। তিনি পুরো হলরুমে পায়চারি করছেন। একটু পরপর ফোনে কারো সাথে কথা বলছেন। উচ্চ কন্ঠে চেঁচিয়ে উঠছেন। উনার চিৎকার চেচাঁমেচিতে বাড়ির কাজের লোক সবাই ভয়ে কাঁপাকাঁপি করছে।
“-সব কয়টাকে গুলি করে মারব। বাড়িতে এতো গুলো মানুষ থাকতে আতিয়া বাড়ি থেকে বের হয় কীভাবে? সবাই কি চোখে টেপ লাগিয়ে রেখেছিল? আতিয়া আবারো সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেল! কেউ তাকে দেখলো না? কেউ আমাকে একটা খবরও দিতে পারলো না? একটাকেও আর কাজে রাখব না। সব গুলোকে বিদায় করবো। আমার এখানে থেকে খেয়ে খেয়ে শুধু নিজের ভুড়ি বড় করা। কাজের কাজ কিছু না। সবাইকে দেখে নিব আমি।’
আশরাফ চৌধুরী বাড়ির কাজের লোকদের বকাঝকা করে আবার যেন কাকে ফোন দিলেন। হামিদ এবাড়ির সবচে পুরোনো কাজের লোক। তিনি পঁচিশ বছর ধরে এবাড়িতে আছেন। তিনিই ছোট থেকে আতিয়াকে কোলে পিঠে করে বড় করেছেন।
হামিদ বিরবির করে বললেন,
“-কাল সন্ধ্যায় যখন মা’রে বকাবকি করলেন, আমি তখনই বুঝে গেছিলাম মা আবার বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। আপনে মেয়েটার উপর আপনার সিদ্ধান্ত চাপাইয়া দিবেন। এইডা তো কোনো ভাবেই হবে না। মা এইবার একদম ঠিক কাজ করছে। আপনে শুধু শুধু চিৎকার চেচাঁমেচি করে গলা ফাটাইতাছেন। মা যেখানে আছে ভালোই আছে।’
হামিদ কথা শেষ করার আগেই আশরাফ চৌধুরী চেঁচিয়ে উঠলেন,
“-হামিদ! এই হামিদ!’
হামিদ এগিয়ে গিয়ে বললেন,
“-জি ভাইজান।’
“-রাখো তোমার ভাইজান। আগে বলো আতিয়া কোথায়? তোমার আদরের মা জননী এবার কোথায় গিয়ে গা ঢাকা দিয়েছে।?’
“-ভাইজান আমি ক্যামনে জানমু মা জননী কোথায় আছে?’
“-দেখো হামিদ আমার সাথে একদম মিথ্যে বলবে না। আমি খুব ভাল করে জানি, তুমি জানো আতিয়া কোথায় আছে। আমার তো মনে হচ্ছে এবার আতিয়ার বাড়ি ছেড়ে পালানোর পেছনে তোমার হাত আছে। তুমি ওকে সাহায্য করেছ।’
হামিদ কাঁদো কাঁদো চেহারা বানিয়ে বললেন,
“-ভাইজান! এতো বছরে আপনে আমারে এইটুকু চিনলেন? আমার উপর আপনার এই বিশ্বাস?’
“-আতিয়া তোমাকেও দেখছি ওর মত বানিয়ে ফেলেছে। তুমি বলো আর না বলো। আমি ওকে খুঁজে বের করবোই। আর আমি যা বলেছি ওকে তাই করতে হবে। ও এবার আমার কথার অবাধ্য হতে পারবে না। তুমি ওকে বলে দিও, দুই তিন দিনের ভেতরে ও আবার বাসায় থাকবে।’
আশরাফ চৌধুরীর ফোন বেজে উঠলে তিনি ফোন রিসিভ করে বাইরে চলে গেলেন। হামিদ নিঃশ্বাস নিয়ে বললেন,
“-মা কোথায় আছো তুমি? আমার সাথে একটা বার কথা বলো। তোমার বাবা তো এইবার অনেক গরম হয়ে আছে।’
বাইরে থেকে শোনা গেল আশরাফ চৌধুরী কাউকে ধমকিয়ে কথা বলছেন,
“-পাচ্ছেন না মানে? একদিনের ভেতর একটা মেয়ে তো আর উধাও হয়ে যেতে পারবে না। আতিয়া এখানকার কিছুই চিনে না। ও কোথায় যাবে?’
“-স্যার আমরা আমাদের সাধ্য মত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’
“-শুধু চেষ্টা চালালে হবে না। আমি আমার মেয়েকে চাই। আমি কিছু জানি না। যে করেই হোক ২৪ ঘন্টার ভেতরে আমি আমার মেয়েকে ফেরত চাই। আপনারা ওকে কোথায় থেকে খুঁজে দিবেন তা আপনারা জানেন। দরকার পড়লে ওর ছবি নিউজপেপারে দিন। ঢাকার বাইরেও ওর খোঁজ লাগান। শহরে, শহরের বাইরে সবগুলো থানায় ওর ছবি পাঠিয়ে দিন। যে করেই হোক ২৪ ঘন্টার ভেতরে আতিয়াকে খুঁজে বের করতেই হবে।’

আতিয়া হোটেল রিসেপশনের সামনে দাঁড়িয়ে ঐ লোকটার জন্য অপেক্ষা করছে। দাঁড়িয়ে থাকতে আর ভাল লাগছে না। সে পায়চারি করতে করতে দাঁত দিয়ে নখ কাটছে। এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। তার খুব টায়ার্ড লাগছে। সারাটা দিন জার্নির উপরে কেটেছে। সেই ভোরে সূর্যের আলো ফোটার আগে বাড়ি থেকে বের হয়েছে। এখন রাত এগারোটা একান্ন। প্রায় বারোটা বাজে। ক্লান্তিতে আতিয়ার চোখ লেগে আসছে। সে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না।
“-কি ম্যানেজার সাহেব! আপনার ঐ স্যার কোথায়? বেড়াতে এসে একটা লোক এতক্ষণ বাইরে কী করছে? উনি কি সকাল হবার আগে ফিরে আসতে পারবেন? রাতটা বাইরেই কাটাবেন তাহলে শুধু শুধু একটা রুম বুক করে বসে আছেন কেন? আজব!’
“-স্যার তো কিছু বলে যান নি। কখন আসবেন কিছুই জানি না। ‘
আতিয়া সত্যিই অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে। ম্যানেজারও আতিয়ার অবস্থাটা বুঝতে পারলেন। তিনি মনে মনে বললেন,
“-আহারে বেচারি! মনে হয় সত্যি সত্যিই অনেক বড় সমস্যায় পড়েছে। নাহলে এতক্ষণ কেউই অপেক্ষা করে বসে থাকতো না। আমার কাছেও তো রুমের জন্য কতো রিকোয়েস্ট করলো। একা একটা মেয়ে এতো রাতে যাবেই বা কোথায়? তার উপর উনি নাকি এখানকার কাউকে চিনেন না। আহা মেয়েটার জন্য সত্যিই এখন মায়া হচ্ছে। না জানি কোন বিপদে পড়েছে।’
ম্যানেজারের হঠাৎ মনে পড়লো। তিনি আতিয়াকে ডেকে বলে উঠলেন,
“-ম্যাম আমার কাছে উনার ফোন নাম্বার আছে। আপনি বললে উনাকে কল করে দেখতে পারি।’
লোকটার কথা শুনে রাগে আতিয়ার গা জ্বলে যাচ্ছে। একটা লোক এতটা গাধা কী করে হতে পারে? আতিয়া রাগ সামাল দিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“-ফোন নাম্বার ছিল তা আগে বললেন না কেন? আগেই যদি উনাকে কল করতেন তাহলে তো আমাকে আর এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হতো না।’
“-সরি ম্যাম একদম মাথায় ছিল না। আমি এক্ষুনি কল করছি। ‘
“-দয়া করে করুন। ওয়েট করতে করতে চোখ দিয়ে রক্ত চলে আসার আগে আপনার স্যারে আসতে বলুন।’
ম্যানেজার তড়িঘড়ি করে নাম্বার বের করে লোকটিকে কল লাগালো। আতিয়া মনে মনে উনাকে হাজার গালি দিয়ে ফেলল।
“-কি কল রিসিভ করেছে? ‘
“-রিং হচ্ছে কিন্তু উনি ফোন তুলছেন না। ‘
“-আমার সাথে এমনটাই হওয়ার ছিল। উফফ গড! কী চাও তুমি আমার কাছে? কেন এমন করছো আমার সাথে? একটু হেল্প করো না তুমি প্লিজ গড।’

সা’দ হোটেলে ঢুকছিল এমন সময় ফোন বেজে উঠলে সে আর ফোন তুললো না। এখন কে ফোন দিতে পারে তা সে আন্দাজ করে নিল। মুচকি হেসে সা’দ বলল,
“-সরি নাহিল। এখন আমি তোমার কল তুলতে পারবো না। কারণ আমি জানি এখন কে তোমাকে দিয়ে কল করাচ্ছে। তুমি কোন সিচুয়েশানে আছো। আর কে তোমার সামনে আছে। তোমার ভাই হয়ে আমি তোমাকে প্যারা দিতে পারি না। ‘
ম্যানেজার দূর থেকে সা’দকে দেখে একপ্রকার চেঁচিয়ে উঠে বলল,
“-ম্যাম ঐ স্যার চলে এসেছেন।’
আতিয়া নীরস গলায় বলল,
“-কোথায়? ‘
“-ওই তো আপনার একটু পেছনেই।’
আতিয়া পেছনে ঘুরে দাঁড়িয়ে একটা ছেলেকে দেখে টাস্কি খেয়ে গেল। সে ভাবতো বাংলাদেশে হয়তো হ্যান্ডসাম কোনো ছেলেই নেই। কিন্তু এখন সে কি দেখছে? আতিয়া তার কল্পনায় যেমন ছেলের ছবি আঁকত। এই ছেলে তো ঠিক তেমন। পুরো যেন তার স্বপ্নের পিন্স চামিং এর মত। আতিয়া ছেলেটার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। কালো ট্রাউজার আর খয়েরি কালারের টিশার্ট পরনে। পাঁচ ফুট দশ/এগারো ইঞ্চি লম্বা তো হবেই। বিদেশীদের মত সুন্দর একটা ছেলে তার দিকে এগিয়ে আসছে। ছেলেটার বাঁ হাতে কালো একটা ঘড়ি। ডান হাতে ফোন। হাতে ফোন রেখেও সে ঘড়িতে সময় দেখছে। কাছে এলে আতিয়া লক্ষ করলো ছেলেটার গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ির জন্য তাকে আরো সুন্দর লাগছে। বাইরের বাতাসে চুল গুলোও কেমন এলোমেলো হয়ে আছে। আতিয়ার কাছে মনে হচ্ছে ছেলেটার চুলগুলো ভাঁজ থাকলে হয়তো এতো সুন্দর লাগতো না। এলোমেলো চুলেই মানিয়েছে। সা’দ আতিয়াকে পাশ কেটে চলে যাচ্ছে আতিয়ার সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। ম্যানেজার তাকে ডেকে বলল,
“-ম্যাম স্যার তো চলে যাচ্ছেন। আপনি উনার সাথে কথা বলবেন না?’
এই কথাতে আতিয়ার হুঁশ ফিরলো। সে ছেলেটাকে পেছন থেকে ডেকে উঠলো,
“-এক্সকিউজ মি, শুনছেন? ‘
আতিয়ার ডাকে সা’দ দাঁড়াল। আশেপাশে তাকিয়ে তার নিজের দিকে ইশারা করে বলল,
“-আমি? ‘
“-হ্যা আপনিই। একটু দাঁড়ান না প্লিজ। আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে। আসলে শুধু কথা না। আমার আপনার থেকে একটা ফেভার লাগবে।’
আতিয়া কথা বলতে বলতে সা’দের সামনে এসে দাঁড়াল।
“-হ্যা বলুন। ‘
“-আসলে আমি খুব সমস্যায় পড়েছি। থাকার জন্য কোনো রুম পাচ্ছি না। সব রুমই আগে থেকে বুক করা।’
সা’দ চুলে হাত চালাতে চালাতে বলল,
“-এখন আমি কী করতে পারি?’
ছেলেটার কথার ভাব দেখে আতিয়ার রাগ উঠে যাচ্ছে। সে এতো সুন্দর করে কথা বলছে। আর ছেলেটা কিনা ভাব দেখাচ্ছে! আতিয়া মনে মনে বলল,
“-বিদেশী ইঁদুর আমি যদি সত্যিই সমস্যায় না পড়তাম, না। তাহলে তোর ভাব দেখানো বের করে দিতাম। তোর থেকে হেল্প চাওয়া তো দূর মরতেও তোর সাথে কথা বলতে আসতাম না।’
সে মনে মনে এসব বললেও মুখে বলল,
“- ইয়ে,আপনি যদি আজ রাতের জন্য আমার সাথে আপনার রুম শেয়ার করতেন তাহলে আমার প্রবলেম সল্ভ হয়ে যেত। আমি কাল সকালেই চলে যাব। শুধু আজকের রাতটার জন্য যদি একটু… ‘
আতিয়া কথা শেষ করার আগে সা’দ বলল,
“-সরি! মিস, ইয়া মিসেস? হোয়াট এভার। আমি অচেনা কোনো মেয়ের সাথে রুম শেয়ার করতে পারবো না। আপনি নিজের জন্য অন্য কোনো ব্যবস্থা করে নিন।’

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here