‘নয়নতারা’
লিখা- ফারিয়া নোভা
(পর্ব-৭)
সেদিন নয়নতারা ক্লাসেও তেমন মনোযোগ দিতে পারছে নাহ। মাথায় কাল থেকে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে বারবার।
এই একদিনে ওর জীবনটা কতটা বদলে যাচ্ছে।
এদিকে রিনি বেশকিছুক্ষন যাবত লক্ষ্য করছে নয়নতারা অন্যমনস্ক হয়ে কিছু একটা ভাবছে। ক্লাস শেষে –
রিনি- কিরে, কি এতো ভাবছিস?
নয়নতারা- (হুশ ফিরে) নাহ রে, কিছু নাহ।
রিনি- আমাকে তো বার্থডে তে দাওয়াতও দিলি নাহ হুহ।
নয়নতারা- তুই তো জানিস, ওই দিনটা আমি অনাথাশ্রমে কাটাই। ওইভাবে তো পালন করা হয় না।
রিনি- হু সব জানি, এই নে তোর বার্থডে গিফট।
নয়নতারা- কি এটা?
রিনি- আমার ফেভারেট একটা হিস্টোরি বুক। আদিমযুগের বিভিন্ন কাহিনী , বিভিন্ন সমাজ, তাদের চলন, তাদের অতিপ্রাকৃত ক্ষমতা সবকিছুর ইতিহাস আছে মোটামোটি।
নয়নতারার রিনুর কথা শুনে বেশ উৎসাহিত হয়।
সে মলাট খুলে দেখে –
‘লিয়ান দ্যা ডার্ক সিটি’
নয়নতারা – তাহলে তো এটা আজই পড়তে হয়।
রিনি- আগে চল, টিফিন টা সেরে নেই।
নয়নতারা ক্লাস শেষে বাসায় এসে ও প্রচন্ড মাথা ব্যাথা অনুভব করে ।
সে কিছু খেয়েই ঘুমিয়ে পড়ে।
নয়নতারা ঘুমের ঘোরে এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখে-
তিনু একটা কালো কাপড়ে মোড়ানো বিছানায় শুয়ে আছে। ওর চোখগুলো বাঁধা।
ছোট্ট মেয়েটা কে ঘিরে এক আলোকশিখা।
আলোকশিখাটা যেনো তিনুর শরীর কে ভেদ করে যাচ্ছে। যতবার তিনুর শরীর ভেদ করে যাচ্ছে ততবার ছোট্ট শরীর টা কেঁপে উঠছে।
ওর শরীর টা আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে।
পেছনে একটা লোক দাঁড়িয়ে, উনার পুরো মুখ কালো কাপড়ে ঢাকা। শুধু চোখগুলো জ্বলজ্বল করছে।
তিনুর শ্বাস- প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে এসেছে।
নয়নতারা চিৎকার দিয়ে ঘুম থেকে উঠলো।
এমন একটা স্বপ্ন ও কেনো দেখলো?
এটা কি কোনো ইঙ্গিত ছিলো?
ওই লোকটাই বা কে?
নয়নতারা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। ততক্ষণে মি. রোদিক মেয়ের দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন –
মি. রোদিক- কিরে মা, কাঁদছিস কেন?
নয়নতারা- (কাঁদতে কাঁদতে) বাবা, তিনু……
মি. রোদিক- তিনু কোথা থেকে আসবে? তুই কি ওকে নিয়ে বাজে স্বপ্ন দেখেছিস?
নয়নতারা মাথা নাড়ায়।
মি. রোদিক মেয়ের দিকে পানির গ্লাস এগিয়ে দেন।
মি. রোদিক- শান্ত হ, একটু পানি খা।
নয়নতারা – বাবা আমি তিনুর সাথে কথা বলবো, প্লিজ।
মি. রোদিক – আচ্ছা, ঠিক আছে মা। আমি কল করছি।
মি. রোদিক ওদের ল্যান্ডফোন থেকে আশ্রমে কল দেন।
ওপাশ থেকে ভারী কন্ঠে-
ফাদার- হ্যালো, কে বলছেন?
নয়নতারা – ফাদার, আমি নয়নতারা।
ফাদার- ওহো মাই ডিয়ার, কেমন আছো? হঠাৎ এই সময়ে? তুমি ঠিক আছো তো?
নয়নতারা – আমি ঠিক আছি, একটু তিনুর সাথে কথা বলতে চাই আমি।
তিনুর নাম শুনে ফাদারের গম্ভীর ভাব টা যেনো আরো বেড়ে যায়….
ফাদার- ও তো এখন ঘুমোচ্ছে মাই চাইল্ড।
নয়নতারা- প্লিজ, ওকে একটু ডেকে দিন। আমি ১ মিনিট কথা বলবো ওর সাথে।
ফাদার- ওকে ওয়েট।
বেশকিছুক্ষণ পর তিনু আসে, ওর ঘুম জড়ানো কন্ঠ….
তিনু- হ্যালো আপু।
নয়নতারা- তিনু তুই কেমন আছিস? ভালো আছিস তো?
তিনু- বিকেল থেকে প্রচণ্ড জ্বর জ্বর লাগছে, শরীর অনেক দুর্বল।
তিনুর কথায় নয়নতারার মাথায় যেনো আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। ফাদার ই বা এসব ওকে জানায় নি কেনো? তাহলে কি স্বপ্নটা সত্যি ছিলো?
নয়নতারা- আচ্ছা তিনু, আমি কাল তোকে দেখতে আসবো কেমন? নিজের খেয়াল রাখিস।
তিনু- চকোলেট এনো কিন্তু…..
লাইনটা কেটে যায়। নয়নতারা কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না।
নয়নতারা নিজেই বুঝতে পারছে এক গভীর রহস্যের জালে সে ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু কোনো সুরাহা করতে পারছেনা।
দিন দিন রহস্যের জট আরো পাকিয়ে যাচ্ছে……
নয়নতারা মাথায় হাত দিয়ে আনমনে বসে আছে। আজ পড়তেও একদম ইচ্ছা হচ্ছে না।
মাথার মধ্যে হাজারো চিন্তাধারা ঘুরপাক খাচ্ছে।
তখনি ল্যান্ডলাইনে কল আসে-
নয়নতারা- হ্যালো, কে বলছেন?
রিনি- আরেহ আমি রিনি।
নয়নতারা- ওহ, তুই। তা কি করছিস?
রিনি- ফিজিক্স পড়ছিলাম। ফিজিক্সের শিট টা যেটা ওইদিন ক্লাসে দিলো তা কি তোর কাছে আছে? আমার টা পাচ্ছিনা।
নয়নতারা – হ্যা, আছে তো। তোর লাগবে?
রিনি- হ্যাঁ প্লিজ কাল নিয়ে আসিস।
কিরে বইটা পড়েছিস?
নয়নতারা – একদম ভুলেই গেছিলাম। এখন পড়বো। কাল তাহলে দেখা হচ্ছে।
রিনি- হু বাই।
রিনি কল দিয়ে ভালো কথাই মনে করিয়ে দিয়েছে। বইটা পড়ে হয়ত কিছুটা ভাল্লগবে।
চিন্তাগুলো থেকেও কিছুক্ষণের জন্য রেহাই পাওয়া যাবে।
নয়নতারা রুমে এসেই রিনির দেয়া বইটা হাতে নেয়, সে সূচিপত্র দেখছে।
বেশ কিছু যুগের বর্ণনাই রয়েছে দেখা যায়। সূচিপত্রের শেষ অধ্যায়ের নামে এসে নয়নতারার চোখ আটকে যায়……
সেখানে ১০ নং অধ্যায় টি ছিলো –
‘অভিশপ্ত রানি রিকভিয়া’
নয়নতারা তার ব্যাগ থেকে সেই চিরকুট টা বের করে, যেটা ফাদারের রুম থেকে পেয়েছিলো।
সেখানে রিকভিয়া শব্দটি কালো কালিতে কেটে দেয়া হয়েছে।
তখনি রুম জুড়ে সেই চিরচেনা মনকাড়া সুবাস পায় নয়নতারা।
নয়নতারার বুকফেটে কান্না আসে-
‘মা……’
এটা অন্তত বুঝে যায়, এই বইটা ওর হাতে ওর মা ই পৌঁছে দিয়েছেন।
নয়নতারা নিজের মনোবল ও ফিরে পায়। তার সাথে তার মা আছে প্রতি পদক্ষেপে, উনিই সঠিক পথ দেখাবেন।
নয়নতারা চোখ মুছে পড়তে শুরু করে-
‘ প্রায় হাজারো বছর আগের কথা। লিয়ান শহর ছিলো তখন এক প্রাণোচ্ছল শহর। যেখানে মানুষদের মধ্যে সম্পর্ক ছিলো ভালোবাসার।
লিয়ান তখনো ছিলো পুরো পৃথিবীর রাজ্যগুলোর জন্য মডেল।
লিয়ানের একাত্মতা, ভালোবাসার বন্ধন দেখে বহিরাগতদের হিংসার ও অবসান ছিলো না বৈকি……
লিয়ান শহরের মানুষজন চরম আতিথেয়তা প্রিয় ছিলেন। সেই সুবাদেই লিয়ান শহরে প্রচুর বহিরাগতদের আগমন দেখা যেতো।
আর লিয়ান শহরের সৌন্দর্য ও ছিলো চোখে পড়ার মতো।
এই সুযোগ কে কাজে লাগিয়ে লিয়ানে প্রবেশ করেছিলো রিকভিয়া নামক এক সুন্দরি নারী। কথিত আছে, তার রুপের ঝলকানিতে সময় ও নাকি থেমে যেতো কিছু মুহূর্তের জন্য।
রিকভিয়া মূলত ছিলেন এক প্রেতসাধিকা। নিজের শহরের মানুষজন যখন সত্যিটা জানতে পারে, তখন তাকে সে শহর থেকে বিতাড়িত করে দেয়। তখনি রিকভিয়া নিজের পরিচয় গোপন করে আস্তানা গড়ে তুলে এই লিয়ান শহরে।
আস্তে আস্তে শহরের মানুষজনের সাথে বেশ শখ্যতা গড়ে তুলতে শুরু রিকভিয়া। একে তো তার রুপ মাধুর্য্য, অন্যদিকে তার বন্ধুত্বসুলভ ব্যবহার দিন দিন মানুষের মন জয় করে নিচ্ছিলো।
আর রাতের আধারে লিয়ান শহর কে যখন অন্ধকার সম্পূর্ণরুপে গ্রাস করে নিতো, তখনি শুরু হতো রিকভিয়ার প্রেতসাধনা….
লিয়ানে সূর্যোদয়ের সাথে সাথে যেনো অন্ধকারের সব কালিমা ধুয়ে মুছে যেতো।
কিন্তু রিকভিয়া ধীরে ধীরে এই শহরের মানুষগুলোর মধ্যে যে অপবিত্রতার বীজ বুনে দিচ্ছিলো, তা কি আদৌ প্রতিহত করা সম্ভব ছিলো?
রিকভিয়ার প্রেতসাধনায় প্রভুকে সন্তুষ্ট করার জন্য নরবলির প্রয়োজন ছিলো অপরিহার্য। কিন্তু এই শান্তির শহরে একটা মানুষের গুম হয়ে যাওয়া মানে দারুণ হুলস্থুল পড়ে যাওয়ার মতো ব্যাপার ছিলো।
রিকভিয়া এবার আর রিস্ক নিতে চায় নি।
এ শহরের সহজ-সরল মানুষগুলোকে বানায় তার মিত্র। তাদের মোড়ে দেয় লোভ- লালসার চাদরে।
মধ্যভিত্ত মানুষগুলো অর্থ, বৈভবের নেশা ছাড়তে পারেনি।
তারাই রিকভিয়া কে জোগাড় করে দিতো নরবলি দেয়ার মানুষ।
রিকভিয়া খুশি হয়ে বানাতো তাদের অনুচর। উপহার দিতো প্রচুর স্বর্ণমুদ্রা।
রিকভিয়ার তখন প্রচার প্রসার হতে থাকে, লিয়ান শহর ছাড়িয়ে রিকভিয়ার কাছে মানুষ ছুটে আসতো।
রিকভিয়া তখনি সবচেয়ে বড় কুকীর্তি টা করে বসে, নিজের প্রভুর থেকে ছলনা করে শুষে নেয় তার সব শক্তি।
রিকভিয়া হয়ে উঠে অসীম ক্ষমতার অধিকারী।
লিয়ান শহরের মানুষগুলো ধীরে ধীরে রিকভিয়ার দাসে পরিণত হুয়। লিয়ান গড়ে উঠে রিকভিয়ার পাপের সাম্রাজ্য হিসেবে। লিয়ানের সূর্যোদয়ও ততদিনে বিষাক্ত হয়ে উঠে। পুরো পৃথিবীর কাছে লিয়ান হয়ে উঠে এক নিষিদ্ধ নগরী…..
রিকভিয়া ছলনার দ্বারা অপরিমেয় ক্ষমতা নিজের কাছে হস্তান্তর করলেও অমরত্ব লাভ করতে পারে নি। রিকভিয়ার সুন্দর দেহ বয়সের ভারে মলিন হয়ে যাচ্ছিলো। চেহারায় বয়সের ছাপ ফুটে উঠছিলো, শরীরের ভাজে ভাজে লক্ষ্য করা যাচ্ছিলো মেদ….
রিকভিয়া নিজের এই হাল চোখে দেখতে পারছিলো। সে কঠোর যজ্ঞ শুরু করে। ২ বছর ১৮ দিন একটানা যজ্ঞ শেষে সে পেয়ে যায় এক সমাধান।
কোনো ১৮ বছর বয়সী কিশোরীর জীবনীশক্তিই ফিরিয়ে দেবে তার রুপ- লাবণ্য।
এবার রিকভিয়া লিয়ান শহরের মানুষগুলোর সাথে প্রতারণা শুরু করে। প্রত্যেকবছর কোনো মায়ের কোল খালি হতো রিকভিয়ার সৌন্দর্য্য রক্ষায়।
লিয়ান শহরের মানুষগুলোর তখন চোখের জল ফেলা ছাড়া কিছুই করনীয় ছিলো না, কেউ তাদের সাহায্যে এগিয়েও আসবে না , কারণ এ যে নিষিদ্ধ নগরী। এখানকার মানুষজন পাপী।
তখনি প্রতিবাদের সুর তোলে লিয়ানের এক স্থায়ী বাসিন্দা। তিনি ছিলেন তুখোড় বুদ্ধিমত্তার অধিকারী।
সে গোপনে সবাইকে নিয়ে রিকভিয়ার দমনের পথ খুঁজছিলেন। তার বিশ্বাস ছিলো লিয়ানের মানুষগুলো যদি তাদের সহযোগীতার হাত না বাড়ায়, রিকভিয়ার একার শক্তি কিছুই করতে পারবে না। তিনি রিকভিয়াকে দমনের পন্থাও বের করে ফেলেছিলেন……
এদিকে রিকভিয়া তার গুপ্তচরের মাধ্যমে সব খবর পেয়ে যান, রিকভিয়া নিজেও ছিলেন প্রচণ্ড বুদ্ধিমতী নারী। সে নিজের সমতুল্য কারো উপস্থিতি বা হওয়ার সম্ভাবনা সহ্য করতে পারতেন নাহ।
এজন্য সেই ব্যাক্তি কে প্রকাশ্যে ডেকে এনে তার শিরদাঁড়া ছিন্ন করে দেন শরীর থেকে। এমন শাস্তি দেখে লিয়ানের মানুষগুলো ভয়ে জবুথবু হওয়ার অবস্থা।
শুধু নিথর দেহটার পাশে একটা আর্তনাদ শুনা যাচ্ছিলো –
‘বাবা…..’
(চলবে)