নয়নতারা পর্ব ৮

‘নয়নতারা’

(পর্ব-০৮)

লিখা- ফারিয়া নোভা

ছোট্ট ছেলেটাকে একটু আশ্রয় দেয়ার কেউ ছিলো না সেদিন।
ওকে ওর বাবার নিথর দেহটার সাথে ফেলে দেয়া হয় আবর্জনা ফেলার স্থানে।

সেই ছেলেটার খবর আর কেউ রাখেনি।
এরপর আর রিকভিয়ার দিকে চোখ তুলে তাকানোর সাহস হয়ে উঠে নি।

রিকভিয়া নিজের সাম্রাজ্যে আধিপত্য বিস্তার করছিলো বাঘিনীর মতো। তবে আগের সেই উৎসাহ টা আর নেই নিজের মধ্যে। সব হাতের মুঠোয় চলে আসলে নতুন করে কিছু পাওয়ার আশা টা মরে যায়।
বেশ অনেকগুলো বছর কেটে গেছে।

রিকভিয়ার এতো শান্তিপুরি কিছুতেই ভালো লাগছে না। মানুষগুলো একরকম কাঠের পুতুল হয়ে গেছে যেনো।
এদিকে রিকভিয়ার জীবন হয়ে উঠেছে অতিষ্ঠ।

এমনি এক বিকেলে রিকভিয়া প্রচন্ড বিরক্তিকর সময় কাটাচ্ছে। তখনি তার প্রাসাদের পেছনের বয়ে যাওয়া নদীর পার থেকে এক করুণ বাঁশির সুর ভেসে আসছে।

রিকভিয়া মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছে। এই বাঁশির সুরে যেনো এক অপরিমেয় নেশা আছে, যা তার হৃদস্পন্দন বাড়িয়ে তুলেছে ক্রমাগত।

রিকভিয়া নিজের সৈন্যদল নিয়ে সেখানে উপস্থিত হয়, গিয়ে দেখতে পারে ১৮ বছর বয়সী এক যুবক আনমনে বাঁশি বাজাচ্ছে।

রিকভিয়া যুবককে বন্দী করে নিয়ে আসে, তারপর থেকেই রিকভিয়ার সঙ্গী হয়ে উঠে স্পার্কি।

স্পার্কির চোখগুলো প্রচণ্ড মায়াবী ছিলো, রিকভিয়া এই প্রথম কাউকে দেখে মনে ভালোবাসার ঝড় অনুভব করছিলো।
স্পার্কি প্রচণ্ড বুদ্ধিমান ও বটে। রিকভিয়া কখনোই বুদ্ধির খেলায় স্পার্কির সাথে পেরে উঠতো না।

দিনদিন ছেলেটার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে উঠছিলো রিকভিয়া।

সেবার রিকভিয়ার জন্মদিনে লিয়ান শহর আনন্দে ভাসছিলো, পুরো শহর জুড়ে কোলাহল।
রিকভিয়া তার রাজ্যের সকলের সামনে স্পার্কি কে বিয়ের প্রস্তাব দেয়-

“শুনেছিলাম ভালোবাসার কাছে কোনো শক্তি টিকতে পারে নি কখনো, আজ নিজে উপলব্ধি করলাম।
তোমায় যে অনেক ভালোবেসে ফেলেছি, হবে কি আমার জীবনসঙ্গী?”

রিকভিয়াকে না বলার মতো বুকে সাহস কার ই বা হতো? আর রিকভিয়ার সৌন্দর্য্য কে এড়িয়ে যাওয়ার ক্ষমতা কোনো পুরুষের থাকার কথা না।
চাঁদ নিজে যখন এসে হাতের মুঠোয় ধরা দেয়, কে বা ছাড়তে চায়?

স্পার্কি এককথায় রাজি হয়ে যায়, খুব ধুমধাম করেই ওদের বিয়ের উৎসব পালিত হয়।

স্পার্কির বুদ্ধিগুণেই রিকভিয়া নতুন নতুন রাজ্য দখলে সমর্থ্য হচ্ছিলো, আর এদিকে রিকভিয়া স্পার্কিকে করছিলো প্রেতসাধনায় দক্ষ থেকে দক্ষতর।

বেশ ভালোই কাটছিলো ওদের বৈবাহিক জীবন, কেউ কারোর চেয়ে শক্তি তে না ছিলো কম, বরং স্পার্কি ছিলো তুখোড় বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন।

এদিকে রিকভিয়া ছিলো স্পার্কির কাছে খোলা জানালার মতো, স্পার্কি ও রিকভিয়া কে সবসময় হাসিখুশি রাখতো।

বছরঘুরে আবারো রিকভিয়ার জন্মদিন চলে এসেছে, স্পার্কি প্রমিস করেছে এই জন্মদিন রিকভিয়ার জীবনের শ্রেষ্ট জন্মদিন হবে।

সেদিন পুরো রাজ্যের প্রজাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়, সবাই রাজপ্রাসাদ কে চারদিক ঘিরে দাঁড়িয়েছে আছে স্পার্কির চমকের অপেক্ষায়।

এদিকে স্পার্কি রিকভিয়ার চোখে কাপড় বেঁধে নিয়ে আসে জনস্রোতের ঠিক মাঝখানটায়।
রিকভিয়াও প্রচন্ড উত্তেজিত বোধ করছে…..

( আচ্ছা পাঠক রা কি বিরক্ত বোধ করছেন এই ইতিহাসের জন্য? স্টোরি টা যেনো বোরিং না হয়, আমি নিজের মতো করে ইতিহাসটা সাজিয়েছি।

আসলে ‘রিকভিয়া’ চরিত্রটার ভূমিকা পুরো স্টোরি জুড়ে, তার জীবন ইতিহাস না দিলে স্টোরি টা অপূর্ণ থাকবে। এছাড়া আমি কোনো বোরিং ইতিহাস ও এড করিনি।
পুরো গল্পের মধ্যেই এটা একটা ছোট্ট রুপকথার গল্পের মতো করেই সাজাতে চেয়েছি আমি। তারপর ও বলছি নেক্সট পার্টেই এই ইতিহাস শেষ হচ্ছে।
আমরা আমার মূল চরিত্রগুলোতে ফিরে যাবো)

স্পার্কি রিকভিয়ার চোখের বাঁধন খুলে দেয়। রিকভিয়া অবাক হয়ে চারদিকে প্রজাদের দেখছে। শেষে স্পার্কির দিকে তাকাতেই রিকভিয়া দেখতে পায় ও রণসাজে সজ্জিত।

রিকভিয়া কিছুই বুঝতে পারছে না। সে প্রশ্ন করে বসে, কোথায় সারপ্রাইজ?

স্পার্কি অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে-

‘সেই একি স্থান, একি মুহূর্ত, একি জনকোলাহল তাও কি কিছু মনে পড়ছে আপনার রাণী রিকভিয়া?
স্মৃতিশক্তি কি দুর্বল হয়ে যাচ্ছে?’

রিকভিয়ার শিরদাঁড়া বেয়ে যেনো এক হিমশীতল জলস্রোত নেমে গেলো।

কি আবোলতাবোল বলছে তার স্পার্কি?

স্পার্কি বলে উঠে-

‘এর চেয়ে বড় সারপ্রাইজ আর কি বা হতে পারে? ১২ বছর আগে ঠিক আপনার জায়গাটায় মাটি আঁকড়ে পড়েছিলাম আমি আর আমার জায়গায় ছিলেন আপনি…….’

জনস্রোতে ততক্ষণে কানাঘুষা শুরু হয়ে যায়। এদিকে রানি রিকভিয়ার চোখে আগুন ঝড়ছে। রিকভিয়া প্রশ্ন ছুড়ে দেয়-

‘কে তুই?’

স্পার্কির হাসি যেনো থামেই না। সে প্রতিত্তোরে বলে-

‘তুই মনে মনে যাকে ভাবছিস আমি সেই, যার চোখের সামনে ওর বাবার মস্তক আলাদা করে দিয়েছিলি তুই সেদিন। আর আমাকে ফেলেছিলি আবর্জনার স্তুপে…..’

রিকভিয়া সহ উপস্থিত সবাই এসব শুনে থতমত খেয়ে যায়। স্পার্কি মুহূর্তের মধ্যে নিজের তলোয়ার বের করে রিকভিয়ার ধর থেকে মাথাটা আলাদা করে দেয়।

জনস্রোতে একটা চিৎকার চেঁচামেচি শুরু হয়ে যায়। স্পার্কির চোখের সামনে রিকভিয়া নিজের দৈববলে আবারো জীবিত হয়ে উঠে।

রিকভিয়া ককিয়ে উঠে-

‘বেইমান, আমার সাথে ছলনা করা? দাঁড়া দেখাচ্ছি মজা তোকে।’

স্পার্কি তখনি রিকভিয়ার ছবিসহ একটা ফটোফ্রেম আগুনে পুড়িয়ে ফেলতে চায়। মূলত ছবিটাই ছিলো রিকভিয়ার প্রাণভোমরা….

রিকভিয়া চিৎকার করে উঠে-

‘নাহ স্পার্কি, তুমি এমন করতে পারো নাহ, তুমি তো আমায় ভালোবাসো বলো’

স্পার্কির ঠোঁটের কোণে বিজয়ের হাসি। সে দ্রুত ফটোফ্রেম টা কালো কাপড়ে বেঁধে ফেলে।
রিকভিয়া অজ্ঞান হয়ে পড়ে।

স্পার্কি রিকভিয়ার শরীর টা নিজের ইচ্ছামত টুকরো টুকরো করে কাটে।

আতংকিত জনসাধারণ এতোক্ষণ যাবত স্পার্কির কান্ড-কারখানা দেখছিলো। স্পার্কি এবার ওদের দিকে তাকায়-

‘নিমকহারামের দল, আমার বাবা কে তোদের জন্য মরতে হয়েছে, আমার সাথে এতো বড় অন্যায় টা করার পর ও তোরা আমাকে বাঁচাতে চেষ্টা করলি নাহ? তোহ আমি কেন তোদের বাঁচাবো? ‘

স্পার্কির অট্টহাসিতে সকলের আত্মা হিম হয়ে আসছিলো। চোখের পলকে প্রেতবিদ্যার মাধ্যমে পুরো শহরে আগুন লাগিয়ে দেয় সে।

পুরো রাজ্যের মানুষ আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে শুধু স্পার্কি আর সেই ফটোফ্রেম টা বাদে।

কথিত আছে তারপর বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন বেশে স্পার্কির মতো কাউকে ঘুরতে দেখা গেছে। ধারণা করা হয়, স্পার্কি আজ ও বেঁচে আছে রিকভিয়ার প্রদত্ত প্রেতবিদ্যার বলে…..

শেষ, বইটাতে আর কিছু লিখা নেই। নয়নতারা রীতিমতো কাঁপছে। পড়তে পড়তে রাত ৩ টা বেজে গেছে।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে নয়নতারার ভয়টা যেনো আরো কিছুগুণ বেড়ে গেছে।
সে এসব কি পড়েছে? এসব ও কি সত্যি?
কে দেবে এতোকিছুর সমাধান?

নয়নতারার কাল রাতের লোকটার কথা মনে পড়ছে খুব, ওই লোকটা মনে হয় ওর মায়ের জীবন সম্পর্কে অনেক কিছু জানেন, সে হয়তো এখন নয়নতারা কে সাহায্য করতে পারতো।
কিন্তু এভাবে কাল গুম হয়ে গিয়ে উনি একদম ঠিক করেন নি।

নয়নতারা এসব ভাবতে ভাবতে রুমের লাইট অফ করে শুয়ে পড়ে। তখনি মনে হলো নয়নতারার কানের কাছে কেউ ফিসফিস করে বলছে-

‘তরী আমি এসেছি……’

নয়নতারা কি কোনো ঘোরের মাঝে আছে নাকি এটাই বাস্তব বুঝতে পারছেনা। ওর প্রচণ্ড মাথা ঘুরছে।
মুখ দিয়ে কোনো আওয়াজ বের হচ্ছে না ভয়ে, ও প্রচণ্ড কাঁপছে।

তখনি নয়নতারা অনুভব করলো ওর মাথায় কেউ হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, কিন্তু কাউকেই দেখতে পাচ্ছে না।
ভয় টা একটু সয়ে এসেছে…

নয়নতারা- আপনি কে বলুন প্লিজ..

ওপাশ থেকে- শুনতে চাও, আমি কে?

নয়নতারা- হ্যাঁ, আমাকে সব বলুন প্লিজ।

ওপাশ থেকে- আমি টগর।

নয়নতারা- টগর? কখনো তো এই নাম শুনি নি।

টগর – শুনবে কি করে, আমার মৃত্যু হয়েছে আরো ১৮ বছর আগে….

নয়নতারা নিজের কান কে বিশ্বাস করতে পারছেনা।

নয়নতারা- ঠাট্টা করবেন না প্লিজ। সত্যি বলুন, আপনি কি ম্যাজিক জানেন?

টগর -নাহ, আজ নিয়তি বেঁচে থাকলে তোমাকে হয়তো আমার কথা বলতো….

মায়ের নাম শুনে নয়নতারা বুঝতে পারে এসব মিথ্যা না। তবে ছেলেটার কণ্ঠস্বরে প্রচুর মায়া লুকিয়ে আছে। মায়ের নাম নেয়ার সময় যেনো আরো কিছুটা ভারি হয়ে এসেছে টগরের কণ্ঠস্বর।

নয়নতারা – আপনি কি তাহলে?

টগর- হুম এক অতৃপ্ত আত্মা, যাকে বন্দি করে রাখা হয়েছে ভালোবাসার পাওনা মেটানোর জন্য।

নয়নতারা- আপনি এসব কি বলছেন?

টগর – সময় হলেই জানতে পারবে।

নয়নতারা- আমার মনে আগে থেকেই হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে,তারপরও কেনো হেয়ালি করছেন আপনি?( কপট রাগ)

টগর – হেয়ালি নয়, পৃথিবীতে প্রত্যেক মানুষ নিজস্ব উদ্দেশ্য নিয়ে জন্মায়, সেই উদ্দেশ্য সাধন ও তাকেই করতে হয়।

নয়নতারা মুষড়ে পড়ে। তাকে সাহায্য করার কেউ নেই।

টগর – কে বলেছে তোমাকে সাহায্য করার কেউ নেই? আমি আছি তো তোমাকে পথ দেখাতে তরী।

নয়নতারা- শুনুন, আমি তরী নই। আমি নয়নতারা।

টগর – পূর্বজন্মের স্মৃতি তুমি ভুলে যেতে পারো তরী, আমি নই। সেগুলো নিয়েই এতো বছর অপেক্ষার প্রহর গুনছি।

নয়নতারা কাঁদছে। জীবনটা কি এতোটা এলোমেলো হওয়ার ই কথা ছিলো?

টগর – তরী…..

নয়নতারা- জ্বী, বলুন।

টগর – আমাকে যেতে হবে। যাবার আগে তোমাকে কিছু মনে করাতে চাই।

নয়নতারা- কি? (চমকে যায়)

টগর – চোখ বন্ধ কর আগে….

নয়নতারা চোখ বন্ধ করে আছে। রুম জুড়ে হিম শীতল হাওয়া বইছে। ওর চোখের সামনে হঠাৎ ই এক দৃশ্যপট ভেসে উঠে-

একটা সুদর্শন যুবক রাস্তার সাইডে দাঁড়িয়ে আছে, তার চোখে মুখে উত্তেজনার ছাপ।
নয়নতারার জায়গাটা বেশ চেনা চেনা লাগছে।

আরে এতো এতিমখানা!
তখনি সাদা জামা পড়া ঘোমটা মুখে এক যুবতী বেড়িয়ে আসে। সে সোজা হাটতে শুরু করেছে।

ছেলেটা মুচকি হেসে মেয়েটার পিছনে যাচ্ছে। ছেলেটা মেয়েটাকে উদ্দেশ্য করে বলে-

‘তরী, একটা কথা ছিলো। ‘

মেয়েটা পেছন ফিরে তাকাতেই ঘোমটা টা মাথা থেকে পড়ে যায়…..

নয়নতারা চোখ খুলে ফেলে। অঝোর ধারায় অশ্রু ঝড়ছে, জীবনে এই প্রথমবার সে তার মা কে দেখলো।
হুবহু একি দেখতে দুজন, তবে মায়ের অবয়ব থেকে যেনো আলোকশিখা ঠিকরে পড়ছিলো……

মনের মধ্যে ঝড় শুরু হয়ে গেলো। তাহলে ওই ছেলেটেই টগর?
হু হতেই হবে, সেই একি কণ্ঠস্বর।
আর কি মায়াবী সেই মুখ…

কিন্তু মায়ের সাথে উনার কি সম্পর্ক ছিলো?
উনি এখন নয়নতারার কাছেই কেনো এসেছেন?

লোকটা এসে আরো কিছু প্রশ্নের সম্মুখে দাড় করিয়ে গেলেন নয়নতারাকে……

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here