কাঠগোলাপের সাদার মায়ায়
পর্ব-৭
বৃষ্টিতে ভিজে পায়ে ব্যথা নিয়ে আমি যখন বাসায় ফিরলাম তখন দেখলাম নিলয় মাত্র বাসার গেটে নেমেছে। আমাকে দেখে বিস্মিত চোখে একবার তাকালো। আমি সেই দৃষ্টি উপেক্ষা করে খুড়িয়ে খুড়িয়ে উপরে উঠলাম। পিছনে নিলয় তাকিয়ে ছিলো হয়তো, আমি একবারও পিছু ফিরে দেখলাম না।
পায়ে ব্যথা নিয়ে নাজেহাল অবস্থায় কাটলো কয়েকটা দিন। অসময়ের বৃষ্টির পানি গায়ে লাগায় জ্বর জ্বর ভাব ও হয়েছে তাই বাসা থেকে একদম বের হলাম না। আন্টি এলেন খোঁজ নিতে। সবসময়ের মতো গল্প করে আবার চলেও গেলেন। দুই তিন দিন পর আন্টি এক বিকেলে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে বলল,
“এই প্রত্যাশা এখন তুমি কেমন আছ?”
“জি আন্টি ভালো। ”
“শোনো রাতে কিন্তু তুমি আমাদের বাসায় খাবে। নিলুর বন্ধুরা এসেছে, ওদের জন্য টুকটাক রান্নাবান্না করব বুঝলে। তুমিও এসো। ”
সেই বৃষ্টির দিনের পর নিলয়ের সাথে আমার আর দেখা হয় নি। ভিতরে ভিতরে চাপা কষ্ট থাকলেও সেটাকে সয়ে নিতে চেষ্টা করছি। আন্টিকে এড়িয়ে যেতে বললাম,
“না আন্টি আমার তো শরীর টা তেমন ভালো নেই। আমাকে বাদ দিন। ”
কিন্তু আন্টি নাছোড়বান্দা। সে কিছুতেই ছাড়বে না। বিকেলে অনেকবার বলে চলে গেল। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম ঘুমের ভাণ করে থাকব তবুও নিলয়ের সামনে যাব না। কিন্তু সেটা সম্ভব হলো না। আন্টি জোর করে আমাকে নিয়ে গেল।
ঢাকা থেকে নিলয়ের তিনজন ছেলে বন্ধু আর দুজন মেয়ে বন্ধুও এসেছে। টেবিলে খেতে যখন বসলাম তখন ওরা প্রত্যেকে আমার সাথে হাই, হ্যালো বিনিময় করলো। তখন আমি মেয়ে দুটি কে ভালো করে দেখলাম। কী সুন্দর সেজেগুজে আছে। চুলগুলো রিবন্ডিং করে কাঁধ পর্যন্ত ছাটা। হাতে ড্রেসের সাথে ম্যাচিং করে নেইলপলিশ লাগানো। ড্রেসিং সেন্সও কী ভালো! সবচেয়ে যে জিনিস টা আকর্ষনীয় সেটা হলো কথা বলার স্টাইল। আমি কোনোদিনও এমন হতে পারব না। মফস্বলে থাকার কারনে কথা বলার ধরনেও একটা আঞ্চলিক টান আসে। এরকম বই, পুস্তকের মতো শুদ্ধ ভাষায় কোনোদিন ও কথা বলতে পারব না।
আমি ভালো করে খেয়াল করে দেখলাম যে এই দুটি মেয়ের মধ্যে ওই মেয়েটা নেই। হয়তো গার্লফ্রেন্ড বলেই মেয়েটাকে বন্ধুদের মাঝে আনে নি।
হঠাৎ আমার কী যে হলো কে জানে! চোখ দিয়ে টপ টপ করে বৃষ্টির ফোটার মতো পানি পড়তে লাগলো। আন্টি প্লেটে যে খাবারগুলো দিয়েছে সেগুলো তেমনি পড়ে রয়েছে। একটা খাবারও আমার গলা দিয়ে নামলো না। নিলয় বন্ধুদের সঙ্গে ব্যস্ত বলে হয়তো আমার দিকে খেয়াল করলো না। আমি উঠে হাত ধুতে গেলে আন্টি অবাক গলায় বলল,
“একি প্রত্যাশা তুমি তো কিছু খেলেই না। ”
“ভালো লাগছিল না আন্টি। ”
আন্টি আমার ভেজা চোখ দেখে আঁতকে ওঠা গলায় জিজ্ঞেস করলো,
“কী হইছে তোমার?”
আমি হেসে বললাম, আমার শরীর টা ভালো নেই আন্টি। আমি বাসায় যাই।
নিলয় মা’য়ের উদ্দেশ্য বলল,
“কোনো সমস্যা ?
আন্টি মন খারাপ করা গলায় বলল,
“দেখ না মেয়েটার শরীর টা ভালো নেই তাই কিছু খেতে পারলো না। ”
নিলয় আমার দিকে তাকালো। কয়েক সেকেন্ডের জন্য চোখাচোখি হলো। গভীর চোখে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো। ওই কয়েক সেকেন্ডের অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করবার মতন নয়। আমি স্বাভাবিক ভাবে নিলয়ের পাশ কাটিয়ে চলে এলাম। দরজার কাছাকাছি যখন আসছিলাম তখন শুনলাম টেবিলের থেমে থাকা আড্ডাটা আবারও জমে উঠেছে।
ঘরে এসে বিছানায় শুয়ে শুয়ে একটা কথাই ভাবতে লাগলাম, যে আমি এতো বোকা কেন! আমার দেখা জীবন আর নিলয়ের দেখা জীবনের মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ। আমার কাছে জীবনের আনন্দ মানে ফুসকার প্লেট হাতে নিয়ে তেতুলের টক টা মুখে দিয়ে তৃপ্তিতে চোখ বন্ধ করে ফেলা। কিন্তু নিলয়ের তো আর সেটা না, তার জগৎ আলাদা, জীবন দেখার ধরনও যেমন আলাদা, তেমনি জীবনের আনন্দও আলাদা। আমার মস্ত বড় ভুল ছিলো নিলয়ের প্রেমে পড়াটা।
***
আমার দিনগুলো কোনো ভাবে কেটে যায়। হুটহাট সিড়ি দিয়ে নামার সময় কিংবা রাস্তাঘাটে নিলয়ের সাথে দেখা হয়ে যায়। কথাবার্তায় তো দূরে থাক, চোখাচোখিও তেমন হয় না। তাছাড়া সামনে পরীক্ষা তাই কিছু সময় পড়াশুনোর মধ্যে কাটে। পড়াশুনোয় কখনো সিরিয়াস ছিলাম না বটে তবে এখন একটু আধটু সিরিয়াস হতে দেখে মা আর ভাইয়াও বেশ অবাক। আর আমি কোনো কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকলে ভালো থাকব ভেবে একটু আধটু পড়ছি।
পরীক্ষা অতি সন্নিকটে বলে বিকেলে ম্যাথ কোচিং এ যাই। একদিন বিকেলে ছাতা নিতে মনে না থাকায় বৃষ্টিতে আটকে গেলাম। ভাইয়াও অফিসের কাজে ঢাকা গিয়েছে তাই বৃষ্টি থামার অপেক্ষা করতে লাগলাম। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে গেছে তবুও বৃষ্টি থামার লক্ষন নেই। এদিকে মা চিন্তায় অস্থির। একটু পর পর ফোন করেন। কিছুক্ষণ পর দেখলাম নিলয় রিকশা নিয়ে এসেছে। রিকশায় আসা সত্যেও ভিজে গেছে। রিকশা থেকে নেমে বলল,
“আঙ্কেল পাঠিয়েছে তোমাকে নেয়ার জন্য। তাড়াতাড়ি চলো।”
আমি বিনা বাক্যব্যয়ে রিকশায় উঠলাম। অহেতুক তর্ক কিংবা জেদ করে লাভ নেই তাই রিকশায় উঠে গেলাম।
এর আগে যেদিন রিকশায় বসেছিলাম সেদিন ইচ্ছে করে নিলয় কে ক্ষ্যাপানোর জন্য গায়ে গা লাগিয়ে বসেছিলাম। আর আজ ইচ্ছে করেই দূরত্ব বজায় রেখেছি। আমি একটু দূরে সরে বসায় বৃষ্টির পানি গায়ে লাগছিলো। নিলয় বলল, আরেকটু ভিতরে চেপে বসো নাহলে তো ভিজে যাবে একদম।
আমি সেকথার কোনো জবাব ও দিলাম না আর ভিতরে চেপেও বসলাম না। বৃষ্টি তখন প্রায় থেমে এসেছে তাই নিলয় ও আর জোর করলো না। কিছু সময় পর নিলয় বলল,
“প্রত্যাশা আমি জানি যে তুমি আমার উপর রেগে আছ। আসলে রাগ টা স্বাভাবিক। কিন্তু আমার সমস্যা হলো আমি অল্পে রাগী না ঠিক ই কিন্তু যখন রেগে যাই তখন হিতাহিত জ্ঞান বুদ্ধি লোপ পায়। তাই আমার ওইদিনের কথাগুলোর জন্য এক্সট্রেমলি সরি।
আমি কোনো উত্তর দিলাম না। রিকশা চলছে তার গতিতে। ঘুটঘুটে অন্ধকারে মেঘলা বাতাস আর ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। আমি আর নিলয় দুজনেই চুপ করে আছি। হঠাৎ নিলয় রিকশাওয়ালাকে বলল,
“মামা রিকশা থামান তো। ”
রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে রিকশাওয়ালাকে বলল,
“ওকে ঠিক জায়গায় পৌছে দিয়েন। ”
আমি কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলাম না।
নিলয় সেদিন রাতে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে এসেছিল এবং পরবর্তী কয়েকদিন তীব্র জ্বরে ভুগেছে। কিন্তু একবারের জন্যও আমি ওকে দেখতে যাই নি। তবে মায়ের কাছ থেকে খবর পেয়েছি।
আমার অবস্থা হলো এমন যে তারে দেখতেও পারি না আবার তারে ছাড়া বাঁচিও না। কাছাকাছি যতক্ষণ থাকব ততক্ষন পর্যন্ত এই যন্ত্রণা সইতে হবে। তাই ভাবলাম দূরে চলে যাব।
বাবা, মা অনেকদিন আগেই চেয়েছিলেন বিয়ে দিতে। কিন্তু আমি রাজি ছিলাম না বলে ব্যাপার টা আর এগোয় নি। তাই এবার নিজেই রাজি হয়ে গেলাম। মা, বাবা অবাক হলেও মনে মনে বেশ খুশি হয়েছিলেন। আমি শুধু বলেছিলাম যে যা করার পরীক্ষার পর করবে, তার আগে না। বাবা, মা মেনে নিয়েছেন। ভাইয়া যা’ও একটু আপত্তি করেছিল বাবা, মা বুঝিয়ে সুঝিয়ে ম্যানেজ করে নিয়েছে।
বারান্দায় রাখা কাঠগোলাপ গাছ টা এখনো আছে। ভেবে রেখেছি বিদায়ের আগে নিলয় কে দিয়ে বলব এটা দিয়েই তো আমাদের গল্পটা শুরু হয়েছিল তাই এটা দিয়েই না হয় শেষ হোক।
চলবে…