কাঠগোলাপের সাদার মায়ায় পর্ব ৮

কাঠগোলাপের সাদার মায়ায়
পর্ব-৮
আমার হঠাৎ বিয়ের খবরে আত্মীয় স্বজন, প্রতিবেশী সবাই খুব অবাক হলো। নিলয়ের মা তো বিশ্বাস ই করছে না যে আমার এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। আমার অবশ্য তাতে কোনো ভাবান্তর নেই। আমি শুধু নিলয় কে ভুলতে চাই।

একদিন কোচিং ক্লাস শেষে আসার পথে ছোট রাস্তার মোড়ে নিলয়ের সাথে দেখা হলো। একটা মোবাইল সার্ভিসিং এর দোকানে বসে ছিলো। আমাকে দেখে বেরিয়ে এসে বলল,

“প্রত্যাশা শোনো?”

আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। নিলয়ের চোখে চোখ রাখলাম না। নিলয় বলল,

“তোমার সাথে আমার কথা আছে। ”

“বলুন। ”

“চলো হাটতে হাটতে কথা বলি। ”

কিছুটা দ্বিধা দ্বন্দে পড়ে গেলাম। নিলয় কী বলতে চাইছে! আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে এই খবর টা অন্যদের সাথে সাথে ওর ও তো পাওয়ার কথা। তাহলে কী ওই ব্যপারেই কিছু বলতে চাইছে!

আমরা দুজন পাশাপাশি হাটতে লাগলাম। বিকেলের আলো তখন মরে এসেছে। কিছুক্ষণ পর সন্ধ্যা নামবে। বেশ কিছুক্ষণ হাটার পরও নিলয় কিছু বলছে না। আমি জিজ্ঞেস করলাম,

“আপনি কী যেন বলবেন বলছিলেন?”

নিলয় সে কথার জবাব না দিয়ে বলল,

“ফুসকা খাবে?”

আমি বিস্মিত হলাম। বিস্ময়ভাব কাটিয়ে বললাম,

“না। ”

নিলয় আমার দিকে তাকিয়ে বলল,

“আমার খুব ফুসকা খেতে ইচ্ছে করছে। তুমি না খেলে আমার পাশে বসে থেকো। এর আগে একদিন আমি বসে ছিলাম না, আজ তুমি থাকবে৷ ”

ফুসকা অর্ডার দিয়ে নিলয় এসে আমার পাশের চেয়ার টা’তে বসলো। আমি আবারও বললাম,

“আপনি যেন কী বলবেন?”

নিলয় এবারও জবাব দিলো না। ফোন স্ক্রল করতে লাগলো। আমার এবার খুব মেজাজ খারাপ হলো। সন্ধ্যার আগে আমায় বাড়ি ফিরতে হবে। অথচ ব্যটার হাবভাব কেমন গা ছাড়া!

ফুসকা এসে গেছে। আমি খাব না বলেছি বলে আমার জন্য আর অর্ডার করে নি। চূড়ান্তরকম অভদ্র ছেলে!
যাইহোক তাতে আমার কী আসে যায়, ওর কাছে ভদ্রতা এক্সপেক্ট করাও বোকামি। আমি যার সাথে অভদ্র হয়েছি, সে তো আমার সাথে অভদ্র হবেই। এটাই তো হওয়ার ছিলো।

নিলয় ফুসকার প্লেট হাতে নিয়ে বসে রইলো। আমি ঘড়িতে সময় দেখে বললাম,

“সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে একটু তাড়াতাড়ি করলে ভালো হয়। ”

আমার এই কথা শুনে নিলয় একটা ফুসকা মুখে দিলো। মুখে দেয়ার সাথে সাথে মুখের রং পরিবর্তন হয়ে গেল। অতি অখাদ্য মুখে তুললে মুখের রং যেমন পালটায়, তেমন পাল্টেছে।

একটা ফুসকা কোনোমতে গিলে প্লেট টা রেখে টিস্যু দিয়ে মুখ মুছে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,

“লন্ডনের একটা ইউনিভার্সিটিতে এপ্লাই করেছিলাম। ওরা পজেটজভ রেসপন্ড করেছে। ”

কথাটা শুনেই আমার গলায় কান্নার দলা পাকালো। কোনোমতে নিজেকে সামলে বললাম,

“কনগ্রাচুলেশন। ”

নিলয় আমার দিকে গভীর চোখে তাকালো। তখন সন্ধ্যাবেলা। আমার জীবনে এমন কোনো সন্ধ্যা এর আগে আসে নি, হয়তো কোনোদিন আসবেও না। আমি মনে মনে বললাম, আল্লাহ এই সময় টা’কে কী থামিয়ে দিতে পারে না।

আমি চোখ নামিয়ে নিলাম। নিলয় ফিসফিস করে বলল,

“তোমাকেও অভিনন্দন। ”

আমি জবাব দিলাম না। চোখের কোনে জল জমে গেছে। প্রানপনে চেষ্টা করলাম সেটা আড়াল করতে।

নিলয় আবারও বলল, শুনলাম তোমার হবু বর নাকি অনেক বড়লোক।

আমি চুপ করে থাকলাম।

“তোমার জন্য ভালো হলো। তুমি তো সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মেছ। এস্টাবলিশড ছেলে ছাড়া বিয়ে করলে তোমার অনেক কষ্ট হবে।

এই কথাটা আমাকে বেশ আঘাত করলো। ইনডাইরেক্টলি বুঝিয়ে দেয়া যে আই এ্যম নাথিং। আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম,

“আমি যাচ্ছি। ”

“আরেকটা কথা। রোজি ইজ নট মাই গার্লফ্রেন্ড। শী ইজ অনলি মাই ফ্রেন্ড। ”

আমি নিলয়ের দিকে তাকিয়ে ঝাঝালো গলায় বললাম, হোয়াটএভার! নাউ আই হ্যাভ নো ইন্টেরেস্ট।

কথাটা বলে এক মুহূর্ত অপেক্ষা করলাম না।

*****
এই নিলয় কে আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। ও আমাকে পছন্দ করে না বলেই জানতাম। তাহলে এতো ব্যখ্যা, বিদেশে যাওয়া এসব কেন শোনাচ্ছে। বাই এনি চান্স ও কী আমায় পছন্দ করতে শুরু করেছে! না সেটা হলে খোচা মেরে বলতো না যে আমি সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মেছি বলে এস্টাবলিশড পয়সাওয়ালা ছেলে বিয়ে করছি।

****
মানুষ ভাবে একরকম কিন্তু তার সাথে ঘটে আরেকরকম। আমার জীবন টা’ও এক মুহুর্তে বদলে গেল। নিলয়ের কথায় সেদিন এতো খারাপ লাগলো যে আমি অনেকক্ষন কেঁদেছিলাম। সেটা খেয়াল করেছিল ভাইয়া। ভাইয়ার সাথে আমার বয়সের অনেক বেশী ডিসট্যান্স ছিলো বলেই সে আমাকে বাবা, মা’র মতো স্নেহ করতো। আমাদের সম্পর্ক মোটেও বন্ধুর মতো ছিলো না। কিন্তু ভাইয়া সেদিন প্রথম আমার সাথে বন্ধুর মতন আচরন করেছিল। আমাকে কাঁদতে দেখে ভাইয়া প্রথমে যে কথাটা জিজ্ঞেস করলো সেটা হলো, ছেলেটা কে প্রত্যাশা?

আমি নিজেকে সামলাতে পারলাম না। ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরে হাপুস নয়নে কাঁদতে লাগলাম। ভাইয়া পরম আদরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,

“আমাকে সব টা খুলে বল প্লিজ। আমি তোকে অবশ্যই হেল্প করবো। বাবা মা’কে যে করে হোক ম্যানেজ করব ই”।

আমি নিজেকে সামলে বললাম, সেটা সম্ভব না ভাইয়া। কারন ব্যপার টা শুধু এক তরফা।

“ছেলেটার নাম তো বল। ”

“নিলয়।”

“আমিও আন্দাজ করেছিলাম। কিন্তু সমস্যা টা কোথায়?”

তারপর আমি নিলয়ের সব ব্যাপার খুলে বললাম। সব শুনে ভাইয়া বলল,

“নিলয়ের উপর জেদ করে তুই বিয়ে করতে চাইছিস?”

আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললাম। ভাইয়া বলল,

“তুই কি পাগল? ”

“আমি নিলয়কে ভুলতে চেষ্টা করছি ভাইয়া। কিন্তু কাছাকাছি থেকে সেটা সম্ভব না। ”

“তাই বলে বিয়ে করতে হবে? বিয়েটা কী পুতুল খেলা! তুই এতো গাধা! বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এক ফোটা বুদ্ধিও বাড়ে নি তোর। ”

“তাছাড়া আর কী করব?”

“অনেক কিছু করার ছিলো। নিলয় যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে তাই কিছু একটা করে দেখিয়ে তো দিতে পারতিস। ”

আমি ভাইয়ার দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে রইলাম।

ভাইয়া বলল, এসব বিয়ে বিয়ে খেলা একদম বন্ধ। তুই ঢাকায় যাবি। প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে হোস্টেলে থেকে পড়াশুনা শুরু করবি।

“কিন্তু আমার তো এক বছর নষ্ট হয়ে যাবে?”

“হলে হবে। এক বছর নষ্ট করে যদি সারাজীবন ভালো থাকা যায় তাহলে নষ্ট করবি এক বছর। ”

আমার কাছে ভাইয়ার কথাগুলো এতো ভালো লাগলো, খুশিতে আমি কেঁদে ফেললাম। ভাইয়া মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, কাঁদিস না। মানুষ চাইলে সব পারে। তুই ও পারবি। চেনা গন্ডির বাইরে গেলে অনেক মানুষের সাথে দেখা হবে, হয়তো নিলয়ের চেয়েও ভালো কাউকে পাবি।

অতিসন্তঃর্পনে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। নিলয়ের চেয়ে ভালো কাউকে পেলেও নিলয় কে তো আর পাব না।

***
ভাইয়া বাবা, মা’কে ম্যানেজ করলো। একমাত্র মেয়েকে বাবা, মা দূরে পাঠাতে কোনোভাবেই রাজি না তবুও ভাইয়ার যুক্তির কাছে হার মানলেন। আমিও মা’কে বললাম, মা জীবন কে একবার আমি সুযোগ দিতে চাই। যদি হেরে যাই তবে তোমাদের কাছেই ফিরব। তোমরা যা করতে বলবে তাই করবো। অবশেষে মা, বাবা রাজি হলেন।

ভাইয়া প্রাইভেট হোস্টেলে সিট বুকিং, ইউনিভার্সিটির ভর্তি ফর্ম সবকিছু তাড়াতাড়ি করে ফেলল। হাতে সময় খুব কম তাই টুকটাক গোছগাছ চলছে। ততদিনে সবাই জেনে গেছে যে আমার বিয়ে ক্যান্সেল।

একদিন ঘটা করে কলেজ থেকে বিদায় নিয়ে এলাম। বেফাঁস কথা বলা, অভদ্র আমির যে এতো বন্ধু বান্ধব আছে সেটা এতদিনে টের পেলাম। সবাই কী ভীষণ মন খারাপ করছে আমি চলে যাব বলে। আমারও ভীষণ খারাপ লাগছে চেনা গন্ডি ছেড়ে দূরে যেতে। তবুও কিছু করার তো নেই।

যাবার আগের দিন আন্টির সাথে দেখা করতে গেলাম। হড়বড় করে কথা বলা আন্টি মন খারাপ করা গলায় বলল,

“তোমার কথা যে আমার বড্ড মনে পড়বে প্রত্যাশা। ”

আমি দু’চোখ ভর্তি জল নিয়ে বললাম,

“আন্টি আমি রোজ আপনাকে ভিডিও কল দিয়ে বকবক করবো। ”

আন্টি বাচ্চাদের মতো শব্দ করে কেঁদে ফেলল। অথচ এই মানুষ টার সাথে মোটে কয়েক মাসের পরিচয় আমার। আমি আন্টিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললাম,
“ছুটি পেলেই চলে আসব তো আন্টি। ”

আন্টি বলল,

“নিলুটাও চলে যাবে। ছেলেমেয়ে গুলো দূরে গেলে ভালো লাগে বলো?”

আমি আর কিছু বললাম না।

***
নিলয়ের সাথে দেখা করতে যখন গেলাম তখন নিলয় বারান্দার গাছে পানি দিচ্ছিলো। আমি কাঠগোলাপ গাছ টা নিলয় কে দিয়ে বললাম,

“এই যে নিন। আমি তো আর থাকছি না কে যত্ন নেবে। তারচেয়ে আপনার জিনিস আপনার কাছেই থাকুক। ”

নিলয় আমার দিকে না তাকিয়েই বলল,

“উইশ ইউ বেস্ট অফ লাক। ”

“থ্যাংক ইউ। আপনার যাবার কী খবর? ”

নিলয় এই প্রশ্নের উত্তর দিতে সময় নিলো। আমার কাছাকাছি এসে চোখে চোখ রেখে বলল,

“আমি চলে গেলে খুশি হবে খুব?”

“আমার খুশিতে কী আসে যায়? আমি নিজেই তো থাকছি না। ”

নিলয় কোনো কথা বলল না। আমিও নিলয়ের চোখের দিকে অপলক তাকিয়ে রইলাম। আবার কবে দেখব কে জানে!

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here