#তুমি_নামক_ব্যাধি
#মুন্নী_আরা_সাফিয়া
#পর্ব_১৭
একসময় ক্লান্ত হয়ে থেমে গেলাম। আমার হেঁচকি তোলা দেখে তিহাম ভাইয়া নরম গলায় বললো,
—‘থামলে কেন?আহ্!কতদিন পর মনেহচ্ছে মাতাল করা কোনো কন্ঠে গান শুনছি।নাও, নাও। শুরু করো আবার।’
ওই অবস্থাতে মুচকি হেসে বললাম,
—‘মজা নিচ্ছেন? ‘
—‘নো।একদমই না।যত খুশি আজকে শোনাও।কিন্তু আজকের পর থেকে বাকি জীবনটাতে যদি এক ফোঁটা চোখের জল ফেলো,তাহলে ভয়ংকর শাস্তি দিবো বলে রাখলাম।’
অভিমানী গলায় জিজ্ঞেস করলাম,
—‘আপনি এত বড় একটা সত্যি কি করে আমার থেকে লুকিয়ে রাখলেন? আমার জানার অধিকার ছিল না?আপনাকে হাতের কাছে পেলে যে এখন কি করতাম আমি নিজেই জানি না।ভাগ্য ভালো আপনার বলতে হবে!’
—‘কি করতে? বিয়ে করে ফেলতে নাকি!আসবো?প্লেনের টিকেট কনফার্ম করি?’
—‘একদম মজা নিবেন না!’
—‘আচ্ছা যাও।আর মজা নিবো না।জানো, আমার যে কি পরিমাণ খুশি লাগছে এই মুহূর্তে তা বলে বুঝাতে পারবো না।এই মুহূর্তটার জন্য কতগুলো বছর, কতগুলো মাস,কতগুলো দিন,কতগুলো ঘন্টা, কতগুলো মিনিট, কতগুলো সেকেন্ড অপেক্ষা করেছি তা তোমার ধারণার বাইরে। কিন্তু আমি তোমাতে সারাক্ষণ এতটাই বিভোর থাকতাম যে তার হিসেব রাখতে পারিনি। ইচ্ছে করছে তোমাকে জড়িয়ে ধরে সাড়া পৃথিবীকে জানিয়ে দেই,আমার পিচ্চি ফাইনালি আমার হাতে ধরা দিয়েছে। আমার পিচ্চি আমারি আছে। এই পিচ্চি, আমার খুব করে তোমার বুকে মুখ লুকাতে ইচ্ছে করছে!’
আমি চুপ করে আছি।কেন জানি ভীষণ লজ্জা লাগছে আমার।লজ্জা নামক বস্তুটার সাথে আজ আমার প্রথম পরিচয়। আমি ভাবতেই পারছি না তিহাম ভাইয়া আমাকে লজ্জা নামক অনুভূতির সাথে প্রথম সাক্ষাৎ করাবে।
উনার মুখে পিচ্চি ডাক শুনে মনের ভেতর ষড়ঋতুর সব মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।এক অন্যরকমের অনুভূতির সাথে ভালোলাগা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। মনের ভেতরের মরা গোলাপের ঝাড়গুলোর গায়ে যে মাকড়সা জালের নাছোড়দশা ছিল তা নিমেষে উধাও হয়ে তরতাজা গোলাপে বসন্তের প্রথম বাতাসে এলোমেলো হয়ে খেই হারাতে লাগলো।
তিহাম ভাইয়া নরম গলায় বললো,
—‘পিচ্চি? চুপ করে আছো যে?তুমি আমায় অনেক জ্বালিয়েছ জানো?তার জন্য কি শাস্তি দেয়া যায় বলোতো?’
ভ্রু কুঁচকে বললাম,
—‘কি!আপনি আমায় শাস্তি দিবেন?দেখুন,আমায় মারুন,কাটুন, হাড়গোড় সব ভেঙ্গে দিন বা যা খুশি করুন,কিন্তু খবরদার না খাইয়ে রাখতে পারবেন না।আগেই বলে রাখলাম। ‘
—‘হা হা হা।আগে তুমি আসো ইতালিতে। তারপর পুরনো হিসাব মেটানো যাবে।এখন তুমি যাও,ফ্রেশ হও।ফোন রাখছি!’
—‘হুম’
—‘ওয়েট!ওয়েট।এই পিচ্চি, আমায় আর কিছু বলবে না?’
—‘বলার মতো কিছু আছে? ‘
—‘কিছুই নেই?'(হতাশ সুরে)
—‘ওহ।কি করেন?’
—‘হা হা হা।আজব!যাও ফ্রেশ হও।তোমাকে একটা দায়িত্ব দিচ্ছি।আমার পিচ্চিকে বলে দিও।আমি তাকে এক বুক ভালোবাসি।’
—‘বলে দিয়েছি।তবে সে মাত্র এক বুক ভালোবাসায় সন্তুষ্ট না।’
—‘তাকে বলে দাও আমার এই এক বুক ভালোবাসার কোনো সীমা পরিসীমা নেই। এটা সাগরের অতলতাকেও হার মানায়।সে খুশি তো?’
মুচকি হেসে বললাম,
—‘হুম।’
—‘এবার লক্ষী মেয়ের মতো পিচ্চিকে বলো যে তার মুখ থেকেও আমি এটা শুনতে চাই।’
খট করে লাইন কেটে দিলাম।আমার মতো মেয়ের এত লজ্জা লাগছে ভেবে নিজের উপর নিজেরই বিরক্তি উঠে যাচ্ছে। ধুর!!কি একটা অবস্থা। মোবাইলের মেসেজ টিউন বাজতেই তাকিয়ে দেখি ভুঁতিহাসের মেসেজ।
“বিলিভ মি,তোমার লজ্জা রাঙা মুখটা এক পলক দেখার জন্য মনটা মারাত্মক বর্শাঘাতে আহত হচ্ছে। তাড়াতাড়ি আমার বুকে চলে এসো না পিচ্চি। তোমায় খুব ছুঁয়ে দিতে মন চাচ্ছে। ভীষণ অভাববোধ করছি তোমার।”
দৌঁড়ে ওয়াশরুমে গেলাম।তিহাম ভাইয়াকে কিভাবে বলবো যে আমিও তাকে ভালোবেসে ফেলেছি।অনেক আগেই।মনে হচ্ছে আমাকে পিটিয়ে তক্তা বানালেও এত বড় কথা মুখ দিয়ে বের হবে না।ফ্রেশ হয়ে নিচে নামলাম।
________________
বিছানায় শুয়ে আছি। রাত মোটামুটি অনেক হয়েছে।ভাবছি সামান্য সময়ের মধ্যে কি থেকে কি হয়ে গেল! সব এক মুহূর্তের মধ্যে পাল্টে গেল।সত্যি ভাগ্যের খেল বোঝার ক্ষমতা কারো নেই।
ভাইয়া আর ভাবী সন্ধ্যাবেলা তিথি আর ওর বরকে নিয়ে বরিশাল গেছে। উদ্দেশ্য দুই পরিবারকে বুঝিয়ে ধুমধাম করে বিয়ে দেয়া।কিন্তু সেই চকিত মুহূর্তের কথা আমার বার বার মনে পড়ছে। তিহাম ভাইয়া নিজের আত্মার ভেতর এতোখানি দম বন্ধ করা ভাব কিভাবে সহ্য করেছে?কেন জানি ওনার জন্য খুব মায়া হচ্ছে।
নিজের অজান্তেই অনেক আগে তাকে নিজের একলা রাজ্যের একজন করে নিয়েছি যে!ফোনটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে কল দিলাম।একবার রিং হতেই হুশ ফিরল।এ আমি কি করছি?আগ বাড়িয়ে কল দিচ্ছি? ছি!ছি!!দ্রুত কল কেটে দিলাম।প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কলার টিউন বেজে উঠল। মাথায় একটা চাটি মেরে কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা কানে নিয়ে চুপ করে রইলাম।
—‘এই পিচ্চি?’
একদম গুম মেরে আছি।জোরে নিঃশ্বাসও ছাড়ছি না তিহাম ভাইয়া টের পাবে ভেবে।বড্ড লজ্জা লাগছে। ইশ!যদি এই লজ্জা নামক নার্ভটাকে শরীর থেকে আলাদা করতে পারতাম!
তিহাম ভাইয়া নরম গলায় বললো,
—‘পিচ্চি, কথা বলবে না?’
আস্তে করে কোনোরকমে বললাম,
—‘বলছি তো!’
—‘ও আচ্ছা। বুঝেছি।আমাকে দাঁতের ডাক্তার, ওহ স্যরি।কানের ডাক্তার দেখাতে হবে।আমি অবাক হচ্ছি এটা ভেবে যে তোমার এই রাগী,জেদী,গুন্ডি টাইপ আচরণ হঠাৎ করে চেন্জ হয়ে ভিজে বিড়ালের মতো চুপসে গেল কিভাবে? ‘
ভ্রু কুঁচকে বললাম,
—‘কি!কি বললেন?আপনি কি?ভুঁতিহাস একটা!’
—‘হা হা।ভুঁতিহাস!ইউ নো,একবার এখানকার টিচার ভুঁতি হাসের বৈজ্ঞানিক নাম ধরেছিল। পেরেছিলাম না বলে মাঠের মাঝে কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখছিল।’
—‘পারবেন কিভাবে?আপনার মাথায় কিছু থাকলে তো।’
—‘পিচ্চি রে!তোমার মাথা থেকে আমার মাথা ন্যাচারালিই অনেক ভালো। কারন পুরুষের মাথার ঘিলুর ওজন হচ্ছে ৫০.২১ আউন্স, আর মেয়েদের ঘিলুর ওজন ৪৪.৫২ আউন্স। ‘
—‘কিন্তু মশাই, আপনার মাথায় ঘিলুর জায়গাতে তো ভুঁতিহাসের বিষ্ঠা আছে। ‘
—‘বলো বলো।আমার কাছে থাকলে এখনই এমন শাস্তি দিতাম যে তখন বুঝতে ঘিলুর জায়গায় কি আছে! ওয়েট ভুঁতিহাসের বৈজ্ঞানিক নাম হলো Aythya anser…..’
আমি শব্দ করে হেসে উঠলাম।তিহাম ভাইয়া লজ্জা মাখা কন্ঠে বললো,
—-‘সঠিক হয়নি?’
—-‘হুঁ।শুধু একটুখানি ভুল ছিল। Aythya ferina হবে।’
—‘তুমি ফিজিক্সের স্টুডেন্ট হয়ে এসব জানলে কিভাবে?’
—‘কলেজে থাকতে পড়েছিলাম। আচ্ছা, একটা কথা বলবো?’
—‘একটা কেন,এক ট্রাক বলো তবুও আমি শুনে বোর হবো না।’
—‘একটা গান শোনাবেন?’
—‘জীবনে প্রথম তুমি আমার কাছে কিছু আবদার করলে আর আমি না শুনিয়ে পারি?’
বলেই তিহাম ভাইয়া গান শুরু করলো।
“প্রাণ দিতে চাই,মন দিতে চাই,
সবটুকু ধ্যান সারাক্ষণ দিতে চাই,
তোমাকে।ওওওও তোমাকে।
স্বপ্ন সাজাই, নিজেকে হারাই,
দুটি নয়নে রোজ নিয়ে শুতে যাই,
তোমাকে। ওওওও তোমাকে।”
ফজরের আযানের শব্দ কানে যেতেই ফোন রাখলাম।কথা বলতে বলতে কখন যে ভোর হওয়ার সময় হয়ে গেছে খেয়ালে ছিল না।ওযু করে নামাজ পড়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম।মনের মধ্যে শরতের কাশফুলের পাপড়ি উড়ে যাচ্ছে দূর থেকে দূর আকাশে। ঠোঁটের কোনে হাসি ধরে রেখে চোখ বন্ধ করে কল্পনার রাজ্যে ডুব দিলাম।
নিস্তব্ধপুরীতে প্রবেশ করতেই দেখি হলুদ পাঞ্জাবি পড়া ছেলেটা একটা গাছের উপর উঠে পা নাচাচ্ছে। তার পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে ভ্রঁ কুঁচকে বললাম,
—‘এই কে,তুমি?এখানে কি করছো?’
ছেলেটা মুখ না ঘুরিয়ে বলল,
—‘এটা আমারো রাজ্য।কারণ তোমার যা তা আমারো।তাছাড়া তুমি নিজেই তো সম্পুর্নটা আমার।’
বলেই লাফ দিয়ে নিচে নামলো।তাকে দেখে আমি শুধু অস্ফুট সুরে বললাম,
—‘তিহাম ভাইয়া, আপনি?’
—‘তোমার সাহস তো কম না।আমাকে ভাইয়া বলছো?নাম ধরে ডাকবে আর তুমি করে বলবে।’
বলেই আমার হাতে টান দিয়ে সামনের দিকে হাঁটা ধরলো।বললাম,
—‘কোথায় যাচ্ছেন? ‘
—‘হুশ।একদম চুপ।তোমার চুল আজ শিউলি ফুল দিয়ে সাজিয়ে দিবো।’
দুজন হাঁটছি তো হাঁটছিই।হাঁটতে হাঁটতেই ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেলাম।
_____________
বিকেল বেলা নিচে সোফায় বসে টিভি দেখছি।আমান, মা ঘুমায়।আজ তিন দিন হলো ভাবী বাপের বাড়ি। তিথির বিয়ে কয়েকটা দিন পর।দুই পরিবার সানন্দে মেনে নিয়েছে।দরজায় কলিং বেলের শব্দে খুলে দেখি একটা ইয়া বড় পার্সেল এসেছে। তাও আবার নামে।সিগনেচার করে চারপাশে চোখ বুলিয়ে রুমে ঢুকলাম।দরজা আটকে……..
(চলবে)
আমি কিন্তু সবার কমেন্ট পড়ি!🥰