তুমি_নামক_ব্যাধি পর্ব ১৩+১৪

#তুমি_নামক_ব্যাধি
#মুন্নী_আরা_সাফিয়া
#পর্ব_১৩
___________

বিছানায় এসে গা মেলিয়ে দিলাম।জানি ঘুম আসবে না।তবুও অশান্ত মনকে শান্ত করার বিকল্প কোনো উপায় আমার জানা নেই।

মোবাইলের দিকে তাকিয়ে দেখলাম ১২ঃ৩৪ বাজে।সন্ধ্যাবেলা একবার গোসল করেছি। তবুও কেমন জানি অস্থির অস্থির লাগছে।পেটে দিয়ে বুঝতে পারলাম ক্ষুধা লাগেনি।কারণ ডিনার করেছি কয়েক ঘন্টা আগে।

বিছানা ছেড়ে উঠে লাইট জ্বালালাম। ঘুম আসবে না,শুধু শুধু শুয়ে থেকে লাভ নেই। আজ এত কাপ কফি খাওয়ার পরো আবার কফির তৃষ্ণা পাচ্ছে। কিন্তু নিচে গিয়ে বানানোর মুড নেই। তাছাড়া বাসায় এখন জ্বলজ্যান্ত লুচিয়া শয়তান ঘুরে বেড়ায়।কখন ঘাড় মটকাবে কে জানে!

আস্তে হেঁটে জগ থেকে মগে পানি ঢাললাম।তারপর টেবিলের উপরে থেকে কফির কৌটা নিয়ে দুই চামচ কফি,তিন চামচ কফিমেট, দেড় চামচ চিনি আর এক চিমটি লবণ দিলাম ঠান্ডা পানিতে।চামচ দিয়ে হালকা নেড়ে টাওয়াল আর ড্রেস নিয়ে ওয়াশরুমে গেলাম।

বেশ সময় নিয়ে শাওয়ার শেষ করলাম।মাথায় টাওয়াল পেঁচিয়ে বাইরে বের হলাম।অনেক প্রশান্তি লাগছে এখন।রুমের লাইট বন্ধ করে বেলকনির নীল আলো জ্বালালাম।কফির মগটা হাতে নিয়ে কাচ ঠেলে বেলকনিতে গিয়ে ডানদিকের কর্নারে রাখা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলাম।একলা একা রাত্রি বিলাসের জন্য আমি প্রস্তুত।

তিহাম ভাইয়ার তিথিকে লেখা চিঠিটা হুট করেই পড়তে ইচ্ছে করছে খুব।কিন্তু সেটাতো সম্ভব না।এতদিনে চিঠিটা কতদূর পৌঁছে গেছে কে জানে!!আচ্ছা, চিঠিতে কি এমন লেখা ছিল যে তিহাম ভাইয়া আমাকে এতবার পড়তে বলেছে?
_____________

তিহাম ভাইয়া আর আমি সামনাসামনি দাঁড়িয়ে আছি।তিহাম ভাইয়ার দুচোখ রক্তবর্ণ।আর আমার যে দুচোখে বিরক্তিতে ভরে থাকে সবসময়, সেখানে এখন রাজ্যের ভয়।কাচুমাচু হয়ে কিসের সাথে যেনো পিঠ ঠেকিয়ে ভয়ে কুঁকড়ে আছি।তিহাম ভাইয়ার হাতে কি যেনো একটা অস্ত্র দেখা যাচ্ছে। তিহাম ভাইয়া চিল্লাতে চিল্লাতে বলছে,

—‘তুই আমার ভালোবাসা গ্রহণ করবি কি না বল?বল তুই আমায় বিয়ে করবি কিনা?তুই আমার ভালো রুপ দেখেছিস, কিন্তু ভেতরের রুপ দেখিসনি।আমায় ভালোবাসবি কি না বল?নইলে তোকে এক্ষুনি জানে শেষ করে দিবো। আমার না হলে তোকে আর কারো হতে দিবো না।কথা বল?’

তিহাম হাতের অস্ত্রটি আমার দিকে তীব্র গতিতে উঠাতেই চিৎকার দিলাম।

নিজের দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখি আমায় বিছানার উপর বসে আছি।আমার পুরো শরীর কাঁপছে। তার মানে এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলাম?কি ভয়ংকর!

টেবিলের উপর থেকে জগ নিয়ে জগ ধরেই পানি খেলাম।বেলকনি দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলাম প্রচুর রোদ উঠেছে আজ।কত বেলা হয়েছে কে জানে!ওয়াশরুমে ঢুকলাম।

স্বপ্নটা কিছুতেই যেনো মাথা থেকে যাচ্ছে না।কিন্তু স্বপ্ন নিয়ে বিশেষজ্ঞরা অনেক কাঠ কয়লা পুড়িয়ে বের করেছে যে,

“সাধারণত স্বপ্ন দেখে ঘুম থেকে জেগে উঠার পাঁচ মিনিটের মধ্যে স্বপ্নের অর্ধেক আর দশ মিনিটের মধ্যে স্বপ্নের প্রায় ৯০% মানুষ ভুলে যায়।”

আমার ক্ষেত্রে এই থিওরী কাজে লাগছে না।আমার পুরোটা স্বপ্ন মনে আছে জেগে উঠার এক দেড় ঘন্টা পরো।কি করা যায়?

আমার রুমে বিশাল বড় দুইটা আলমারি ভর্তি শুধু বিভিন্ন লেখকের বই।কিছুক্ষণ খুঁজে বিদেশি এক লেখকের বই বের করলাম।বইয়ের নাম “স্বপ্নের আংশিক ধারণা “। মার্ক করা কিছু লাইন নজরে এলো।

‘একজন স্বাভাবিক মানুষ বছরে গড়ে এক হাজার ৪০৬ (প্রতি রাতে ৪ টি হিসেবে) স্বপ্ন দেখে।আমরা স্বপ্নে তাদেরকে দেখি যাদের আমরা চিনি।অনেক সময় স্বপ্নে অচেনা কাউকে দেখলেও সে আসলে আমাদের অনেক আগে দেখা ভুলে যাওয়া কেনো ব্যক্তি।তাছাড়া নাক ডাকার সময় মানুষ কোনো স্বপ্ন দেখে না।বেশিরভাগ সময় মানুষ ভোর রাতে অপেক্ষাকৃত বেশি স্বপ্ন দেখে।আর স্বপ্ন মা………………..’

দরজায় ঠকঠক আওয়াজ হচ্ছে। বইয়ের উপর থেকে চোখ তুলে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

—‘কে?’

—‘আমি’

মেয়ে মানুষের কন্ঠ শুনে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম।তিহাম ভাইয়া না তাহলে। দ্রুত দরজা খুলে সামনে তাকাতেই খুশিতে দুচোখ ঝলমলে করে উঠলো। জড়িয়ে ধরে বললাম,

—‘কেমন আছিস, তিথি?’

তিথি হেসে বলল,

—‘পাগল,ভালো আছি।তুই?’

—‘ভালো।’

নাকি সুরে বলে ওভাবেই জড়িয়ে ধরে রইলাম।তিথি বললো,

—‘এই বার তো ছাড়বি নাকি?’

—‘ছাড়বো না আমি।’

—‘রুমে যেতে দিবি না?দরজার বাইরেই দাঁড় করিয়ে রাখবি?’

ওকে ছেড়ে হাত ধরে বিছানায় বসালাম।বললাম,

—‘হুট করেই চলে আসলি যে।আগে থেকে জানাতে হয় না?’

—‘রওনা দেয়ার পর জানিয়েছি তো।জানিস সবাই কিন্তু এসেছে।আমার মা বাবা,তিহাম ভাইয়ার মা বাবা, তুহিন সবাই। ‘

—‘দারুণ। চল নিচে যাই।দেখা করি সবার সাথে। আহ্!আমার ক্ষুধাও লেগেছে প্রচুর।কয়টা বাজে রে?’

—‘তিনটা প্রায়।’

—‘হোয়াট?সর্বনাশ।আমি সেই রাতে ডিনার করেছি।আর নিচে নামিনি।সকাল বেলা কেউ হয়তো দরজা ধাক্কাচ্ছিল।আমি বলেছি খাবো না।কিন্তু আমি ভাবছি ওটা স্বপ্ন ছিল। চল চল।’

—‘তুই মানুষ হবি না।এই ঘুম তোর জীবন জিরা, মশলা, তেজপাতা সব করে দিল।চল।’
________________

নিচে নেমে সবার সাথে টুকটাক কথা বলে কিচেনে ঢুকলাম।তিথি,তুহিন,তিহাম ভাইয়াসহ সবাই হলরুমে বসে আছে। কালকের পর তিহাম ভাইয়ার সাথে আমার আর কথা হয়নি।চোখে চোখ ও পড়েনি।কারণ আমি ইচ্ছে করেই ওনার দিকে তাকাইনি।শুধু কন্ঠ শুনছি।কোনো হেলদোল নেই। সেই আগের মতোই প্রাণোচ্ছল।

অনেক আগেই সবার খাওয়া শেষ। সাথে আমারও।ফ্রিজ থেকে মিষ্টি বের করে খেয়ে হলরুমে এসে বসলাম তিথির পাশে। সন্ধ্যা নামার সময় হয়ে গেছে।বাবা,বড় ভাইয়া দিশান সবাই এখানে এখন।গল্পগুজব করছে।

একপর্যায়ে তিহাস ভাইয়ার বাবা সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললো,

—‘তিহামের ছুটি প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে।তিথি,তিহাম দুজনেই বড় হয়ে গেছে। এই মাসের মধ্যেই চার হাত এক করে দিতে হবে।’

বুকের ভেতর হঠাৎ করেই খচ করে উঠলো।পরমুহূর্তেই খুশি হলাম।তিথির বিয়ে হবে।দারুণ! তিহাম ভাইয়ার দিকে তাকাতে নিয়েও তাকালাম না।তার মুখের এক্সপ্রেশন দেখার তীব্র ইচ্ছে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দিলাম।

কিন্তু তিথির দিকে তাকালাম। ওর সারা মুখে লজ্জার আভা ছড়িয়ে পড়েছে। ওকে এই অস্থিকর অবস্থা থেকে বের করতেই ভাবীকে বলে দুজন উপরে উঠে আসলাম। নিচের কথাবার্তা আর কানে গেল না।

_____________

রাত প্রায় এগারোটা বাজে। হঠাৎ করেই শুনতে পেলাম তিহাম ভাইয়াকে নাকি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।সারা বাসার কোথাও নেই।ফোন দিয়েও নাকি পাওয়া যাচ্ছে না।ফোন বন্ধ বলছে।শুনেই আমার শরীর দিয়ে চিকন ঘাম বের হওয়া শুরু করলো।

সোফায় বসে পড়লাম। তিহাম ভাইয়া কোনো অঘটন ঘটালো না তো।এত বড় ছেলে কিভাবে এতটা অবুঝ হতে পারে ভাবতে পারছি না।চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে।কিন্তু আমি কোন অধিকারে কাঁদবো।চাপা কষ্ট চেপে রেখে নির্বিকার বসে আছি।সবাই দুঃচিন্তায় অস্হির হয়ে পড়েছে।

হঠাৎ ভাবী দৌঁড়ে এসে বললো,

—‘তিহাম ঠিক আছে। ওর কিছু হয়নি।হটাৎ করে ঢাকায় জরুরি কাজ পড়েছে। তাই বাইরে থেকেই চলে গেছে।তাই কাউকে বলার সময় পায়নি।আর ওর ফোনের চার্জ শেষ হয়ে গেছিল। তাই ফোন দিতেও পারেনি।’

ভাবী এক নিঃশ্বাসে বলে হাঁফাতে লাগলো। বুকের ভেতর থেকে ভয়ের দীর্ঘমশ্বাস টা বেরিয়ে আসল। যাক উনি ঠিক আছেন তাহলে।তবুও কোথায় যেনো খটকা লাগছে।মন মানতে চাইছে না।কেন জানি মনে উনি নিজেকে পালিয়ে রেখেছেন কোনো কিছু থেকে।

______________

তিথিরা আজ চলে গেছে। দুই দিন ছিল আমাদের বাসায়।তিহাম ভাইয়া আর আসেনি।ঢাকা থেকে হয়তো বাসায় গেছে। নাকি ঢাকাতেই আছে,তাও জানা নেই। বিয়ের ডেট এখনো হয়নি তিথির।তাই সবাই তাড়াতাড়ি গেল।অনেক কাজ করতে হবে বলে।

(চলবে)
#তুমি_নামক_ব্যাধি
#মুন্নী_আরা_সাফিয়া
#পর্ব_১৪
.

বিয়ের ডেট এখনো ঠিক হয়নি তিথির।তাই সবাই তাড়াতাড়ি চলে গেছে। অনেক কাজ বাকি।
______________

বিছানায় আধশোয়া হয়ে ল্যাপটপ নিয়ে বসে আছি।নিউজফিডে ঘুরতে ঘুরতে বোর হয়ে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট চেক করলাম।তিহাম ভাইয়া ৪ সপ্তাহ আগে রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে রেখেছে। দেখেছি অনেক আগেই।ফলোয়ার বানিয়েই রেখে দিয়েছি।মেসেজ রিকোয়েস্টের পরিমাণ আনটলেরেবল হয়ে গেছিল বলে ব্লক দিয়ে রেখেছি।

তিহাম ভাইয়ার আইডি তে ঢুকলাম।সব পাব্লিক করা।প্রোফাইল পিকটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম।ভাইয়ার ফ্যাশন সেন্স অনেক হাই।হতেই হবে।দীর্ঘ দিন হলো ফরেনে থাকে বলে কথা। তিহাম ভাইয়ার পিকটা দেখে মনে হচ্ছে আজ প্রথম দেখছি।অবসর সময়ে ওনার চেহারা মনে করার চেষ্টা করলে মনে পড়ে না।

কেন জানি ওনাকে এত দেখার পরো মনে হয় কাছ থেকে ভালোভাবে ওনাকে দেখাই হয়নি।অথচ কয়েক কিলোমিটার দূরে থেকে ওনার অবয়ব দেখেই বুঝতে পারি এটা উনি।ধুর! কি সব ভাবছি আমি!

আই ডি থেকে বের হয়ে ই মেইল চেক করতেই চমকে উঠলাম। কয়েক সেকেন্ড ধুম মেরে বসে রইলাম। নিজেকে কেমন অনুভূতি হীন মনে হচ্ছে। চোখ ল্যাপটপের স্ক্রিনে আটকে গেছে। কয়েক মিনিট পর হুশ ফেরায় দিলাম এক চিৎকার।

ল্যাপটপ ফেলে রেখে বিছানার উপর খুশিতে অনেক লাফালাফি করলাম।ওয়াশরুমে ঢুকে জোরে সোরে চিল্লানি দিয়ে মুখে পানি দিয়েবের হয়ে একদম শান্ত হয়ে গেলাম।ধীরে সুস্থে রুম থেকে বের হয়ে নিচে নামলাম।মা,ভাবী,আমান সবাই সোফায় বসে টিভি দেখছে। বিকেল হয়ে গেছে প্রায়।ভাইয়া আর বাবা এখনো ফেরেনি।আমাকে দেখে ভাবী মুচকি হেসে বলল,

—‘কি,ক্ষুধা লেগেছে তো?ক্ষুধা না লাগলে তো তুমি উপর থেকে নিচে নামো না সহজে।’

সোফায় ভাবী আর মায়ের মাঝে বসে বললাম,

—‘একটা ব্রেকিং নিউজ আছে। কেউ আবার কোনো ধরনের স্ট্রোক বা অ্যাটাক, ফ্যাটাক করবে না।আগে থেকে বলে রাখলাম।সো,কুল!!’

তিনজনই আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল।আমি ঠান্ডা গলায় বললাম,

—‘ইতালির University of Bologna থেকে ই-মেইল পাঠিয়েছে। আমি সিলেক্ট হয়েছি।সামনের মাসের মধ্যে যেতে হবে।’

চুপ করে আছে সবাই। আমি কি ভুল কিছু বললাম? হঠাৎ ভাবী আমাকে জড়িয়ে ধরে খুশিতে লাফাতে লাগলো।আমান আমার চারপাশে ঘুরছে খুশিতে।শুধু মায়ের চোখে জল দেখলাম।হয়তো আমাকে, নিজের নাড়িকে ছেড়ে এতদূর থাকতে হবে বলে কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে।

মায়েরা তো এমনই হয়।মাকে জড়িয়ে ধরলাম।মাকে এক পৃথিবীর চেয়ে বেশি ভালোবাসি।কিন্তু অন্যদের মতো তাকে খুব বেশি জড়িয়ে ধরা হয়নি।মা আমাকে ধরে কান্না করে দিল।আমি খুব স্বাভাবিক রয়েছি।কারণ আমার চোখের জল যে আমায় একা পেয়ে কুঁড়ে কুঁড়ে খায়।কারো সামনে নয়।

ভাবী ফোন হাতে নিয়ে ভাইয়ার নাম্বারে কল করতে করতে বললো,

–‘দিয়ানা,এত বড় একটা খুশির খবরে তুমি এতটা শান্ত কিভাবে থাকতে পারো?তোমার এতদিনের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে,অথচ তুমি কি ঠান্ডা রয়েছ। সত্যিই অবিশ্বাস্য। ‘

ভাবী একে একে সবাইকে ফোন দিয়ে বলা শুরু করল। আমি শুধু বাবা,আর বড় ভাইয়ের সাথে কথা বলে উপরে চলে আসলাম। অনলাইনে ঢুকলাম না।সবাই জ্বালিয়ে খাবে।আমার ফ্রেন্ড জাকিয়ার কাছে খোঁজ নিয়ে জানলাম যে ভার্সিটি থেকে শুধু আমি একাই ইতালিতে পড়ার সুযোগ পেয়েছি।

ইতালি!!মনে মনে আরেক বার উচ্চারণ করতেই মাথা খারাপের মতো অবস্থা হলো।খুশিতে তিহাম ভাইয়ার কথা তো ভুলেই গেছিলাম। কি হবে এখন?বাবা, মা তো নিশ্চয়ই পরিচিত মানুষ রেখে আমায় একা একা রাখবে না বিদেশে। তাছাড়া আমি একা একটা মেয়ে মানুষ। কি হবে এখন?

দৌঁড়ে নিচে নেমে ভাবীকে জিজ্ঞেস করলাম তিহাম ভাইয়ারা ইতালির কোথায় থাকে?শুনে নিস্তেজ হয়ে গেলাম।কারণ তিহাম ভাইয়ারা Bologna শহরে দীর্ঘদিন ধরে থাকে।ভাবিসহ মা খুশিতে আত্মহারা অবস্থা।

এতক্ষণ আমার সেফটি নিয়ে তাদের মনে যে পাহাড় সমান ভয় ছিল তা এখন সমতলকেও হার মানিয়েছে।কিন্তু ভয়ের দানা বেঁধেছে আমার নিজের মনে।পরমুহূর্তেই মনে হলো তিহাম ভাইয়া তো বিয়ে করবেই।বিয়ে করলেই ঠিক হয়ে যাবে সব।

_________________

আমার বিদেশ যাওয়ার প্রতিটা জিনিস তোড়জোড় করে কেনা শুরু হয়ে গেছে। যদিও এখনো ২৩ দিন বাকি আছে যাওয়ার।সামনের মাসের ১৭ তারিখে ফ্লাইট আমার।তিথির বিয়ের কোনো খবর পাচ্ছি না।দাওয়াত দিবে না নাকি?কে জানে!!তিহাম ভাইয়া সেই যে রাতের বেলা আমাদের বাসা থেকে চলে গেছে। আর আসেনি।

সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো সেদিনের পর থেকে আর ম্যাসেজ, কল বা কোনো ধরনের খোঁজ নেয়নি আমার।আমি যে ইতালিতে চান্স পেয়েছি সেটা জানার পর ও কোনো যোগাযোগ করেনি।নাকি জানে না?সেটা কিভাবে সম্ভব? অবশ্যই জানে।হয়তো দিয়ানা নামের ভূতটা মাথা থেকে নেমেছে। স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেললাম।
___________

গভীর রাত মনে হচ্ছে। মোবাইলে তাকিয়ে দেখলাম ১২ঃ৩১ মিনিট।মোটামুটি ভালোই রাত হয়েছে।ঘুম আসছে না।কারণ সারা বিকেল ঘুমিয়ে কাটিয়েছি।বিছানা ছেড়ে উঠলাম।।

আলমারি থেকে সব বইয়ের নাম বেছে বেছে বিদেশি লেখক হেনরি হ্যাগার্ড এর “দি ব্রেদরেন” বইটি হাতে নিলাম।সেবা প্রকাশনী থেকে বাংলা অনুবাদ করা।বহু বার পড়েছি।তবুও পড়তে অনেক ভালো লাগে। স্টোরিটা জাস্ট অসাধারণ!! রোজামুন্ড,উলফ্ আর গডউইন এর নানা সাহসিকতা,প্রেম, ভালোবাসা,যুদ্ধ সব মিলিয়ে বইটা হাজার বার পড়ার যোগ্য। বিছানায় শুয়ে পড়া শুরু করলাম।

কতক্ষণ কেটে গেছে জানা নেই। দরজায় ছিটকিনি লাগানোর শব্দে ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকাতেই জমে পাথর হয়ে গেলাম।নড়ার শক্তি নেই। ওই অবস্থায় নিশ্চল হয়ে তাকিয়ে আছি।আমার সামনে তিহাম ভাইয়া। দরজায় ছিটকিনি লাগিয়ে তার গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অনেক গম্ভীর ভাবে।

আমার মাথা কাজ করা শুরু করতেই উঠে বিছানায় পায়ে ভর দিয়ে বসলাম।বইটা বন্ধ করে মোবাইলে তাকালাম।১ঃ০৩ বাজে।বই পড়তে পড়তে হয়তো টায়ার্ড হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি আর স্বপ্ন দেখছি।

তিহাম ভাইয়া কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আশপাশে চোখ বুলিয়ে সোফায় বসলো।প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ওখান থেকে উঠে এসে বিছানায় বসলো।আমার দিকে তাকিয়ে বললো,

—‘তার মানে তুমিও আমার মতো রোজ আমায় স্বপ্ন দেখো?আর এখন আমায় স্বপ্ন ভেবেই চুপ করে আছো, তাই তো?তাহলে আমাকে মেনে নিতে এত কেন কষ্ট হয়?’

ঘোর কেটে গেছে। হাতে চিমটি দিলাম।স্বপ্ন নয় তার মানে!মুহূর্তে চোখ ধ্বক করে জ্বলে উঠলো। আর তার সাথে মন কৌতূহল আর বিস্ময়ের সাগরে হাবুডুবু খাওয়া শুরু করলো। হাত বাড়িয়ে আমি টেবিল থেকে জগ নিয়ে পানি খেলাম। তিহাম ভাইয়া বললো,

—‘দিয়ামনি,তুমি চাইলে চিৎকার, চেঁচামেচি করতে পারো!তাহলে আজ রাতেই তোমাকে বিয়ে করে সম্পূর্ণ আমার করে নিয়ে যাবো।”

এত রাতে একলা একটা মেয়ের ঘরে একলা একটা ছেলে আসলে ভয়ে হাত পা কাঁপা কাপি করার কথা। কিন্তু আমার ভয় লাগছে না।যেটা লাগছে সেটা হলো প্রচন্ড রাগ।কিন্তু চেঁচামেচি করতে পারছি না।কারণ বিবেকের কাছে আমি বাঁধা।আমি চাই না তিহাম ভাইয়ার এসব পাগলামো কেউ জানুক।সুস্থ মতো তিথির সাথে বিয়েটা মিটে গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।আমি জানি তিথি এই বজ্জাত টাকে পাগলের মতো ভালোবাসে।

তিহাম ভাইয়ার কন্ঠ কানে গেল। বললো,

—‘কোনো অযথা প্রশ্ন করো না প্লিজ।আমি কেন আসলাম,কিভাবে আসলাম এত রাতে ওসব জিজ্ঞেস করো না।শুধু বলি যে আমান ছাড়া একটা কাক পক্ষীও জানে না আমি এসেছি।তোমায় কিছু কথা বলবো।কিন্তু তুমি তো আমায় তোমার ধারে কাছেও ঘেঁষতে দাও না।তাই রাতের বেলা এসেছি। ‘

কন্ঠে বিষ ঢেলে শুধু বললাম,

—‘কি বলবেন?কি বলার আছে আপনার?’

তিহাম ভাইয়া বললো,

—‘অনেক কিছু।প্রথমত,আমি আগামী কাল রাত তিনটার ফ্লাইটে ইতালি ফিরে যাচ্ছি।’

চমকে তাকালাম মুখের দিকে।বিস্ফারিত কন্ঠে বললাম,

—‘সেকি?কেন?তিথিকে বিয়ে করবেন না?আর আপনার ছুটি তো এখনো দুই মাসের মতো বাকি।তাহলে?’

—-‘আমি তিথিকে বিয়ে করবো না।কিন্তু বাসা থেকে প্রেশার দিচ্ছে। আমি জানতাম এরকম হবে।তাই ওই দিনই ঢাকা গিয়ে যাওয়ার বন্দোবস্ত করে এসেছি। তবে কাউকে সরাসরি বলিনি যে আমি তিথিকে বিয়ে করবো না।শুধু তিথিকে বলেছি আজ সন্ধ্যায়।’

—‘কি?কেন করলেন এই কাজ?হোয়াই?আপনি জানেন তিথি আপনাকে কতটা ভালোবাসে?’

—-‘জানি এবং আমি ওকে এতগুলো বছর ভালোবাসার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি।কিন্তু পারিনি। কাল রাতে আমি চলে যাবো। সেজন্য তোমার সাথে দেখা করতে এসেছি। তুমি কি বুঝতে পারছো যে আমি তোমাকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করতে পারবো না?’

—‘কি?’

—‘আমি বলছিলাম যে আমি তোমাকে ভালোবাসি।আর তোমাকে ছাড়া অন্য কাউকে নিজের জীবন সঙ্গী করতে পারবো না।আর আমার চিরকুমার বা দেবদাস হওয়ারো বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। প্রয়োজনে তোমাকে কিডন্যাপ করে বিয়ে করবো।সো,তোমাকে ওয়ার্নিং দিতে এসেছি যে আজ থেকে তোমার সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে শুধু আমার বসবাস থাকবে এবং তুমি শুধু আমার কথাই ভাববে।ইজ ইট ক্লিয়ার?’

—‘মামার বাড়ির আবদার!!এক্ষুনি রুম থেকে বের হন।আর সকাল বেলা আমানের যে কি হাল করবো তা আমি নিজেও জানি না।’

—‘আমানকে কিছু বলতে গেলে তুমি নিজেই ফেঁসে যাবে।তার চেয়ে বেটার হবে ওকে না ঘাটানো।আমি বরং কাল ইতালি গিয়ে তোমার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করবো।’

—‘দেখুন আমার রাগ উঠাবেন না।বেরিয়ে যান আমার বাসা থেকে। কেউ যেনো জানতে না পারে।যেভাবে এসেছেন সেভাবে চলে যাবেন।’

—‘দেরি হবে আমার যাওয়া। অনেক দিন তোমায় দেখতে পাবো না।দেখতে দাও আজ মন ভরে।’

কপাল কুঁচকে তাকালাম।নিজেকে রাগকে আর কন্ট্রোল করতে পারছি না।তবুও নিজেকে সংযত করে নরম গলায় বললাম,

—‘ভাইয়া, একটু বোঝার চেষ্টা করুন।জীবন তো দাবার গুটি নয় যে যা তা খেলবেন।আর হেরে গেলেন তো হেরে গেলেন!নাহ।তা নয়। জীবন অনেক জটিল একটা বিষয়। এর প্রতিটা পদক্ষেপের সিদ্ধান্ত অনেক ভেবে চিন্তে নিতে হয়। একটা অনুরোধ করবো।আপনি প্লিজ তিথিকে বিয়ে করুন।প্লিজ তিথিকে বি…………..’

—-‘শাট আপ।জাস্ট কিপ ইয়োর মাউথ শাট!’

তিহাম ভাইয়ার ধমকে থেমে গেলাম।উনার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখি ওই দিনের মতো দুচোখ রক্তবর্ণ হয়ে গেছে। আমার দুহাত চেপে ধরে বললো,

—‘তিথির জন্য খুব দরদ,নাহ!আর আমার দিকে একবার ফিরেও তাকানো হচ্ছে না।কেন?হোয়াই?আমি কি এতই অবহেলিত? কেন তুমি আমাকে বোঝার ট্রাই করছো না?কেন অন্য সবার কষ্টকে দেখতে পাচ্ছো অথচ আমার কষ্ট বোঝা তো দূরের কথা, একবার ফিরেও তাকাও না?হোয়াই?তুমি জানো এই কয়েক দিন আমার উপর দিয়ে কি গেছে??কতটা অসহায় মনে হয়েছে নিজেকে?

তোমার সামনে আসিনি এই ভেবে যে হয়তো আমার অনুপস্থিতিতে তুমি আমাকে একটু বুঝতে পারবে।বাট আ’ম টোটালি রঙ।তুমি তিথি তিথি করে উঠে পড়ে লেগেছো। কেন আমাকে তোমার কি মানুষ বলে মনে হয় না?আমার কষ্ট কি কষ্ট না?(একটু থেমে)তুমি জানো,যখন আমি শুনতে পেলাম যে তুমি Bologna ইউনিভার্সিটিতে চান্স পেয়েছো, আমি কি পরিমাণ খুশি হয়েছিলাম?

আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে আমার থেকে তোমাকে কিছুতেই দূরে যেতে দিব না।ফোর্স করে হলেও তোমাকে আমার কাছে রাখবো এন্ড ইটস মাই ফাইনাল ডিসিশন। এখন এই মুহূর্ত থেকে তুমি শুধু আমার কথা ভাববে।আন্ডারস্ট্যান্ড? ‘

আমার দুহাত ঝাঁকিয়ে বললো।আমি নিচু মাথা উঁচু করে তাকিয়ে দেখলাম তিহাম ভাইয়া রাগে ফোঁস ফোঁস করছে।মেজাজ খারাপ হয়ে গেল।শক্ত গলায় বললাম,

—‘আমার হাত ছাড়ুন।আর আজকের পর থেকে আপনাকে সচেতন মনে তো দূরের কথা অবচেতন মনকেও ভাবতে দেব না। ইউ আর ডেড টু মি!’

ঠাস করে থাপ্পড়ের শব্দ কানে আসতেই গালে হাত দিলাম।তিহাম ভাইয়া আমার গালে থাপ্পড় মেরেছে? অবাক হয়ে তাকাতেই উনি আমাকে বিছানায় শক্ত করে চেপে ধরে আগুন ঝরানো কন্ঠে বললো,

—‘আমার কথা ভাববি না?এখন তোর এমন হাল করবো যে আজকের পর থেক প্রতিটা মুহূর্ত শুধু আমার কথাই ভাববি!আমি না থাকলেও তোর সব জুড়ে শুধু আমার রাজত্ব থাকবে।’

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here