কলঙ্ক পর্ব ৩

#কলঙ্ক
#৩য়_পর্ব
#অনন্য_শফিক



বাবা কম্পিত গলায় মাকে বললেন,’আমেনা, তুমি না গোনাহ হবে এই ভয়ে একটা পিঁপড়াও মারো না এখন কী করে বলছো একটা রক্ত মাংসের আস্ত মানুষ মেরে ফেলতে?’
মা উত্তেজিত গলায় বললেন,’এখন সাত পাঁচ ভাবলে হবে না। আগে মান সম্মান রক্ষা হোক।মান সম্মান না বাঁচলে আবার কিসের জীবন!’
কথাগুলো বলে আবার মা কেঁদে উঠলেন।আর আমার পিঠে কিল বসিয়ে দিতে দিতে বললেন,’কেন এসব করলি তুই?কেন করলি?’
আমি চুপ করে আছি। এখন আর কাঁদতেও পারছি না।চোখ শুকিয়ে গেছে। তবে ভেতরটা কাঁদছে। খুব করে কাঁদছে।আর মনে পড়ছে আমানের কথা। আমানকে এখনও আমি পুরোপুরি দোষী ভাবতে পারছি না।ভাবতে কষ্ট হচ্ছে।আমি বরং নানান যুক্তি দাঁড় করাচ্ছি।এমনও তো হতে পারে আমান নিজেকে যোগ্য করে তুলতে আমেরিকা চলে গেছে। ওখান থেকে অনেক টাকা পয়সা অর্জন করে দেশে আসবে। তারপর আমায় চমকে দিয়ে আমার সামনে এসে হুট করে উপস্থিত হবে। তারপর বলবে, চলো।
আমি বলবো, কোথায়?
সে বলবে, আমাদের বাড়িতে।
তারপর বাড়ির সবাই আমায় বরণ করে নিবে।আর এর কদিন পরই আমান আমায় নিয়ে আমেরিকায় উড়াল দিবে!

আরেকটা দিন আমি মাকে নিয়ে হসপিটালে কাটালাম।বাবা গেলেন ফুলপুরে। ওখানে গিয়ে আমানদের বাড়ির ঠিকানা খুঁজলেন। কিন্তু কোন ভাবেই ওদের খোঁজ খবর বের করতে পারলেন না ‌। অবশেষে ব্যর্থ মানুষের মতো তিনি ফিরে এলেন হসপিটালে।

ঠিক হলো এবরোশন করা হবে। আমার পেটের ভেতর থাকা বাচ্চাটা নষ্ট করে ফেলা হবে।মেরে ফেলা হবে ওকে।ভাবতেই আমার ভেতরটা কেঁপে উঠছে।মনে হচ্ছে এমন পাপ করার চেয়ে দোযখ লাভ অনেক ভালো!
আমি কেঁদে ফেললাম। কাঁদতে কাঁদতে মাকে বললাম,’ওমা,কী সব করতে চাইছো তোমরা?আমি মানবো না মা। কিছুতেই মারতে দিবো না ওকে!’
মা তার মুখটা ভেঙচিয়ে আমার গালে একটা শক্ত করে চড় দিয়ে বললেন,’হারামজাদি বেহায়া মাইয়া! লজ্জা করে না তোর এইসব বলতে! সন্তান জন্ম দিলে এই সন্তানের পরিচয় দিবি কী? মানুষ তো জানতে চাইবো সন্তানের বাপ কে?তুই কী বলবি?বাপ নাই?বাপ ছাড়া সন্তান জন্ম দিছস?তোর এই কলঙ্ক নিয়ে তুই কই যাবি?কে তোরে গ্রহণ করবো?’
আমি হাউমাউ করে কাঁদছি।আর নিজের চুল নিজেই টেনে ছিঁড়ে ফেলছি।
মা বললেন,’ভুল করার পর এইসব করে লাভ নাই। এখন ঠান্ডা হ।একটু পর নার্স আসবো।তোর এবরোশন হবে।এটাই ফাইনাল।’
বাবাও কিছু বলছেন না।চুপ করে আছেন। তাকে দেখে বোঝা যায় তিনিও নিরুপায়।সত্যি কথা বলতে বাবা মা দুজনেই একটা অনাগত সন্তানের জীবন নাশের চেয়ে তাদের কিংবা আমার ইজ্জত-সম্মান বাঁচানো নিয়েই ব্যস্ত!
আমি বাবাকে এবার ডেকে উঠলাম। কেঁদে কেঁদে বললাম,’বাবা,ও বাবা, তুমি মাকে বুঝিয়ে বলো না প্লিজ!আমি কী করে আমার এই ক্ষতিটা করবো?’
বাবা তার চোখ মুছতে মুছতে কেবিন থেকে বেরিয়ে চলে গেলেন বাইরে।আমি জানি তিনি সত্যি সত্যি নিরুপায়।তার কিছুই করার নাই। কারণ তাকে সমাজে বসবাস করতে হবে।আর সমাজে বাস করতে হলে এমন দু চারটা প্রাণ নাশ কোন ব্যপার না! এইসব প্রাণ নাশের চেয়ে নিজেদের সম্মান বাঁচানো বেশি জরুরি!

নার্স এসে গেছে।ওরা আমায় কোথায় যেন নিয়ে যাবে।অন্য কোন রুমে।ওখানেই এবরোশন করবে।আমি এবার চিৎকার করে কেঁদে উঠেছি। মার হাতটা শক্ত করে ধরে অনুনয় করে বলছি,’ওমা,মাগো,ওমা, তোমার পায়ে পড়ি গো মা! তুমি আমার এই ক্ষতিটা করো না!’
মা কাঁদছেন। কেঁদে কেঁদে নার্সদের বলছেন,’যাও।তোমরা ওকে নিয়ে যাও।’
আমি জান প্রান ছেড়ে চিৎকার করে বললাম,’না।আমায় তোমরা নিয়ে যাবে না।’
ওরা আমার কথা শোনলো না।ওরা আমায় নিয়ে যেতে লাগলো টেনে টেনে।একটা নার্স আমার দিকে তাকিয়ে মুখটা কেমন করে উঠে বললো,’আকাম যখন করছিলেন তখন খেয়াল আছিলো না! ছিঃ ছিঃ ছিঃ! এখন আবার গলা ছাইড়া চিৎকার করেন!’
আমি বললাম,’চুপ করো বলছি।যা তা বলছো!’
ওই নার্স আমার দিকে তাকিয়ে তার কানে হাত দিয়ে বললো,’তাওবা তাওবা!আস্তাগফিরুল্লাহ! এই তো দেখি চোরের মায়ের বড় গলা।নষ্টামি করে পেট বাঁধাইলেন আপনি। এখন দোষ আমার!’
‘নষ্টামি করেছি মানে?’
‘নষ্টামি না করলে পেটে বাচ্চা আসলো কেমনে?গায়েব থাইকা?’
আমার যা রাগ পেলো এবার!আমি ওকে ধমক দিয়ে বললাম,’একদম চুপ করো স্টুপিড।’
নার্স মেয়েটা খিলখিল করে হেসে উঠে অপর নার্সটিকে বললো,’মেডামের রাগ পাচ্ছে। আহারে আহারে!’
তারপর দুজন নার্সই হি হি হি করে হেসে উঠলো।

আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো হসপিটালের একটা পরিত্যক্ত এবং অন্ধকার প্রকোষ্ঠে। ওখানে এক গাইনি মহিলা ডাক্তার এসেছেন।এই ডাক্তারের মুখের ভাষা আরো বিচ্ছিরি!
আমার খুব খারাপ লাগছিলো তখন।ভাবতেও কষ্ট হচ্ছিল আমার নিজের সন্তানকে আমিই খুন করতে সাহায্য করছি! এই জন্য আমি কাঁদতে কাঁদতে ডাক্তার মহিলার পায়ে পড়ে গেলাম। বললাম,আপু,প্লিজ!আল্লার দোহাই লাগে, আপনি আমার অত বড় ক্ষতিটা করবেন না!’
ডাক্তার মহিলা ধমক দিয়ে বললেন,’চুপ।একদম চুপ। আপনার কোন কথা আমি শুনতে পারবো না। আপনার গার্ডিয়ান যা বলেছে তাই করতে হবে আমার!’
আমি কী করবো আর।চোখ বন্ধ করে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলাম।

এবরোশন ব্যপারটা যতটা সহজ মনে করতাম আমি ততটা সহজ না। খুব কঠিন।ডাক্তার যখন কাজ শুরু করলো তখন আমার কষ্ট হচ্ছিল।ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে আল্লাহকে ডাকতে লাগলাম আমি।আর কেবল তখন মনে হচ্ছিল আমার চেয়ে তো আমার সন্তানটা কষ্ট পাচ্ছে বেশি!জীবন্ত শিশুটাকে তো ওরা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারছে। এই শিশুর আর্তনাদ আমি শুনতে পাচ্ছি। স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি। সেই শিশুর কান্না কিংবা আর্তনাদ যেন আমার কানে না আসে তাই আমি
চিৎকার করতে লাগলাম।
ডাক্তার তখন ধমক দিলেন আমায়। বললেন,’চুপ করুন বলছি।’
কিন্তু আমি কিছুতেই চুপ করতে পারছিলাম না।ব্যথায় কঁকিয়ে উঠতে লাগলাম বারবার।
ডাক্তার এবার বললেন,’আপনাদের মতো মেয়েদের পৃথিবীতে থাকার চেয়ে না থাকা ভালো।বাপ মায়ের মুখে চুনকালি দিয়ে আবার চেঁচাচ্ছেন! তখন হুঁশ ছিল না যখন প্রেমিকের সাথে ওইসব করেছিলেন?’
আমি চাপা রাগ নিয়ে বলতে চাইছিলাম ,’আপনি ভুল বুঝছেন।আমি কোন প্রেমিকের সাথে নোংরামো করিনি।এই সন্তানের বাবা আমার স্বামীই!’
কিন্তু এই কথাটা আমি বলতে পারলাম না।এর আগেই তীব্র ব্যথায় আমার এক পাটির দাঁতের সাথে অপর পাটির দাঁত লেগে গেল।সারা শরীর কাঁপতে লাগলো।মনে হলো এক্ষুনি আমি সেন্সলেস হবো।এর ঠিক পাঁচ মিনিট পর আমি সেন্সলেস হলাম!

সেন্স ফেরার পর দেখি আমি সেই আগের কেবিনে। আমার সারা শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে।মাথা ভার হয়ে আছে। পেটে তীব্র ব্যথা।মা আমার সামনে বসে আছেন।বাবা বিছানার একপাশে ক্লান্ত হয়ে ঘুমাচ্ছেন।
কী মনে করে হঠাৎ পেটের উপর হাত দিলাম।আজ সকাল বেলায়ও যে পেটখানা ভরা ছিল সেই পেট এখন খালি!
আমি গলা ছেড়ে কেঁদে উঠলাম। কাঁদতে কাঁদতে বললাম,’মা,আমি ওকে ছাড়া কীভাবে বাঁচবো!’
মা বিরক্ত মুখে বললেন,’আর ভালো লাগছে না কিন্তু। আরেকবার যদি সন্তান নিয়ে কিছু বলবি তবে কিন্তু তোকে এখানে ফেলে রেখে আমরা চলে যাবো!’
মার কথাটা শুনে ভয়ে আমার শরীরটা জমে উঠলো! আমার নিজের জন্মদাত্রী মা কীভাবে এমন নিষ্ঠুর একটা কথা বলতে পারলেন!

হসপিটাল থেকে ছুটি দিলে মা বাবা আমায় নিয়ে বাড়ি চলে গেলেন। তারপর মা চারদিকে ঘটকদের লাগিয়ে দিলেন—–

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here