#মুক্ত_পিঞ্জিরার_পাখি
#Ipshita_Shikdar
#পর্বঃ১১
৩৩।
“কী করছো তুমি এই সময়ে?”
আরিজের প্রশ্নটা শুনে চমকে উঠে পক্ষী। সেই সাথে বেশ ভয়ও পায় যে এই ঘরেত আলমারিতে তার কাপড় রাখতে দেখে যুবক কিনা বলে উঠে…
আনমনেই ভাবে সে,
“এখন কী আরিজ সিরিয়ালের স্বামীদের মতো আমায় অপমান করবে? বলবে আমি লোভী তার উপর অধিকার জমানোর পঁয়তারা করছি? নাকি আমাকে…. ”
তার ভাবাভাবির মাঝেই আরিজ আরেকদফা একই বিষয়ে প্রশ্ন করে বসে। উত্তরে যুবতী কিছুটা আমতা আমতা করে বলে,
“আসলে… আসলে আমি কাপড় রাখছিলাম আলমারিতে।”
“এটা বলতে এতক্ষণ লাগে! যাই হোক আমি ওজু করে আসি, এখনই আজান দিবে।”
পক্ষী তো অবাক আরিজের উত্তরে। তবুও বিস্ময় কাটিয়ে আলতো গলায় “হুম” বলে নিজের কাজ করতে শুরু করে। আরিজ ওয়াশরুম থেকে বের হলে পক্ষী নিজেও সালাতের জন্য পবিত্র হয়ে আসে। অতঃপর পক্ষী ঘরে সালাত আদায় করে নেয়, আর আরিজ যায় মসজিদের উদ্দেশ্যে।
নামাজ শেষ করে পক্ষী রান্নাঘরে দৌড় দেয়, চা বানিয়ে ফ্ল্যাস্কে রাখে এবং নাস্তাও বানিয়ে ফেলে। তারপর বেডরুমে এসে আরিজের জামা-কাপড় বের করে রাখে। বিয়ের বেশ কয়েকদিন হয়ে গেলেও আজই প্রথম নিজেকে বিবাহিত বলে মনে হচ্ছে যুবতীর। এ নিয়ে অনেক ভালো লাগার মাঝে কাজ করছে ভীতি। এই ভীতি আরিজের প্রতিক্রিয়ার।
৩৪।
আরিজ প্রিয়ার জন্য অপেক্ষা করছে, এই ভোরের স্নিগ্ধ সময় দু’জন একসাথে হাঁটাচলার মাঝে কথোপকথন করতে অভ্যস্ত। প্রায় পনেরো মিনিট পর প্রিয়া বের হয়ে আসে। তার পরনে একটা সেমিলং টপ ও প্লাজু। চুলগুলো উঁচু করে ঝুঁটি করা। যুবকের নিকট তাকে আকর্ষণীয় লাগলেও পক্ষীর মাঝে যে স্নিগ্ধতা খুঁজে পায় তা যেন এই প্রান্তে নিখোঁজ।
নিজেকে এভাবে পর্যবেক্ষণ করতে দেখে প্রিয়ার ভ্রুজোড়া কিঞ্চিৎ কুঁচকে আসে। খাণিক জোরেই ডাক দিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“কী হয়েছে? এভাবে দেখছো কেন?”
আরিজ কিছুটা হচকচিয়েই যায়। তারপর অস্বস্তি নিয়ে উত্তর দেয়,
“কিছু না। চলো, এদিকটায় হাঁটি। বাসায় ফিরতে হবে আবার।”
“হুম।”
সবসময়কার মতো বিভিন্ন কথাবার্তার মধ্য দিয়ে তাদের সকালের হাঁটাচলা শেষ হয়। অবশেষে সময় হলো দু’জনের নিজ নিজ অবস্থান তথা বাড়িতে ফিরার। সাধারণত এই সময় প্রিয়াকেই ঠেলে আরিজকে পাঠাতে হয়। কিন্তু আজ প্রিয়াকে অবাক করে দিয়ে আরিজ বলে উঠে,
“বেশ সময় হয়েছে, প্রিয়। এখন চলি, তুমিও বাড়ি যাও।”
যুবতীর খুব অভিমান হচ্ছে, তা কী যুবকটা বুঝতে পারছে! হয়তো না, তাই তো কথাটি বলে তার উত্তরের অপেক্ষা না করেই বিপরীত পথে চলতে শুরু করেছে। সে তো জানে কাঙ্ক্ষিত মানুষের অনাকাঙ্ক্ষিত আচারণ কতটা হৃদয়ঘাতক।
আচমকাই চেনা ভয়ে কেঁপে উঠে প্রিয়ার প্রেমময়ী মন।
“যুবকের হৃদয়ের ধুলোময় ভূমিতে আমার অস্পষ্ট ভাবে লিখা নামটা কি মুছে যাচ্ছে না কারো মনসাগরের স্রোতে?”
রাজ্যের অন্ধকার ছেয়ে যায় অপরূপা যুবতীর মুখশ্রীতে। খুব করে ইচ্ছে হচ্ছে রমণীর যে কেউ এসে হাতটা নিজের হাতের মাঝে নিয়ে মাথাটা নিজের কাঁধে নিয়ে কপোলে নিজের উষ্ণ স্পর্শ নিয়ে শীতল গলায় বলুক “আছি তো পাশে, চিন্তা কীসের তবে!”। কিন্তু এ শহরে যে এমন মানুষ পাওয়া বড়োই কঠিন সাধ্য কাজ।
৩৫।
“আসসালামু আলাইকুম।”
ঘরে ঢুকতেই এমন মধুময় নারী গলায় সালাম শুনে বিস্মিত হয় আরিজ। তবে বেশ দ্রুতোই তা কাটিয়ে উঠে যেই কাঙ্ক্ষিত নারীটিকে উত্তর দিতে সামনে তাকিয়েছে তখনই তাকে ঘিরে ধরে একরাশি হতাশা। কারণ পক্ষী প্রকৃতপক্ষে তাকে ফোনে কথা বলার শেষমুহূর্তে অন্যকাউকে উদ্দেশ্যে করে বলেছে, আর এখন হাসি মুখে ফোনটি কান থেকে নামাচ্ছে।
আপন মনেই ভেবে উঠে সে,
“এত সুন্দর সালামের শ্রোতা আমি না হয়ে অন্যকেউ হলো কেন! ব্যাপারটা মানতে পারছি নাই বা কেন! নাকি অধিকারটা প্রকৃতপক্ষে আমার ছিল বলেই ভেবে বসে আছি!”
এর মাঝে শ্যামাঙ্গি নারীটির বোধ হয় একজন ঘরে ঢুকেছে। কাঙ্ক্ষিত পুরুষকে দেখে কপোলে ঘামই জমে যায় তার, কারণ সে কিছু বলতে চাচ্ছে তবে কথাটার প্রতিক্রিয়া নিয়ে বেশ দ্বিধান্বিত সে।
আরিজের ভ্রু জোড়া কুঁচকে আসে পক্ষীর মুখভঙ্গিমায় এবং এভাবে তার দিকে তাকিয়ে থাকায়। খাণিক গলা খাঁকারি দিয়ে জিজ্ঞেস করে উঠে,
“কী হলো! কিছু বলবে আমায়?”
বলার সুযোগ পেয়ে আর হাত ছাড়া করতে মন চাইলো না শ্যামাঙ্গিনীর। আমতা আমতা করেই বলল,
“না মানে আপনার বাইরে পড়ার কাপড়… মানে আপনার কাপড়চোপড় বের করে রেখেছিলাম।”
কথাটা বলে পক্ষী চোখজোড়া তুলে সামনে তাকাতেই দেখে যুবক ভ্রুজোড়া কুঁচকে গম্ভীর ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে। শুকনো ঢোগ গিলে সে। পুনরায় বলতে লাগলো,
“আসলে আমি না… আন্টি না মানে খালা…”
আর কিছু বলার পূর্বেই নিজের তর্জনী ও মধ্যমা আঙুল দ্বারা যুবতীর নরম অধরসুধা চেপে ধরে আরিজ। এ দুটোর ছটফটে ভাব দেখে যে ঝড় বয়ে যাচ্ছিলো যুবকের হৃদমাঝে।
আরিজ অধরজোড়া থেকে তীক্ষ্ম দৃষ্টি সরিয়ে মেয়েটার মুখভঙ্গি খেয়াল করতেই আলতো হেসে ফেলে। নারীটিকে যে এমন বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে থাকলে বড় বেশি মনমোহিনী লাগে।
মৃদু গলায় সে বলে উঠে,
“এত আমতা আমতা করার কী আছে? করেছো তো করেছো। সামান্য সাহায্য তো করেছো আমায়, এ আর এমন কী!তাছাড়া এতে তো আমারই সুবিধা হয়েছে। এতোও শয়তান নয় আমি যে আমার শুভাকাঙ্ক্ষীকেই ঝাড়বো।”
এতক্ষণ তো শুধু বিস্ময়ে চোখজোড়া পটোলচেরা হয়েছিল, এখন এই কথা শুনে পক্ষীর মনে হচ্ছে চোখজোড়া কোটর থেকেই বের হয়ে আসবে। মনে মনে ভাবছে,
“লোকটার কথার বলার সুর এমন মিষ্টি হলো কী করে? তাও আবার আমার সাথে! ভাবা যায় এসব!”
তার অহেতুক সব ভাবাভাবির মাঝেই আরিজ পুনরায় বলে উঠে,
“এই শুনো, এখন থেকে না রোজ রোজ বের করে রাখবে। বুঝেছো তো পক্ষী?”
পক্ষী তাও দৃষ্টি তার চোখে স্থির রেখে নিরবতাই পালন করছে। তাই সে একটু জোরেই বলে,
“কী হলো! উত্তর দিচ্ছো না কেন?”
যুবতী তীব্র অস্বস্তি নিয়ে চোখজোড়া মেঝেতে নিক্ষেপ করে আবার চোখজোড়া তুলে তাকে কিছু একটা ইশারা করে। কিছুটা মাথা খাটাতেই সে বুঝতে পারে, তার আঙুল জোড়াই সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকা রমণীকে আটকে রেখেছে অধরজোড়া চলাচল করা থেকে।
ঝট করে হাত সরিয়ে ফেলে আরিজ। বিড়বিড় করে বলে,
“আরিজ জামান কবে থেকে আর কী করেই বা এমন নিয়ন্ত্রণহীন আর খাপছাড়া হলো! নাকি বিষয়টা শুধু এই নারীটিকেই ঘিরে!”
“কিছু বললেন আপনি?”
আচমকা এমন প্রশ্নে কেমন ঘাম ছুটে যায় আরিজের। জোরপূর্বক হেসে মৃদু গলায় বলে,
“না, না, কিছু না। আমি ফ্রেশ হয়ে আসি।”
“আচ্ছা আপনি ফ্রেশ হয়ে একবারে তৈরি হয়ে নিচে এসে পড়েন তাহলে। আমি ব্রেকফাস্ট গুছিয়ে রাখছি।”
৩৬।
“মা, বড় খালা তোমরা যা করছো, তা কি ঠিক হচ্ছে? ওরা ওদের মতো সময়ের সাথে সামলে যাবে, এভাবে পক্ষীর গলায় দায় ঝুলিয়ে দেওয়াটা উচিত মনে হচ্ছে না।”
আমির একটু আমতা আমতা করতে চিন্তিত গলায় কথাটা বলে সামনে বসে থাকা দুজন মধ্যবয়স্কা নারীর দিকে তাকালো। তাকাতেই দেখে উভয় নারী তার কথা শুনেই নাই এমন একটা ভাব ধরে আপেল কাটছে।
“তোমাদের কাণ্ডকারখানা কিছুই বুঝি না। প্রথমে পক্ষীকে মেনে নিবে না বলে এত কাহিনী করলে, এখন আবার দুজনকে মিলানোর কসম কেটে বসে আছো। জানো আরিজ তার পার্সোনাল জিনিসপত্র স্পেশাল্লি তার কাপড়চোপড়, ঘড়ি, রুমাল এসবে কারো ঘাটাঘাটি তো দূরে থাক হাত দেওয়াও পছন্দ করে না। মা, এমনকি তুমি হাত দিলেও ছেলে সারা বাড়ি চেঁচিয়ে মাথায় তুলে, আমিনাও ভয়ে ওর রুমে যায় না। সেখানে তুমি পক্ষীকে জেনেশুনে এই মানুষরূপী বাঘের খাঁচায় পাঠালে! না জানি মেয়েটার…”
আরও কিছু বলার পূর্বেই নয়না বিরক্তির সুরে বললেন,
“উফঃ আমির ডেইলি সোপের ক্যারেক্টারের মতো কানের সামনে শুধুশুধু ঘ্যান করবি না তো। আমরা তোর আগে হইসি, তুই আমাদের আগে না। যত্তসব জ্বালা!”
যুবক পুনরায় দুই মায়ের সামনে মিনমিনে সুরে বলল,
“কিন্তু বেচারি পক্ষী…”
“তোর বেচারি সুস্থভাবে পায়ে হেঁটে রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছে।”
নয়ন্তিনী বেগম পিছনের দিকে ইশারা করে কথাটা বললেন। মায়ের কথায় আমিরও সেদিকে অবাক চোখে তাকায়। অতঃপর আবার উদাস সুরে বলে,
“মেয়েটাকে মনে হয় বকে রুম থেকে বের করে দিয়েছে তোমাদের আদরের রাজপুত্র। ”
“ওরে আমার গাঁধা বাছাধন, যদি আমার সুপুত্র মেয়েটাকে বকে বের করতো তাহলে কী আর মেয়েটা রান্নাঘর থেকে আরিজের কাপে চা সার্ভ করে দিতো! চলো তো বুবু ডাইনিংয়ে যেয়ে বসি। এর সাথে থাকলে আমাদেরও যাবে বুদ্ধি!”
নয়নাও ছোটো বোনের কথার সাথে সায় জানিয়ে সোফা থেকে উঠে যেতে যেতে বললেন,
“বুঝলে তো বাছাধন, চুল আমাদের এমনিই পাকে নেই। আর আমের থেকে আঁটি বড় হয় না কখনো।”
তারা চলে যেতেই আমির গম্ভীর ভঙ্গিমায় বিড়বিড় করে বলল,
“আসলেই আমের থেকে কখিনো আঁটি বড় হয় না।”
চলবে…