একটুখানি বিশ্বাস
রোকসানা আক্তার
পর্ব-১৯
” মালটা সেই ছিল।তার রূপের তাড়নে ভাবনার গোচর কাটছে না।”আক্ষেপ গলায় বলেই আবিদ বিছানায় তার গাঁ টা এলিয়ে দেয়।
“কে।” দেয়ালে পিঠ ঠেকে মোবাইলে পূর্ণ মনোযোগ রেখেই নিমজ্জক কন্ঠে বলে অরুন।
মিনিট দশেক আগে দুজন শুতে আসছে।বাসায় গাদাগাদি মেহমান ঢল।।তাই একে-অপরের বেড শেয়ার করা ছাড়া উপায় নেইই। অরুনের বন্ধুদের টু-বেড দেওয়া হয়।শুতে গিয়েও জায়গার হিমসিম লেগে যায়।বেচারী আবিদের টু-বেডে আর জায়গা হয়নি জায়গা সংকুলানের কারণে।পরে,অরুনই আবিদকে তার সাথে নিয়ে রুম শেয়ার করে।
“কে আর হবে।তোর ভাবীর ওই বান্ধবীটার কথাই বলছি।”
অরুন চোখ থেকে মোবাইল সরিয়ে ক্ষীণ চাহনিতে আবিদের দিকে দৃষ্টি এঁটে।গোমড়া মুখে বলে,
“পছন্দ হয়েছে তাকে?”
“পছন্দ তো বটে তারসাথে একটা আক্রোশও।এরকম মেয়ের সাথে দিনরাত যাপন করলেও মন ফুরবে না।তার রূপে বড়ই জাদু,আহা।”
অরুন কিঞ্চিৎ ভ্রু বেঁকে বলে,
“ঘুমাবি কখন?”
“এইতো একটু পর।আগে তোর সাথে কথা বলা শেষ দিই।”
“আমার কিছু বলার নেই।ঘুম পাচ্ছে।ঘুমাবো।”
“উফস দোস,এরকম স্বার্থপর কথা বলছিস যে?আমার মনের কথাগুলোতো একটু শুনবি!”
অরুন পাশে মোবাইল রেখে অনিচ্ছুকতা বসার হয়ে বলে,
“বল।”
“ওই মেয়েটার সাথে আমাকে একটু কথা বলিয়ে দে না?শালার ছেমড়ি একটা ভাবের জম কথাই বলতে চায়না।”
অরুন বেঁকে হেসে।অসাড়তায় বলে,
“আমি সব মেয়েদের সাথে কথা বলিনা।তুই অন্য কাউকে দিয়ে ট্রাই কর দেখ।”
বলেই কম্বল টেনে মুড়িয়ে শুয়ে পড়ে।
“এই অরুন,অরুন?একটু পরে ঘুমা-না ভাই।আগেতো আমার মনের অনল নিভা।”
কিছুক্ষণ ধরে অরুনকে নিয়ে খটখট করার পর ব্যর্থ মন নিয়ে নিজেও শুয়ে পড়ে।
অশ্রু কাচুমাচু দিয়ে ঘুম থেকে উঠে।পাশে তাকিয়ে রিংকি এখনো নির্বিঘ্নে ঘুমচ্ছে।কালরাত রিংকি স্বইচ্ছায় অশ্রুর সাথে ঘুমাবে বলে বায়না ধরে।অবুঝ বাচ্চা। একদম নাঁখোশ করতেও পারেনি।মন খারাপ করবে।তাই সাগ্রহে রিংকিকে কাছে টেনে নিজের সাথে শুইয়ে দেয় অশ্রু।সূর্যের সকালটা সাদা কুয়াশায় এখনও আবৃত্ত।মানুষকে কম্বলে মুড়িয়ে নিজেও আরামে ঘুমের গোচরে।প্রকৃতির অবলীলায় কিছুক্ষণ তাকিয়ে তারপর বিছানা থেকে নামে।বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নেয়।কালকের জটলা লেহেঙ্গাটা ফেলে মিহি কাপড়ের একটা থ্রী-পিস পড়ে।ড্রেসটি লতা কালারের।অশ্রুর চামড়ার শুভ্র রংয়ের সাথে ড্রেসের কালারটিও তাকে বেশ ফুটিয়ে তুলেছে।।
দরজা খুলে বাইরে পা বাড়াতেই জিম্মি ধরে আসে তার।
ডাইনিং সোফায় অরুন বসে আছে।সাথে কয়েকজন মহিলা।মহিলাগুলো অরুনের খালা,মামী,ফুপি হবে বৈ-কি।অশ্রুর মাথায় রাগ চটে যায়।প্রথম সকালটা এর মুখ দেখেই শুরু হলো না জানি আজ পুরো দিনটাই তার খারাপ যায়।ভেবে ভেবেই অশ্রু বিমূঢ় মুখে ঘাড় ঘুরিয়ে আনে।পেছন থেকে একজন মহিলা ডেকে উঠেন,
“আরেহ এই মেয়ে ওদিকে যাচ্ছ কেন এখানে আসো।”
মনে মনে ক্রোধানলে ফেটে পড়লেও অশ্রু সম্মানের রেশটা ধরে রাখতে স্মিত মুখে পেছনে তাকায়।মিটি হেসে বলে,
“জ্বী, আমাকে বলছেন?”
“হুম।তোমাকেই।তুমি ছাড়া ওখানে আর অন্যকেউতো নেই।” হেসে।
অশ্রু ভদ্রতার সহিত পা চালিয়ে উনাদের সামনে গিয়ে দাড়ায়। তাছাড়া অরুনকে উপেক্ষা করে।অরুন তখন ভাবের জমে মোবাইলে মাথা ঠেকে রেখেছে।অন্য আরেকজন অশ্রুর হাত টেনে নিজের পাশে বসায়।আদরের সম্মেত অশ্রুর মাথায় হাত রেখে বলে,
“কাল এতটাই ব্যস্ততার মধ্যে কেটেছে তোমার সাথে পরিচয় হবার সময় মেলে নি।সংকুলান সময়টা আঁতুড়িপাঁতুড়ি কাজেই শেষ।যাইহোক,তোমার নামটা কী?”
“জ্বী,আমার নাম অশ্রু।”
“সুন্দর নাম।কিসে পড়?”
“অনার্সে।”
“আচ্ছা।রুমকি সম্পর্কে তোমার কী হয়?”
“রুমকির বান্ধবী বোধহয়,না?” পাশ থেকে অন্য একজন বলে উঠে।অশ্রু মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে।।
অশ্রুর পাশের মহিলাটি মুঁচকি হাসে।তারপর নিজেদের পরিচয় দেয়।
“আমি তোহিয়া রানী।ইমতিয়াজের আন্টি।আর এ হলো ইমতিয়াজের মামী……।” এভাবেই তোহিয়া রাণী অশ্রুকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেন।অরুন সামান্য তম তটস্থতা বোধে মোবাইল ছেড়ে উঠে দাড়ায়।বলে,
“আন্টি আমি গেলাম।তোমরা কথা বলো।”
বলেই চলে যায়।তোহিয়া রাণী অরুনের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মুখে মিটি হাসি টেনে মাথা নাড়েন।বিড়বিড়িয়ে নিজমনে বলেন–“পাগল ছেলে।”
তারপর স্বাভাবিক মগ্নতা এনে অশ্রুকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
“একে চেন?”
অশ্রু মিথ্যা অভিনয়ে দুপাশে মাথা নাড়ে।তোহিয়া রাণী বলেন,
“ওর নাম অরুন।ইমতিয়াজেরই ছোট ভাই।বোন নেই।অবশ্য এটাও জানো তাদের মা নেই।”
“জ্বী।”
“হুমম।আমার বোন ওদের ছোট রেখেই মারা যায়।মায়ের আদর কী ওরা জানে না।তবে আমার দুলাভাই মা হারানোর বেদনাকে ঢেকে দিতে তাদের ভীষণ আগলে রেখেছেন নিজের ভালোবাসায়।একটা কথা আছে,মায়ের ভালোবাসার অপূর্ণতা কখনো বাবার কোল দিয়ে পূর্ণ হয়না।দিনশেষে মনে একটা হাহাকারই থেকে যায়।যদিও সেটা দুলাভাই বুঝতে পারেননি।তবে আমি তার পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুভব করতে পেরেছি।বোনের ছেলে মানেইতো আমার ছেলে।মায়ের দুঃখরতা পূরণ করতে মাতৃত্বের স্নেহে দুজনের পাশে থেকেছি। তখন আমারও একটা ছেলে ছিল।বয়স ছিল তিনবছর।অরুন এবং আমার ছেলে আবরার প্রায়ই সমবয়সী।আমি আমার সংসার ফেলে আবরারকে নিয়ে এ বাড়ি চলে আসি।এখানেই তাকে অরুনের সাথে পড়িয়ে টড়িয়ে বড় করি।আমার স্বামী প্রথমত এই জিনিসটি কটু চোখে দেখেছেন।পরে আস্তে আস্তে আমাকে বুঝতে পেরে পরে আর বাঁধা প্রদান করেননি।
বলেই তোহিয়া রাণী জোরে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন।অশ্রু সেদিকে খানিক তাকিয়ে চোখদুটো ফ্লোরের দিকে নিবদ্ধ করে।আসলেই মানুষের জীবনটা ঢেউ তোলা নদীর মতো।শত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য,ভালো খাওয়া,ভালো থাকা ইত্যাদি থাকার পরও দিনশেষে সবারই মনে একটা আক্ষেপ থেকেই যায়।উদাহরণটা অরুনের ফ্যামিলির দিকে টেনে অশ্রু আবার শান্তশিষ্ট হয়ে বসে।
তোহিয়া বেগম অশ্রুর কাঁধ চেপে বলে,
” আচ্ছা থাকো তুমি আমি ওদিকটা একটু দেখে আসছি। ”
“জ্বী,আচ্ছা।”
একে একে সবাই উঠে যায়।রুমকি এবং ইমতিয়াজের ঘুম এখনো ভাঙ্গেনি।দুজন মানব-মানবী নিমজ্জ ঘুমে।তাদের জ্বালাতন করতে কেউই ফোঁড়ন টানেনি।কারণ বৌ-ভাত আজ নয়,আগামী কাল অনুষ্ঠিত হবে।তাই দুজনকে সখ্যতার সহিত বৃন্দাবনে ছেড়ে দিয়েছে সবাই।তাদের জন্যে বেলা ফুরোয়নি।তারা শুয়ে আছে,শুয়ে থাকুক না।বাসায় ফ্যামিলি’স রিলেটিভ ছাড়া আদার্স কেউ নেই।সাত-আটটা কাজের লোক যে যার কাজে গোচ বেঁধে হাত চালাচ্ছে।অরুনের খালা,মামী রান্না চড়িয়ে দিয়েছে।আবার কেউবা এখনও ঘুমচ্ছে।
পুুরো বাড়িতে এখন শুনশান নিরবতা। নিঃশব্দ
পরিবেশের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে অশ্রু হাঁক ছাড়ে।হুট করে কোথা থেকে আবিদ এসে অশ্রুর অপোজিটে বসে।বলে,
“গুড মর্নিং।”
অশ্রু অপ্রস্তুত বোধে সামনে তাকায়। কিছু না ভেবে পেয়ে উঠে দাড়ায়।রুমের দিকে মুভ করতেই আবিদ পেছন থেকে বলে উঠে,
“উদার হৃদয়ের মেয়েরা কখনো ভাব করতে জানে না।”
আবিদের কথায় অশ্রু থমকে দাড়িয়ে যায়।
একটুখানি বিশ্বাস
পর্ব-২০
রোকসানা আক্তার
আবিদের চোখমুখ সোনালী আভা ধারণ করে।দাঁতের নিচে ঠোঁট চাপড়ে ইন্দ্রিয়ের গ্রাহ্যে বলে,
“আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ই বলে তুমি আমার স্বপ্নের প্রেয়সী।আমার শত তপস্যায় তোমার মনে একটুখানি সাড়া জাাগালেও আই’ম সো লাকী।কারণ একটুখানি তেই শিঙ্গ ছোঁয়া যায়।”
এরইমাঝে অশ্রু পেছন ফিরে।আর আবিদের উদ্দেশ্য তূরী বাজায়। বলে,
“এই হ্যালো,তখন কি যেন বললেন?”
আবিদ ধ্যানের জগৎ থেকে বাস্তবে ফিরে আসে।তারপর অপ্রস্তুত হয়ে দাড়ায়।অশ্রুর দিকে জিজ্ঞাসূচকে তাকায়।
“মানে তখন কি বলেছিলেন আমি ঠিক বুঝতে পারিনি।আবার বলুন।
সত্যিইতো তখন অশ্রুকে কি যেন বলে দাঁড় করাল,এখন ঠিক মনে পড়ছে না।এই মনভোলা অভ্যেসটা আর গেলনা।এটা একটা রোগ।নিজে বলি আবার নিজেই ভুলি।যতকিছুই হোক এই প্রিয়সীর জন্যে একজন সাইকোলজিস্টের কাছে যেতে হবে। কৃপণ বাবার রক্ষিতা ধন লুটে হলেও।
ভেবেই আবিদ আনমনে মুখে একটা হাসিহাসি ভাব রেখে তাকাতে থাকে।
“চারপাশে তাকাতে বলিনি।আমার উওর দেবার জন্যে বলছি।”
আবিদ নড়েচড়ে কৃত্রিম হাসে।তোতলে তোতলে বলে,
“আ-আ-আ-সলে আ-মি….”
“হয়েছে আর বলা লাগবে না।এবার আমি বলি শুনুন।কারো ব্যাপারে ভালোভাবে না জেনে তাকে উদার হৃদয়বান বলে সম্বোধন করা বেমানান।আগেতো তার ব্যাপারে জানুন!তারপর নাহয় বলুন।”
কথা শেষ করেই অশ্রু লম্বা লম্বা পা পেলে নিজের রুমে চলে আসে।অরুন সিড়ির উপর থেকে সবটা দেখতে পায়।তাচ্ছিল্য মুখে আবিদের সামনে এসে দাড়ায়।বলে,
“তুই-না ব্যাটা একটা ষাঁড়।এই মেয়েদের পেছনে ঘুরঘুর করা অভ্যেসটা তোর এখনো চ্যান্জ হয়নি।”
“সব মেয়ের পেছনে ঘুরঘুর করলেও দিনশেষে তার মনের মানুষ একজনই চাই।আর সেটা এই মেয়েটি।আচ্ছা, এর নামটা কী জানিস?”
“অশ্রু।”তাচ্ছিল্য গলায় বলে।
” বেশ সুন্দর একটা নাম।তবে অশ্রু আবার আমার চোখেও যেন অশ্রু না ভাসায়।”
অরুন মুখ বেঁকে গাল ফুলা করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।বলে,
“নাস্তা করতে আস।”
বলেই অরুন ডাইনিং-এ চলে যায়।তোহিয়া রাণী একে একে প্লেটে নাস্তা বাড়তে থাকেন আর গলা উঁচিয়ে বাসার আনাচেকানাচে থাকা সবাইকে ডাকতে থাকেন।সবাই তরতর পায়ে ডাইনিং এসে পা চড়িয়ে বসে পড়ে।তবে এখনো রুমকি,ইমতিয়াজ এবং অশ্রু আসেনি।তা খেয়াল করেই রিংকিকে বলেন,
“এই রিংকি,যাতো অশ্রুকে গিয়ে নিয়ে আস।”
“আচ্ছা,আন্টি।”
আবিদ তড়িঘড়ি প্লেটে হাত বসিয়ে খেতে থাকে।তা দেখে অরুনের অন্যান্য বন্ধুরা খিকখিকিয়ে হাসে।
“এরে আবু,তুইতো ভালোই গিলতে পারিস।”(রশিদ)
“এজন্যেই তো ব্যাটা একটা লাড্ডু।”(তোয়াফ)
“কম করে খা,তাহলেই মেয়েদের নজরে পড়বি।” (অরুন)
আবিদকে নিয়ে সবার হট্টকথা দেখে তোহিয়া রাণী বলে উঠেন,
“হয়েছে,তোমরাতো কম খাও এজন্যেই এক-একজনের শরীরে চিমটি লেগে আছে।গাঁয়ে একফোটা মাংসের দানাও নেই।তোমাদের কোনো মেয়ে বিয়ে করতে রাজি হবে কিনা ওটা ভাবো।তারপর অন্যকে নিয়ে ঠাট্টা করতে এসো।আবিদ বাবা তুমি ওদের কথা কর্ণাপাত না করে চুপচাপ খাও তো।জানোই তো কাউয়াদের কাজই হলো কা কা কা করা।”
“উহহহহ খালামণি,তোমার এই ছেলেটা দেখতে কাউয়ার মতো?এত হ্যান্ডসাম,স্মার্ট একটা ছেলেকে মুহূর্তেই কাউয়া বানিয়ে ফেললে?”
“তুই কাউয়া না,তোর খাসিয়ত কাউয়া।”
অরুণকে এভাবে তোহিয়া রাণী ছোট করায় উল্টো সবাই আরো আনন্দ পায়।আবিদও হেসে দেয়।অরুন আপসেট গলায় বলে,
“তুমি আমার খালামণি হয়ে সবার সামনে আমায় এভাবে অপমাণ করলে।দুঃখ দুঃখ।”
বলেই খাবারে মন দেয় অরুন।রিংকি অশ্রুকে নিয়ে ডাইনিং আসে।তোহিয়া বেগম চেয়ার টেনে অশ্রুকে বসতে দেন।অশ্রু নিচে দৃষ্টি রেখেই সংকোচ বোধে বসে।আর লোলুপ চোখে তাকিয়ে থাকে অরুনের বন্ধুরা।তোহিয়া রাণী অশ্রুকে খাবার বেড়ে দেন। তারপর ইমতিয়াজ এবং রুমকিও ডাইনিং-এ চলে আসে।রুমকি এবং ইমতিয়াজকে দেখে ডাইনিং এ বসা সবাই উল্লাসিত আওয়াজ তোলে।একজন বৃদ্ধা চোখ রাঙ্গিয়ে বলে উঠে,
” ঘুম কেমন হলো দাদুভাই এবং দাদুবোন?
“ভালো।”মিটি হেসে রুমকি বলে।বৃদ্ধাও হাসে।বৃদ্ধার কথাতে ছিল আঁট। সেটা বোধহয় রুমকি বুঝে উঠতে পারেনি।আমাদের সমাজের দাদী-নানী ডাকা মানুষগুলো নাতি-নাতনীদের সাথে একটু রসিকতা সুলভ কথা বলতে বেশ পছন্দ করেন।
রুমকির কোনোরকম রিয়াকশন না দেখে পাশ থেকে রশিদ(অরুনের বন্ধু) বলে উঠে,
“আহা,ভাবী বেশ ভালোই ঘুম দিয়েছ দেখি।ইস,যদি এই দেবর গুলোকে একটু ভাগ দিতা!”
এধরনের অতিরন্জিত কথায় রুমকির হেঁচকি উঠে যায়।গলায় হাত দিয়ে খুক খুক কাশতে থাকে।তোহিয়া রাণী একগ্লাস পানি এগিয়ে রুমকির হাতে দেন।রুমকি সড়াৎ সড়াৎ পানিটুকু উৎসারক করে।অশ্রু বান্ধবীর দিকে একনজর তাকিয়ে আবার প্লেটে চোখ রাখে।সাথে অরুনের বন্ধুদের চৌদ্দ গুষ্টিকেও ধুঁয়েমুছে একাকার।এই ছেলেগুলো একদম বেহায়া।মান-সম্মান বলতে কিছু নাই।কখন কার সামনে কি বলা লাগবে সেই ম্যানার্স টুকুই জানে না এরা।নির্লজ্জ মানুষের বন্ধুগুলোও যে নির্লজ্জ হয় তা জানা ছিলনা।
আজব দুনিয়ার আজব মানুষ!নিজমনে বিড়বিড়িয়ে গৎবুলি ব্যবহার করে কোনোমতে খাবারটা শেষ করে অশ্রু।তারপর বেসিনে হাত ধুঁয়ে চলে যায়।
এদিকে রুমকির ব্রেকফাস্টটাও শেষ হয়।সোফায় বসে অশ্রুর খোঁজে চারপাশ তাকাতে থাকে।কাল থেকে দুজন এ বাড়িতে অথচ কেউ-কারো সাথে ভালো করে একটুখানি কথা পর্যন্ত বলতে পারেনি।সম্পর্কের জাল শ্বশুর বাড়িতে কী এতই কঠিন, যে আপন মানুষগুলোর সাথে কথা বলতেও বেগ পেতে হয় অনেক।ভাবতে ভাবতেই রুমকির দু’চোখ দীঘির জলের রূপ নেয়।এখন টপকে শুধু জলটুকু পড়ার বাঁকি।চোখদুটোকে সামলাতে চেষ্টায় লেগে যায় রুমকি।কারণ,আশপাশে অনেকেই আছে দেখে ফেললে সমস্যা হয়ে যাবে।শাড়ির আঁচল টেনে চোখের কার্ণিশটুকু হালকা মুছে নেয়।রুমকির এরকম মনঃকান্নার মাঝেই অশ্রু রুমকির সামনে এসে উপস্থিত হয়।আর তার পাশ ঘেঁষে ধপসে বসে।রুমকিকে তাক লাগিয়ে দেওয়ার জন্যে কাঁধ চেপে বলে,
“বাসর কেমন হয়েছে দুজনের?”
অশ্রুকে দেখামাএই রুমকির যেন কোমায় যাওয়া নিঃশ্বাসটা জীবন্ত হয়ে উঠে।ছলছল চোখে বলে,
“কোথায় ছিলি এতক্ষণে?”
“রুমেই তো।”
“মিস করেছি ভীষণ।এ বাড়িতে আমার আপন বলতে শুধু তুই-ই আছিস।আর তোর সাথেই আমার একটিবারও কথা বলার সুযোগ হয়নি।”
“আমারও।আচ্ছা ওয়েট কী যেন বললি?ও হ্যাঁ মনে পড়ছে।এ বাড়িতে আমিই তোর শুধু আপন?”
“হু।”
“আর ইমতিয়াজ ভাইয়া?”
রুমকির চোখমুখ লাল হয়ে যায়।লাজুকতা মুখে বলে,
“ওটা তো অন্য প্রসঙ্গে।”
“এ প্রসঙ্গ আর ও প্রসঙ্গ দুটোই এক। বরঞ্চ,কদিন পর আমিই তোর পর হয়ে যাবো।হিহিহিহি।”
“দূর,যা তা বলিস না!আচ্ছা তুই এখানে থাক।আমি কিচেনে গিয়ে ফুপী,আন্টির সাথে একটু কাজে হাত লাগাই।এভাবে গন্ডারের মতো বসে থাকলে খারাপ দেখায়।”
“হুমম।যা।”
রুমকি চলে যায়।টি-টেবিলের উপর পড়ে থাকা একটি দৈনিক পত্রিকা দেখতে পায় অশ্রু।সেটা হাতে তুলে একটু নেড়েচেড়ে কালকে ঘটে যাওয়া সব ঘটনায় চোখ বুলাতে থাকে।হুট করে একটা লেখা দেখামাত্রই অশ্রুর দু’চোখ ধাঁধিয়ে যায়।নিউজটির হেডলাইনে এরকম লেখা—-“যুগান্তর পত্রিকার সাধারণ সম্পাদক আলাউদ্দিন আলম মিথ্যে সংবাদ ছাপিয়ে ক্লাইন্টের থেকে তিন লাখ টাকা ঘুষ হিসেবে গ্রহণ করেন।”
অশ্রু এর বিস্তারিত পড়তে বেহুশ মনে অন্য পাতা উল্টায়।সম্পূর্ণ টা পড়েই থিতলে যায় অশ্রু।কেননা মিথ্যে সংবাদের অভিযোগে এই সপ্তাহের মধ্যেই তার বাবাকে আদালতে হাজির করাবে আইনবিভাগ। অশ্রুর কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না এসব।করণ সে তার বাবাকে খুব ভালো করেই চেনে।যে বাবা সততাকে নমস্কার আর ঘুষকে তিরস্কার করে সংবর্ধনা জানায় সেখানে এধরনের ঘাপলাঘাপলি একটা হ্যালুসিনেশন ব্যাপার।এটা নিশ্চয়ই অন্যকারো চাল হবে রেপুটেশন নষ্ট করতে।সাত-সাতটা বছর তার বাবা সততার সহিত সাংবাদিকতা করে এসেছে কখনোই এরকম অভিযোগ আসেনি।তাহলে আজ??নাহ নাহ এসব অন্য কেউই করেছে।ভাবতে ভাবতেই অশ্রুর কান্না চলে আসে। কোনোমতে চোখের পানি ঠেঁকিয়ে তড়িৎ পায়ে রুমে চলে আসে।দরজাটা বন্ধ করেই বুকফাঁটা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে অশ্রু।কিছুতেই কান্না তার থামছে না।কি হচ্ছে এসব তার ফ্যামিলির উপর!কি এমন প্রতিশোধ তার বাবার উপর ফুসেছে!কিছুই মাথায় আসছে না অশ্রুর।অতঃপর কান্না থামিয়ে হাতের উল্টো সাইড দিয়ে চোখের পানি মুছে নেয়।বাবাকে কল করবে বলে মনস্থির করে। বালিশের নিচ থেকে মোবাইলটা হাতে নিয়ে বাবার নাম্বার টুকতে গেলেই চোখের সামনে একটা মেসেজের টুং বেজে উঠে।তাকিয়ে রুমকির মেসেজ–“তাড়াতাড়ি একটু চিলেকোঠার রুমটায় আসতো কথা আছে তোর সাথে আমার।”
রুমকির এধরনের মেসেজ দেখে ভ্রু কুঁচকে আসে অশ্রুর।সাডেন এধরনের মেসেজ করার কারণ কী!কিছুক্ষণ আগেইতো দুজন কথা বলল।নাকি সে বাবার ব্যাপারে এসব জানতে পেরেছে এজন্যে এত আর্জেন্ট ডাকা, তাও গোপন কক্ষে। হয়তো!
ভেবেই অশ্রু নিজেকে অগাধ সামলিয়ে নেয়।
দরজাটা খুলে টিপটিপ পা ফেলে সিড়ি বেয়ে চিলকোঠার রুমের দিকে অগ্রসর হয়।বাড়িটা প্রায়ই দু’তালার।এ তালা পেরোলে ছাদ।তারসাথেই চিলেকোঠার রুমটি।তবে অশ্রুর মনে কেনজানি ভয় ভয় অনুভূত হয়।ভেতরের কোনো শক্তি জব্দ গলায় বলে উঠে–না অশ্রু,ওদিকে যাস না।বিপদ আছে বিপদ।
তবে বিপদ কেন হবে!মেসেজটা তো রুমকির ফোন থেকেই করা।রুমকি ছাড়া অন্যকেউ ফোনে হাত দিবে কেন!।রুমকিই হবে।গোপন কথা।পরের বাড়িতো।বলার সুবিধা হয় না।
এসব ভাবতে ভাবতেই কখন যে সে চিলেকোঠার রুমে প্রবেশ করে তা খেয়ালেই ছিল না।পুরো রুমটা অন্ধকার।একটু যে আলো আসবে সে জো টুকুও নেই।সবগুলো জানলাআঁটসাঁট ভাবে বন্ধ করা এবং পর্দা দিয়ে ঘেরা।বাতিও নিভিত।এসব দেখে অশ্রু সারা শরীরের লোম খাঁড়া হয়ে যায়।ভয়ার্ত মুখে আস্তভাবে রুমকিকে ডাকার চেষ্টা করে।পরমুহূর্তে দরজা ঠেলে কারো রুমে ঢোকার আওয়াজ শুনতে পায়।অশ্রু ঘাড় ঘুরিয়ে সেদিকটায় তাকায়।আবছা আঁধারে অশ্রু ব্যক্তিটিকে ভালোভাবে দেখতে পায়নি।ব্যক্তিটি অশ্রুকে পাশ কেটে কর্ণারে থাকা ড্রয়ার থেকে একটা ল্যাম্পলেট বের করে।সঙ্গে সঙ্গে ল্যাম্পলেটে আগুন জ্বলে উঠে।ল্যাম্পলেটে আগুন জ্বালানো ব্যক্তিটিকে চেনতে অশ্রুর বেশিক্ষণ বেগ পেতে হয়নি।এ যে অরুন তা অশ্রু তীক্ষ্ণ চোখেই আবিষ্কার করে।
চলবে…..
(হায়রে অশ্রু, শেষপর্যন্ত বাঘের মুখেই পড়লি😁😁।)
চলবে….