একটুখানি বিশ্বাস পর্ব ৫৯+৬০+৬১

একটুখানি বিশ্বাস
পর্ব-৫৯
রোকসানা আক্তার

অবশেষে,অরুন এবং অশ্রুর বিয়ের দিনটা পাকা হয়।বিয়ে আগামী বৃহস্পতিবার। অর্থাৎ কালকের পরদিন। ভুট্টো পোদ্দার নিজে এসেই বিয়ের দিনটা ফাইনাল করে যান।সঙ্গে একগাদা মালাই,রসগোল্লা,সন্দেশ,দই,ফলমূলতো আছেই।
এমন একটা সুসংবাদের গন্ধ অশ্রুর সর্বাঙ্গ শিহরিত।সাথে থৈ থৈ আনন্দোৎসব।তার আনন্দটুকু শুধু সমুদ্রেই মানাবে । সেখানে ছেড়ে দিলে সে অবাধে সাঁতরাবে আর টুকি টুকি সুখ কুঁড়াবে।এহেন বিলাশ, এহেন অভুক্ত সুখ অন্যকারো চোখে পড়লে খারাপ ভাববে।বলবে,মেয়েটা নির্ঘাত বিয়ে পাগল!

অশ্রু কোলের মাঝে বালিশ চেপে বসে।আর মুহূর্তে আবিষ্কার করে ফেলে অরুনকে কল করে এখন আচ্ছামত বকবে।আজ তার বাবা আসবে এ’কথা একটিবারও বললো না,অথচ কালরাত তার সাথে কতই না কথা হলো!এমন একটা নিউজ কীভাবে পারলো বুকে চেপে গলা ভিজিয়ে অন্যকথা বের করতে!
মানুষতো অতি খুশির সংবাদে বেসামাল হয়ে যায়। খুশির কথাটা যতক্ষণ প্রিয় মানুষটিকে না সঁপে ততক্ষণ বুকের ভেতরটা তার কেঁচকেঁচিয়ে উঠে!কিন্তু সেক্ষেত্রে অরুন একদমই বিপরীত।যতটা আনন্দে কথাটা বলার,ততটাই ছিল গুরুগম্ভীর।ও হ্যাঁ,সে তো এমনিতেই কথা কম বলে।আসলেই গো, গাম্ভীর্য মানুষের মুখের ভাব বোঝা বড়ই মুশকিল।
ভেবেই কিলবিলিয়ে উঠে অশ্রু।তারপর হাতে ফোন তুলে নেয়।হাত তার মৃদু কাঁপছে।অন্যদিন কল করতে হাতে এমন কাঁপন আসেনি, অথচ আজ নিজ থেকে কল করতে কেনজানি লজ্জা লজ্জা ফিল হচ্ছে।কম্পিত হওয়ার বিষয়টি হয়তো তারই একটি কারণ!
অশ্রু নাম্বার স্ক্রিনের সামনে এনে এবার থেমে যায়।ভাবুকতায় পড়ে।কল করবে কি করবে না।কল করে তাকে বলবে। আচ্ছামত বকতে পারবে ত?সেই সাহসটুকু আদৌ হয়েছে?য়ু হু মোটেও হয়নি।
অশ্রু আর কল করে নি।।

বেলা চারটা বেজে দশ মিনিট।বাসার সবাই নানান ব্যস্ততায় মশগুল ।কেউ দূরের মেহমানদের মোবাইলে কল করে করে ইনভাইট করছে।কেউ বিয়ের ডেকোরেশন সাজাতে তার লে-আউট বানাচ্ছে।কেউ বা বিয়েতে কি রান্না হবে,কি খাওয়াবে ওসবের লিস্ট করতে বড় একটা ডায়েরী নিয়ে বসছে।
আলাউদ্দিন ডাইনিং থেকে কিছুটা দূরত্বে দাড়িয়ে কিছু লোকদের সাথে হাত নেড়ে নেড়ে কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছেন। কথার ফাঁকেই বিপুলকে দেখতে পেয়ে হাঁক ছেড়ে ডেকে উঠেন।বিপুল মৃদু কন্ঠতায় সম্মতি প্রদান করে উনার দিকে এগিয়ে যায়।
“জ্বী ফুপা,বলুন?”
” তোকে একটা কাজ করতে হবে।”
“জ্বী,বলুন?”
” ফটোগ্রাফ দোকানে যেতে হবে।সেখানে গিয়ে মুকবুলকে বলবি আজ রাতের মধ্যেই পাঁচশো কার্ড চাপাতে।যদি কারণ জিজ্ঞেস করে তাহলে বলবি অশ্রুর বিয়ের।”
“ডিজাইন কেমন হবে?”
“তোর যেটা ভাল্লাগে ওটা দিস।”
“জ্বী,আচ্ছা।
” আর এই কাগজটা নে।এখানে বরপক্ষ এবং কণেপক্ষের ডিটেইলস লেখা আছে।”
বিপুল কাগজটি হাতে নেয়।পেছন ফিরতেই আলাউদ্দিন আবার বললেন,
“আরেকটা কাজ আছে।”
“জ্বী,ফুপা।”
” একটা নিঁখুত ডিজাইন কার্ডের অর্ডার দিবি যেটা খুবই স্পেসিফিক হবে।”
“স্পেসিফিক হবে কেন?”
“আরেহ ওটা দিয়ে কাল বরপক্ষদের ইনভাইট করতে যাবো!”
“জ্বী,আচ্ছা।এখনই ফটোগ্রাফ দোকানে যেতে হবে?”
“এখন না ভালো লাগলে রাতেও যেতে পারিস।সমস্যা নাই।”
“জ্বী,আচ্ছা। আর কোনো কাজ? ”
“এখন ওমন কাজ চোখে পড়েনি।পড়লে জানাবো।”
“আচ্ছা,ফুপা।তাহলে গেলাম। ”
বিপুল।কাগজটি হাতে নিয়ে ছাদের দিকে চলে যায়।ছাদে কোনো লোকজন নেই।পুরো ছাদ জামাকাপড়ে বিস্তর।দড়ি উপর কাপড়গুলো মৃদু হাওয়ায় দিকে দিকে দুলছে।ঝলমল বিকেল গড়িয়ে শেষ বিকেল ছুই ছুই অথচ কেউই জামাকাপড় গুলো নিতে আসেনি।তাদের মতে জামাকাপড় নেওয়ার সময়ই হয়নি।যখন চারদিক আবছা অন্ধকার এবং মাগরিবের আযান পড়বে তখন দ্রুতপায়ে ছাদে এসে পৌঁছাবে।আলস্যে ভরা বাঙ্গলা!
এখন গাছের একদম মাথায় কিঞ্চিৎ রোদ ঢুকঢুকে নাচছে।যেকোনো সময় সেই রোদ টুকুও উবে গিয়ে ওই সাদাকাশে মিশে যাবে।পাখিদের ক্লান্তিমাখা কিচিরমিচিরে তাদের বাসায় ফিরবে।শহরের ব্যস্ত মানুষগুলো পোটলায় তরুতরকারি গুঁজে প্রবল বেগে বাসায় ফিরবে।এটাই শেষ বিকেলের স্নিগ্ধ একটা মুহূর্ত। তাছাড়া,এই মুহূর্তে আরো একটা দিকও অস্নিগ্ধ তা হলো একাকীত্ব মানুষের বিষন্নতা!
বিপুল তার বিষন্নতাকে গাঁথতে এক ফসলা এই নির্জন ছাদকেই বেছে নিয়েছে। হাতে থাকা কুটির এই কাগজটি টুপ করে সামনে মেলে ধরে। আর তাকিয়ে থেকে ধীরপায়ে রেলিং এর দিকে অগ্রসর হয়।রেলিং পর্যন্ত থেমে গিয়ে কাগজটা আবার হাতের মুঠোয় নিয়ে চোখের পাতা ছোট করে আনে।তার চোখমুখে একটা উদাসীনতার চিহ্ন ছুঁয়ে যায়।দিকি এক অক্ষর শব্দও মুখ থেকে আসছে না।তবে কী খুবই খারাপ তার মন-প্রাণ-হৃদয়!এই খারাপ লাগাটা অশ্রুর জন্যে নাতো?হয়তো,হ্যাঁ!
ভালো লাগলে যে ভালোবাসা যায়,ভালোবাসলেই যে বিয়ে করা যায় এ’দুটি কথা বিপুলের ভেতরটায় এখন আষ্টেপৃষ্টে জড়িত।কী উচিত হলো সংগোপনে কাউকে অনেকটা বেশি ভালোবেসে?তার সব মুহূর্তগুলোকে নিজের আপন ভাবতে?অথচ পরসু থেকে সে অন্যের রক্ষিতা!ভুলতে পারবে ত?সব অনুভূতির ভালোবাসাগুলোকে ছিটে ফেলে নিজের মতো করে বাঁচতে?
ভেবেই কান্না পায় বিপুলের খুব।কান্না করলেই একটু যেন শান্তি রটবে মনে।তবে কান্না পেতে চাইলেও কান্নাকে চোখের কার্ণিশে পাত্তা দেওয়া অনুপযোগী।
জোরে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে বিপুল।
এই অন্দরে পেছনে কারো পায়ে ঝুমুর বাজার শব্দ পেয়ে উদাস মনটা জাগ্রত হয়।পেছনে ফিরে তাকিয়ে অশ্রু ।বিমূর্ত চোখে তাকিয়েও আবার আগের মতন মাথা ঘুরিয়ে নেয়।কী লাভ একে দেখে?একে দেখলেই বুকের জ্বালাটা আরো দ্বিগুণ বাড়বে।বুকের ভেতরটা ঠান্ডা বরফে জমে যাবে।কিছুতেই জমতে দেওয়া যাবে না।তাপমাত্রা বিহিত রেখে একে এখন থেকেই মন থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করতে হবে!
অশ্রু নির্জীব এখানে বিপুলকে দেখে পাশে এসে রেলিং ধরে দাড়ায়।বাইরের দিকে দৃষ্টি এঁটে বলল,
“কী,ভাই?একা একা ছাদে কি করেন?”
“এইতো এমনেই।”
“ওহ। আমিতো ভাবলাম ভাবীর সাথে কথা বলতে এসছো!”বলেই চোখ টিপে হাসতে থাকে।
বিপুল প্রসঙ্গ পাল্টে এবার গম্ভীর গলায় বলল,
” এই অবেলায় এখানে?”
“জামাকাপড় নিতে এসছি।নুজিফা ফাজিলটা একদমই ফাজি!কথা শুনে না।আপনার বোনের সাথে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে।বললাম জামাকাপড়গুলো ছাদ থেকে নিয়ে আসতে।তা না উল্টো ন্যাঙ্গ মেরে চলে গিয়েছে।”
“ওহ। যাদের নতুন বিয়ে হবে তাদের ছাদে আসতে নেই।নাহলে অশুভ কিছুর নজর পড়বে।”
অশ্রু মুখে হাত রেখে হেসে ফেলল।বলল,
“আহা,এসব ভুয়া কথা!”
“ভুয়া নয়,সত্য।আমাদের চট্রগ্রাম এরকম একটা কান্ড হয়েছিল।কাল তার বিয়ে আর আজ সে ছাদে এলো।কিছু সময়ের ব্যবধানে সে ছাদ থেকে উধাও।বাসায় একটা হৈচৈ পড়ে গেল নববউ কোথায় গেল,কোথায় গেল ভেবে!সেই তুফান!
পরে শুনতে পেলো মেয়ে কারো সাথে পালিয়ে গেছে সবাইকে কানাবক দেখিয়ে।”
অশ্রু এবার আর হাসি থামাতে পারিনি।হাসতে হাসতে যেন মাটিতে লুটিয়ে পড়বে।বিপুল তা দেখে বলল,
“হাসিস না।মজা করলাম।তোর তো আর তেমন করার সিচুয়েশন নয়!”
বলেই থেমে যায়।অশ্রু হাসি থামায়।বাইরে লুক করে বিপুলকে বলল,
“পরিবেশ টা খুবই সুন্দর!আবছা আধারে সাদা আলো হালকা!এই সময় একটা গান ধরলে সেই হত।”
“হু।”
“ভাইয়া,আপনি না অনেক ভালো গান জানেন?আমায় একটা গান শুনান প্লিজ?হঠাৎ কেনজানি আমার গান শুনতে ইচ্ছে হয়েছে।”
বিপুল নিঃশব্দে একটা নিঃশ্বাস ছাড়ে।মনে মনে ভাবে, ছাদে একটা শীতল পাটি পেতে পাঁজকোলে বসবে।সে কোলে তোর মাথা রেখে আকাশের ওই থালার মতো চাঁদটার দিকে তাকিয়ে গান গাইবে। যে গানের সুর শুনে বহুধূর থেকে সমুদ্রের পানি ছলছল শব্দ তুলবে ।চাঁদটা প্রাণ জুড়িয়ে দেখবে আর হাসবে।নির্জীব গাছগুলো তার জায়গা থেকে নড়চড়ে উঠবে। সেদিন তারাও তালে তাল মিলিয়ে গান গেয়ে উঠবে।আর সে তা দেখে হাসবে।এমন স্নিগ্ধ পরিবেশে গান শুনতে শুনতে তার চোখের পাতা ভার হয়ে আসবে।ঘুমা ঘুমা চোখে অস্ফুট স্বরে বলে উঠবে,বিপুল আমার খুব ঘুম পাচ্ছে!ঘুমাই?
আমি তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলবো,হু ঘুমাও।সবই ডায়েরীতে লিখা এক একটা স্বপ্ন ছিল।আপসোস,আজ বুনো সেই স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেল।তবে হ্যাঁ,আজ তার অনুরোধ আমি রাখবো।তাকে আজ গান শুনাবো এই সাঁঝের বেলায়।হয়তো এই দিনটা আর কখনো আসবে না!
বলা শেষ করেই বিপুল নড়েচড়ে দাঁড়ায়। তারপর প্রকাশিত গলায় ছেড়ে দেয় তার সুরেলা গান,
“আমার মতো এত সুখী,নয়তো কারো জীবন!
কী আদর-স্নেহ ভালোবাসায় জড়ালে মায়ার বাঁধন।
জানি,এ বাঁধন ছিঁড়ে গেলে কভু,
আসবে আমার মরণ….।
আমার মতো এতো সুখী নয়তো কারো জীবন!
কী আদর স্নেহ-ভালোবাসা জড়ালে মায়ার বাঁধন।”
এটুকু বলেই বিপুলকে থামতে হয়।অশ্রু বলল,
“আজ দুঃখের গান শোনার মোড নেই ভাইয়া।”
বলেই হাসার চেষ্টা করে।বিপুল ম্লান চোখে তাকিয়ে থাকে।অশ্রু আবার বলল,
“আচ্ছা, আমি যাই।নিচে কেউ না দেখতে পেয়ে টেনশন করবে।”
বলেই অশ্রু জামাকাপড় গুলো দড়ি থেকে টেনে টেনে হাতে নেয়।আর প্রবল বাতাসের মতো নিচে চলে যায়।অরুন একমগ্নে দাড়িয়েই!
অশ্রু নিচে আসতেই চমকে উঠে।রুমকি দাড়িয়ে। প্রশ্নানুসারে তাকাতেই রুমকি বলে উঠলো,
“হোয়াট এ সারপ্রাইজ, বেস্টু?বিয়ের কথা ভাবতে ভাবতেই এই বান্ধবীটাকেই ভুলে গেলি!”
অশ্রু থতমত খায়।কী বিশ্রী কথা!সবার সামনে এভাবে বলতে হলো?দিলোতে লজ্জা পাইয়ে!
অশ্রুর ইতস্ততা দেখে রুমকি হাসতে হাসতে বললো,
“রুমে যাই।কথা আছে তোর সাথে!চল।”
অশ্রু রুমকি নিয়ে রুমে যায়।অশ্রু দরজা লাগিয়েই হাঁপা হাঁপা গলায় বলতে লাগলো,
“বিয়েটিয়ে হয়ে তোর লজ্জা সরমি সব চলে গেছে!ক’দিন পর বাচ্চা ফুটালে তখনতো ডাইরেক্ট ডাইরেক্ট সব বলবি।”
রুমকি হাসে।অশ্রু বিনোদ শেষ করে আমৃত্য গলায় বলল,
“তো কখন আসলি?আমার কথা আজ কী ভেবে মনে পড়লো নাকি ইমতিয়াজ ভাই অশ্রু নামের কোনো এক বান্ধবী আছে বলে স্মরণ করিয়ে দিল।”
“সর,তেমন কিছু না।তুই আমার বেস্টু!বিয়ের আগের দিন বেস্টুরা বান্ধবীদের বাসায় আসবে এবং বিয়ের দিন পর্যন্ত থাকবেই এটাই নিয়ম।নাহলে মুখ ফুলিয়ে সারাজীবন খোটা দিবি ”
“পরসু তোর শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছি।কালকের পরতো দু’জন ঝাঁ হয়ে যাবো।এখন বেস্টু বেস্টু করছিস।।হা হা হা।”
“আরেহ,কবুল বলার পর তুই আমার ঝাঁ।এর আগেতো নয়।এখন বেস্টু হিসেবে আমি আমার দায়িত্ব পালন করছি।ইমতিয়াজের থেকে বলেই এখানে চলে আসি।”
“ইমতিয়াজ ভাইতো মাশাল্লাহ।তবে আমার বলদা স্বামীটা কেমন হয় কি জানি!”
“অরুন,ইমতিয়াজ থেকেও ভালো।যেমন -হ্যান্ডসাম,তেমন রোমান্টিক। তোকে সবসময় বুঝতে চেষ্টা করবে।তবে,আপসেট তো আমি প্রথমেই ইমতিয়াজের প্রেমে না পড়ে যদি আমি অরুনের প্রেমে পড়তাম… আহা!! ”
অশ্রু ভ্রু কুঁচকে ফেললো।কঠিন গলায় বলল,
“আমার স্বামীকে নিয়ে টানাটানি করবি না।অরুন শুধু এই অশ্রুর।” বলেই মুখ চেপে হাসে।তারপর আবার মশকরা করে বলল,
“এই বিয়ের পরতো তুই আমার বড় ঝাঁ।তখন বসে বসে কর্তার মতো আদেশ দিবি নাতো?সারাদিন খুনসুটি ঝগড়া করবি নাতো?সবাইতো বলে,ঝাঁ ঝাঁয়ে জানের শত্রু!”
রুমকি এবার ফেলফেল হেসে দেয়।মাথা গাট্টি মেরে বলল,
“ঝগড়া করবো নাতো আদর করে কোলে তুলবো নাকি?একেবারে অরুনের কোলে নিয়ে দিয়ে আসবো।হা হা হা হা।”
অশ্রুও হাসে।এভাবে চলে দু’বান্ধবীর খুনসুটি আড্ডা।
একটুখানি বিশ্বাস
পর্ব-৬০
রোকসানা আক্তার

অশ্রু কবুল বলার আগ মুহূর্তে আলাউদ্দিনের চোখমুখে চিন্তার দাগ এঁকে যায়।অরুনের হাতে মেয়েকে তুলে দিতে কেনজানি মনে খুব খুব ভয় হচ্ছে। জেদের কাছে হার মেনে আদরিনীকে তুলে দিচ্ছেন উৎকন্ঠায়,সংকোচতায় এবং দ্বিধায় ভরা মনে।অরুনের ভালোবাসা কি খাটি,নাকি ভালোবাসা নামক কোনো এক প্রতারণার জাল তা তিনি জানেন না।
বুকের ভেতরটা ঢিপঢিপ করে উঠে।উৎকুন্ঠা মনকে স্বস্তি দিতে না পেরে ছুটে যান ডাইনিং এ।সেখানে মুখে রুমাল দিয়ে বর সেজে বসে আছে অরুন।তার চোখের মণি চকচকে,মনে একটা উত্তেজনার ভাব।অশ্রুকে পেয়ে যে বড্ড খুশি সে তা আলাউদ্দিনের বুঝতে সময় লাগেনি।তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মিহি পায়ে অরুনের সামনে দাড়ায়।আলাউদ্দিনকে দাড়িয়ে থাকতে অরুন চোখতুলে তাকায়।পাশে আবরার বসা।সে বলল,
“আঙ্কেল কিছু বলবেন?”
আলাউদ্দিন উপরে-নিচে মাথা ঝাঁকায়।তারমানে,তিনি কিছু বলবেন।তৎক্ষনাৎ আবরার দাঁড়িয়ে যায়।আর আলাউদ্দিনকে বসতে জায়গা করে দেয়।
আলাউদ্দিন খুব আলতোভাবে সেখানটায় বসে।চারপাশ একবার চোখ বুলিয়ে অরুনের দিকে আরেকটু চেপে বসেন।চোখে করুণ চাহনি এঁটে খুব আস্ত গলায় বলেন,
“বাবা,তোমাকে আমার কিছু কথা বলার আছে।”
চকিত অরুন আলাউদ্দিনের দিকে তাকায়।হুটহাট কি বলবে ভেবেই অরুন চোখে একটা প্রশ্নবিদ্ধ ভাব আনে।আলাউদ্দিন খুবই শান্ত গলায় বলেন,
“বাবা,অশ্রু আমার খুব আদরের মেয়ে।ওর জীবনের সকল চাওয়া-পাওয়া মধ্যপরিবারে বিরাজ করেও মেটাতে চেষ্টা করেছি।ও কখনো কষ্ট,দুঃখ পাক তা আমি চাইনি।শেষমুহুর্তে চেয়েছি এ পাগলী মেয়েটাকে একটা ভালো ছেলে দেখে বিয়ে দিব।সেখানটায় মেয়ে তোমায় পছন্দ করে বসেছে।জানি তুমি ওকে বুঝেছো,দেখেছো,শুনেছো এবং সে ও।তাই ওর মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে বেশিক্ষণ জিম্মি রাখতে পারিনি।ও যেখানে ভেবেই নিয়েছে ভালো থাকবে,তা আমারও বিশ্বাস আমার মেয়ে ভালো থাকবে।তাই এই অভাগা বাবা হিসেবে তোমার কাছে আমার একটাই অনুরোধ আমার মেয়েকে কখনো কষ্ট দিও না বাবা,কখনোই না।ওকে আমি খুব ভালোবাসি।”
বলতে বলতে আলাউদ্দিনের চোখে পানি ভরে যায়।অরুন বললো,
“ছিঃ আঙ্কেল,আপনি এসব কি বলতেছেন!আমার উপর আপনার এতটাই অবিশ্বাস! দোয়া করবেন,আমার এই জীবন থাকতে অশ্রুর গায়ে এবং মনে একটা ফুলের টোকাও পড়তে দিবনা।আপনি যেমন আপনার মেয়েকে খুব ভালোবাসেন,ঠিক তাই আমিও চেষ্টা করবো আমার সর্বস্ব দিয়ে!”
আলাউদ্দিন ভরসার বাণী শুনে একটা শ্বাস নেন।লোকে মুখে কত শুনেছেন, কত দেখেছেন-কবুল বলার আগে সবাই ভালো।মেয়ে বাড়ি বাড়ি থেকে শ্বশুর বাড়ির চৌকাঠে পা রাখলেই যাতাকলে পিষন শুরু হয়!তাই এখানে অরুনের ভরসা পেয়েও আবার মনকে স্থির রাখতে পারছেন না।তবে,যাই হোক পৃথিবীর সব তো আর এক নয়!

সন্ধের দিকে আলাউদ্দিন কেঁদে কুটে মেয়েকে বিদেয় দেন।পুরো পোদ্দার বাড়ি এখন মানুষের ঢোল-বিঢোল!বড় বড় চোখ দিয়ে সবাই অশ্রুকে দেখছে আর তার প্রসংশার করছে।বউ বউ থেকেও ছোট বউটা একদম ফকফকে।এর রূপের এক কড়িও নেই বড় বউয়ের মাঝে।মেয়েটা একদম খাসা মেয়ে।তার চোখ,গাল,নাঁক কী সুশ্রী!চুলগুলো কি মিহি!সুন্দরের অভিধানে যার অর্থ শুধুই সুন্দর!
এসব গুঞ্জন অশ্রুর কানে বাজে।তার প্রসংশার ধ্বনি শুনে সে যতটা খুশির হবার কথা,ততটাই ফুপরে গেছে।
মানুষদের কি খেয়েদেয়ে আর কোনো কাজ নেই-কে সুন্দর,কে কালো,কে লম্বা ,কে বেটে এসব গুণ বিচার করা!এসব করে এদের লাভই বা কি!আজাইরা প্যাঁচালের পাবলিক সব!রুমকি জায়গায় যদি সে থাকতো তাহলে সবগুলাকে একসাথে চ্যাংদোলাই করতো।
অতঃপর হাজারো মানুষের সাধন-সায় সমাপ্ত শেষে রুমকি এবং অরুনের কাজিনরা অশ্রুকে অরুনের রুমে নিয়ে যায়।পুরো রুম হরেক রকমের ফুলে সজ্জিত।রজনীগন্ধা,গোলাপ,গাদা,বকুল,কামিনী ইত্যাদি।এগুলোর সুভাসিত ঘ্রাণ অশ্রুর নাকের দু’ছিদ্র দিয়ে তীরতীরে ঢুকে যায়।অশ্রুর চোখেমুখে একটা স্নিগ্ধতা ছুয়ে যায়।রুমকি অশ্রুকে বিছানায় বসিয়ে বলল,
“অশ্রু?কেমন লাগছে বাসর ঘরটা?”
রুমকির এহেন কথায় অশ্রু কিছুটা ধাতস্থ বোধ করে। মুহূর্তে মাথাটা নিচু করে ফেলে।তা দেখে অরুনের কাজিনরা খিলখিল হেসে দেয়।একজন বলে উঠলো,
“আহা,কী লজ্জা ভাবীর!আমাদের সামনে লজ্জায় রক্তিম হয়েছো ভালো কথা আমাদের ভাইয়াটার সামনে এরকম মোটেও চলবে না।নাহলে ভাইয়াটার খা খা বুকটা রিক্তায় ভরে যাবে।”
পাশ থেকো আরেকজন বলে উঠলো,
“আমাদের সামনে লজ্জা পেলে ঠিকই তবে ভাইয়ার সামনে এমনটি করবে না।ওরকম একটা হ্যান্ডসাম, স্মার্ট ছেলে যখন সামনে এসে দাড়াবে দেখবি তখন নিজেই ঘায়েল হয়ে গাঁয়ে উপর পড়বে।”
সবাই একসঙ্গে হো হো করে হেসে উঠে।অশ্রুর এবার দু’গাল আরো রক্তিমায় চেয়ে যায়।এই মেয়েগুলোর ঠোঁটকাটা নিশ্চয়ই। নাহলে কেউ এমন শ্রী কথা মুখে আনতে পারে।কী পঁচা রে বাবা!
অশ্রুর ভাবনার মাঝেই রুমকি কাঁধে হাত রেখে বললো,
“আমরা এখন যাইরে অশ্রু।ভয় পাস না।কিছুক্ষণের মধ্যে অরুনকে পাঠিয়ে দিব,হ্যাঁ?”
অশ্রু জবাব না দিয়ে মাথা তুলে তাকায়।রুমকি ঠোঁটের দুপাশের মাংস কুঁজে করে অশ্রুর গাল টিপে চলে যায়।

মিনিট ত্রিশেক পার হলে অরুন আলতো দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকে।অরুনের উপস্থিতিতে অশ্রুর ভেতরটা ধক করে উঠে।পালস রেটের দ্রুতগতিতে উঠানামা শুরু হয়ে যায়।নিঃশ্বাস ফালানোর ফাঁকর নাই!কী আশ্চর্য ওই ব্যক্তির প্রবেশে হঠাৎ মনের সাথে মনের তান্ডব শুরু হলো কেন!এমনটা ত হওয়ার কথা নয়।তবে কী ওই ব্যক্তির প্রতি তার একরাশ সংকোচ,লজ্জা অনুভব হচ্ছে বলে?হয়তো,তাই ই।
অশ্রু চোখবুঁজে নিজেকে ধাতস্থ রাখার চেষ্টা করে।অরুন টিপটিপ পায়ে অশ্রুর সামনে এসে বসে।অশ্রুর মাথা নুইয়ে।মেয়েটা যে খুব লজ্জাবতী তা অরুনের অবচেতন মনটা আগ থেকেই হুশিয়ার।অরুন একদন্ড হেসে দিয়ে অশ্রুর মুখের থুতনিতে হাত রাখে।এহেন স্পর্শে অশ্রুর পুরো শরীর কম্পন করে উঠে।অরুন আলতো মুখটা তুলে ধরে।
লজ্জামাখা দু’চোখে গাঢ় কাজল লেপ্টে।গোলাপী দু’খানা ঠোঁট ধীরভাবে কাঁপছে,দু’গাল টকটকে লাল হয়ে আছে।কী অপ্রতিম সুন্দর এই মানবী?চোখে ভরা কি তার মায়া!কি স্নিগ্ধতা এর রূপে।বড়ই জাদু আছে।অরুন কেনজানি অশ্রুর দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারে নি।মাথায় একটা ঝাঁকি দিয়ে সুড়সাড় বলে উঠলো,
“অশ্রু,তোমার দু’গাল লাল কেন?খুবচে লজ্জা ফিল হচ্ছে।তাইতো?”
অশ্রু মাথা নুইয়ে দু’পাশে ঝাঁকায়।অরুন মুঁচকি হেসে বললো,
“লজ্জায় তো আমি হস্তক্ষেপ করবোই।তবে এখন নয়।তার আগে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসো।তুমি খুব ক্লান্ত মায়াবিনী। ”
এই প্রথম অরুনের মুখে “মায়াবিনী ” শব্দটা শুনতে পেলো।অরুন হঠাৎ মায়াবিনী বললো কেন?তার মাঝে কি সত্যিই মায়া আছে?হু, বৈ-কি।মায়া আছে বিধায়তো অরুনকে এমন পাগল বেশে ভালোবেসেছে।অরুন আবার বললো,
“তাড়াতাড়ি যাও অশ্রু।ফ্রেশ হলে টায়ার্ড রিডাক হবে।”
অশ্রু মাথাতুলে অরুনের দিকে একপলক তাকায়।তারপর সম্মতি প্রদান করে ফ্রেশ হতে বাথরুমে চলে যায়।
একটুখানি বিশ্বাস
পর্ব-৬১
রোকসানা আক্তার

অশ্রু ফ্রেশ হয় বাইরে আসে।অরুন তখন মাথা নুইয়ে নিউজফিড ঘুটঘুট করছে।অশ্রুর উপস্থিততে টের পেয়ে অরুন হালচোখে স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে সেদিকে তাকায়।তাকাতেই চোখদুটো গোল আলুর মতো আঁটকে আসে।এতক্ষণে লেপে থাকা গাঢ় কাজল,এলোমেলো মাথার চুল,ম্লান মুখ ধুঁয়েমুছে নতুন রূপের ঝটা খুলেছে।গালদুটো আয়নার মতো চকচকে হয়ে আছে। চোখ,ঠোঁট,মুখ পুরোটা জুড়েই জোৎস্না রাতের একরাশ স্নিগ্ধতা উপচে পড়ছে। কী সুন্দর,কী নিষ্পাপ মুখ।এমন মুখের দিকে তাকিয়ে সারাটি জীবন কাটিয়ে দেওয়া সম্ভব।
এভাবে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে অরুন মাথাটা একটু ঝাঁকিয়ে মোবাইল পাশে রেখে উঠে দাড়ায়।তারপর একটা শ্বাস টেনে অশ্রুর দিকে এগিয়ে যায়। একটু মুঁচকি হেসে বললো,
“আমিও ফ্রেশ হয়ে আসছি।বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ো।তুমি খুবই ক্লান্ত।”
অরুন পাশ কেটে বাথরুমে চলে যায়।অশ্রু সেদিকে নিবৃত্তে তাকিয়ে খানিক রাগ হয়। কী বললো,এ?আজ-না বাসর?ভুলে গেলো!কত কথা,কত গীতা শুনতে শুনতে নাকি স্বামী-স্ত্রী পুরো রাত কেটে যায়। আর ইনি আসছে ভাব দেখাতে!ভাবছে উনিই একমাত্র ভাব জানেন আর কেউ জানে না।ওয়েট আমিও দেখাচ্ছি,হু!
মনে মনে বলেই অশ্রু বিছানায় কাঁত হয়ে শুয়ে যায়।কিছুক্ষণ পর অরুন টাওয়াল হাতে বাথরুম থেকে বেরোয়।বেরুতেই প্রথম নজর যায় বিছানার দিকে।অশ্রু কাঁত হয়ে নাঁক ঢেকে ঘুমচ্ছে।অরুন ভ্রু যুগল কুঁচকে আনে।তখন এমনিতেই বললো,শুয়ে পড়তে।আর শুলেই যে মস্তিষ্ক সুপ্ত হয় এমন নয়।জাস্ট শরীরের ক্লান্তি দূর করতে অসুপ্ত অবস্থায় মস্তিষ্ককে একটু শান দেওয়া বৈ-কি।মেয়েটা তা না করে উল্টো নাঁক ঢেকে ঘুমাচ্ছে!।অবুঝ নাকি এই মেয়ে?ইস এতদিনে কতইনা বুদ্ধিমতী এবং বড় ভেবে আসা আমি।
কিন্তু এই ভাবনাটা তার মনে বেশি সময় ঠায় পায়নি। অন্তরের ক্রন্দন থেকে বেরিয়ে মনের আসল কথা এবার বেরিয়ে আসে।প্রকাশিত মুখ করে বললো,
“আমার বুঝ মেয়ে দরকার নেই।এই অবুঝটাকেই দরকার! ”
তারপর অরুন টাওয়াল টা সোফার চৌকাঠে রেখে আলতো পায়ে বিছানায় উঠে।মাথাটা অশ্রুর দিকে ঝুঁকে এনে ছোট গলায় বললো,
“অশ্রু,শুয়ে পড়েছো?”
অশ্রু জবাব দেয়নি।অরুন আবারও বললো,
“এই অশ্রু,অশ্রু?সত্যিই শুয়ে পড়লে?”
তবুও অশ্রুর রেসপন্স নেই।অরুন বোকা মুখে মাথার চুল চুলকাতে থাকে। এই মেয়ে যে সত্যি সত্যিই ঘুমিয়ে পড়বে তা অরুন ভাবেই নি!উফস!!
তারপর আর কি চোখের পাতা ছোট করে মন খারাপ করে বসে থাকে।অরুন এভাবে কিছুক্ষণ কাটার পর অশ্রু এবার হালকা নড়চড়ে উঠে। অশ্রুর নড়াচড়ার আওয়াজ পেয়ে অরুন সেদিকে তাকায়।তারপর আবার মুখ ফিরিয়ে নেয় অভিমান করে।অশ্রু কাচুমাচু দিয়ে সড়াৎ উঠে বসে।ঘুমা ঘুমা চোখে বললো,
“এখনো ঘুমান নি, আপনি?”
“ঘুমাতে তুমি কী আর দিলে?”
“ওমা আমি আবার কি করলাম?”অবাক হওয়ার ভান করে বললো
“জানি না।”
অশ্রু মুখ চেপে হাসে।গলা ঝেড়ে নিজেকে আরেকটু শক্তপোক্ত করে বললো,
“আমার সাথে আপনার ঘুমানোর কী সম্পর্ক থাকতে পারে?তাছাড়া, আমিই বা আপনার ঘুম নির্ঘুম করতে যাবো কোন দুঃখে?আমার মাথায় কী সমস্যা আছে?”
অরুন অশ্রুর কথা বলার সবগুলো শব্দ কানের ভেতর ঢুকিয়ে চোখেমুখে স্বাভাবিকতা বজায় রাখে।তারপর মুখ স্মিত করে অশ্রুর দিকে পাশ ফিরে তাঁকায়।চট করে ওর হাতের কব্জি ধরে তার দিকে টেনে এনে বললো,
“খুব অভিমান জানো,না?ঘুমের ভান ধরে আমায় বোকা বানাচ্ছ?”
অরুনের শক্ত হাতে অশ্রুর নরম হাত মানিয়ে নিতে পারেনি।তাই ব্যথাটা ঢিপঢিপ জ্বলে উঠে।অশ্রু কুঁকড়ানো গলায় বললো,
“আআআআ,ব্যথা পাচ্ছি।ছাড়ুন।ছাড়ুন তো!”
“হাতটা ধরেছি কী ছাড়ার জন্যে?”
অরুনের বলার ভঙ্গিমা টা ছিল খুবই মিঠেল।তার চোখের কোণে জমেছে একরাশ ইচ্ছে, যে ইচ্ছেে এতদিন সপ্তাবস্থা কাটিয়ে এখন দপদপ জ্বলে উঠেছে।অশ্রুকে কাছে পাওয়ার তীব্র ব্যাকুলতায় মন্থর হয়ে উঠেছে তার মন-প্রাণ-হৃদয়। তা অশ্রু তার ধারালো নয়ন দিয়ে বুঝতে পেরে অন্য প্রসঙ্গ টেনে বললো,
“আপনি খুব পঁচা!”
অরুন মুহূর্তে ধাঁধায় পড়ে।বললো,
“কেন?দেখতে খারাপ?”
“নাহ।”
“তাহলে পঁচা হওয়ারতো প্রশ্নই আসে না!”
“পঁচা তো শুধু সুন্দরের বিষয়টাতে হয়না।বাহুল্য বিষয় এতে জড়িয়ে।”
“সে তোমার ক্ষেত্রে,তবে আবার ক্ষেত্রে শুধু সুন্দরকেই আমি পঁচা ভাবি।”
“তাহলে আমারটাই শুনুন?”
“য়ু হু,একদমই নয়!”
“কিন্তু কেন?”
অরুন কথার উত্তর না দিয়ে অশ্রুর ছলছল মুখে তাকায়।তার সৌন্দর্য,রূপ,ভার্জিনিটি সবকিছুই তারদিকে টানছে।এই মুহূর্তে অন্যকথা বলতে মোটেও ইচ্ছে হচ্ছে না তার।অরুন তাকিয়ে থাকতে থাকতে গভীর ঘোরে চলে যেতে থাকে।আর ডান হাতটা অশ্রুর মুখের দিকে বাড়িয়ে গালে আলতো হাত রেখে বললো,
“ও আমার রূপের ডালি!”
অরুনের হাতটা কত ঠান্ডা।অরুনের হিমেল স্পর্শ অশ্রুর পুরো শরীর ঝিনঝিন করে উঠে।অরুন টস করে গালে একটা চুমু বসিয়ে দেয়।বুকের ভেতরের পালস রেটটা যেমন টুপটুপ শব্দ তুলতে থাকে,সাথে শরীরের কম্পন।এতক্ষণ তো যথেষ্ট চেষ্টা করেছে নিজেকে সামলে রাখতে। তবে এবার কি নিজেকে গুঁটিয়ে আলগোছা করে রাখতে!
অরুন তার নাঁকের দু’ছিদ্র ক্ষীণ করে আলতোভাবে অশ্রুর সুগন্ধি চুলে নাঁক ডুবায়,একটা নেশা ধরে গেলো এবার।নেশাটা ক্রমশ বাড়তে থাকে।সে হাত দিয়ে অশ্রুর ঘাড়ের চুলগুলো সরিয়ে নেয়। অশ্রু চোখবুঁজে জিম্মি চাদরে হাত খাঁমচে বসে আছে।আর ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলছে।
অরুন তার ধনুক ঠোঁটের স্পর্শ লাগায় অশ্রুর ঘাঁড়ে ।অশ্রুর পুরল শরীর শিরশির কেঁপে উঠে।অরুন ঘাড়ে অজস্র চুমু দিতে দিতে বামহাত দিয়ে অশ্রুকে বিছানায় শোয়াতে থাকে।তার ভালোবাসায় জড়িয়ে চাদরে মুড়িয়ে যায় দুটো মানব-মানবী।
কী স্নিগ্ধ তাদের ভালোবাসা!কী মোহময় ভালোবাসার সুর।সে সুরে পৃথিবীর সব ভালোবাসা একছন্দে গান তুলে।গান গাইতে গাইতে তারা হাঁপিয়ে উঠে।তারপর আবারো গাইতে থাকে,আবারো হাঁপিয়ক উঠে।তবুও শেষ নেই তাদের অপ্রতিম ভালেবাসার স্পর্শ!

সকালে সূর্যের মৃদু রোদ জানলা গলে ভেতরে প্রবেশ করে।অরুন তখন শাওয়ার সেরেছে মাত্র।অশ্রু বেঘোরে এখনো ঘুমিয়ে।অরুন ঘুম থেকে জাগার পর অশ্রুকে দেখলো ঘুমিয়ে।হাতের ঢগা দিয়ে আলতো স্পর্শ করে অশ্রুলে ডাকে।অশ্রু উঠে নি।তেলেপোজা ঘুম তার চোখে তখনো জড়িয়ে।তাই অরুন আর অশ্রুকে উঠায়নি।সে ঘুমিয়ে আছে।ঘুমাক।তারপর নিজেই খুব খুশিয়ারী অশ্রুকে পাশ কেটে উঠে স্নান করতে চলে যায়।
অরুনের ড্রেস চ্যান্জ পর্ব শেষ হলো।ভেঁজা চুলগুলো হাত দিয়ে একটু গোছগাছ করে বিছানার কাছে আসতেই অশ্রুর ঘুম ভেঙ্গে যায়।অশ্রু চোখদুটো খুলতেই প্রথমে চোখ পড়ে অরুনের দিকে।ব্রাউন কালার একটা গেন্জি,পড়নে ব্লাক জিন্স,হাতে চকচকে কালো ঘড়ি গেটআপটা খুব সুন্দর লাগছে। ফর্সা মুখে ভেঁজা চুল থেকে টুপটুপ পানি গড়িয়ে পড়ছে সে ত আরেকটা আর্ট!গোসলের পরে একে কোনো এক আর্টিস্ট দেখলে নির্ঘাত তার সৌন্দর্য্যটা রংতুলিতে ফুটিয়ে তুলতো।আর সেই আর্ট কতটা নিখুঁত, সুন্দর, মুগ্ধভরা হতো তা পুরো পৃথিবীকে তাঁক লাগিয়ে দিত।ছেলে মানুষ সুন্দর,তবে এতটা বেশি সুন্দর তা অশ্রুর জানা ছিল না।টুপ করে তার চোখে পানি চলে আসে। এই পানিটুকু অরুনের সৌন্দর্য্যের কাছে চোখ হার মানার কারনে।অশ্রু পানিটুকু ঠেকাতে উঠতে ব্যস্ত হয়ে যায়।এরইমধ্যে অরুন বলে উঠলো,
‘ঘুম শেষ হয়েছে তোমার?”
অশ্রু মাথা উপরে-নিচে মাথা ঝাঁকিয়ে “হ্যাঁ” ইঙ্গিত করে।
“আচ্ছা, তাহলে উঠো।আর গোসলটা সেরে নাও।”
অশ্রু উঠতে গেলেই “আআআআ”করে শব্দ করে উঠে।
” এনিথিং রং অশ্রু?”
অশ্রু বলতে পারেনি।বলতে পারে নি তা বলা যাবে না, তার খুব লজ্জা ফিল হচ্ছে তার যে এখন প্রচন্ড পেট ব্যথা করছে।আর ছেলেদের কানে পেঁটে ব্যথার কথা উঠালেই ওরা অন্যকিছু মিন করে।পেঁট ব্যথাতো শুধু পিরিয়ডের জন্যে নয়,অতিমাত্রায় গ্যাস জমলেও হয়।
তারপর নিজেকে ধাতস্থ করে বললো,
“নাহ কিছু না।উঠছি।”
বলেই অশ্রু শরীরের সর্ব শক্তি দিয়ে উঠার চেষ্টা করে।অরুনও তার হাত বাড়িয়ে আলতো ধরে উঠাতে।অবশেষে অশ্রু উঠে দাঁড়ায়।অরুন পেছন ঘুরে কাবার্ডের দিকে এগিয়ে যায়।কাবার্ডের দরজা খুলে অশ্রুকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“এখানে তোমার পছন্দনীয় সব জামাকাপড় কিনে রেখেছি।বিলিভ পছন্দ হবে।তাই তোমার যেটা ভালো লাগে ওটা পড়ে নিও।আর আমি একটু নিচে যাচ্ছি।”
বলেই অরুন না দাড়িয়ে চলে যায়।অশ্রু আস্ত পায়ে বিছানা থেকে নামার চেষ্টা করে।ওমনি পেটের ব্যথাটা আরো চটকে উঠে।তবে,হুট করে পেটের ব্যথা এমনভাবে বাড়ার কারণ কী?কাল সে ত তেমন তেলে জাতীয় খাবার খায়নি।আর হালকা খেলেও কখনো এমন ব্যথা হওয়ার কথা না অথচ এখন?
ভাবনাটা মাথায় চেপে হুট করে ঝেঁড়ে দেয়।তাচ্ছিল্য গলায় বলল,
“দাৎ হয়তো এমনি।একটা গ্যাস্টিক ট্যাবলেট খেলেই সেরে যাবে।”
তারপর অশ্রু কাবার্ড থেকে একটা লাল রঙ্গের শাড়ি হাতে নিয়ে বাথরুমের দিকে এগিয়ে যায়।
চলবে…
চলবে…..
(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here