কৃষ্ণচূড়ার রং লাল-৩৭.🎈
@হাফসা আলম
_____________________
একটি ব্যস্ত সকাল।সবাই খুব মনযোগ দিয়ে নিজের নিজের কাজ করছে।আলভী এদিক সেদিক ছুঁটছে।ভাই ভাই একটা দায়িত্ব তার মাঝে বিরাজ করছে।মিসেস আমিনা রান্নাঘরের কাজ করছে।হোসাইন সাহেব আর রুচিকার বাবা ক্যাটারিং সার্ভিসের লোকেদের সাথে কথা বলছে।ব্যস্ত ব্যস্ত পায়ের ধনী চলছে ঘরময়।মিষ্টি সূর্যের তীর্যক রোদটা সাদা পর্দা ভেদ করে মুখের উপরে এসে পড়তেই তুতুলের অর্ধেক সুন্দর স্বপ্নটা অসম্পূর্ন ভাবে শেষ হয়ে গেল।বিরক্তিতে তুতুলের চোখটা কুঁচকিত হলো।আড়মোড় ভেঙ্গে চোখ খুলে একটা অদ্ভুত ব্যাপার আবিষ্কার করে ফেলল সে।তার গায়ের উপরে অসংখ্যা ফুলের বাসা।যেন সে সদ্য তৈরি হওয়া সতেজ ফুলের দোকান।বিস্ময়ের চরম সীমায় পৌছে তুতুল চোখ খুলে তাকাল।দেখল,তার শরীরের উপরে গাঁদা ফুলের ছড়াছড়ি।হলুদ রং গায়ের উপরে লেপ্টে আছে।সাদা কম্ফোটারের উপরে হলুদে রংটা দারুন ভাবে নিজের রূপ প্রকাশ করছে।তুতুল উঠে বসে।মাথায় পেঁচিয়ে আছে ফুলের লতা।গলায় শরীরে পেঁচিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ।চুল গুলোতে জড়োসড় হয়ে আছে ফুল।রায়হান খিলখিল করে হাসে।হাসির শব্দে তুতুল অবাক হয়ে সামনে তাকায়।রায়হান হাসছে।সামনে ভেসে উঠছে তার সাদা ফকফকে দাঁত।সামনের একটা খালি জায়গাও চোখে পড়ছে।দুই একটা দাঁত পড়েছে তার।তুতুল দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল,’রায়হান বাবু যে।তা তুমি এখানে কি করছ??তাও এতো সকালে?’
রায়হান দ্রুত এগিয়ে আসে তুতুলের সামনে।তারপর হাতের ছোট ক্যামেরা তাক করে তুতুলের দিকে।গম্ভীর কন্ঠে হুকুম করে,’ স্মাইল প্লিজ।’
রায়হানের কথার ভঙ্গীতেই হেঁসে ফেলল তুতুল।ফুলে জড়ানো তুতুলের একটা ছবি বেরিয়ে এলো ক্যামেরার উপরের অংশ বেদ করে।রায়হান এবার তুতুলের বিছানায় উঠে বসে।জুতো খুলে নেয় পা থেকে।তুতুলের কাছে এসে একটা একটা করে ফুল সরিয়ে দেয়।তুতুল ভারী অবাক হয়ে রায়হানের কাণ্ড দেখে।বাচ্চা কেউ বলবে একে?কত গম্ভীর হয়ে কাজ করছে।যেন বড় একজন গম্ভীর গুরুজন।তুতুল চোখ ছোট করে বলল,’ কি হয়েছে?আপনি এত সকালে আমার বাসায়?কি কাজে এসেছেন মিষ্টার বাবু?’
রায়হান রাগী একটা লুক নিয়ে বলল,’ আমাকে একদম বাবু ডাকবে না।কোন দিক থেকে তোমার মনে হচ্ছে আমি বাবু?আর যেন না শুনি।’
কিছুক্ষণ নিবিড় দৃষ্টি নিয়ে দেখল রায়হান কি করে।নিজের কাজের প্রতি সে খুব মনযোগী।চুল,জামা হাতে যেখানে যেখানে ফুল ছিল সব সরিয়ে দিল সে।তারপর একটা মিষ্টি ফোকলা দাঁতের দীর্ঘ হাঁসি টেনে বলল,’ এবার ঠিক আছে।ছবিটা সুন্দর হয়েছে খুব।দেখবে তুমি?’
‘ অবশ্যয়।দেখাও।’
রায়হান ছবি এগিয়ে দিল।তুতুল দেখল নিজের হাঁসি মাখা স্নিগ্ধ ছবিটা।হলুদ আর গায়ের সাদা জামার ভাঁজে তাকে খুব অমায়িক দেখল।তুতুল রায়হানের গাল টেনে বলল,’তুমি তো দারুন ছবি তুলতে পারো।’
‘ আমি জানি।কিন্তু তুমি আমাকে বাচ্চাদের মত গাল টানলে কেন?তুমি তো দেখি আচ্ছা পঁচা মেয়ে।মামুকে বলে দিব তুতুল খালামনি দিন দিন পঁচা হয়ে যাচ্ছে।আর ছবি তুলে দিব না।হুহ্’
তুতুল আহাম্মক বনে গেল।হা করে রায়হানের দিকে তাকিয়ে থাকে।মুঠোফোন বেজে উঠে বেসুরা কন্ঠে।থ মেরে থেকেই ফোন কানে ধরে তুতুল।ওপাশ থেকে ভেসে আসে কঠিন পুরুষ কন্ঠ,’ বারান্দায় এসো।’
তুতুল হতচকিয়ে যায়।ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখে জ্ঞানী বাবা নামে সেইভ করা নাম্বারটা।রিঝের ফোন।তুতুল নিচু গলায় বলল,’ কেন?’
‘ এর কোন উত্তর নেই।আসতে বলেছি আসবে।কথা শেষ।’
‘ কিন্তু কারণ ছাড়া আমি কেন যাব?মাত্র ঘুম থেকে উঠেছি।ফ্রেশ হতে হবে।পরে আসব।এখন ওয়াসরুমে যাচ্ছি।’
তুতুল ফোন কানে নিয়েই উঠে আসে ।রিঝ কর্কশ স্বর ছাড়ে।বলে,’ আসতে বলেছি মানে আসবে।তুমি বড্ড বেশি প্রশ্ন কর।থাপ্পড় গালেই পড়বে এবার।’
তুতুল চরম বিরক্ত নিয়ে ওড়না তুলে নেয়।ধুপ ধুপ শব্দ করে পা চালিয়ে বারান্দায় দাঁড়ায়।রিঝের এক হাতে সাদা মগ।অন্য হাতে ফোন।বারান্দার গ্রিলে হেলে দাড়িয়ে আছে সে।পরনে সাদা গেঞ্জি।কাল ট্রাউজার।রিঝ হেসে ফোনটা কাঁধে চেপে হাত নাড়াল।তুতুল কিছুই বুঝল না।পিছনে তাকিয়ে দেখল রায়হান খুশিতে গদগদ হয়ে হাত নাড়াচ্ছে।তুতুল বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করল,’ কাহিনী কি বলবেন??’
‘ আমি ওকে পাঠিয়েছি।তোমার একটা ছবি তুলতে।থিমটা হবে ফুলের সমারহ।ওর শর্ত ছিল এক রাত আমার রুমে ঘুমাতে চায় সে।দিন এবং রাত মিলিয়ে সে থাকবে এই রুমে আমার সাথে।’
তুতুল চমকে রায়হানের দিকে তাকাল।রায়হান হাত দিয়ে ইশারা করল নিচু হতে।তুতুল নিচু হয়।রায়হান দু হাতে তুতুলের গাল টেনে দিল।শোধ করেছে।মুচকি হেসে আঙ্গুলের ছোট অংশ দেখিয়ে বলল,’তুমি এই একটু খানি সুন্দর।না আর একটু বেশি।গালগুলো তোমার মত তুলতুলে।মামু বলে না তুলা পাখি।ঠিক তেমন।’
রায়হান ক্যামেরা হাতে ছুঁট লাগায়।তুতুল বিস্ময়ে হতবাক হয়ে বলল,
‘ এসবের মানে কি?আমার ছবি দিয়ে আপনি কি করবেন?বাচ্চাকে এসব কি শিখাচ্ছেন??পাগল টাগল হয়ে গেলেন না কি?’
‘ সেটা তো আমি আগে থেকে প্রিয়।শুধু প্রকাশ করিনি।এখন করি।’
‘ কেন?এখন প্রকাশ করার মত কি এমন হয়েছে?’
‘ এখন তো তুমি আমার বউ।বউ হচ্ছে অনেকটা নিজের ডায়েরির মত।যখন খুশি পড়া যায়।পার্সোনাল ডায়েরি!’
‘ আপনাকে কত বার বলেছি বউ বউ করবেন না।তবুও কেন করেন?আর কাজ নেই না কি?’
‘ এই যে এখনও তো কাজ করছি।বউকে সময় দেওয়া পৃথিবীর গুরুত্ব থেকে অধীক গুরুত্বপূর্ন্য কাজের মধ্যে অন্যতম।’
তুতুল বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকে দূরের সেই বারান্দার মসৃণ হাসি মাখান ছেলেটার দিকে।এত আবেগ!এই লোকটার মাঝে!কবে থেকে?বিয়ে হলে কি সব ভয়ংকর মানুষ গুলোর মাঝে এমন বিচিত্র পরিবর্তন ঘটে?
‘ ঘুম কেমন হয়েছে?’ রিঝের সজহ সুন্দর প্রশ্ন।তুতুল এবার বেহুশ হয়ে যাবে মনে হয়।সকাল সকাল এত ধকল নিতে পারছে না সে।রিঝের এই নতুন নতুন প্রকাশিত রূপ তাকে খুব ভাবায়।তুতুলের ঠোঁট জোড়া নিজস্ব গতিতে আলাদা হয়ে যায়।রিঝ হালকা হেসে কফির মগে ঠোঁট ডুবিয়ে দিল।
‘ আপনি সুস্থ আছেন তো?’ তুতুলের কন্ঠে বিস্ময় প্রকাশ পেল।রিঝ সপ্রশংসায় পঞ্চমুখ করে বলল,’ অবশ্যই সুস্থ।একদম ফিট।তোমাকে কোলে নিয়ে ঘুরার মত প্রচুর শক্ত সঞ্চারিত আছে।’
তুতুল কিছু বলল না।শুধু গোল গোল চোখ জোড়া দিয়ে চেয়ে রইল।কি গভীর দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে!কি নেশা ধরানো হাসি!সব প্রেমিকের হাসিটা কি এতটা সুন্দর হৃদয় কাঁপান হয়?না।শুধু তার রিঝ ভাইয়ের হাসিটাই এতো সুন্দর।পৃথিবীর সবচাইতে মায়াবি হাসির মালিক তার রিঝ ভাই।গম্ভীর মুখের চঞ্চল হাসি!রন্ধ্রে রন্ধ্রে যেন নেশা ছড়িয়ে দিচ্ছে এই হাসি।ঝড়ছে রঙ্গের অঝোর স্রোত ধারা।এটাই কি সেই ভালবাসার রং?যে রঙ্গে রাঙ্গার স্বপ্ন থাকে প্রতিটি নারীর বুক পাঁজড়ে!এই ভালবাসা কি কৃষ্ণচূড়ার সেই লাল রং?যে রঙ্গ কৃষ্ণচূড়া মৃত্যুর আগ পর্যন্তও নিজের মাঝে ধারণ করে?নিরবিচ্ছিন্ন রং!তাহলে কেন এল এতো দেরিতে তার জীবনে?কয়েক সেকেন্ডের মাঝে মনে পরে এই মানুষটা তো তার সঙ্গী।পুরানো সঙ্গী!রিঝ অনেক্ষণ হ্যালো হ্যালো করছে।কিন্তু তুতুলের কোন সাড়াশব্দ নেই।সে গভীর মনযোগ দিয়ে তাকিয়ে আছে রিঝের ব্যালকনির দিকে।চোখে চোখ পড়তেই তৃষ্ণার্ত দু’টি চোখ পড়ল চোখে।তুতুল গভীর ভাবে সেই চোখে ডুবে ডুবে দেখছে।সরাচ্ছে না।এতো বেহায়া সে কবে হলো?সামনের দূরত্বও মানছে না এই দৃষ্টি।তীক্ষ্ন চোখের পলক পড়ছে না।পাশে এসে দাড়ায় আরোহি।তুতুলের পিঠে ধাক্কা দিতেই সে হুড়মুড়িয়ে পাশে তাকাল।হাত থেকে পড়ে যেতে নিল ফোন।আরোহি সন্দেহের চোখে তাকিয়ে বলল,’ তুই এখানে কি করছ আপু??’
তুতুল এই প্রথম এমন ততলিয়ে কথা বলল,’আ আ আমি কক কি যেন করছিলামম?’
আরোহি অবাক হয়ে বলল,’ আমি কিভাবে যানবো তুই কি করছিলি?নিজেই বল?’
‘ ভুলে গেছি।হ্যাঁ কি করছিলাম ভুলে গেছি।’
তুতুল হাঁসফাঁস করছে।চুরি করে ধরা পরেছে মত অবস্থা তার।রিঝ তীর্যক চোখে সব পর্যবেক্ষণ করছে দূর থেকে।তার হাসি পাচ্ছে।গগন কাঁপান হাসি।আরোহি রিঝকে দেখে বারান্দায়।তুতুলের ফোন হাতের মুঠোয়।তাই বুঝতে পারে না রিঝ কার সাথে কথা বলছে।আরোহি তুতুলের দোলনার পাশে রাখা চেয়ারে বসে।তুতুল বসে দোলনায়।পা গুঁটিয়ে।আফসোসের একটা টান টান রেখা টেনে আরোহি বলল,’ আমি না একটা চশমা পড়া ছেলেকে খুব পছন্দ করি আপুনি।’
আড়চোখে রিঝের দিকে তাকায় তুতুল।রিঝ নিজের চশমা ঠিক করতে ব্যস্ত তখন।আরোহি তুতুলকে দু হাতে ঝাঁকিয়ে বলল,’ তোরে কি বলছি শুনতে পাচ্ছিস না?’
‘ ও হ্যাঁ বল বল।’
‘ আমি একটা ছেলেকে পছন্দ করি।’
চোখেমুখে বিরক্তির প্রকাণ্ড রেখা টেনে তুতুল বলল,’ তো বসে আছস কেন?যা বিয়ে করে নে।কে আঁটকে রেখেছে।’
‘ করতাম তো।কিন্তু উনি পাত্তা দেয় না।’
‘ তোরে পাত্তা দেয় না??সে পোলার চোখ নাই না কি?ও চশমা পরে বলছস না?মনে হয় ভাল করে দেখে না।তা না হলে তোরে পাত্তা দিবে না এমন ছেলে নেই জগৎে।’
‘ চোখে সবই দেখে।শুধু আমাকেই পাত্তা দেয় না।’
‘ কি বলছ?তুই তো অনেক সুন্দর পাত্তা দেয় না কেন?’
‘ কে জানে।আপু তুই আমাকে সাহায্য করবি?’
‘ কিভাবে?’
‘ আমার পক্ষ হয়ে বলে দিবি যে আমি তাকে ভালোবাসি।অনেক বেশি ভালোবাসি।’
তুতুল সময় নিয়ে ভাবে।তারপর উৎসাহ দিয়ে বলল,’ ঠিক আছে ছেমড়ি।তোর জন্য এইটুকু করতেই পারি।সে কোথায় থাকে??’
‘ এখানেই।আশেপাশে।আজ হলুদের অনুষ্ঠানেও আসবে।’
‘ তাহলে তো অনেক সুবিধা।দেখাই দিছ।আমি বলে দিবো।’
‘ আচ্ছা।’
খুশিতে মনের মাঝে বাকবাকুম করে উঠে আরোহির।দু হাতে জাপ্টে ধরে তুতুলকে।তুতুল হাসে।পাগল মেয়ে।প্রেমে পড়ার বয়সটাই গোলমেলে।পড়লে মনে হয় হাত পা ভেঙ্গে পড়ে।উঠতে চেয়েও উঠতে পারে না।রিঝের চোখে চোখ পড়তেই সে ইশারা করে।আরোহি খুশিতে ছুঁটে রুমের দিকে চলে যায়।তুতুল ফোন কানে ধরে ঝাঁড়ি মারা কন্ঠে বলে,’ কি হয়েছে?এতো জালাচ্ছেন কেন?’
চরম চমৎকার একটা ঠোঁট কামড়ানো হাসি দিয়ে রিঝ বলল,’ এটা তো ট্রেলার ছিল।মুভি তো শুরুই হয়নি।’
রিঝের কথা শুনে তুতুল হাসল।বলল,’ আপনার মাথা গেল বলে।পাগলামি বন্ধ করুন।’
অদ্ভুত স্রোতের মত শীতল একটা বাতাস খেলে গেল।দোল খাইয়ে দিল তুতুলের দীর্ঘ কালো কোঁকড়া চুল গুলো।ঢেউ খেয়ে এলোমেলো কেশ এসে পড়ল মুখের দৃশ্যমান অংশে।ঠেকে দিল অনেকটুকু মুখ।রিঝ উদ্বেগী হয়ে বলল,’ চুল সরিয়ে দেও।আমি দেখছি তো।’
‘ কি দেখবেন?’চমকে উঠে বলল তুতুল।
নেশাতুর কন্ঠে জবাব আসল,’
‘ তোমার কালো তিলের মায়াবী হাসি
আমার কলিজায় বাজে দীর্ঘ সর্বনাশের সুর রাশি রাশি।’
_________________________
আলভী দরজা খুলতেই চোখে পড়ে হলুদ বর্ণে ডুবা মেয়েটি।মনিপুরি হলুদ শাড়ির ভাঁজে মুড়িয়ে আছে সে।ডান হাতে চুড়ি।বাম হাতে চেইনের ঘড়ি।খোঁপা করা চুল।সেই চুলের ভাজে হলুদ ফুলের জায়গা হয়েছে।ঠোঁটে গোলাপি লিপস্টিক।মুখ জুড়ে একটা ঠান্ডা ভাব।খুব গম্ভীর টিচারের মত দেখতে লাগছে।আলভী আশ্চর্য গলায় ডেকে উঠল,’ আম্মু!ও আম্মু।’
ছেলের এমন খক খক গলার চিৎকার শুনে মিসেস আমিনা রান্নাঘর থেকে ছুঁটে আসেন।চিন্তিত সুরে বলে উঠেন,’ কি হইছে??এমন চিৎকার করছ কেন?’
‘ আম্মু ও এখানে কি করছে??’
আমিনা চোখ তুলে তাকায়।প্রীতিকে দেখে মিষ্টি করে হাসে।প্রীতিও হাসে জবাবে।তারপর আলভীর হাত টেনে সামনে থেকে নিয়ে এসে রাগী কন্ঠে বললেন,’ কি করছে মানে কি?ও মেহমান।বেয়াদপের মত চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তুলছ কেন?আর ওকে আমি ডেকেছি।কত ভালো মেয়ে।তুতুলের জন্য কত রাত জেগে ছিল তুই ভুলে গেলি সব।’
‘ কিছুই ভুলি নি আম্মু।কিন্তু এখন যদি আমার বোনের বিয়ে হতো অবশ্যয় আমি দাওয়াত করতাম।কিন্তু এটা আমার মামার মেয়ের বিয়ে।কত দুরের সব।’
‘ তোর মামাই বলেছে ডাকতে।তোর সমস্যা কি ?এমন কেঁচ কেঁচ করছ কেন?যা ওকে ঘরে নিয়ে আয়।ফাইজলামি বন্ধ কর।’
অসহায় চোখে আলভী মায়ের দিকে একবার তাকায়।আর কোন উপায় না পেয়ে সে প্রীতির কাছে যায়।কিছুটা বিরক্তি নিয়েই বলে,’ আসো।’
প্রীতি বিরক্তির কারণ বুঝতে পেরে একটু মন খারাপ করে।তবে সেই মন খারাপ বেশিক্ষণ স্থায়ী হলোনা।
আকাশের সাথে এসেছে রূমাশ্রী।রিঝের বাবার বিজনেস পার্টনার হলো আকাশের বাবা।সেই হিসেবে মিসেস মরিয়ম এবং মিস্টার মুহিতও এসে হাজির হয়েছে হলুদের অনুষ্ঠানে।আকাশের পাশে রূমাশ্রীকে দেখে মিসেস মরিয়ম খুব চটে গেলেন।আকাশ বুঝতে পারেনি তার বাবা মাও এসে হাজির হবে।সকালে যখন ফোন করেছিল তখন তার মা বলেছিল হলুদে গিয়ে কি আর করবে।বিয়েতেই যাবে।কিন্তু এখন পরিস্থিতি দেখে আকাশের পালাতে ইচ্ছে করছে।পথ খুঁজে চলেছে সে।কোন দিক দিয়ে পালাবে!মা যে দিকে যাচ্ছে সে তার বিপরিত দিকে হাঁটছে।মরিয়ম স্বামীর কানের কাছে বসে গুজুর গুজুর ফুসুর ফুসুর করছে।বার বার বলেছে,’দেখ না গো এই মেয়ের সাথে আমার আকাশ কি করে?হসপিটালে ও দেখালাম আকাশের পিছনে পিছনে ঘুরছে।এখনও দেখছি ঘুরছে।কাহিনী কি??শুনো না আমি ওই দিন একটা মেয়ের কন্ঠ শুনেছিলাম।সকাল সকাল তো আর আকাশ অফিসে থাকে না।তাহলে নারী কন্ঠ কই থেকে আসছে?আল্লাহ আমার ছেলে লুকিয়ে প্রেম ট্রেম করেনি আবার ??’
মিষ্টার মুহিত স্ত্রীকে আশ্বস্থ করে বললেন,’ তেমন কিছুই না।তুমি বেশি ভাব।এসব হলে আকাশ অবশ্যয় আমাদের জানাত।ও তো সব কথাই তোমার সাথে শেয়ার করে।প্রেম করলেও বলত।’
‘ তবুও আমার না কেমন গোলমেলে লাগছে।’ মরিয়মের কন্ঠে বড্ড চিন্তা।
রামিম আর আসমা আসে এক সাথে।আকাশ রামিমকে দেখেই প্রচন্ড উত্তেজিত হয়ে বলে উঠে,’ ভাই রূমাশ্রী আমার সাথে আসছে।’
রামিম হেসে উঠে বলল,’ তো কি হইছে?ও তো তার বাড়িতেই থাকে।আসলে কি হইছে?’
‘ ভাই আম্মুও এসে হাজির হয়েছে।আমাদের দুইজনকে এক সাথে দেখে কি যে চেহারা করেছে তোকে বলে বুঝাতে পারবো না।’
‘ আরে বাদ দে।আন্টি মনে হয় এমনেই ভাবছে এই মেয়ে এখানে এলো কিভাবে।’
আসমা আকাশের কাঁধ চাপড়ে বলল,’ হ সেটাই হবে।নো চিন্তা।বাই দ্যা ওয়ে রূমাশ্রীর সাথে তোর দিন কাল কেমন চলে??’
আকাশ কপাট রাগ নিয়ে বলে,’ কেমন চলে মানে কি??আমি কি ওর লগে থাকি না কি?’
‘ থাকলে কি হয়?তোরই তো বউ।’ রামিম টিটকারি মারে।আসমা সেই সাথে তাল দেয়।একেই প্রচন্ড চিন্তা ভয় আকাশের অঙ্গে অঙ্গে বয়ে চলছে।তারপরে এসব হাসি থাট্টা সে নিতে পারছে না।আসমা ঠোঁট টিপে হেসে বলল,’ দোস্ত পাহাড়ি মাইয়ারে শাড়ি কেডা পড়াইছে??তুই!!’
আকাশ একপলকে সামনে তাকায়।ভালো করে দেখে হলুদ শাড়ির পাহাড়ি কন্যা রূমাশ্রীকে।পাতলা হলুদ জামদানী শাড়ি।সোনালি রঙ্গের ব্লাউজ।লম্বা সুরু চুলগুলো পিঠময় ছড়িয়ে ছিঁটিয়ে আছে।কমলা ঠোঁটে দিয়েছে খয়েরি লিপস্টিক।মেকাপ করেছে অল্পসল্প।একেই সুন্দর।তারপর এখন লাগছে ভয়ংকর সুন্দর।আকাশের একটি ঠোঁট নিচে নেমে গিয়ে হা হয়ে যায়।আসমা চোয়াল ঠেলে বলে,’ ধীরজ রাখ দোস্ত।তোরই তো বউ।নজর লাগবো তো।’
আকাশ কেঁশে গলা পরিষ্কার করে।ভাব নেয় রাগের।তারপর বলে,’ ফালতু কথা বন্ধ করবি তোরা?’
‘ না করবো না।আগে বল শাড়ি কে পড়াইছে?তুই?’ আসমা চোখ টিপে বলল।আকাশ দু হাত নেড়ে বলল,’ এই না না।ও নিজেই পড়েছে।শুধু শাড়িটা আমি কিনে দিয়েছি।’
আসমা চোখ কপালে তুলে উচ্চ শব্দে বলল,’ ও ও ওও এই হচ্ছে বেপার।বাবুতো দেখি বউরে শপিংও করে দেয়।’
আকাশ চোখ রাঙ্গিয়ে তাকাল।আসমার ভ্রক্ষেপ নেই।সে চেতাইতেই ব্যস্ত।
সন্ধ্যা নেমেছে হলুদ খামের প্রলেপ বেয়ে।চারপাশে হলুদের সাজে ছেঁয়ে গেছে প্রকৃতি।সামনা সামনি দুটি বাড়ি আজ বউ সেজেছে।গাছপালা,দেয়াল,আঙ্গিনা সেজেছে নিজের একটা অন্যরকম রূপে।হালকা মৃদূ বাতাস ছড়িয়ে পড়ছে পাতায় পাতায়।অন্ধকারকে ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছে হাজারো ঝাঁকের ফ্যাকাসে,উজ্জ্বল আলোক রশ্নি।তুতুল হাতে তুলে নেয় একটা কাজলের পেন্সিল।আঁকতে বসে চোখের নিম্নের রেখা।কাজল তার পছন্দের কোন বস্তু নয়।কিন্তু শুনেছে তার ডাগর ডাগর গোল চোখগুলোতে কাজল দারুন মানাবে।মানুষ স্বাভাব স্বরূপ নিজের গুনগান বা তারিফ যেটাই বলা চলে সেটাই অন্যের কাছ থেকে পাওয়াটা গ্রহণ করে বেশি।আজকের এই সাজ যেন নিজের জন্যে নয়।অন্যের নামে বরাদ্দকৃত।মনের মাঝে একটা যুক্তিহীন বোবা সত্ত্বার কথায় সে আজ নিজেকে সাজিয়ে তুলছে।এই সাজের প্রতিটি আনাচে কানাচে আছে পবিত্রতা।এমন একজনের জন্য এই সাজ যার জন্যেই তৈরি সে।স্বামীর জন্যেই তো সাজ হালাল করা হয়েছে।শুনেছে সে।জ্ঞানী মানুষ উঠতে বসতে এসবই জ্ঞান দেয়।বিশেষ করে গ্রামের দাদি চাচিরা।ভারি অদ্ভুত যুক্তি।এত কষ্ট করে সাজবে।নিজেকে ফুঁটিয়ে তুলবে।নিজের রূপের বহিপ্রকাশ ঘটাবে এই সাজ দিয়ে।মানুষ দেখে সুন্দর বলবে।এটাই তো স্বাভাবিক।কিন্তু কি আশ্চর্য নিয়ম।শুধু একজনের জন্যেই এই সাজ বরাদ্দ।এই প্রকাশিত রূপের প্রতিটি বিন্দু কণা তার।শুধু তার জন্য।কি অনুচিৎ নিয়মকানুন!তুতুল মুখটা ছিটকে নিল।দ্রুত উঠে পড়ল আয়নার সামনে থেকে।মনে মনে নিজেকে কিছু উদ্ভট কথা শুনিয়ে দিল।রুমের সফেদ পর্দাটা ঠেলে বেড়িয়ে এলো আরোহি।গুটিশুটি পায়ে এসে দাড়িয়ে পড়ে তুতুলের পাশ ঘেঁষে।কাজল চোখের উপরের ভ্রু গুলো কুঁচকিত করে তুতুল প্রশ্ন করল,’ কিরে?তুই এখানে কি করছ?নিচে যা।সবাই তো চলে গেছে।’
‘ তোর জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম আপু।’ আরোহি একটু ধীরে ধীরে কথা বলছে।যেন তার অনেক সময় চাই।তুতুল হাতের কাজল নিচের টেবিলে রেখে বিছানা থেকে ওড়না তুলে নিতে নিতে বলল,’ কেন?আমার জন্য অপেক্ষা করার কি আছে?যা নিচে যা।আসছি আমি।’
প্রথমে মৃদূ স্বরে।তারপর গলার স্বর খানিকটা চড়া করে তুতুলকে বলল,’ আপুনি উনি ছাদে আছে।’
ওড়না কাঁধের দু পাশে রেখে লম্বা করে ছেড়ে দেয় তুতুল।বিস্ময় প্রকাশ করে বলল,’ কে রে?’
‘ আরে তোকে বলেছিনা চশমা পড়া ছেলে?’
তুতুল স্তম্ভিত কন্ঠে বলল,
‘ তুই সিরিয়াসলি বলেছিলি??’
‘ অনসিরিয়াস হবো কেন?প্লিজ আপু তুই বলছিস বলবি।প্লিজ বলে দে না।যে আমি উনাকে পছন্দ করি।’
কথা বলতে বলতে তুতুলের হাতটা টেনে হেঁচড়ে সিঁড়ির দিকে নিয়ে গেল।তুতুল বলল,’ তুই কি পাগল??এই বয়সে প্রেম?তাও আমারে দিয়া বলাইতে চাস?কেস খাওয়াবি না কি?’
‘ প্রেম করবো কে বলছে।বিয়ে করবো একদম।আপুর বিয়ে হয়ে গেলেই রাস্তা খালি।এক ঘরে দুজন।’
একটু নীরব থেকে তুতুল সন্দিহান কন্ঠে বলল,’ এক ঘর মানে??’
‘ আরে মানে এক সাথে ঘর থেকে বিদায় হব।’
‘ এতো সখ বিদায় হওয়ার??’
আরোহির কথায় তুতুল একদম নির্বাক হয়ে পড়ে।এই মেয়ে কি পাগল?বিকারগ্রস্ত মনে হচ্ছে এই আরোহিকে।তুতুলকে আকুতিমিনুতি করে ঠেলে পাঠায় উপরের দিকে।ছাদে উঠে ভয়ে অন্তরআত্না কেঁপে উঠে তার।একটা লম্বা মত লোক দাড়িয়ে।ঝাপসা আলোকসজ্জা।ভালো করে দেখা যাচ্ছে না।সে ধরে নিল পাঞ্জাবি পরিহিত পুরুষ।আশ্চর্জ্জনক ভাবে খুব চেনা চেনা মনে হচ্ছে।পিছে দু’হাত নিয়ে দাড়িয়ে আছে মানুষটি।ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল তুতুল।একটু উচু গলায় প্রথমে বলল,’ এই যে শুনছেন?আরোহিকে চিনেন??’
বিপরিত পাশের উত্তর এলো নিশ্চুপ।কোন কথাই শুনা গেল না।কিছু হয় তো বলেই নি।তুতুল ভয়ে আতঁঙ্কে নিজের বুকে ফুঁ মারে।শুকনো ঢোক গিলে।গলা শুকিয়ে গেছে এই একটুতেই।লম্বা শ্বাস নেয় সে।অনেক সাহস সঞ্চয় করে চোখ বন্ধ করে।দ্রুত গতিতে নিঃশ্বাস বন্ধ করে বলা শুরু করে,’ দেখেন আমার বোন আছে না আরোহি সে না কি আপনাকে পছন্দ করে।এক কথায় লাভ সাবের ব্যাপার।সে ভালবাসে।আপনারও উঁচিত ভালবাসা।রূপবতী মেয়ে।অনেক সুন্দর।ধবধবে গায়ের রং।টানাটানা চোখ।চিকন পাতলা ঠোঁট টকটকে লাল।লম্বাও অনেক।আর কি কিছু লাগে?আমার তো মনে হয় না।সে বিয়েও করতে চায় আপনাকে।রাজি হয়ে যান।আপুর বিয়ের পরেই আপনাদের বিয়ে দিয়ে দিবো।এখন আসি।’
তুতুল দৌড়ে পালাতে নেয়।এসব সে পারে না।কারো জন্য তো দূর নিজের জন্যও করতে পারে না।ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে সে।মনে হচ্ছে ছাদে প্রেতাত্না ঘুরছে।এখনি মেরে দিবে।ঘাড় মটকে দিবে।না হয় গলায় বসাবে কামড়!তুতুল নিজের হাতে টান অনুভব করে।সারা শরীর ঘামে ভিঁজে উঠে তার।কাজল চোখের পাপড়িতে জমে পানি।আকর্ষিক ভাবে ফেঁসে গেলো মনে হচ্ছে।মানুষটা যদি তার সাথে উল্টোপাল্টা কিছু করে?সে তো চিনেও না।একা ছাদে।আর যদি ভুত হয়!ফাঁদে পড়া পাখির মত ছটফট করা শুরু করে তুতুল।কেঁদেই দিলো বলে।হঠাৎ হেঁচকা টান পরে।তুতুলের পিঠ ছুটে এসে বাড়ি খায় প্রশস্ত বুকে।সুগঠিত দুটি পেশি দু পাশ থেকে আঁকড়ে ধরে তাকে।মেদহীন কমড় জড়িয়ে ধরে দুটি হাত।ঘাড়ে বাড়ি খাচ্ছে উষ্ণ গরম নিঃশ্বাসের তাপ।গলা কাঁধময় ছড়িয়ে পড়ছে সেই গরম হওয়ার উত্তপ্ত তাপ।একটা মিষ্টি ঘ্রাণ ভেসে আসছে নাকে।অতিপরিচিত আপন সেই সুঘ্রাণ।একটা ঠান্ডা খোঁচা দাঁড়ি যুক্ত থুতনি এসে ভর করে খালি কাঁধের অংশ।উম্মুক্ত অংশ জুড়ে শিরশির অনুভুতি ছড়িয়ে পড়ছে।কানের পাশে শীতল মায়াবি একটা কন্ঠ এসে লাগে।কেউ বলছে চিকন সুরেলা কন্ঠে,
‘ রূপের সৌন্দর্য দিয়ে ভালবাসা হয় না।ভালবাসাই সব কিছুকে সৌন্দর্য্যে মুড়িয়ে দেয়।রূপে ডুবিয়ে দেয়।যখন তুমি ভালবাসা নামক মায়াজালে আটকা পড়ো।তখন সে খনিকে খনিকে তোমার চোখে রূপবতী হয়ে উঠে।কিন্তু সব রূপবতীকে ভালবাসা হয়ে উঠে না।’
কৃষ্ণচূড়ার রং লাল-৩৮.🎈
@হাফসা আলম
_____________________
সাদা পাঞ্জাবির হাতায় সুন্দর কাজ।পরিপাটি পোশাক।বিয়ে করতে যাচ্ছে না কি?তাও আবার?তুতুল তিক্তমেজাজে তাকাল।তার এখন খুব মেজাজ খারাপ।আরোহির কি মাথা খারাপ?না কি পাগল হয়ে গেছে?সারা দুনিয়ায় আর ছেলে খুঁজে পেল না?খুঁজে খুঁজে তারি জামাইয়ের ঘাড়ে ঝুলতে চায়?এ কেমন বিচার?চশমা পরা মানুষের তো অভাব নেই দুনিয়া জুড়ে।কেন শুধু রিঝ ভাইয়াই হতে গেল?তুতুলের মুখের রেখা আরো উলটপালট হয়ে যায়।মানুষের মনের মত বিচিত্র আর কিছু এই পৃথিবীতে আছে বলে তুতুলের মনে হচ্ছে না।আরোহির দেখান ছেলে যে রিঝ হবে স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেনি সে।কিন্তু যখন ঘুরে দেখল সেই অতি পছন্দের চশমা পরিহিত ব্যক্তিটি হচ্ছে রিঝ মুহূর্তে তার সর্বাঙ্গ জ্বলে উঠল যেন।একটা অদ্ভুত অনুভুতি বিষাক্ত সাপের মত ছবল দিল যেন।সেই বিষ ছড়িয়ে পড়ল তার অঙ্গে অঙ্গে।নিজের আপন অস্তিত্ব যেন হঠাৎ করে বিলিন হয়ে গেল।মস্তিষ্ক থাবা মেরে শুধু একটা কথাই কামড়ে ধরে আছে উনি তো আমার!এটা ঠিক রিঝকে সে আজও স্বামী হিসেবে ঠিক মেনে নিতে পারেনি।বিয়েটা খুব অদ্ভুত ভাবেই হয়েছিল।মনটা মানলেও মস্তিষ্ক মানতে সময় নিচ্ছে।তাই বলে সজ্ঞানে নিজের স্বামীকে অন্যের করে দেওয়ার মত বদ্ধ উম্মাদের মত কাজ সে কিভাবে করবে?তুতুল গভীর ভাবে অনুভব করছে সে নিজের ছোট মামাতো বোনটিকে খুব অপছন্দ করছে।এক কথায় ঘৃন্নাও কাজ করছে।সে জ্বলছে!খুব করে জ্বলছে একদম জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের মত।যদিও তার ছোট বোনটি জানে না রিঝ ভাইয়া সম্পর্কে তার কি হয়?জানবে কিভাবে এই ভয়াবহ সত্য কাউকে তো বলাই হয়নি।গোপনে খুব নিরবে পড়ে আছে একটা কোনায়।এভাবে তাকে দোষ দেওয়া একদম উঁচিত হচ্ছে না।তবুও..আচ্ছা তাহলে কি সবাইকে বলে দেওয়া উঁচিত??কিন্তু বলে দিলে তো সবাই খুব কষ্ট পাবে?ভাইয়া তো রেগে আগুন হবে।এক্সিডেন্ট কথাটা সবাইকে বুঝিয়ে বলতে সময় লাগবে।তত সময় কি সবাই দিবে?এভাবেই মনের মধ্যে ক্রমাগত লড়াই করছে তুতুল।বাড়ির দ্বিতীয় ছাদটিতে পা ঝুঁলিয়ে বসে আছে তারা।তুতুলের মুখটা আবছা আলোয় দেখা যাচ্ছে।লালছে ছাপ পড়েছে।রিঝ চুপ করে বসে আছে।তুতুল কিছু বলবে বলে অপেক্ষা করছে তেমন নয়।কিন্তু তুতুল চুপ করে আছে কেন সেটাই ভাবছে।আরো কয়েক মিনিট পরে তুতুল মুখ খুললো।ক্রদ্ধের সাথে বলল,” আরোহির সাথে আপনার চক্কর চলে??”
আকর্ষিক এই কথাটা কানে যেতে রিঝ টের পেল তুতুল খেঁপা।মুখটা তুতুলের দিকে ফিরিয়ে সে তাকিয়ে আছে।তুতুল আবার বলল,’ কথা বলছেন না কেন?’
‘ কি বলবো?’
‘ এই যে চক্করের কথা’
‘ ছি এসব কেমন ভাষা?আর কিসের চক্কর?’
‘ তা না হলে এ আমাকে দিয়ে আপনাকে বিয়ের কথা কেন বলল?’
‘ আমি কি জানি।’ রিঝ মুখটা ঘুরিয়ে সামনে রাখে।তুতুলের এমন লাগামহীন কথা তাও তার সাথে ভাবতেই পারছে না সে।
‘ আপনি জানেন না?’ সন্দেহান হয়ে বলল তুতুল।
‘ না জানি না।জানবো কিভাবে?ওর সাথে কি আমার কথা হয়?যে সব আগে থেকে জানবো?’
‘ একদম ও বলবেন না?হয় তুই করে বলবেন না হয় আপনি।আর যদি দেখি কাউকে ও ও করে কথা বলছেন তাহলে ধাক্কামেরে নিচে ফেলে দিবো।’
‘ ফেলে দিবে?’ রিঝের কন্ঠে বিস্ময় প্রকাশ পেল।কথাটা শুনে নয়।তুতুল বলেছে তাই।
‘ হ্যাঁ দিবো।মোটেও মজা করছি না।সত্যি দিবো।আপনি বলেন আপনি তো আমার হাজবেন্ড।আপনার তো বউ আছে।তাহলে অন্য মেয়ে আপনাকে কিভাবে বলতে পারে সে আপনাকে বিয়ে করতে চায়?তাও আপনারি বউয়ের মাধ্যমে?’
‘ সেটাই তো।কত বড় সাহস তাই না?আমিও ভাবি এতো সাহসি একটা মেয়ে থাকতে তুমি কেন আমার গ না স্যরি।’
চোখ রাঙ্গিয়ে রিঝের দিকে তাকাতেই রিঝ ঢোক গিলে চাপা হাসল।ভাবতে লাগল এই মেয়েকে সে কবে থেকে ভয় পেতে শুরু করেছে।এখন থেকে!
‘ আরহিকে আপনি পছন্দ করেন??’ গলার স্বরে ভীতি।রিঝ কপালের একপাশের চুল আঙ্গুল দিয়ে সরিয়ে দিল।তুতুল বিরক্ত চোখে তাকাল।বলল,’ এসবের কারণেই তো ছোট ছোট মেয়েগুলো বেহুশ হয়ে পড়ে।’
‘ কিসবের কারণে?’ রিঝ কৌতুহলি হয়ে তাকাল।তুতুল মুখ বাঁকা করে ভেংচি কাটল।দূরের বাড়ি থেকে হঠাৎ একটুকরো আলো এসে পড়ল তাদের গায়ের উপরে।তুতুল দু হাতে মুখ ঢেকে নেয়।রিঝ চোখের উপরে ডান হাত রাখে। তীর ছুঁটে এসেছে এমন আলো।আসমা ছাদের কোনা থেকে হাত নাড়াল।রিঝ কপাট রাগ নিয়ে ফোন বের করে কানে ধরল।কল রিসিভ করতেই বলল,’ ফাইজলামু পাইছস??আলো সরা।’
‘ তোমরা লুকিয়া লুকিয়া প্রেম করিবা আর আমরা লুকিয়ে দেখলেই ফাইজলামি??’
‘ আসমা মজা না।আলো অফ করে নিচে যা।দ্রুত।’ রিঝের কন্ঠে তুতুল নিজেও ভয় পেয়ে গেল।তুতুলের উপরের রাগ আসমার উপরে চালিয়ে দিয়ে রিঝ সটাং হয়ে ঠিক হয়ে বসে।দু’একটা দীর্ঘ করে শ্বাস ফেলল।তুতুল একটু লুকিয়ে আড়চোখে রিঝের দিকে তাকাল।সাদা পাঞ্জাবিতে যে এই লোকটাকে এত সুন্দর লাগে সে আগে যান তো না।সুগঠিত পেশীতে ফিট হয়ে লেগে আছে।বাহু,প্রশস্ত বুকের সাথে সফেদ পাঞ্জাবিটা দাঁত কামড়ে গভীরে যত্নে জড়িয়ে আছে।চুল,দাঁড়ি সব কিছু কত পারফেক্ট করে সাজানো।মেয়েরা যেমন,সেজেগুঁজে রাস্তায় বের হয় অন্যের চোখে নিজেকে পরিপাটি দেখানোর জন্যে।ছেলেরাও নিশ্চুয় এই শরীর তৈরি করে অন্যের চোখে নিজেকে তুলে ধরতে।রিঝ ভাইয়াও নিশ্চুয় তাদের দলেই।তা না হলে কষ্ট করে সকাল সকাল এত কসরত কেন?তুতুলের চোখ জোড়া জ্বলে উঠে।যেখানে সে এই একজন লোকের জন্যে সেজেছে আর এই লোক সম্পর্ন্য বডি তৈরি করে রেখেছে অন্যদের দেখানোর জন্যে?সে তো নায়ক নয়,বা মডেলও না।যে এতো সুন্দর শরীরের খুব প্রয়োজন।এসব দেখে দেখেই তো আরোহি বিয়ে করার জন্য নাচানাচি করছে।তুতুল মনের কথাগুলো বলেই দিল,
‘ এত যত্ন করে বডি তৈরি করেন নিশ্চুয় ছোট ছোট মেয়েগুলোকে পটানোর জন্যে??তাই না মিষ্টার ভাইয়া??’
চোখ বড় বড় করে ভূত দেখার মত তাকাল রিঝ।কড়া কন্ঠে বলল,’ সাবধানে কথা বলো।তোমার কি আমাকে একটুও ভয় করছে না?কি সব বলেই চলেছ?সেট আপ।’
মুখের সামনে হাতটা এমন ভাবে নাড়াল যেন মাছি তাড়াচ্ছে।মনে মনে তুতুল একটু ভয় পাচ্ছে।কিন্তু সে তো এখন এই লোকের বউ।একটু নড়েচড়ে বসলো সে।কেমন যেন একটা ভাব চলে এসেছে।বউ হওয়ার মাঝেও যে এতো তেজ পাওয়া যায় তার জানা ছিল না।তুতুল সমান তালে রাগ দেখিয়ে বলল,’ না করছে না।’
রিঝ এবার পুরোদমে রেগে গেল।তুতুলের সামনাসামনি মুখ ঘুরে বলল,’ ভালবাসা মানে বুঝো??মজা করার মত জিনিস না।আমি যখন একবার বলেছি তোমাকে ভালবাসি মানে এই জীবনে আর অন্যকাউকে ভালবাসা সম্ভব হবে না।আর এসব বডি অন্যকে ইমপ্রেস করার জন্যে করিনি।অন্যের জন্য আমি কখন কিছু করি না।তোমাকে যে ভালবাসি সেটাও নিজের জন্য।কারণ আমার দ্বারা অন্যকাউকে ভালবাসা হচ্ছে না।আমি চেষ্টা করেছি।কিন্তু হচ্ছে না।এতে আমার কিছুই করার নেই।ভালবাসি মানে বাসি।সব কিছুর বিনিময়ে তোমাকে আমার চাই।আমি নিজের থেকেও বেশি ভালবাসি তোমায়।ভালবাসার থেকেও বেশি ভালবাসি তোমায়।যতটা ভালবাসলে ভালবাসা নিজেও বিরক্ত হয়ে উঠবে।তার থেকেও বেশি বাসি।’
ফোঁস ফোঁস করে দ্রুত নিঃশ্বাস ছাড়ছে রিঝ।শরীরে এক ঝড় বয়ে গেল যেন।সাধারণত এত দ্রুত কথা সে বলে না। চোখজোড়া লাল।নাকটাও লাল হয়ে গেছে।রাগে তার চোয়ালের হাড় উঠা নামা করছে।ঘনঘন চোখের পলক পড়ছে।বিমুগ্ধ চোখে তুতুল দেখছে।এসব কথা নতুন শুনছে না সে।ইয়াজও বলতো।আরো সুন্দর করে গুঁছিয়ে পরিপাটি করে উপস্থাপন করত।অনেকটা ভালবাসা মাখিয়ে বলত।রিঝের মত কর্কশ গলায় না।কিন্তু এই কথাগুলোর মত মধুর কথা যেন এই পৃথিবীতেই নেই মনে হচ্ছে তার।এত সুন্দর করে আর কেউ ভালবাসার কথা বলতে পারবে কি না সে জানে না।কিন্তু এই এগারো বারের বলা ভালবাসি কথাটার চেয়ে সুন্দর মনকাড়া ভাষা বোধ হয় আর নেই।বেশ অনমনেই তুতুল বলল,
‘ এত ভালবাসেন?’
‘ হুম বাসি।এখন ফিল্মের মত বলবেনা আমার জন্যে জীবন দিতে পারবেন?আগেই বলে দিচ্ছি পারবো না। ’
‘ কেন কেন?’ বেশ উদ্বেগী হয়ে প্রশ্ন করল সে।
‘ পারবো না মানে পারবো না।জীবন মূল্যবান।’
সঙ্গে সঙ্গে তুতুলের মুখটা থেকে বিমুগ্ধ ভাব উবে গেল।খুব কষ্টের একটা হাওয়া বয়ে গেল অন্তরে অন্তরে।পাগালা একটা ব্যক্তিত্ব বলল,’ আমার চেয়ে জীবন মূল্যবান!তাহলে কেমন ভালবাসা?’বুকে একটা ব্যথা অনুভব হচ্ছে।বেশ ঝাঁঝাল ব্যথা।আহত চোখে সে রিঝের দিকে তাকিয়ে রইল।তার মানে রিঝ নিজের চাইতে বেশি ভালবাসার কথাটা রেগে বলে ফেলেছে।পৃথিবীতে প্রতিটি ব্যক্তি কাউকে না কাউকে নিজের থেকেও বেশি ভালবাসে।রিঝের জীবনের সেই কেউ হতে না পারার কষ্টে তার বুক ভারী হয়ে উঠে।মনে মনে ভাবে সুযোগ পেলেই তো ইয়াজের মত অন্যকাউকে পছন্দ হয়ে যাবে।সে হয়ে যাবে জীবনের থেকেও দামি।মূল্যবান!রিঝ ভারি একটা নিঃশ্বাস ফেলে।রাগ দমিয়ে তুতুলের নরম হাত নিজের মুঠোবন্দি করে।পা গুলো ঝুঁলিয়ে তুতুলের মত নিচে রাখে।পরিবেশের মত শান্ত হয়ে উঠে সে।তারপর থেমে থেমে বলল,’ তোমার সাথে বাঁচার মত এতো সুন্দর জীবন ফেলে আমি যেতে চাইনা।এত সহজে তো একদমই না।আমি যদি বাকিদের মত বলি আমি তোমার জন্য মরতে পারবো,তখন তুমি যদি বলো এখন এই মুহূর্তে জীবন দিয়ে দিতে।ধরলাম আমি দিলাম।তারপর কি হবে?না আমি তোমাকে পাবো না পরকালে শান্তি।আমি তোমাকে আমার জীবনের চাইতেও বেশি ভালবাসি!এ কথাটা মানে হচ্ছে আমার জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত আমি তোমার নামে করছি।তোমাকে আমি বেশি মূল্য দিচ্ছি।তার মানে কি বুঝতে পারছ?আমি তোমাকে নিজের মূল্যবান জীবনের থেকে বেশি মূল্যবান মনে করি।জীবন দিয়ে নয় জীবনভর আমি তোমাকে ভালবাসতে চাই।আমি চাই সারাটা জীবন তোমার হাত ধরে কাঁটিয়ে দিতে।তোমাকে ভালবেসে সকালের সূর্যের আলো নিজের চোখে মাখিয়ে নিতে।আমি তোমাকে কতটা চাই আমি নিজেও জানি না।সব চাওয়ার মাঝে পাওয়ার নেশা থাকে না।কিন্তু তুমি আমার সেই চাওয়া যাকে পাওয়ার নেশায় আমি মরিয়া।যে নেশা আমার হৃৎপিন্ড,কলিজা,মস্তিষ্ক,হাড়ে হাড়ে চেপে বসেছে।তোমাকে পাওয়ার নেশা তোমার প্রিয় কৃষ্ণচূড়ার রঙ্গের থেকেও মারাত্নক গাঢ়!
রিঝ উঠে যেতে নেয়।তুতুল হাতটা টেনে বসিয়ে দেয়।বাম হাতের ভাঁজে হাত রাখে।হঠাৎ একটা আশ্চর্য কাণ্ড হলো।তুতুল রিঝের হাতটা পরম আবেশে জড়িয়ে কাঁধে মাথা রাখল।অবিশ্বাস্য এই কাজটি রিঝ সহজে নিতে পারছিল না।ভাবতে হচ্ছে তাকে।কয়েক সেকেন্ড সে নিরব ভাবনায় ডুবে থাকল।গরম উষ্ণ নিঃশ্বাস যখন রিঝের বুকের দিকে ছুঁটে আসল তখন তার হুশ ফিরল।তুতুল চাপা স্বরে অদ্ভুত প্রশ্ন করল,’ আমার কি আপনাকে ভালবাসা উঁচিত??’
রিঝ কথাটা শুনে খুব হাসলো।উচ্চ শব্দে হাসতে লাগল।তুতুলের রাগ হলো।রিঝের হাতে শক্ত টিমটি কাটল।থামতে বলল।রিঝ হাসি থামিয়ে বলল,’ যদি আমি ভালবাসতে শিখাতে পারতাম তাহলে কি করতাম যানো??’
‘ কি করতেন??’
‘ তোমাকে ভালবাসতে শিখাতাম।খুব যত্ন করে শিখিয়ে দিতাম।নিজের জন্য ভালবাসা শিখিয়ে নিতাম।কিন্তু আফসোস এমন নিয়ম নেই।’
‘ আপনি বলুন আমার কি আপনাকে ভালবাসা উঁচিত?তাহলে আমি অবশ্যয় চেষ্টা করবো?’
‘ ভালবাসতে জানতে হয়।শিখতে হয় না।যখন হবে তুমি নিজেই বুঝতে পারবে।আপাতত তোমাকে দিয়ে এটা হচ্ছে না।আমার ভালবাসাই যথেষ্ট।’
আহাম্মকের মত তুতুল তাকিয়ে বলল,’ আপনি কি আরোহিকে পছন্দ করেন?’
‘ ঠাটিয়ে চড় বসাবো।বেয়াদপ।’
ধমকে তুতুল চুপ হয়ে যায়।মিটিমিটি হাসে।তার খুঁশি লাগছে।ইচ্ছে করছে একটু নাচানাচিও করতে।করলে কি উনি তাকে নিয়ে হাসবে?
রাত তখন কয়টা তারা দু’জনে জানে না।রিঝের মত সময় মাপা ছেলেটা আজ তুতুলের কথা বিভোর হয়ে শুনছে।আকাশে তখন অর্ধ চাঁদ।কালো আকাশের আশেপাশে চলছে তারকাদের খেলা।জেগে আছে সব।সঙ্গ দিচ্ছে তাদের দুজনকে।স্নিগ্ধ ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে।হু হু করে বইছে তীব্র বাতাস।হাওয়া উড়িয়ে নিচ্ছে তুতুলের নেটের ওড়না।আবার ফিরিয়ে দিচ্ছে হাওয়ায় হাওয়ায়।পতাকার মত উড়ছে কোঁকড়া কালো চুল।চাঁদের আলোয় কাজল চোখ দেখতে কি যে মায়াবি লাগছে তা প্রকাশ করার মত ভাষা তৈরি হয়নি।মাঝে মাঝে নিজের কথায় হেসে কাজল চোখের কোণায় কোণায় জলের ফোয়ারা তৈরি করছে সে।রিঝ চুপচাপ শুনছে।সে খুব শুনতে পারে।সবার এই গুন থাকে না।রিঝের আছে।কলিগরা বকবক করে কান শেষ করে ফেলে।সবাই তাকে খুব পছন্দও করে।তার এই নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে শুনতে পারার গুনের জন্য।কারণ পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষ কথা বলতে পছন্দ করে।শুনতে নয়।রিঝ উল্টো।অন্যসবার কথা তার শুনতে তেমন ভাল লাগে না।জোর করেই শুনে।কিন্তু আজ শুনছে মন্ত্রমুগ্ধের মত করে।যাকে ভালবাসে তার সব কিছুই ভালবাসায় ভরে উঠে।কথাটা সত্য।তুতুল বলল,’ আমার কিছু অদ্ভুত সখের কথা বলি??’
রিঝ সহজ গলায় বলল, বল।’
তুতুল উত্তেজিত হয়ে বলল,’ আগে বলেন পুরোন করবেন??’
‘ সামর্থের বাহিরে কিছু করা আমার পছন্দ না।’
‘ ভাব নিচ্ছেন কেন?আমি কি গাড়ি বাড়ি চাইবো না কি?’
‘ তাহলে?’
তুতুলের আগ্রহ কমে গেল।রিঝ বলল,’ বলো না শুনি।’
‘ কি আর শুনবেন।আপনার কেন মনে হলো আমি গাড়ি বাড়ি চাইব?’
রিঝ হেসে উঠে বলল,’ মজা করেছি।’
‘ সবাইকে মজা করলে মানায় না।আপনাকে তো একদমই মানায় না।তাই করবেন না মজা।’
‘ তাই না কি?কেন?’
‘ কারণ আপনি জ্ঞানী বাবা।রাগেই বেশি সুন্দর লাগে।’
‘ রাগটা কত ভয়ংকর জানো তো?’
‘ জানি।’
‘ সামলাতে পারবা??’
‘ এ এমন কি কাজ।আপনাকে এখন আর আমি ভয় পাইনা।বউ তো।বউদের ভয় পায় সব পুরুষজাতি।’
তুতুল দাঁত বের করে হেসে দিল।রিঝ বলল,’ তাহলে মেনে নিচ্ছো তুমি আমার বউ?’
তুতুল থতমত খেয়ে চুপ করে যায়।রিঝ কিছু বলতে যাবে তার আগেই কথা ঘুরিয়ে বলল,’ আপনি শুনবেন??’
‘ শুনেই তো যাচ্ছি।’
তুতুল হেসে বলল,’ প্রথম সখ আপনি আমাকে বেহালা বাজানো শিখাবেন।একদম আপনার মত করে।’
‘ সিরিয়েসলি?এটাও সখ হয়?আমার চেয়ে ভালো টিচার পাবে তুমি।নিয়ে যাবো।’
‘ না আমি আপনার কাছেই শিখবো।’
‘ ওকে ওকে ।বাচ্চাদের মত চিৎকার করছ কেন।পরেরটা বল?’
‘ তারপর বাইক চালান শিখতে চাই।আপনি শিখাবেন?’
‘ পাগল পাইছ?আমি এটা শিখাতে পারবো না।’
“ এমন করছেন কেন?শিখালে কি হয়।প্লিজ প্লিজ প্লিজ।’
রিঝ বিরক্ত হয়ে বলল,’ ঠিক আছে।পরের সখটা নিশ্চুয়ই বলবে আমার ডায়েরি পড়তে চাও??তোমার সখ কি কি হতে পারে আমার জানা হয়ে গেছে।ইডিয়েট একটা।’
‘ আপনি কিভাবে জানলেন আমি ডায়েরি পড়তে চাইবো?তবে হ্যাঁ এটা সত্য।পড়তে চাই মানে চাই।’ তুতুল এক গাল হেসে উঠে।
রিঝ রেগে যাওয়ার ভান করে বলল,’ মানুষের গোপন জিনিস জানতে চাওয়া উঁচিত নয়।’
তুতুল ঠোঁট উল্টে নেয়।বলে,’ বুঝতে পেরেছি আপনি পড়তে দিবেন না।দিবেন কেন গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে অনেক কিছু লিখেছেন যে।হুহ লাগবে না।’
তুতুল উঠে যেতে নেয়।রিঝ আবার বসিয়ে দিয়ে বলল,’ পরের গুলো বলো।’
‘ বলবো না।’
‘ তাহলে আমি এখন ধাক্কা মেরে ফেলে দিবো।’
তুতুল নিচের দিকে একবার তাকায়।পড়লে বাঁচবে কিনা সে জানে না।কিন্তু হাত পা ভাঙ্গবে।শুকনো ঢোক গিলে বলল,’ বাকি গুলো ভুলে গেছি।’
‘ বলবে?’ একটু চেঁচিয়ে বলল রিঝ।তুতুল রিঝের পাঞ্জাবির দিকে একবার তাকায়।তারপর লাজুক হাসি হেসে বলল,’ আপনার পাঞ্জাবি পড়তে চাই।সাদা পাঞ্জাবি।রংটা প্রিয় বলেই বলছি।মজা নিবেন না কিন্তু।তাহলে এখনি চলে যাবো।’
লজ্জারানী তুতুলের গালে মুখে নাকে এসে ভর করে।দুটি গাল লাল টুকটুকে হয়ে যায়।ও লজ্জা পাচ্ছে।একদম লজ্জাবতি গাছের মত মিইয়ে গেল সে।ঠোঁটের অনাচে কানাচে মুচকি মিষ্টি হাসি।রিঝ ভারী গভীর নয়নে পরোক্ষ করল।ভাবল সত্যি তার বউটা অনেক সুন্দর!না অনেক না এর থেকেও বেশি সুন্দর।ঠিক অর্ধ চাঁদের চাইতেও বেশি।রিঝ চাঁদের দিকে একবার তাকায়।তারপর সেই চাঁদের সাদা ধবধবে আলো এসে পড়েছে যে লাল মুখে সেই মুখের দিকে তাকায়।মেয়েটা পাগল আছে।কথাটা মনে মনে বলেই সে হাসল।তারপর তুতুলকে হ্যাঁচকা টানে বুকের পাশে নিয়ে এসে বলল,
‘ তুমি কি প্রথম থেকেই এতো সুন্দর না কি আমার বউ হওয়ার পর থেকে আরো বেশি সুন্দর হয়ে উঠছ?’
তুতুল কিছু বলে না।চুপটি করে রিঝের হৃৎপিন্ডের শব্দ গুনতে শুরু করল।বুকের শব্দ ঝড়ের মত।যেন প্রলয়কালীন ঝড় বুকেই বয়ে চলছে।পরিবেশ ঠান্ডা।শীতল।হাওয়ায় যেন কুণ্ডলী পাকিয়ে এসে কানে কানে ফিসফিস করে বলছে,’ এই মানুষটাকে ভাল না বাসলে তুই জীবনে ভালবাসা কি সেটাই বুঝবি না।মানুষটাকে ভালবাসা উঁচিত না শুধু প্রয়োজন।’
_______________________
হলুদের রাতে তুতুল আর রিঝ ছিল লাপাত্তা।আরোহি তো খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল।ছাদে উঠেও খুঁজে ছিল।কিন্তু সেখানে ছিল না।একে রাত।তারউপরে ছাদে তেমন আলো নেই।সে আর সাহস করে একদম উপরের ছাদে উঠেনি।খুব ভয় পাচ্ছিল সে।একটুও মজা করতে পারে নি।নিজের বোনের হলুদ আর সে কোণায় বসে বসে ভাবছিল,রিঝ কি তুতুলকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছে ছাদ থেকে?দিতেও পারে।এই ছেলের বিশ্বাস নেই।আরোহি তো নিজের নিঃশ্বাসকেও একবেলা বিশ্বাস করে নিবে কিন্তু রিঝের রাগকে তার বিন্দু মাত্র বিশ্বাস নেই।রাতে যখন তুতুলের বাবা আর আলভী খোঁজা খুঁজি শুরু করল। তখনও পাওয়া গেল না।আসমা কোথা থেকে এসে বলল,’ তুতুল সেফ আছে।ওকে আমার একটা কাজে রিঝের সাথে যেতে বলেছি।খুবই গুরুত্বপূর্ন্য কাজ।চলে আসবে।’
আরোহি তখন একটা দীর্ঘ শান্তির শ্বাস ফেলল।কিন্তু ঘুমাতে এসে দেখল ঘুম আসছে না।এপিঠ ওপিঠ করে অনেক কষ্টে চোখ লেগে আসে।ভোরে উঠে দেখে তুতুল তার পাশেই।রাতের জামাটাও পাল্টেনি।ওভাবেই শুয়ে আছে।সকাল হতে না হতেই আরোহি তুতুলের মাথা খারাপ করে দেয়।তুতুলের তখন প্রচন্ড মাথা ব্যথা।সারা রাতের ঘুম তার চোখের পাতায় লেপ্টে আছে।তার মধ্যে আরোহির একটাই প্রশ্ন,রিঝ উত্তর কি দিয়েছে?’ তুতুলের যে তখন কি রাগ হচ্ছিল সে বলে বুঝাতে পারবে না।ইচ্ছে করছিল একটা ঠাটিয়ে চড় মেরে দিতে।বলতে,দেখ উনি আমার…. বলতে চেয়েও বলে না সে।গলা থেকে কথাটা আবার গিলে নেয়।আরোহি উত্তর শুনতে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।বিয়ে বাড়ি মানেই মানুষে ভরা মহল।এদিকে মানুষ ওদিকে মানুষ।এক পলকের জন্যে মনে হয় পৃথিবীর সবাই এসে হাজির হয়েছে ঘরে।সবাই তৈরি হয়ে বসে আছে।সামনাসামনি বিয়ে।এটা কোন বিয়ে?তুতুলের খুব বিরক্তিকর মনে হচ্ছে এই বিয়ে।বর এক লাফে এসে হাজির হতে পারবে।মেয়েকে বেশি দূরে যেতে হবে না।দু লাফে বাড়িতে।কিন্তু একটা দিক ভাল হয়েছে।রুচিকা আপু তার আশেপাশেই থাকবে।আপুকে তার খুব ভাল লাগে।অনেক আদর করে বলে কথা।তুতুল নিজের মাকে শাড়ি পড়িয়ে দিতে ব্যস্ত।মায়ের আচঁল ঠিক করে দিচ্ছে।কুচি ঠিক করে দিচ্ছে।
আকাশের মায়ের মাথায় হাত।এখন হার্টঅ্যাট করবে মনে হচ্ছে।রাগে ক্রদ্ধে শরীর জ্বলে যাচ্ছে তার।নিজের ছেলে বিয়ে করেছে?তাও একটা উপজাতি পাহাড়ি মেয়েকে?অথচ তিনি জানে পর্যন্ত না।মাথায় যেন আকাশটাই ভেঙ্গে পেড়েছে তার।সামনে বসে আছে রূমাশ্রী,আকাশ।দুজনেই ভীতু খুব।আকাশের মুখটা রক্ত শূন্য।মা তার বন্ধুর মত ছিল।সব কিছুই সে মায়ের সাথে শেয়ার করে।এত বড় কথাটা চেপে গেছে জেনে তার মা না জানি কি রিয়েক্ট করে?ভাবতেই তার কলিজা কাঁপছে।একটু দূরে দাড়িয়ে এই দৃশ্য দেখছে আসমা আর রামিম।রিঝ পাশে এসে দাড়িয়ে বলল,’ দাড়িয়ে আছিস কেন?চল।’
রামিম অসহায় কন্ঠে বলল,’ দোস্ত আকাশ তো ফেঁসে গেছে।ওর বিয়ের কথা জেনে গেছে আন্টি আঙ্কেল।’
‘ ও এই ব্যাপার।আন্টিকে তো আমিই বলেছি।’ রিঝ শার্টের হাতা ভেঙ্গে নিতে নিতে বলল।আসমা রামিম দুজনেই বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে চেঁচিয়ে বলল,’ তুই!’
‘ হুম আমি।এতো চিৎকার চেঁচামেচি করার মত কিছু হয়নি।বিয়ে করছে বাবা মা জানবে এটাই স্বাভাবিক।তোদের মুখ দেখে মনে হচ্ছে খুন করেছে।’
রিঝের কন্ঠ স্বাভাবিক।সে হাসছে।তাকে একটুও বিচলিত দেখাচ্ছে না।উল্টো মনে হচ্ছে সে দারুন খুশি এই ব্যাপারটায়।আসমা রামিম দুজন দুজনের দিকে একবার তাকাল।তারপর আবার রিঝের দিকে।রিঝ রামিমের পিঠ চাপড়ে বলল,’চল যাই।এদের এসব কথার মাঝে থেকে কাজ নেই।’
রামিম তৎপর হয়ে বলল,’ তুই এটা কি করলি??আকাশ তো এখন পুরো ফেঁসে গেছে।দেখ অবস্থা কত খারাপ।পরেও বলা যেত।আর ও না চাইতে তুই কেন বললি?বেচারা আকাশ।’
‘ ও মোটেও বেচারানা।মাঝে মাঝে সঠিক পথে চলতে হলে আগে ফাঁসতে হয়।’
‘ রিঝ তুই সব সময় যা করিস সব ঠিক মনে হয় আমার।কিন্তু এটা ঠিক মনে হচ্ছে না।স্যরি দোস্ত।’ আসমা রেগে বলল।রিঝ কাজে লেগে পড়ে।মেহমানদারী করছে সে।ভাইয়ের বিয়েতে তার কাজের চাপ নেহাত কম নয়।এদের কথায় তেমন পাত্তা দিল না সে।আসমা মুখে আঙ্গুল পুরে কামড়ে কামড়ে দেখছে আকাশের নেতিয়ে যাওয়া মুখটা।হঠাৎ করে রামিমের হাত চেপে বলল,’ ভাই আমাদেরটা তো একদম কেস খাওয়ার মত।এটা যদি রিঝ বলে দেয় হিমেল বিয়েই করবে না আমাকে।’
রামিম রেগে উঠে বলল,’ সব সময় নিজের কথা না ভেবে অন্যের কথা ভাব।বিয়ে না করলে নেই।তোর তো বিয়ে হেয়ে গেছে।আবার বিয়ে করতে হচ্ছে কেন?যতসব ফালতুতামি।ডিজগাস্টিং।
মায়শাকে দেখে আসমা।দূর থেকে দেখা যাচ্ছে লাল ড্রেসে হাজির হয়েছে সে।তাকে এখানে দেখবে ভাবেনি কেউ।কারন সে দেশের বাহিরে ছিল।এসেই আকাশের বিয়ের কথা তার কানে আসে।সবাই মোটামুটি বিয়ের চাইতেও এই বিষয়ে বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে।মায়শা এসে আসমার হাতটা হ্যাঁচকা টান দিয়ে সরিয়ে দেয়।আসমা চমকায়।রেগে পিছনে তাকিয়ে দেখে দাঁত বের করে হেসে আছে মায়শা।মুখটা ছোট হয়ে যায়।রামিম এসবে তেমন মন দিচ্ছে না।সে আকাশের কথা ভেবেই দিশাহারা।আকাশের মায়ের সাদা মুখটা লাল রক্ত বর্ণ ধারণ করেছে।কি হবে ভাবতেই রামিম ভয়ে আছে।আসমা মায়শাকে দেখে খুশি হতে পারল না।এসেছে ভালো কথা।কিন্তু হাতটা এভাবে টেনে নেওয়ার কি আছে।সে কি খেয়ে ফেলবে।একটা ভয়ংকর অধিকার বোধ আসমার উপরে ভর করে।চেপে বসে মাথায় মনে।হঠাৎ করে অবিশ্বাস্য একটা কাজ করে ফেলে সে।মায়শার হাত টেনে সরিয়ে দিয়ে নিজে রামিমের হাতটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।রামিম কিছু বুঝলো না।হা করে আসমার থমথমে ফ্যাকাসে মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।মায়শাও অবাক।আসমার মনের একটা অবাধ্য সত্ত্বা বলছে রামিমের উপরে তার অধিকার বেশি।মায়শা উড়ে এসে জুড়ে বসতে চাইছে কেন?অন্য সত্ত্বা বলছে,আরে বাবা ওরা তো বয়ফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ড।তোর আর হিমেলের মত।তুই তো হিমেলকে পছন্দ করিস।বিয়েও করবি।ছেড়ে দে হাত।’ আসমা ছাড়তে চেয়েও ছাড়ল না।জিদ চেপে বসে মাথায়।সে ছাড়বে না।আরো শক্ত করে হাতটা ধরে সে।রামিম ভারী চমকায়।হাতের বাঁধনের দিকে তাকায়।ঠিক তখনই আকাশের গালে ঠাটিয়ে চড় বসিয়ে দেয় তার মা।সবাই হতবিহ্বল হয়ে সে দিকে তাকায়।মুখ ফুঁটে বেরিয়ে আসে,এটা কি হল?’
__________
__________
#চলবে…………
ভুলগুলো আল্লাহর দেওয়া মহান গুন ক্ষমার চোখে দেখবেন।
#চলবে…………
ভুলগুলো আল্লাহর দেওয়া মহান গুন ক্ষমার চোখে দেখবেন।