কৃষ্ণচূড়ার রং লাল পর্ব ৪৫+৪৬

কৃষ্ণচূড়ার রং লাল-৪৫.🎈
@হাফসা আলম
____________________
আকাশ জুড়ে তারাদের খেলা।মাঝে একটা গোলাকার চাঁদ।আলোর ছড়াছড়ি।মাঝ আকাশে যদি চাঁদ না থাকত তাহলে মানুষের জীবনে বড্ড আলোর অভাব হত।রূমাশ্রী বসে বসে আকাশের খেলা দেখছিল।তার রুমের জানালাটা খুব বড়।কাঁচের জানালা।চাঁদটিকে দেখযায় একদম কাছ থেকে।ব্যস্ত পায়ের ধ্বনি।আকাশ আসছে।কি মোহনীয় অনুভুতিতে সে জড়িয়ে পড়েছে সে নিজেও জানে না।লোকটার চলার ধ্বনি শুনেও সে ধরতে পারছে।রূমাশ্রী পুরানো দিনের কথা ভাবে।এই তো দেখা।কয়েকদিন আগে।কি অদ্ভুত ভাবেই না দেখা হয়েছিল।রূমাশ্রী আপন মনে হাসে।আকাশ ঘামে ভেঁজা শরীরে এসে রূমাশ্রীর গা ঘেঁষে বসে।সাথে সাথে রূমাশ্রী ঝাঁঝাল কন্ঠে বলে উঠে,’আকাশ তোমাকে আর কতবার বলতে হবে?এভাবে এসেই বসবে না।শরীর খারাপ করবে।ঘাম শরীরে শুকিয়ে গেলে জ্বর হয়।বুকে ঠান্ডা জমে কাঁশি হতে পারে।যাও ফ্রেশ হও।’আকাশ আহ্লাদি গলায় বললো,’এভাবে বলো কেন?দশটা না বিশটা না একটা মাত্র জামাই তোমার।গায়ের সাথে ঘেষেছি বলেই এমন করছ?’রূমাশ্রী হাসি লুকিয়ে বললো,’ফালতু কথা ছাড়।’‘ আমি ফালতু কথা বলিনা।’ আকাশ মুখ ঘুরিয়ে নিল।রূমাশ্রী ভ্রু কুঁচকে নিল।ছোট চোখ গুলো আরো ছোট করে নিয়ে সে বললো,’তোমাকে গোমড়া মুখে মানায় না।হাসলে ভালো লাগে।’‘তো আমি কি করতাম।’আকাশ মুখ আরো গোমড়া করল।রূমাশ্রী হাসলো।আকাশ বাচ্চাদের মত কথা বলে।এই ছেলে বাবা হবে!এখনো সুযোগ পেলেই শুধু বলে ইশ জীবনে একটা প্রেম করতে পারলাম না।বুঝলে বউ প্রেম হচ্ছে অভিজ্ঞতা।এটা না করলে জীবনে একটা বড় সরো অভিজ্ঞতা মিস হয়ে যাবে।আর আমি সেটাই করলাম।দুঃখ!রূমাশ্রীর খুব হাসি পায়।কোন মেয়ে আকাশের পছন্দ না।কাউকে সে মন থেকে পছন্দও করে না।তবু তার প্রেম করা চাই।একে নিয়ে রূমাশ্রী কি করবে ভেবে পায় না।মৃদূ হেসে কমলা রঙ্গের ঠোঁট জোড়া রূমাশ্রী আকাশের গালে বসিয়ে দেয়।আকাশ খুশিতে গদগদ হয়ে ঠোঁট জোড়া এগিয়ে দিয়ে বললো,’এদের প্রতি জুলুম করছ কেন?’ ‘কারণ এরা জুলুমের যোগ্য।’ রূমাশ্রীর কাঁট কাঁট গলা।’আকাশ হাসলো।ফুলা ফুলা পেটে হাত রাখতে গিয়েও রাখলো না।এক ছুটে জামা নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো।দশমিনিটে আবার হাজির।রূমাশ্রী খাবার নিতে যায়।দেখে আকাশের মা আগে থেকে খাবার নিচ্ছে।রূমাশ্রীকে তিনি কাজ করতে দেন না।খুব খেয়াল রাখে।জীবন কত বিচিত্র!আজ হয়তো কাউকে পছন্দ না।কিন্তু কাল সে প্রিয় হয়ে উঠতে পারে।শুধু সুযোগের অপেক্ষা।মিসেস মরিয়ম সুযোগ দিয়েছেন।রূমাশ্রী কাজে লাগিয়েছে।আজ সে উপজাতি,বউ এসব কিছুকে ছাড়িয়ে মেয়ে হয়েছে।দু’জনে গল্প করতে করতে উপরে আসে।আকাশ বিছানায় কাত হয়ে শুয়ে ছিল।মায়ের হাতে প্লেট দেখে সে এগিয়ে আসে।খাবারের প্লেট নিজের হাতে তুলে নেয়।এত কাজের লোক আছে তারা করবে।নিষেধ করেছে সে কাজ করতে না।কিন্তু তার মা জোর করে করে।মিসেস মরিয়ম সব সময় বলেন,আমি যদি মায়ের মত ব্যবহার করি সেও মেয়ে হয়ে উঠার চেষ্টা করবে।একদিন সফল হবে।আমরা হয়ে উঠব মা মেয়ে।’ কি চমৎকার সব কথা তার মা জানে।না পৃথিবীর সব মাই চমৎকার কথা জানে।
মিসেস মরিয়ম কিছুক্ষণ ছেলের সাথে গল্প করলেন।মা রুম ত্যাগ করতেই আকাশ রূমাশ্রীর পায়ের কাছে বসে।প্রতিদিনের মত আজও রূমাশ্রী সরে যেতে চায়।আকাশ দেয় না।ফুলা পেটে হাত রেখে সে গভীর চুমু আঁকে।রূমাশ্রীর চোখে পানি চলে আসে।নিজের বাবার কথা মনে পড়ে।ইশ কত ভালোই না বাসে বাবারা।পৃথিবীতে মায়ের চেয়ে আপন কেউ নেই।আর বাবার মত গভীর আদর করার কেউ নেই।আকাশ কি সব বলে।কান পেতে শুনে।হেসে উঠে রূমাশ্রীর দিকে তাকিয়ে বলে,’আমার মেয়ে আমাকে বেশি ভালোবাসে।’ ‘ ছেলে হবে।’ রূমাশ্রী বলে।
আকাশের মন খারাপ হয়।সে জানে তাদের ছেলে হবে।তবে সে বিশ্বাস করে মিরাক্কেল কিছু হবে।বাচ্চা পৃথিবীর আলো দেখেনি।হয় তো রিপোর্ট ভুল।মেয়ের খুব সখ তার।ভালো লাগে।কিউট কিউট চুল হয়।জুতো হয়।কত রঙ্গের জামা।ফ্রক।সব মিলিয়ে মেয়ে বাচ্চার মত কিউট ছেলেরা হয় না।তাদের মেয়ে হলে ভালো হত।রূমাশ্রী হাসে।আকাশের চুলের ভাঁজে হাত বুলিয়ে বললো,’তোমার মনে আছে আমাদের প্রথম দেখা হওয়ার কথা?’ আকাশে সমান তালে হেসে উঠে বললো,’ মনে থাকবে না কেন?কিভাবে ফেলে ছিলে ইশ।’‘ আর তুমি আমাকে কত অপছন্দ করতে।মনে আছে?’ ‘তুমি কোমড় বেঁধে ঝগড়া করতে।’ ‘ তো কি করবো।তুমি কম ছিলে? ‘ অবশ্যয় কম ছিলাম।’ ‘ ও হো একদম নিজের দোষ লুকাতে চাইবে না।’ ‘ আমি লুকাচ্ছি না।’‘ লুকাচ্ছ।’ ‘ মোটেও না।তুমি সব সময় আমাকে রাগিয়ে দিতে।’‘ খেয়ে দেয়ে যেন আমার আর কাজ ছিল না।’ রূমাশ্রী মুখে ভেঙ্গচি মারে।আকাশ গাল টেনে দিয়ে বললো,’তুমি বড্ড ঝগড়া করতে।’ কথা মুখ থেকে বের হতে দেরি রূমাশ্রী পাল্টা আক্রমণের দেরি হল না।সে বললো,’ তুমি সাধু।’আকাশ ভাব নিয়ে বললো,’ সন্দেহ আছে?‘ সত্যি বলি?’ রূমাশ্রী গম্ভীর হয়।‘ মিথ্যা বলা পছন্দ না।’
‘ তোমার মত ঝগরুটে ছেলে আমি আমার বাপের জন্মে দেখিনি।’আকাশ রাগি রাগি চোখে তাকায়।রূমাশ্রীর দারুন লাগে এই মুখশ্রীটা।সে বললো,’ তুমি জোর করে হলুদ না লাগালে আমাদের বিয়ে হত না।’ ‘ ভাগ্যিস লাগিয়েছিলাম।আসলে এটা সত্য যে আল্লাহ যা করে তার বান্দার ভালোর জন্য করে।’ ‘ তুমি তো তারপরেও আমাকে বের করে দিতে চেয়েছিলে।’ ‘ ও হ্যালো আমার ঘরেই ছিলে তুমি।’ ‘ পরে তো বের করেই দিতে।’ ‘ জীবনেও না।’
‘কেন?’ ‘ আমি দ্বিতীয় দিনই তোমার প্রেমে পড়েছিলাম।হলুদ লাগানোর আগে।শিকার করতে দেরি করেছি এই আর কি।’ রূমাশ্রী বিস্মৃত।আকাশ কখনো এ কথাটা তাকে বলেনি।আজ প্রথম সে বললো।আকাশ একটু অস্বস্তিতে পড়ে গেছে।এটা গোপন ছিল।রূমাশ্রী হাসল।আকাশ কোমড় জড়িয়ে ধরল।রূমাশ্রীও ধরল।চুলের ভাঁজে চুমু বসিয়ে দিল।ভালোবাসা গুলো সুগন্ধীর মত আষ্টেপৃষ্ঠে ধরছে।____________
দক্ষিনের জানালায় গ্রিল নেই।কেউ চাইলেই বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করতে পারে। মেয়ের রুমের একটা জানালা এমন খোলামেলা রাখতে নারজ ছিল আমিনা।তার মতে রুমের জানালা হবে অসংখ্য গ্রিলে ঠাসা।তিনি অনেক বার এটা নিয়ে কথা বলেছেন।কিন্তু মেয়ের এক কথা তার গ্রিল ভাল লাগে না।দম বন্ধ দম বন্ধ মনে হয়।রাতের দিকে আমিনা মেয়েকে একবার দেখতে এলেন।মেয়ের বিয়ে হয়েছে।অনুষ্ঠানের তারিখও ঠিক হয়েছে।পাশের বাড়িই তো।তবুও তার ভালো লাগছে না।পৃথিবীতে এই একটা আদরের জিনিস মানুষ যত্নে রাখে অন্যের জন্য। ‘ তুই এখনো জেগে আছিস?আশ্চর্য!’ ‘ আশ্চর্যের কি আছে?’ ‘রাত কটা বাজে জানস তুই?’ ‘ জানি।’
‘ তাহলে বই নিয়ে শুয়েছিস কেন?লাইট অফ করে ঘুমা।’
আমিনা লাইট অফ করে দিলেন।তুতুল খুব বিরক্ত হল।গায়ে কাঁথা টেনে দিলেন।পাশে বসে কিছুক্ষণ মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।তুতুল হেসে উঠে বললো,’ মনে হচ্ছে আমি বাচ্চা।’‘ তুই তো বাচ্চাই।’ ‘ মোটেও না।একদম এসব বলবে না।’ ‘ শুন তুতুল তুই আমার ছোট মেয়ে।ছোটরা সব সময় ছোট হয়।জন্মের সাথে সাথে এরা ট্যাগ লাগিয়ে আসে।তারা ছোট।’ তুতুল কিছু বললো না।শুধু হাসলো।নিঃশব্দের সেই হাসি তীব্র বাতাসের মত শরীর মন ছুঁয়ে দিল আমিনার।প্রথম দিনের অনুভুতি।হসপিটাল থেকে ফিরছিলেন।ডাক্তার বলেছিলেন আমিনা আর কখন মা হতে পারবে না।প্রথম বাচ্চা জন্ম দেওয়ার সময় ও এটা বলেছিল।কারণ প্রথম বাচ্চায় খুব ঝুঁকি হওয়ার শর্তেও উনি নিয়েছিলেন।মনটা খুব খারাপ ছিল।মেয়ে হিসেবে তার খুব সখ ছিল একটা মেয়ের।ছোট ছোট হাত পা হবে।ঝুটি করা চুল।ছোট ছোট হাতে রঙ্গীন চুড়ি।পায়ে ঝুমুর ঝুমুর করে বাজবে নুপুর।প্রথম কানের দুল পড়ার সময় হবে আত্নহারা আনন্দ।ছেলেকে দিয়ে এসব হয় না।রিক্সার একটা চাকা হঠাৎ নষ্ট হয়ে যায়।মাঝ রাস্তায় নেমে পড়তে হয়।বাসা বেশি দূরে ছিল না।তাই হাঁটতে শুরু করেছিল দু’জনে।রাস্তার পাশে ড্রেন।পাশে চিকন সরু একটা রাস্তা।ঘাস লতাপাতায় জঙ্গলা হয়ে ছিল।কিছু ফুল গাছ দেখল আমিনা।হোসাইন সাহেব এগিয়ে গেল।যৌবন কালে খুব ফুল প্রেমি ছিলেন আমিনা।হোসাইন সাহেব অফিস থেকে ফিরার পথে সব সময় একটি ফুল নিয়ে আসতেন।খুবই অদ্ভুত রঙ্গের ফুল।আজ বউয়ের মন ভালো করার জন্য তিনি ড্রেন পেরিয়ে অপর পাশে যায়।আমিনা অনেক নিষেধ করে।কিন্তু তিনি শুনেন না।হঠাৎ চিৎকার করে উঠেন।মিসেস আমিনা তখন আকাশে ভেসে থাকা মেঘর দিকে তাকিয়ে ছিল।মেঘে মেঘে বেলা বুঝা যাচ্ছিল না।স্বামীর চিৎকার শুনে হকচকিয়ে যান তিনি।দ্রুত বোরখা উপরে তুলে ড্রেন পার হলেন।হোসাইন সাহেবের চোখমুখ আতঙ্কে ঢাকা।মুখের দিকে একবার তাকিয়ে তিনি প্রশ্ন করলেন,’ কি হয়েছে?এমন করছ কেন?’‘ তুমি দেখ।’
‘ নিশ্চুয়ই সাপ দেখে চিৎকার…’ তিনি আর কিছু বলতে পারলেন না।তার চোখের সামনে আজও সেই দিনটি ভাসে।জ্বলজ্বল করে ভাসে।মনে হয় বাস্তব।সেই পথ বাস্তব।তার সামনে।একটা গোল ঝুড়ি।তার উপরে একটা সাদা পর্দার মত কাপড়ে পেঁচিয়ে আছে বাচ্চাটা।গোলগোল চোখ গুলো ভারি অদ্ভুত।এমন চোখের দিকে দীর্ঘ কয়েক মিনিট তাকিয়ে থাকলে শরীর অবশ হয়ে আসবে মোহনীয়তায়।কি ঠোঁট,কি গাল,কি ভ্রু,কালো কুঁচকুঁচে কোঁকড়া চুল।কি মায়া,এত ছোট একটি মেয়ের চুল এত বড়!দু’জনেই বাঁকরূদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন অনেক্ষণ।বাচ্চাটা হঠাৎ বিড়াল ছানার মত কেঁদে উঠল।আমিনার তখন কি অনুভুতি কাজ করেছিল তা তিনি জনম জনম চেষ্টা করলেও বুঝাতে পারবে না।তিনি কোলে তুলে নিলেন।রাজকীয় ঝুড়ি।দেখেই বুঝা যাচ্ছে কেউ খুব যত্ন করে রেখে গিয়েছে।গলায় ঝুলছে সোনার চেইন।হাতে চারটি ছোট ছোট সোনার চুড়ি।কিন্তু কে রাখল?কিভাবে এল?কার বাচ্চা?এত কিছু ভাবতে পারলো না আমিনা।হোসাইন অনেক চেয়েছিল পুলিশের কাছে যেতে।খোঁজ নিতে।হতে পারে কারো বাচ্চা হারিয়ে গিয়েছে।কিন্তু আমিনা কখনো যেতে দেননি।এত মমতায় জড়িয়ে নিলেন যে তাকে ছাড়াতে ইচ্ছে করলো না হোসাইন সাহেবের।আলভী তখন অত বুঝত না।সে ভেবেছিল তার বোনকে নেওয়ার জন্যই তার বাবা মা হসপিটালে গিয়েছিল।সেই দিন ছিল আনন্দের।আলভী পাগলের মত জাপ্টে চুমু খেয়েছিল।শরীর এতো ছোট আর এতো নরম ছিল যে ছোট আলভীর হাত পা কাঁপনি ছুঁটে গিয়েছিল।সে ধরীধরী কিন্তু ধরে না অবস্থা।খুব ভয়ে ভয়ে একবার কোলে নিয়ে এক গাল হেসে চেঁচিয়ে বলেছিল,’কি নরম!আম্মু একদম তুলোর মত।বাবুর নাম তুতুল রাখমু।’
আমিনার চোখ ভিঁজে উঠে।গালে হাত দিয়ে দেখেন চোখে পানি।তিনি কাঁদছেন!আল্লাহ কখন কার ভাগ্যে কি রাখে বুঝা বড্ড দায়।যদি তার মেয়ে হয়ে যেত।তখন হয় তো এত মমতা কাজ করত না।মেয়েটার বাবা মায়ের খোঁজ করত।হয় তো পেয়ে যেত।নয় তো অন্য কোথাও দিয়ে দেওয়া হোত।আজ সে তাদের ঘরের আলো।ভাগ্য!বিচিত্র জিনিস।তুতুল ঘুমিয়ে পড়েছে।তিনি বুঝতে পেরে একটা চুমু দিলো কপালে।তারপর রুমের দরজা হালকা খোলা রেখে বের হয়ে গেলেন।সে জেগে ছিল।এমন ভাব করল যেন সে ঘুমাচ্ছে।উঠে বসে তুতুল।ফোনের লাইট অন করে নিজে নিজে মিটিমিটি হাসে।
তুতুলের প্রায় ঘুমঘুম আসছিল।বইটা শেষ না করে উঠতে ইচ্ছে করছে না।রিঝ নামক ছেলেটা তার খুব বাজে অভ্যাস করে দিয়েছে।বইয়ের অভ্যাস।কে বলে বই পড়ার অভ্যাস বাজে হয় না।সে বলছে,এই নেশা খুবই বাজে।একবার শুরু করলে দুনিয়া ভুলে যেতে ইচ্ছে করে।তা না হলে মনের শান্তি ভুলে যেতে হয়।বিরক্তিকর রোগ!তুতুল উপুত হয়ে শুয়ে আছে।জানালা দিয়ে কিছু একটা ধপ করে পড়ে।মা নিষেধ করার পরেও সে আবার জানালা খুলে দিয়েছিল।খোলা জানালার বাতাস মিষ্টি হয়।শরীর জুড়িয়ে যায়।তুতুল চিৎকার করতেই যাচ্ছিল।রিঝ মুখটা চেপে ধরে কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,’চিৎকার চাই না।’
‘ আপনি এখানে কি করছেন?তাও এত রাতে?’ তুতুল জোড়ে নিঃশ্বাস নেয়।দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল তার।রিঝ রেগে আছে।কেন?তুতুল বুঝতে পারছে না।সে আবার বললো,’হয়েছে কি?এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?’
‘ আমার ডায়েরি কই?’‘ আমি কিভাবে বলবো?আশ্চর্য!’ভাবটা এমন যেন সে ডায়েরি কি তাই জানে না।রিঝ জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিচ্ছে।নাকটা ফুলে ফুলে উঠছে।তুতুল বিরক্ত গলায় বললো,’একদম এভাবে তাকাবেন না।কি এমন ডায়েরি যে এত রাতে মানুষের বাসা বিশেষ করে একটা মেয়ের রুমে আসতে হয়েছে?কি আছে ডায়েরিতে?’
‘ আমি নিশ্চিত ডায়েরি তুমি চুরি করেছ।’
‘ তওবা তওবা।’ ‘ ফাজলামো হচ্ছে?’
‘ সেটা তো আপনি করছেন।’ ‘ আমি করছি?’
‘ হুম আপনি করছেন।’তুতুল বই পড়ায় মন দিল।তাকে দেখে মনে হচ্ছে রুমে সে আর বই ছাড়া কিছু বা কেউ নেই।খুব মনোযোগ দিয়ে সে বইয়ের প্রতিটি পৃষ্ঠা উল্টাচ্ছে।এত যত্ন!রিঝ দ্রুত দরজা বন্ধ করে আসে।তারপর বইটা সামনে থেকে এক টানে নিয়ে নেয়।তুতুল বিরক্ত মুখে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ।তারপর সোজা হয়ে শুয়ে বললো,’ বাকি অংশটুকু আপনি পড়ে শুনান।আমার খুব টায়ার্ড লাগছে।শুরু করুন।’রিঝ রেগে রেগে বললো,’ তুতুল আমি মজা বা আনন্দের মুডে নেই।আমার ডায়েরি কোথায়?’
‘ আমি সত্যি জানি না।’ তুতুল নিজের কাজে ভারী অবাক।সে এত সুন্দর করে মিথ্যা বলতে পারে তার জানা ছিলো না।কেউ একজন বলেছিল,মিথ্যা দুই প্রকার।একটা হুট করে মুখে চলে আসে।আর একটা গুঁছিয়ে বলতে হয়।গুঁছিয়ে মিথ্যায় ধরা খাওয়া হয় বেশি।তুতুলের মতে মিথ্যা তিন ধরনের হয়।আর একটা হল গুঁছিয়ে রাখা মিথ্যা হুট করে মুখ থেকে বের হয়ে যাওয়া।যেটা এখন তার বেলায় হচ্ছে।’ তুতুল ইচ্ছে পূরণ করতে এসব করেছ?
‘ আমার ইচ্ছের মধ্যে তো পাঞ্জাবিও আছে।এখন আমি কি আপনার বাড়ি থেকে তা চুরি করে নিয়ে এসেছি?’
‘ ডায়েরি কোথায় বলো।’রিঝ ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলছে।তুতুল লক্ষ করল রিঝের হাফ হাতা গেঞ্জি।হাতের বাকি অংশ অবলীলায় দেখা যাচ্ছে।কালো কুচকুচে লোমে ভরা।সাদা হাতে কালো লোম।এসব অংশ সব সময় ঢাকা থাকে।রোদের আলো কম পড়ে।মুখের চেয়েও হাতটা বেশি ফর্সা।সাথে কনুই কাঁটা।ছিড়ে গেছে।রক্তের ছাপ।সাদা হাতে লাল বেশি মানাচ্ছে।তুতুল ভ্রু কুঁচকিত করে নিজের হাতের দিকে তাকায়।আহা তার থেকেও বেশি সুন্দর।এটা মানা যায়!‘ আমি সত্যি জানি না।’ভারী ইনোসেন্ট গলায় বললো তুতুল।রিঝ আবার প্রশ্ন করে,‘ তুমি আমার রুমে আমার অনুমতি ছাড়া ঢুকেছ?’তুতুল এবার উঠে বসে।ফ্লাশ লাইট ধরে রিঝের চোখের উপরে।একবারো চোখ কুচকে নেয়নি সে।কি আশ্চর্য মানুষ!এটা মানুষ তো?রিঝ আগুন চোখে তাকিয়ে আছে লাইটের দিকে।চোখের রং মনে হচ্ছে সোনালি।‘ তুতুল মাথা গরম করো না।ডায়েরি কি তুমি নিয়েছ?’‘ না।একদমই না।’ কাঁট কাঁট গালায় বলে
তুতুল মুখ ঘুরিয়ে নিল।রিঝকে চিন্তিত দেখাল।
‘ আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে ডায়েরিতে হীরে জহরত লুকিয়ে রেখেছেন।এমন করছেন কেন?সামান্য ডায়েরিইত।’
চারপাশে তীক্ষ্ন চোখ বুলিয়ে দেখে রিঝ।নেই।মনে মনে খুব হাসলো তুতুল।বুদ্ধিমান মানুষকে বোকা বানানোর মত মজার এই পৃথিবীতে আর কিছু নেই।সত্যি মজার।তুতুল নিজের হাতের বইটি এগিয়ে দিয়ে বললো,’ পড়া শুরু করুন।তা না হলে আব্বুকে বলেদিবো আপনি লুকিয়ে আমার রুমে এসেছেন।’ ‘ তো কি হয়েছে?’ রিঝের কন্ঠ স্বাভাবিক হয়ে আসে।তুতুল শুয়ে পড়তে পড়তে বললো,’ অনেক কিছু হয়েছে।আমি একটা মেয়ে।আপনি একটা ছেলে।কম বয়সি যুবকযুবতি।অনেক কিছু হলো না।’
‘ সাথে আমরা হাজবেন্ড ওয়াইফও।’ ‘ বেশি কথা বলবেন না।পড়া শুরু করুন।’কয়েক সেকেন্ড বিরক্ত মুখে তাকিয়ে রিঝ বিছানায় বসল।তুতুল উঠে যায়।অবাক চোখে রিঝ তাকিয়ে থাকে।সত্যি সত্যি বাবার কাছে যাচ্ছে না কি?রিঝ নার্ভাস হয়ে পড়ে।তুতুলের বাবার প্রতি সে একটু ভীতু।আসলে ভীতু কথাটা ভুল।সে সম্মান করে।এখন যদি সত্যি এভাবে তাকে লুকিয়ে মেয়ের রুমে দেখে!তার কি অবস্থা হবে সে জানে না।কিন্তু সে খুবি লজ্জিত হবে।রিঝ ফিসফিস করে তুতুলকে ডাকে।তুতুল পিছনে কয়েক কদম এসে বললো,’ ফিসফিস করছেন কেন?বিশ্রী শুনাচ্ছে।’
‘ তুমি কি সত্যি আঙ্কেলের কাছে যাচ্ছো?’তুতুল জবাব দিল না।সে দ্রুত পায়ে রুম ত্যাগ করল।জানালার দিকে তাকায় রিঝ।আবার লাফিয়ে নামবে?বইয়ের দিকে তাকায়।এটা পড়ে শুনাতে হবে।এখন যাবে?ভাবনার মাঝেই তুতুল আসে।তার পায়ে একটুও শব্দ হচ্ছে না।নিঁখুত ভঙ্গী।হাতে ব্যান্ডেজ,ক্রিম।রিঝের হাতটা দ্রুত নিজের হাতে নিয়ে কাঁটা জায়গায় তুতুল স্যাভলন ক্রিম লাগিয়ে দেয়।জ্বালা করলেই রিঝ একটু নড়ে উঠে।ফুঁ দেয় সে ব্যাথায় তুতুল।রিঝ বিমুগ্ধতায় ধাঁধানো চোখে চেয়ে থাকে।জীবন এত সুন্দর হয়! তুতুল বললো,‘ ডায়েরিতে এমন কি আছে?যার জন্য আপনি হাত ছিঁড়ে ছুড়ে আমার রুম আসলেন?’
‘ আছে অনেক কিছু।’ ‘ বলুন আমি শুনি।’ ‘ আমার দূর্বলতা।’ ‘ তো কি হয়েছে।দূর্বলতা কেউ জেনে গেলে কি হয়?’ রিঝ হাত সরিয়ে নিয়ে বই নেয়।তুতুল পাশে কাত হয়ে শুয়ে বললো,’ বলুন না?’ ‘ আমি নিজের দূর্বলতা কাউকে দেখাতে চাই না।দূর্বলতা হচ্ছে গোপন করার জিনিস।দূর্বল স্থানে আঘাত করা মানুষের স্বভাব।’ তুতুল আবেগী গলায় বললো,‘ প্রমিজ করছি আমি আঘাত করবো না।আমাকে বলুন।’ ‘ অলরেডি একটা সবাই জানে।’ ‘ যেমন??’ তুতুল উঠে বসে।চোখেমুখে প্রবল আগ্রহ। ‘ বই শেষ করি।তোমার বুকসেলফের বেশির ভাগ বই তো তুমি আমাকে দিয়েই শেষ করিয়েছ।’ তুতুল হেসে বললো,’অভ্যাসটাও তো আপনার থেকে পেয়েছি।সবচেয়ে বড় কথা আপনার কন্ঠ অসাধারণ’
রিঝ ম্লান হেসে বললো,‘ শুধু কন্ঠ??’একটু ভেবে তুতুল বললো,’ আর গুলো মনে পড়ছে না।’ রিঝ হাসলো।বইয়ের নাম ড্রাকুলা।ব্রাম স্টোকারের লেখা।তুতুলের এসবের প্রতি আগ্রহ বেশি।তার ধারণা পৃথিবীর গহীন জঙ্গলে একটা সত্যি ভয়ংকর ড্রাকুলার বাড়ি আছে।হঠাৎ একদিন সে ভুল করে তার বাসায় চলে যাবে।ভয়ংকর কাউন্ট ড্রাকুলা প্রথম দেখায় তার প্রেম পড়ে যাবে।দু’জন প্রেম করবে।দুনিয়া তাদের বিরোধীতা করবে।রিঝের খুব হাসি পায় এসব শুনলে।তার বউ তারই সামনে বসে নিজের প্রেম করার ইচ্ছা পোষণ করে।কথার শেষে বলে,’ আপনার উঁচিত আমাকে সাহায্য করা।আমি তো আপনার বউ তাই না।’অদ্ভুত!বইটা পড়তে শুরু করে।মাঝে মাঝে গা ঝমঝম করে।রিঝ আগেও এ বই পড়েছিল।কিন্তু এখন হঠাৎ তার মনে হচ্ছে সত্যি যদি ড্রাকুলা তার বউকে নিয়ে যায়?তুতুল তো বলে দিয়েছে ড্রাকুলার সাথে সে প্রেম করতে রাজি।বইয়ের শেষ পৃষ্ঠা শেষ করার আগে রিঝের মনে হল তার বুকের বামপাশ ভারী।মাথা ঘুরিয়ে তাকাল সে।তুতুল গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে।ঘুমের মাঝে সে রিঝের বুকের টি-শার্টের একটি অংশ মুঠো করে ধরছে।ধীরে ধীরে সে রিঝের বুকে মাথা রাখে।একি!এবার জড়িয়ে ধরছে?রিঝ অদ্ভুত চোখে দেখছে।ঘুমের মাঝে সব মানুষকে নিষ্পাপ মনে হয়।মেয়েদের বোধ হয় একটু বেশিই সুন্দর মনে হয়!একটু বেশি!বাম হাতটা ছিল বেডের উপরে।আধশোয়া হয়ে ছিল সে।রিঝ হাত উঠিয়েই রাখে।জীবনের সুন্দর মুহূর্ত মনে হয় ভালোবাসার মানুষকে পাশে পাওয়া।তাকে পাশে দেখার মত আনন্দের অনুভুতি খুব কম আছে দুনিয়ায়।মাথাটা ঝুঁকিয়ে নেয় রিঝ।ডান হাতের বই রেখে কপালের উপরের এলোমেল চুল সরিয়ে দেয়।ঠোঁটের গরম ছোঁয়া বসিয়ে দেয় মাঝ কপালে।কন্ঠ নিচু করে শেষে কথাটা বললো,’ যেমন?আমি তোমাকে মরিয়া হয়ে ভালোবাসি।এরচেয়ে বড় দূর্বলতা আমার জীবনে আর কিছু নেই।’ ________
রেয়ানার বিয়ে হচ্ছে বড় বিজনেসম্যানের বিদেশি ছেলের সাথে।টাকা,টাকা আর টাকার দুনিয়া।দেশের সবচেয়ে নাম করা বিজনেসম্যানের ছেলে সে।নিজেরও বিজনেস আছে বিদেশে।টাকা পয়সার অভাব নেই।রেয়ানার বাবা মায়ের পছন্দ করা ছেলে।তার খালার কেমন যেন আত্নীয় হয়।সেভাবেই পরিচয়।রেয়ানাও হ্যাঁ বলে দেয় তারপর বিয়ে।বিয়ে বাড়ি দেখে তুতুল কিছুক্ষণ হা করে তাকিয়ে রইল।রিঝকে বাসায় গিয়ে দাওয়াত করা হয়েছে।সাথে রামিম আকাশ,আসমাকেও।রিঝ মুখের উপরে বলেদিয়েছিল সে আসতে পারবে না।কিন্তু তুতুল আসবে মানে আসবেই।সে খুব খুশি।তার খুশি দেখার মত।রেয়ানা একটু করে বলেছিল তুতুলকে নিয়ে আসতে।সে মনে করেছিল তুতুল আসলে রিঝ আসবে।তুতুল এক পায়ে খাঁড়া।
পিছনে তাকায় রিঝ।তুতুল নেই?চারপাশে তাকিয়ে সে দেখল তুতুল এখনো আগের জায়গায়।আবার পিছনে আসে সে।‘ কি করছ তুমি এখানে কেন?’তুতুল বিস্মৃত কন্ঠে বললো,’ আল্লাহ্ কত বড়লোক এরা!’রিঝ হাসলো।নিচু কন্ঠে বললো,’ অফসোস হচ্ছে?’তুতুল বললো,‘ কেন?’রিঝ দুঃখের সাথে বললো,‘ এই যে আমরা এত বড়লোক না তাই।’‘ শুনুন আমি এতো বড়লোকের বিয়ে বাড়িতে আগে কখন আসিনি।তাই অবাক হচ্ছি।আফসোসের কিছু নেই।আর আমি মানুষের টাকা দিয়ে তাকে বিবেচনা করিনা।আমি করি গুন দিয়ে।ভিতরে যাই।দেখি।যদি মনে হয় উনার জামাই খুব গুনি তখন একটু আফসোস না হয় হবে।’‘ আফসোস হবে?’অবাক হওয়া কন্ঠে রিঝ বললো।তুতুল ঠোঁটের সাথে ঠোঁট মিলিয়ে বললো,‘ হতেই পারে।’
আসমা,রূমাশ্রীকে দেখে তুতুলের খুব খুশি হয়।দারুন আনন্দিত গলায় সে বললো,’ ওহ তোমাদের দেখে খুব ভালো লাগছে।আমি তো ভেবেছি এত বড় বাড়িতে সবার ভীরে আমি হারিয়ে না যাই।’আসমা হেসে উঠে বললো,‘ যাবে না।আমরা তো দূর থেকেও আমাদের তুলা পাখিকে চিনে নিবো।’রূমাশ্রী বললো,’ সেটাই।তবে সবাই আমাকে অদ্ভুত চোখে দেখছে।’রসিকতা করে আকাশ বললো,’ কারণ তুমি এলিয়েন।’রূমাশ্রী চোখ রাঙ্গালো।রেয়ানার লেহেঙ্গা দেখে সবার চোখ জ্বলজ্বল করে উঠে।কি সুন্দর সব।পাথরের প্রতিটি কাজ নিঁখুত।যেন হীরে বসানো।গাঢ় লাল রংটা কি মারাত্নক সুন্দর।রিঝ সোফার এক কোণে বসেছে।অনুষ্ঠান জিনিসটা তার মোটেও পছন্দ না।ঝামেলা ছাড়া থাকতে তার ভালো লাগে।রাতটা মাটি।তুতুল এসে বসে পাশে।বিরক্ত গলায় বলে,’ সব মানুষ কি অদ্ভুত।’
তীর্যক চোখে রিঝ তুতুলকে একবার দেখে বললো,’ নিষেধ করেছিলাম।শুনলে না তো।’ তুতুল রিঝের সামনের চুলে আঙ্গুল ঘুরিয়ে বললো,’ অবাধ্য হতে ভালো লাগে।’তুতুল উঠে গেল।রিঝ হাসলো।
রেয়ানা তুতুলের দিকে একঝলক তাকিয়ে তার বান্ধুবীদের অদ্ভুত ভাবে বললো,’ আমার হাজবেন্ড আমাকে এনগেজমেন্টে কি গিফট করেছে জানছ??’একটা মেয়ে বললো,’ ডায়মন্ডের আংটি।’রেয়ানা বললো,‘ আরে সেটা তো দিয়েছেই।গিফটও করেছে।’ মেয়েটা বললো,‘ BMW কার।দামও জানি।এক কোটি দশ লক্ষ।’ ‘ইয়েস।কালার কি যেন?’‘ কালো।’ ‘ আমার প্রিয় রং।’ বলেই রেয়ানা হাসলো।বাকিদের মুখে বিরক্তি।তাদের দেখে বুঝা যাচ্ছে শুনে শুনে তারা শহিদ।তুতুল সবার সামনেই শব্দ করে হেসে ফেললো।রেয়ানা রেগে বললো,’ হাসছো কেন?’
তুতুল অপ্রস্তুত হয়ে বললো,’ এমনেই।’‘ এমন কেউ হাসে না।ভাব দেখাচ্ছো?হাসার মতো কিছু বলেছি?আমাকে তো আমার হাজবেন্ড প্রথম দিনেই এসব গিফট করেছে।তোমাকে কি করেছে?আসলে তুমি এসবের যোগ্যই না।
তুতুল বেকুব বনে গেল।আসমা চারপাশে দেখে।ভাগ্যিস রিঝ নেই।তা না হলে বউয়ের গাল লাল হয়ে যেত।আল্লাহ বাঁচাইছে।তুতুলের হাত ধরে আসমা চলে আসতে নেয়।রেয়ানা আসতে দেয় না।রেয়ানার মনে অনেক কষ্ট।তুতুল বুঝতে পারছে।পছন্দ বা ভালোবাসা যেটাই হোক সেটা তো এখন তার নেই।অন্যের হয়ে গেছে।বেচারি।তুতুল মৃদূ হেসে রেয়ানার হাত ধরে বললো,’ আপু তুমি আমার থেকেও সুন্দর।ইঞ্জেনিয়ার।তোমার বাবা বড়লোক।তুমি,তোমার ভাগ্য সব আলাদা।তাই তুমি তোমার মত পেয়েছ।আমি আমার মত।হয় তো বেশি ভাল পেয়েছি।আমার হাজবেন্ড আমাকে যা দিয়েছে তা আমার পাপ্য নয়।সে আমাকে বেইন্তেহাম মোহাব্বাত দিয়েছে।অসম্ভব ভালোবাসা।’
আসমা যেতে যেতে তুতুলকে বললো,’ ওই তোমারে না রিঝ ডায়মন্ডের পায়েল দিয়েছে।সেটা বললানা কেন?রিঝ তো পায়েও ডায়মন্ড বসায়।হুহ।’তুতুল আসমার কানে কানে বললো,’এই মেয়ের মাথা আগে থেকে গরম আছে।আরো গরম করে কি লাভ।কেউ যদি নিজেকে বড় করে মজা পায় আনন্দ পায় এতে আমার বা তোমার ক্ষতি কি।’আসমাও হাসলো।বেচারি রেয়ানা।রিঝ পাশেই ছিল।দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে সে ভাবলো কত বুঝে তার তুলতুল পাখি।সে সত্যি তুলোর মত।নরম কোমল হৃদয়ের অধিকারি।
রিঝে ধাক্কা লাগে একজনের সাথে।তার গায়ে কোলডিংস পড়ে যায়।রিঝ শার্টের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পেরে বললো,’ওহ স্যরি।আসলে আমি খেয়াল করিনি।’
‘ করবেন কিভাবে?সামনের মেয়েটা তো কোন দিকে খেয়াল করতে দিচ্ছে না।’চমকে তাকায় রিঝ।ইয়াজ!ইয়াজ লম্বা লম্বা চুল দাঁড়ির জন্য তাকে চেনা যাচ্ছে না।রিঝ প্রথমে চিনতে পারেনি।সময় লেগেছে বুঝতে।এই একটা মানুষকে দেখলে শরীর জ্বলে উঠে তার।গায়ে যেন কেউ আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।কথা না বলে রিঝ চলে যায়।ভেজাল করতে চায় না সে।তুতুলকে এদিক সেদিক খুঁজে।মাত্র এখানে ছিল।কোথায় গেল?’
তুতুল রেয়ানার সাথে এমন ব্যবহার করছে যে মনে হচ্ছে আপন বড় বোন।রেয়ানা নিজেও অবাক।তুতুল আস্তে করে রেয়ানা কাছে এসে বললো,’ আপু আমি যদি তোমার হাজবেন্ডের ডায়মন্ড বসানো জুতো চুরি করি তুমি রাগ করবে?’রেয়ানার হাসি পেল।একদম বাচ্চাদের মত আবদার।ঠোঁট উল্টে রেখেছে তুতুল।রেয়ানার হঠাৎ বড্ড মায়া হল।তুতুলকে পৃথিবীর সবচেয়ে মিষ্টি মেয়ে মনে হচ্ছে।খুব ভালো লাগছে।আগে কখন সেভাবে দেখেনি।সব সময় মনে হত খারাপ মেয়ে।ইশ সে কত খারাপ ভাবত।মেয়েটা আসলে একটা রসোগোল্লা।সে তুতুলের একটা হাত টেনে বললো,’ যা খুশি করো।পারলে শেরওয়ানিও চুরি করতে পারো।তবে শর্ত আছে?‘ কি??’‘ পায়জামা নিওনা।বেচারা লজ্জা পাবে।’তুতুল হাসিতে ফেঁটে পড়ে।তার কিছু নতুন বন্ধু হয়েছে।সব বড় আপু।রেয়ানার বান্ধুবী।চাচাতো বোন।খালাতো বোন।কেউ একজন বলেছিল বিয়ে বাড়িতে সব মেয়ের মাথা আউলা হয়ে যায়।এক সুত্রে বাঁধা পড়ে সবাই।তুতুল আর রেয়ানার একটা চাচাতো বোন স্টেজের উপরে উঠে।রেয়ানার হাজবেন্ডের নাম আশরাফুল।সে বসে বসে বিরক্ত হয়ে উঠেছে।তুতুল একগ্লাস জুস এগিয়ে দিয়ে বললো,’ দুলাভাই এটা আপনার জন্য নিয়ে এসেছি।খুব গরম তাই না।’‘ দুলাভাই বলবে না।শুনতে বাজে লাগে।’
‘ তাহলে কি বলবো?মি.আশরাফুল??’‘ এভাবে নাম ধরে ডাকবে কেন?’‘ তাহলে কি ভাইয়া ডাকবো?’’কোন জন্মের ভাই আমি?’‘ তাহলে জিজু ডাকি?’
‘ না শুনতে ভালো লাগছে না।’
তুতুলের কাজ হয়ে গেছে।সে এবার ক্ষিপ্ত সুরে বললো,’তাহলে আশরাফুল্লা ডাকি?’
‘ এসব কেমন অসভ্যতা।’রেয়ানা মিটমিট করে হাসে।আশরাফুলের রাগ উঠছে।সে বললো,’ তুমি জানো আমি কে?নাম বিগড়ে বলছ কেন?’‘ আমার জানা হয়ে গেছে আপনি কে।আসি।’সে কেঁটে পড়ে।জুতোও নিয়ে আসে।রেয়ানার খুব মজা লাগছিল।তুতুল জুতো লুকিয়ে রাখে মদের বোতলের তাকের পিছনে।লুকিয়ে আসার সময় দেখে একটা লোক মনের মত মদ গিলছে।তুতুল অবাক হয়ে বললো,’ এত নেশা করে মরবেন তো!’তারপর চলে আসতে যাবে এমন সময় লোকটি হাত ধরে ফেলে।চমকে উঠে পাশে তাকায় সে।ইয়াজ নেশা গ্রস্ত গলায় বললো,’ মরেই তো গিয়েছি।’নিয়তি বড় অদ্ভুত।অবাক চোখে তুতুল দেখে।এটা ইয়াজ?আল্লাহ্!রিঝের আগমন তখনই হয়।সে আগে পিছনে কিছু শুনে না।ইয়াজের কাছ থেকে হাত ছাড়িয়ে নেয়।দুই একটা ঘুঁষি বসিয়ে দেয়।তুতুল থামানোর অপ্রাণ চেষ্টা করে।দু’জনের মাঝে আবার মারামারি হয়।জখম হয় দুজনেই।বিয়ে বাড়ি তৈরি হয় কাঁচ ভাঙ্গা বাড়িতে।সব কাঁচের বোতল ভেঙ্গে ফেলে রিঝ ইয়াজ মিলে।এদের থামানো কঠিন।অনেকে মিলে আলাদা করে।তুতুল অনেক কষ্টে রিঝকে টেনে নিয়ে আসে বাহিরে।রাস্তায় হাঁটতে থাকে দু’জনে।নিস্তব্ধ, নিরবতা দুজনের মাঝে।প্রথম কথা বলে তুতুল,’ এসবের মানে কি?আপনার সমস্যা কি?এভাবে মারতে গেলেন কেন?হাত ছাড়িয়ে চলে আসলেই হত।’
‘ হত না।সে আমার জিনিসে টাচ করল কিভাবে?এতো সাহস হয় কিভাবে।’রিঝের কপালে রক্ত।হাতে রক্ত।তুতুল বুঝতে পারছে না কি করবে।তার খুব রাগ হচ্ছে।নিজের প্রতি।কেন সে আসতে গেল।ইয়াজ আসবে জানলে সে কখন আসতো না।ব্রিজের উপরে দাঁড়ায় দুজনে।তুতুল রিঝের কালো ব্লেজার খুলে নেয়।হাতের ঘড়ি খুলে নেয়।ফোনটাও নিয়ে নেয়।সব ছুঁড়ে মারে লেকের পানিতে।রিঝ চেঁচিয়ে উঠে বললো,’ হোয়াট দ্যা হেল!কি করছ?’
‘ আপনার জিনিসে টাচ না শুধু ফেলেও দেয়েছি।চলেন আমার সাথে মারামারি করুন।আমাকে মারুন।’
‘ পাগল হলে?’ তুতুল রেগে বললো,‘ আপনার সাথে থাকতে থাকতে।’রিঝ দ্বিগুন রেগে বললো,‘ তুতুল বেশি হয়ে যাচ্ছে।’‘ রাগটা একটু বেশি মনে হয় না আপনার?’
রিঝ নিচের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিল,‘ হয়।’ ‘ তাহলে দেখান কেন?’‘ কন্ট্রোল হয় না।’দীর্ঘশ্বাস নেয় রিঝ।তুতুল ব্রিজের সাইডে বসে।রিঝও বসে।তুতুল বিনীত কন্ঠে বললো,‘ আপনার রাগ কমিয়ে ফেলবেন।কখনো এতো রাগ দেখাবেন না।আমার সামনেও না পিছনেও না।’ ‘ আচ্ছা।’
‘ ভালো হয়ে যান।’ ‘ আচ্ছা।’ ‘ নিজের যত্ন নিতে শিখুন।’
‘ তুমি আছ তো।’গভীর কন্ঠে বললো রিঝ।তুতুল হাত গুলো দেখে।ইশ কি ভয়ংকর ভাবে কেঁটেছে।কপালও কেঁটেছে।রিনঝিনে কন্ঠে তুতুল বললো,’রক্ত কখনো ঝড়াবেন না।’‘ আচ্ছা।’‘ আচ্ছা আচ্ছা করছেন কেন?’
‘ তো কি করবো?’ রিঝের একটা বাহুতে তুতুল মাথা রাখে।দু’হাতে জড়িয়ে ধরে বাহু শক্ত করে।শীতল কন্ঠে বলে,’ এসব আমার পছন্দ না।কখনো মারামারি করবেন না।আমার কষ্ট হয় আপনার ক্ষত দেখলে।প্লিজ এসব করবেন না।দেখুন কত কেঁটেছে?ইশ।’ রিঝ সংযত গলায় বললো,যাও করবো না।ইমোশনাল হচ্ছো কেন?’তুতুল উঠে দাঁড়ায়।রিঝের চশমাটা নিয়ে নেয়।একটা ভেঙ্গে এসেছে রেয়ানার বিয়েতে।রিঝের পকেটে সবসময় এক্সট্রা চশমা থাকে।কারণ তার চশমা ভাঙ্গে বেশি।এটা নতুন।রিঝ সাবধান করে বললো,’এটা লাস্ট আছে।ফেলবে না।আমি বাসায় যেতে পারবো না তাহলে।’ তুতুল পাত্তা না দিয়ে বললো,‘ আমিও কিন্তু থামতে বলেছিলাম।আপনি মারামারি করেই চলেছিলেন।’‘ সেটা আলাদা হিসাব।’
তুতুল লেকে হাত ছুড়ে দেয়।রিঝ চোখ বুজে।ওহ!এখন সে যাবে কিভাবে?দূরের কিছুই তো সে দেখবে না ভালো করে।সব ঝাপসা ঝাপসা।তুতুল এবার হাঁটা শুরু করে।রিঝ পিছন থেকে ডাকে।তুতুল শুনে না।মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে রিঝ ভাবে বাসায় যাবে কিভাবে?তুতুল পিছন দিক দিয়ে আসে।কাঁধে ঝাপিয়ে পড়ে।রিঝ অবাক হয়।চমকে উঠে।তুতুলের খুব হাসি পায়।হাসতে শুরু করে শব্দ করে।চারপাশে অনেক গাড়ি।ধূলোবালি উড়ছে।সাথে উড়ছে তুতুলের কোঁকড়া কালো চুল।রিঝ গায়ের মিশ্র ঘ্রাণ পেয়েই বুঝতে পারলো এই সে নারী।তার সর্বনাশের ঘড়ি।সেও হাসলো।রিঝের চোখে চশমা পড়িয়ে দিল তুতুল।তারপর বায়না ধরল কাঁধে চড়ার।রিঝ কাঁধে নেয়।তুতুলকে কাঁধে নিয়ে হাঁটতে তার খুব ভালো লাগছে।ফোন,মানিব্যাগ,ঘড়ি তুতুল ফেলেনি।শুধু ব্লেজার ফেলে দিয়েছে।রিঝের বিশ হাজার টাকা লস।ভাবতেই খুশি লাগছে তুতুলের।গল্পের ঝুড়ি নিয়ে বসে সে।তারও লস হয়েছে।আশরাফুল্লার কাছ থেকে সেও টাকা নিতে পারতো।পুরাই লস।আশরাফুলের গল্প শুনে রিঝের কান শেষ।তুতুল বলে আর শব্দ করে হাসে।বেচারা মনে হয় খালি পায়েই বাড়ি যাবে।কারণ জুতো কই কেউ জানে না।যেখানে লুকিয়েছিল সেখানে তো ভাঙ্গচুর হয়েছে।জুতো উড়ে কই চলে গেছে কে জানে ।______________
আজ তুতুলের বিয়ে।সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে সে নিজেকে আবিষ্কার করল……..
কৃষ্ণচূড়ার রং লাল-৪৬.(প্রথম খন্ড)🎈
@হাফসা আলম
____________________
আমিনা মেয়ের দিকে এমন ভাবে তাকিয়ে আছেন যেন সে মানুষ নয়।উড়ে এসেছে অন্য কিছু।অন্য কিছুটা কি?ভূত,প্রেত,নাকি পরী টরী?তুতুল বুঝতে পারল না।মায়ের এমন দৃষ্টি দেখে সে চমকে উঠে।সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই সে নিজেকে মায়ের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আবিষ্কার করলো।আমিনা মেয়েকে দেখছেন।খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন, চোখগুলো,নাক,দু’পাশের গাল,ভ্রু জোড়া,আর আর চুল,তারপর ঠোঁটজোড়াতে এসে তিনি থমকে যান।অদ্ভুত ভাবে মুক্তর মত জ্বলজ্বল করা কালো মনি যুক্ত চোখ গুলো ঘুরে ঘুরে দেখেন।দু’ঠোঁটের মাঝ থেকে বেরিয়ে আসে,এতো সুন্দর!তিনি ভয়ংকর রকম চমকে উঠেন।মেয়েদের রূপের একটা ব্যাপার আছে।এদের রূপের পরিবর্তন ঘটে।ছেলেদের ঘটে কম।তাদের ছোট বেলায় এক রকম দেখায়।যৌবনে আরেক রকম।যৌবনের রূপ নিয়েই বৃদ্ধের পথ ধরে।মেয়েদের বেলায় ভিন্ন দৃষ্টান্ত।এদের রূপ কখনো সুন্দর,কখনো রূপবতী,কখনো মোহনীয়, কখনো বা অপ্সরী দেখায়।আমিনা ভাবেন,তার মেয়েকে কেমন দেখাচ্ছে?বিয়ের সময়টায় মেয়েদের সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন ঘটে।বইয়ের পাতায় পাতায়ও রয়েছে এর বর্ণনা।পরিবর্তন ঘটবে।হলুদের ফলে রংটা আরো খুলবে।উজ্জ্বল দেখাবে।স্বাভাবিক।কিন্তু এত অস্বাভাবিক সৌন্দর্য্যের কারণ কি?বুকটা কেমন যেন ভার ভার লাগছে।মনে হচ্ছে বুকে কেউ পাহাড় সমান পাথরের বোজা চাপিয়ে দিয়ে চলে গেছে।তার কেন মনে হচ্ছে মেয়ে অসম্ভব সুন্দর হয়ে উঠেছে।এই মেয়েকে চোখ ছাড়া করতে পারবেন না।গায়ের চাদর ফেলে উঠে বসে তুতুল।মায়ের এমন বিমোহিত চাহনীর কারণ বুঝতে পারলো না সে।কোমল কন্ঠে ডাকল,’আম্মু।ও আম্মু।এভাবে তাকিয়ে আছ কেন?চোখ সরালেন না তিনি।আগের মত চেয়ে রইলেন।দরজার কাছে এসে দাঁড়ালো প্রীতি।নিচু গলায় বললো,’ মা চা খাবেন?’কট করে জবাব দিলেন আমিনা,’ তুমি হসপিটালে যাবে না আজ?’প্রীতি দীর্ঘ হাসি হেসে বললো,’ কি যে বলেন মা।আজ আমার একমাত্র ননদিনীর বিয়ে।আমি কি কাজে যেতে পারি?আজ ছুটি আমার।’’ওহ।’চা খাবেন না?’ না খাবো না।’সম্পূর্ন কথা শেষ করলো আমিনা তুতুলের মুখের দিকে তাকিয়ে।কেন যেন আজ তার ইচ্ছে করছে বহু বছরের পুরোনো সেই সব কথা বলে দিতে।কেন যেন মনে হচ্ছে সময় কোথাও থমকে যাচ্ছে।কি আশ্চর্য অনুভুতি!বুঝতে পারছেন না কেন এমন হচ্ছে।মায়ের পিছন থেকে গলা জড়িয়ে ধরল তুতুল।বিগলিত সুরে বললো,’ আম্মুর কি হয়েছে?’ভারী শরীরটা হঠাৎ কেঁপে উঠলো।আমিনা নিজেকে সামলে নিয়ে হাতগুলো আরো জড়িয়ে বললেন,’আম্মুর কিছু হয়নি।’’ আম্মুর কন্ঠ কেমন যেন?’’কেমন?’’ চা খাবে না কেন?’আমিনা মৃদূ হাসলেন।বললেন,’পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর কিছু অনুভুতির মধ্যে একটি মেয়ে বিদায়।আমি সেই ভয়ংকর অনুভুতির শিকার হতে যাচ্ছি।চা খাওয়ার অনুভুতি এখন কাজ করছে না।’
চোখের কোণে জমে জলের ছিটা।তুতুল আরো গভীর ভাবে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে।মাও কাঁদে।মেয়েও কাঁদে।দু’জোড়া নয়নের অশ্রুতে ভাসে ভালোবাসা, অনুভুতি, যত্ন,আদর।আমিনার মনে পড়ে ৩২বছর পুরোনো স্মৃতির কথা।নিজের মায়ের কথা।তিনি পৃথিবীতে নেই।কিন্তু রয়ে গেছে অনুভুতিতে ঠাসা স্মৃতি।ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ভালোবাসায় ভরা অতিত।জীবনটা সত্যি অদ্ভুত।খুব অদ্ভুত।এক সময় তিনি থাকবেন না।তার মেয়ে নিজের মেয়ের বিদায়ের আগুনে জ্বলবে।চোখ ফেঁটে বেড়িয়ে আসবে কান্না।সেও পুরোনো দিনের কথা ভাববে।মনে পড়বে মায়ের কথা।অতিত সুন্দর হয়!
ঝাঁঝিয়ে উঠে একটা কন্ঠ।আলভীর গলা পেয়ে মুখ চেপে ধরে প্রীতি।চোখ নিচু করে নামিয়ে দেখে আলভী।অশ্রুতে ভাসা দু’টি চোখ তাকে চুপ করতে ইশারা করছে।মুখের হাত সরিয়ে কান্নায় থামা থামা গলায় প্রীতি বলল,চুপ করো।ওই দিকে দেখ।’লম্বা আঙ্গুলের ইশারায় আলভী সামনে তাকাল।তুতুল তখন কেঁদে কেঁদে বলছিল,’ আম্মু তুমি আমাকে বেশি বেশি বেয়াদপ বলো।’আমিনা অবাক হয়ে মেয়ের দিকে মুখটা হালকা ঘুরিয়ে নিয়ে বললেন,’কেন?’ একটু হাসে তুতুল।ঠোঁট জোড়া কামড়ে ধরে কয়েক সেকেন্ডের জন্য।তারপর বলে,’ শুনতে ইচ্ছে করছে।কেন জানি না।’ বুকটা আরো ভারী হয় আমিনার।মনের মাঝের একটা পাখি ভাঙ্গা ডানায় ছটফট করতে শুরু করে।খুব ব্যাথা,মারাত্নক কষ্ট অনুভব হচ্ছে।মেয়ের গালের সাথে গাল ঘঁষে তিনি বললেন,’এত কান্নাকাঁটির কিছু নেই।এখনকার মেয়েরা নাচতে নাচতে শ্বশুর বাড়ি যায়।তুইও যাবি।একদম সানগ্লাস পড়ে।কি যেন একটা গান আছে না?’ আমিনা অনেকক্ষণ ভাবলেন।গানের নাম মনে করতে পারলেন না।পিছনে থেকে একটি পুরুষের নরমেলা গলা ভেসে এলো।সে বলল,’ কালা চাশমা হবে আম্মু।’
মা মেয়ে পিছনে তাকাল।পুরুষ মানুষ শক্ত মনের পাথরের মত কঠিন হয়।এদের কোন পুরুষ কাঁদাতে পারে না।শুধু,শুধু নারীর কারনে কাঁদে পুরুষ।কত শক্তি এই নারীতে!ভাবতেই অবাক লাগে প্রীতির।আলভীকে সে যতবার কাঁদতে দেখেছে প্রতিবার তার বোনের জন্য।এত ভালোবাসা হয় কিভাবে?সে ভাবে।আরো ভাবে।ভাবতে ভাবতে কোথায় যেন হারিয়ে যায়।সে আর বের হতে পারে না।হঠাৎ কি যেন হল।ঝড়ের বেগে ছুঁটে আসা তুতুল পড়ল ভাইয়ের প্রশস্ত বুকে।বিড়াল ছানার মত জড়িয়ে নিল আলভী।একটা বিড়ালের বাচ্চা।একদম বাচ্চা।তুলতুলে সেই ছোট শরীর।আজ কত বড় হয়ে গেছে।আজ তার বিয়ে!মনের মাঝের সবচেয়ে ভয়ংকর সত্ত্বা কান্না।সেই সত্ত্বা হুট করেই আঘাত করে বসে কলিজায়।আলভী হাউ মাউ করে বাচ্চাদের মত কাঁদে।সাথে কাঁদে তুতুল,আমিনা প্রীতি।সবার কান্নার আওয়াজে বাহিরের সবাই ছুটে আসে।হোসাইন সাহেব বিস্মৃত চোখে তাকিয়ে থাকে কয়েক মুহূর্ত।ছেলে মেয়ে বউ সব কাঁদছে।তিনি কঠিন গলায় বললেন,’কান্নাকাঁটির কি আছে।কাঁদছ কেন সবাই?’কেউ তার কথায় পাত্তাদিলো না।সবাই নিজেদের মত কেঁদেই চলেছে।হৌসাইন সাহেব প্রীতির দিকে তাকিয়ে বললেন,’প্রীতি তুমিও?’প্রীতি ঝাঁপসা চোখে একপলক দেখে।লোকটির কন্ঠ কত কঠিন!অথচ চোখে পানি।কি আশ্চর্য সব।প্রীতির বিদায়ের সময় তার বাবা একটুও কাঁদেনি।পরে তার ভাই ফোন করে জানিয়েছে কান্না,অতিরিক্ত চাপ,উত্তেজনায় তার পেশার বেড়ে গেছে।বাবারা কি এমনই হয়?‘ কান্না থামাও।রিঝ নিচে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।তুতুলকে পার্লারে সে নিজে দিয়ে আসবে।এমনটা আমি জীবনেও শুনিনি।নিজের বিয়ের দিন সে নিজে তার বউকে পার্লারে নিয়ে যাবে।শুধু শুধু আর অপেক্ষা করাচ্ছো কেন?আর ওই আলভী তোকে পাঠিয়েছি ডাকতে আর তুই কান্নায় মেতে উঠেছিস।ছাড় ওকে।’ আমিনা জড়িয়ে ধরে হোসাইন সাহেবকে।আকর্ষিক ভাবে তিনি হতভম্ভ হয়ে পড়েন।নিজেকে সামলাতে বারংবারং থমকে যাচ্ছেন তিনি।স্ত্রীর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,’ মেয়েটার মন খারাপ হবে।এসব না করলে হয় না তোমাদের।চুপ করো।’আলভী চুপ করে যায়।চোখ মুখে তুতুলকে টেনে বুক থেকে সরিয়ে বলে,’ওই পাগল তুই কি জীবনের জন্য অন্য দেশে চলে যাচ্ছিস?তোর কপাল ভালো বুঝলি।তুই তো একদম বাড়ির সামনে থাকবি।নো চিন্তা তুলতুল।আমি তোরে সেখানে থাকতে দিবো না।তুই এই বাড়িতেই থাকবি।আমি কথা দিচ্ছি।’ কান্নার মাঝে ঝিলিক দিয়ে উঠে এক চিলতি হাসি।সাথে মিশিয়ে কান্না।তুতুল আবার ভাইকে জড়িয়ে ধরতে চায়।আলভী দম খিঁচে আছে।আর একটা আক্রমণে সে আবার ভেঙ্গে পড়বে।তাই আগে আগে বললো,’ হয়েছে আর জড়িয়ে ধরতে হবে না।যা রেডি হ।খাওয়া দাওয়া কর।রিঝ অপেক্ষা করছে।সত্যি এটাও সম্ভব।সে তো পাগল আমি হলে জীবনেও নিজের বউকে পার্লার তো দূর সেই বাড়ির সামনেই যেতাম না।যেতাম না ভুল আমি তো যাইওনি।নিজের বিয়েতে বউকে পার্লারে নিয়ে যাবে।বাহ ভাই বাহ।’আলভী কয়েক কদম চলে যায়।হঠাৎ মনে হয় আর সুযোগ হবে না।সে আবার ছুঁটে এসে জড়িয়ে ধরে তুতুলকে।তুতুলও ধরে ভাইকে।আবার ছেড়ে চলে যায়।থমথমে রুমটা আরো গুমুট ধরে থাকে কিছুমুহূর্ত।একে একে সবাই রুম ত্যাগ করে।আমিনাও শেষে চলে যায়।
নিজের বিয়েতে সবাই চায় তাকে দেখাবে আলাদা।সবচেয়ে সুন্দর।সবচেয়ে দামি।বউ বউ একটা ব্যাপার থাকতে হবে।তুতুলেরও ইচ্ছে তেমন।তাই সে পার্লারে যেতে চায়।সাজতে চায়।খুব সুন্দর করে।যতটা সুন্দর করে সাজলে তাকে রিঝমান নামক এই অসম্ভব সুদর্শন পুরুষের পাশে দারুন দেখাবে।রিঝের মতে সে পারফেক্ট।তবুও বিয়ে।সখ থাকতেই পারে।তাই রিঝও রাজি হয়ে যায়।বাড়িতে মেকাপ আর্টিস্ট ডাকা হয়।কিন্তু যাদের আসার কথা ছিল তারা হঠাৎ করে আসবে না বলেদেয়।যে বেশি ভালো মেকাপ করতে পারে তার নানু মারা গেছে।রাত তিনটের সময় কল করে বলেছে।তাই তুতুলকে যেতে হচ্ছে।আসমা,রামিম, আকাশ রূমাশ্রীদের বাসস্থান হলো রিঝের বাড়ি।দীর্ঘ চারদিন তারা এখানেই আছে।রামিম এই চারদিনের সবচেয়ে বড় সুযোগ লুফে নিয়েছে।সে রিঝের বেড রুমটা দখল করেছে।সাথে নিয়েছে আকাশকেও।দুজনে মিলে রিঝের অবস্থা নাজেহাল করে ছেড়েছে।ফোন কেড়ে নিয়েছে।কোথাও থেকে একটা ফোন জোগাড় করে কথা বলতে নিলে সেটাও এসে কেড়ে নেয়।শুধু নজরবন্দি করে রেখেছে।গায়ে হলুদের দিনে ঘটে অদ্ভুত এক ব্যাপার।তুতুলের গায়ে হলুদ হয় তাদের ছাদে।বড় কোন আয়োজন করেনি।হলুদের অনুষ্ঠান হয় একদম ছোট খাটো করে।মায়ের সেই হলুদের শাড়ি দেখে তুতুলের ভারী লোভ হয়।সে অন্যসব দামি শাড়ি ফেলে নিজের মায়ের সেই আমলের পুরানো সুতার হলুদ শাড়িটি গায়ে জড়িয়ে নেয়।একদম বাঙ্গালী নিয়মে শাড়ির ভাঁজ।গলার মালা,মাথার টিকলি,হাতের চুড়ি,কোমড়ের বিছা সব গাঁদা ফুল আর গোলাপের তৈরি।ছাদের উপরে হলুদের আয়োজন।রিঝ একবার মাত্র দেখতে চাওয়ার অনুমতি নেয় রামিমদের কাছ থেকে।তারা তো অর্ধেকেরও অনুমতি দিতে চাইলো না।রিঝ সবাইকে ফাঁকি দিয়ে ছাদে উঠে।তাও দেয়াল বেয়ে।তুতুলের সারা শরীর হলুদে লেপ্টে আছে।পা থেকে শুরু করে কপাল।রিঝ তুতুলের ফোনে কল করে।ফোন ধরে আরোহি।বুঝতে পারে না রিঝ।সে শুধু বলে উপরের ছাদে একবার আসতে।তারপর কথা না শুনে ফোন কেঁটে দেয়।অপেক্ষার মত কঠিন কষ্টের জিনিস কমই থাকে।কিন্তু কিছু অপেক্ষায় থাকে আনন্দ,উল্লাস,উত্তেজনা,রিঝ পিছনের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ায়।চারপাশের ঝিঁকিঝিঁকি আলোর মাঝে রিঝ আরোহিকে আবিষ্কার করে।মাথার ভেতরের ছাই আগুনে পরিনত হয়।রেগে সে বলে,’তুই’ আরোহি আরো একটু এগিয়ে আসে।থামিয়ে দিয়ে রিঝ বললো,’থাপড়ে গালের দাঁত ফেলে দিবো তোর।এত রাতে একা ছাঁদে কি করছিস?’আরোহি আরো একটু এগিয়ে আসতেই রিঝ গরম চোখে তাকাল।অগ্নিগিরির মত সেই উত্তপ্ত চোখের দিকে তাকিয়ে আরোহি আর এগিয়ে গেলো না।একরাশ রাগ নিয়ে রিঝ হাত ঝাঁকায়।কঠিন গলায় বলে উঠে,’ যা নিচে যা।’ আরোহি ধিমি ধিমি গলায় বললো,’আমি চলে গেলে আমার সাথের সব নিয়ে যাবো।’ গলার স্বর শক্ত করে রিঝ বললো,’অবশ্যয় নিয়ে যাবি।তোর জিনিস এখানে রেখে কি হবে?’’জিনিস কিন্তু আপনার।’আরোহি মৃদু মৃদু হাসছে।সাবধানে চোখ ঘুরিয়ে নেয় রিঝ।তারপর শান্ত হয়ে আসা গলায় বললো,’আমার জিনিস মানে?’আরোহি সরে যায়।পিছ থেকে হলুদ ছায়া বেড়িয়ে আসে।লজ্জায় নতজানু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা হলুদ কুড়িকে দেখে রিঝের বুকে একটা প্রলয়কারী ঝড় আঘাত হানে।ভয়ংকর সেই ঝড়ের কবলে পড়ে গাম্ভীর্যতা ভরা রিঝ এলোমেলো হয়ে যায়।রিঝ রেলিং ধরে।একটুর জন্য পড়ে যেত।কতক্ষণ সে শুধু তাকিয়ে ছিল সে জানে না।যখন হুশ ফিরল বুঝতে পারলো অনেক সময়।আরোহির পায়ে মশা কামড়ে দিয়েছে।তার আর্তনাদে হুশে ফিরা রিঝ একটু একটু করে এগিয়ে আসে।গাঁদা ফুলের একটা গন্ধ ভেঁসে আসছে নাকে।গায়ের শুভ্র সুন্দর মিষ্টি গন্ধের সাথে মিশে সেই ঘ্রাণ অদ্ভুত রূপ নিয়েছে।কপালের সেই মাঝ গোলাপ!কি মোহনীয়তায় ছুঁয়ে রেখেছে।ইশ!রিঝ হাতগুলো নিজের হাতে নেয়।চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে গভীর বিমুগ্ধতায়।চারপাশের ঝিরিঝিরি রিনরিনে বাতাসে বইছে ভালোবাসার স্নিগ্ধতা।উড়ছে হওয়ায় হওয়ায় প্রেম।বাম হাতে তুতুলের ডান হাত।রিঝের ডান হাতটা নিজের বাম পাশের বুক ছুঁয়ে রেখেছে।নির্লিপ্ত কন্ঠে রিঝ বললো,’ তোমাকে ভালোবেসেছি।তোমাকে চেয়েছি।আজ পাওনা স্বরূপ তুমি আমার সামনে রয়েছ।’
একটু থেমে রিঝ আবার বললো,’ তোমাতে মুগ্ধ হওয়ার আর কিছু নেই।যা আছে সব বিমুগ্ধতাকে ছাড়িয়ে।’
একটা ঢোক গিললো সে।তারপর আবেগে আপ্লুত হয়ে বললো,’ আমার মনের প্রতিটি খোলা দরজায় আমি তোমার প্রতিচ্ছবি ঝুলিয়ে রেখেছি।যাতে কেউ আসলেই তোমাকে দেখে তাকে ফিরত পাঠাতে পারি।
‘তোমার রূপ গুণ কিছুতেই আমি মুগ্ধ নই।আমি শুধু তোমাতেই বিমুগ্ধ।’
হাসির একটা শব্দ ভাসছে।কান খাড়া করে রিঝ সেই শব্দ শুনে।তুতুল নেতিয়ে যাচ্ছে যেন।এত লজ্জা সে কখনো পায় না।আজ কি হলো?রিঝ তো প্রায় এসব বলে।তুতুলের ভালো লাগে তাই আরো বেশি বলে।কিন্তু আজ তুতুল লজ্জা পাচ্ছে।অন্য সময় হাসতো।শব্দ করে।রিঝ চারপাশে তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল।আরোহি সেখানে দাড়িয়ে হাসছে।শুধু আরোহির কন্ঠ না।আরো আছে।ভাবতে ভাবতেই আসমা এসে পড়ে রিঝের কাঁধে।গলা জড়িয়ে সে কাঁধে ঝুলে পড়ে।আর শব্দের বৃহৎ গামলা নিয়ে হাসতে শুরু করে।রিঝের কান ধরে যায়।সে ঝাঁকিয়ে নামায় আসমাকে।রামিমের দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে বললো,’ তোর বউকে সাবধান করতে পারস না?যখন তখন অন্য পুরুষের কাঁধে উঠা মোটেও ভালো নয়।’রামিম হু হা শব্দ করে হাসলো।বললো,’ কাঁধে ঝুলে লাভ কি?ওকে তো শুধু আমিই কাঁধে নেওয়ার ক্ষমতা রাখি।’সবাই হাসলো।রিঝ বললো,’দলবেধে সবার আসার কারণ জানতে পারি?’আকাশ চেঁচিয়ে বললো,’ Happy anniversary bro.রিঝ মাথা ঝাঁকিয়ে হেসে উঠে বললো,’এটা আমাকে কেন বলছিস?তোর বউকে বল।বলদ একটা।’
ঘড়ি দেখে রিঝ।বারোটার বেশি।হ্যাঁ আজ তাদের বিয়ের দ্বিতীয় বছর।সময় কত দ্রুত চলে যায়।সুখের সময় গুলো যায় আরো দ্রুত।সবাই মিলে কেক কাটে।ছাদে বসে খাওয়াদাওয়া করে।রিঝ পুরো অবাক।এত আয়োজন কখন করলো?সে জানতেও পারলো না।সবাই চলে যায় অনেক্ষণ পরে।যাওয়ার আগে রিঝকে খুব বিরক্ত করে।তুতুলকে দেখতে দেয় না।রিঝ যদি একটু তাকায় সবাই চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে।দু’জনকে বসিয়ে রাখে দুই কোণায়।কথা বলতে দেয় না।আলাদা আলাদা করে রাখে।যাওয়ার সময় আসমা তুতুলকে টেনে নিয়ে আসতে চায়।রিঝ তখন রেগে আগুন।চোখের দিকে একবার তাকিয়ে আসমা আর টানাটানি করে না।চলে যায়।সফেদ লাইটের দিকে তাকিয়ে থাকে তুতুল।মৃদূ বাতাসের গতিতে রিঝ পাশে দাঁড়ায়।
‘ হলুদে ঢাকা তুমিটাকে খুব সুন্দর লাগছে।’মুখ ফিরিয়ে তাকায় তুতুল।শান্ত স্থির চোখ মেলে সে বললো,’এটা পুরোনো কথা।নতুন কিছু নেই?’ কিছু মুহূর্ত নিরব থেকে রিঝ বললো,’ তুমি খুব বিশ্রী।’ তুতুল পাতলা ঠোঁটজোড়া মেলে হাসলো।বাতাসে একটা ঝুমুরঝুমুর শব্দের সৃষ্টি হয়।তার সাথে মিলন হয় তুতুলের রিনঝিনে কন্ঠের,’এটাও পুরানো।আরো নতুন কিছু থাকলে বলুন রিঝ ভাইয়া।’ রিঝ রাগ দেখিয়ে তুতুলের দু বাহু চেপে ধরে।হালকা ভাবে।তুতুল ভ্রু উঁচিয়ে নেয়।রাগান্বিত গলায় রিঝ বলে উঠলো,’ ডোন্ট কল মি ভাইয়া?’ শব্দ করে হেসে উঠে তুতুল।এক হাতে ঠোঁট চেপে ধরে বললো,’এটা নতুন ছিল।আই লাইক ইট।’’ তাহলে কি ঠিক করলে?’’ আরো বেশি করে ডাকবো ভাইয়া।’ রিঝ হাসল।হলুদের মাঝে ঢেকে যাওয়া কালো তিলটির খোঁজ করলো সে।না পেয়ে বাম হাত দিয়ে ঠোঁটের পাশের হলুদের প্রলেপ মুছে দিল।নিরবে নিভৃতে চেয়ে রইল কিছু সময়।স্রোতের মত পেরিয়ে গেল সময়।কালো মনির মাঝের আলোক রশ্মি উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।চোখ সরিয়ে নিতে পারলো না।মনে মনে সে ভাবতে লাগলো,সব বাস্তব?এই মেয়েটা কাল থেকে সম্পূর্ন তার।নিজের।অন্যকারোর ভাগ নেই।কোন ইয়াজ থাকবে না তাদের মাঝে।নিজের করে পাওয়ার মাঝে যে এতো আনন্দ আছে সে জানত না।সত্যি জানত না।মেয়েটা সত্যি তার তো!
‘ এবার বাসায় যাও।’ অবাক হয়ে তুতুল বলল,চলে যাবো?’’ হুম যাবে।’ তুতুলের মন খারাপ হয়।সে ভেবেছিল দুজনে সারা রাত গল্প করে পার করে দিবে।সকালে উঠে বিয়ে হবে।ইশ কত মজার হবে।ঘুমে দু’জনেই ঢুলবে।আহা।কিন্তু সবকিছুতে পানি ঢেলে দিল মানুষটা।কেন যেন আজ অনেক কথা বলতে ইচ্ছে করছে।সারা রাত সারা দিন সব মিলিয়ে অনেক কথা বলতে ইচ্ছে করছে।পিছন থেকে ডাক দিল রিঝ।তুতুল তরিৎ গতিতে ফিরে তাকাল।রিঝ বললো,’ ভালোবাসো?’ তুতুল শুধু হাসলো।কিছু বললো না।পায়ের হালকা শব্দে সে গায়েব হয়ে গেল।নিজের কপালের চুল সরিয়ে দিয়ে রিঝ মুচকি হাসলো।
তুতুলের গায়ে সাদা সেলোয়ার কামিজ।রিঝের হাতে আলভী ব্যাগ তুলে দেয়।হোসাইন সাহেব মেয়ের দিকে এমন ভাবে তাকিয়ে থাকে,তুতুলের আর ভালো লাগে না।বাবার গলা জড়িয়ে ধরে সে।রিঝ অবাক!বিয়ে তো আরো পরে।বিদায়েরও অনেক বাকি।তাহলে এখন থেকে কাঁদছে কেন?আর সে তো বিয়ে করে থাকবে সামনের বাড়িতে।দিন রাত সব সময় এসে দেখা করতে পারবে।তুতুল ফুঁফিয়ে কেঁদে বললো,’ শুনো আব্বু আমি কিন্তু তোমার কাছেই থাকবো।বিদায়ের সময় কিন্তু ও বাড়িতে যাবো না।’
হোসাইন সাহেব কোন শব্দ করলেন না।নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলেন।আলভীও কাঁদছে দেখে রিঝ বললো,’ তুই কাঁদছিস কেন?তোর মেয়ে তো না বোন।’’তুই বুঝবি না।কলিজা দিয়ে দিতে কষ্ট হয়।’’আমার বুঝাও লাগবে না।কলিজা পাওয়ার আনন্দ অদ্ভুত খুশির হয়।’রিঝ ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো।আলভীর গা জ্বলে গেল যেন,মুখটা এমন করলো।তাতেও রিঝের হাসি পেল।
খোলা জানালার বাহিরে মুখ রেখে তুতুল বসে আছে।বাতাসে তার কোঁকড়া চুলগুলো এলোমেল হয়ে উড়ছে।ঠোঁটে লেগে আছে হাসি।চোখগুলো উজ্জ্বল।নাকটা একটু লাল।গোল চোখে পানি।কান্না করছে না।আগের রেশ রয়ে গেছে।রিঝ প্রশ্ন করলো,’ সব নিয়ছো?’তুতুল আগের মত থেকে বললো,’হুম।’’ কখন সাজানো শেষ হবে?’’জানি না।’’সাজ শেষ হলে ফোন করবে।’ ভারী অবাক হয়ে তুতুল ফিরে তাকালো।বলল,’আপনি আবার নিতে আসবেন?’রিঝ সামনে মনোযোগ দিয়ে বললো,’হুম আসবো।’ বাতাসে গলায় পেঁচিয়ে গেছে তুতুলের চুল।গলা থেকে সরিয়ে দিতে দিতে সে বললো,’আজ শুধু আমার না আপনারও বিয়ে।’’আমি জানি।’’তাহলে আমার পিছনে ঘুরছেন কেন?ভাইয়া বা ভাবি আমাকে নিয়ে যাবে।আমি বলে এসেছি।’’ বউ কার?’’ মানে?’’মানে তুমি বউটা কার?’’আপনার।কোন সন্দেহ আছে?’’নেই বলেই নিজের কাজ নিজে করছি।চুপ থাকবে।এতো কথা বলছো কেন?’’আমি একা বলছি কই?আপনিও বলছেন।’’এবার চুপ।’ তুতুল মুখ ফুলিয়ে চুপ করে রইল।হঠাৎ মনে পড়ার ভঙ্গীতে কিছু বলতে চাইল।রিঝ ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে চুপ করিয়ে দিল।বাকি রাস্তায় কেউ কথা বললো না।পার্লারে নামার আগে একটি ছোট মেয়ে ফুলবিক্রেতা ফুল নিতে বললো।তুতুল নিল একটা।রিঝ সব ফুল কিনে নিল।তুতুল বললো,’এত ফুল কেন কিনতে গেলেন?’’আমার ইচ্ছে।’’এতো ফুল দিয়ে আমি কি করবো?’’ তোমার জন্য নয় এগুলো।’তুতুলচোখ বড় করে নিয়ে বললো,’কার জন্য?’রিঝ মৃদূ হেসে বললো,’আমার বউয়ের জন্য।’সে ফুল গুলো এগিয়ে দিল তুতুলের দিকে।ডান হাতে ফুল নিয়ে তুতুল হাসতে লাগল।বউরা সন্দেহবাজ হয় খুব।রিঝ একটি সাদা ফুল ছিড়ে নিয়ে তুতুলের কানের পাশে গুঁজে দিল।মুখটা সামনে টেনে নিয়ে এসে কপালে চুমু বসিয়ে বললো,’ যাও।’ দুজনে এক সাথে বেরিয়ে আসে।রিঝ কেন বের হলো তুতুল বুঝলো না।একটু গিয়ে তুতুল আবার ফিরে আসলো।রিঝ একটু চমকাল।একদম কাছে এসে তুতুল রিঝের গলা জড়িয়ে ধরল।কাঁধে মুখ লুকালো।কানের পাশে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,’ আমার রাজকুমার আমার জন্য কতক্ষণ অপেক্ষা করতে পারবে?’ পাতলা কোমড়টা দু’হাতের বাঁধনে জড়িয়ে রিঝ মাতাল কন্ঠে বললো,’সারা জীবন।মৃত্যুর পরের জীবনেও তোমার রাজকুমার তোমার অপেক্ষায় বসে থাকবে।শুধু তোমার জন্য আমার রং।রং বিহীন কৃষ্ণচূড়াকে খুব বিশ্রী দেখাবে।তাই বেশি অপেক্ষা করাবে না।অনেক তো হল।আর কত!’
তুতুল আরো গভীর ভাবে জড়িয়ে নিয়ে বললো,’আর একটু।কয়েক ঘন্টা।’’অপেক্ষা কষ্টের খুব।তবে আমি করবো।’তুতুল রিঝকে ছেড়ে দেয়।রিঝের বুকটা খালি খালি হয়ে পড়ে।হাতের ভাঁজে কি যেন একটা দিয়ে তুতুল একচিলতি হাসি হেসে ভিতরে ঢুকে গেল।কাগজের ভাঁজ খুলে রিঝ দেখল তাতে গোটা গোটা অক্ষরে সুন্দর হাতে লেখা,’ভালোবাসা যে শিখায় তাকে ভালো না বেসে থাকা যায় না।আপনাকে ভালো না বাসতে পারলে আমার পৃথিবীর সব প্রেম সব মোহাব্বত সব ভালোবাসা পৃথা।ভালোবাসা কি?কেমন?এর অনুভুতি কিভাবে প্রকাশ করতে হয় আমি জানি না।যদি বললেই এর ভাব প্রকাশ পায় তবে বলবো আমি আমার আপনিটাকে খুব খুব খুব ভালোবাসি।যতটা ভালোবাসা হয় না,ঠিক ততোটা।ঠিক ততোটা যতটা শুভ্র সাদা আর নীলাভ রং তার আকাশকে ভালোবাসে।হ্যাঁ আমি ভালোবাসি।সবুজ রং যেমন তার প্রকৃতিকে ভালোবাসে ,ঠিক তেমন যেমনটা বৃষ্টির রং ভালোবাসে তার পানিকে,ধূসর রং যেমন ভালোবাসে তার সমুদ্রকে,গাঢ় সবুজ যেমন তার পাহাড়কে,লাল রং যেমন কৃষ্ণচূড়াকে,হলুদ রং যেমন তার গাঁদাকে,গোলাপি রং যেমন তার গোলাপকে ঠিক তেমন।আমি ভালোবাসি আমার সেই মানুষটাকে যে আমাকে ভালোবাসতে শিখিয়েছে।আমি ভালোবাসি আমার চোখ বন্ধের ,সেই স্বপ্ন রিঝমান রহমানকে।’
আমাদের ভালোবাসার সূচনা নেই,ইতি নেই।তাই দু’টিই লিখলাম না।’
বাকরূদ্ধ রিঝ চিরকুট পড়ে বহু বার।সে পড়তে থাকে।যতবার পড়ে ততোবার মনের মাঝে একটা উড়ন্ত প্রজাপতি ডানা ঝাপটায়।বুকটা এক হাতে মুঠো বন্দি করে রাখে সে।খাঁমছে ধরে শার্টের পাশটা।সাদা কাগজে ভেসে উঠে পিছনে ফিরে চুল সরিয়ে দেওয়া সেই এক-টুকরো হাসি।কারো হাসি এতো সুন্দর হয় কিভাবে?কিভাবে?
_____________
মধ্যে বয়স্ক মহিলার চুলে পাকন ধরেছে।সাদা হয়ে উঠছে মাঝের কিছু চুল।খুব রুক্ষ ভাবে সে মুখের সাজ শেষ করছে।মাঝে মাঝে তুতুল খুব ব্যাথা পায়।সাথে খুব বিরক্ত হয়।আসমা আসে শেষের দিকে।গাজরা হাতে সে তুতুলকে খুঁজে।এদিক সেদিক খুঁজে সে বললো,’হুরায়রা নামের কেউ এসেছিলো?’তুতুল চেয়ার থেকেই দেখছিল।চেঁচিয়ে সে বললো,’আপু আমি এখানে।’ বিস্মৃত চোখটা কয়েকবার বন্ধ করে আবার খোলে।তুতুলের চোখে তখন কাজল পড়িয়ে দিচ্ছিলো মহিলাটি।তুতুল যেহেতু তেমন কাজল পড়ে না তাই তার চোখ ভিঁজে আসে বারে বারে।এক সময় মহিলা বিরক্ত গলায় বললো,’ আপনার চোখে এত পানি কেন?’তুতুল খিটমিট করে বললো,’আপনার মুখটায় এত রাগ কেন?’ মহিলা অবাক হলেন।চোরা চোখে একবার নিজেকে আয়নায় দেখে নিলেন।আগে কেউ কখনো তাকে এভাবে বলেনি।এই প্রথম।আসলে তিনি তেমন সাজান না।এই পার্লারের মালিক তিনি।কিন্তু এটা বড় ক্লাইন্ট।তাই তাকেই কাজে হাত দিতে হয়েছে।তুতুলের মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি হেসে ফেললেন।সময় নিয়ে তুতুলকে দেখলেন।তুতুল ভ্রু কুঁচকে রাখলো।তিনি বললেন, ‘আপনার চোখ গুলো খুব সুন্দর ম্যাম।’’তুতুল!তুতুল বলে ডাকতে পারেন।আপনার মেয়ের বয়সি হবো।’তিনি পুনরায় হাসলেন।তুতুলও একটু একটু করে পুরাটাই হেসে ফেললো।মহিলা নিজের জীবনের গল্প করতে করতে বাকি সাজ শেষ করল।আসমা তখনো তুতুলকে ভালো করে চিনতে পারলো না।তার মনে হচ্ছে সে ভুল করে এখানে এসে পড়েছে।আশ্চর্য গলায় সে বললো,’তুমি তুতুল তো?আমাদের তুতুল?’ তুতুল ঠোঁট উল্টে বললো,’কেন?বাজে দেখাচ্ছে?’ ‘ অপ্সরী কখনো দেখেছেন আন্টি?’মহিলাটি হাসলেন।বললেন,’ এই মেয়েটি সত্যি অপ্সরী।সুন্দর তো অনেকে হয়।কিন্তু ও মনে হয় একটু বেশিই।প্রথম দেখায় বা সাজিয়েও তা মনে হয়নি।যা মনে হয়েছে তার কথা শুনে।আধা ঘন্টায় মনে হচ্ছে সে সত্যি অপ্সরী।যে সারা জীবন পাবে সে সত্যি ভাগ্যবান।’’ ও যাকে পারে শুধু সে না যাকে ও পাবে সেও কম না।১৬বছরের অপেক্ষার ফল হচ্ছে আমাদের এই অপ্সরী।’আসমার কথায় অবাক হয় মহিলাটি।আসমা গল্পের মত সব কাহিনী বলে।শুনে তিনি বাকরূদ্ধ গলায় বললেন,’ও না তুমি ভাগ্যবান।এত ভালোবাসা যেন শুধু কাব্য,গল্পে,উপন্যাসেই মানায়।সত্যি কারের আছে জানা ছিলো না।ভাগ্যিস আজ আমি তোমাকে সাজিয়েছিলাম।’ তুতুল লাজুক হাসলো।ফুলের গাঁজরা সে লাগালো না।রিঝ যে ফুল গুলো কিনে দিয়েছে সেগুলো দেখিয়ে বললো,’ এগুলো লাগিয়ে দিতে পারবেন?’মহিলাটি বললেন,’ দিতে পারবো।কিন্তু এগুলো বেশি সুন্দর দেখাবে না।বেলি ফুলেরটা দেও।’’ না এগুলো কেউ খুব যত্নে দিয়েছে।এগুলোই দিবো।প্লিজ।’মহিলাটি হাসলেন।পরিয়ে দিলেন।সব শেষ করে তারা বের হয়ে আসে যখন তখন প্রায় দুপুর একটা।রিঝকে ফোন করে তুতুল।ফোন ধরে রিঝ বললো সে মসজিদে আছে।একটু অপেক্ষা করতে।তুতুল আর আসমা অপেক্ষা করে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে।হঠাৎ কি যেন মনে পড়তেই তুতুল দ্রুত ছুটে যায় পার্লারে।পার্লারটি একটি শপিং মলের দোতলায়।আসমাকে বলেছে সে যাতে দাঁড়িয়ে থাকে।তা না হলে রিঝ তাদের খুঁজে পাবে না।পার্লারের মহিলা পার্লার বন্ধ করেই দিচ্ছিলো।কারণ আজ শুক্রবার।তার তো আসারই কথা ছিলো না।তবুও তিনি এসেছেন।ভাগ্যিস তুতুল ঠিক সময়ে পৌছে যায়।হাঁপাতে হাঁপাতে তুতুল বললো,’প্লিজ আন্টি দরজাটা একটু খুলুন।’তিনি অবাক হয়ে বললেন,’ কেন?’ ’আপনি আলতা পড়ানোর সময় আমার পায়ের যে পায়েলটা খুলে ছিলেন ওটা আমি ভুলে রেখে গিয়েছি।’তিনি দরজা খুলে দেন।তুতুল দ্রুত পায়েল খুঁজতে শুরু করে।অনেক খুঁজে পায় ঝুড়িতে।মহিলাটি অবাক হয়ে দেখছে।একটুর জন্য কেঁদে দেওয়া বাকি ছিল।একটা পায়েল এত গুরুত্বপূর্নের কারণ তিনি খুঁজে পেলন না।তুতুল এমন ভাবে উনাকে জড়িয়ে ধরলেন যেন তিনি তার মা।মুহূর্তের মাঝে মোহনীয় মায়ায় তিনি জড়িয়ে পড়লেন।বললেন,’একটা পায়েলই তো?অবশ্য ডায়মন্ডের।আমি তোমাকে দিয়ে আসতাম।কাজ যেমনই হোক মানুষ হিসেবে সৎ আমি।কিন্তু তুমি তোমার চুড়ির কথা ভুলে গেলে তো।সেগুলোও কিন্তু খুব দামি ছিল।’তিনি দুটি চুরি নিয়ে এলেন।এগুলো তুতুলকে রিঝের মা দিয়েছিলো।সে তো ভুলেই গিয়েছিল।মাথায় হাত দিয়ে জিভ কাঁটে সে।মহিলাটি হেসে তুতুলের হাতে পরিয়ে দিতে দিতে বললেন,’ পায়েলের রহস্য কি?’লজ্জায়মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে তুতুল বললো,’এটা রিঝ ভাইয়ার দেয়া গিফট।’তিনি বললেন,’ভাইকে খুব ভালোবাসো?’তুতুল এবার হাসলো।বললো,’ভাইটাই আমার হাজবেন্ড।ছোট থেকে ভাই ডাকতাম।তাই এখনো ভাইডাকি।’তিনি কিছু বলতে চেয়েও বললেন না।থাকনা কিছু অদ্ভুত জিনিস পৃথিবীতে।সব সময়,সব নিয়ম আর নীতি মেনে হতে হবে এমন তো নয়।তুতুলের হাসিটা আর চোখ গুলো এত ভালো লাগলো যে তিনি শুধু তাকিয়েই রইলেন।চলে যাওয়ার পরেও একবার পিছনে ডেকে চোখ গুলো দেখে নিলেন।গোলগোল বড় চোখ।আহা কি মায়া।
তুতুল বাহিরে এসে দেখে আসমা ফোনে কার সাথে যেন ঝগড়ার মত কথা বলছে।একটু সময় পরে সে বুঝতে পারলো লোকটি রামিম ভাইয়া।একটু ঝুঁকে সে পায়েলটা পড়তে চাইলো।কিন্তু ভারী লাল শাড়িটা ঠিক সামলে উঠতে পারছিলো না।পায়ের হিল খুলে সে পরার চেষ্টা করে।কেউ একজন হুট করেই ধাক্কা দিয়ে বসে।খুব রাগ লাগে তুতুলের।পায়েল ছিটকে পড়ে দূরে।উপরে তাকিয়ে তুতুল বুঝতে পারে পায়েল রাস্তার মাঝে প্রায়।গাড়ি তেমন নেই।তাই সে নিজেই হেঁটে পায়েল নিতে যায়।সাবধানে পায়েলটা হাতে নিতেই সে বুঝতে পারলো খুব বড় ভুল হয়ে গেছে।রাস্তাকে বিশ্বাস করা তার বোকামু ছিলো।পিছন থেকে দ্রুত গতিতে ছুটে আসছে একটি হলুদ বড় গাড়ি।কি ভয়ংকর গতি।ভয়ে শিউড়ে উঠে তুতুলের শরীর।জীবনের শেষ নিঃশ্বাস একদম কাছে মনে হচ্ছে।চলার শক্তি হারিয়ে ফেললো সে।শাড়িটা দু’হাতে খামছে ধরলো।কোন দিকে যাবে ভাবতে ভাবতে মাথা ফাঁকা হয়ে গেল।হঠাৎ চারপাশে গাড়ির যাতায়াত বেড়ে যাচ্ছে।হর্নের শব্দে কান ঝাঁ ঝাঁ করে উঠছে।দিশাহারা হয়ে সে ঠাই দাঁড়িয়ে রইলো।পৃথিবীটা ঘুরতে শুরু করেছে।হঠাৎ মনে হল পিছন থেকে শব্দ আসছে।সম্পূর্ন শরীর ঘুরিয়ে পিছনে তাকায় তুতুল।একটা বাচ্চা!এত ছোট বাচ্চা মাঝ রাস্তায় কিভাবে?ভেবে পাচ্ছে না তুতুল।হঠাৎ তার মনে হচ্ছে তার ভয়ের চেয়েও প্রকট এই বাচ্চার কান্না।সে মাঝ রাস্তায় হাত পা ছড়িয়ে কাঁদছে।চিৎকারে তুতুলের কানের পর্দা যেন ফেটে যাবে।সে লক্ষ করছে তার পা নড়ছে।সে হাঁটতে পারছে।শূন্য চিন্তা থেকে ধীরে ধীরে তার মাথা কাজ করছে।হাতের পায়েলটা মুঠো বন্দি করে নেয় সে।শক্ত করে ধরে।শাড়ির একটা পাশ পায়ের পাতা থেকে উপরে তুলে সে নিজের সর্বশক্তি দিয়ে ছুটে বাচ্চাটার কাছে যায়।বাচ্চাটাকে তুলে নেয়।আশেপাশে দুই তিনটা গাড়ি সাই সাই করে চলে গেছে।ভয়ে তুতুল বাচ্চাটিকে জড়িয়ে ধরে।শক্ত করে।বাচ্চাটিও কেঁদেই চলেছে।দ্রুত পথ পার করা সহজ হচ্ছে না।কয়েকবার চেষ্টা করেও পারছে না।তুতুল মৃদূ হেসে বাচ্চাটিকে জিজ্ঞেস করলো,’তোমার নাম কি?’ এমন ভয়ংকর পরিস্থিতে কেউ নাম জিজ্ঞেস করলে সেটা অবশ্যয় খুব একটা সহজ দেখাবে না।বাচ্চাটি কান্না থামিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো কয়েক সেকেন্ড।তুতুল ভুলিয়ে ভালিয়ে আবার জিজ্ঞেস করে।চার পাঁচ বছরের সেই বাচ্চাটি নরম কন্ঠে বললো,’আমার নাম তুতুল।তৌফিকা হাসান তুতুল।’তুতুল বিস্মৃত হলো।একুই নাম!তার নামও তো তুতুল।আগে সে ভাবতো তার এই নাম শুধু তারই আছে।না আরো আছে ভেবে তুতুল হাসলো।ছোট তুতুল প্রশ্ন করলো,’আপনার ভয় করছে না?’’কিসের ভয়?’’ গাড়ি দেখে?’’ না করছে না।’ কথা শেষ করতেই ছোট তুতুল দেখল তাদের পথ শেষ।তারা একদম রাস্তার পাশে এসে থেমেছে।অনেক অন্ধকারের মাঝে এক ফোঁটা আলো যেমন আনন্দের ঝর্ণা নিয়ে আসে তেমন করে হাসলো বাচ্চা মেয়েটা।তুতুলও হাসলো।গাল টেনে দিয়ে সে ভাবল এত সাহস সে পেল কিভাবে?মাঝ রাস্তা থেকে সে একটা বাচ্চাকে বাঁচিয়েছে!সে?মনটা আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠে।সতেজ অনুভুতি।কেউ বলেছিল সাহায্য করলে আলাদা আনন্দ পাওয়া যায়।তাহলে কি সে সাহায্য করেছে?এত আনন্দ কেনো পাচ্ছে!তুতুলের খুব খুশি লাগছে।খুশিতে নাচতে ইচ্ছে করছে।মাঝ রাস্তায় নাচবে!রিঝ আসুক।এক সাথে নাচবে।বিয়ের পোশাকে মাঝ রাস্তায় নাচলে মন্ধ হবে না।সবাই উৎসুক হয়ে দেখবে।আলোড়ন পড়বে চারপাশে।রাস্তার পাশ ঘেঁষে সে উপরে আসতে যাচ্ছিলো।একটা কালো গাড়ি ছুঁটে আসে।উড়িয়ে দেয় সম্পূর্ন শরীরটাকে!মুহূর্তের মাঝে সে নিজেকে আবিষ্কার করে,শূন্যে,বাতাসে,হাওয়ার ভাঁজে ভাঁজে।আকাশটা খুব কাছে মনে হচ্ছে।এই তো,একটু হলেই ছুঁয়ে দিতে পারবে।হঠাৎ কি হলো!তুতুল কিছু বুঝে উঠতে পারলো না।বিকট শব্দ তুলে গাড়ি ধাক্কা দিয়েছিল।শরীরের সব হাড় একত্রে ভেঙ্গে গুড়ো গুড়ো হলে বুঝি এমন যন্ত্রনা হয়?তুতুল স্পষ্ট বুঝতে পারছে এখানে কিছুর ইতি হবে?কার?তার নিজের?হঠাৎ কেনো?সময় দিয়ে হলো না কেন?চারপাশের চিৎকার তার কানে আসতেই সে নিজেকে পিছঢালা রাস্তার বুকে লুটায়িত অনুভব করলো।শরীর ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো যেন।ইশ কি ভয়ংকর কষ্ট!তুতুলের শরীর কেঁপে উঠে।যন্ত্রনায় কাতরাতে কাতরাতে সে অনুভব করতে পারলো না কিছু।কারো কথা কানে আসলো না।শেষ বারের মত দেখল একটি মেয়ে দৌড়ে আসছে।পরিচিত মুখ।মনে করতে পারলো না কে।শরীর ভিঁজে উঠে।কপালে পানির মত তরলের আবির্ভাব ঘটে।ধীরে ধীরে লাল বেনারসি আরো লাল হয়ে কালো খয়েরিতে রূপ নেয়।কেন নিচ্ছে!তার লাল পছন্দ।বিয়ের শাড়ি হবে লাল!টকটকে লাল..আজ তার বিয়ে তো!বিয়ে!শরীর আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে পড়ে।নিস্তব্ধ হয়ে উঠে চারপাশ।চিৎকারের শব্দও আসে না কানে।চুলের ফুলগুলো থেতলে গেছে?ইশ কত সখ করে পড়েছিলো।কার জন্য যেন?ভালোবাসা যে শিখিয়েছে তার জন্য।তাকে ভালোবাসা হলো না।জ্বলে যাচ্ছে শরীর।মৃত্যু যন্ত্রনা একেই বলে?আহা তার প্রিয় মানুষ!কাউকে দেখছে না কেনো?শেষ বার দেখতে চায়।আকুতি ভরা গোল চোখ গুলো আরো বড় হয়ে উঠে একবার।কানের পাশ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে গরগর করে লাল রক্ত।মাথার নিচ ভিঁজে উঠে স্রোতে।রক্তের স্রোত!এসব কি হয়ে গেলো?সংসার হলো না।কাছা কাছি পাশাপাশি থাকা হলো না।সে তো কথা দিয়েছিল?কথা রাখতে পারেনি!হাতের মুঠোটা সবার চোখে পড়লো।শক্ত হয়ে ছিল।অনেক লোকের ভিরে কেউ টানতে চেয়েছিল।কিন্তু নিতে পাড়লো না।ছাড়াতে পারলো না।তুতুল নামের বাচ্চা মেয়েটা ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে একবার চোখ তুলে দেখে।তার পর পরই চিৎকার করে শুয়ে পড়ে রাস্তায়।তার মা ছুঁয়ে এসেছিল আরো আগেই।মেয়েকে জড়িয়ে তিনি বসে পড়ে।প্রগাঢ় অন্ধকারে ঢাকা জগত থেকে শুধু একটু অনুভুতি প্রকাশ পেল!এই যে পায়েল হাতের মুঠোয় বন্দি আছে তো!এতেই হবেনা? কথা রাখা।
______________________
হোসাইন সাহেব টেলিফোন একদম পছন্দ করেন না।এই টেলিফোনে দুনিয়ার সব দুঃসংবাদ এসে হাজির হয় বাড়িতে।বার্তা বয়ে আসবে সুসংবাদ।দুঃসংবাদ কেন আসবে?তার মায়ের মৃত্যুর সংবাদ এসেছিল এই টেলিফোনে।বাবারও।শ্বশুর শাশুরিরও।মেয়ের খারাপ অবস্থার খবরও এসেছিল এই টেলিফোনে।ফোনটা যখন বেজে উঠে তখনি বুকটা ধড়াস ধড়াস করে।এই বুঝি হার্ট ফেল হবে।আজ এই শুভ দিনে এই ফোনের বাজাটা তার একদমই ভালো লাগলো না।কয়েকবার বাজল।তিনি উপস্থিত থেকেও ফোন ধরলেন না।ঠিক করলেন আজ বাজতেই থাকুক।কিন্তু তিনি ধরবেন না।তিনি বুঝতে পেরেছেন,যে ফোন করছে সে খুব বড় বেয়াক্কেল।তা না হলে ধরছে না যেনেও কেন বার বার কল করছে?এদের বলে বোকা।বোকারাই মানুষ বিরক্ত হয় যেনেও বিরক্ত করতে চলে আসে।আলভী এসে দেখে টেলিফোন বেজে চলেছে।বাবার দিকে সে একবার তাকিয়ে টেলিফোনটা তুলতে যায়।হোসাইন সাহেব কড়া গলায় বললেন,’ নিচে তোর কাজ আছে না?যা কাজ কর।সব মেহমানকে খেতে দিয়ে আয়।’’ টেলিফোন বাজছে আব্বু।’’বাজুক।দেখি কত বাজতে পারে।’’গুরুত্বপূর্ন হতে পারে।’ তোর ফোন আছে না।’আলভী অবাক হয়ে বললো,’সেটা তো সবারই আছে।’’ তোর প্রয়োজন হলে তোকেই ফোন করবে।এটা তুলবি না।শেষ কথা।’ হোসাইন সাহেব টেনশনে পাইচারী করতে শুরু করলেন।কেন পাইচারী করছেন তিনি বুঝতে পারছেন না।আলভী স্পষ্ট বুঝতে পারছে তার বাবা চিন্তিত।তাই সে আর বেশি বাড়ায় না।চলে যেতেই নিবে তখন তার ফোনটা বিশ্রী শব্দ করে বেজে উঠে।হোসাইন সাহেব চমকালেন।চোখ গুলো লাল হয়ে উঠলো তার।পেশার বেড়েছে মনে হয়।আলভী ফোন কানে দিতেই তার মাথা চক্কড় দিয়ে উঠল।সোফার হাতল ধরে সে বসে পড়লো।চাপাস্বরে বললো,’আপনার ভুল হচ্ছে।আমাদের কেউ হসপিটালে কেন যাবে?’অপর পাশ থেকে বললো,’আসমা নামের মেয়ে আমাকে আপনার নাম্বার দিয়েছে।হসপিটালে আপনাদের প্রেসেন্ট।কন্ডিশন ভালো না।খুবই সিরিয়াস।আপনারা যতদ্রুত সম্ভব আসুন।’
ফোনটা হাত থেকে পড়লো না।একদম লেগে রইলো।হোসাইন সাহেব উত্তেজনায় ঘামতে শুরু করলেন।সম্পূর্ন কথাটাও তিনি শুনলেন না।তার আগেই ঘামছেন।কি আশ্চর্য!
__________
পর্বটা বিশাল হয়ে গেছে।পাঠকদের পড়তে পড়তেই বিরক্ত লেগে যাবে।তাই আইডিতে পর্বটিকে দুই ভাগে ভাগ করে দেওয়া হচ্ছে।পরের পর্ব সন্ধ্যা ছয়টায় পোস্ট হবে।
#চলবে…………
ভুলগুলো আল্লাহর দেওয়া মহান গুন ক্ষমার চোখে দেখবেন।
#চলবে…………
ভুলগুলো আল্লাহর দেওয়া মহান গুন ক্ষমার চোখে দেখবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here