সংসার পর্ব ১৯+২০

#সংসার
#পর্ব_১৯

#লেখিকা_সুরাইয়া_ইসলাম_সানজি।

আমার তাদের দিকে তাকিয়ে নিমিষেই ভয় কেটে যায়। আর মুগ্ধ চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকি। সৃষ্টি কর্তার এক একজোড়া ভালোবাসার সংসার কতই না মধুর।

৩৭.
আমরা সবাই বান্দরবান এসে, চান্দের গাড়ি নিয়ে নিলাচল নিমাম্বর রিসর্টে চলে যাই। আকাই ভাইয়া আগে থেকেই তিনটা রুম বুক করে রেখেছিল।
এখানে এসে আমরা সবাই একসঙ্গে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। পরেরদিন সকাল বেলা সবাই ঘুমিয়ে আছে আমি ওঠে নামাজ পড়ে বারান্দায় যাই। চারদিকে কুয়াশার জন্য কিছু দেখা যাচ্ছে না। গায়ে শীতল বাতাস উপছে পড়ছে। আমি আবার রুমে ঢুকে দেখি রুদ্র চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে আছে।

“আজ এত সকালে ওঠলেন যে? ঘুম ভালো হয়নি?”

রুদ্র কিছু না বলে আমার হাত আচমকা টান দিয়ে বেডের ওপর বসায়। আমার কোলে মাথা রাখে। আমি ওঠতে চাইলে কোমড় জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকে। ঘুম ঘুম চোখে বলে।
“উহু নড়ো না তো।”

আমি রুদ্রের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি।কপালে কয়েকটা চুল পড়ে আছে। আমি হাত দিয়ে চুল গুলো এলোমেলো করে দেয়।রুদ্র আমার পাগলামি দেখে চোখ বন্ধ করেই মুচকি হাসি। আর আমি ঘোড় লাগা দৃষ্টিতে তার মায়া ভরা হাসির দিকে তাকিয়ে থাকি সারা মুখে মায়ায় ছড়িয়ে আছে। তার চোখ, তার ঠোঁটে সব কিছুতে মায়া উপচে পরছে। আচ্ছা একটা মানুষ আদৌ কি এতটা পারফেক্ট হয়? এই মানুষটা যে আমার অর্ধাঙ্গিনী, আমার জীবন সঙ্গী মনে পরতেই সারা শরীরে খুশির শিহরণ বয়ে যায়।

চারদিকে কুয়াশা কেটে সূর্যের রঙিন আভা ফুটে ওঠেছে। আমি তাড়াতাড়ি রুদ্রকে ওঠিয়ে রুমের বারান্দায় নিয়ে যাই। আমরা যে তিনটি রুম বুক করেছি সেগুলো এক সাথেই আর তিনটি রুমের একটি বড় বারান্দা।
আমি আর রুদ্র বারান্দায় নামতে দেখি রাইমা আপু আর রাকিব ভাই রিসর্টের সামনে দাড়িয়ে কথা বলছে। দুজনের হাতেই কফির মগ। রাকিব ভাইয়া গ্রিলের সামনে দাড়িয়ে হাত দিয়ে নানান জিনিস দেখাচ্ছে আর সেটার বর্ণনা দিচ্ছে। আর রাইমা আপু গ্রিলে পিঠ ঠেকিয়ে এক দৃষ্টিতে রাকিব ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে।

আমি রুদ্রের এক বাহু জড়িয়ে ধরে তাদের দিকে এগিয়ে গেলাম। আমাদের দেখে রাইমা আপু বলল-

“মেঘ শুভ সকাল, ঘুম কেমন হলো?”

“শু-প্রভাত। অনেক ভালো, তোমাদের?”

“হ্যাঁ ভালো। জায়গা টা খুব সুন্দর তাই না?”

আমি রাইমা আপুর কথায় চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম। আসলেই জায়গাটা খুব সুন্দর। চারদিকে মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। জায়গাটার নাম যেমন নিলাচল তেমনই মনে হচ্ছে আকাশের নীল আচল চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। চারদিকে সাদা মেঘের দল উড়ে বেড়াচ্ছে। সৃষ্টিকর্তা খুব নিঁখুত হাতে এই জায়গাটা সাজিয়েছেন।
,

নিলাচলের চারদিকে ঘুরে দেখবো। অথচ এখন পর্যন্ত জেনি আপুর ঘুম ভাঙ্গার নাম নেই। আকাশ ভাইয়ার ঘুম না কাটলেও রুদ্রের ভয়ে ওঠে বসে আছে। ঘুম ঘুম চোখে বেশ কয়েকবার আকাশ ভাইয়া জেনি আপুকে ডাকলে ওঠে না।

তাই রুদ্র জেনি আপুকে ধাক্কা মেরে ওঠতে বলে।

“জেনি ওঠ, নাস্তা খেয়ে আমরা বের হবো। তাড়াতাড়ি ওঠ। এখানে আসছিস কি ঘুমানোর জন্য?”

জেনি আপু রুদ্রকে আকাশ মনে করে ঘুমের ঘোড়ে বকতে শুরু করলো।
“আকাইশ্যার বাচ্চা এখন থাপ্পড় খাবি। যা তো ডিস্টাপ করিস না।”

আকাশ ভাইয়া আপুর কথা শুনে দূর থেকে মিটমিট করে হাসছে যার মানে আজ সে বকা খাইনি সব রুদ্র খাইছে।

রুদ্র রাগে আকাশ ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বলল-
“ওই না হেসে এই হলুমানেরে ঘুম থেকে তোল। নয়ত তোর একদিন কি আমার একদিন।”

আকাশ ভাই হাসি থামিয়ে মুখটা পেচার মতো করে বেডের দিক এগিয়ে গেল।
“ভাইরে ভাই এই চিপা থেকে বের কর। একদিকে তুই ধমক দিস অন্যদিকে ওইটায় বকা দে। বল আমি কোন দিকে যামু।”

আকাশ ভাইয়ের অবস্থা থেকে বুক ফেটে হাসি আসলেও আমি ঠোঁটে ঠোঁট চেপে হাসি আটকিয়ে রাখি। নয়ত এই মুহূর্তে হাসলে আকাশ ভাইয়া কাঁদতে কাঁদতে বলবে মেঘ তুমিও হাসছো?

আকাশ ভাইয়া ভয়ে ভয়ে বেডের পাশের গ্লাস থেকে বেডের দুই হাত দূরে গিয়ে জেনি আপুর মুখে ওপর পানি ঠেলে দেয়। জেনে আপু রাগে চিৎকার দিয়ে ওঠলে সামনে রুদ্রকে দেখে চুপসে যায়। অপরাধী ভাঙ্গিতে বসে থাকে।

৩৮.
আমরা সবাই নাস্তা শেষ করে ড্রেস চেইঞ্জ করতে যাই। আমি আর রাইমা আপু নীল কালারের সাড়ি পরেছি। আমাদের দেখে জেনি আপু বলে-
“ওই তোমরা নীল সাড়ি পরছো, আমাকে আগে বলতে আমিও নিয়ে আসতাম।”

জেনির আপুর কথা শুনে রাইমা আপু বলে-
“জেনি আপু তুমি যে নিলাচল এসে নীল শাড়ি আনবেনা আমরা কি জানি?”

জেনি আপু মন খারাপ করে বসে থাকলে আমি গিয়ে বললাম-
“আপু এই নাও এটা হালকা নীল কালার সাড়ি আমার কাছে এক্সটা ছিল। এটা পরো। কিন্তু এটার সাথে মিলিয়ে নীল ব্লাউজ নেই।

“উহু মেঘ ওসব লাগবে না। আমার নীল ফতুয়া আছে। জিন্সের ওপর এটা পরে নিতে পারব।”

আমি, রাইমা আপু আর জেনি আপু সেজে গুজে রিসর্ট থেকে বের হলাম একটু দূরেই আকাই ভাইয়া প্রকৃতির ছবি তুলছে আর রুদ্র আর রাকিব ভাই দাড়িয়ে কথা বলছে।
রাইমা আপুকে নীল সাড়িতে খুব মানিয়েছে কিন্তু জেনি আপুকে ভালো লাগলেও নিচের দিক থেকে ঠিক একটা ভালো লাগছেনা জিন্সের কারনে। জেনি আপুর অবস্থা দেখে আমার ওই বাংলা প্রবাদের কথা মনে পরল- ‘উপর ঠিক ঠাক নিচে সদরঘাট।’ সাড়ির সাথে জিন্স সত্যিই হাস্যকর। তবুও এই হালকা রঙের নীল শাড়িতে জেনি আপুকে আকাশের দেবী মনে হচ্ছে।

আমরা রুদ্রদের দিকে এগিয়ে গেলে রাকিব ভাই হালকা হেসে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে বলে-
“নিলাচলের বুকে তিন নীল রমনী যেন নিলাচলের সূন্দার্য আরো ফুটিয়ে তুলেছে।”

আমি রাকিব ভাইয়ের কথায় মুচকি হাসি দেয়। রুদ্র আমার দিকে এগিয়ে এসে বলে-
“তোমাকে নীল রঙে যে এত সুন্দর লাগে আগে কেন বলোনি। তাহলে আমি পছন্দের জায়গায় আকাশি না রেখে নিল রঙকে বেশি প্রধান্য দিতাম।”

আমাদের এগিয়ে আসতে দেখে আকাশ ভাইয়া সবার অগোচরে জেনি আপুর কয়েকটা ছবি তুলে নেয়।

জেনি আপু আকাশ ভাইয়ার সামনে গিয়ে বলল-
“এই তুই তো বললি না আমাকে কেমন লাগছে?”

আকাশ ভাইয়া একটু হেসে বলল-
“পেত্নির মতো। জিন্সের সাথে শাড়ি ও মাই গড তুই মনে হয় প্রথম মেয়ে এ কিনা জিন্সের সাথে শাড়ি পরেছে। বুইন তুই আসলেই জিনিয়াস। গ্রামের চাচাতো বোন যখন আধুনিক বউ হয়।”

জেনি আপু আকাশ ভাইয়ার কথা শুনে পিঠে কয়েকটা কিল বসিয়ে বলে-
“হারামি আমি তো আর তোর মত হাফ প্যান্ট পরে নেই। দেখিস আজ যদি কয়েকটা ছেলে পটিয়ে না নেয় তবে আমার নামও জেনি না।”

আমি জেনি আপুর কথায় হালকা হেসে সামনের দিক এগিয়ে যাই। আমার পিছন পিছন সবাই আসছে। আকাশ ভাইয়াকে ঘুম ঘুম চোখে হাঁটতে দেখে রুদ্র বলল-
“সালা ঠিক মত হাঁট। নয়তো এখান থেকে পরে গেলে বিয়ের আগে জেনি বিধবা হবে। রাতে ঠিক মত ঘুমাস নি? আমার বিয়ে করেও তো দিব্যি ঘুমিয়েছি তাহলে তোর হলো কি?”

“ভাই তুই আমার জায়গায় থাকলে বুঝতি। সারারাত বসে বসে ঘুমিয়েছি। এই হারামিটা অচেনা জায়গা ভয় পায়। একটা পাখি ডাক দিলেও চিৎকার করে ওঠে।শেষ রাতে একটু শুইছি তাও আবার সোফায়। একবার ভাব ভাই বিয়ের আগেই এই অবস্থা বিয়ের পর কি হবে?”

আকাশ ভাইয়ের কথা শুনে আমরা সবাই হেসে ওঠলাম। পাহাড়ের মাঝখান থেকে রাস্তা। রাস্তার দু পাশে মনে হচ্ছে প্রকৃতি সূন্দার্য এখানে এসে ঘুমিয়ে আছে। আমরা সবাই হেঁটে হেঁটে সব জায়গা দেখছি। চারপাশ দেখে মনে হচ্ছে আকাশের নিচে মেঘ আর সেই মেঘের ভিতর বাড়ি।
হঠাৎ আমি একটা জায়গা দেখে সেখানে দৌড়ে যাই। জায়গাটার নাম রোয়াদো রং। জায়গা খুব সুন্দর আমি মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকি। এখানে দাড়িয়ে কয়েকটা দিন অনায়াসে পাড় করে দেওয়া যায়।
আমার পাশে চোখ পরতেই দেখি রুদ্র আমার দিকে ঘোড় লাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি আচমকা খুশিরে রুদ্রকে জড়িয়ে ধরি।

“মেঘ ছাড়ো, সবাই তাকিয়ে আছে।”

আমার চারদিকের কথা মনে পরতেই তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেয়। দেখি আশেপাশের সবাই আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি লজ্জায় মাথা নত করে ভাবি- এত লজ্জা পাওয়ার কি আছে আমি কি অন্য কাউকে জড়িয়ে ধরেছি। এটাতো আমারই জামাই।”
‘আমার জামাই’ কথাটা মনে মনে কয়েকবার আওড়াতেই আবার লজ্জায় লাল হয়ে ওঠি।

আকাশ ভাইয়া আমাদের সবার ছবি তুলতে তুলতে ক্লান্ত হয়ে বসে আছেন। কিন্তু বসে বসে জেনি আপুর ছবি তুলে যাচ্ছেন। জেনি আপু বিভিন্ন পোজে দাড়াচ্ছে আর আকাশ ভাইয়া বিরক্ত মাখা ভঙ্গিতে সেগুলো ক্যামেরায় বন্দি করছে।

আমি হাঁটতে হাঁটতে একটা পাথরের উপর বসতে গিয়ে পিছলে অন্য একটা পাথরের উপর পরি। আর একটা পাথর আমার পায়ে এসে পরে।
তেমন একটা ব্যাথা না পেলেও এখন এতটা দূর হাঁটা সম্ভব না। আমাকে বসে থাকতে দেখে রুদ্র আমাকে ওঠিয়ে তার কোলে নেয়। আমি বার বার বলছি আমি হেঁটে যেতে পারব কিন্তু কে শুনে কার কথা।
চারপাশের সবাই আমাদের দেখে জোড়ে চিৎকার করছে। কেউ ভিডিও করছে। আমি লজ্জায় রুদ্রের গলা জড়িয়ে ধরে বুকের ভিতর মাথা লুকিয়ে রাখলাম।
#সংসার
#পর্ব_২০

#লেখিকা_সুরাইয়া_ইসলাম_সানজি।

আমি হাঁটতে হাঁটতে একটা পাথরের উপর বসতে গিয়ে পিছলে অন্য একটা পাথরের উপর পড়ে যায়। আর একটা পাথর আমার পায়ে এসে লাগে।
তেমন একটা ব্যাথা না পেলেও এখন এতটা দূর হাঁটা সম্ভব না। আমাকে বসে থাকতে দেখে রুদ্র আমাকে ওঠিয়ে তার কোলে নেয়। আমি বার বার বলছি আমি হেঁটে যেতে পারব কিন্তু কে শুনে কার কথা।
চারপাশের সবাই আমাদের দেখে জোড়ে চিৎকার করছে। কেউ ভিডিও করছে। আমি লজ্জায় রুদ্রের গলা জড়িয়ে ধরে বুকের ভিতর মাথা লুকিয়ে রাখলাম।

৩৯.
দুপুরে খাবার খেয়ে, বিকেলের দিকে চলে গেলাম চিম্বুক পাহাড়ের উদ্দেশ্যে। বান্দরবান জেলা থেকে চিম্বুক পাহাড় প্রায় ২৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।

গাড়ি করে যেতে যেতে হঠাৎ আঁকাবাঁকা একটা নদী চোখে পরে। আমি দ্রুত গাড়ি থামাতে বলে সেই নদীর তীরে যাই। আমার পিছে পিছনে বাকি সবাই আসছে। মুগ্ধ চোখে চারদিকে তাকিয়ে দেখি। বিকেলের হেলে পড়া সূর্যের জন্য নদীর পানি চিকচিক করছে। আমি সেদিকে পিটপিট করে তাকিয়ে আছি। মনে হচ্ছে প্রকৃতি আমাদের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসছে।
রুদ্রের দিকে উৎসাহ দৃষ্টিতে নদীর নাম কি জিঙ্গেস করলে বলে নদীর নাম সাঙ্গু নদী। এমন প্রকৃতির সাথে নদীর নাম একদম মিলছে না। মনে মনে ভাবছি নদীটার নাম কি দেওয়া যায়।

সবাই গিয়ে গাড়িতে আবার নিজ নিজ সিটে বসছে। কিন্তু আমি একই জায়গায় ভাবুক দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবছি নদীটার নাম কি দেওয়া যায়। নদীটার সৌন্দর্য দেখে যে কেউ এর মায়ার প্রেমে পরতে বাধ্য। সেখানে নদীটার নাম কি সাঙ্গু? আমি মনে মনে ভাবলাম নদীটার “প্রেমাবীনি” হলে মন্দ হত না। আমি জোড়ে চিৎকার করে উঠলাম-
“ইয়াসস প্রেমাবীনি”

হঠাৎ আমাকে চিৎকার করতে দেখে সবাই অবাক হয়ে গাড়ির ভিতর থেকৈ তাকিয়ে রইলো। রাইমা আপু চড়া গলায় বলল-
“মেঘ তুমি কি পাগল হয়ে গেলে, নাকি জ্বীন ট্বিনে ধরছে?”

আমি নিজেই নিজের বোকামি বুঝতে পেরে অপ্রস্তুত ভাবে হেসে উঠলাম। গাড়িতে ওঠে বসতেই রুদ্র ফিসফিস করে বলল-
“মায়াবীনি নাম না হয়ে ‘প্রেমাবীনি’। মারাত্মক সুন্দর নাম দিলে নদী টার।”

আমি তার দিকে অবাক হয়ে তাকালাম সে কি করে জানলো আমি এটা নদীর নাম রাখছি?
আমি প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকালে রুদ্র উত্তরে শুধুই মুচকি হাসে।
আমি মনে মনে বলে ওঠলাম-
“হায়! এই হাসি যে আমাকে মেরেই ফেলবে।”

আমার দিকে সবাইকে তাকিয়ে হাসতে দেখে বুঝলাম কথাটা আমি মনে মনে না জোরেই বলে ফেলছি।
,

চিম্বুক পাহাড় সমুদ্র পৃষ্ট থেকে প্রায় ২৫০০ শত ফুট উপরে অবস্থিত। এখানে দাড়ালে মনে হয় মেঘের উপরে দাড়িয়ে আছি আর মেঘ নিচ থেকে ভেসে যাচ্ছে। গড়িতে করে যাওয়ার সময় মনে হচ্ছে আমরা চাঁদের বুকে পাড়ি দিচ্ছি। আমি পাহাড়ের উপর ওঠে ঘাসের উপর বসে পরি। কি অপরূপ সুন্দর্য।

জেনি আপু আর রাইমা আপু এসে ঘাসের উপর বসল।

জেনি আপু ঘাসের উপর বসতে বসতে বলল-
“সবাই সবার কাপল কে এখানে বসে প্রপোজ করলে মন্দ হবে না। কি বলিস আকাশ? ”

জেনি আপুর কথায় আকাশ ভাইয়া সায় দেয়।
আমি ভাবতে থাকি রুদ্র আমাকে কি দিয়ে প্রপোজ করবে এখানে প্রপোজ করার মতো কোনো জিনিস আছে। রুদ্র আমাকে প্রপোজ করবে ভাবতেই মনের ভিতর এক অজানা অনুভূতিতে ভরে যায়।

রাকিব ভাই পাহাড়ের আসেপাশে থেকে কিছু ঘাস ফুল নিয়ে এসে রাইমা আপুকে প্রপোজ করতেই রাইমা আপু রাকিব ভাইয়ে জড়িয়ে ধরে।
আকাশ ভাই কি দিয়ে প্রপোজ করবে ভাবতেই আসে পাশে তাকায়। তখনই রিসর্ট থেকে আসর সময় দুষ্টুমি করে রাইমা আপুর একটা উরনা গলায় পেচিয়ে নিয়েছিল। সেটা নিয়ে জেনি আপুর কাছে গিয়ে মাথায় পেচিয়ে বউদের মতো করে পরিয়ে দেয়।

তখনই রাইমা আপু বলে ওঠল-
“আকাশ ভাই এটা কি হলো? আমার উরনা দিয়ে প্রপোজ। না হবে না। এটা মানি না।”

“রাইমা,পরে না হয় বাসায় ফিরে জেনিকে প্রপোজ করা যাবে। কিন্তু এই মুহূর্তে তোমার ভাইয়ের প্রপোজ দেখার জন্য মনটা আকুপাকু করছে। যে ছেলেটা জীবনে কোন মেয়েদের কাছে যায় নাই সেই ছেলেটা কিভাবে বউকে প্রপোজ করবে দেখার জন্য আমার আর তর সহ্য হচ্ছে না।”
আকাশ ভাইয়ার কথায় সবাই উৎসক হয়ে রুদ্রের দিকে তাকায় আমি মিটমিট করে হাসছি। কি দিয়ে প্রপোজ করবে, কেমন করে প্রপোজ করবে?

রুদ্র কিছু একটা ভেবে মুচকি হেসে হাঁটু গেড়ে আমার সামনে ঘাসের উপর বসে। আমাকে ইশারায় তার হাঁটুর উপর পা রাখতে বললে আমি না রেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি কি করবে এটা ভেবে। চারপাশে লোকজন, কারো মুখে কোন কথা নেই সবাই তাকিয়ে আছে কি হচ্ছে এটা ভেবে।

রুদ্র মুচকি হেসে ইশারায় পা তার হাটুর উপরে রাখতে বললে আমি কাঁপা কাঁপা পা তার দিকে এগিয়ে দিতেই সে নিজে পা নিয়ে হাটুর উপরে রেখে পকেট থেকে একটা পায়েল বের করে। পাথরের দু প্যাঁচের একটা পায়েল ঝকঝক করছে। আমি মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছি।
রুদ্র পায়েল টা পায়ে পরিয়ে দিয়ে ওঠে দাড়াতেই আমি রুদ্রকে জড়িয়ে কান্না করে দিলাম। রুদ্র আমাকে কাপালের উপর তার ঠোঁট ছুইয়ে দেয়। মনে মনে একটা কথাই ভেসে ওঠে আদৌ কি আমি এতো ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য?

ছোট বেলায় যার ভালোবাসা বেশি পেতাম তাকেই হারিয়ে ফেলেছি। যে ভালোবাসা উপচে পরে সেটা যে আমার কপালে বেশি দীর্ঘ হয়না। কিন্তু আমার যে রুদ্রের ভালোবাসা অনন্তকাল চাই।

৪০.
চিম্বুক পাহাড় থেকে ফিরার সময় একটা মেয়ে আমাদের দিকে হাত নেড়ে এগিয়ে আসলো।

“হেই আকাশ, তুমি এখানে,কেমন আছো? আরে জেনি আপু আপনিও আছেন যে? সবাই এখানে কি ব্যাপার।”

মেয়েটির কথা শুনে জেনি আপুর মুখটা মুহূর্তে ফ্যাকাশে হয়ে গেল। জেনি আপু উত্তর না দিয়ে বলল-

“মেঘ চলো চলো আমাদের লেইট হয়ে যাচ্ছে।”

আমি আকাশ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে দেখলাম আকাশ ভাইয়া কেমন করে মেয়েটার দিকে এই দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

মেয়েটি বলল-
“কোথায় যাবে, কোন রিসর্টে ওঠছো?”

আকাশ ভাইয়া আস্তে করে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল-
“আমরা নীলাচল নিলাম্বর রিসর্টে ওঠেছি, হঠাৎ এখানে‌, কেমন আছো?”

মেয়েটা মুচকি হেসে বলল-
“উমমম ভালো, এই তো ঘুরতে এসেছি। চলো আমিও নীলাচল নিলাম্বর রিসর্রটে ওঠেছি। একসাথেই যাওয়া যাবে।”

মেয়েটি কথা শেষ করার আগেই জেনি আপু বলল-
“দুঃখিত আপু, আমরা যে গাড়িতে আসছে সেখানে ছয়জনের বেশি ওঠা যাবে না। তুমি বরং অন্য টায় আসো।”

মেয়েটি মন খারাপ করে বলল-
“আচ্ছা ঠিক আছে তোমরা তাহলে যাও।”

আকাশ ভাইয়া মেয়েটির সাথে আর কেউ এসেছি কিনা জিঙ্গেস করলে মেয়েটি মাথা নাড়িয়ে না বলে।

“কি বলো তুমি একা এসেছো? এই সন্ধ্যায় একা এখানে একটা মেয়ে থাকা নিরাপদ হবে না। চলো আমাদের সাথে চলো কষ্ট করে হলেও রিসর্ট পর্যন্ত যেতে পারব।”

এক প্রকার জোড় করেই আকাশ ভাইয়া মেয়েটিকে আমাদের সাথে গাড়িতে নিয়ে নেয়। আমরা সবাই মেয়েটির সাথে নানান কথা বলছি। মেয়েটির নাম লিনা। একটু কথা বলেই বুঝলাম মেয়েটি অনেক মিশুক। আর অবাক করা বিষয় মেয়েটি আকাশ ভাইয়ার খালাতো বোন। অথচ জেনি আপু আকাশ ভাইয়ার কজিন হয়েও মেয়েটিকে চিনেও না চেনার ভান কেন করলো?
গাড়িতে সবাই অনেক গল্প করলেও জেনি অপু একটা কথাও বলল না আনমনা হয়ে সারাটা রাস্তা বসে ছিল। যে মেয়ে এত কথা বলে সে কি না আজ চুপচাপ। আমার একটু সন্দেহ হলেও পরে ভাবছি হয়তো ক্লান্ত তাই চুপচাপ বসে আছে।

রিসর্টে ফিরে ফ্রেশ হয়ে সবাই শহালকা রেস্ট নেই। তারপর ওঠে একসাথে ডিনার করে বারান্দায় আড্ডায় বসে পরি। একেক জন তার জীবনের একেক কথা বলছে। রুদ্র আমাদের প্রথম ফোন আলাপের কথা গুলো বললে আকাশ ভাইয়া বলে-

“সালা তলে তলে এতদূর? আমি তো ভাবতাম বিয়ের পর থেকে তুই বউ পাগল হইছিস। এখন তো দেখি বিয়ের আগে থেকেই অনেক ছিলি। আমি প্রেম করলেই জ্ঞানের ভান্ডার খুলে বসতি অথচ নিজের বেলা ষোল আনা মাফ?”

আকাশ ভাইয়ের কথায় আড্ডায় হাসির রোল পরে যায়। কথার এক ফাপে জেনি আপু বলল-

“বুঝলে মেঘ রুদ্রকে ভার্সিটিতে থাকতে সাত বার প্রপোজ করছিলাম। কয়েকবার ধমক টকম দিলেও শেষের বার তো ও সোজা গিয়ে একটা স্যারের কাছে কমপ্লেন করে। আর আমাদের সেই জহিরুল স্যারটা ছিল খুব মজার। সে এই ভালোবাসাকে বন্ধুত্বের রূপ দেয়। সেদিন সে বলছিল- একরোখা ভালোবাসা হারিয়ে যায়, কিন্তু বন্ধুত্ব হারায় না। জেনি তুমি যদি রুদ্রু কে সারা জীবন রাখতে চাও বন্ধুত্বের হাত বাড়াও।
তারপর থেকে ওর সাথে আমার ফ্রেন্ডশিপ শুরু হয়।”

আমি জেনি আপুর কথা শুনে অবাক হয়ে যাই। সাতবার প্রপোজ করছে অথচ ব্যাপারটা তার কাছে সাধারণ।
আমাদের কথা বলতে দেখে লিনা অপু আমাদের দিকে এগিয়ে আসে। লিনাকে দেখে আকাশ ভাইয়া একটু সরে তার পাশে জায়গা করে দেয় সেখানে বসতে বলে। লিনা আপু আসলেই জেনি আপু বলে-

“রুদ্র আমার ঘুম পাইছে, তোরা আড্ডা দে। সকালে কথা হবে।”

জেনি আপু চলে যেতেই আমার সন্দেহ হয়। আমি চুপচাপ সেখান থেকে উঠে জেনি আপুর রুমের সামনে এসে দেখি জেনি আপু খাটের একপাশে বসে হাটুতে মাথা গুটিয়ে কাঁদছে।

“আপু কি হইছে কাঁদছো কেন?”

আমাকে হঠাৎ জেনি আপু সামনে দেখে তাড়াতাড়ি চোখে পানি মুছে মুখে হাসি টেনে বলে-
“আরে মেঘ কাঁদছিনা তো, খারাপ লাগছে আরকি।”

আমি আপুর পাশে বসে তার কাধে হাত দিয়ে বললাম-
“আপু আমি খারাপ লাগা আর ভালো লাগা বুঝি। তোমার চোখের জল অন্য কিছু বলছে যে?”

আমার কথা শুনে জেনি আপু এবার হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে।কান্না জড়িত কাঁপা কাঁপা গলায় বলে-
“ও ও আ আমার আকাশ নিয়ে যাবে মেঘ। আমি বাঁচবো না।”

আমি জেনি আপুকে শান্ত করে কি হইছে জানতে চাইলে বলে-
“আকাশ আর লিনা ছোট বেলা থেকে একে অপর কে ভালোবাসত। তাই ওদের পরিবার ওদের দুজনের বিয়ে ঠিক করে রেখেছিল। তখন আমার আর আকাশের সাপে নেউলে সম্পর্ক। লিনা আকাশ আর আমার থেকে দুই বছরের ছোট ছিল।

তখন আমরা ইন্টার দ্বিতীয় বর্ষে পড়ি। আকাশ আর লিনার পরিবার চাইছিল কোর্টের মাধ্যমে বিয়েটা করিয়ে রাখবে। পরে যখন প্রাপ্তবয়স্ক হবে তখন অনুষ্ঠান করে বিয়ে করাবে। কিন্তু যেই দিন বিয়ে হবে সেই দিন লিনা কোন একটা ছেলের সাথে পালিয়ে চলে যায়।
সেইদিন আকাশ প্রথম জানতে পারে লিনা আরো সম্পর্কে জড়িয়ে ছিল। সেই থেকে ওর সব মেয়ের উপর বিশ্বাস ওঠে যায়। বেশ কয়েক বার সুইসাইড করতে গেলেও প্রতিবার আমি ওকে আটকাই। সম্পর্কটা আমাদের সাপে নেউলে হলেও এটা দুজনেরই অভ্যাসে পরিনত হয়ে যায়।
আকাশ একের পর এক রিলেশনে জড়াতো আর প্রত্যেকটা সম্পর্ক আমি গিয়ে ভেঙ্গে দিতাম। তখন আবার লিনা আমাদের মাঝে আসে। আবার আকাশ লিনার মায়ায় জড়িয়ে যায়। তার কয়েক মাস পর লিনা আকাশকে একটা মেসেজ দিয়ে সব কিছু থেকে ব্লক করে দেয় যেখানে লেখা ছিলো-
“আকাশ তোমার প্রতি শুধুই আমার আবেগ। আমি অন্য একজনকে ভালোবাসি। যে আমাকে এতদিন দূরে রেখেছে কিন্তু এখন আবার সে আমাকে চায়। আমি তার কাছে ফিরে যাচ্ছি ক্ষমা করে দিও।”

আকাশ সেই দিন খুব কষ্ট পেলেও আমি সেই ওকে সামলাই। সেই থেকেই আমাদের বন্ধুত্ব শুরু। তারপর আস্তে আস্তে মেলামেশা, বিশ্বাস বাড়তে থাকে। তারপর দুইজন দুই শহরে পড়তে গেলে উপলব্ধি করি দুজন দুজকে ভালোবাসি। সেই থেকেই আমাদের সম্পর্ক শুরু হয়।”

এখন আবার লিনা ফিরেছে আমার ভালোবাসাকে কেড়ে নিতে বলতে বলতেই জেনি আপু কান্নায় ভেঙ্গে পরে।

আমি দরজার দিকে তাকিয়ে দেখি আকাশ ভাইয়া আসছে। আকাশ ভাইয়া আসতে দেখে জেনি আপু তাড়াতাড়ি চোখে জল মুছে নেয়। আকাশ ভাইয়া কিছুক্ষণ জেনি আপুর দিকে তাকিয়ে ওয়াশরুমের দিক পা বাড়ায়।
,

সকাল বেলা আমি নামাজ পড়ে বারান্দায় বসে প্রকৃতি অনুভব করতে থাকি। রুদ্র নামাজ পরে আবার ঘুমিয়ে গেছে। চারপাশে ঘন কুয়াশা।
হঠাৎ আমি পিছনে শব্দ শুনে পিছনে তাকিয়ে দেখি আকাশ ভাইয়া দরজা খুলে পা টিপেটিপে বাহিরে যাচ্ছে। আমিও আকাশ ভাইয়ের পিছু নিয়ে দেখি আকাশ ভাইয়া লিনা আপুর রুমের সামনে দাড়িয়ে আছে।

লিনা আপু দরজা খুললে আকাশ ভাইয়া ভিতরে যায়। আমি দূর থেকে শুধু দেখছি তারা কি বলছে শুনতে পারছি না।
পিছনে অন্য কারো আসার শব্দ শুনে তাকিয়ে দেখি জেনি আপু এদিকেই আসছে। আমি জেনি আপুকে দেখে চুপচাপ বারান্দায় চলে যায়। জেনি আপু ধীরু পায়ে লিনা আপুর দরজায় নক করছে।

আমি জেনি আপুকে সেখানে দেখে আতকে ওঠি। এখন যদি আকাশ ভাইয়াকে লিনা আপুর রুমে জেনি আপু দেখে তাহলে সে কি করবে জানি না। ভয়ে ভয়ে আমিও সেদিকে পা বাড়াই।

#চলবে,,,,
#চলবে,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here