#দহন
#পর্ব_১৪
#লেখা_মিম
-” দেখ মুহিব, এখানে সভ্য ফ্যামিলির কথাটা আনছিস কেনো? প্রেমিক বা স্বামীর সামনে নিজেকে এভাবে গুটিয়ে রাখার সাথে সভ্য ফ্যামিলির সম্পর্কটা কোথায়?”
-” অবশ্যই আছে। একটা মেয়ের আচরন ডিপেন্ড করে তার ফ্যামিলির শিক্ষার উপর। শিমুলের ফ্যামিলি সভ্য তাই শিমুলও সভ্য। নীলার ফ্যামিলি হচ্ছে একটা অসভ্য ফ্যামিলি। এজন্যই নীলা অন্যের হাজবেন্ডের সাথে প্রেম করে বেড়াচ্ছে রাস্তাঘাটে চুমু খেয়ে বেড়াচ্ছে। নীলা যদি ভালো ফ্যামিলির মেয়ে হতো কখনোই এসব করতে পারতো না।”
-” আমাকে দিয়ে শিমুলের সাথে তোর পরিচয়। শিমুল তো আর তোর ফ্যামিলি মেম্বার না বা আপন বোন না যে তুই শিমুলের হয়ে এত কথা বলছিস।”
-” তোরও অনেক আগে থেকে শিমুলকে আমি চিনি। আর শিমুল আমার আপন নাকি পর সেটা তোকে দেখতে হবে না। অন্যায় তো অন্যায়ই। তুই অন্যায় করছিস। এখন তুই আমার বন্ধু বলে কি তোকে আমি উচিত কথা বলবো না?”
-” দেখ মুহিব, আমার দিকটা একটু বোঝার চেষ্টা কর প্লিজ। নিজের সাথে বহু যুদ্ধ করেছি। লাগাতার মনটাকে বুঝাতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু কোনোভাবেই শিমুলের দিকে মনটাকে ঝুঁকাতে পারিনি। নীলার দিকেই শুধু মন টেনেছে আমার।”
-” এতদিন তোর নীলা কোথায় ছিলো? এতবছর কেনো তোর সাথে যোগাযোগ করেনি?”
-” ঐ ছেলেটা ওকে ধোঁকা দিয়েছে। ওর সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছিলো ছেলেটার। ওদের পুরো এলাকা আত্মীয়-স্বজন সব জায়গায় জানাজানি হয়েছে। বিয়ের দুদিন আগে ওর সাথে ছেলেটা বিয়ে ভেঙে দিয়েছে। পুরো এলাকায় নীলার নামে অনেক কু-কথা রটিয়েছে। এরপর থেকে সবাই ওকে খারাপ নজরে দেখা শুরু করেছে। অনেক আজেবাজে কথা শুনতে হয়েছে নীলাকে। এলাকার ছেলেরা ওকে বিভিন্নভাবে খারাপ ইঙ্গিত দিতো। জাহান্নাম হয়ে গিয়েছিলো ওর জীবনটা। এরপর ওরা বাসা পাল্টে অন্য এলাকায় চলে আসে যেখানে কেউ ওদের চিনে না। মেয়েটা অনেক কষ্টে আছে মুহিব। ওদের মাথার উপর এখন কেউ নেই। একটা ভাই নেই, বাবা নেই। সেই ঘটনার পর এই দুই বছরে ওর তিনটা বিয়ের প্রস্তাব এসেছিলো। ওর আত্মীয়স্বজনদের কাছে যখন পাত্রপক্ষ ওর অতীত শুনে তখন কেউই ওকে বিয়ে করতে চায় না। ওরা অনেক বিপদে আছে।”
-” এই দুইবছর কেনো তোর সাথে যোগাযোগ করেনি? এখন কেনো বিয়ের পর তোর গলায় ঝুলতে চাচ্ছে?”
-” ও নাকি আমার নম্বরে ট্রাই করেছে অনেকবার। কিন্তু আমি তো আগের সিমটা চেইন্জ করে ফেলেছিলাম। আগের বাসায় খোঁজ নিয়েছিলো। বাসাটাও তো বদলে ফেলেছি। আমাকে খুঁজে পাবে কিভাবে বল?”
-” শোন, এত কথা বলে লাভ নেই। যা হওয়ার তা হয়েছে। নীলাকে এখন তুই ছেঁড়ে দিবি এটাই শেষ কথা।”
-” আমি ওকে ছাঁড়তে পারবো না। আমি ওকে ভালোবাসি। সে ও আমাকে ভালোবাসে। আমি ওকে যদি এখন ছেঁড়ে দেই তাহলে ও আবার সুইসাইড এটেম্পট নিবে। এবার যদি ও সত্যিই মরে যায় তখন? না না…. নীলা বিপদে আছে। এই মূহূর্তে ওর উপর ওর ফ্যামিলির মাথার উপর একটা ছায়া প্রয়োজন। ওকে আমি এই অবস্থায় একা করে দিতে পারিনা।”
-” তাহলে তুই কি করতে চাচ্ছিস?”
-” আমি নীলার ছায়া হতে চাই। ওর হাতটা আঁকড়ে ধরতে চাই।”
-” তাহলে শিমুল কোথায় যাবে?”
-” দেখ এখন যেহেতু সব কথা শিমুলের সামনে খোলাসা হয়ে গেছে অতএব এখানে আর লুকোচুরির কিছু নেই। সোজাসাপ্টা কথা বলে দেই। শিমুলকে আমি ডিভোর্স দিতে চাই।”
শিমুল মুহিব দুজনই হা হয়ে অনিমের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষন পর মুহিব ভ্রু কুঁচকে অনিমের অনেকটা তেড়ে এসে বললো,
-” বুঝে শুনে কথা বলছিস তো? কাকে কি বলছিস তুই?”
-” হ্যা বুঝে শুনেই বলছি।”
-” নীলাকে ছেড়ে দিলে নীলা মরে যাবে আর শিমুলকে ছেড়ে দিলে ওর কি দশা হবে সেটা কি আন্দাজ করতে পারছিস? ও মরে যাবে না? ওকে তো তুই এসব কথা বলে বলেই আধমরা বানিয়ে দিচ্ছিস। মেয়েটার মুখের দিকে একটাবার তাকিয়ে দেখতো কি হাল হয়েছে মেয়েটার?”
-” সব ঠিক হয়ে যাবে মুহিব। ওর অবস্থা নীলার মতো না। ওর মাথার উপর বাপ-ভাইয়ের ছায়া আছে। আর্থিক অবস্থা ভালো আছে। নীলার চেয়ে দেখতে বেশি সুন্দর। ওর নামে কোনো scandal নেই। বিয়ে হয়েছে এখনও ছয়মাসও হয়নি। তাছাড়া এটা তো সবাই জানবে আমার কারনে ডিভোর্স হচ্ছে। ওর কোনো দোষই থাকবে না। ওকে ওর বাবা- ভাই আবার বিয়ে দিতে পারবে ছয় মাসের মধ্যেই। এমনকি ভালো পরিবারে বিয়ে দিতে পারবে। হতে পারে ছেলেটা ডিভোর্সি হতে পারে। কিন্তু অনেক ডিভোর্সি ছেলেরাও তো ভালো হয় তাই না? তুই দেখিস শিমুলের অনেক ভালো জায়গায় বিয়ে হবে।”
-” কিসব বলে যাচ্ছিস তুই? এগুলো কি যুক্তি………”
মুহিবের কথা শেষ হওয়ার আগেই শিমুল অনিমের ডানগালে সজোরে চড় মেরে বসলো। শিমুলের এমন আচরনে অনিম মুহিব দুজনই অবাক। ঘরের ভেতর এই মূহূর্তে বেশ থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। কয়েক সেকেন্ড পর শিমুল খুব ঠান্ডা গলায় বললো,
-” নিজেকে আর কন্ট্রোল করতে পারছিলাম না। সেই কখন থেকে তোমার তামাশা দেখেই যাচ্ছি, শুনেই যাচ্ছি। পেয়েছো টা কি তুমি আমাকে? এতবছর গান শোনালে তুমি আমাকে ভালোবাসো, আমার জন্য তুমি মরে যেতেও প্রস্তুত। আর এখন শোনাচ্ছো ভালোবাসো না। তাহলে বিয়ে করেছো কেনো? বিয়ে যেহেতু করেছো সংসারটা আমার সাথেই করতে হবে। আমি তোমাকে ডিভোর্স দিবো না। শুনতে পারছো কি বলছি? ডি-ভো-র্স দিবো-না। তুমি কি আমাকে তোমার মতো ভাবো ? তুমি বউ ফেলে অন্য নারীতে আসক্ত হতে পারো কিন্তু আমি তোমাকে ছেড়ে অন্য লোকের সাথে সংসার বাধবো না। তোমাকে বিয়ে করেছি তোমার সাথেই সংসার করবো। আমার বাপ ভাই আমাকে অনেক যত্নে বড় করেছে। আমার জীবনটা এত সস্তা না যে তুমি আমাকে নিয়ে যা খুশি করবে। যা বলার বলেছো। আমি আর কখনো এই নীলার নাম শুনতে চাই না।”
-” তুমি কি আমার সাথে জোর করে সংসার করতে চাচ্ছো?”
-” হ্যাঁ। জোর করেই করবো।”
-” জোর করে কোনো কিছুর পরিনামই যে ভালো হয়না সেটা কি তুমি জানো?”
-” তোমার সাথে ডিভোর্স হলেও আমি ভালো থাকবো না, না হলেও আমি ভালো থাকবো না। আমি এই দুটো থেকে যে সিদ্ধান্তই নেই না কেনো কোনোটাতেই আমার সুখ মিলবে না। এরচেয়ে ভালো তোমার সাথে থেকেই অসুখী হই।”
-” আমি নীলাকে ভালোবাসি, তোমাকে না। তুমি আমার উপর এভাবে জোর করতে পারোনা। তুমি শুধু নিজের কথাই ভাবছো। আমার দিকটা দেখছো না।”
-” তোমার কোনদিক দেখতে বলছো? তোমার সুখ? তুমি আমার কথা ভেবেছো যে আমি তোমার দিকটা দেখবো?”
-” শিমুল, I want divorce। বুঝতে পারছো না কেনো এভাবে সংসার করা যায় না। এই মুহিব বুঝাচ্ছিস না কেনো ওকে?”
-” কি বুঝাবো? শিমুল তো খারাপ কিছু বলেনি। এতবছর ওর সাথে থাকার পর, বিয়ে শাদি করার পর তুই এমন অন্যায় আবদার ধরবি এটা তো মেনে নেয়ার মতো না। শিমুলের কথায় যৌক্তিকতা আছে। তুই যেসব বলছিস সেগুলো হচ্ছে অযৌক্তিক। আমি শিমুলের সাপোর্টেই কথা বলবো। শুধু আমি কেনো যে এই কথা শুনবে সেই ই শিমুলকেই সাপোর্ট করবে। ভেবে দেখতো অনিম, তুই শিমুলকে ডিভোর্স দেয়ার পর সমাজের মানুষ যখন জানবে তুই নীলার জন্য ওকে ছেড়েছিস তখন মানুষ তোকে কোন নজরে দেখবে? সমাজে মুখ দেখাতে পারবি তো? মানুষ তোকে এখন যতটা সম্মান করে তখন এর চেয়ে আরও বেশি ঘৃনা করবে। অন্য একটা মেয়ের জন্য মান-সম্মান, শিমুল, এত সুখের সাজানো সংসার সব শেষ হয়ে যাবে।”
-” যাক সব শেষ হয়। ওসবের ধার এখন আর আমি ধারি না। নীলাকে বিয়ে করে দূরে চলে যাবো আমি। দেশের বাইরে চলে যাবো। কেউ আমাদের পাবে না। নীলার ভালোবাসাই আমার জন্য যথেষ্ট। অন্য কাউকে আমার প্রয়োজন নেই।”
-” এতবছর তো শুনে এসেছি শুধু আমার ভালোবাসা পেলেই তোমার চলবে। অন্য কারো ভালোবাসা তোমার লাগবে না। আর এখন বলছো নীলার কথা। এক মুখে কয় ধরনের কথা বলো অনিম?”
-” এতবছর নীলার ভালোবাসাটা তোমার কাছে খুঁজেই গেছি। কিন্তু পাইনি। ওর মত করে তুমি আমাকে ভালোবাসতে পারোনি।”
-” নীলার মতো করে ভালোবাসবো কেনো? আমি কি নীলা? আমি নীলা না। আমি শিমুল। আমি তোমাকে আমার মতো করে ভালোবাসবো।”
-” তোমার ভালোবাসার ধরন আমার মনমতো না। নীলা বুঝে আমি কেমন ভালোবাসা চাই।”
-” এতদিন…….”
-” আর কথা বাড়িও না তো। আমি নীলার সাথে ঘর বাঁধবো, ওকেই বিয়ে করবো। আমি ডিভোর্স চাই আর এটাই ফাইনাল।”
কথাটা বলে অনিম বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো। এতক্ষন শিমুলের যে তেজ চোখে মুখে ফুটে ছিলো অনিম ঘর থেকে বের হওয়া মাত্রই তা ওর চোখ মুখ থেকে সরে গেলো। বিষাদের ছায়া এখন ওর চোখে মুখে ফুটে উঠেছে। সোফায় বসেই নিজের শরীরটা এলিয়ে দিলো সে। মুহিব দেখতে পেলো শিমুলের দুগাল বেয়ে পানি ঝড়ছে। এতক্ষনে শিমুল কাঁদছে। আস্তে আস্তে ওর কান্নার আওয়াজটা বাড়ছে। মুহিবের ভেতরটা দুমড়ে মুচরে যাচ্ছে। কিন্তু মুহিব ওকে আটকাবে না। মুহিব জানে এই মূহূর্তে শিমুলের মনে কোন আগুন লেগেছে। সেই আগুনে মন পোঁড়ার যন্ত্রনাটা চোখের পানি হয়ে ঝড়ে পড়লে তবেই কমবে। ভেতর পোঁড়ার যন্ত্রনা যে কি সেটা মুহিবের চেয়ে ভালো আর কে জানে? কিন্তু এভাবে কাঁদতে দেখেও সহ্য হচ্ছে না মুহিবের। শিমুলের মাথার উপর আলতো করে হাত রাখলো মুহিব। শিমুল তখনও চিৎকার করে কেঁদেই যাচ্ছে। কাঁদতে কাঁদতেই মুহিবকে বললো,
-” সব শেষ হয়ে যাচ্ছে মুহিব ভাই। অনিম, আমার সংসার সব…..”
-” কিচ্ছু শেষ হবে না শিমুল। আল্লাহর উপর ভরসা রাখো। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
-” অনিম এসব কি বলে গেলো? এতবছর পর ও আমাকে বলছে আমার ভালোবাসা নাকি ওর মনমতো না। আমার ভালোবাসায় কোথায় ঘাটতি রেখেছি আমি?”
-” কোথাও রাখোনি শিমুল। অতি সুখে মানুষ পাগল হয়ে যায়। অনিমও তাই ই হয়েছে। নীলার কাছ থেকে ফের ধাক্কা খেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।”
-” আমার সংসার ঘুনে ধরেছে মুহিব ভাই। নীলা নামের ঘুন। সংসারটাকে শেষ না করে এই ঘুনপোকা পিছু ছাড়বে না।”
-” বললেই হলো? এত সহজ নাকি সবকিছু?”
-” আমার এতবছরের স্বপ্ন, ভালোবাসা সব কিছু অনিম মূহূর্তে গুড়িয়ে দিচ্ছে। আমাকে দিয়ে নীলার ঘাটতি পূরন করেছে। আমাকে কি ওর মানুষ বলে মনে হচ্ছে না? এসব কিভাবে করতে পারে ও আমার সাথে? এগুলো কি বললো ও আজকে আমাকে?”
-” শিমুল তুমি এখনই অস্থির হয়ে পড়লে এতবড় যুদ্ধটা সামাল দিবে কিভাবে?”
-” সামলানো সম্ভব না। যুদ্ধটা তো করতে হবে অনিমের বিপক্ষে। নিজেকে কিভাবে সামলাবো বলেন তো। যাকে এত ভালোবাসি তার সাথেই যুদ্ধ করতে হবে।”
-” কিচ্ছু করার নেই শিমুল। নিজের ভালোবাসাকে নিজের কাছে ধরে রাখতে হলে কখনো কখনো সেই ভালোবাসার মানুষের সাথেই যুদ্ধ করতে হয়। অনিম তোমার হাজবেন্ড। ওর উপর পুরোপুরি হক্ব আছে তোমার।”
মুহিব শিমুলকে শান্ত করার আপ্রান চেষ্টা করছে। কোনোভাবেই ওকে শান্ত করতে পারছে না। রাত দশটা বেজে গেছে। শিমুল এখনো কেঁদেই চলছে। মাথার দুপাশের রগ ফুলে উঠেছে তার। মুহিব সেই কখন থেকে পানির গ্লাস হাতে নিয়ে বসে আছে শিমুলকে খাওয়ানোর জন্য। কিন্তু খাওয়াতে পারেনি। অনিমটাও বাসায় এখনো আসছেনা। এদিকে রাত বাড়ছে। শিমুলের সাথে এই সময়ে খালি ঘরে থাকাটা খুবই দৃষ্টিকটু দেখায়। এই মূহূর্তে সে শিমুলকে একা রেখে কোথাও যেতেও পারছে না। অনিমকে কয়েক দফা ফোন দেয়া হয়েছে। কিন্তু সে ফোন রিসিভ করছে না।”
(চলবে)