#দহন
#পর্ব_১৯
সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা বাজে। বসার রুমটাতে সবাই মিটিং করছে। মূল টপিক: শিমুল যাবে বিদেশ। শিমুলের দুই ভাইও অফিস থেকে চলে এসেছে আধাঘন্টা হয়েছে। নদী আর দুই ভাই প্রায় একসাথেই ঘরে এসে ঢুকেছে। আফসানা আর বৃষ্টি বিছিয়ে বিছিয়ে সব কথা বলেছে তাদের। রফিক সাহেব চুপচাপ সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছে। সমস্ত কথা শোনার পর বাকি দুইভাই আর দুলাভাইয়ের মুখে একটাই কথা , “ও বললেই হলো নাকি? কোথ্থাও যাবেনা ও।” নদী চুপ করে এতক্ষন সব কথা শুনেছে। এখন সে আফসানাকে জিজ্ঞেস করলো,
-” শিমুল কোন দেশে যেতে চাচ্ছে কিছু জানিস?”
-” না আপা। জিজ্ঞেস করিনি।”
-” জিজ্ঞেস করার দরকার ছিলো না?”
-” একদমই না। ওকে বিদেশ যেতেই দিবোনা যেখানে সেখানে অত সত কথা জিজ্ঞেস করবো কেনো?”
-” যাহ্, শিমুলকে ডেকে আন। ও কি চাচ্ছে ওর মুখ থেকেই শুনবো।”
শিমুল এতক্ষন পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে সব কথা শুনছিলো। নদীর ওকে ডেকে পাঠানোর কথা শুনতেই নিজে থেকেই রুম থেকে বেরিয়ে এসেছে।
-” কি রে তুই নাকি বিদেশ যেতে চাচ্ছিস?”
-” হ্যাঁ।”
-” কেনো?”
-” এখানে আমার শান্তি লাগেনা আপা। এখানে থাকলে আজীবনেও আমি অনিমকে ভুলতে পারবো না।”
-” ঠিকাছে ভুলতে পারবিনা। তাই বলে দেশ ছেড়ে যাওয়ার কি হলো। অন্য কোথাও তো বাসা চেন্জ করে চলে গেলেই হয়।”
-” আপা ঠিকই বলছে। তোর যেহেতু সমস্যা হচ্ছে এখানে তাহলে আমি আর মুকুল কাল থেকেই দূরে কোথাও বাসা খুঁজবো। এখানে আর আমরা থাকবো না।”
-” না, আমি থাকবোনা এই দেশে। তোরা বুঝতে পারছিস না আমার কথাটা। আমি একটু নিজের মতো করে বাঁচতে চাই।”
-” আমরা কি তোকে বাঁধা দিয়েছি?”
-” বাঁধা দিবি কেনো? আমি আমার নিজের ইচ্ছাতেই কথাটা বলছি। সেখানে যেয়ে পড়ালেখাটা কমপ্লিট করতে চাচ্ছি আমি।”
-” সেখানে গেলে তো তোর আবার নতুন করে ভর্তি হতে হবে। অলরেডি এখানে তুই অনার্স সেকেন্ড ইয়ার ফাইনাল দিয়ে ফেলেছিস। দুইবছর ওয়েস্ট হয়ে যাবে তোর।”
-” ওয়েস্ট হলে হবে। যেখানে আমাকে অন্য কেউ এসে পুরো তছনছ করে দিলো, সেখানে এই দুইবছর সময় ওয়েস্ট হলে বিশেষ কোনো ক্ষতি হবে না।”
-” তাহলে এককাজ কর। চট্টগ্রাম বা রাজশাহী ভার্সিটিতে নতুন করে ভর্তি হ। দেশের ভিতরেই থাকবি। তবুও আমরা একটু নিশ্চিন্ত থাকতে পারবো। আমাদের ইচ্ছা হলেই তোকে আমরা দেখে আসতে পারবো। বিদেশ গেলে তো হাজার ইচ্ছা হলেও তোকে দেখতে আসতে পারবো না।”
-” আপা তুই যা খুশি বলতে পারিস।আমি কোনো কথাই শুনবো না। আমি বিদেশ যাবোই। আমাকে এখানে কোনোভাবেই তোরা আটকে রাখতে পারবিনা। তোরা যদি রাজি না হোস তাহলে আমি নিজে নিজেই সব ব্যবস্থা করে চলে যাবো। আমার গহনাগুলো বেঁচে আমি চলে যাবো।”
-” শিমুল, তুমি আমাদের ছেড়ে থাকতে পারবা? কষ্ট হবে না তোমার?”
-” দুলাভাই, আমার অনুভুতি মরে গেছে।”
-” তুমি অনিমের জন্য আমাদের কেনো ছেড়ে চলে যাচ্ছো বলো তো? আমরা কি দোষ করেছি?”
-” আপনারা কোনো দোষ করেননি। আপনারা তো সবসময় আমার ভালো দিকটাই চিন্তা করেছেন। দুলাভাই আমি নিজের মেরুদন্ড সোজা করে বাঁচতে চাই। প্লিজ আমার দিকটা একটু বুঝার চেষ্টা করুন।”
-” কোন দেশে যেতে চাচ্ছিস তুই?”
-” ইংল্যান্ড যাবো।”
-” কোথায় ভর্তি হবি?”
-“Queen merry ভার্সিটিতে। হোয়াটচ্যাপেল এড়িয়াতে বাসা নিবো। ওটা বাঙালি এড়িয়া। সেখান থেকে ভার্সিটিও কাছে।”
-” ওখানে তো বড়খালা থাকে। তুই কি সেখানে খালার সাথে থাকতে চাচ্ছিস।”
-” না, আমি একা থাকবো। অন্য কোথাও বাসা ভাড়া নিয়ে থাকবো।”
-” খালার ওখানে থাকলে সমস্যা কি?”
-” আমি একা বাঁচতে চাই। নিজেকে নিজের মতো করে সাজাতে চাচ্ছি।”
-” খরচ কেমন পড়বে কিছু খবর নিয়েছিস?”
-” সেসব তোদের ভাবতে হবে না। আমি ওখানে জব করবো। নিজের খরচ নিজেই চালাবো।”
-” বাহ্, একাই সব সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছিস দেখা যায়। আমাদের কাছ থেকে টাকা পয়সা নিবি না, খালার সাথেও থাকবি না। একাই থাকবি। তুই কি চিরতরে আমাদের ছেড়ে চলে যেতে চাচ্ছিস?”
-” আমি কি সেটা বলেছি নাকি? আমি গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করেই দেশে চলে আসবো।”
-” তাহলে সবকিছু এমন একাই করতে চাচ্ছিস কেনো?”
-” ঐ যে বললাম, মেরুদন্ড সোজা করে বাঁচতে চাই।”
-” এটাই কি তোর ফাইনাল ডিসিশন?”
-” হ্যাঁ।”
শিমুলের কথা শুনে নদী বেশ ভালোই টের পাচ্ছে শিমুলের রোখ চেপে গেছে। হাজার বারণেও কোনো লাভ হবে না। ও যাবেই। ওকে পারমিশন দিতেই হবে। তবে না দিলেও সেসবের পরোয়া শিমুল করবে না। কিন্তু এভাবে চলে যাওয়াটা কি শিমুলের ঠিক হবে? ও নিজেকে সাজাতে চায় সেটা খুবই ভালো কথা। কিন্তু এভাবে এত দূরে? ও যদি চলে যায় তাহলে মুহিব? মানুষটাতো এত বছর স্যাক্রিফাইস করেই গেলো। আজও শিমুলকে ভালোবাসি বলে দাবী করলো না। ও কি তাহলে আর কখনোই দাবী করতে পারবে না? ভালোবাসাটা কি আজীবন একতরফাই থেকে যাবে? মুহিব তো শিমুলকে অনেক ভালোবাসে। এই ভালোবাসাটা পাওয়ার যোগ্য শিমুল। তাহলে কেনো সে এভাবে দূরে সরে যেয়ে নিজেকে এই ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করবে? শিমুলকে মুহিবের কথা বলতে হবে। হতেপারে এই মুহূর্তে বলা ঠিক হবেনা। কিন্তু এছাড়া কোনো উপায় নেই। দেখা যাক কথাটা বলে ওকে আটকানো যায় কিনা?
রাতের খাবার শেষে শিমুলের রুমের দিকে এগোচ্ছে নদী। জরুরি কথা বলার আছে শিমুলকে। সন্ধ্যা বেলাতেই সে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে মুহিবের কথাটা বুঝিয়ে বলতে হবে। তখনই সবার সামনে কথাটা বলা ভালো দেখাতো না। পরিস্থিতি অন্যরকম হয়ে যেতো তখন। তাই আজরাতটা এখানেই থাকবে নদী। তার হাজবেন্ড চলে গেছে ডিনার শেষ করেই।
নদী শিমুলের রুমে যেয়ে দেখে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে সে। দরজাটা আটকে দিয়ে শিমুলের বিছানায় এসে বসলো নদী। নদীর উপস্থিতি টের পেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো শিমুল।
-” দরজা আটকিয়েছো কেনো?”
-” তোর সাথে কথা আছে। আমার পাশে এসে বস।”
-” কি কথা?”
-” আমি জানি এই মূহূর্তে তোকে এসব কথা বলা খুবই অযৌক্তিক হবে। তবু না বলেও থাকতে পারছি না।”
-” কি কথা, বলে ফেলো।”
-” মুহিব তোকে ভালোবাসে। অনিমের সাথে তোর সম্পর্ক হওয়ার আগে থেকেই ও তোকে ভালোবাসে।”
শিমুল হতবাক হয়ে নদীর দিকে তাকিয়ে আছে। কি শুনলো সে এটা? ঠিক শুনছে তো? নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে শিমুলের। মুহিব ভাই? এটা কি করে সম্ভব।
-” হা করে তাকিয়ে থেকে লাভ নেই শিমুল। এটাই সত্যি।”
-” তোকে এসব কে বলেছে?”
-” কেউ বলেনি। আমি নিজে দেখেছি। আমাদের আগের বাসাটায় তুই যখন প্রতিদিন বিকালে ছাদে উঠতি তখন মুহিব তোর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো। কি যে টান খুঁজে পেতাম ওর চাহনীতে! কিন্তু কাউকে কথাটা জানাইনি। ভেবেছিলাম যার কথা সেই এসে বলুক।”
-” মুহিব ভাই যদি আমাকে ভালোইবাসতো তাহলে অনিমের হাতে তুলে দিলো কেনো?”
-” সেটা মুহিবই ভালো জানে।”
-” আর তুমি এত আগে থেকে যেহেতু কথাগুলো জানতেই তাহলে আগে বলোনি কেনো? এখন এসে কেনো বলছো?”
-” তখন বলিনি কারন অলরেডি অনিমের সাথে তুই সম্পর্কে জড়িয়ে গিয়েছিস। আর এখন বলছি কারন ছেলেটা এতটা বছর ধরে তোকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসেই যাচ্ছে। কখনও কোনো দাবী করেনি। তোর কি মনে হয়না এমন একটা মানুষকে তোরআপন করে নেয়া উচিত?”
-” তুমি এই আবদারটা কিভাবে রাখলে আপা? তাও আমার এমন একটা সময়ে?”
-” জানি আবদারটা অযৌক্তিক। কিন্তু আমি মুহিবের দিকটাও ভাবছি। মানুষটা ফের কষ্ট পাবে তুই চলে গেলে। ভালোবাসি কথাটা সে মুখ পর্যন্ত আনতে পারবে না।”
-” আর আমি? আমার দিকটা ভাবছিস না?”
-” হ্যা অবশ্যই ভাবছি। তোরদিকটা ভাবছি বলেই মুহিবের কথাটা তোকে বললাম। ও তোকে সুখে রাখবে শিমুল। যে সুখ পাওয়ার তুই যোগ্য সেই সুখ তুই পাবি মুহিবের কাছে।”
-” আঘাতের ক্ষত এখনও শুকায়নি অথচ তুমি চলে এসেছো সেই ক্ষত স্থানে অন্য কাউকে বসাতে?”
-“আমি তো তোকে বলছি না এখনই তুই মুহিবকে মনের মধ্যে জায়গা দিয়ে দে। তুই সময় নে। নিজেকে সময় দে। মনের সাথে বোঝাপড়া কর। দেখবি হিসাব মিলে যাবে। অনিম তোকে ফেলে চলে গেছে মূহর্তেই। তুই ওকে আঁকড়ে বাঁচবি কতদিন? যে তোকে ভালোবাসে তাকে কেনো কষ্ট দিবি শিমুল?”
-” আমি কষ্ট দিচ্ছি! আমি কি কখনো মুহিব ভাইকে বলেছি আমাকে আপনার ভালোবাসতে হবে ? অথবা আমি কি কখনো উনাকে ভালোবাসা দেখিয়ে সরে দাঁড়িয়েছি? আমি তো এমন কিছুই করিনি। আমার মনে কখনোই এসব ছিলো না। তাহলে আমাকে কেনো তুই দোষ দিচ্ছিস যে আমি উনাকে কষ্ট দিচ্ছি?”
-” আমি তোর দোষ দিচ্ছিনা শিমুল।”
-” মুহিব ভাই কি বলেছে তোকে এসব কথা বলতে?”
-” কখনোই না। মুহিব আমাকে কেনো এসব কথা বলতে বলবে?”
শিমুল কিছুক্ষন চুপ করে রইলো। এরপর কি যেনো ভেবে মুহিবকে ফোন করলো।
-” হ্যালো……”
-” মুহিব ভাই আপনি কি ফ্রি আছেন?”
-” হ্যা আছিতো।”
-” আমাদের বাসার ছাদে আসবেন একটু?”
-” এত রাতে? কোনো সমস্যা হয়েছে শিমুল?”
-” আপনি আসেন এরপর বলছি।”
শিমুল ফোন রাখার পরই নদী বললো,
-” তুই মুহিবকে আসতে বললি কেনো?”
-” কাজ আছে।”
-” কি কাজ?”
-” এটার আজ একটা ইতি টানবো।”
-” মানে? তুই কি এখন মুহিবের সাথে সিন ক্রিয়েট করবি?”
-” না। ছাদে চল আমার সাথে। তাহলেই তো বুঝবি।
বিশ মিনিট পর মুহিব শিমুলদের ছাদে এসেছে। শিমুল নদী আরও আগে থেকেই অপেক্ষা করছিলো মুহিবের জন্য। পুরো রাস্তা মুহিব চিন্তা করতে করতে এখানে এসেছে। এত রাতে কিজন্য ডাক পড়েছে ওর? ছাদে এসেই বেশ উৎকন্ঠা নিয়ে শিমুলকে জিজ্ঞেস করলো,
-” কি হয়েছে শিমুল?”
-” মুহিব ভাই সোজাসাপ্টা উত্তর দিবেন। আপনি কি আমাকে ভালোবাসেন?”
মুহিবের এই মূহূর্তে মনে হচ্ছে সে আকাশ থেকে নিচে পড়ে যাচ্ছে। নদীর দিকে তাকালো মুহিব। নদীর মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে সেই কথাটা বলেছে শিমুলকে। সে উত্তর কি দিবে খুঁজে পাচ্ছে না। এমন একটা পরিস্থিতিতে সে পড়ে যাবে এমনটা সে কখনোই কল্পনা করেনি।
-” কি হলো উত্তর দিচ্ছেন না কেনো?”
-” ইয়ে ….. মানে… হুম….. হ্যা বাসি।”
-” দেখেন মুহিব ভাই, ফের কাউকে মনের মধ্যে জায়গা দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। আপনি যদি এই আশায় থাকেন যে আমার জীবনে এখন কেউ নেই। সেই শূন্যস্থানটা আপনি পূরন করবেন তাহলে সেটা পুরোটাই আপনার ভুল ধারনা। আপনি মরিচিকার পিছনে ছুটছেন। আমার পক্ষে কখনোই সম্ভব না আপনাকে মনের মধ্যে জায়গা করে দেয়া। আমি এখন নিজের মতো বাঁচতে চাই। সম্পূর্ন নিজের মতো।”
(চলবে)