তোলপাড় পর্ব ২৩

তোলপাড়
ইসরাত জাহান তানজিলা
পর্ব-২৩
__________
অরূণী বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে তাকায় রুদ্রের দিকে। রুদ্র ওঁর হাত ধরেছে?পুলকিত হতে লাগলো অরূণীর শরীরের প্রতিটি রন্ধ্র।কেন রুদ্র হাত ধরেছে? রুদ্র কি তাহলে অরূণী’কে ভালোবাসে? এরকমই এক শঙ্কায় অরূণীর শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল রক্ত প্রবাহিত হতে লাগলো। এই অনুভূতির ব্যাখ্যা করার মতো শব্দের জোগান দিতে পারবে না অরূণী। উদ্ভ্রান্তের মতো তাকায় রুদ্রের দিকে।অরূণীর হৃদয় উপকূলে মহাপ্রলয় হয়ে যাচ্ছে। মোহাবিষ্ট হয়ে কম্পিত স্বরে, “হাত ধরেছেন কেন আপনি?”
অরূণীর গলায় তীব্র অবিশ্বাস্য। আবেগে অরূণীর গলা ধরে আসছে। শরীরের সমস্ত শিরা উপশিরায় তোলপাড়! রুদ্র অরণীর হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে। রুদ্রের মুখাবয়ব নিতান্তই স্বাভাবিক যেন এমন’টা প্রতিনিয়ত হয়ে আসছে।অরূণী ব্যাকুল চিত্তে প্রত্যুত্তরের অপেক্ষায় তাকিয়ে আছে। রুদ্র অরূণীর প্রশ্নের উত্তরে শুধু হাসলো।এই হাসির অর্থ খুঁজে পেলো না অরূণী। রুদ্রের আচরণ কেমন রহস্যজনক। অরূণীর ছটফটানি আরো বাড়ে। পুরোপুরি অধৈর্য হয়ে আবার জিজ্ঞেস করে, “হাসছেন কেন?”
রুদ্র সহজ গলায় বলল, “এমনি হাসছি,খাওয়া শেষ করো।সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে।”
অরূণীর দ্বিধান্বিত গলা, “আপনি আমায় ভালোবাসেন?”
– “রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে বলবো।”
রুদ্র অরূণীর হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রেখে খেতে লাগলো। ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে রেখেছে।অন্যদিকে অরূণী মুহূর্তে মুহূর্তে খুন হচ্ছে। ধারালো অনূভুতিতে ক্ষত বিক্ষত হচ্ছে।অরূণীর মনে হচ্ছে ও কেঁদে ফেলবে। ওঁর চোখ বেয়ে এক্ষুণি অবাধ্য জল গড়িয়ে পড়বে।কেন কাঁদবে তা অরূণী জানে না, শুধু বুঝতে পারছে ওঁর কান্না পাচ্ছে ভীষণ। রুদ্র অরূণীর দিকে তাকিয়ে তাড়া দিতে লাগলো, “খাচ্ছো না কেন তুমি?”
রুদ্রের মুখে তখনও হাসি।মনে হচ্ছে কোনো রোমাঞ্চকর অনুভূতি ব্যক্ত করছে রুদ্র।অরূণী উত্তর না দিয়ে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো রুদ্রের দিকে। রুদ্র পুনরায় বলল, “রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে বলবো।খাচ্ছো না কেন তুমি?”
অরূণী খাবার মুখে দেয়।দুই মিনিটে খেয়ে ফেলে সব। রেস্টুরেন্ট থেকে বের হওয়ার তাড়নায় দিশেহারা হয়ে যায় অরূণী। রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে কিছুদূর যাওয়ার পর রুদ্র অরূণীর হাত ছেড়ে দেয়।উত্তরের অপেক্ষায় অরূণীর উন্মত্ত হয়ে তাকায়। রুদ্র ব্যস্ত গলায় বলে, “অরূণী সন্ধ্যা হয়ে আসছে বাসায় চলে যাও।”
– “বললেন না তো হাত কেন ধরেছেন?”
রুদ্র প্রসঙ্গ’টা এড়িয়ে গিয়ে বলল, “আমার একটু জরুরি কাজ আছে যেতে হবে।”
অরূণী ধৈর্যচ্যুত হয়ে পড়ে, “আপনি আমার প্রশ্ন’টা এড়িয়ে যাচ্ছেন কেন?”
রুদ্র একটা রিক্সা ডাকে।অরূণীর কথা’টা শুনলো না বোধ হয়।রিক্সাওয়ালার সাথে কথা বলে অরূণীর দিকে তাকায়, “তুমি এই রিক্সায় যাও।আর তোমার প্রশ্নের উত্তর’টা পরে দিবো।”
অরূণী উত্তরের জন্য অপেক্ষামান হয়ে বার বার তাকাচ্ছে রুদ্রের দিকে। রুদ্র সম্পূর্ণ এড়িয়ে যায়।অরূণী আর কিছু জিজ্ঞেস করার আগে রুদ্র ট্যাক্সি ডেকে উঠে পড়ে।
__________
কিরণ রুদ্রের উপর প্রচণ্ড রেগে যায়।রাগে চোখ দুটো ধিকধিক করতে থাকে কিরণের। রোষপূর্ণ গলা কিরণের, “কারো এমন বিশুদ্ধ আবেগ অনুভূতি নিয়ে তুই মজা নিস? বিবেক বুদ্ধি লোপ পাচ্ছে তোর?”
কিরণ রাগে ক্রমশ অস্থির হয়ে যাচ্ছে।একটু থেমে আবার বলে, “অরূণীর হাত ধরে তোর লাবণ্যকে দেখাতে হবে?লাবন্যের মত একটা থার্ড ক্লাস মেয়ের জন্য তোর..।”
রাগে গলা ধরে আসছে কিরণের। রুদ্র শান্ত ভঙ্গিতে বলে, “রাস্তা ঘাটে চেঁচামেচি করিস না কিরণ।আমার একটু ভুল হয়েছে আমি বুঝতে পারছি।লাবণ্য’কে রেস্টুরেন্টে দেখে আমার চিন্তা চেতনা সব অকেজো হয়ে গিয়েছিলো।”
রুদ্র একটু থেমে কিছু সময় পর উদাস গলায় বলল, “ আর কেউ না জানলেও তুই তো জানিস আমি ও’কে কত ভালোবেসে ছিলাম। দীর্ঘ দিনের প্রেম! প্রায় আট মাস পর দেখা হয়েছে।বিশ্বাস কর আমি এলোমেলো হয়ে গিয়েছিলাম।আমি শুধু অরূণীর হাত ধরে হেসে কথা বলে লাবণ্য কে বুঝাতে চেয়েছি আমি ও’কে ছাড়া ভালো আছি।আসলে আমি ভালো নেই।”
রুদ্রের বিষাদ মাখা গলা শুনে কিরণের গলাও নরম হয়। ঠাণ্ডা মেজাজে কিরণ জিজ্ঞেস করে, “একটা মেয়ে’কে এতদিনেও ভুলতে পারিস নি?কেউ অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে হারিয়ে গেলে তাকে ভোলা যায় না। কিন্তু লাবণ্য তো প্রতারণা করেছে।”
– “একটা মেয়ে’কে ভোলা যায়। কিন্তু হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসা,আবেগ, অনুভূতি এসব ভোলা যায় না।একটা নিখাদ প্রেমের গল্প কখনো ভোলা যায় না।”
অনেকক্ষণ ধরে আর কেউ কিছু বলে না। রুদ্র নিরবতা কে বিলীন করে আবার বলে, “হৃদয় নিংড়িয়ে যে মানুষ টা’কে ভালোবাসা হয় সে মানুষটা কে কখনো ভোলা যায় না। মানুষ গুলো বুকের বাঁ পাশ’টা অবশ করে দিয়ে চলে যায়।তবুও জীবন চলে তার নিয়মে। কিন্তু কোনো এক অবসন্ন দুপুরে কিংবা বৃষ্টিমুখর সন্ধ্যায় বুকের ভিতর চিনচিনে ব্যথা হয়। জীবন চলার পথে কখনো অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে কোথায়ও দেখা হয়ে গেলে সব কিছু যেন এলোমেলো হয়ে যায়।”
রুদ্র থেমে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে।কিরণ হঠাৎ প্রশ্ন করে, “তাহলে তুই অরূণী’কে দেখা করতে বললি কেন? এখন আবার বলিস না যে তুই আগে থেকে জানতি লাবন্য ওই রেস্টুরেন্টে আসবে।”
রুদ্র এক ঝলক ম্লান হাসে, “আমি কীভাবে জানবো লাবন্য ওই রেস্টুরেন্টে আসবে?”
কিরণ প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে জোর গলায় বলে, “তো অরূণী’কে কেন দেখা করতে বললি?”
– “অরূণীর পাগলামি গুলোও আমায় জেঁকে ধরেছে। কেমন অদ্ভুত মেয়ে’টা! আচ্ছা দোস্ত কখনো শুনেছিস ভালোলাগার অনুভূতিতে কারো গায়ে জ্বর আসে?”
রুদ্র নিজের করা প্রশ্নের জবাব দিয়ে নিজেই বলে, “অরূণীর জ্বর আসে। অদ্ভুত না?জ্বরের ঘোরে অরূণীর প্রলাপ গুলো সেদিন রাতে আমায় অস্থির করে তুলেছিলো।সেই মুহূর্তে আমি অকারণেই বলে ফেলেছিলাম দেখা করার কথা। কেন বলেছি সে প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে নেই। কিন্তু ওঁর হাত ধরবো কিংবা ওঁর সাথে ওভাবে কথা বলবো এমনটাও করতাম না যদি লাবণ্যের সাথে দেখা না হতো।”
কিরণের মেজাজ আবার উত্তপ্ত হচ্ছে। রুদ্র বলল, “চল বাসায় চল।”
– “রুদ্র কিছু কিছু মানুষ থাকে অদ্ভুত রকমের। যাদের আবেগ, অনুভূতি গুলো বাড়াবাড়ি রকমের। স্বচ্ছ কাঁচের মত আবেগ, অনুভূতি।অরূণীও তেমন। অরূণীর বিষয় গুলো প্রথম প্রথম একদম কৌতুকের মত হাস্যকর ভাবা যায়। কিন্তু এখন বলবো মেয়েটা আসলেই তোকে ভালোবাসে।কেমন অন্য রকম একটা মেয়ে!ভালো না বাসিস কিন্তু ওঁর আবেগ অনুভূতি গুলো নিয়ে এমন’টা কেন করছিস?কেন হাত ধরেছিস ওঁর?কি উত্তর দিবি তুই? বলবি যে তোর প্রাক্তন’কে দেখাতে হাত ধরেছিস।প্লীজ অন্তত এই উত্তর টা দিস না ও’কে।তোর আর আমার কাছে এসব বিষয় একদমই কষ্ট পাওয়ার মত না। কিন্তু অরূণী অনেক কষ্ট পাবে।”
রুদ্র চিন্তায় পড়লো। রুদ্রের মুখাবয়ব অন্তত তাই বলে।এই প্রসঙ্গে আর কিছু না বলে উন্মনা হয়ে বলল, “রাত হয়েছে অনেক চল।”
রুদ্রের এই নির্লিপ্ত ভাব দেখে কিরণও বিরক্ত হয়। কথা বাড়ায় না। রুদ্র বাসায় গিয়ে সবে ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হলো। তখনই ফোন’টা বেজে ওঠে। অরূণীর ফোন দিয়েছে ভেবে রুদ্র একটু দ্বিধান্বিত হয়।‌ ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখে অপরিচিত ফোন নম্বর। রুদ্র মাথা কাত করে ফোন’টা কাঁধের উপর আটকে রাখার চেষ্টা করে খাটের ওপর রাখা বই খাতা গুলো টেবিলের দিকে নিতে নিতে বলে, “কে বলছেন?”
– “লাবণ্য বলছি।”
রুদ্র কয়েক মুহূর্তের জন্য থমকে যায়। নিজেকে দ্রুত সামলে নেয়। বই-খাতা গুলো টেবিলের উপর রেখে ডান হাতে ফোন’টা ধরে কানের কাছে নেয়। অনেকক্ষণ নিঃশব্দে কেটে গেলে রুদ্র স্বাভাবিক গলায় দ্রুত প্রশ্ন করে, “ও লাবণ্য।কী খবর বলো?”
লাবন্য চুপই থাকে। কিছুক্ষণ কেটে গেলে বলে, “রুদ্র,কেমন আছো?”
– “এই তো ভালো।তুমি?”
– “রেস্টুরেন্টের মেয়ে’টা কে ছিলো?”
রুদ্র বারান্দায় গিয়ে চেয়ারে বসে।কয়েক মুহূর্ত চোখ দু’টো বুঁজে থাকে।ফোন’টা কানের কাছেই। ওপাশ থেকে বলে, “কী হলো?”
রুদ্র হো হো করে হেসে ওঠে।বিষদময় সে হাসি, “লাবণ্য তুমি আমায় কেন ছেড়ে গিয়েছো সে প্রশ্ন’টা আমি তো আজও করি নি। তুমি কেন এতদিন পর ফোন দিয়ে এই ধরণের প্রশ্ন করছো?”
– “হাসছো যে?”
রুদ্র হাসির কারণ’টা বলে না, “তুমি ভেবো না যে আমি জানি না তুমি কেন ছেড়ে গিয়েছো।”
– “রুদ্র ওই মেয়ে’টা কে?”
– “লাবণ্য ফোন’টা রাখো।নয়ত আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না।তোমার মুক্তি দরকার ছিলো দিয়েছি। তোমার কোনো চাওয়া অপূর্ণ রাখি নি।”
লাবণ্য ফোন রাখে না। রুদ্র নিজেই লাইন কেটে দেয়।লাবন্য আবার ফোন দেয়। কয়েক বার ফোন বাজার পর রুদ্র ফোন রিসিভ করে আবার। উগ্র রোষে চোখ দুটো বন্ধ করে বলে, “ হাসিবের সাথে তোমার অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি কী আমি দেখি নি? সোহানের সাথে ভাইরাল হওয়া ভিডিও আমি দেখি নি? কখনো প্রশ্ন করেছি তোমায়? তুমি সম্পর্কের ইতি টানতে চেয়েছো আমি টেনে দিয়েছি। চার-পাঁচ বছরের সম্পর্কে আমি তো তোমার ঠোঁট দুটোও ছুঁয়ে দেখি নি। আমি তো সুন্দর একটা সম্পর্ক চেয়েছিলাম।”
রুদ্র সর্বশক্তি দিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে আবার বলে, “ফোন কেন দিয়েছো তুমি আমায়?”
হাতের ফোন’টা ফ্লোরে ছুঁড়ে মেরে চূর্ণ বিচূর্ণ করে ফেলে রুদ্র। কিরণ ছুটে আসে। হতভম্ব হয়ে বলে, “কী হলো ফোন ভাঙলি কেন?”
রুদ্র উত্তর দেয় না।কিরণ আবার প্রশ্ন করে, “কে ফোন দিয়েছে?লাবণ্য?”
রুদ্র অস্থির ভঙ্গিতে বলে, “কিরণ যা এখান থেকে। প্লিজ কোনো প্রশ্ন করিস না।”
রুদ্রের মেজাজ বুঝতে পেরে কিরণ চলে যায়। রুদ্র চোখ দুটো বন্ধ করে বসে থাকে। তিক্ত লাগছে সবকিছু।বিষাদময় লাগছে পৃথিবী’টা।
(চলবে)
ফোনেতোলপাড়
ইসরাত জাহান তানজিলা
পর্ব-২৩
__________
অরূণী বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে তাকায় রুদ্রের দিকে। রুদ্র ওঁর হাত ধরেছে?পুলকিত হতে লাগলো অরূণীর শরীরের প্রতিটি রন্ধ্র।কেন রুদ্র হাত ধরেছে? রুদ্র কি তাহলে অরূণী’কে ভালোবাসে? এরকমই এক শঙ্কায় অরূণীর শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল রক্ত প্রবাহিত হতে লাগলো। এই অনুভূতির ব্যাখ্যা করার মতো শব্দের জোগান দিতে পারবে না অরূণী। উদ্ভ্রান্তের মতো তাকায় রুদ্রের দিকে।অরূণীর হৃদয় উপকূলে মহাপ্রলয় হয়ে যাচ্ছে। মোহাবিষ্ট হয়ে কম্পিত স্বরে, “হাত ধরেছেন কেন আপনি?”
অরূণীর গলায় তীব্র অবিশ্বাস্য। আবেগে অরূণীর গলা ধরে আসছে। শরীরের সমস্ত শিরা উপশিরায় তোলপাড়! রুদ্র অরণীর হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে। রুদ্রের মুখাবয়ব নিতান্তই স্বাভাবিক যেন এমন’টা প্রতিনিয়ত হয়ে আসছে।অরূণী ব্যাকুল চিত্তে প্রত্যুত্তরের অপেক্ষায় তাকিয়ে আছে। রুদ্র অরূণীর প্রশ্নের উত্তরে শুধু হাসলো।এই হাসির অর্থ খুঁজে পেলো না অরূণী। রুদ্রের আচরণ কেমন রহস্যজনক। অরূণীর ছটফটানি আরো বাড়ে। পুরোপুরি অধৈর্য হয়ে আবার জিজ্ঞেস করে, “হাসছেন কেন?”
রুদ্র সহজ গলায় বলল, “এমনি হাসছি,খাওয়া শেষ করো।সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে।”
অরূণীর দ্বিধান্বিত গলা, “আপনি আমায় ভালোবাসেন?”
– “রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে বলবো।”
রুদ্র অরূণীর হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রেখে খেতে লাগলো। ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে রেখেছে।অন্যদিকে অরূণী মুহূর্তে মুহূর্তে খুন হচ্ছে। ধারালো অনূভুতিতে ক্ষত বিক্ষত হচ্ছে।অরূণীর মনে হচ্ছে ও কেঁদে ফেলবে। ওঁর চোখ বেয়ে এক্ষুণি অবাধ্য জল গড়িয়ে পড়বে।কেন কাঁদবে তা অরূণী জানে না, শুধু বুঝতে পারছে ওঁর কান্না পাচ্ছে ভীষণ। রুদ্র অরূণীর দিকে তাকিয়ে তাড়া দিতে লাগলো, “খাচ্ছো না কেন তুমি?”
রুদ্রের মুখে তখনও হাসি।মনে হচ্ছে কোনো রোমাঞ্চকর অনুভূতি ব্যক্ত করছে রুদ্র।অরূণী উত্তর না দিয়ে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো রুদ্রের দিকে। রুদ্র পুনরায় বলল, “রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে বলবো।খাচ্ছো না কেন তুমি?”
অরূণী খাবার মুখে দেয়।দুই মিনিটে খেয়ে ফেলে সব। রেস্টুরেন্ট থেকে বের হওয়ার তাড়নায় দিশেহারা হয়ে যায় অরূণী। রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে কিছুদূর যাওয়ার পর রুদ্র অরূণীর হাত ছেড়ে দেয়।উত্তরের অপেক্ষায় অরূণীর উন্মত্ত হয়ে তাকায়। রুদ্র ব্যস্ত গলায় বলে, “অরূণী সন্ধ্যা হয়ে আসছে বাসায় চলে যাও।”
– “বললেন না তো হাত কেন ধরেছেন?”
রুদ্র প্রসঙ্গ’টা এড়িয়ে গিয়ে বলল, “আমার একটু জরুরি কাজ আছে যেতে হবে।”
অরূণী ধৈর্যচ্যুত হয়ে পড়ে, “আপনি আমার প্রশ্ন’টা এড়িয়ে যাচ্ছেন কেন?”
রুদ্র একটা রিক্সা ডাকে।অরূণীর কথা’টা শুনলো না বোধ হয়।রিক্সাওয়ালার সাথে কথা বলে অরূণীর দিকে তাকায়, “তুমি এই রিক্সায় যাও।আর তোমার প্রশ্নের উত্তর’টা পরে দিবো।”
অরূণী উত্তরের জন্য অপেক্ষামান হয়ে বার বার তাকাচ্ছে রুদ্রের দিকে। রুদ্র সম্পূর্ণ এড়িয়ে যায়।অরূণী আর কিছু জিজ্ঞেস করার আগে রুদ্র ট্যাক্সি ডেকে উঠে পড়ে।
__________
কিরণ রুদ্রের উপর প্রচণ্ড রেগে যায়।রাগে চোখ দুটো ধিকধিক করতে থাকে কিরণের। রোষপূর্ণ গলা কিরণের, “কারো এমন বিশুদ্ধ আবেগ অনুভূতি নিয়ে তুই মজা নিস? বিবেক বুদ্ধি লোপ পাচ্ছে তোর?”
কিরণ রাগে ক্রমশ অস্থির হয়ে যাচ্ছে।একটু থেমে আবার বলে, “অরূণীর হাত ধরে তোর লাবণ্যকে দেখাতে হবে?লাবন্যের মত একটা থার্ড ক্লাস মেয়ের জন্য তোর..।”
রাগে গলা ধরে আসছে কিরণের। রুদ্র শান্ত ভঙ্গিতে বলে, “রাস্তা ঘাটে চেঁচামেচি করিস না কিরণ।আমার একটু ভুল হয়েছে আমি বুঝতে পারছি।লাবণ্য’কে রেস্টুরেন্টে দেখে আমার চিন্তা চেতনা সব অকেজো হয়ে গিয়েছিলো।”
রুদ্র একটু থেমে কিছু সময় পর উদাস গলায় বলল, “ আর কেউ না জানলেও তুই তো জানিস আমি ও’কে কত ভালোবেসে ছিলাম। দীর্ঘ দিনের প্রেম! প্রায় আট মাস পর দেখা হয়েছে।বিশ্বাস কর আমি এলোমেলো হয়ে গিয়েছিলাম।আমি শুধু অরূণীর হাত ধরে হেসে কথা বলে লাবণ্য কে বুঝাতে চেয়েছি আমি ও’কে ছাড়া ভালো আছি।আসলে আমি ভালো নেই।”
রুদ্রের বিষাদ মাখা গলা শুনে কিরণের গলাও নরম হয়। ঠাণ্ডা মেজাজে কিরণ জিজ্ঞেস করে, “একটা মেয়ে’কে এতদিনেও ভুলতে পারিস নি?কেউ অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে হারিয়ে গেলে তাকে ভোলা যায় না। কিন্তু লাবণ্য তো প্রতারণা করেছে।”
– “একটা মেয়ে’কে ভোলা যায়। কিন্তু হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসা,আবেগ, অনুভূতি এসব ভোলা যায় না।একটা নিখাদ প্রেমের গল্প কখনো ভোলা যায় না।”
অনেকক্ষণ ধরে আর কেউ কিছু বলে না। রুদ্র নিরবতা কে বিলীন করে আবার বলে, “হৃদয় নিংড়িয়ে যে মানুষ টা’কে ভালোবাসা হয় সে মানুষটা কে কখনো ভোলা যায় না। মানুষ গুলো বুকের বাঁ পাশ’টা অবশ করে দিয়ে চলে যায়।তবুও জীবন চলে তার নিয়মে। কিন্তু কোনো এক অবসন্ন দুপুরে কিংবা বৃষ্টিমুখর সন্ধ্যায় বুকের ভিতর চিনচিনে ব্যথা হয়। জীবন চলার পথে কখনো অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে কোথায়ও দেখা হয়ে গেলে সব কিছু যেন এলোমেলো হয়ে যায়।”
রুদ্র থেমে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে।কিরণ হঠাৎ প্রশ্ন করে, “তাহলে তুই অরূণী’কে দেখা করতে বললি কেন? এখন আবার বলিস না যে তুই আগে থেকে জানতি লাবন্য ওই রেস্টুরেন্টে আসবে।”
রুদ্র এক ঝলক ম্লান হাসে, “আমি কীভাবে জানবো লাবন্য ওই রেস্টুরেন্টে আসবে?”
কিরণ প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে জোর গলায় বলে, “তো অরূণী’কে কেন দেখা করতে বললি?”
– “অরূণীর পাগলামি গুলোও আমায় জেঁকে ধরেছে। কেমন অদ্ভুত মেয়ে’টা! আচ্ছা দোস্ত কখনো শুনেছিস ভালোলাগার অনুভূতিতে কারো গায়ে জ্বর আসে?”
রুদ্র নিজের করা প্রশ্নের জবাব দিয়ে নিজেই বলে, “অরূণীর জ্বর আসে। অদ্ভুত না?জ্বরের ঘোরে অরূণীর প্রলাপ গুলো সেদিন রাতে আমায় অস্থির করে তুলেছিলো।সেই মুহূর্তে আমি অকারণেই বলে ফেলেছিলাম দেখা করার কথা। কেন বলেছি সে প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে নেই। কিন্তু ওঁর হাত ধরবো কিংবা ওঁর সাথে ওভাবে কথা বলবো এমনটাও করতাম না যদি লাবণ্যের সাথে দেখা না হতো।”
কিরণের মেজাজ আবার উত্তপ্ত হচ্ছে। রুদ্র বলল, “চল বাসায় চল।”
– “রুদ্র কিছু কিছু মানুষ থাকে অদ্ভুত রকমের। যাদের আবেগ, অনুভূতি গুলো বাড়াবাড়ি রকমের। স্বচ্ছ কাঁচের মত আবেগ, অনুভূতি।অরূণীও তেমন। অরূণীর বিষয় গুলো প্রথম প্রথম একদম কৌতুকের মত হাস্যকর ভাবা যায়। কিন্তু এখন বলবো মেয়েটা আসলেই তোকে ভালোবাসে।কেমন অন্য রকম একটা মেয়ে!ভালো না বাসিস কিন্তু ওঁর আবেগ অনুভূতি গুলো নিয়ে এমন’টা কেন করছিস?কেন হাত ধরেছিস ওঁর?কি উত্তর দিবি তুই? বলবি যে তোর প্রাক্তন’কে দেখাতে হাত ধরেছিস।প্লীজ অন্তত এই উত্তর টা দিস না ও’কে।তোর আর আমার কাছে এসব বিষয় একদমই কষ্ট পাওয়ার মত না। কিন্তু অরূণী অনেক কষ্ট পাবে।”
রুদ্র চিন্তায় পড়লো। রুদ্রের মুখাবয়ব অন্তত তাই বলে।এই প্রসঙ্গে আর কিছু না বলে উন্মনা হয়ে বলল, “রাত হয়েছে অনেক চল।”
রুদ্রের এই নির্লিপ্ত ভাব দেখে কিরণও বিরক্ত হয়। কথা বাড়ায় না। রুদ্র বাসায় গিয়ে সবে ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হলো। তখনই ফোন’টা বেজে ওঠে। অরূণীর ফোন দিয়েছে ভেবে রুদ্র একটু দ্বিধান্বিত হয়।‌ ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখে অপরিচিত ফোন নম্বর। রুদ্র মাথা কাত করে ফোন’টা কাঁধের উপর আটকে রাখার চেষ্টা করে খাটের ওপর রাখা বই খাতা গুলো টেবিলের দিকে নিতে নিতে বলে, “কে বলছেন?”
– “লাবণ্য বলছি।”
রুদ্র কয়েক মুহূর্তের জন্য থমকে যায়। নিজেকে দ্রুত সামলে নেয়। বই-খাতা গুলো টেবিলের উপর রেখে ডান হাতে ফোন’টা ধরে কানের কাছে নেয়। অনেকক্ষণ নিঃশব্দে কেটে গেলে রুদ্র স্বাভাবিক গলায় দ্রুত প্রশ্ন করে, “ও লাবণ্য।কী খবর বলো?”
লাবন্য চুপই থাকে। কিছুক্ষণ কেটে গেলে বলে, “রুদ্র,কেমন আছো?”
– “এই তো ভালো।তুমি?”
– “রেস্টুরেন্টের মেয়ে’টা কে ছিলো?”
রুদ্র বারান্দায় গিয়ে চেয়ারে বসে।কয়েক মুহূর্ত চোখ দু’টো বুঁজে থাকে।ফোন’টা কানের কাছেই। ওপাশ থেকে বলে, “কী হলো?”
রুদ্র হো হো করে হেসে ওঠে।বিষদময় সে হাসি, “লাবণ্য তুমি আমায় কেন ছেড়ে গিয়েছো সে প্রশ্ন’টা আমি তো আজও করি নি। তুমি কেন এতদিন পর ফোন দিয়ে এই ধরণের প্রশ্ন করছো?”
– “হাসছো যে?”
রুদ্র হাসির কারণ’টা বলে না, “তুমি ভেবো না যে আমি জানি না তুমি কেন ছেড়ে গিয়েছো।”
– “রুদ্র ওই মেয়ে’টা কে?”
– “লাবণ্য ফোন’টা রাখো।নয়ত আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না।তোমার মুক্তি দরকার ছিলো দিয়েছি। তোমার কোনো চাওয়া অপূর্ণ রাখি নি।”
লাবণ্য ফোন রাখে না। রুদ্র নিজেই লাইন কেটে দেয়।লাবন্য আবার ফোন দেয়। কয়েক বার ফোন বাজার পর রুদ্র ফোন রিসিভ করে আবার। উগ্র রোষে চোখ দুটো বন্ধ করে বলে, “ হাসিবের সাথে তোমার অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি কী আমি দেখি নি? সোহানের সাথে ভাইরাল হওয়া ভিডিও আমি দেখি নি? কখনো প্রশ্ন করেছি তোমায়? তুমি সম্পর্কের ইতি টানতে চেয়েছো আমি টেনে দিয়েছি। চার-পাঁচ বছরের সম্পর্কে আমি তো তোমার ঠোঁট দুটোও ছুঁয়ে দেখি নি। আমি তো সুন্দর একটা সম্পর্ক চেয়েছিলাম।”
রুদ্র সর্বশক্তি দিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে আবার বলে, “ফোন কেন দিয়েছো তুমি আমায়?”
হাতের ফোন’টা ফ্লোরে ছুঁড়ে মেরে চূর্ণ বিচূর্ণ করে ফেলে রুদ্র। কিরণ ছুটে আসে। হতভম্ব হয়ে বলে, “কী হলো ফোন ভাঙলি কেন?”
রুদ্র উত্তর দেয় না।কিরণ আবার প্রশ্ন করে, “কে ফোন দিয়েছে?লাবণ্য?”
রুদ্র অস্থির ভঙ্গিতে বলে, “কিরণ যা এখান থেকে। প্লিজ কোনো প্রশ্ন করিস না।”
রুদ্রের মেজাজ বুঝতে পেরে কিরণ চলে যায়। রুদ্র চোখ দুটো বন্ধ করে বসে থাকে। তিক্ত লাগছে সবকিছু।বিষাদময় লাগছে পৃথিবী’টা।
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here