পার্সেল ৩য় পর্ব
Misk Al Maruf
.
আমিতো নিশির মৃত্যুর পরই ওর সিম নষ্ট করে ফেলেছিলাম। তাহলে পার্সেলের প্রেরক স্থানে ওর নাম্বার আসলো কীভাবে? আমার মুখে কৌতুহলপরায়ণ ভঙ্গিমা দেখে নজরুল ভাই জিজ্ঞেস করলেন,
-কী ভাই কোনো সমস্যা হয়েছে নাকি?
তাঁর কথায় আমি তাঁর দিকে মুখ ফিরিয়ে বলে উঠলাম,
-ভাই এখানেতো আমার প্রথম স্ত্রীর নাম্বার দেওয়া কিন্তু আমিতো ওর সিম সেই কবেই ভেঙ্গে ফেলেছিলাম।
তিনিও আমার কথায় কিছুটা অবাক হলেন বটে। পরক্ষণেই বললেন,
-আচ্ছা ভাই নাম্বারটায় কল দিয়ে দেখেনতো কল ঢুকে কীনা?
তাঁর কথামতো আমি পকেট থেকে ফোনটা বের করেই নাম্বারটি ডায়াললিষ্টে উঠিয়েই কল দিলাম। কিন্তু সিম কোম্পানির সেই চিরচেনা বার্তা শুনে বেশ হতাশ হলাম অর্থাৎ নাম্বার বন্ধ। নজরুল ভাই বিষয়টি বুঝতে পেরে বললো,
-ভাই আপনাকে কনফিউশনে ফেলানোর জন্য কেউ হয়তো এরকম মজা করছে। আপনার এখন উচিৎ হবে আপাতত এসব চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলা। এইসব ফালতু রহস্য নিয়ে যত ঘাটাঘাটি করবেন ততোই রহস্য বাড়তে থাকবে। আচ্ছা কাগজদুটো দেখিতো।
সত্যি বলতে নজরুল ভাইয়ের কথায় আমি নিজের মনকে কোনোভাবেই সান্ত্বনা দিতে পারছিলাম না তবুও তাঁর কথামতো আজকের এবং গতকালের চিঠি দুটো এগিয়ে দিলাম। চিঠি দুটো তিনি উলটে পালটে দেখার সাথে সাথে চিঠির উপরে থাকা কাগজটিও বেশ পরখ করে নিলেন।
-ভাই এগুলা বাগেরহাট থেকে পাঠানো হয়নি বরং ঢাকার মধ্য থেকেই কেউ পাঠিয়েছে।
তাঁর কথায় সহসাই আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
-কী করে বুঝলেন?
তিনি চিঠির উপরে থাকা কাগজটি আমার চোখের সামনে ধরে বললেন,
-এই দেখেন কাগজের উপরে কী লেখা? এগ্রো ফুড এন্ড বেভারেজ লি., ঢাকা, বাংলাদেশ। তার মানে ভিতরের কাগজটি সাধারণ প্রিন্ট করা একটি কাগজ হলেও উপরের প্যাকেটটি কোনো সাধারণ কাগজ নয় বরং এসব প্যাকেট ঢাকার শহরেই পাওয়া যায়। আর বিভিন্ন লোকজন এসব কোম্পানির পরিত্যাক্ত কাগজ দিয়ে বিভিন্ন ধরণের খোলা প্যাকেট কিংবা চিঠির প্যাকেট বানায়। এখন আপনার মনে ঠিকই প্রশ্ন জাগছে যে আমি এসব জানলাম কীভাবে? মূলত বেশ কিছুদিন আগে আমি আমাদের এলাকার মসজিতে শুক্রবার মিষ্টির প্যাকেট বিতরণ করার জন্য খালি প্যাকেট সংগ্রহের জন্য গিয়েছিলাম। সচরচার মানুষ পাট কাগজের প্যাকেটে মিষ্টি দিলেও আমি তা তখন খুঁজে পাইনি তাই বাধ্য হয়েই এই টাইপের পরিত্যক্ত কাগজ দিয়ে বানানো প্যাকেটে মিষ্টি দিতে হয়েছিলো।
-হুম ভাই বুঝলাম যে এটা ঢাকার ভিতর থেকে পাঠিয়েছে তাহলে পার্সেলের উপরে থাকা প্রেরকের স্থানে বাগেরহাটের নাম দেওয়া কেনো?
-আরে ভাই পার্সেল প্রদানকারী কী আপনার মতো মাথামোটা নাকি? সে এসব উদ্ভট পার্সেল পাঠাচ্ছেই আপনাকে কনফিউশনে ফেলার জন্য। তাহলে জায়গার নামটাইবা আসল লিখবে কেন?
-তা তো বুঝলাম ভাই কিন্তু কুরিয়ার সার্ভিসেতো যেখান থেকে পার্সেল পাঠানো হয় সেখানের নামই উল্লেখ থাকে তাহলে এটা ব্যতিক্রম হওয়ার কারণ কী?
-হুম ভাই একটি বুদ্ধিমানের কথা বললেন। দাঁড়ান দেখছি বিষয়টা।
এই বলেই তিনি পুনরায় কুরিয়ারের দায়িত্বে থাকা ছেলেটির সামনে এগিয়ে যেয়েই বললেন,
-ভাই আপনাদের পার্সেলগুলো আদান প্রদানের দায়িত্ব কার একটু বলা যাবে?
-দুঃখিত স্যার! আপনার পার্সেলে যদি কোনো ত্রুটি থাকে তবে সেটা বলতে পারবেন। এখানে কারো ব্যক্তিগত বিষয় শেয়ার করা নিষেধ।
-ভাই আপনি একটু সাইডে আসেন কিছু কথা ছিলো।
ছেলেটি নজরুল ভাইয়ের কথামতো একটু সাইডে যেতেই তিনি চকচকে একটি নতুন ২০০টাকার নোট ছেলেটির পকেটে গুঁজে দিয়ে কী যেন বললেন। পরক্ষণেই ছেলেটির নিস্তেজ মুখখানা হাসিতে পরিপূর্ণ হয়ে উঠলো। অতঃপর ছেলেটিকে বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ কিছু বুঝিয়ে দিয়েই তৎক্ষনাৎ তিনি আমার সামনে চলে আসলেন। তাঁর এহেন কান্ডে আমি কিছুটা কৌতুহলী নয়নে তাকে জিজ্ঞেস করলাম,
-কী বললেন ভাই? আর কীসের টাকা দিলেন?
-বোকা মানুষের সাথে রহস্য রহস্য খেলা আর ছাগলকে ঘাস খাওয়ানো একই কথা। ভাই আপনে যদি এইভাবে পার্সেলগুলো সংগ্রহই করতে থাকেন তাহলে আসল চালবাজকে কখনোই খুঁজে পাবেন না। মনে রাখবেন কেউ যদি আপনাকে দ্বিধায় ফেলার জন্য এক পা এগোয় তাহলে আপনাকে তাঁর পিছনের দিকে না যেয়ে উল্টো দুই পা সামনে এগোতে হবে। আমার ধারণা পরপর দুদিন যেহেতু এই পার্সেল দুটি পাঠিয়েছে তবে কালকেও আবার পাঠাবে। আর কালকেই রহস্য উদঘাটন হবে যে পার্সেলগুলো কী সুদূর বাগেরহাঁট থেকে এসেছে নাকি ঢাকার মধ্য থেকেই কেউ পাঠিয়ে মজা নিচ্ছে? তবে একটি বিষয় আমি বুঝতে পারছিনা আর সেটা হলো পার্সেলে আপনার প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর কারণটাই কেন বারবার ইঙ্গিত করা হচ্ছে?
-হুম ভাই! একারণেইতো আমার রাতের ঘুম হারাম হচ্ছে।
-যাক এখন এতো চিন্তা না করে বাসায় যান। কালকেই সরাসরি মাঠে খেলা শুরু হবে।
নজরুল ভাইয়ের থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ির দিকে রওয়ানা দিলাম। সত্যি বলতে তিনি আমাকে নিয়ে মাঝেমধ্যে তাচ্ছিল্যমাখা কথা বললেও আমার তেমন খারাপ লাগেনা কারণ আমি কোনো কোনো সময় সহজ বিষয়গুলোও বুঝে উঠতে পারিনা। কিন্তু তিনি তাঁর সূক্ষ্ম চিন্তাভাবনা দিয়ে ঠিকই খুঁটিনাটি সবকিছু বের করে ফেলেন আর একারণেই তাকে আমার সব থেকে বেশি ভালো লাগে।
বাড়িতে আসতেই দেখি মিমির বাবা অর্থাৎ আমার শ্বশুর টাকা নিতে চলে এসেছেন। গতকাল মিমিকে যদিও বলেছিলাম শ্বশুরকে টাকা দেওয়া আর বাবাকে টাকা দেওয়া একই কথা তবে সত্যি বলতে আমি সেটা মন থেকে বলিনি। কারণ মিমির বাবাকে আমার পছন্দ না করার মূল উদ্দেশ্য বারবার টাকা চাওয়ার কারণটা নয় বরং তাঁদের বংশীয় একটি খারাপ কাজের জন্য। আমার বাবার থেকে শুনেছিলাম মিমির বাবারা এক কালে বড়সড় ডাকাত ছিলো এবং গ্রাম্য এলাকায় থাকা বড় বড় জমিদার বাড়িতে লুটতরাজ চালাতো। কিন্তু একটা সময় তাঁদের প্রভাবপ্রতিপত্তি কমে আসায় তাঁরা সাধারণ জীবনে ফিরে আসে। তবে এই কলঙ্ক তাঁদের পথ ছাড়েনি। তাঁরা ভালো পথে চলে আসার দরুন তখন সাধারণ মানুষ সুযোগের সদ্ব্যবহার করে সবাই এক হয়ে তাঁদের সকলকে গ্রামছাড়া করেছিলো। একটা সময় মিমির মা অর্থাৎ আমার খালার সাথে তাঁর প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কিন্তু তাঁদের এই কলঙ্কিত অতীতের কারণে গ্রামের কোনো পরিবারই তাঁদের নিকট মেয়ে দিতে রাজি হতো না এমনকি আমার নানাও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। যখন তাঁরা গ্রাম ছেড়ে চলে যায় তখন আর কোনো উপায় না পেয়ে মিমির আম্মুকে নিয়ে তিনি ভেগে গিয়েছিলেন। নিজের মেয়ের এহেন কর্মকান্ডের কারণে আমার নানা তাকে ত্যাজ্য করে দিলেও আমার মা তাঁর প্রাণপ্রিয় বোনের প্রতি ভালোবাসা কাঁটিয়ে উঠতে পারেননি। ফলস্বরূপ তিনি বোনকে নিজের আশেপাশে রাখার জন্য প্রথম থেকেই মিমির সাথে আমাকে বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। আমি ছোট থেকেই দেখে এসেছি মিমির বাবার আমাদের বাড়িতে বেশ আনাগোনা ছিলো। আমার বাবা তাকে পছন্দ করতেন না বলে কখনো টাকা চাওয়ার সাহস পাননি। পড়ালেখা শেষ করে যখন আমি সরকারী চাকুরী পাই তখন থেকে তাঁর আনাগোনাটা কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছিলো। কারণ তিনি জানতেন মা কে পটিয়ে যদি মিমিকে আমার হাতে তুলে দেওয়া যায় তবে তাঁর আর কোনো টাকার চিন্তা থাকবে না। কিন্তু মা পটে গেলেও বাবার অসম্মতিতে তখন তিনি আগাতে পারেননি কারণ আমার বাবা ঠিকই আঁচ করতে পেরেছিলেন তাঁর মূল উদ্দেশ্যটি। স্বাভাবিকভাবেই নিশিকে বিয়ে করার সময় তিনি এবং তাঁর পরিবার আমার বিয়েতে আসেননি। তবে সবচেয়ে অবাক করা একটি বিষয় হলো নিশিকে বিয়ে করার পরবর্তী তিনমাসে আমাদের বাড়িতে তিনি পা না দিলেও এরপর থেকে এতোটাই উৎফুল্ল আর হাসিখুশি ভাবে আমাদের বাড়িতে আসতেন যেটা আমি দেখেছিলাম লাষ্ট আমার সরকারী চাকুরী পাওয়ার পর।
এতো গেলো অতীতের কথা, আমি ঘরে ঢুকতেই মিমির বাবা আমার দিকে ভদ্রতার সহিত এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো,
-কেমন আছো বাবা?
আমি মুখে খানিকটা হাসি এনে ভালো থাকার সায় দিলেও মনে মনে ঠিকই বলছিলাম,
-আপনার মতো সুবিধাবাদী মানুষের অতীতের সেই অভ্যাস এখনো যায়নি। টাকা কী আমি এতো সহজেই দিয়ে দিবো?
এসব ভাবনা থেকে নিজেকে বাস্তবে ফিরিয়ে রান্নাঘরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মিমির দিকে তাকালাম। ওর চেহারায় বেশ একটা উৎফুল্লতা দেখতে পেলাম। সত্যি বলতে আমার শ্বশুর যতই খারাপ হোক না কেন মিমি আর আমার শ্যালক মিহাদের মন দুটো যে পানির ন্যায় সহজ সরল সেটা বলার অপেক্ষা রাখেনা। মিমি মেয়েটি অল্পতেই কোনোকিছুতে খুশি হলেও ওর ধৈর্য্য শক্তির প্রবণতা খুব বেশি। আমি যদি ওকে বকাঝকাও করি তবুও ও নিশ্চুপ শ্রোতার ন্যায় সবকিছু শুনে যাবে কিন্তু পাল্টা জবাব দিবেনা।
-মিমি! আংকেলের জন্য কী রান্না করেছো?
-জ্বী বাবার জন্য গরুর মাংস আর পোলাও রান্না করেছি।
-আচ্ছা।
এই বলেই আমি আমার বেডরুমে চলে আসলাম। আমার এখন উদ্দেশ্য মূলত মিমির বাবাকে বিভিন্ন উসীলায় ঘুরানো এবং তাঁর ধৈর্য্য শক্তি পরীক্ষা করা। এতো সহজেই যদি তাঁর হাতে একলাখ টাকা দিয়ে দেই তবে লোভ পেয়ে সে আবার টাকা চাইবে।
আপাতত এই চিন্তা বাদ দিয়ে আজকের পার্সেলের চিঠিটি হাতে নিলাম। তখন সেই নাম্বারের রহস্য মিলাতে মিলাতে চিঠির মধ্যে থাকা লেখাটিও দেখতে মনে ছিলোনা। তাই গতকাল এবং আজকের পার্সেলে থাকা চিঠি দুটো টেবিলের পাশাপাশি রেখে দুটোর মধ্যে যোগসূত্র জানার চেষ্টা করলাম। প্রথম চিঠিতে বোল্ড অক্ষরে লেখা,
“আপনার স্ত্রী আত্মহত্যা করেনি বরং তাঁকে খুন করা হয়েছে।”
আর দ্বিতীয় অর্থাৎ আজকের চিঠিতে খুব স্পষ্ট এবং মোটা অক্ষরে লেখা,
“যে খুন করেছে সে হয়তো আপনার আশেপাশেরই কেউ।”
দ্বিতীয় চিঠিটি পড়ে আমি বেশ চিন্তায় পরে গেলাম। আমার আশেপাশের কেউ মানে কে হতে পারে? আর এই চিঠিটাই বা দিচ্ছে কে? এইসব কিছুর রহস্যে যখন আমি বিভোর হয়ে যাচ্ছি তখনি মিমির ডাকে আমি হকচকিয়ে উঠলাম। চিঠি দুটো লুকিয়ে কিছুটা রাগান্বিত স্বরে জিজ্ঞেস করলাম,
-কী হয়েছে?
-না মানে বাবার টাকাটা…
-আসলে আজ ব্যাংক থেকে টাকাটা উঠাতে একদমই মনে ছিলোনা। কাল উঠিয়ে দিবোনে তাকে আজ বাসায় থাকতে বলো।
মিমিও বেশ কিছুটা খুশি হয়ে বললো,
-আচ্ছা ঠিক আছে বলছি।
.
পরদিন অফিসে বসে নজরুল ভাইয়ের সাথে পার্সেল বিষয়ে আলাপ করছি ঠিক তখনি আবার অচেনা নাম্বার থেকে আমার মোবাইলে কল আসলো। নজরুল ভাই বেশ উৎফুল্ল স্বরে আমাকে বলে উঠলেন,
-দেখেন ভাই আজকেও আবার পার্সেলের কথা বলে কীনা?
তাঁর কথামতো কলটি রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে এক অচেনা যুবক সেই চিরচেনা বাক্যসহ বলে উঠলো,
-স্যার, আপনার নামে একটি পার্সেল এসেছে। অনুগ্রহপূর্বক যাত্রাবাড়ী শাখা থেকে নিয়ে যাবেন।
গত দুদিন পার্সেলের কথা শুনে আমার তেমন কিছু অনুভূত না হলেও আজ কোনো এক অজানা কারণে আমার শরীরে উত্তেজনার পারদ শীর্ষে উঠে গেছে। নজরুল ভাই বেশ রহস্যময়ী হাসি দিয়ে বললেন,
-বলছিলাম না ভাই আজকেও আবার পার্সেল পাঠাবে? আর বাগেরহাঁট থেকে প্রত্যেকদিন পার্সেল পাঠানোও কিন্তু সম্ভব না এটা শুধু ঢাকার মধ্য থেকেই পাঠানো সম্ভব। বুজছেন?
-তাহলে কী আমরা অফিসের ছুটি শেষেই পার্সেল নিয়ে আসতে যাবো?
-শুধু পার্সেল নিয়ে আসতে না বরং কোন হারামজাদায় আপনার সাথে মজা নিচ্ছে সেটাও পারলে আজকেই বের করে ফেলবো।
সত্যি বলতে নজরুল ভাইয়ের এমন আগাম চিন্তাভাবনার কারণে আমি সত্যিই মাঝেমধ্যে অবাক হই। আমার মনে হয় উনি যদি এই চাকুরী না করে গোয়েন্দা হতেন তবে কোনো কেসের রহস্যই আর রহস্য থাকতো না।
অজস্র কৌতুহল আর উত্তেজনা নিয়ে অফিসের ছুটি শেষে কুরিয়ার অফিসে উপস্থিত হলাম। আমার নাম্বারটি মিলিয়েই পার্সেলটি হাতে নিতেই দেখি গত দুদিন যেমন একই মলাট করা চিঠি আমাদের পাঠানো হয়েছিলো আজকেও হুবুহু তাঁর অনুরূপ। নজরুল ভাই আমাকে দূরে সরিয়ে গতকাল যেই ছেলেটিকে ঘুষ দিয়েছিলো তাঁর সাথে একান্তে কী যেন বললেন। নজরুল ভাইয়ের সাথে কথা বলার অন্তর ছেলেটি কাকে যেন ডাক দিয়ে আমাদের কাছে নিয়ে আসলো। যেই ছেলেটিকে সে ডাক দিয়েছিলো তাঁর বয়সটা বেশি নয় তবে যতটুকু বুঝলাম যে সে পার্সেল আদানপ্রদানের কাজে নিয়োজিত। আমিও নজরুল ভাইয়ের কাছে যেতেই তিনি ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলেন,
-তুমি এই পার্সেলটি কই থেকে এনেছো?
-কই থেকে নিয়ে আসবো আবার? এখানে যেহেতু বাগেরহাঁট লেখা আছে তাই বাগেরহাঁট থেকেই এনেছি।
-মিথ্যা বলবা না। আমি জানি বাগেরহাঁট থেকে প্রতিদিন পার্সেল আসেনা কমপক্ষে এক দুইদিনের ব্যবধান থাকে। কিন্তু এরকমই পার্সেল আমাদের নিকট গত দুদিন থেকে আসতেছে।
নজরুল ভাইয়ের কথায় ছেলেটি বেশ বোকা বনে গেলো তবুও সে কোনোভাবেই স্বীকার পাচ্ছিলোনা। নজরুল ভাই বিষয়টি বুঝতে পেরে পকেট থেকে পাঁচশত টাকার একটি নোট ছেলেটির পকেটে গুঁজে দিয়ে বললো,
-এবার বলো কই থেকে এনেছো?
ছেলেটি টাকাটা হাতে পেয়ে বেশ ইতঃস্তত ভঙ্গিতে বললো,
-জ্বী ভাই কিন্তু এসব বলা মানা করা আছে তবুও বলছি এটা আসলে সদরঘাঁট শাখা থেকে পাঠানো হয়েছে। এগুলোকে হাইড পার্সেল বলা হয় এবং এগুলো পাঠানোর সময় টাকাটাও একটু বেশি লাগে যেহেতু জায়গার নাম আর মোবাইল নাম্বার ভিন্ন থাকে।
-হুম বুঝলাম। তোমাকে আমি আরো এক হাজার টাকা বখশিশ দিবো যদি তুমি আমাদের সাথে এখনি সদরঘাঁটে যাও।
তাঁর কথা শুনে ছেলেটি বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ অসম্মতি জানালেও একপর্যায়ে নজরুল ভাইয়ের কথার মারপ্যাঁচে পরে ছেলেটি যেতে রাজি হয়।
আমরা এখন দাঁড়িয়ে আছি সদরঘাঁটের কুরিয়ার শাখায়। সেখানের দায়িত্বে থাকা একজনকে নজরুল ভাই বলে উঠলেন,
-আচ্ছা ভাই, আপনাদের এখান থেকে বাগেরহাঁটের কথা বলে পরপর তিনদিন আমাদের কাছে পার্সেল এসেছে কিন্তু কে পাঠাচ্ছে তা জানিনা। আপনাদের সিসি ক্যামেরার ফুটেজটা দেখা যাবে?
-দুঃখিত স্যার! বহিরাগতদের ফুটেজ দেখানো মানা আছে।
-তাহলে আপনারা যে এরকম হাইড পার্সেল পাঠিয়ে আমাদের হয়রানি করছেন সেটা কী আপনাদের নিয়মের মধ্যে আছে?
নজরুলের ভাইয়ের সাথে একপর্যায়ে লোকটির কথা কাঁটাকাঁটির সময় আকস্মাৎ তিনি বলে উঠলেন,
-আপনি জানেন আমি কে? আপনারা যদি এই মুহূর্তে আমাকে ফুটেজ না দেখান তবে আমি এখনি পুলিশের কাছে কমপ্লেইন করবো। আপনাদের কারণেই আমাকে এসব উদ্ভট পার্সেল পাঠিয়ে খুনের হুমকি দিচ্ছে।
নজরুল ভাইয়ের কথায় আমি অবাক হয়ে গেলাম। কারণ পার্সেল পাঠাচ্ছে আমাকে তাহলে খুনের হুমকি তাকে দেয় কীভাবে?
পরক্ষণেই সেখানের দায়িত্বে থাকা প্রধান লোকটি বেশ ভয় পেয়ে নজরুল ভাইকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন,
-প্লিজ শান্ত হন আপনি। আমি দেখাচ্ছি আপনাকে ফুটেজ এদিকে আসুন।
তাঁদের এহেন পরাজয় দেখে বুঝলাম এটাও নজরুল ভাইয়ের একটি চালাকি ছিলো।
অতঃপর লোকটি সকাল থেকে রেকর্ড হওয়া ফুটেজ আমাদের দেখাতে শুরু করলো। আকস্মাৎ একটি জায়গায় আমি তাঁদেরকে থামতে বললাম। নজরুল ভাই বেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
-কী ভাই পাইছেন?
-হ্যাঁ হ্যাঁ এই মেয়েটিকে চেনা চেনা লাগছে কিন্তু ক্যামেরাটা তাঁর মাথার উপরে থাকায় চেহারা দেখা যাচ্ছেনা।
আমর কথা শুনে নজরুল ভাই লোকটিকে বলে উঠলেন,
-এই মেয়েটিকে স্পষ্টভাবে দেখার জন্য আর কোনো ফুটেজ আছে?
-হ্যাঁ ভাই আছে।
এই বলেই তিনি ফুটেজটি অন করলেন। অতঃপর আসল সময়টিতে তিনি ফুটেজটি নিয়ে আসতেই আমি অবাক হওয়ার চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে গেলাম। একি এটাতো আমার প্রথম স্ত্রীর অনুরূপ সেই মেয়েটি যাকে আমি প্রথমেই রাস্তা দিয়ে এক যুবকের সাথে হেঁটে যেতে দেখেছিলাম। এ কীভাবে সম্ভব?
.
[To Be Cotinued]
.
{আগামী পর্বেই সমাপ্তি}
(পরবর্তী পর্বের লিংক কমেন্টে পাবেন।)