#যখন_তুমি_এলে।
#পর্ব- ১০।
লেখা – জাহান লিমু।
দুপুরে খাওয়ার পর শহরের মানুষজন ভাতঘুম দেয়। বিরুনিকা রসমালাই বানিয়েছিল গতকাল। ছোট একটা কৌটায় ভরে, সেটা সাচীদের ফ্ল্যাটে নিয়ে গেল। দরজায় নক করে দেখে দরজা খোলা। ভেতরে ঢুকে দেখে সায়াহ্ন প্লেটে ভাত নিয়েও আঁকিবুঁকি করছে। বিরুনিকা কি বলবে ভেবে পেলো না।
সায়াহ্ন কে পাশ কাঁটিয়ে চলে গেল সাচীর রুমে। কিন্তু সে নেই। এখনো আসেনি। ডিরেক্টর ম্যামের প্রেম বোধহয় রকেটের গতিতে চলছে। আর তারই ভাই,কি করছে? একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। শফিকুরের রুমে একটু উঁকি দিয়ে দেখে,উনি ঘুমাচ্ছে। তাই আর ডাক দিলো না। অগত্যা কুনোব্যাঙ এর কাছেই আসতে হলো। তখনো ভাত,তরকারি মেখে কি যেন বানানোর চেষ্টা করছে। বিরুনিকার মন চাইছিলো,ভাতের প্লেইটে জল ঢেলে দিতে। একটা মানুষ এতো উদাসীন প্রকৃতির কি করে হয়? দুনিয়া ভেসে গেলেও,এর ভাবনা শেষ হবেনা। যত্তসব আজগুবি চিন্তাভাবনা মাথায় নিয়ে ঘুরে। অবশ্য ঘুরে বললে তো ভুল হবে। কুনোব্যাঙ এর মতো রুমের কোনায় বসে থাকে। চোখেমুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে ডাইনিং টেবিলের একপাশে দাঁড়ালো সে। কিন্তু তাতে কুনোব্যাঙ এর কি?
সে তো এক লোকমা ভাত খায়,আর কি আঁকিবুঁকি করে। ঠাস করে কৌটাটা টেবিলের উপর রেখে চলে যেতে নিলো সে। তখন বোধহয় সায়াহ্নর হুঁশ ফিরলো। তবে একটুও ঘাবড়ালো না। স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
” এটার ভেতর কি?”
” বিরুনিকা যেতে নিয়েও পিছু ফিরলো। একদম সায়াহ্নর মুখের কাছে এসে আস্তে করে বললো,বোম!”
সায়াহ্ন আবারও বিরুনিকাকে হতাশ করে, যথা স্বাভাবিক কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
” আপনি বানিয়েছেন?”
” বিরুনিকা দাঁত কটমট করে বললো,হ্যাঁ। আমিই বানিয়েছি। আমি একজন পেশাদার বোম প্রস্তুতকারী।
আপনি জানেন না?
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমিই আমেরিকাকে বোমের সাপ্লাই দিয়েছিলাম। হিরোশিমা, নাগাসাকিতে আমার বানানো বোমই নিক্ষেপ করা হয়েছিল। সায়াহ্ন কতক্ষণ কি যেন ভাবলো। তারপর হুঁট করে বললো,
“আচ্ছা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ জানি কবে হয়েছিল?”
” বিরুনিকা নিজের রাগটা সর্বোচ্চ হজম করার চেষ্টা করলো। চোখ খিচে বললো,১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫।”
” তাহলে এখন আপনার বয়স কত?”
” এবার বিরুনিকা আর ধৈর্য ধরে রাখতে পারলনা। এই লোক নিজেকে কি মনে করে? বিরুনিকাকে এদিক-ওদিক কিছু খুঁজতে দেখে সায়াহ্ন মিনমিনে গলায় বললো,
” আপনার বয়সটা বললেন না? অবশ্য মেয়েরা কখনোই তাদের সঠিক বয়স বলে না। মেয়েরা ভাবে বয়স প্রকাশ হয়ে গেলেই,তাদের সব রহস্য শেষ। মেয়েরা পারলে নিজেদের বয়স ঊনিশেই আঁটকে দেয়। কারণ কুড়ি হলেই তো বুড়ি। সায়াহ্ন বেশ মজার কথা বলে ফেলেছে,এমন ভাব করে হেসে উঠলো। তবে হাসিটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। এর আগেই মাথায় শীতল কোনকিছুর উপস্থিতি অনুভব করলো। তরল জাতীয় কিছু মনে হচ্ছে। ঠান্ডায় শরীর শিউরে উঠলো। চোখ বন্ধ করে ফেললো। যখন চোখ খুললো,বিরুনিকার দীঘল কালো চুল চোখে ভাসলো শুধু। মেয়েটা আবার একটা অঘটন ঘটিয়ে গেল।
অঘটনঘটনপটীয়সী মেয়ে।
পাশেই একটা বড় বোতল পড়ে থাকতে দেখলো। বুঝতে পারলো ফ্রিজের ঠান্ডা জল তার উপর বৃষ্টিরুপে ঝরে পড়েছে। পড়েনি অবশ্য, পড়ানো হয়েছে।
আরাদের ভাবসাব সুবিধার ঠেকছে না রোহানীর। রোহানী শুধু পিছু পিছু ছুটছে। বেচারীর এভাবে দৌঁড়াতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু এই পাগলকে একা ছাড়া যাবেনা। কখন কি করে বসে। রোহানী হাঁপাতে লাগলো। আর বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,এভাবে কয়েকদিন দৌড়ালে তো আমি এমনিই স্লিম হয়ে যেতাম। আরাদ কি করতে চাইছে? পাগলের মত এদিক-ওদিক কি যেন খুঁজছে শুধু। আশেপাশে যে কয়টা রেস্টুরেন্ট ছিলো,সবকয়টাতে ঢুকছে একনাগাড়ে।
কিন্তু কিছু খাওয়ার জন্য নয়,সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। তাহলে কি করতে চাইছে এই ছেলে?
রোহানীর মাথা আর শরীর দুটোই হাল ছেড়ে দিয়েছে। আর কুলোচ্ছে না। সে একটা জায়গায় বসে পড়লো।
রাদও সেখানেই থমকে দাঁড়ালো। কিছুটা সামনে এগিয়ে গিয়েও,কি যেন দেখে আবার পিছনে সরে আসলো। সেটা দেখে রোহানী ফট করে দাঁড়ালো। রাদ একটা রেস্টুরেন্টের ভেতর ঢুকছে আবার। আরো বার্গার খাবে নাকি?
রোহানী রাদের পিছন পিছন ছুটলো। এবং কিছুদূর যেতেই বুঝতে পারলো, রাদের এখানে থমকে দাঁড়ানোর কারন। যে ভয়টা পাচ্ছিল,সেটাই। রোহানী সূরা-কালাম পড়তে লাগলো ভয়ে। কারন রাদ সহজে কারো সাথে লাগেনা। ইনফ্যাক্ট খুব প্রয়োজন ছাড়া কারো সাথে কথায় বলেনা। ভার্সিটিতে ঐ কাপলদের নিয়ে দুষ্টুমি করেই কেটে যায়। তবে আরেকটা বিশেষ দিক আছে রাদের। ব্রেকআপা করানোর পর যদি দেখে যে,না ছেলেমেয়ে উভয়ই সিরিয়াস ছিলো। দু’দিন যেতেই এক্স কে লাথি দিয়ে নেক্সট খোঁজা শুরু না করে,তবে রাদ আবার উল্টো চাল চালে। আর যারা নেক্সট খোঁজা শুরু করে দেয়,তাদের মতদের আবারো ব্রেকআপ করায়। এসব করেই ওদের সময় কেটে যায়। ব্রেকআপ করালেও,কাউকে সেভাবে আঘাত করেনা। শুধু যে সম্পর্কগুলো মরীচিকার মতন,সেগুলোর ধোঁয়াশা কাটিয়ে দেয়। সম্পর্কে গেলে অনেকসময় আমরা অপর পাশের মানুষটার ত্রুটি খুঁজে পায়না। আর রাদ ঠিক সেই ত্রুটিটাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। এর পরের সিদ্ধান্ত তাদের,সেখানে রাদের কোন হস্তক্ষেপ থাকেনা। হয়তো অনেকের কাছে ব্যাপারটা সিলি মনে হতে পারে। তবে এটাই আরাদের ক্যারেক্টার।
রোহানীর ভাবনায় আঘাত হানলো, রাদের করা পরবর্তী কাজটি। কোন কথা না বলে,সোজা কাপোল টেবিলটার পাশে দাঁড়ালো। কাউকে কোনকিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নিচে বসে পড়লো। হুঁট করেই মেয়েটার ওড়না হাতে নিয়ে, মাথা,মুখ মুছতে লাগলো। মেয়েটা বোধহয় বিষয়টা হজম করতে পারছিলনা। কিংবা রাদ এমন কিছু করবে,সেটা কল্পনায়ও ভাবেনি। যদিও এতোক্ষণে রাদের চুল,মুখ শুকিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তাতে কি?
কতক্ষণ মুখ, চুল ঘষাঘষি করে,উঠে দাঁড়ালো। সাচীর হাতে একটা সার্ফএক্সেল এর সাবান ধরিয়ে দিল। তুহিন পুরো হতভম্ব বিষয়টা দেখে। তবে সে এতটুকু বুঝতে পারছে,এরা পূর্ব পরিচিত। তাই সে মাঝখান থেকে কোন কথা বলছেনা। সাচীর রিএকশান দেখার অপেক্ষায়। সাচীর দিকে তাকিয়ে দেখে,ওর হাত পা রাগে কাঁপছে সম্ভবত। সাচী বাসায় চলে যেতে চেয়েছিল,তুহিনই নিয়ে এসেছে। তবে বিষয়টা এতোদূর গড়াবে সেটা তুহিনের ভাবনার বাইরে। তাহলে কখনোই সাচীকে আটকাতো না। অবশ্য সাচীও বোধহয়, এমন কিছু ভাবেনি। তুহিন ভাবছে,ছেলেটার মাথায় সমস্যা আছে নাকি?
আর নয়তো সাচীর সাথে কোন শত্রুতা। তুহিনের ভাবনায় ছেদ ঘটলো আরাদের কথায়। সে সাচীর হাতে সাবানটা দিয়ে বললো,সরি টু।
তারপর একটু সরে দাঁড়িয়ে বলতে লাগলো,
কাপড়ের কঠিন থেকে কঠিনতর দাগ তুলে, কাপড়কে করে নতুনের মত চকচকে,উজ্জ্বল। মাত্র দশটাকায়। সাচীর সামনে ফলের জুসের গ্লাস রাখা ছিল। সেটা নিয়ে কয়েক ডুব খেয়ে,গ্লাসটা রেখে চুপচাপ বের হয়ে আসলো রাদ। এতোক্ষণ ছুটোছুটি করে গলা শুকিয়ে গিয়েছিল। সাচীর তখন মাথায় আগুন ধরে গেছে। এতবড় অপমান,তাও তুহিনের সামনে! রাগে তরতর করে কাঁপছে সে। তুহিন আগে সাচীকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করতে লাগলো। রোহানী কিছুক্ষণ কিংকর্তব্যবিমূঢ় এর মতো দাঁড়িয়েছিল সেখানে। যখন সংবিত ফিরলো,তাড়াতাড়ি কেটে পড়লো। এখানে দাঁড়িয়ে বন্ধুর কর্মের শাস্তি, ওর খাওয়ার কোন ইচ্ছে নেই। পিটুনি তো আর বার্গার নয়। তবে গণপিটুনির সাথে বার্গারের একটা মিল আছে। বার্গার খেলেও শরীর মোটা হয়,গণপিটুনি খেলেও। তবে একটা ভেতর থেকে,আরেকটা বাইরে। এটা ভাবতে ভাবতেই জোরে জোরে হাঁটতে লাগলো রোহানী। আজকে ওজন মাপলে দেখবে,নিশ্চিত এক-দুই কেজি একদিনেই কমে গেছে। এমন বন্ধু থাকলে,স্বাস্থ্য কমানোর জন্য ডায়েটের কি দরকার?”
#চলবে…