অনুভূতি
পর্ব ১৬
মিশু মনি
.
২৭.
মিশু মেঘালয়ের বুকে হাত রাখতেই মেঘালয়ের মুখ থেকে যন্ত্রণার আওয়াজ বের হলো। মিশু অবাক হয়ে খেয়াল করলো, মেঘের বুকে অজস্র আচড়ের দাগ। গলায় তাকিয়ে দেখে একদম হিংস্র কিছু আচড়, নখ বসে গেছে। লাল হয়ে ফুলে গেছে কয়েক জায়গায়। ও আঁৎকে উঠলো।
মেঘালয় বললো,”দেখেছো কি অবস্থা করে ফেলেছো?”
মিশু মুখটা করুণ করে বললো,”এই অবস্থা আমি করেছি?”
– “তাছাড়া? কি পরিমাণ অত্যাচার চালাচ্ছিলে আমার বুকের উপর। দুহাত দিয়ে একদম। আচড়াতে আচড়াতে অবস্থা খারাপ করে দিয়েছো।”
আচড় দেয়া জায়গাগুলোতে আলতো করে স্পর্শ করলো মিশু। মেঘালয় ব্যথা পেয়ে শব্দ করে উঠছে। ফর্সা গলা আর বুকের এমন ভয়াবহ অবস্থা দেখে খারাপ লাগছে মিশুর।
মেঘালয় বললো,”আগামী এক সপ্তাহ এই দাগ থাকবে মনেহচ্ছে।”
– “সেকি! এত গভীর ক্ষত করে ফেলেছি আমি?”
– “হুম ম্যাম। চিন্তা করছি আমি বাইরে বের হবো কিভাবে? মেয়ে হলে নাহয় হিজাব বাঁধতাম। এই অবস্থা দেখলে লোকজন কি যে ভাব্বে! ”
মিশু চিন্তিত হয়ে বললো,”লোকজন অনেক আজেবাজে জিনিস ভাব্বে।”
– “তা তো ভাব্বেই। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবো নতুন বিয়ে করছি ভাই। সেজন্য বউ এ দশা করছে।”
– “নতুন বিয়ে করলে বউ এ দশা কেন করবে?”
– “জানো না কেন করবে?”
– “না তো। কেন?”
মেঘালয় হেসে বললো,”ওটা একটা শাস্ত্র। বাসর রাতে বরের গলা,বুক,কাঁধে বড়বড় নখ দিয়ে আচড় দিয়ে দাগ করে দিতে হয়।”
মিশু অবাক হয়ে বললো, “কি বলছেন এসব? আমিতো এমন শাস্ত্র কক্ষনো শুনিনি। বউরা কেন এরকম হিংস্র কাজ করবে? আমি বাবা পারবো না। আচ্ছা, আমাকে ও কি আবারো এভাবে আচড় দিতে হবে?”
মিশুর অবুঝের মতন কথাবার্তা দেখে দারুণ মজা লাগছে মেঘালয়ের। ও মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, “হুম দিতে হবে।”
– “তোমার ব্যথা লাগবে না?”
– “নাহ লাগবে না। লাগলেও কিছু করার নাই।”
– “আমি পারবো না। তখন তো অজান্তেই এরকম করে আচড় দিয়ে ফেলেছিলাম। সিরিয়াসলি আমি জেনেশুনে এসব করতে পারবো না।”
মেঘালয়ের আরো হাসি পেয়ে গেলো। ও হাসি চেপে রেখে বললো,”তাহলে কামড় দিয়ে কাজ চালিয়ে দিবা। কামড়ে দাগ বসালেই হলো।”
– “আমি কি কুত্তা? মানুষ কি মানুষ কে কামড়ায়?”
মেঘালয় হেসে বললো,”তুমি কুত্তা না, বউরা তো কামড়ায় ই। কিছু করার নেই। বিয়ের শাস্ত্রে এটাও আছে। এটা তো মানতেই হবে তাইনা?”
– “এসব আজেবাজে শাস্ত্র কে বানিয়েছে বলুন তো? যত্তসব বাজে বাজে কথা। আমি আচড়াতেও পারবো না,কামড়াতেও পারবো না।”
– “তাহলে তো বিয়ে পরিপূর্ণ হবেনা ম্যাম। এটা যে শাস্ত্র।”
– “কি মুছিবত! দাগ করতেই হবে?”
– “হুম হবে। নিয়ম পালন করতে হবেনা?”
মিশু একটু ভেবে বললো,”তোমার ব্যথা লাগবে না?”
মিশুর করুণ মুখের দিকে তাকিয়ে এবার সত্যিই বড্ড হাসি পেলো মেঘালয়ের। কিছুতেই হাসি চেপে রাখতে পারলো না। শব্দ করে হেসে ফেললো। মিশু জিজ্ঞেস করলো, “হাসছেন কেন আপনি? আমি কি হাসার মতন কিছু বলেছি? ”
– “একদম ই নাহ। তুমি একটা কাজ করতে পারো। তাহলে নিয়ম ও পালন হয়ে যাবে, আর আমি ব্যথাও পাবো না।”
মিশু মেঘালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কি সেটা শুনি? আমি সেটাই করবো তাহলে।”
মেঘালয় কণ্ঠে একটু আবেগ ঢেলে বললো, “ঠোঁট দিয়ে কামড় দিতে পারো।”
কথাটা শোনামাত্র এক পলকেই মিশুর চেহারা নীল বর্ণ ধারণ করলো লজ্জায়। এতবেশি লজ্জা পেলো যে, না পারছে দাঁড়িয়ে থাকতে,না পারছে বসে পড়তে। লজ্জায় চোখ মেলে থাকতেও পারছে না। ওর এমন লাজুক চেহারাটা মেঘালয় হা হয়ে চেয়ে চেয়ে দেখছে। মিশু মুহুর্তেই পিছন ফিরে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলো। মেঘালয় উঠে পিছন দিক থেকে ওকে জড়িয়ে ধরে মিশুর কাঁধের উপর মাথা রাখলো। আবেশে চোখের পাতা ঘনঘন কাঁপছে মিশুর। অন্যরকম একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেছে ও।
মেঘালয় ওর লাল মসৃণ গালের সাথে নিজের খোঁচা খোঁচা দাড়ি ঘষে দিলো। সমস্ত শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠলো মিশুর। এ কেমন অনুভূতি! এমন অনুভূতি কক্ষনো হয়নি ওর। মেঘালয় আলতো করে মিশুর কাঁধ থেকে এক গোছা চুল সরিয়ে ওর ঘাড়ে খুব নিবিড় ভাবে দুই ঠোঁট দিয়ে চাপ দিলো। জিভটা চামড়া স্পর্শ করতেই দারুণ ভাবে শিহরিত হয়ে উঠলো মিশু। দ্রুত নিশ্বাস পড়তে লাগলো। সুখের আবেশে চোখে জল এসে গেছে। কোনো নড়াচড়া করতে পারলো না ও। মেঘালয় আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। একটু পিছিয়ে আসতেই মিশু ঢলে পড়ে যাচ্ছিলো। মেঘালয় মিশুকে টেনে এনে নিজের কোলের উপর বসিয়ে দিয়ে সিটে হেলান দিলো। মিশু ওর বুকে মাথা লুকিয়ে চুপটি মেরে রইলো।
এভাবে অনেকটা সময় পেরিয়ে গেলো। বেশ কিছুক্ষণ পর চোখ বুজেই বিড়বিড় করে মিশু বললো,”এটাকে কি চুমু বলে?”
– “হুম।”
মিশু কেঁপে উঠলো। আবারো বিড়বিড় করে বললো,”আমার না খুব ভালো লেগেছে। খুউউব ভালো লেগেছে। আমি আমার জীবনে কতবার কতরকম গাড়িতে উঠেছি। কক্ষনো এরকম আরাম লাগেনি।”
মেঘালয় ফিক করে হেসে বললো,”গাড়িতে ওঠা আর চুমু বুঝি এক হলো?”
– “কেন হবেনা? না মানে কখনো এত ভালো লাগেনি কোনোকিছু। সেজন্য বললাম। আর কোনো উদাহরণ পাচ্ছিলাম না ত।”
মেঘালয় মিশুর মাথাটা বুকে চেপে ধরে বললো,”পাগলী টা। এত অবুঝ কেন তুমি? আমি ভেবেছিলাম তুমি খুব ম্যাচিউরড। কিন্তু এতটা ইনোসেন্ট সেটা সত্যিই কল্পনা করিনি।”
– “কেন? আমি কি করেছি?”
– “নাহ, কিছু করোনি। অবুঝ মেয়েটা। খুকুমণি বললেও কম বলা হবে।”
মিশু কিছু বললো না। অনেক্ষণ চুপ করে থেকে মাথা তুলে তাকালো মেঘের দিকে।মেঘালয়ের চোখ একদম লাল হয়ে গেছে। মিশু অবাক হয়ে বললো,”আপনার চোখ লাল কেন?”
মিশুর চুলে হাত বুলিয়ে দিলো মেঘালয়। কিভাবে মেয়েটাকে বুঝাবে ওর ভেতরে কি তুমুল ঝড় শুরু হয়ে গেছে। মেয়েটা যে কিচ্ছু বুঝেনা। একটা সেকেন্ড ও স্থির হয়ে থাকতে পারছে না মেঘ, প্রচণ্ড ছটফটানি কাজ করছে ভেতরে। মিশুকে কিভাবে বুঝাবে সেটা? একটা ছোট নিশ্বাস ফেলে মেঘালয় বললো, “রাতে না ঘুমালে আমার চোখ লাল হয়ে যায়।”
মিশু মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, “ওহ আচ্ছা। এই আমার না কেমন কেমন লাগছে।”
হাসলো মেঘালয়। তার নিজের ই তো কেমন কেমন লাগছে। মিশুর কেমন লাগছে সেটা অনুধাবন করতে ওর কোনোই সমস্যা হলোনা। তবুও জিজ্ঞেস করলো, “কেমন কেমন?”
– “একটা কেমন কেমন, দুইটা কেমন কেমন, অনেক গুলা কেমন কেমন।”
মিশুর বাচ্চাদের মতন কথা বলার ভঙ্গি দেখে হেসে ফেললো মেঘালয়। সুখের মুহুর্ত গুলোতে মেয়েটার বয়স যেন হুট করেই অনেক কমে যায়। খুব কিউট লাগে তখন। গালটা টেনে দিতে ইচ্ছে করে।
মেঘালয় জিজ্ঞেস করলো, “সেই কেমন গুলা কেমন গো মিশু? একটু কওনা শুনি?”
– “আমি নিজেই তো বুঝতে পারছি না সেই কেমন গুলা কেমন। তবে ইচ্ছে করছে।”
– “কি ইচ্ছে করছে?”
মিশু ওর বুকে মুখটা আরো একটু লুকিয়ে বিড়বিড় করে বললো, “আপনি একটু আগে যেটা করলেন, আরেকবার সেটা করুন।”
শিউরে উঠলো মেঘালয়। কি বলবে মিশুকে? নিজেকে কোনোমতে সামলে নিয়ে বললো, “নারে পাগলী। ওটা করা যাবেনা আর।”
– “এটাও কি শাস্ত্রে আছে?”
– “হুম আছে। বিয়ের আগে এসব করতে হয়না রে।”
– “তাহলে আপনি কেন করলেন?”
থতমত খেয়ে গেলো মেঘালয়। এর উত্তর কি দেবে সে? আবেগের বশে অজান্তেই করে ফেলেছে। সেটা বললে তো মেয়েটা বুঝবে না। ও বললো, “আমিতো জানি রাত পোহালেই এই মেয়েটাকে আমি বিয়ে করে নিচ্ছি। সেজন্যই করেছি।”
-” আপনি আবার জানুন রাত পোহালেই আমাকে বিয়ে করে নিচ্ছেন। তারপর আবার করুন।”
মিশুর মাঝে এখন চরম আকারের ঘোর কাজ করছে। তার উপর একটু ঘুম ঘুম ভাব ও চলে এসেছে ওর। এমন ভাবে বলছে যে ইচ্ছে করছে মেয়েটাকে বুকের সাথে পিষে ফেলি। ওর বুকের ভেতর ঢুকে যেতে ইচ্ছে করছে। ও নিজেও জানেনা এভাবে বলে কিভাবে পাগল বানিয়ে দিচ্ছে মেঘালয়কে। এতদিন শুধু মনের আকর্ষণ ছিলো, এখন দৈহিক আকর্ষণ অনুভূত হচ্ছে। ভেবেছিলো আরো কয়েকদিন সময় দেবে মিশুকে যাতে ও মেঘালয়কে বুঝতে পারে। কিন্তু এখন আর সে ইচ্ছে নেই, ইচ্ছে করছে এক্ষুনি ওকে বিয়ে করে নিয়ে স্বর্গসুখের অন্যতম একটা স্তরে ওকে ঘুরিয়ে আনতে। অচেনা একটা পাগলামিতে পেয়েছে দুজনকে।
মিশু বললো, “কি ভাবছো? করবে না?”
– “উহু মিশু, এটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দাও।”
– “কেন? আপনার বুঝি ভালো লাগেনি?”
– “ব্যাপার টা ভালো লাগা খারাপ লাগার নয় রে। ব্যাপার টা অন্যকিছু।”
– “কি ব্যাপার? আমার গা ঘেমে গেছে বলে?”
– “কি বিপদে পড়লাম রে বাপ! মেয়েটাকে একটু বুঝ দাও কেউ। মিশু, তুমি কি দয়া করে আমার কোল থেকে উঠে সামনের সিটে গিয়ে বসবা? প্লিজ?”
– “না বসবো না। এভাবে বললে আমি কান্না করবো। আমি চেয়েছি বলে আপনি আমাকে দূরে গিয়ে বসতে বলবেন কেন? আমি কোলেই বসে থাকবো, আর আপনি আবারো ঠিক ওইভাবে ওইভাবেই একবার জিভ দিয়ে ছুঁয়ে দিবেন।”
মেঘালয় মিশুকে ছেড়ে দিয়ে সিটে হেলান দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। এই মেয়েটা একেবারেই খুন করে ফেলেছে। এতটাও ইনোসেন্ট স্বভাবের মেয়েও জগতে আছে সেটা ওর জানা ছিলোনা। অনায়াসে এভাবে বললে কি মাথা ঠিক রাখা যায়?
– “মিশু, তোমার কি লজ্জা লাগেনা এসব বলতে?”
– “এখন লাগছে না। আপনি তো বললেন রাত পোহালেই আমাকে বিয়ে করে নেবেন। আর একটা মেয়ের সবচেয়ে আপন হচ্ছে তার বর।বরকেই তো বলবো তাইনা?”
– “এটা বুঝো আর আমার ব্যাপার টা বুঝো না? ন্যাকামি করো?”
– “আরে বাবা সত্যি বুঝিনি। বুঝলে কি আর বারবার বলি বলো? কোথায় সমস্যা একটু বলবে?”
– “আমি নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে পারবো না রে। টিকতে পারবো না,বুঝো না কেন?”
– “কেন পারবা না?”
মেঘালয় মাথাটা তুলে মিশুর দিকে তাকিয়ে বলল, “ধরো তুমি একজন রাইটার। তুমি আমাদের এই জার্নিটা নিয়ে একটা গল্প লিখবা। সেই গল্পটা পড়ে দুনিয়ার সমস্ত পাঠক বুঝে যাবে আমার মধ্যে কি হয়ে যাচ্ছে। একটা দুইমাসের বাচ্চাও এই গল্পটা পড়লে বুঝবে মেঘের ভেতরে কেমন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। আর তুমি বুঝতে পারছো না। আজব না?”
মিশু হেসে বললো, “তাহলে আমি লিখালিখি শুরু করে দিই? পাঠকদেরকে জিজ্ঞেস করে করে জেনে নিবো তোমার ভেতরে কি চলছে? মেঘের ভেতরে বিদ্যুৎ চমকানোই স্বাভাবিক। আর তারপর সেই মেঘ থেকে জলকণা বৃষ্টি হয়ে ঝড়বে আমার গায়। ঠিক না?”
মেঘালয় বললো, “তোমাকে আর সাহিত্য চর্চা করতে হবেনা। নিজেও পাগল হইছো, আমাকে ও বানাইছো। এরপর পাঠকদেরকেও বানাবা। পাজি মেয়ে কোথাকার, দয়া করে উঠে গিয়ে ওই কোণায় জানালার সিটে বসে থাকো। আর একটাও কথা বলবা না। কালকে বিয়েটা হতে দাও, তারপর দেখে নিবো কত বৃষ্টিতে ভেজার শখ। অধিকারের বৃষ্টি দেখেছিলে কখনো?”
মিশু আর কিছু বললো না। মুখটা গোমরা করে উঠে গিয়ে সামনের সিটে জানালা দিয়ে মাথা বের করে বাইরে তাকিয়ে রইলো। মেঘালয়ের খুব খারাপ লাগছে মিশুর জন্য। ও জানে মিশু এখন বাইরে তাকিয়ে খুব কান্না করছে। কাঁদুক, তবু ওর কাছে যাওয়া যাবেনা। বিপজ্জনক মেয়ে একটা।
একবার ওর দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে সিটে হেলান দিয়ে বসে রইল মেঘালয়। মিশুকে কষ্ট দিয়ে ফেলেছে ভেবে নিজের ই কান্না করতে ইচ্ছে করছে।
চলবে..
অনুভূতি
পর্ব ১৭
মিশু মনি
.
২৮.
মিশু জানালায় মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ওর ঠিক সামনা সামনি বসে ওর দিকে চেয়ে আছে মেঘালয়। কি বলা উচিৎ বা কি করা উচিৎ বুঝতে পারছে না।
একটু পর বললো, “আমি কি শার্ট গায়ে দিবো নাকি কেউ তাকাবে?”
মিশু তবুও ঠায় জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে রইলো। মেঘালয় আবারো জিজ্ঞেস করলো, “আমি কি শার্ট পড়বো?”
এবারেও মিশুর কোনো উত্তর নেই। মেঘালয় আবারো একই প্রশ্ন করতেই মিশু ভয়ানক রেগে জবাব দিলো, “সেটা আমাকে জিজ্ঞেস করছেন কেন? আপনার যা খুশি করুন। আমি কেন তাকাবো আপনার দিকে? আমি আপনার কে? আমার কোনো কথাই আপনাকে রাখতে হবেনা। শার্ট গায়ে দিন পারলে ট্রেনের সিটের গদি খুলে গায়ে দিন।”
এমন রাগত কথাবার্তা শুনে মেঘালয়ের প্রচণ্ড হাসি পেলো। অনেক চেষ্টা করেও হাসি চেপে রাখতে পারলো না। মিশুর দিকে একটু ঝুঁকে এসে বললো, “তারমানে চাইছো আমি এভাবেই থাকি তাই তো?”
মিশু আবারো চেঁচাল, “বললাম না আপনার যা খুশি করুন। গায়ে দিবেন না খুলবেন সেটা আপনার ব্যাপার। পারলে কারো কাছে বস্তা চেয়ে নিয়ে গায়ে দিন।”
– “সিস্টেমে আমাকে খালি গায়ে থাকতে বলছো? যাতে বারবার তাকাতে পারো? আমি কি বুঝিনা তুমি আড়চোখে কতবার তাকাও।”
– “আমার বয়েই গেছে তাকাতে। গায়ে দিন, খুলুন আপনার ইচ্ছা। আমিতো কেউনা। আমার কথা কেন শুনবেন? শুনবেন ই না তো। পারলে গায়ে যেগুলা আছে সেগুলাও খুলে ফেলুন।”
মেঘালয় জিহ্বায় কামড় দিয়ে বললো, “সিরিয়াসলি?”
মিশু থতমত খেয়ে গেলো। মেঘালয় দুষ্টুমি ভরা চোখে চেয়ে আছে। একবার ওর দিকে তাকিয়েই হাসি পেয়ে গেলো মিশুর। ফিক করে হেসে ফেললো। মেঘালয় ওর হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় চেপে ধরে বললো, “এত পিচ্চি কেন তুমি?”
– “আমি পিচ্চি? পিচ্চিকে বিয়ে করছেন কেন তাহলে?”
– “বিয়ে? ওহ হ্যা, দারুণ কথা মনে করিয়ে দিয়েছো তো। বিয়ে তো করতে হবে।”
কথাটা বলেই মিশুর হাত ছেড়ে দিয়ে পূর্বকে কল দিলো মেঘালয়। দুবার রিং হওয়ার পর পূর্ব রিসিভ করে বললো, “কোন শালা বে এত রাতে?”
– “তুই আমার কোন বোনকে বিয়ে করছিস যে শালা বলছিস?”
পূর্ব ঘুম জড়ানো গলায় বলল, “উম মেঘু শালা, তুই ব্যাটা। এত রাতে ঘুমাস না ক্রে? আমার মতন মিষ্টি কণ্ঠি পোলাদের ডিস্টার্ব করতাছোস হ্রামি।”
– “পূর্ব, একটু উঠে বস। দরকার ছাড়া এত রাতে কল দিইনি।”
– “মাত্র ঘুমালাম ব্যাটা। বল কি হইছে?”
– “আমি বিকেলে বিয়ে করবো।”
পূর্ব একলাফে বিছানার উপর উঠে বসলো। চোখ কচলাতে কচলাতে বললো, “কি বলছিস এসব?”
– “হুম, এমন ভাবে বিয়ের এরেঞ্জমেন্ট করবি যাতে কোনো পাবলিক টের না পায়। কাজীকে কারো বাসায় নিয়ে এসে বিয়ে পড়ানো যায়?”
পূর্ব একদম হতভম্ব। মেঘালয় এসব বলছে সেটা বিশ্বাস ই হচ্ছেনা ওর। রীতিমত অবাক হওয়ার পালা। মেঘালয় বললো, “পুরো দায়িত্বটা তোকে দিলাম, তুই সায়ান আর আরাফ মিলে যা ব্যবস্থা করার করবি। তোদের তিনজনের বাইরে কোনো কাকপক্ষীও যেন টের না পায়।”
-“সেটা নাহয় করলাম, কিন্তু দুম করেই বিয়ে করছিস কি জন্য? কোনো ঝামেলায় ফেঁসেছিস?”
– “না ভাই, প্রেমে পড়ছি। বিয়ে করে তারপর প্রেম করবো।”
– “আন্টি আংকেল?”
– “আমার বউটা নিতান্তই বাচ্চামেয়ে, বউটা আরেকটু বড় হলে আবার বিয়ে করবো।”
– “বাচ্চা হোক আর কাচ্চাই হোক, বিয়ের এক সপ্তাহের মধ্যে বড় হয়ে যাবে।”
বলেই পূর্ব হেসে উঠলো। মেঘালয় বলল, “ফাজলামি পরে করিস। আমি সিরিয়াস হয়ে যা বলি শোন।”
– “তুই কি আসলেই সিরিয়াস দোস্ত?”
– “হ্যা, মিশুর আর কেউ নাই এই দুনিয়ায়। ওর অসুস্থ মা গ্রামে থাকে, সেই মায়ের ভরণ পোষণের দায়িত্বও মেয়েটার কাঁধে। ওর কাঁধসহ পুরো শরীরের দায়িত্ব এখন আমি নিতে চাচ্ছি। বুঝাতে পারলাম?”
পূর্ব অবাক হয়ে বললো,”মিশু মানে? সুপার শপের মেয়েটা? ওরে একদিন রাত্রে তোর বাইকে দেখছিলাম না?”
– “হ্যা সেই পিচ্চিটা।”
– “সেদিন ই ডাউট হইছিলো, তলে তলে এতদূর? ওই ৩৮ কেজি ওজনের বাচ্চাটার দায়িত্ব নিতে কি লাগে?”
– “আমার বউকে বাচ্চা বলবি না, একমাত্র আমি বলার অধিকার রাখি। তোকে যা বলি, তাই কর।”
– “টেনশন নিস না, ট্রিট হিসেবে সীতাকুণ্ড ট্যুরের সমস্ত খরচ তোর।”
– “সীতাকুণ্ড যাবো না, নতুন বউ নিয়ে সাজেক যাবো। মেঘের দেশে ঘুরিয়ে নিয়ে আসি।”
– “তোর মত হাই লেভেলের মেঘ সাজেকে আছে? তোর পুরো শরীর ঘুরিয়ে আন,তাহলেই হয়ে যাবে।”
মেঘালয় হেসে বললো, “দহন আর বাড়াস না দোস্ত। আমি একা কেবিনে মিশুকে নিয়ে আছি, সে সামনে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।”
– “বাহ! আমার হিংসে হচ্ছে মেঘু শালা। দিলি আমার ঘুম হারাম করে।”
– “সকালে বাসায় গিয়ে আম্মুর কাছে টাকা নিবি,আইডি কার্ড নিবি। আমাদের গাড়িটা নিয়ে সোজা কমলাপুর স্টেশনে চলে আসবি। আম্মুকে যা বলার আমি বলে রাখবো।”
– “বাসরের ব্যবস্থা করবো না?”
– “কোথায় নিবি? যেই হোটেলেই যাবো, পাবলিক চিনবে। রিস্কি হয়ে যায় না?”
– “সায়ানদের বাসায় ম্যানেজ করি। আংকেল ইংল্যান্ড গেছে,আন্টি ট্রেনিং এ গেছে। বাসা একদম ফাঁকা। সারারাত আমরা গান বাজিয়ে পার্টি করবো, ড্রিংকস করে স্বর্গে চলে যাবো, আর তোরা বিছানাকে স্বর্গ বানিয়ে ফেলবি।”
মেঘালয় শব্দ করে হেসে উঠলো। হাসি থামিয়ে বললো, “সায়ানদের বাসাতেই বিয়ের ব্যবস্থা কর। রেজিস্ট্রি, কবুল দুটোই একসাথে।”
মেঘালয় আরো অনেক খুঁটিনাটি বিষয় পূর্বকে বুঝিয়ে বললো। খাবারের ব্যবস্থা করতে বললো, আর কিসব যেন বলে দিলো। মিশু সেসব মন দিয়ে শুনতেও পেলোনা। ও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে মেঘালয়ের উন্মুক্ত বুকের দিকে। ঘন লোমে আবৃত বুকটা যেন পৃথিবীর সমস্ত সুখ নিয়ে বসে আছে, লোমগুলো নাভি পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে গেছে, ট্রেনের ভিতরে হলুদ আলোয় মেঘালয়ের শরীরটা অদ্ভুত সুন্দর লাগছে। মুখটায় রাজ্যের মায়া ভর করেছে,গলাটা দেখলেই বুকটা চিনচিন করে উঠে। মেঘালয়ের কপালের উপরে চুলের নিচের অংশটা, এই জায়গাটা এতবেশি সুন্দর লাগে যার তুলনা বোধহয় হয়ই না। একটা ছেলে কিভাবে এত সুন্দর হতে পারে! ভ্রু দুটো ঘন কালো, তার নিচে একজোড়া মায়াবী চোখ। ছেলেদের চোখ ও এত সুন্দর হয়! কত শত মেয়ে মেঘালয়ের এই সৌন্দর্য আর আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব দেখে ওর পিছনে লাইন লেগে থাকে। সেই ছেলেটা ওকে আজকেই বিয়ে করে তারপর প্রেম করতে চাইছে! এটা তো স্বপ্নের চেয়েও বেশি কিছু। সুখে মিশুর মরে যেতে ইচ্ছে করছে।
মেঘালয় কল কেটে দিয়ে খেয়াল করলো মিশু ওর গলার দিকে তাকিয়ে আছে। ও হেসে বললো, “কি দেখো মায়াবতী?”
মিশু চমকে উঠে বললো, “আপনার ফিগার টা অনেক আকর্ষণীয়।”
– “হা হা হা, হিংসে হয়?”
– “নাহ, সুখ হয়। আপনার কোমর আর হাতের মাসল ও অনেক সুন্দর, বিপজ্জনক রকমের সুন্দর।”
– “সুন্দর আবার বিপজ্জনক ও হয়?”
– “হুম হয়। ভয়ংকর সুন্দর।”
মেঘালয় এসে মিশুর পাশে বসে ওর হাতটা ধরে বললো, “আকর্ষণীয় ফিগার তোমার ও হবে। কয়েকটা ইয়োগা শিখিয়ে দিবো, রেগুলার প্রাক্টিস করবা। খাবারে একটু বৈচিত্রতা আনতে হবে,আর একটু যত্ন। তাহলেই দেখবা মিশুকে দেখলেই ছেলেরা কেমন ফিট খেয়ে পড়ে।”
– “উহু,আমি কাউকে ফিট খাওয়াতে চাইনা। আমার নায়িকা হওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই। শুধু আপনার পাশে দাঁড়াতে পারলেই হলো। আচ্ছা, আপনার আশেপাশে এত সুন্দর সুন্দর মেয়ে, আমার চেয়েও সুন্দর অনেক মেয়ে আছে। আপনি কেন আমাকেই ভালোবাসলেন?”
– “সবাই তো আর মিশু না।”
– “মিশুর বুঝি আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে?”
– “কোনো মেয়ে কি ফাজলামো করে হলেও বলবে, শার্ট খুলুন। আগে বুকটা দেখবো তারপর বিয়েতে রাজি হবো?”
বলেই হেসে উঠলো। মিশু লজ্জা পেয়ে মুচকি হাসলো। মেঘালয় আবারো বললো, “অবশ্য কোনো মেয়ে ঘাড়ে একটা চুম্বন প্রাপ্তির জন্য এত কান্নাকাটি ও করবে না।”
আবারো হেসে উঠলো মেঘালয়। মিশু লজ্জায় কুকড়ে যাওয়ার মত অবস্থা হলো। মাথা নিচু করে চেয়ে রইল মেঘালয়ের পায়ের পাতার দিকে। ছেলেটার পায়ের আঙুল গুলোও নজরকাড়া, বিয়ের পর রাতে যখন মেঘালয় ঘুমাবে, মিশু সারারাত জেগে বসে বসে ওর দিকে তাকিয়ে থাকবে। কাউকে হা করে দেখার মাঝেও যে এত সুখ বিরাজ করে এটা ওর জানা ছিলো না। যত দেখে, তত দেখতে ইচ্ছে করে।
মিশু জিজ্ঞেস করলো, “আচ্ছা আপনি বারবার বলছিলেন যেন পাবলিক টের না পায়, কেন বলছিলেন?”
মেঘালয় বললো, “পাগলী, আমার ক্যারিয়ার মাত্র শুরু হচ্ছে। এখনই যে পরিমাণ লোক আমাকে চেনে, আমি কাজি অফিসে বিয়ে করছি এটা একজন পাবলিক জানলেই হয়েছে। যদি কোনোভাবে প্রকাশ হয়, ক্যারিয়ারের বারোটা বেজে যাবে। কিন্তু আমি এটা এখন আমার ফ্যামিলিকেও জানাতে চাইছি না।”
মিশু জিজ্ঞেস করলো,”আমি শ্বশুরবাড়ি যাবো না?”
মেঘালয় বললো, “যাবা। কিন্তু বিয়ের কথাটা এখনি জানাবো না বাসায়। আগে ক্যারিয়ারটা দাঁড়িয়ে যাক, তোমার ক্যারিয়ার গুছিয়ে দেই,বাবার বিজনেসে হাত লাগাই, তারপর ধুমধাম করে সবাইকে জানিয়ে আমাদের বিয়ে হবে। প্রেস আসবে, টিভিতে দেখাবে, সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখাবে।”
মিশু মেঘালয়ের দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, “আমার ভয় করছে। আপনি খুব বড় হয়ে গেলে আমাকে ছেড়ে চলে যান যদি?”
– “ছেড়ে কোথায় চলে যাবো? এই ভয়টা দূর করার জন্যই তো আইনের বাঁধনে বেঁধে ফেলছি। যাতে তোমার হারানোর ভয়টা কক্ষনো না হয়। ঘুড়ির নাটাইটা তোমার হাতে ধরা থাকবে, যখনি চলে যেতে চাইবো, সুতো ধরে টান দিবা।”
– “যদি সুতো ছিঁড়ে চলে যান?”
– “আমি শুধু তোমার আকাশেই উড়বো, সুতো ছিড়ে গেলেও তোমার আকাশের ই কোথাও না কোথাও থাকবো ঠিকই। জমিনে পড়লে তোমার বুকের জমিনেই পড়বো।”
মিশু মেঘালয়কে জাপটে ধরে বললো, “আমার ভয় করছে। খুব ভয় করছে।”
মেঘালয় হাতের বন্ধনে শক্ত করে বেঁধে ফেলে বললো, “সব ভয় দূর করে দিবো, তোমার শরীর থেকে সমস্ত বিষ শুষে নিবো।”
– “কিভাবে?”
মেঘালয় আবেগ মিশ্রিত কণ্ঠে ফিসফিস করে বললো, “যেটা আরেকবার করার জন্য তখন কান্নাকাটি করলে, ওরচেয়ে আরো গভীরভাবে।”
মিশু শিউড়ে উঠে ওর বুকে দুটো কিল বসিয়ে বললো, “খুব খারাপ একটা, আপনি খুব খুব খারাপ।”
– “সব ছেলেই বউয়ের কাছে খারাপ।”
মিশু আবেশে চোখ বুজে রইলো মেঘালয়ের উন্মুক্ত বুকে। ওর রোমশ বুকের ঘ্রাণ নিতে নিতে সুখে ভেসে যাচ্ছিলো একদম।
চলবে..
Golfho