অনুভূতি,পর্ব-৪৮+৪৯

0
1004

অনুভূতি
পর্ব ৪৮
মিশু মনি
.
৭৭.
খাবার টেবিলে বাবা চারটা কার্ড দেখিয়ে বললেন, “ইনভাইটেশন কার্ড। ডিজাইন গুলো মিশুকে দেখিয়ে একটা সিলেক্ট করিস।”
মেঘালয় চমকে উঠলো কার্ড দেখে। একদিনের মধ্যে বাবা কার্ডও পছন্দ করে ফেলেছে! আসলে বাবা মা ওকে খুবই ভালোবাসেন,তাই ছেলেকে সারপ্রাইজ দিতেও ভালোবাসেন। কিন্তু মিশু তো এখনি কিছুতেই বিয়ে করতে চাইছে না, এটা বাবা মাকে কিভাবে বলা সম্ভব?
বাবা বললেন, “আমি এদিকে যা যা করতে হয় সবই ভেবেচিন্তে ঠিক করে ফেলবো। যেহেতু আমাদের আর নিজস্ব লোক নেই,আমাদেরকেই সব ব্যবস্থা করতে হবে। তোর কাজিনদের ডাকবি, আমি তোর চাচা আর মামাদের ফোন দিয়ে জানিয়ে দিয়েছি। এখন তোর প্রথম কাজ হচ্ছে একজন ভালো ওয়েডিং প্লানারকে সিলেক্ট করা।”
মেঘালয় অবাক হয়ে বললো, “আব্বু! এসব কি বলো? এত দ্রুত এতকিছু করে ফেলেছো?”
বাবা বললেন,”হুম। কারণ আমার একটাই ছেলে,কিন্তু আমাদের রিলেটিভ আর ফ্রেন্ড সার্কেল অনেক। বিয়ে তো একবার ই হবে,আমি চাই আগামী দুদিনের মধ্যেই সব আত্মীয় স্বজন আমাদের বাসায় চলে আসুক। এক সপ্তাহ ধরে আনন্দ চলুক বিয়ের। আকাশ আহমেদের ছেলের বিয়ে বলে কথা। এক সপ্তাহ বাসায় লাইট জ্বলবে,হৈ চৈ হবে। তবেই না বিয়ে বাড়ি বিয়ে বাড়ি মনেহবে।”
মেঘালয়ের বুকটা চিনচিন করতে শুরু করেছে। মিশু যদি আগের মত থাকতো তাহলে আজকের এই কথাগুলো শুনলে ওর সুখে মরে যেতে ইচ্ছে করতো। বাবা মা ওকে নিজের মেয়ের মত মনে করে। ওনারা কত কিছু প্লান করে ফেলেছেন। এখন কিভাবে বাধা দেবে মেঘালয়? কিছুই ভেবে পাচ্ছে না। বাবার আরো দু একটা প্লান শুনে মেঘালয় নিজের রুমে আসলো। এসেই কল করলো মিশুকে।
বাবার সমস্ত প্লানের কথা শুনে মিশু বললো, “এতকিছু কেন ব্যবস্থা করে ফেললো? এত তাড়াতাড়ি আমি বিয়ে করতে চাইনা।”
– “বিয়ে তো হয়েই গেছে। এমন ভাব করছো যেন তোমাকে জোর করে বিয়ে দিচ্ছে আমার সাথে?”
– “ব্যাপার সেটা নয়। সংসার আর এত বড় একটা ওয়েডিং প্রোগ্রামের জন্য মেন্টাল প্রিপারেশন দরকার। হুট করেই হয়না।”
– “মিশু,প্রত্যেকটা মেয়ের স্বপ্ন থাকে এরকম ধুমধাম করে খুব আয়োজন করে বিয়ে হোক। বাবার মত শ্বশুর পাওয়াটা ভাগ্যের ব্যাপার। তুমি শ্বশুর শ্বাশুরি নয়,নতুন বাবা মা পেতে চলেছো।”
– “মেঘ,একটু বোঝার চেষ্টা করো প্লিজ।”
মেঘালয় বললো, “আমার ভাই হিমালয়কে হারিয়ে মা আমাকে বুকে আগলে রেখে বড় করেছে। তাদের কত স্বপ্ন আর আশা আমাকে নিয়ে। আমার পছন্দ ওরা মেনে নিয়েছে। তোমাকে ভালোবাসি কথাটা শুনে ওরা তোমার পরিচয় জানার ও প্রয়োজন মনে করেনি। মেনে নিয়েছে তোমায়। এখন ওদের করা প্লান গুলোকে আমি চুরমার করে দিতে পারিনা। তোমার আপত্তি থাকলে তুমি নিজে কথা বলো ওদের সাথে।”
মিশু একটু থেমে বললো, “আমিই বাবার সাথে কথা বলবো।”
– “কিহ! তুমি বাবার সাথে কথা বলবে তবুও বিয়ে করবে না?”
– “একটু সময় নিবো কিছুদিন। অন্তত দুইমাস।”
– “তারমানে আমাকে আরো দুইমাস তোমাকে ছাড়া থাকতে হবে? আমি পারছি না মিশু। আমার কষ্ট হয়।”
মিশুর জবাব পাওয়া গেলো না। কলটা হুট করেই হোল্ড হয়ে গেলো। মেঘালয় তিন মিনিট ফোন কানে ধরে রইলো, কল হোল্ড। ও রাগে ফোনটা গায়ের জোরে ছুড়ে মারলো। ফোনটা দেয়ালে লেগে ব্যাটারি খুলে বিছানার উপর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লো। মেঘালয় মেঝেতে বসে রাগে নিজের মাথার চুল নিজে ছিড়তে লাগলো। আজকে দিনে মিশুকে কাছে পাওয়ার পর ওভাবে সরিয়ে দিয়েছে সেই আঘাতটা এখন আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। মেঘালয় ও তো মানুষ, কত সহ্য হয়?
ও সায়ানকে কল দিয়ে বললো, “দোস্ত কই তুই? খাওয়ার মত কিছু আছে?”
– “মানে? কি খাবি?”
– “মাল খাবো মাল। মেজাজ খুব গরম, কিছু আছে?”
– “এত রেগে আছিস কেন? মিশুর সাথে কিছু হয়েছে?”
মেঘালয়ের বুকে সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ার মতন প্রশ্নটা এসে লাগলো। কিভাবে এর উত্তর দিবে ও? কতটা দহনে দগ্ধ হচ্ছে সে শুধু মেঘালয়ের ভেতর টাই জানে। বাবা মায়ের করা প্লানগুলোকে কিভাবে ধুলিসাৎ করবে ভেবে আরো খারাপ লাগছে। দুপুরে মিশুর কাছ থেকে তাচ্ছিল্য হওয়ার পর মেজাজ চরম খারাপ হয়ে আছে। মিশু কি ভেবেছে ওকে? ও কি বনের জন্তু? কিন্তু সায়ানকে কিছু বলতে পারলো না।
সায়ান বললো, “কি হইছে আমাকে বলবি না?”
– “বাসায় আংকেল আন্টি আছে?”
– “না। দুজনেই সিলেটে আছে। দুদিন থাকবে।”
– “আমি আসছি তোর বাসায়।”
মেঘালয় ওর বাবা মায়ের রুমে এসে বাবাকে বললো, “আব্বু, আমি সায়ানদের বাসায় যাচ্ছি। কখন আসবো বলতে পারছি না। আমার ফোন আছাড় দিয়েছি, দরকার হলে সায়ানের নাম্বারে কল দিও।”
বাবা মা অবাক হয়ে তাকালেন মেঘালয়ের দিকে। কি বলছে কিছুই বুঝতে পারছেন না ওনারা। মেঘালয়ের কি হলো হঠাৎ করে? এমন তো কখনো করেনা ও। ফোন আছাড় দেয়ার মত বাজে অভ্যাস ওর কখনোই ছিলোনা। ওনারাও চিন্তায় পড়ে গেলেন।
মেঘালয় বললো, “আমি একটু একা থাকতে চাইছি দুটো দিন। মিশু ফোন দিলে কি বলে শুনিও। আর মিশুকেই জিজ্ঞেস করো ও এখন ই বিয়ের জন্য প্রস্তুত কিনা?”
বাবা কিছু একটা বলতে যাবেন কিন্তু তার আগেই মেঘালয় এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরে বললো, “টেনশন করোনা আমার জন্য। শুধু দোয়া করো একটু। আমার মনের উপর দিয়ে খুব ঝড় বয়ে যাচ্ছে।”
আর কিছুই বললো না। সোজা বেড়িয়ে এসে গাড়ি নিয়ে সায়ানের বাসায় চলে এলো।
সায়ানকে সব কথা খুলে বলে অনেকটা হালকা লাগছে মেঘালয়ের। সায়ান নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে। চেয়ে আছে মেঝের দিকে। ওর বিশ্বাস ছিলো দুনিয়া উলটে গেলেও মিশু কখনো বদলাবে না। সেই মিশুই বদলে গেছে ব্যাপারটা কিছুতেই ও মেনে নিতে পারছে না। ভেতরে দহন শুরু হয়ে গেলো ওর ও। এটা কিভাবে সম্ভব!
মেঘালয় মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। সায়ান বললো, “নিশ্চয় ভালোমতো ঘুমাস না। আজকে আমার সাথে ঘুমা তো। আমাকে একটু ভাবতে দে। ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ মাইন্ডে একটা আলোচনা করা যাবে।”
মেঘালয় কিছু বললো না। ওর মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। গত একটা মাস ধরে একটু একটু করে মিশুর পরিবর্তন শুরু হয়েছে। প্রথমে বুঝতে পারেনি ও। বুঝতে পারার পর অনেকবার করে মিশুকে বলেছে তুমি আর আগের মত নেই। মিশু হেসেই উড়িয়ে দিয়েছে। আর এখন বললে অস্বীকার করছে কথাটা। কি করতে পারে ও এখন? চিন্তায় ঘুম আসবে না। তাই বেশ কয়েকটা স্লিপিং পিল খেয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলো। মাথাটাও একটু বিরতি চাইছিলো। শোয়ার পরপরই ঘুম এসে গেলো।
মেঘালয়ের ঘুম ভাংলো পরেরদিন দুপুর দুটার পর। সায়ান জানালো ওর আম্মু একবার ফোন দিয়ে খোজ নিয়েছে। মেঘালয় আশা করেছিলো মিশু একবার ফোন দেবে। কিন্তু মিশুর ফোন না পেয়ে একটু মন খারাপ ই হলো ওর। সায়ান খাবার নিয়ে এসে বলল, “আগে খা তারপর কথা বলি।”
মেঘালয় সায়ানের অনুরোধে একটু খাবার খেলো। তারপর দুই বন্ধু মিলে আলাপ করতে লাগলো কিভাবে মিশুকে সবকিছু বুঝিয়ে বলা যায়। সায়ান বললো, “যেভাবে পারিস ওকে একবার ট্যুরে নিয়ে যেতে হবে। প্রয়োজনে ঘুম পারিয়ে হলেও ওকে নিয়ে যেতে হবে। সিস্টেমে একবার ট্যুরে নিয়ে গেলে দেখবি একান্ত তোকে পেয়ে সব ভূলে গেছে।”
আইডিয়াটা বেশ পছন্দ হলো মেঘালয়ের। মিশুকে যেভাবে পারে ট্যুরে নিয়ে যেতে হবে। দরকার হলে মিথ্যে বলে নিয়ে যেতে হবে। কারণ প্রকৃতির কাছে গেলে ও একদম বদলে যায়। সেই বাচ্চা স্বভাবটা চলে আসে ওর মাঝে। এখন ওকে নিয়ে কোথাও একাকী ভাবে ঘুরতে গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। একান্তভাবে পেলে সবকিছু বুঝিয়ে বলা সম্ভব। তারপর বিয়েতেও রাজি করানো যাবে।
কোথায় যাওয়া যায় এসব নিয়েও প্লান করে ফেললো। এখন কিভাবে মিশুকে ট্যুরে নিয়ে যাবে সেটা ভাব্বার বিষয়। এটা নিয়েই চিন্তা করতে লাগলো দুই বন্ধু মিলে। মেঘালয়ের ফোন তো বাসায় পড়ে আছে, মিশু কি একবার ফোনও দেয়নি? খুব জানতে ইচ্ছে করছে। তবুও মনটাকে শান্ত করে বসে রইলো ও।
সারাদিন কোথাও বের হলোনা। রাতে বের হয়ে পূর্ব, আরাফ ও সায়ানের সাথে রেস্টুরেন্টে গিয়ে একটু আড্ডা দিলো। কাজের চাপে অনেক দিন বন্ধুদেরকে সময় দিতে পারেনি। অনেকদিন পর সবার সাথে কথা বলে বেশ ভালো হয়ে গেলো মনটা। কিন্তু সায়ান ছাড়া কাউকেই জানালো না মিশুর এই অদ্ভুত পরিবর্তনের কথা।
রাতে সায়ানের বাসাতেই ফিরলো। বাড়িতেও কল দিলোনা। সায়ানকে জানিয়ে রাখলো মা ফোন দিলে যেন কথা বলে রেখে দেয়। ও একটু একা থাকতে চায়। রুমে চুপচাপ শুয়ে শুয়ে মনে করছে সেই প্রথম দিনের কথাগুলো। রাতারগুলে গিয়ে পাগলিটা চাটনি বিক্রি করা শুরু করে দিয়েছিলো। কত সুন্দর ছিলো মিশু পাগলীটা। এখনকার মিশুটাকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না মেঘালয়। বুকটা দুমড়ে মুচড়ে যেতে চাইছে।
এমন সময় সায়ান এসে বললো, “মেঘ, Rj প্রয়াসের মান্থলি ইনকাম কত হয় রে?”
মেঘ একটু ভেবে বললো, “ও তো অনেক রকমের কাজ করে। এই দুই লাখের মত আসে।”
সায়ান হেসে বললো, “বাহ! আর তোর মাসে কত আসে?”
– “আমি তো সেভাবে হিসেব করিনি। সবকিছু শুধু দেখাশোনা করি। যখন যা লাগে বের করে নেই। ইনকামের ব্যাপারটা নিয়ে ভাবিনি কখনো।”
সায়ান এসে হাসতে হাসতে বললো, “এটাই স্বাভাবিক না? প্রয়াসের অনেক নাম যশ। হ্যান্ডসাম, সেলিব্রেটি, ফিল্ম টিল্ম করে। আরো কত কি!”
– “মানে? হঠাৎ ওর কথা জিজ্ঞেস করছিস কেন?”
সায়ান ওর ফোনটা এগিয়ে দিলো মেঘালয়ের দিকে। ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকানো মাত্রই মেঘালয় দেখতে পেলো প্রয়াসের আইডি থেকে ছবি আপলোড করা হয়েছে। সেই ছবিতে মিশু ওকে কেক খাইয়ে দিচ্ছে আর আশেপাশে অনেক লোকজন হাত তালি দিচ্ছে। ক্যাপশনে লিখেছে, “এই পুতুল বালিকাকে ছাড়া আমার বার্থডে একদম অসম্পূর্ণ থেকে যেতো।”
মেঘালয়ের মাথায় রক্ত উঠে গেলো যেন। ও সায়ানের ফোনটাই আছাড় মারতে যাচ্ছিলো। সায়ান ওকে থামালো। মেঘালয় কিছুতেই আর নিজেকে সামলাতে পারলো না। বিছানার উপর একটা পাওয়ার ব্যাংক ছিলো সেটা নিয়েই মেঝেতে ছুড়ে মারলো।
সায়ান মেঘালয়কে ধরে বলল, “কি পাগলামি করছিস?”
মেঘালয় ডুকরে কেঁদে উঠলো এবার। সায়ানকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “আমি আর সহ্য করতে পারছি না রে। আর পারছি না। একটা মাস ধরে আমাকে এভোয়েড করে যাচ্ছে মিশু। আমি সহ্য করতে করতে আর নিতে পারছি না। এতদিন তবুও নিজেকে সান্ত্বনা দিয়েছি। কিন্তু এটা দেখার পর আর পারছি না।”
সায়ান বললো, “কষ্ট পাস না। হতে পারে ওদের মাঝে কোনো রিলেশন নেই। মিশু হয়ত জাস্ট ফ্রেন্ডলি মেশে। যেহেতু একসাথে কাজ করে,একটা ভালো বন্ডিং ক্রিয়েট হতেই পারে। তুই মন খারাপ করিস না। ও তো তোর বউ।”
মেঘালয় চোখ মুছে বললো, “আমার এতটুকু বিশ্বাস আছে যে মিশু আর কারো সাথে এফেয়ারে জড়াবে না। কিন্তু আমি যে ওকে কোনো ছেলের সাথে দেখলে সহ্য করতে পারিনা। আমার মাথা খারাপ হয়ে যায়। এটা কি মিশু জানেনা? তবুও কেন প্রয়াসের সাথে মিশতে যাবে ও?”
সায়ান কিছু বলার মত ভাষা খুঁজে পেলোনা। মেঘালয়কে সান্ত্বনা দিয়ে বললো, “টেনশন করিস না। হয়ত এমনিতেই দাওয়াতে গেছে,প্রয়াসই হয়ত ওকে পছন্দ করে। এটা নিয়ে মন খারাপ করিস না।”
মেঘালয় একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, “মানলাম তোর কথাই ঠিক। কিন্তু অন্য কারো সাথে আমি ওকে মানতে পারিনা একদম ই। তুই কি জানিস আমাদের বিয়ের প্রথম রাতেই ওকে আমি থাপ্পড় মেরেছিলাম? ও তোদের সাথে ডান্স করেছিলো বলে। তোরা আমার সবচেয়ে আপনজন, তবুও আমি মেনে নিতে পারিনি। বাসর রাতে ঘরে ঢুকেই ও আমার থাপ্পড় খেয়েছে।”
সায়ান অবাক হয়ে তাকালো মেঘালয়ের দিকে।
মেঘালয় একটু থেমে আবারো বললো, “সায়ান রাগ করিস না। আমার প্রোগ্রামের দিন তোকে ওর হাত ধরে বসে থাকতে দেখে আমি সহ্য করতে পারিনি। অনেক কষ্টে গান গেয়েছিলাম। ওকে নিয়ে বাইরে আসার সময় তুই ওর কাঁধে হাত রেখেছিলি এটা দেখে আমার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। আমি কি করেছি জানিস? বাইরে বের হয়ে পাগলের মত বিহ্যাভ করছিলাম মিশুর সাথে। একবার বলছিলাম মেডিকেলে যাবো, একবার রিক্সা নিয়ে শিল্পকলা। আমার মেজো খালামণির সাথে চরম খারাপ আচরণ করেছিলাম সেদিন। বাসায় গিয়ে মিশুকে গলা টিপে মেরে ফেলতে চাইছিলাম শুধুমাত্র তোর সাথে ওভাবে দেখে। ওর জিভ বেড়িয়ে এসেছিলো এত জোরে টিপে ধরেছিলাম। ভাবতে পারিস?”
সায়ান অবাক হয়ে বললো, “মেঘ! তুই ওকে কতটা ভালোবাসিস আমাদের কারো অজানা নয়। ও ছোট মানুষ, হুট করেই নতুন পরিবেশ পেয়েছে তাই এরকম করছে। তুই প্লিজ মন খারাপ করিস না।”
– “আমি মরে যাবো রে ওকে ছাড়া। ও ছাড়া আমার দুনিয়াটা অন্ধকার।”
– “কিন্তু এখন ওকে এই ব্যাপার নিয়ে সিন ক্রিয়েট করে কোনো লাভ হবেনা। বরং ও আরো রেগে যাবে। যে বদলে যায়,তার মধ্যে কখনো এসব ন্যায় নীতি বোধ কাজ করেনা।”
মেঘালয় একটু ভেবে বলল, “আমি ওকে কিভাবে বুঝাবো? কি বললে বুঝবে ও?”
সায়ান কিছুক্ষণ গালে হাত দিয়ে বসে চিন্তা করলো। তারপর বললো, “ওকে বুঝাতে গেলেও ও ক্ষেপে যাবে। তখন উলটা তোর উপর রিয়েক্ট দেখাবে। বলতেও পারে আমি সেপারেশন চাই।”
– “কিহ!”
মেঘালয় দুহাতে মাথার চুল টেনে ধরে কান্না করে ফেললো। বললো, “আমার জগতের পুরোটাই ওকে দিয়ে দিয়েছি। সবখানে শুধু মিশু রাজত্ব করে। ওকে ছাড়া আমি থাকবো কিভাবে? আমাকে খুন করে ফেললেও এতটা কষ্ট হবেনা যতটা ওকে ছেড়ে দিতে হবে। আমি কি করবো এখন? কিছুই মাথায় আসছে না।”
সায়ান মেঘালয়কে জড়িয়ে ধরে রইলো কিছুক্ষণ। প্রখর আত্মমর্যাদা সম্পন্ন মেঘালয় আজ নিতান্তই নিঃস্ব হয়ে গেছে। বড্ড অসহায় দেখাচ্ছে ওকে। এই মেঘালয় একজন সত্যিকার প্রেমিক,একজন সত্যিকার ভালোবাসার মানুষ। যে তার ভালোবাসা ছাড়া অসহায়। কিভাবে কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। সায়ান নিজে একবার কথা বলবে কি মিশুর সাথে?
মেঘালয় বললো, “আমার মাথা কাজ করছে না। কিছু খেতে হবে। ড্রিংকস করবো।”
– “পাগলামো করিস না তো। ভাব আর একটা উপায় বের কর। সবকিছুর আগে জানতে হবে মিশু প্রয়াসের সাথে কোনো রিলেশনশিপে গেছে কিনা।”
– “প্লিজ এই কথা বলিস না। প্রয়াসকে খুন করে ফেলবো আমি।”
– “শান্ত হ দোস্ত।”
মেঘালয় কে অনেক সান্ত্বনা দিচ্ছে সায়ান। তবুও মেঘালয় কিছু বুঝতে চাইছে না। ওর খুব কষ্ট হচ্ছে। মিশুকে ছাড়া কিচ্ছু ভাবতে পারছে না ও।
মেঘালয় বললো, “আম্মু আব্বুকে এটা কিছুতেই বলা যাবেনা। ওরা ওদিকে বিয়ের প্লান করছে। আমি বলেছিলাম দশ দিনের মধ্যে এরেঞ্জ করতে। সেজন্য মামা চাচাদেরকেও ফোনে জানিয়ে দিয়েছে। সবাই এসে যাবে দুদিনের মধ্যে। কি করি এখন বল? এখন যদি মিশু বলে দেয় আরো সময় চাই,তখন বাবা মা কষ্ট পাবেনা?”
– “তা তো পাবেই। এটা তো আর রিলেশন নয় যে ব্রেকাপ করবি।”
মেঘালয় বললো, “রিলেশনের ব্রেকাপ হয়, স্বামী স্ত্রীর ডিভোর্স হয়। কিন্তু ভালোবাসার কখনো ব্রেকাপ হয়না রে। এটা আজীবন থাকে। আমি ওকে ভালোবাসি, প্রচণ্ড ভালোবাসি।”
সায়ান নিশ্চুপ। এরকম পরিস্থিতি আসবে সেটা ভেবে ও আগেই ভয় পেয়েছিলো। তবে ও ভেবেছিলো মেঘালয় বদলে যাবে। মিশু বদলে যাবে এটা ওর কল্পনাতীত ছিলো। এখন মেয়েটার মনে কি চলছে বুঝে আসছে না ওর।
মেঘালয় হঠাৎ উঠে বাথরুমে চলে গেলো। ফ্রেশ হয়ে এসে বললো, “আমি একটু বের হবো।”
-“কই যাবি?”
মেঘালয় কোনো উত্তর দিলো না। চুপচাপ বসে ভাবতে লাগলো। কি যেন ভাবছে গভীর মনোযোগ দিয়ে। সায়ান ওর দিকে বারবার তাকাচ্ছে কিন্তু কিছু বলার সাহস পাচ্ছে না। মেঘালয় উঠে দাঁড়িয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললো, “আমি মিশুর কাছে যাচ্ছি।”
সায়ান চমকে উঠলো- “এত রাতে?”
– “হুম।এবার আমি কি করি তাই দ্যাখ। আমার অবহেলা সহ্য হচ্ছেনা।”
সায়ান তাকিয়ে রইলো মেঘালয়ের দিকে। মেঘালয়ের চোখেমুখে যেন আগুন ঝরছে। ও বাসা থেকে বেড়িয়ে গাড়ি নিয়ে দ্রুত মিশুর বাসার দিকে রওনা দিলো।
চলবে..

অনুভূতি
পর্ব ৪৯
মিশু মনি
.
৭৮.
মিশু একটু আগেই ঘুমিয়েছে। কলিং বেলের শব্দে ঘুম ভাঙায় একটু বিরক্ত হলো। দরজার ফুটো দিয়ে দেখলো মেঘালয় এসেছে। ও দরজা খুলে দিয়েই চোখ কচলাতে কচলাতে বললো, “এত রাতে!”

মেঘালয় আচমকাই কোলে তুলে নিলো মিশুকে। তারপর দরজা লাগিয়ে দিয়ে সোজা রুমে চলে এলো। রুমের দরজা লাগিয়ে দিয়েই মিশুকে দরজার উপরেই ঠেস দিয়ে ধরলো দুহাতে। মিশু পরে যাচ্ছিলো বলে ওর কোলে বসেই দুহাতে গলা জড়িয়ে ধরতে বাধ্য হলো। মেঘালয় ওকে দেয়ালে ঠেস দিয়ে দুহাতে শক্ত করে মাথাটা চেপে ধরে মিশুর নিচের ঠোঁটটা নিজের দুই ঠোঁটের ভেতরে নিয়ে নিলো।

মিশু মেঘালয়ের এমন আকস্মিক আক্রমণে খেই হারিয়ে ফেলেছে। থতমত খেয়ে গেছে একদম। গতকাল থেকে কোনো ফোনও দিলোনা। আজ এমন মাঝরাতে হুট করে এসেই এমন আকস্মিক হামলা করলো যে বাঁধা দেয়ার ও সুযোগ নেই। মিশুর এখনো ঘুমের ঘোরই কাটেনি। ও দুহাতে মেঘালয়ের গলা জড়িয়ে ধরে রইলো। মেঘালয় একটা হাত ওর কোমরে রেখে খুব জোরে চাপ দিতে লাগলো। আস্তে আস্তে হাতটা একটু একটু করে উপরে তুলছে আর জোরে চেপে ধরছে। এতদিনের সমস্ত অবহেলা আর যন্ত্রণার অবসান এভাবেই ঘটাতে চাইছে ও। সমস্ত কষ্টেরা যেন নির্বাসন নিচ্ছে এই রাগের মধ্য দিয়ে।

মিশু ওর স্পর্শে ক্রমশই অস্থির হয়ে উঠছে। একটানা অনেক্ষণ ধরে চুম্বনের পর মুখটা ছেড়ে দিলো মেঘালয়। মিশু ওর বুকে মাথা গুঁজে দিয়ে বিড়বিড় করে বললো, “এটা কি হলো? এভাবে এসে…”

মেঘালয় হেসে বললো, “হুট করে ফিরে এসে লুট করে নিয়ে যাবো। বলেছিলাম না একদিন?”
-“যাও দুষ্টুটা।”

মেঘালয় মিশুকে আরো জোরে ঠেস দিয়ে ধরলো। তারপর জিজ্ঞেস করলো, “প্রয়াসের আইডিতে এটা কি দেখলাম?”
-“আমরা সবাই ওনার বার্থডেতে গিয়েছিলাম। কিন্তু ওই লোকটা একান্ত আমাকেই হাইলাইট করবে আমি ভাবিনি।”

মেঘালয় খুব জোরে মিশুর পেটে চাপ দিয়ে ধরে বললো, “আমার সহ্য হয়না অন্য কাউকে। জানিস না তুই? আজকে তোকে খুন করেই ফেলবো আমি।”

বলেই মিশুকে বিছানার উপর ফেলে দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো ওর উপর। কিন্তু এরপর মিশু যা করলো সেটার জন্য একদম ই প্রস্তুত ছিলোনা মেঘালয়। মিশু মেঘালয়ের ঘাড়ে জোরে কামড় দিয়ে একেবারে দাগ বসিয়ে দিলো। মেঘালয় মুখ তুলে বললো, “এরকম হিংস্র কামড় দিচ্ছো কেন?”
-“তুমি এত হিংস্র জানোয়ারের মতন বিহ্যাভ কেন করছো?”

মেঘালয় রেগে বললো, “কি বললা তুমি? এতদিন ধরে আমাকে দগ্ধ করতে করতে আজকে আমাকে জানোয়ারের সাথে কম্পেয়ার করছো?”
-“আমি তোমাকে দগ্ধ করিনি কখনো। তুমি অযথাই আমাকে ভূল বুঝলে আমার কিছু করার নেই। এখন আমাকে ছাড়ো তো। এভাবে চেপে ধরলে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে।”

মেঘালয় আরো জোরে মিশুকে চেপে ধরে বললো, “দম বন্ধ হয়ে মরে যাও। আমাকে কেন দূরে রাখো তুমি?”
-“মেরেই ফেলো তো আমাকে। আমি মরলেই যেন তোমার কত শান্তি।”

মেঘালয় হুট করেই ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। মিশু সীমা অতিক্রম করে ফেলেছে এবার। বারবার মেঘালয়কে এভাবে সরিয়ে দেয়ার পরিণাম কতটা ভয়ংকর হবে ভাবতেও পারেনা ও। মেঘালয়কে কি মানুষ মনে হয়না? এটা রীতিমত অপমান। মেঘালয়ের ভেতরটা কিভাবে পুড়ছে সেটা কি ধরতে পারছে না ও? একমাস যাবত এভোয়েড করে দুবার ওকে সরিয়ে দিলো কাছ থেকে। একদিন পস্তাতে হবে এসবের জন্য।

মেঘালয় বিছানা ছেড়ে নেমে এসে বললো, “আর কখনো তোমাকে ছুঁয়েও দেখবো না। সারাক্ষণ ফোন দেই,আমাকে ব্যস্ততা দেখাও। একটা মাস হলো আমাকে নিজে থেকে ফোন দাওনা। আমি যতরাতেই দেই,তুমি টায়ার্ডনেস দেখিয়ে ঘুম দাও। আরে আমি সারাদিন কত ছুটাছুটি করে, পরিশ্রম করে ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরে ওয়েট করি তোমার সাথে একবার কথা বলার জন্য। আর তুমি আমাকে ব্যস্ততা নামক অজুহাত দেখাও। আমার স্পর্শ আজকাল অসহ্য লাগে? সেজন্য কাছে টানলেই আমাকে অপমান করে সরিয়ে দাও? আমাকে তো খুব বিরক্ত লাগছে তাইনা? এই মেঘালয় আর কক্ষনো বিরক্ত করবে না তোমাকে। কক্ষনো বিরক্ত করবে না।”

কথাটা বলেই দ্রুত হেঁটে মেঘালয় বাসা থেকে বেড়িয়ে এলো। মিশু বিছানায় বসে রইলো থ হয়ে। মাঝরাতে কি থেকে কি হয়ে গেলো কিছুই বুঝতে পারছে না ও। মেঘালয় এভাবে মন খারাপ করে চলে গেলো! সবকিছু কেমন যেন ঘোর ঘোর লাগছে ওর। বুকের ভেতর চিনচিন ব্যথা অনুভূত হতে শুরু করলো।

মেঘালয় বাসা থেকে বেড়িয়ে গাড়ি চালাতে লাগলো খুব জোড়ে। ওর চোখেমুখে আগুন ঝরছে। মিশুর এই আমূল পরিবর্তন মেনে নেয়ার মত নয়। মেঘালয় আর কিছুই করবে না। যে নিজে পরিবর্তন হয়েছে,সে নিজ দায়িত্বেই ঠিক হয়ে যাবে। মেঘালয়কে হারানোটা কত বড় অপ্রাপ্তি ঠিকই বুঝবে ও। এখন শুধু সময়ের ব্যাপার।
মিশু অনেক্ষণ ঝিম মেরে বসে রইলো। তারপর বালিশে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লো।

৭৯.
সকালে ঘুম ভাঙল অনেক বেলা করে। উঠে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা খেয়ে নিলো। আজকে রেডিওতে প্রোগ্রাম নেই। বিকেলে ফটোগ্রাফি এক্সিবিশনের অনুষ্ঠানে উপস্থাপনা করতে হবে। এখন কি করা যায় তাহলে? মেঘালয়কে কি একবার কল দেবে? এরপর ই রাতের ঘটনাটা মনে পড়ে গেলো। মেঘ বুঝি রাগ করেছে খুব। অত গভীর ভাবে কিছু ভাবলো না মিশু। মনেমনে বললো, “মেঘ তো আমাকে ছাড়া থাকতেই পারবে না। ঠিকই একটু পরেই কল দেবে। জগতের সমস্ত নিয়ম ভেঙে যাবে তবুও মেঘালয় আমাকে ছাড়া একটা মুহুর্ত থাকতে পারবে না।”

এটা ভেবে নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে ইয়োগা করতে আরম্ভ করলো। মেডিটেশন করলো অনেক্ষণ ধরে। বেশ মানসিক প্রশান্তি লাগছে। মেঘালয় দারুণ একটা জিনিস শিখিয়ে দিয়েছে। টেনশন হলে একবার মেডিটেশনে বসলেই সমস্ত টেনশন উধাও হয়ে যায়। ছেলেটা এত ভালো! মিশু একবার হাসলো মনেমনে। সত্যিই ছেলেটা অনেক ভালো। এত ভালোবাসে কেউ কখনো! মেঝেতে বসেই এসব ভেবে ভেবে হাসছিলো।

ফোন বেজে উঠলো মিশুর। ও স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখলো প্রয়াস ফোন দিয়েছে। রিসিভ করে বললো, “হ্যালো।”
-“মিশু, গুড মর্নিং।”
-“গুড মর্নিং, কালকে আপনি ক্যাপশনে ওটা কি লিখেছেন? আর আমাকেই কেন এভাবে হাইলাইট করলেন?”
-“উম,রাগ করেছো?”
-“সেটা নয়। আমার ফ্যামিলি মেম্বারের কাছে আমাকে জবাবদিহি করতে হয়েছে।”
-“ওহ, সরি। একটু বুঝিয়ে বলোনা। এটা আর এমন কি ব্যাপার? সবার কমেন্ট গুলো দেখেছো? আমাদের জুটিটাকে নাকি খুব সুন্দর মানিয়েছে।”
-“কিসের জুটি?”
-“হা হা হা। রেগে যাচ্ছো? আরে সবাই ভাবছে আমরা একে অপরকে.. বুঝোই তো। আমার আম্মুর ও নাকি তোমাকে খুব পছন্দ হয়েছে। আম্মু বলছে আরেকবার তোমাকে বাসায় নিয়ে আসতে।”
মিশুর মেজাজ চড়ে গেলো। বললো, “আমি ব্যস্ত এখন। ফোন রাখছি।”

ফোন রেখে রাগে ফুঁসতে লাগলো মিশু। প্রয়াসের সাথে ওর সেরকম কোনো সম্পর্ক নেই। কেবলমাত্র কলিগ হিসেবেই দেখে মিশু। কিন্তু লোকটা ওকে খুব পছন্দ করে। একটু একটু স্বপ্নও দেখতে শুরু করেছে। মিশু জানেনা এসব। ওর বার্থডে তে সব কলিগ মিলে গিয়েছিলো কিন্তু মিশুকে নিয়েই লোকটা এত মাতামাতি করেছে। কয়েকটা ছবি আপলোড দিয়েছে।

মিশু মনেমনে বললো, “আমার পক্ষে কাউকে ভালোবাসা সম্ভব নয় কারণ আমি শুধুই মেঘালয়ের। অপরপাশের মানুষটা তাকে নিয়ে কি ভাবছে সেটা না জেনেই এই লোকগুলা এমন মাতামাতি করে যে মেজাজ গরম হয়ে যায়। আমার জগতে মেঘালয় ছাড়া আর কেউ থাকতে পারেনা। আর কক্ষনো কথা বলবো না এই লোকটার সাথে। সকাল সকাল মেজাজ খারাপ করে দিলো।”

মিশু মুখে ফেসপ্যাক লাগিয়ে বসে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর উঠে শাওয়ার নিয়ে এসে লাঞ্চ সেরে নিলো। দুপুর পেরিয়েছে। একটু পরেই বের হবে এক্সিবিশনে যাওয়ার জন্য। গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে রেডি হয়ে নিলো। তারপর বেড়িয়ে পড়লো বাসা থেকে।

প্রোগ্রাম খুব ভালোভাবেই শেষ হলো। রাত নয়টার দিকে বাসায় ফিরলো মিশু। বাসায় এসে চেঞ্জ করে শাওয়ার নিলো। তারপর খাবার টেবিলে এসে একটা আপেল নিয়ে কামড়াতে কামড়াতে টিভিটা ছেড়ে দিয়ে বসলো। রৌদ্রময়ী কদিন হলো আলাদা বাসায় উঠেছে। ওর বিয়ের কথাবার্তা হচ্ছে পূর্ব’র সাথে। বাসায় একদম একা মিশু। এই মুহুর্তে হুট করেই খুব একা একা লাগতে শুরু করলো।

হঠাৎ ই মনটা কেমন বিষণ্ণতায় ছেয়ে গেলো। রাত ১২ টা বেজে গেছে। ফোনের দিকে কয়েকবার তাকালো মিশু। আজ সারাদিনে ফোনটা বারবার বাজলো না কেন? মেঘালয় দিনে কয়েকবার কল দেয়,আজকে একবার ও দিলো না কেন? ফোনটা এখনো বেজে উঠছে না কেন?

মিশু এসে ফোন হাতে নিয়ে মেঘালয়ের নাম্বারে কল দিলো। ফোন আনরিচেবল শুনেই বুকটা ধক করে উঠলো ওর। সারাদিন একবার ও কল দিলোনা এখন আবার বন্ধ! মিশুর বুকটা চিনচিন করে উঠলো। পুরো বাড়িটা একা, আজ রোদও নেই। মেঘালয় ফোনও দিচ্ছেনা,কেমন যেন একাকীত্ব ভর করলো এসে। মিশু একটা টেক্সট পাঠালো মেঘালয়ের নাম্বারে, “phone bondho keno?”

মেসেজ সাকসেস হলোনা। মিশু মেসেজ বক্সের মেসেজ গুলো দেখতে লাগলো। মেঘালয় দুদিন আগে দিয়েছে, “mishu emon behave keno korcho amar sathe?”
“tomar ki hoyeche bolba please?”
“kono karone amar upor rege acho tumi? tomar vetor kichu niye confusion cholche? ki hoiche bolba amk?”

এরকম প্রায় ত্রিশটা মেসেজ যেসবের সারমর্ম হচ্ছে মিশুর কিছু হয়েছে কিনা? মিশু কেন চেঞ্জ হয়ে যাচ্ছে? আর মেঘালয়কে কেন কষ্ট দিচ্ছে? প্রশ্নগুলো মাথায় নিয়ে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালো মিশু। নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করলো, “আসলেই কি আমি বদলে গেছি?”

আয়না দেখে নিজেই চমকে উঠলো। সত্যিই আয়নায় নিজের যে প্রতিবিম্ব ও দেখছে সেটা সত্যিকার মিশু নয়। এটা নকল মিশু। এই মিশু কৃত্রিম,অনেক রংচং মেখে বানানো। এটা মেঘালয়ের মিশু নয়। মেঘালয়ের কষ্ট পাওয়াটা কি স্বাভাবিক নয়?

মিশুর বুকের চিনচিন ব্যথাটা আরো বেড়ে গেলো। খুব খারাপ লাগছে ওর। কিন্তু এই পরিবর্তন কিভাবে কোথ থেকে হলো ও কিছুই বুঝতে পারেনি। মনমরা হয়ে আয়নার পাশের সোফায় বসে রইলো অনেক্ষণ। ফোন হাতে নিয়ে কয়েকবার কল দিলো মেঘালয়ের নাম্বারে, কিন্তু বন্ধ পাচ্ছে। কেন যেন একবার সরি বলার প্রয়োজন অনুভব করছে মিশু। কিন্তু ওর নাম্বার তো বন্ধ।

ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে গেলো অনেক রাতে।

পরদিন ঘুম ভাংলো অনেক দেরিতে। আজকে সকালেই প্রোগ্রাম আছে। রেডি হয়ে নাস্তা করে কাজে চলে গেলো। কাজের মাঝে কিছু মনে হয়নি। কিন্তু কাজ থেকে বাসায় এসে ফোন নিয়ে দেখলো মেঘালয় একবার ও কল দেয়নি। মিশুর এবার সত্যি সত্যি চিন্তা হচ্ছে। বিকেল হয়ে গেলো, দুদিন ধরে মেঘ কল দিচ্ছেনা। তবে কি সত্যি সত্যিই রাগ করেছে ও?

মিশু চিন্তায় ভেঙে পড়লো। মেঘালয় ফোন দিচ্ছেনা কেন? সত্যিই সেদিন রাতে কষ্ট পেয়েছে? মিশু অনেকবার কল দিয়েও নাম্বার বন্ধ পেলো। তারপর বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলো সেদিন রাতে আসলেই কেমন আচরণ করেছে মেঘালয়ের সাথে। কথাগুলো মনে করার চেষ্টা করতেই সব স্পষ্ট ভেসে উঠলো চোখের সামনে। সব মনে পড়ে যাচ্ছে আর বুক ফেটে কান্না বেড়িয়ে আসতে চাইছে।

মিশুর এতদিনের সব অন্যায় আচরণের কথা মনে করে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে। মেঘালয় যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে বলেই এটা সম্ভব হয়েছে। নয়ত নিজের ভূলগুলো বোঝার সাধ্য ওর কখনোই হতোনা। সত্যিই মেঘালয়ের শূন্যতা খুব করে অনুভব করছে ও। মেঘালয়কে ছাড়া একটা দিনও চলবে কি? ও কোথায় এখন? ফোন দিচ্ছেনা কেন?

মিশু মেসেঞ্জার, হোয়াটস এপ সবখানেই মেসেজ পাঠিয়ে রাখলো। চারদিন আগে একটিভ ছিলো। বাসায় তো ওয়াইফাই আছে, মেঘালয় কি তাহলে বাসায় নেই? কিছুই মাথায় আসছে না মিশুর।

থাকতে না পেরে মেঘালয়ের মায়ের নাম্বারে কল দিলো। দুবার রিং হলো কিন্তু কেউ রিসিভ করলো না। মিশুর বুক ফেটে যাচ্ছে। চার পাঁচদিন আগে আংকেল আন্টি বিয়ের কথা বলেছিলেন। মিশু কিছুদিন সময় চেয়েছিলো বলেই কি ওনারাও রেগে গেছেন? মা ছেলে সবাই মিলে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়ে বসে আছে। মিশুর এ শহরে আর কে আছে ওনারা ছাড়া? একমাত্র মেঘালয় ছাড়া আর আপন বলতে ওর কেউ নেই। মেঘালয় কোথায়?

মিশু অনেকবার কল দিলো মেঘালয় আর ওর মায়ের নাম্বারে। ওর বাবার নাম্বারে কল দিয়ে দেখলো নাম্বার বন্ধ। টেনশন মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। খুবই অসহায় লাগছে নিজেকে। কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়লো মিশু।

৮০.
পরদিন সকালের প্রোগ্রাম শেষ করেই মিশু মেঘালয়ের বাসায় চলে এলো। এসে মেঘালয়ের মাকে দেখেই নিজেকে সামলাতে পারলো না। ছুটে এসে ওনাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। কাঁদতে কাঁদতে বললো, “আম্মু আমাকে মাফ করে দাও। আমাকে মাফ করে দাওনা প্লিজ।”

মিশুর এরকম কান্নার কারণ বুঝতে না পেরে উনি জিজ্ঞেস করলেন, “কি হইছে মিশু?”
মিশু অবাক হয়ে বললো, “আপনি জানেন না কি হয়েছে?”
– “না তো। মেঘ তো কিছুই বলেনি।”
– “রাতে অনেকবার কল দিলাম আপনার নাম্বারে, ধরলেন না কেন তাহলে?”
মা বললেন, “আমার নাম্বার সাইলেন্ট করে ঘুমিয়েছিলাম।”
– “বাবার নাম্বার বন্ধ পেলাম কেন? সবাই আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়ে বসে আছেন?”
-“আকাশ তো রাতে ফোন বন্ধ করে ঘুমায়। সকালে কল ব্যাক করতে চাইলাম, পরে ভাবলাম তোর তো এই সময়ে প্রোগাম থাকে তাই আর কল দিইনি।”

মিশু ওনাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে গেলো, “আম্মু মেঘ আমার সাথে খুব রাগ করেছে। তিনদিন ধরে আমাকে ফোন দেয়না। ওর নাম্বার ও বন্ধ।”
মা মিশুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, “আমি জানিনা তোদের মাঝে কি হয়েছে। তবে মেঘালয় যখন এসে বলল বিয়ে ক্যানসেল করে দাও তখনি ভাবলাম হয়ত ব্রেকাপ হয়ে গেছে তোমাদের। মেঘালয় আর কিছুই বলেনি। ওর ফোন রুমে পড়ে আছে। ও কোথায় গেছে কিচ্ছু বলে যায়নি।”

মিশু কান্নায় ভেঙে পড়লো। বিয়ের ব্যাপারটা ডিনাই করার কারণেই মেঘালয় আরো বেশি কষ্ট পেয়েছে। ব্রেকাপ কি করে হবে? স্বামী স্ত্রী’র মাঝে তো ব্রেকাপ হয়না। এটা তো মাকে বলা সম্ভব না। তবে সবমিলিয়ে পাহাড় সমান কষ্ট দিয়ে ফেলেছে মেঘালয়কে। এখন কি হবে? কেউই জানেনা মেঘালয় কোথায় আছে!

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here