অনুভূতি,পর্ব-৪৬+৪৭

অনুভূতি
পর্ব ৪৬
মিশু মনি
.
৭৩.
খুব সকালেই ঘুম ভাংলো সবার। পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় উপভোগ করা হলো। সাজেকের সৌন্দর্য দুহাতে ভেতরে গ্রহণ করলো সবাই। ক্ষণিকে ক্ষণিকে রূপ বদলায় সাজেক। এখনি সবকিছু সুন্দর স্পষ্ট, একটু পরেই আবার মেঘে ছেয়ে যায়। কুয়াশার মত মেঘ এসে গা ভিজিয়ে দেয়,আবার কখনো হুট করেই নেমে পড়ে বৃষ্টি। হেলিপ্যাডের সূর্যাস্ত, সূর্যোদয় সবই উপভোগ করা হলো। এখন চলে যেতে হবে ভেবে মিশুর মনটা একদম খারাপ হয়ে গেছে।
মেঘালয় ওকে খুব করে বোঝালো যে আবারো ওকে নিয়ে আসবে কিন্তু কিছুতেই ওর মুখে হাসি ফুটলো না। খুব কষ্ট পাচ্ছে মেয়েটা। লেগুনায় পুরোটা পথ ছাদের উপর বসে মেঘালয় শক্ত করে ধরে রইলো ওকে। সাজেক থেকে ফেরার পথে দীঘিনালা ঝুলন্ত ব্রিজ ও দীঘিনালা বনবিহার দেখে তারপর খাগড়াছড়ি ফিরলো। মিশু এখনো মুখ গম্ভীর করে বসে আছে। আসার সময় কত আনন্দ হচ্ছিলো আর যেতে হচ্ছে মনখারাপ করে। সারাজীবন যদি পাহাড়ের উপর বসেই কাটিয়ে দেয়া যেতো!
খাগড়াছড়ি থেকে বাস ছাড়লো রাত্রিবেলা। বাসে উঠেই মেঘালয়ের বুকে মাথা রেখে আরামের ঘুম দিলো মিশু। মেঘালয় ধরে রইলো ওকে। মেয়েটা এখনো বড় হলোনা,কোথাও গেলে আর ফিরতে চায়না কিছুতেই। এই মন খারাপের রেশ আরো কিছুদিন থাকবে ওর। খুব দ্রুত আরেকটা ট্যুরের ব্যবস্থা করতে হবে মনেহচ্ছে।
রোদ পূর্ব’র কাঁধে মাথা রেখে বসে আছে। পূর্ব ওর জীবনের নানান গল্প শুনাচ্ছে আর ও মুগ্ধ হয়ে শুনছে। পূর্ব বলেছে এখন থেকে রোজ দেখা হবে ওর সাথে। সকালে রোদকে অফিসে নামিয়ে দিয়ে যাবে আবার সন্ধ্যার আগে ওকে নিয়ে বাসায় পৌছে দেবে। নতুন এক সুখাস্পর্শে মুখরিত হয়ে উঠছে রোদ।
নিখিল ও দুপুরের প্রথম হানিমুন বেশ সুন্দর কাটলো। ওরা একে অপরকে হারানোর পর আবারো পেয়ে কি পরিমাণ সুখী হয়েছে তা শুধু ওরাই জানে। একে অপরকে নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসে যে!
৭৪.
দেখতে দেখতে ছয় মাস কেটে গেলো।
মিশু বেশ জনপ্রিয় রেডিও জকি হয়ে উঠেছে। মিডিয়ার জগতে নতুন পা দেয়ার পরও দ্রুত এত ভালো প্রোগ্রাম ম্যানেজমেন্ট করতে শিখবে এটা মেঘালয় কল্পনাও করেনি। ওর যেকোনো কাজ শেখার ক্ষমতা ভালো। মেধাকে দারুণ কাজে লাগাতে পারে মেয়েটা। রেগুলার ভার্সিটিতে যাওয়া আসা, প্রোগ্রামে আসা, টুকটাক ঘুরতে যাওয়া, আর কাজের ব্যস্ততার মধ্য দিয়েই ওর দিন কাটছে।
মেঘালয়ের নতুন এলবাম বেড়িয়েছে আর রেডিওতে গান করছে। গানের প্রতি ঝোক কমে এসেছে মেঘালয়ের। মিশু মিডিয়ায় পা দেয়ার পর থেকে ও এসব কাজের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। দুজনেই সেলিব্রেটি হয়ে গেলে সমস্যা। মিশু ক্যারিয়ারে দ্রুত উঠছে যখন, উঠুক। ইদানীং টিভির প্রোগ্রামে উপস্থাপনার কাজ করছে মেয়েটা। বেশ অফার পাচ্ছে কাজের। মোটামুটি জনপ্রিয় দুটো প্রোগ্রামে উপস্থাপনা করেছে। সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকে ও।
মেঘালয় গান কমিয়ে দিয়ে বাবার বিজনেসে মন দিয়েছে। একমাত্র ছেলে,সব দায়িত্ব ওকেই নিতে হবে। সারাদিন অফিসে কাজ দেখাশুনা করে ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরে যখন মিশুকে ফোন দেয়,
মিশু রিসিভ করে বলে, “আমি এখনো বাইরে। বাসায় ফিরে ফোন দিবো।”
মেঘালয় ফোন কেটে দিয়ে অপেক্ষা করে। অনেক্ষণ সময় পেরিয়ে যায় তবুও মিশুর কল আসেনা। ও আবারো কল দেয়। মিশু রিসিভ করে বলে, “মাত্র বাসায় ঢুকলাম, ফ্রেশ হয়ে ফোন দিচ্ছি।”
মেঘালয় ক্লান্ত শরীরে শুয়ে অপেক্ষা করে ওর ফোনের জন্য। তবুও কল আসেনা। দেখতে দেখতে ঘন্টাখানেক পার হয়ে যায়। মেঘালয় অস্থির হয়ে ওঠে। কথা না বললে ঘুমও আসেনা। ও একবার কথা বলার জন্য কল দেয় মিশুকে। মিশু রিসিভ করে ঘুম জড়ানো গলায় বলে, “ঘুমাচ্ছি। কাল ফোন দিও। খুব টায়ার্ড আমি। এখন ঘুমুতে দাও।”
মেঘালয় কল কেটে দিয়ে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। অপলক ভাবে অনেক্ষণ তাকিয়ে থাকে। স্ক্রিনে মিশুর উচ্ছল ছবি। ওর ছবির দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। ওর জায়গায় মিশু থাকলে নির্ঘাত কান্না করে দিতো। ও তো ছেলে,তাই কাঁদতে পারেনা। গত দুটো সপ্তাহ ধরে প্রতিটা রাতেই এরকম করছে মিশু। মেঘালয় ওর বাসায় যেতে চায়,সেটাও বারণ করে দেয়। ব্যস্ততার অজুহাত দেখায়। সারাদিন কাজ করে ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফেরার পর সারারাত জেগে মেঘালয়কে সময় দেয়ার মত এনার্জি নাকি থাকেনা আর। মেঘালয় কিছুই বলেনা,শুধু ওর এই নিশ্চুপ বদলে যাওয়া দেখে যায়।
যেই মেয়েটা ছয় মাস আগেও একটা রাত ফোন না দিলে কান্নায় ভেঙে পড়তো, আজ তার কথা বলার মত সময় নেই। যে মেয়েটা পুরো সপ্তাহ অপেক্ষা করে বসে থাকতো মেঘালয় কবে আসবে, যেদিন মেঘালয় ওর কাছে আসতো সেদিন বিকেল থেকেই সাজগোজ করে বসে থাকতো। আজ সেই মেয়েটা পনের দিন ধরে দেখা না করেই আছে। একবার ভিডিও কল দিয়ে মুখটা দেখানোর মতন সময়ও নাকি নেই! মানুষ উপরে উঠে গেলে কি এমন ই হয়? কই মেঘালয় যখন সাধারণ একটা ছেলে থেকে একজন জনপ্রিয় শিল্পী হয়ে উঠলো,যখন প্রতিটা পত্রিকায় ওর মাউন্টেইনিয়ারিং এর ছবি ছাপা হলো তখন তো মেঘালয় একটুও বদলায় নি। বরং মিশুর ভালোর জন্যই গান গাওয়া কমিয়ে দিয়েছে ও। আর সেই মিশুই কিনা…!
রাত একটা থেকে দুটো, দুটো থেকে আড়াইটা বেজে গেলো। নার্ভগুলো ধীরেধীরে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে। ঘুমে চোখ বুজে আসছে মেঘালয়ের। ফোনটা হাত থেকে পড়ে গেলো। ঘুমিয়ে গেলো আস্তে আস্তে।
বাইরে বৃষ্টি নেমেছে। খুব বাতাস হচ্ছে। মেঘালয়ের মা এসে দেখলেন রুমের দরজা খোলাই আছে। মেঘালয় জানালা খোলা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। উনি এসে রুমের জানালা লাগিয়ে দিলেন। মেঘালয়ের গায়ের উপর চাদর টেনে দিলেন। ছেলেটাকে খুবই মায়াবী দেখাচ্ছে। নিজের খেয়াল রাখেনা ঠিকমত, একটুও সেজেগুজে বাইরে যায়না। গত কয়েকদিন থেকে চুল ও আচড়ায় না ঠিকমত। মা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।
রুমে এসে মেঘালয়ের বাবাকে বললেন, “একটা কথা বলবো?”
আকাশ আহমেদ ঝড়ের শব্দে উঠে বসেছেন। উনি কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “হুম বলো।”
– “বলছি যে, মেঘ তো এখন বিজনেসে ভালোই মন দিয়েছে। ওর তো পড়াশোনাও শেষ। এখন কি বিয়েটা দেয়া যায়না ওর?”
উনি চমকে তাকালেন স্ত্রীর দিকে। বিয়ের কথাটা একদম ই মাথায় আসেনি ওনার। মাথাটা ঝাঁকিয়ে বললেন, “মেঘ কি এখনি বিয়ে করতে চায়?”
– “না চাওয়ার কি আছে? ওকে তো আর কষ্ট করে চাকরী নিতে হবেনা। গান করছে,বিজনেস করছে। এখন বিয়েটা দিয়ে দাও।”
– “হুম, জিজ্ঞেস করে দেখি কি বলে।”
মা বললেন, “যাই বলুক ওকে বিয়ের তাগাদা দিতে হবে। মিশুর সাথে প্রায় বছর খানেকের সম্পর্ক, ওরা কি চায়না বিয়ে করতে? এতদিনের সম্পর্ক, মেঘ মাঝেমাঝেই ওর ওখানে যায়। চার পাঁঁচবার ট্যুরেও গেলো একসাথে। ওদের সম্পর্ক নিশ্চয় স্বামী স্ত্রী’র মত হয়েই গেছে। আমাদের উচিৎ বিয়ে দিয়ে দেয়া তাইনা?”
বাবা বললেন, “হুম। আচ্ছা কাল নাস্তার টেবিলেই তুলে দেখো কথাটা।”
সকালে খাবার টেবিলে কথাটা বলতেই মেঘালয় উৎফুল্ল হয়ে উঠলো। মিশু আজকাল ব্যস্ততার অজুহাতে যোগাযোগ কমিয়ে দিয়েছে, ওকে ছাড়া থাকতে খুবই কষ্ট হয় মেঘালয়ের। এরকম একটা প্রস্তাব তো মেঘ না চাইতেই বৃষ্টির মতন। বিয়ে করে ওকে নিজের কাছে এনে রাখবে,সারাক্ষণ বাবা মায়ের সাথে থাকবে। সবাই জানবে ও মেঘালয়ের স্ত্রী। যখন তখন ওর কর্মস্থলেও গিয়ে হাজির হতে পারবে।
মেঘালয় খুশি হয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “আমার লক্ষী আম্মু। দশদিনের মধ্যে আয়োজন করতে পারবা না? আমি আর দেরি করতে চাইনা।”
মা হেসে বললেন, “বাবাহ! এতদিন দেরি করতে পারলি আর এখন দশদিনের মধ্যেই?”
মেঘালয় লজ্জা পেয়ে বললো, “মা, ওর মত পুতুলটাকে দূরে রাখি কি করে বলো? আমিতো ভেবেছিলাম ওর পড়াশোনা শেষ না হওয়া অব্দি বিয়ের জন্য তোমাদেরকে বলতেই পারবো না।”
– “পড়াশোনা চালিয়েই যাক। আর দুজনেই তো মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছিস, অযথা দেরি করে কি হবে?”
মেঘালয় মাকে জড়িয়ে ধরে রইলো। ওর কি যে আনন্দ হচ্ছে। এখন মিশুকে সারপ্রাইজ দিতে হবে।
৭৫.
ভার্সিটি থেকে ফিরেই মিশু দেখলো মেঘালয় ওর বিছানায় শুয়ে ঘুমাচ্ছে। বেশ অবাক হলো ও। রাতে মেঘালয় কল দিয়েছিল,কথা বলা হয়নি। সকালে ৮ টায় ক্লাস ছিলো,উঠে ক্লাসে চলে গেছে। মাত্র ফিরলো ভার্সিটি থেকে। ছেলেটার সাথে সেরকম কথা হচ্ছেনা কয়টাদিন ধরে।
মিশু এসে মেঘালয়ের গায়ে হাত রেখে বললো, “ঘুমাচ্ছো?”
মেঘালয় চমকে উঠলো মিশুর ডাক শুনে। ঘুম জড়ানো গলায় বললো, “একটু ঘুম এসে গিয়েছিলো। রাতে ঘুম হয়নি তো।”
মিশুর দিকে ভালোমতো তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো, “পনের দিন পর দেখছি তোমায়। কতটা বদলে গেছো!”
বলেই মিশুকে কাছে টেনে নেয়ার চেষ্টা করলো। ওর কাছাকাছি আসার পর যখনি ঠোঁট স্পর্শ করতে যাবে মিশু ওকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বললো, “আমার খুব উশখুশ লাগছে। সরো তো আগে ফ্রেশ হয়ে আসি।”
মেঘালয় হতাশ হয়ে ওকে ছেড়ে দিলো। মিশু আজকাল কেমন যেন হয়ে গেছে। আর আগের মত কাছে আসতেও চায়না।
মিশু বাথরুমে ঢুকে গেলো আর কিছু না বলেই। মেঘালয় উঠে বাইরে গিয়ে রান্নাঘর থেকে খাবার এনে টেবিলে সাজালো। যত্ন করে খাবার রেডি করে বসে অপেক্ষা করতে লাগলো মিশুর জন্য। মিশু গোসল থেকে বেড়িয়ে একটা টি-শার্ট ও কোয়ার্টার প্যান্ট পড়ে চুলে টাওয়েল বেধে খাবার টেবিলের কাছে আসলো। ওর স্নিগ্ধ চেহারা দেখে পাগল হয়ে গেলো মেঘালয়। উঠে এসে মিশুর কোমরে হাত দিয়ে ওকে কাছে টেনে নিয়ে বললো, “ইস! আমার বউটা দিনদিন যা আকর্ষণীয় হচ্ছে,ইচ্ছে করছে তোমাকেই খেয়ে ফেলি।”
মিশু মেঘালয়ের গালে বুলিয়ে দিয়ে বললো, “তুমি কালো হয়ে গেছো কেন?”
– “বউয়ের গায়ের রঙ বরের গায়ের রঙের ব্যস্তানুপাতিক। তুমি ফর্সা হচ্ছো তাই আমি কালো হচ্ছি।”
– “হা হা, তাই নাকি? তোমাকে খুবই উসকোখুসকো দেখাচ্ছে মেঘ। নিজের একটু কেয়ার করতে পারোনা?”
– “নাহ পারিনা। আমার দিকে তাকানোর সময় তো আজকাল তোমার নেই। অযথা নিজের কেয়ার করে কি করবো?”
মিশু হাসলো। মেঘালয়ের বাহুর বন্ধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে গিয়ে চেয়ার টেনে নিয়ে বসলো। মেঘালয় ওর পাশেই বসলো। মিশু খাবারে হাত দিয়ে বললো, “শুরু করো।”
মেঘালয় অবাক হয়ে যাচ্ছে মিশুর আচরণ দেখে। এত পরিবর্তন! হুট করেই হয়নি। ধীরেধীরে হয়েছে। মেঘালয় ওকে অনেকবার বলেছে, “মিশু তুমি কেমন যেন হয়ে যাচ্ছো। প্লিজ কখনো চেঞ্জ হয়ে যেওনা।”
মিশু হেসে বলেছে, “আমি আজীবন এমনই থাকবো মেঘমনি।”
তবুও আজ এতটা বদলে গেছে! মেঘালয়ের দিকে তাকানোর সময় ও ওর হচ্ছেনা। এমন ভাব করছে যেন মেঘালয় আসাতে খুব বিরক্ত হয়েছে ও।
মেঘালয় কষ্ট করে খাবার তুলে নিলো। কিন্তু নিজে মুখে না দিয়ে মিশুর দিকে এগিয়ে দিলো। মিশু ওর হাতেই খাবার খেয়ে যাচ্ছে অথচ একবার ও ওকে খেতে বলছে না। এমন কেন মেয়েটা?
মেঘালয় বললো, “আমার খিদে পেয়েছে মিশু।”
– “সেকি! তুমি খাচ্ছোনা কেন? খাও।”
মেঘালয়ের বুকটা ফেটে যাচ্ছে কষ্টে। মিশুর এমন পরিবর্তন ও মানতে পারছে না। অনেক কষ্টে একটু ভাত মুখে দিলো কিন্তু গলা দিয়ে নামলো না। মিশু বললো, “একটা নিউজ আছে।”
মেঘালয় নিশ্চুপ। মিশু বলেই গেলো, “একটা বিজ্ঞাপনে কাজ করার অফার পেয়েছি।”
মেঘালয় আঁৎকে উঠে বললো, “মডেল! কোনো দরকার নেই।”
– “কেন? আমিতো ভাবলাম তুমি শুনলে হ্যাপি হবে। বাট..”
– “মিশু,তুমি জকির কাজ করছো করো। আর উপস্থাপনার কাজটাও ভালো। কিন্তু পুরোপুরিভাবে মিডিয়ায় নেমে পড়ো আমি চাইনা সেটা। তোমাকে মডেল হতে হবেনা। তুমি আমার স্ত্রী, আমার ভালোবাসা, আমার মিশু।”
মিশু কিছু বললো না। কিন্তু ওর মুখটা কালো হয়ে গেছে। মেঘালয় বললো, “আমাকে একবার ও বলার প্রয়োজন মনে করোনি? আজকাল কোথায় যাও কি করো কিচ্ছু জানাও না।”
– “তুমি বিজি থাকো, কিংবা আমি আমি বিজি থাকি তাই জানানো হয়না।”
– “ভালো। তোমার কি মন খারাপ হচ্ছে? শোনো, আমি মডেলিং করতে দিবো না মিশু। তুমি মিডিয়ার আর কোনোকিছুতেই যেতে পারবে না। পড়াশোনা করো আর রেডিওতে কাজ করো। তোমার জীবনের অন্য একটা লক্ষ্য আছে সেটা ভূলে যেওনা।”
মিশু কিছু না বলে চুপচাপ খাচ্ছে। মেঘালয় আরেকবার মিশুর মুখে তুলে দিতে যাচ্ছিলো কিন্তু মিশু নিলো না। সরিয়ে দিয়ে বললো, “আর খাবো না। পেট ভরে গেছে।”
কথাটা শুনতে খারাপ লাগলেও মেঘালয় হাসলো। বললো, “হাত ধুয়ে নাও। রুমে যাও আমি আসছি।”
মিশু হাত ধুয়ে রুমে চলে গেলো। মেঘালয় রুমে এসে দেখলো মিশু বিছানায় শুয়ে ফোনে কি যেন করছে। মেঘালয় এসে পাশে শুয়ে পড়লো।
মিশু অনেক্ষণ ধরে ফোন চাপাচাপি করছে। মেঘালয় ওর হাত থেকে ফোনটা নিয়ে বিছানায় রেখে মিশুকে বুকে টেনে নিলো। আলতো করে কপালে চুমু এঁকে দিয়ে বললো, “রাগ করেছো?”
– “না। রাগ করবো কেন?”
– “তুমি আজকাল এত ব্যস্ত থাকো, আমার খুব কষ্ট হয় পাগলীটা। মিডিয়াকে ক্যারিয়ার হিসেবে বেছে নিলে ব্যক্তিগত জীবন বলতে কিছুই থাকবে না। বুঝো সেটা?”
মিশু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, “বাদ দাও। আমি করছি না আর কিছু।”
– “পড়াশোনা ঠিকমত করো। আর তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে। এ বছরের সবচেয়ে সেরা সারপ্রাইজ।”
– “দার্জিলিং ট্যুর নাকি? এখন কোথাও যাবোনা। কয়েকদিন টানা প্রোগ্রাম আছে।”
মেঘালয় হতাশ হয়ে বললো, “সেরকম কিছু না। এরচেয়েও বড় সারপ্রাইজ।”
মিশু সেদিকে কোনো উৎসাহ না দেখিয়ে উঠে বসতে বসতে বললো, “আমাকে বের হতে হবে।”
মেঘালয়ের বুকে হাতুরি পিটতে লাগলো। মিশু ওকে ফেলে এভাবে চলে যাচ্ছে আর বলছে বের হতে হবে? মেঘালয় কি বলতে চাইছে সেটা শোনার ও আগ্রহ নেই?
মিশু বিছানা থেকে নেমে ওয়াশরুমে চলে গেলো। মেঘালয় বালিশে মুখ গুঁজে দিয়ে দুহাতে শক্ত করে চেপে ধরলো বালিশটা। ওর সবকিছু ভেঙে ফেলতে ইচ্ছে করছে। মিশুকে বিন্দু পরিমাণ রাগ দেখানোর সাধ্য ওর নেই। ও কোনভাবেই মিশুকে আঘাত করতে পারেনা। ইচ্ছে করছে ঘরের সমস্তকিছু ভেঙে ফেলতে।
চলবে..

অনুভূতি
পর্ব ৪৭
মিশু মনি
.
মিশু ফ্রেশ হয়ে এসে রেডি হয়ে নিলো। মেঘালয় বালিশ থেকে মুখ তুলে দেখলো মিশু চুল আচড়াচ্ছে। এতক্ষণ খেয়াল ই করেনি মেঘালয়, মিশুর লম্বা চুলগুলো কেটে ছোট ছোট করে ফেলেছে। মেঘালয়ের মেজাজ প্রচণ্ড গরম হয়ে গেলো। এত সুন্দর চুলগুলোর এই অবস্থা করে ফেলেছে!
মেঘালয় উঠে এসে মিশুকে হেচকা টানে বুকের উপর টেনে নিলো। তারপর রেগে বললো, “এই কয়েকদিন কিচ্ছু বলিনি তোমায়। তোমার চুল স্বপ্নে দেখে তোমার প্রেমে পড়েছি আমি। আর তোমার চুলের এই হাল কি করে হলো?”
মিশু মেঘালয়ের বাহুর বন্ধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করতে করতে বললো, “সবসময় চুল লম্বাই ছিলো। একটু ছোট করে দেখলাম কেমন দেখায়।”
– “চুল কাটার আগে আমার পারমিশন নিয়েছিলে?”
– “হেয়ার কাটিং এর জন্য পারমিশন কেন নিতে হবে?”
মেঘালয়ের আরো রাগ উঠে গেলো। ও মিশুকে দুহাতে চেপে ধরে বললো, “জানিস না তোর চুলের প্রতি আমার কত দূর্বলতা? কতবার করে বলেছি যেন আজীবন তোমার চুলের ঘ্রাণ এমনই থাকে। সবসময় চুলগুলো এমনই রেখো। আর তুমি চুল ছোট করে ফেলেছো,আবার কালার ও করেছো?”
মিশু বললো, “কক্ষনো করিনি। তাই ইচ্ছে করলো করতে।”
– “তুমি কখন পার্লারে যাও সেটাও আমাকে বলোনা। আমিতো তোমার চুল না দেখলে বুঝতেই পারতাম না তুমি আজকাল পার্লারে যাও।”
– “পার্লারে যাওয়াটা কি দোষের?”
– “মেঘালয়ের বউ পার্লারে কেন যাবে?”
– “আজব কথা বললে।”
– “হ্যা বললাম। কারণ আমার বউ কখনো পার্লারে যাবেনা, প্রয়োজনে পার্লার থেকে বিউটিশিয়ান নিজে আমার বাসায় এসে আমার বউকে সার্ভিস দেবে। আমি কখনোই চাইনি তুমি চুল কেটে কালার করে এতটা মডার্ন হয়ে যাও। তোমার ন্যাচারাল লুকটার জন্যই আমি তোমাকে ভালোবাসি।”
– “এখন কি ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে না?”
মেঘালয় বললো, “ইচ্ছে করছে তোমাকে কামড়ে শেষ করে ফেলি। কতদিন থেকে সারাক্ষণ ব্যস্ততার অজুহাত দেখাচ্ছো। আমি কিচ্ছু বলিনি। তুমি সপ্তাহে একদিন আমাকে সময় দিলেও আমার আপত্তি নেই। যাতে তুমি ভালো থাকো সেটাই করো। কিন্তু তুমি নিজেকে চেঞ্জ করে ফেলবা আমি সেটা মানতে পারবো না। মাসে একবার দেখা হলেও তোমার পবিত্র আর বিশুদ্ধ ন্যাচারাল চেহারাটা দেখতে চাই আমি।”
মিশু এবার গায়ের জোরে মেঘালয়ের হাতের বন্ধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। মেঘালয়ের রাগ এখনো কমছে না। কিন্তু মিশুকে কিছুই বলতে পারছে না ও। রাগে নিজের মাথার চুল ছিড়তে ইচ্ছে করছে ওর। বদলানো মানে একেবারে চেহারাও বদলে ফেলেছে! এটা কিভাবে সম্ভব!
মিশু বললো, “শান্ত হও মেঘ। এত রেগে যাবে আমি বুঝতে পারিনি। ভেবেছিলাম তুমি খুশিই হবে। কিন্তু আমার সব কাজে তুমি খুশি হওনা,সেটা আমার জানা ছিলোনা।”
মেঘালয় মিশুর সামনে এসে চোখে চোখ রেখে বললো, “তোমার সব ইচ্ছে পূরণ করতে নিজের জীবনটাও দিয়ে দিতে পারি আমি। কিন্তু তুমি নিজেকে বদলে ফেলো না প্লিজ। দোহাই লাগে তোমার।”
– “আমি একটুও বদলাইনি মেঘ। তুমি আমায় ভূল বুঝছো। আমাকে আগের মত ভালোবাসার চোখে দেখো, দেখবে আমি একটুও বদলাইনি।”
– “তুমি ইদানীং ওয়েস্টার্ন ড্রেস পড়তে শিখেছো?”
– “এটা নিয়েও তোমার অভিযোগ? যেখানে চলাফেরা করি,সেখানে পড়তেই হয়। তোমার চেয়ে ভালো কে জানে? একটা পার্টিতে কি আমি কামিজ স্যালোয়ার পড়ে যাবো?”
– “নিজের স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলো না মিশু। তুমি যেমন ছিলে,তাতেই তোমাকে আর সবার থেকে অনন্য আর সুন্দর লাগতো। অন্যকে নকল করে সুন্দরী হওয়া যায়না।”
মিশু রেগে বললো, “আমি কাউকে নকল করছি না। আমার যেটা পড়তে বা যা করতে কমফোর্ট ফিল করবো, আমি সেটাই পড়বো। এতে কাউকে নকল করার কথা কেন আসছে মেঘ?”
মেঘালয় আর কিছু বললো না। এভাবে মিশুকে বোঝানো সম্ভব না। ওকে ধীরেসুস্থে ঠাণ্ডা মাথায় বুঝিয়ে বলতে হবে। কিন্তু মিশু তো দ্রুত রেডি হচ্ছে বাইরে যাওয়ার জন্য। মেঘালয় কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। মিশু আয়নার সামনে সাজগোজ করছে। মেঘালয় একটু ভেবে এগিয়ে এসে ওকে পিছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরলো। মিশুর পেটে হাত রেখে বলল, ” আমি বলেছিলাম না রেগুলার ইয়োগা করলে তোমার ফিগার দেখে যেকোনো ছেলের মাথা ঘুরে যাবে। দেখেছো পেটটা কত স্লিম লাগছে?”
মিশুর রাগ নিমেষেই কমে গেলো। ও আয়নার দিকে তাকিয়ে বললো, “সত্যি বলছো?”
মেঘালয় হেসে বলল, “হুম আমার পাগলী টা। কিন্তু একটু মেদ থাকলেই তোমায় সুন্দর দেখাতো, নাভীটা একদম কুয়ার মত লাগতো আগে।”
মিশু মুচকি হেসে বললো, “হা হা হা। সবার তো স্লিম ফিগার পছন্দ। তোমার আবার হালকা মেদ ভালো লাগে?”
– “তুমি আমার সেরা সুন্দরী ছিলে বুঝলে? এখনো ভালোই লাগছে। কিন্তু আগে তোমাকে ন্যাচারাল লাগতো ”
– “এখন কি প্লাস্টিক প্লাস্টিক লাগে?”
– “স্ট্যাচু স্ট্যাচু লাগে। হা হা হা।”
মিশু হেসে বললো, “ছাড়ো তো। রেডি হতে দাও।”
মেঘালয় মিশুর কাঁধে মাথা রেখে ওর গালে গাল ঘষে ছোট ছোট দাড়ির হালকা খোঁচা দিয়ে বললো, “তোমার গায়ের স্মেলটা দারুণ মিশু।”
মিশু শিহরিত হয়ে উঠলো। মেঘালয়কে ছাড়ানোর চেষ্টা করে বললো, “এখন দুষ্টুমি না। আমার রিহার্সাল আছে।”
– “যাবে তো। একটু ভালোবাসতে দাও। তোমাকে দেখলে একদম ই দূরে থাকা যায়না। বড্ড আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছো। পাগল হয়ে যাচ্ছি।”
– “মেঘ,তুমি এই অসময়ে কেন এলে? আমার কাজ আছে।”
– “একটু পরে গেলে কিছু হবেনা। রেগুলার তো আর আসিনা, কতদিন পরে এলাম।”
– “উফফ পেটে এভাবে হাত বুলাচ্ছো কেন মেঘ? অস্থির হয়ে উঠছি তো।”
– “অস্থির করতেই চাইছি। এখন তোমার কোথাও যাওয়া হবেনা। এখন আমার মাঝে মিশে যাবা তুমি।”
– “বাচ্চাদের মতন করোনা তো। আমার একটা প্রোগ্রাম আছে। কিছু ডায়ালগ মুখস্থ করতে হবে আমায়।”
মেঘালয় বললো, “সব হবে। পরে যেও। আমাকে কেন এত দূরে সরিয়ে রাখো বলোতো? এরকম একটা বউকে রেখে কি দূরে থাকা যায়?”
মিশু হাসার চেষ্টা করে বললো, “কাজের সময় দুষ্টুমি?”
মেঘালয় মিশুর টপসের নিচ দিয়ে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে ওর পেটে চাপ দিতে দিতে বললো, “কতটা চেঞ্জ হয়ে গেছো তুমি। আজকাল আর লজ্জায় নীল হয়ে যাওনা। আগে যদি এভাবে বলতাম তাহলে বলতে, তুমি একটা খুব খারাপ। সেই কথাটা শুনতে এত ভালো লাগতো আমার! আমার বুকে মুখ গুঁজে দিয়ে লজ্জায় মরে যেতে। দুটো কিল বসাতে আমার বুকে। বড্ড মিস করি সেইসব দিনগুলোকে!”
মিশু কিছু বললো না। নিজের বদলে যাওয়ার কথাগুলো শুনতে শুনতে আর মেঘালয়ের পাগল করা স্পর্শে অস্থির হয়ে উঠতে লাগলো। মেঘালয় আস্তে আস্তে পিছনে সরে এসে মিশুকে বুকে জড়িয়ে ধরেই বিছানায় শুয়ে পড়লো। মিশুর জিন্সের ভেতর দিয়ে ওর তলপেটে হাত রাখলো। মিশুর ঘোর ঘোর লেগে যাচ্ছে। মেঘালয় মিশুর পায়ে পা রেখে আলতো করে ছুঁয়ে দিতে লাগলো। মিশু উত্তেজনায় ছটফট করতে শুরু করেছে। ছেলেটা এত দুষ্টু,এমন ভাবে ঘায়েল করে ফেলে যে নেশা ধরে যায়। এমন সময় মিশুর ফোন বেজে উঠলো।
মিশু ওঠার চেষ্টা করতেই মেঘালয় ওকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হলো। মিশু ফোন রিসিভ করে বললো, “হ্যালো”
ওপাশ থেকে কি বললো বোঝা গেলো না। মিশু বললো, “আচ্ছা আমি এক্ষুণি আসছি।”
ফোন রেখেই বললো, “সরি মেঘ। আমাকে যেতে হবে এখন। শিল্পকলায় একটা ফটোগ্রাফি এক্সিবিশন অনুষ্ঠানে উপস্থাপনা করতে বলেছে। আমি এখনো ফাইনালি জানাইনি কিছু। প্রধান অতিথি হাসানুল হক ইনু। সে কারণেই ইচ্ছে করছে প্রোগ্রামটা করি। এখান গিয়ে একটু দেখে আসতে হবে কি ব্যাপার।”
মেঘালয় কিছু বললো না। আজকাল এতকিছু করছে ওকে কিছুই জানানোর প্রয়োজন মনে করেনা মিশু। অযথা বলেই বা কি হবে। সে যাই করুক,এই অবস্থায় মেঘালয়কে ফেলে গেলে সেটা খুবই কষ্টদায়ক হবে মেঘের জন্য। ও সহ্য করতে পারবে না এরকম আচরণ। যাকে সবটুকু উৎসর্গ দিতে পারে,যার জন্য দিনরাত একাকার করে পরিশ্রম করে যাচ্ছে সেই মেয়েটাকে যদি একটু ভালোবাসতে না পারে এরচেয়ে বড় কষ্ট আর কি হতে পারে?
মিশু বললো, “তুমি কি যাবে? না গেলে তোমার কোনো কাজ না থাকলে বাসায় থাকো। আমি তাড়াতাড়ি ফিরবো।”
মেঘালয় একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। সারপ্রাইজ দিতে এসে নিজেই বারবার সারপ্রাইজড হয়ে যাচ্ছে। এতকিছু কল্পনাও করেনি ও। এত দ্রুত এত বিশাল সব পরিবর্তন সত্যিই মেনে নেয়ার মত নয়। মেঘালয় দুহাতে মুখ ঢেকে বিছানায় বসে রইলো। মিশু সেদিকে খেয়াল ও করলো না। ফ্রেশ হয়ে এসে আরেকবার চুলগুলো আচড়িয়ে নিয়ে ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে বাইরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলো। দরজার কাছে গিয়ে বললো, “আমি আসছি। জরুরি কাজ না থাকলে আজকে থেকে যাও।”
কথাটা বলেই চলে গেলো মিশু। মেঘালয়ের বুকটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। জরুরি কাজ থাকলেও মিশু একবার বললে সবকাজ ফেলে ওকে সময় দিতো মেঘ। মিশুর খুশির জন্য সবই করতে পারবে ও। আজকে যদি ওর জায়গায় মিশু থাকত, আর মেঘালয়ের যদি সরকারি চাকরীও হতো তবুও মিশুর ভালোলাগার জন্য ডিউটিতে যেতো না ও। চাকরী জলে যাক,মিশুর প্রশান্তি আগে। যে মিশুর জন্য এতটা ভালোবাসা বুকে নিয়ে আজকে ওকে বিয়ের কথাটা বলবে বলে এসেছে,সে মিশু ওকে পাত্তাই দিলোনা। এতটা কাছে পাওয়ার পর এভাবে ফেলে চলে গেলে মানুষের মাথা ঠিক থাকার কথা না। সেখানে মেঘালয় ওকে নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসে,মেঘালয়ের মনের অবস্থা সাংঘাতিক রকমের খারাপ হলো। ও বিছানায় শুয়ে রইলো চুপচাপ।
৭৬.
মিশু সন্ধ্যার পরপর ই ফিরলো। বুয়া এসে রান্না করে দিয়ে গেছে। মেঘালয় বিছানা ছেড়ে ওঠেনি। শুয়ে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়েছিলো। ঘুম ভাঙার পর শুয়েই আছে। মিশু এসে বিছানার পাশে বসে বললো, “ঘুম হলো? ওঠো, নাস্তা করো।”
মেঘালয় কিছু বললো না। চোখ মেলে তাকালো মিশুর দিকে। মিশুকে খুবই স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে। বাসায় ফিরে আবার শাওয়ার নিয়েছে বোধহয়। ভেজা চুল থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে। দুপাশের সামনের কাটা চুলগুলো মুখের উপর এসে পড়েছে। মেঘালয় অনেক্ষণ তাকিয়ে রইলো মিশুর মুখের দিকে। এই মেয়েটাকে ছাড়া ও বাঁচবে কি করে?
মিশু বললো, “কি দেখছো অমন করে? ওঠো, ফ্রেশ হয়ে এসে নাস্তা করবে। আমিতো ভেবেছিলাম তুমি চলে গেছো। যাক,থেকে গিয়ে ভালোই করেছো। কতদিন কাছে পাইনা তোমায়।”
মেঘালয় একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, “দুপুরে ওভাবে আমাকে তাচ্ছিল্য করে ফেলে রেখে গেলে। এখন আবার এটা বলছো?”
– “মেঘ,আমি কাজ ছিলো বললাম না। সবকিছুর একটা সময় থাকে।”
– “হুম,আমার জানা ছিলোনা। সরি।”
– “রাগ করছো কেন? কাল আমার অফডে। আজকে সারারাত দুজনে জেগে জেগে গল্প করবো। এখন উঠবে কি?”
মেঘালয় উঠে ফ্রেশ হয়ে আসলো। রাত নেমেছে। চা খেতে খেতে বললো, “নতুন নতুন কাজ করছো। আমাকে জানাও না কিছু।”
– “ব্যস্ততার কারণে জানানো হয়না।”
– “জগতে ব্যস্ততা বলে কিছু নেই। সবই গুরুত্বের উপর নির্ভর করে। আমি কঠিন ব্যস্ততার সময়েও তোমাকে সময় দিয়েছি।”
– “তারমানে বলতে চাইছো আমি তোমায় গুরুত্ব দিইনা?”
মেঘালয় নিশ্চুপ রইলো কিছুক্ষণ। তারপর বললো, “একটা সারপ্রাইজ দিতে এসেছিলাম তোমায়।”
– “হুম বলো।”
মেঘালয় চায়ে চুমুক দিয়ে বললো, “আগামী দশদিনের মধ্যে আমাদের বিয়ে হচ্ছে।”
মিশু চমকে উঠে বললো, “বিয়ে মানে! কিসের বিয়ে?”
মেঘালয় বললো, “আমাদের বিয়ে। আব্বু আম্মু চাইছে তোমাকে বিয়ে করে বাসায় তুলতে। ভেবেছিলাম আরো তিন চার বছর পর বাসায় তুলবো। ওরা চাইছে যখন দেরি করে লাভ কি? আমাদের প্রথম বিবাহ বার্ষিকীর দিনেই আমরা আরেকবার বিয়ে করবো। কি বলো?”
মিশু অবাক হয়ে চেয়ে আছে। মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, “সম্ভব না। কিছুতেই সম্ভব না।”
মেঘালয় অপ্রস্তুত হয়ে তাকালো মিশুর দিকে। ভেবেছিলো মিশু খুশিতে ওকে জড়িয়ে ধরবে। কিন্তু মিশু এরকম বলবে সেটা ও ভাবতেও পারেনি। অদ্ভুত লাগছে।
মিশু বললো, “এত তাড়াতাড়ি আমি সংসারে জড়াতে পারবো না। আগে নিজের মত করে লাইফটা এনজয় করি,ক্যারিয়ার গোছাই তারপর।”
– “তোমার লাইফে আমি ছাড়া আর কি আছে? সবই হবে,আমাদের ভালোবাসার স্বীকৃতি পেয়ে সব করবে।”
– “সংসার একটা ঝামেলার জিনিস। আমি এখন ই পারবো না।”
– “তোমাকে কোনো ঝামেলা করতে হবেনা। আমাদের বাসায় তোমার কোনো দায়িত্ব নেই,শুধু আমাকে ভালোবাসবে”
– “এখনি না মেঘ। আরো কিছুদিন সময় যাক তারপর। এত তাড়াতাড়ি কেন?”
– “তুমিই আগে বলতে কবে বাসায় তুলবো? আজ এটা বলছো?”
– “হ্যা,কারণ মাত্র ক্যারিয়ার শুরু হচ্ছে আমার।”
– “উফ ক্যারিয়ার রাখবে তুমি? আমার বিজনেস পুরোটাই তোমায় দিয়ে দিবো, সব তোমায় দিয়ে দিবো, সব। তুমি জনপ্রিয় Rj হয়েছো, টিভিতে উপস্থাপনা করছো। আর কি চাও?”
মিশু অবাক হয়ে গেলো মেঘালয়ের ঝাঁঝালো কথা শুনে। বললো, “একটু নিজের মত এনজয় করতে দাও।”
– “তোমার এনজয় করার জন্য তোমার আমাকে বাদ দিতে হবে? আমার সাথে কতদিন ভালোমতো কথা বলোনা তুমি?”
– “মেঘ,একটু বুঝার চেষ্টা করো। এত তাড়াতাড়ি সংসার পারবো না আমি।”
মেঘালয় উঠে এসে মিশুর পায়ের কাছে বসে ওর কোলে মাথা রেখে বললো, “তুমি একটু বোঝার চেষ্টা করো মিশু। আমি একদমই তোমাকে ছাড়া থাকতে পারিনা। আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। আর তোমাকে নিয়ে আজকাল খুব চিন্তা হয়। তুমি ইদানীং বেপরোয়া ভাবে চলাফেরা করো। আমাদের বাসায় থাকলে একটু শাসনে থাকবা,আমার সাথে বের হবা সবসময়। আমার চিন্তা থাকবে না।”
– “তোমার সাথে সবসময় বের হতে হবে? আমার স্বাধীনতা কেড়ে নিতে চাইছো তুমি?”
– “এটা কি বললা মিশু? আমি তোমাকে স্বাধীনতা দিচ্ছি,সবসময় আমার সাথে রাখতে চাইছি আর তুমি বলছো?”
– “হ্যা। আমার স্বাধীনতা কেন কেড়ে নিতে চাও তুমি? আমাকে একটু স্বাধীন ভাবে থাকতে দিবানা?”
মেঘালয় মিশুর কোল ছেড়ে দিয়ে মেঝেতে পা মেলে দিয়ে বসে পড়লো। মিশুর মুখ থেকে এমন কথা একদম ই আশা করেনি ও। বুকটা ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে মাটির ভেতর ঢুকে যেতে। কি বলবে বুঝতে না পেরে নিশ্চুপ হয়ে রইলো। এমন সময় ফোন বেজে উঠলো ওর। মা ফোন দিয়েছে। রিসিভ করে বললো, “হ্যা আম্মু বলো।”
মা বললেন, “বাসায় আসবি একটু তাড়াতাড়ি? তোর আব্বু একটু তাড়াতাড়ি আসতে বলেছে। একসাথে ডিনার করবো। জলদি আসিস।”
মেঘালয় “আচ্ছা” বলে রেখে দিলো। ভালোই হলো। এই মুহুর্তে মিশুর সামনে বসে থাকলে মিশুর তিক্ততা আরো বেড়ে যেতো। আর ওরও খারাপ লাগতো খুব। তারচেয়ে এখন বাসায় চলে যাওয়াটাই ভালো হবে। ভেবেচিন্তে সবকিছু ঠিক করে ফেলতে হবে।
মেঘালয় মায়ের কথাটা মিশুকে বলে চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলো। মিশু একবার থাকতেও বললো না। ঠায় বসে রইলো সোফায়। মেঘালয় বুক ভরা যন্ত্রণা নিয়ে বেড়িয়ে এলো বাসা থেকে। ছেলেদের নাকি কখনো কাঁদতে নেই,যদি চিৎকার করে একবার কাঁদতে পারতো!
চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here