হঠাৎ হাওয়া, পর্ব:২

#হঠাৎ_হাওয়া (২)

পুরো ট্রেনে শুনশান নিরবতা সবাই টুকটাক ঘুমিয়ে পড়েছে,মায়া দ্বিতীয়বার খুব বড় একটা দীর্ঘশ্বাস নিতেই হিমালয় বলল,
—এত্ত বড় দীর্ঘশ্বাস নেওয়ার মত কিছুই হয় নি ওঠার পর থেকেই দেখছি বড় বড় নিঃশ্বাস নিচ্ছ কারণ টা কি?
মায়া চমকে উঠলো, বেশ ভয় পেয়েছে ও আশা করেনি কেউ জেগে আছে মায়ার বুকের মধ্যে খুব ধুক ধুক করছে,
—আরে কি সমস্যা ভয় পেয়েছ নাকি?
—আপনি ঘুমান নি?
মেয়েটার কণ্ঠটা ভয়ংকর রকমের সুন্দর এই মেয়েটার কথায় এক অদ্ভুত মায়া আছে, কেমন তীক্ষ্ণ এক ধার আছে, একজন মেয়ের কণ্ঠ এত সুন্দর হতে পারে হিমালয় তা কখনো ভাবে নি মেয়েটার গানের গলা নিশ্চয়ই সুন্দর।
—হ্যা ঘুমিয়েছি তো আমার ঘুমের ঘোরে কথা বলার অভ্যেস আছে সেই অভ্যেস থেকে তোমার সাথে কথা বলছি।
মায়া একটু দমে গেলো নিজের বোকামির ওপর নিজেই হেসে ফেলল।কিন্তু ও হুট করে ভয় পেয়ে গেছে এখনো কেমন গা কাপছে ওর এই এক বদ অভ্যেস অল্পতেই ভয় পেয়ে যায়।মায়া একটু আমতা আমতা করে বলল
—ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, আমি একটু আপনাকে ছুতে পারি?
হালকা একটা আলো আছে ঠিক গাঢ় জোৎস্না নয় কেমন যেন একটা ম্লান আলো সেখানে শুধু অবয়ব বোঝা যাচ্ছে মায়া বুঝলো,হিমালয় ডান হাতটা বাড়িয়ে দিয়েছে,
—চাইলে হ্যান্ডশেক করতে পারো কিন্তু প্লিজ ছুয়ে দিলে ভয় চলে যাবে এরকম কথা ভেবে ছোয়ার দরকার নেই।
মায়া একটু ইতস্তত করে হাতটা বাড়িয়ে বলল,
—মানুষের কিছু কিছু বিশ্বাস থাকে যা থেকে সে বেড়িয়ে আসতে পারে না কখনোই পারে না আমি সেরকম একটা স্টুপিড গার্ল বলতে পারেন।
মায়া হিমালয়ের হাত ছুয়েই কেপে উঠলো কেন কে জানে!শুধু মায়া না হিমালয় ও কেপে উঠলো,
হিমালয় কণ্ঠে যথেষ্ট চিন্তা নিয়ে বলল,
—কি ব্যাপার তোমার হাত এত্ত ঠান্ডা কেন!এত ঠান্ডা মানুষের হাত কি করে হয়?!
—চিন্তা করার কিছু নেই আসলে ভয় পেলে বা টেনশন করলে আমার হাত পা খুব ঠান্ডা হয়ে যায়, আমার বমি পায় আমি খেতে পারি না খুব বেশি হলে সেন্সলেস হয়ে যাই, এগুলো নর্মাল এখন অভ্যেস হয়ে গেছে।
বলেই মায়া একটু নিঃশ্বাস ফেলল,
—আবার?
এবার মায়া হেসে ফেলল
—হাসছ কেন?
—আসলে মানুষের যখন অনেক চিন্তা হয় তখন মানুষের মস্তিষ্কে অক্সিজেনের অভাব হয় সেই অভাব টা পূরণ করতে মানুষ জোরে শ্বাস নেয় আর বিনিময়ে খুব বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলে একে আমরা দীর্ঘশ্বাস বলি
—এটা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা?
—কি জানি জানিনা, আমি একটা ব্যাখ্যা দাড় করালাম।
—তুমি আর দীর্ঘশ্বাস ফেলবে না
—আরে মুশকিল তো আপনি তো এই নিয়ে খুব জ্বালাতন করছেন,একদম বাবার মতো ডিস্টার্ব করছেন।
বাবার মত কথাটা বলেই মায়া থেমে গেলো ও খুব ছোট্ট করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো,আস্তে আস্তে মায়ার মন ভারী হয়ে আসছে ও সবটা গুলিয়ে ফেলছে এমনটা ও নাও করলে হতো বাবার সাথে কথা বললেও হতো বাবা সবটা বুঝতো, তাড়াহুড়ো করে ও এটা কি করল?মায়া আস্তে উঠে দাড়ালো এবং দৌড়ে কেবিন থেকে বের হয়ে গেলো,হিমালয় কিছু বুঝে উঠল না মেয়েটার কি হলো ও উঠে মেয়েটার পিছু নিলো।হিমালয় দেখলো মায়া ট্রেনের দরজা দিয়ে উঁকিঝুঁকি মারছে এই মেয়েটা কি লাফিয়ে নামার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে নাকি! হিমালয় মায়ার বাহু ধরে টেনে বলল
—পাগল নাকি কি করছ?!
—আমি নামব
—এখান থেকে নামতে চাইলে সোজা উপরে চলে যাবে
—উপরে মানে!
হিমালয় একটু বিরক্ত হলো মেয়েটা নিতান্তই ঘোরের মধ্যে বাড়ি ছেড়েছে একে এখন কি বোঝাবে,এ একেবারেই ছেলেমানুষ ধরণের মেয়ে
হিমালয় দরজার সাথে হ্যালান দিয়ে আড়িয়ে এক হাত দিয়ে দরজা আটকে মায়ার দিকে তাকালো তারপর বলল,
—তোমার যে ভাইয়ার সাথে বিয়ে ঠিক হলো তার সাথে যোগাযোগ করেছো? সে তোমার থাকার কোনো ব্যাবস্থা করে নি?
—তনয় ভাইয়া তো ফোন রিসিভ করছে না মনে হয় ব্যাস্ত,বাড়িতে কি একটা অবস্থা ভাবা যাচ্ছে!
হিমালয় মাথা নিচু করে ফেললো মেয়েটার কণ্ঠে অদ্ভুত ঘোর আছে…হিমালয় আস্তে জিজ্ঞেস করলো,
—বাসায় যেতে চাও নাকি?ব্যাবস্থা করব?
মায়া কিছুক্ষণ এদিকওদিক তাকাতাকি করলো তারপর বলল,
—না যেতে চাই না।
হিমালয় অবাক হয়ে বললো
—একটু আগেই না ট্রেন থেকে লাফিয়ে বাড়ি যেতে চাচ্ছিলে
—ভুল করছিলাম, মানুষ একবার যখন ভুল করে তারপর ভুল করতেই থাকে।
বলেই মায়া আবার একটা নিঃশ্বাস ফেললো তারপর হেসে ফেললো,হিমালয় অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো মেয়েটা অদ্ভুত মুহুর্তেই হাসছে মন খারাপ করছে কথা বলছে চুপ থাকছে!মায়া আড়চোখে তাকিয়ে বলল,
—চলুন ভেতরে যাই নয়তো সবাই ভাববে আমি আবার আপনাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে গেছি
হিমালয় হালকা হেসে বলল,
—সবাই জানে,হিমালয় আহমেদ কে কিডন্যাপ করা ওতো সহজ না আর তোমার মত একটা খুকি পক্ষে তো না ইই।
—আমি খুকি!
—অবশ্যই, একটু পরেই ভোর হবে তুমি ভেতরে গেলে যাও আমি যাচ্ছি না
—আমি আগে এসেছি আমি এখানেই থাকবো
হিমালয় বিড়বিড় করে বলল,
—আচ্ছা মুসিবত তো
—কিই বললেন?
—বললাম আমার পুশিক্যাট এর কথা খুব মনে পড়ছে
মায়া চুপ করে গেলো ওর মনটা খারাপ হয়ে গেলো মনে মনে ভাবছে কি হবার ছিলো আর কি হয়ে গেলো, মায়া আনমনে হিমালয়ের সামনে ট্রেনের দেয়ালে হ্যালান দরজা দিয়ে বাইরে তাকালো, আস্তে আস্তে অন্ধকার কেটে বাইরে ফর্সা হচ্ছে মায়া বাইরে তাকিয়ে আছে ওর চোখ ছলছল করছে, হিমালয় অবাক হয়ে মেয়েটিকে দেখছে, মেয়েটিকে সকালের প্রথম আলোয় কি চমৎকার লাগছে!

স্টেশন থেকে নেমে ওরা সবাই হালকা ফ্রেশ হয়ে একটা চায়ের দোকানে বসলো, সাজ ধুয়ে ফেলার পর মায়াকে অনেক স্নিগ্ধ লাগছে, নিরব বরাবর চুপ থাকলেও বলে উঠলো
—সাজ তুলে ফেললে যে একটা মেয়েকে এতটা চমৎকার লাগতে পারে আমি কখনো ভাবিনি!
মায়া লজ্জা পেয়ে একটু মাথা নিচু করে ফেললো
নিরবের বন্ধুরা সবাই যতটা না মায়াকে দেখে মুগ্ধ হলো তারচেয়ে বেশি নিরবের প্রশংসা শুনে অবাক হলো, নিরব পারতপক্ষে কথাই বলে না! সবাই নিরবের দিকে চেয়ে আছে দেখে নিরব বলল,
—এত অবাক হওয়ার কি আছে! তোমরা এমন ভাব করছ আমি বোবা আর হঠাৎ করেই আজ কথা বলছি,
পুষ্প আড় চোখে নিরবের দিকে তাকিয়ে মুখ ফুলিয়ে রইলো।
মায়া এতক্ষণ চায়ের কাপটা হাতের মধ্যে নিয়ে বসে ছিল, মুখে দিতেই পেটের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠলো ও চা টা রেখে দিলো, মনে পড়লো কাল সারাদিন ও কিছুই খায় নি।ধ্রুব খেয়াল করে বলল,
—তুমি কি সারাদিন কিছু খেয়েছিলে?
মায়া ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে দেখলো দেখতে আধুনিক হলেও ছেলেটার বাচনভঙ্গিতে কোনো ভান নেই মায়া একে একে সবার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো, ওদের মধ্যে নিরব একমাত্র সম্পূর্ণ ফরমাল ড্রেসে, আবির মুডি ধরণের, কথার একটা সুন্দর ব্যাক্তিত্ব আছে সব দারুণ ম্যানেজ করতে পারে, পুষ্প খুব দুরন্ত বয়সের সাথে ছেলেমানুষি যায় নি আর হিমালয় একে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না কখনো নরম তো কখনো ভাব নিচ্ছে, ধ্রুব মায়ার জবাবের আশা ছেড়ে দিয়ে বললো
—আমাদের সবাইকে পর্যবেক্ষণ শেষে কি সিদ্ধান্ত নিলে?
মায়া চমকে উঠলো, সবাই মায়ার দিকে তাকিয়ে ধ্রুব আবার বলল,
—তুমি মেয়েটা যে এতটা শাখা না তা বোঝাই যাচ্ছে,এর আগে সিলেট এসেছো?
মায়া এবার জোর দিয়ে বলল,
—হ্যা!
—বেশ আমাদের দেখে কি মনে হলো আমাদের সাথে যাওয়া যায়?
মায়া একগাল হেসে বলল,
—খুব যায়
মায়া লাফিয়ে উঠে বলল,
—গেট রেডি ফর এন এমেইজিং ট্রিপ,
সামনে এগোতেই মায়া শাড়ির সাথে পেচিয়ে হোচট খেয়ে নিজেকে সামলে নিলো,ওমনি সবাই হেসে ফেললো।

চলবে….
সামিয়া খান মায়া

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here