হঠাৎ হাওয়া, পর্ব:৩+৪

#হঠাৎ_হাওয়া (৩)

শুকতারা রিসোর্টের বারান্দায় দাঁড়িয়ে মায়া দেখছে ভোরের আলো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে সব আস্তে আস্তে পরিষ্কার হচ্ছে মায়া ভেজা চুলগুলো মুছতে মুছতেই ওর চোখ ভিজে উঠলো, মায়া চোখ মুছে নিজেকে শক্ত করলো তারপর রিসোর্টের মধ্যেই হাটাহাটি করতে লাগলো বনাক কোর্টের উপর দাঁড়িয়ে মায়ার মনটা ভালো হয়ে গেলো চারিদিকে সবুজের হাতছানি, দূরে সুরমা নদী, মেঘালয় রেঞ্জ! মায়ার মনটা দারুণ ফুরফুরে হয়ে গেলো,আনমনে মায়ার চোখে মুখে আনন্দ ফুটে উঠলো, মায়া প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে ভাবলো এই রিসোর্টের পাশেই তো হযরত শাহপরাণের মাজার ও কি একবার ঘুরে আসবে নাকি রিসোর্টের সামনের টিলাটায় একবার যাবে, মায়া আনমনেই রিসোর্টে চক্কর লাগাতে লাগলো ও নিচে নামতে নামতে খেয়াল করলো পাশের রেস্টুরেন্টে সম্ভবত কোনো অনুষ্ঠান হচ্ছে দেখে তো বিয়ে মনে হচ্ছে, মায়া দেখলো একজন বয়স্ক লোক চোখমুখ শক্ত করে দাড়িয়ে আছে সম্ভবত কোনো অসুবিধা হয়েছে মায়া একটু এগিয়ে গিয়ে লোকটার কাছে দাড়ালো, মায়া একটু গলা খাকারি দিয়ে বলল,
—আঙ্কেল কোনো সমস্যা?
লোকটা চোখমুখ কুচকে মায়ার দিকে তাকিয়ে বলল
—না বলেই ভেতরে দিকে ঢুকতে লাগলো
মায়ার মাথায় দুষ্টুমি চেপে বসলো মায়া লোকটাকে অনুসরণ করে ভেতরে গিয়ে বললো
—আঙ্কেল এখানে কি কোনো অনুষ্ঠান হচ্ছে,?
লোকটা বেশ বিরক্ত হলো মায়ার কথার জবাব দিলো না,ভেতর থেকে একজন মহিলা বের হয়ে কাদো কাদো স্বরে লোকটিকে বলল,
—মিষ্টি তো রুমের দরজা লাগিয়ে দিয়েছে খুলছে না
তারা দুজনেই খুবই আপসেট হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো মায়া এবার ওনাদের কাছে গিয়ে একটু কড়া সুরে বলল,
—কি সমস্যা? বলছেন না কেন? আপনারা কি জোর করে মেয়ের বিয়ে দিতে চাচ্ছেন না কি?
এবার মহিলাটি বলল,
—না মা আসলে আজ আমাদের মেয়ে মিষ্টির গায়ে হলুদ ও ওর ভাইয়া কে খুব ভালোবাসে ওর ভাইয়ার ইচ্ছে ছিল বিয়ে ঢাকাতেই হবে কিন্তু ছেলেপক্ষ চায় বিয়ে সিলেটেই হবে দিহানের বাবা তো আমাদের জোর করে নিয়ে এসেছেন কিন্তু দিহান আসে নি আর মিষ্টি এখন জেদ করে আছে ভাইয়া না এলে ও কিছুতেই ঘর খুলবে না।

মায়া ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
—আপনি কি একটু আমায় মিষ্টির ঘরের সামনে নিয়ে যাবেন?
লোকটি এবার চোখ কুচকে বলল
—তুমি সেখানে গিয়ে কি করবে
মায়া ভ্রু কুচকে মিষ্টির বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,
—কিছুই তো বোঝেন না দেখছি যা আপনি করেন নি তাই করবো।
মিষ্টির মা মায়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
—এই লোকটা সবসময় এরকম করে তুমি এসো আম্মু আমার সাথে,
মায়া মিষ্টির রুমের দরজার সামনে এসে দাড়ালো একটু নক করতেই ভেতর থেকে কেউ বলল,
—প্লিজ মা বিরক্ত করবে না আমার কথার কোনো নড়চড় হবে না
মায়া নরম কণ্ঠে বলল,
—মিষ্টি আমি মায়া, তোমার বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন দরজা টা খোলো
মিষ্টির মা অবাক হয়ে মায়ার দিকে তাকালো ওপাশ থেকে মিষ্টি তড়িঘড়ি করে দরজা খুললো ভীত চোখে বলল,
—কোথায় বাবা কোথায়?!
মায়া ভেতরে গিয়ে মিষ্টিকে নিয়ে দরজা লাগিয়ে বলল,
—প্রশ্ন পরে করবে তোমার বাবা একদম পারফেক্ট আছে, দরজা খুলছিলে না তাই একথা বলেছি।
মিষ্টি ভ্রু কুচকে মায়ার দিকে তাকালো,মায়া সে নজর উপেক্ষা করে বলল,
—তোমার ভাইয়াকে কল লাগাও দেন স্পিকার অন করো
—ভাইয়া ফোন রিসিভ করবে না
—আচ্ছা বেশ নম্বর দাও
মিষ্টি তেমন কিছু না বলে নম্বর টা দিলো মায়া ওর ফোন থেকে কল করতে দুবার রিং হওয়ার পর ফোন রিসিভ হলো,ওপাশ থেকে কেউ একজন বলল
—হ্যালো কে?
—আমি মায়া
—কে মায়া
—সেটা আপনি চিনবেন না
—আপনার বোন দরজা আটকে বসে আছে ভেতরে কোনো সাড়াশব্দ নেই হয়তো কোনো দূর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছে,
—হোয়াট!
মিষ্টি চোখ বড়বড় করে মায়ার দিকে তাকিয়ে আছে।মায়া একটু চুপ থেকে বলল,
—আপনি কি আসতে পারবেন?
—আমি আমি এক্ষুনি আসছি! মিষ্টি!
—দুঃখিত এরকম কিছুই হয় নি, মিষ্টি একদম ঠিক আছে
—কিইইহ! আপনি কে! আমার সাথে মশকরা করছেন?হাও ডেয়ার ইউ
—এরকম বাজে মশকরা করার জন্য আমি খুবই দুঃখিত তবে একটু ভেবে দেখুন এরকম হওয়াটা কি খুব অস্বাভাবিক? আপনি অহেতুক জেদ ধরে ঢাকায় বসে আছেন কাল আপনার ছোট বোনের বিয়ে,আপনি তো জানেন সে আপনাকে কত ভালোবাসে আজ যদি মিষ্টি এরকম কিছু করে তাহলে কি সেটা খুব অস্বাভাবিক হবে?
অপরপাশে নিরবতা…. মায়া একটু থেমে বললো
—আপনি মিষ্টির বড় ভাইয়া কাল মিষ্টির জীবনের বিশেষ দিন আপনি নিজের জেদের জন্য আপনার বোনের এতবড় একটা দিনে তার পাশে থাকবেন না? মিষ্টির শ্বশুর বাড়ির সবাই তো এ নিয়ে সারাজীবন মিষ্টিকে কথা শোনাতে পারে সবার চোখে মিষ্টি ছোট হয়ে যাবে, বাবার উপর রাগ করে আপনি আপনার বোনের অসম্মান করবেন?
ওপাশে কোনো কথা নেই।মায়া ছোটো করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল
—আপনি কি শুনছেন?
—শুনছি
মায়া ফোনটা মিষ্টি কে দিয়ে বললো একবার তোমার ভাইয়া কে ডাকো দেখো সে তোমার ডাক অগ্রাহ্য করবে না মিষ্টি মায়ার থেকে ফোন টা নিয়ে কান্নামাখা কণ্ঠে বলল,
—তুই আসবি না ভাইয়া?
—আমি আসছি ৪ ঘন্টার মধ্যে আমি তোর সামনে থাকবো।
মিষ্টি আর মায়া দুজনেই একটু হাসলো।

কথা আর হিমালয় কর্টেজের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে কথা হিমালয়ের পাশে ঘেষে বলল,
—তোর কি মন খারাপ?
হিমালয় দৃষ্টি পাহাড়ের দিকে রেখে বলল,
—তুই আমাকে এত বুঝিস কি করে?
কথা একটু হেসে বললো
—সেটা তুইও জানিস
হিমালয় কথাকে একটু পেছনে রেখে সামনে এগিয়ে বলল,
—ওই মেয়েটাকে তো অনেক্ষণ দেখছি না
—মায়া
—হুম
ধ্রুব ওদের কাছে আসতে আসতে বলল,
—আমিও অনেক্ষণ মায়াকে দেখিনি কোথায় গেলো বলতো!
তখনই আবির এসে বললো
—তোরা যে কেন এত ঝামেলার জড়াস আমি বুঝি না যে মেয়ে বাড়ি থেকে পালায় সে সব জায়গা থেকেই পালাতে পারে,
নিরব আস্তে বলল,
—তুমি তো জানো আবির মেয়েটা কেন পালিয়েছে
আবির ঝাঝালো কণ্ঠে বলল,
—কারণ মেয়েটা একটা স্টুপিড, ও ওর কথাগুলো ওর বাবাকে বললেই পারতো গাধা একটা ও জানে আজকাল রাস্তায় কত বিপদ! সবাই তো তোদের মত ভালো না
কথা পশ্রয়ের সুরে বলল,
—মেয়েটা নিতান্তই ছোট মানুষ

মায়া ওদের পেছনে এসে হালকা কেশে বলল,
—অনেক হয়েছে মায়া নিয়ে আলোচনা, আপনারা কি আজ কোথাও যাবেন নাকি এখানেই থাকবেন আমি কিন্তু বেড়াতে এসে বসে থাকতে পারবো না।
হিমালয় মায়ার দিকে তাকিয়ে দেখলো কাল রাতের মতো পরিণত লাগছে না আজকে মেয়েটাকে সদ্য কিশোরীর মত লাগছে তবে চমৎকার! হিমালয় চোখ ফিরিয়ে নিলো, ধ্রুব মায়ার কাছে গিয়ে বলল,
—তা আপনি গিয়েছিলেন কোথায় মিস চুমকি
মায়া নিজের জামার গলাটায় হাত দিয়ে বলল,
—ইশ কলার নেই
তাও একটু ভাব নিয়ে বলল,
—সমস্যা সমাধান করতে,
বলেই নিজের চুল গুলো সামনে থেকে পেছনে ছুড়ে মারলো,আবির চোখমুখ শক্ত করে বিড়বিড় করে বলল,
—নিজেই তো আস্ত এক সমস্যা
মায়া চোখ সরু করে মাজায় হাত রেখে বলল,
—এই যে আবির ভাই আমি কিন্তু রেগে যাবো এভাবে বিধিয়ে কথা বললে হুম।
আবির চোখ বড় বড় করে বলল
—ভয় দেখাচ্ছো পিচ্চি মেয়ে?
মায়া আহ্লাদী কন্ঠে বলল,
—আমি কি ডাইনী বুড়ি যে ভয় দেখাবো?
ওমনি অন্য সবাই হেসে ফেললো, পুষ্প মুখ গোমড়া করে দাড়িয়ে রইলো দূরে ধ্রুব এগিয়ে এসে বলল,
—ওয়েট ওয়েট তুমি আবিরকে ভাইয়া বললে!
—হ্যা তো!
—প্লিজ আমি সুন্দরী মেয়েদের মুখে ভাইয়া ডাক সহ্য করতে পারি না আমার পেট খারাপ হয়ে যায়
মায়া মাথা চুলকে বলল,
—তবে দুটো এমোডিস খেয়ে নেবেন!
—না তুমি অবশ্যই আমাকে ভাইয়া বলবে না, আমাকে তুমি নাম ধরেই ডাকবে
—তাতে কিন্তু খুব লাভ হবে না,
—সে পরে দেখা যাবে
—আচ্ছা, তাহলে আমি কাকে কি ডাকবো?আমি কিন্তু নিরব ভাইয়া কে ভাইয়াই ডাকবো
নিরব একগাল হেসে বলল
—অবশ্যই
পুষ্প মনে হয় খুশি হলো এবার ও এগিয়ে এসে নিরবের পাশে দাড়ালো।
মায়া এবার হিমালয়ের কাছে গিয়ে বলল,
—আর আপনাকে কি ডাকবো মহারাজ?
ধ্রুব পেছন থেকে বলল,
—ওর এটিটিউড রাজকুমারের মতোই তুমি ওকে মহারাজ রাজকুমার একটা ডাকলেই হলো।
মায়া বলল,
—আপনারা কি আজ সত্যি কোথাও বের হবেন না!
হিমালয় মায়ার দিকে তাকিয়ে বললো সবাই রেডি হও আজ খাদিমনগড় ঘুরে আসি, হিমালয়ের বলতে দেরি আছে মায়ার দৌড় লাগাতে দেরি নেই।ওরা জীপে খাদিমনগর জাতীয়উদ্যানে এলো মায়া, জীপ থেকে নামতে গিয়ে একবার জামায় বেধে হোচট খেয়েছে,হিমালয় বাহু না ধরে ফেললে নিশ্চিত আছাড় খেয়ে মানসম্মান যেতো, মায়া আকাবাকা রাস্তা পার হয়ে চা বাগান ঘুরে ঘুরে দেখছে ধ্রুব ওর ক্যামেরা নিয়ে প্রকৃতির ছবি তুলছে ফাকে ফাকে মায়ার ছেলে মানুষিরও, পুষ্প নিরবের পাশে হাটতে হাটতে বলল,
—নিরব তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে
নিরব বরাবরের মত চুপ রইলো, পুষ্প নিরবের হাত ধরে ওকে থামিয়ে বলল
—আমার কথা শোনো
—বলো,শুনছি তো
—তুমি সামনে কি করবে ভেবেছো
—হ্যা এই ট্রিপটার পর পুরোপুরি ক্যারিয়ার নিয়ে পড়বো আগামী দুবছর আমি নিজেকে সময় দেবো
—তারপর?
—তারপর মানে?
—প্লিজ নিরব আমার ধৈর্যের আর পরীক্ষা নিও না তুমি কি বুঝতে পারো না আমাকে?
নিরব এবার সরাসরি পুষ্পের দিকে তাকিয়ে বললো
—পুষ্প কিছু জিনিস বুঝেও না বুঝে না জেনে থাকতে হয়,
—আমি তোমাকে ভালোবাসি
নিরব এবার চোখ সরিয়ে সারি সারি বাগান পেরিয়ে দিগন্তে চোখ রাখলো।
—চোখ ফিরিয়ে নিও না
নিরব পুষ্পের দিকে না তাকিয়েই বললো
—ছোটবেলা থেকে আমি বৃত্তি উপবৃত্তির টাকা দিয়ে পড়ালেখা করেছি পুষ্প, ডাক্তারির কোচিং করার জন্য আমার মা তার একমাত্র সোনার চুড়ি জোরা বিক্রি করে আমার হাতে তুলে দিয়েছিলো,
আমি তোমার মত সোনার চামচ মুখে,প্রাচুর্য আর প্রাপ্তির মধ্যে বড় হই নি পুষ্প, আমি যতদূর জানি তোমার বাবা বংশ, গৌরব এসব খুব মানেন,তোমার বাবার সাথে পাল্লা দেওয়ার মতো কোনো যোগ্যতাই আমার নেই।আমি মানছি হয়তো একসময় আমার অবস্থার পরিবর্তন হব্র কিন্তু তোমার বাবার কাছে আমি দিনমজুর পুত্রই থেকে যাবো।আর এটাও তোমার সামান্য মোহ একসময় কেটে যাবে।

অনেকগুলো কথা বলে ফেলেছে নিরব ও পুষ্পকে পেছনে রেখে সামনে এগিয়ে গেলো, মায়া পুষ্প আর নিরবকে খেয়াল করলো পুষ্প মুখ গোমড়া করে রইলো।হিমালয় এসে মায়ার কাছে দাঁড়িয়ে বললো
—ধ্যানে বসেছো নাকি?
মায়া বেখেয়ালে বলল,
—পুষ্প আপু নিরব ভাইয়া কে খুব ভালোবাসে না?
হিমালয় একটু চমকালো
—তুমি কি করে বুঝলে?
—নিরব ভাইয়াও পুষ্প আপুকে ভালোবাসে কিন্তু….
—কিন্তু কি?
মায়া হিমালয়ের দিকে তাকিয়ে খুব উৎসাহে বললো
—আপনার মনে হয় না এদের একসাথে থাকা উচিত! বন্ধুর চেয়ে ভালো কি আর কোনো জীবনসঙ্গী হতে পারে?
হিমালয় ধীরে বললো
—জীবনসঙ্গী হওয়া এত সহজ না, ভালো বন্ধু যে জীবনসঙ্গী হিসেবে ভালো হবে এরকম না,
—কিন্তু এদের ক্ষেত্রে তো তাই
—সেটা এরাই ভালো বুঝবে
বলেই হিমালয় হাটা ধরলে মায়া হিমালয় কে ডাকে
—মহারাজ!
হিমালয় দাড়িয়ে যায় মায়া মাথা নিচু করে হিমালয়ের সামনে গিয়ে দাড়িয়ে বলল,
—দুজন ভালোবাসার মানুষ এক আকাশের নিচে আলাদা আলাদা বেচে তো থাকে ভালো থাকে না, আপনি কি চান আপনার বন্ধুরা কষ্টে থাকুক?
বলেই মায়া দৌড়ে সেখান থেকে চলে এলো,

চা বাগান ঘুরে ওরা রেইনফরেস্ট, রাতারগুল ঘোরাঘুরি শেষ করে রিসোর্টে ফিরলো সন্ধ্যা নাগাদ মায়া এতক্ষণ বকবক করে মাথা খেয়ে ফেলেছে, পুষ্প একদম চুপচাপ। নিরব হিমালয় খেয়াল করলেও কিছু বললো না।সন্ধ্যার কিছুক্ষণ পর মায়া ওর কর্টেজের বাইরে এসে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো হিমালয়ের রুমের জানালা দিয়ে মায়াক্র দেখা যাচ্ছে, মায়া কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর অল্প পরিচিত কণ্ঠস্বরে পেছনে ফিরলো,মিষ্টি।হিমালয় দেখলো একটা মেয়ে সম্ভবত আজ মেয়েটার গায়ে হলুদ আর ওর পাশের একটা ছেলে মায়ার সাথে কথা বলছে,দিহান এগিয়ে মায়ার কাছে গিয়ে দাড়িয়ে বলল,
—তুমিই মায়া?
মায়া ছেলেটার দিকে এক নজর তাকিয়ে বললো
—আপনি মিষ্টির ভাইয়া?
দিহান হেসে মাথা নেড়ে বলল,
—হ্যা
হিমালয় বাইরে বেরিয়ে এলো…

চলবে….
সামিয়া খান মায়া

#হঠাৎ_হাওয়া (৪)

দিহান একটু হেসে বলল
—তুমিই তো আমাকে কল করেছিলে
মায়া একটু লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল,
—আসলে আমি খুবই দুঃখিত, বাট সিচুয়েশানটাই এমন ছিল যে আমার তখন এটাই ভালো মনে হচ্ছিল,
দিহান পশ্রয়ের হাসি হেসে বলল,
—শুনলাম মিষ্টিকেও নাকি বাবা অসুস্থ বলে দরজা খুলিয়েছো
মায়া মাথা নিচু করে চোখ বন্ধ করে ফেললো।
হিমালয় বাইরে বের হয়ে ওদের কথা কিছু বুঝতে পারলো না মায়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
—কি হয়েছে, কোনো সমস্যা?
দিহান হ্যান্ডশেকের উদ্দেশ্যে হাত এগিয়ে বলল,
—আমি সৈয়দ দিহান।
হিমালয় হ্যান্ডশেক করতে করতে বলল,
—হিমালয় আহমেদ।
—আসলে আজ আমার বোনের গায়ে হলুদ, কাল বিয়ে, একটু ফ্যামিলি প্রবলেম ছিল এই ম্যাডাম সলভ করে দিয়েছে,
হিমালয় হেসে বলল,

—ও আচ্ছা!
—তো আমার বোন চাইছে যাতে মায়া ওর বিয়েতে এটেন্ড করে,
মিষ্টি মায়ার হাত ধরে বলল,
—তুমি এলে আমি খুবই খুশি হবো, তোমার জন্যেই ভাইয়া এলো না হলে ওর যে জেদ কেউ ওকে বোঝাতে পারে না
মায়া হেসে বলল,
—তোমার ভাইয়া তোমার জন্য এসেছে মিষ্টি তার জেদের থেকেও তুমি তার কাছে ইম্পর্টেন্ট।
—তুমি আসবে তো?
—আমি তো একা নই মিষ্টি আমার সাথে আরো অনেকে আছে
দিহান বলল,
—আর কে?হিমালয় তো? তুমি অবশ্যই ওকে নিয়ে এসো
মায়া হাত নেড়ে বলল
—না না শুধু মহারাজ নয়,কথা আপু,পুষ্প আপু,নিরব ভাইয়া, আবির ভাই, ধ্রুব
মায়া বড় একটা দম ফেললো হাপিয়ে গেছে এমন ভাব,হিমালয় ওকে থামিয়ে বলল,
—আহা মায়া তুমি ওনাদের বিরক্ত করছ কেন! এতগুলো মানুষ হুট করে বললেই হয়? তুমি বরং এটেন্ড করো
দিহান হেসে বলল,
—না না মায়া বলছে যখন তখন তোমরা সবাই ইনভাইটেড, ডু সামথিং কল দেম আমি নিজে ওদের সবাইকে বলতে চাই।
হিমালয় আমতা আমতা করে বলল,
—ওকে লেট মি কল।

হিমালয়ের কল পেয়ে সবাই বাইরে বের হয়ে এলো দিহান ওদের বলল আপনারা সবাই আসুন এখনই হলুদের প্রোগ্রাম শুরু হবে মায়া অবাক হয়ে বললো
—রেডি হবো না!
দিহান হেসে বলল,
—আচ্ছা আচ্ছা রেডি হয়েই এসো।

দিহান চলে যেতেই সবাই মায়াকে ঘিরে ধরলো ঘটনা শোনার জন্য মায়া বলল,
—সব পরে হবে এখন একটা কম্পিটিশন করে দেখি কে আগে রেডি হয় চলো।
বলেই মায়া দৌড় লাগালো কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সবাই মেয়েটার কান্ড দেখে চেয়ে রইলো হঠাৎ ধ্রুব দৌড় লাগিয়ে বলল,
—আমি হারতে রাজি নই তোরা থাক।

মায়া হলুদরঙা গোল জামা পড়ে চুল পোনিটেইল করে গায়ে একটা সাদার উপরেই সাদা সুতোর কাজ করা চাদর জড়িয়ে বাইরে এসে দাড়িয়েছে ও এসে দেখলো সাদা প্যান্ট আর শার্টের সাথে হলুদরঙা একটা ব্লেজার পড়ে হিমালয় আগে থেকেই বাইরে দাঁড়িয়ে হিমালয় আড় চোখে তাকিয়ে ঠোট বাকিয়ে হেসে বলল,
—আমি জিতে গেছি
মায়া একরাশ বিরক্তি নিয়ে হিমালয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
—কোনো প্রুভ আছে?
হিমালয় অবাক হয়ে বলল,
—মানে!
—মানে এখনো কেউ আসে নি, আপনি আর আমি ছাড়া কেউ জানে না আমাদের মধ্যে কে আগে এসেছে
হিমালয় খুবই আহত হয়ে বলল,
—তার মানে?
—এত মানে মানে করছেন কেন আমি কি বলছি তা আপনিও বুঝতে পারছেন আমিও পারছি
হিমালয় হাল ছেড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
—হাউ মিন!
মায়া মুখ যথাসম্ভব কঠিন করে বলল,
—দীর্ঘশ্বাস ফেলবেন না দীর্ঘশ্বাস ফেলার মত কিছুই হয় নি।
পরে দুজনেই একসাথে হেসে ফেললো তখন একে একে সবাই বের হতে লাগলো,ধ্রুব বিরক্ত মুখে বলল,
—হেরে গেলাম নাকি! জিতলো কে?মায়া নিশ্চয়ই?
মায়া হিমালয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
—না মহারাজ।
হিমালয় মায়ার দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসতে লাগলো।

হলুদের প্রোগ্রাম বেশ বড়সড় ই মনে হচ্ছে একটা বড় গাছের নিচে মিষ্টির গায়ে হলুদের স্টেজ করা হয়েছে সামনে কাঠ দিয়ে আগুন জ্বেলে তার চারপাশে সম্ভবত এখানকার আদিবাসী নাচ করছে, মিষ্টির বাবা এসে মায়ার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
—মায়া
—হ্যা আঙ্কেল বলুন
মিষ্টির বাবা বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন কি বলবেন হয়তো গুছিয়ে নিতে পারছে না মায়া একগাল হেসে বললো
—ইউ আর ওয়েলকাম আঙ্কেল এন্ড ইটসওকে
মিষ্টির বাবা একটু বিব্রত ভঙ্গিতে হাসলেন।তারপর সস্নেহে বললেন
—আমাদের খুব বেশি আত্মীয় আসতে পারে নি তোমরা নিজের মনে করেই আমাদের পাশে থেকো।
সবাই মিষ্টির কাছে গিয়ে একে একে হলুদ মাখালো শুধু আবির গেলো না ও একটু দূরে দাঁড়িয়ে রইলো, মায়া খেয়াল করে আবিরের কাছে গিয়ে বললো
—আবির ভাই
আবির কিছু না বলেই এক মনে সামনে জ্বলন্ত আগুনের দিকে তাকিয়ে রইলো,মায়া আবিরের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
—যখন আমার মাম্মাম মারা যায় আমার বাবা একদম একা হয়ে যায় আমি ছাড়া আমার বাবার দুনিয়াতে কিন্তু সত্যি বলতে আপন কেউ নেই তার নিজের বোনও আছে তার সম্পত্তির লোভে।আমি যে কি না বাবার একমাত্র আপন মানুষ সেও বাবাকে একা ফেলে চলে এসেছি তাও অসম্মানজনক পরিস্থিতিতে, সেক্ষেত্রে আমি বিশ্বাসঘাতক তাইনা?
আবির এবার সরাসরি মায়ার দিকে চাইলো কন্ঠ নিচু করে বলল,
—তোমার উচিত তোমার বাবাকে একটা ফোন করা করেছিলে?
—এমন অনেক কিছুই আমাদের উচিত আমরা কি তা করি? আবির ভাই আমি এখানে আসার পর আপনার অন্য সব বন্ধুরাই কিন্তু একবার না একবার তার বাসায় কথা বলেছে এমনকি অল্পভাষী নিরব ভাইয়াও তার মাকে আমার সামনেই ২/৩ বার কল করেছে আপনি কি একবারো আপনার বাসায় কল করেছেন?
—এ ব্যাপারে আমি কিছুই বলতে চাই না।
—আচ্ছা ঠিকাছে বলবেন না। আমিই বলছি কিছু কিছু ভালোবাসা থেকে দায়িত্ববোধ জন্মায় আর কিছু কিছু দায়বদ্ধতা মায়া তৈরি করে যার শক্তি ভালোবাসার অনেক উপরে। কেউ আপনার সাথে বেইমানী করেছে বলে, আপনাকে ভেতর থেকে দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছে বলে আপনি সবার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন এটা সমাধান নয়।বরং আপনি সুযোগ খুজুন অসহায় কারো অবলম্বন হওয়ার।হয়তো আপনি কল করবেন না জেনেও আপনার বাসায় আপনার আম্মু ফোনের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করছে। এটুকুই বলার ছিল।আমি বরং মিষ্টির কাছে যাই।
মায়া দৌড়ে আবিরের সামনে থেকে চলে গেলো আবির মায়ার যাওয়ার দিকে চেয়ে রইলো।হিমালয় এতক্ষণ একটু দূরে দাড়িয়ে ওদের কথা গুলো শুনছলো ও এসেছিলো আবির কে ডাকতে আবির একমাত্র হিমালয়েরই যা একটু কথা শোনে, হিমালয় এগিয়ে আবিরের কাধে হাত রেখে বলল,
—কি ভাবছিস?
—অনেক কিছুই যা আরো আগে ভাবা উচিত ছিল,তোরা যা আমি আম্মুকে একটা কল করে আসি।

আবির ফোন করে ফিরে আসতেই দেখলো ভেতরে একটা জটলা মতো হয়েছে বেশ কিছু কান্নাকাটির শব্দও শোনা যাচ্ছে ও এগিয়ে হিমালয়ের কাছে দাড়িয়ে কারণ জিজ্ঞেস করে জানতে পারলো মিষ্টির যার সাথে বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো সে নাকি বাড়িতে নেই, বিয়ে হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। মায়া ভাবলেশহীন ভাব্র দাড়িয়ে আছে , মিষ্টির মা কান্নাকাটি করছেন দিহান রাগে কাপছে হাতের কাছে যা পাচ্ছে ছুড়ে মারছে হিমালয় ধ্রুব এগিয়ে গিয়ে ওকে শান্ত করার চেষ্টা করছে, মিষ্টি এতক্ষণ চুপচাপ দাড়িয়ে ছিলো পাথরের মতো হঠাৎ ও এক ছুট লাগালো, দিহান দৌড়ে ওর পিছু নিলো বেশিদূর মিষ্টি যেতে পারলো না তার আগেই আবির বা হাত দিয়ে শক্ত করে মিষ্টির ডান হাতের কব্জিটা ধরে ফেললো, মিষ্টি হঠাৎ জ্ঞান হারিয়ে ফেললো।পড়ে যাওয়ার আগেই আবির ওকে ধরে ফেললো। আবির বুঝলো মেয়েটার সারা শরীর খুব ঠান্ডা হয়ে গেছে। দিহান দৌড়ে এসে মিষ্টিকে কোলের মধ্যে নিলো পানির ছিটা দিয়ে ওর জ্ঞান ফেরানো হলো, দিহানের বুকের মধ্যে মুখ নিয়েই মিষ্টি কেদে ফেললো।হুট করে আবির একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো, ও দিহানের দিকে তাকিয়ে বললো
—আমি মিষ্টি কে বিয়ে করতে চাই।
ওর বন্ধুরা সবাই আবিরের দিকে হা হয়ে তাকিয়ে রইলো, মিষ্টির বাবা মাও বেশ অবাক হলো দিহান কিছু বলার আগেই মিষ্টি কঠিন করে বললো,
—আমি কারো দয়া চাই না।
আবির মিষ্টির দিকে না তাকিয়ে দিহানের চোখে চোখ রেখে বলল,
—আপনারা এটা কে দয়া বা করুণা মনে করবেন না, অনেক কিছুই আমরা ভেবে চিনতে সিদ্ধান্ত নিয়ে সময় নিয়ে শুরু করি আবার কিছু জিনিস হুট করেই হয়। আমি নিজেও জানিনা আমার এরকম সিদ্ধান্তের কারণ কি,একটু আগেই মায়া আমাকে বলছিলো অনেক ভালোবাসা থেকে দায়িত্ববোধ জন্মায় আর কিছু কিছু দায়িত্ববোধ এমন মায়া তৈরি করে যা ভালোবাসার অনেক উর্ধ্বে। ছেলে হিসেবে বা পরিবার হিসেবে কোনো দিক দিয়েই মনে হয় না আমি মিষ্টির অযোগ্য হবো। বাকিটা আপনারা বিবেচনা করে দেখতে পারেন।
মিষ্টির বাবা আবিরের দিকে তাকিয়ে বলল,
—তোমার পরিবার?
—আমার সিদ্ধান্তই আমার পরিবারের সিদ্ধান্ত। মিষ্টির বাবা একটু থেমে বলল,
—আমি আর কিছু ভাবতে পারছি না যা দিহান ভালো বোঝে।
দিহান আবিরের চোখে তাকিয়ে বলল,
—তুমি কি আজ রাতে বিয়ে টা করতে পারবে আবির?
—হ্যা পারবো,আপনি আজ রাতের মধ্যে চাইলে আমার সম্পর্কে খোজ নিয়ে জেনে নিতে পারেন আমার ব্যাকগ্রাউন্ড।
—আমার কিছু জানবার নেই জেনে বুঝে তো অনেকে অনেক কিছু করলো। তোমার মধ্যে লয়ালিটি আছে এন্ড দ্যাটস এনাফ,
মিষ্টি দিহানের দিকে তাকিয়ে বলল,
—ভাইয়া!
দিহান মিষ্টির মাথায় হাত রেখে বলল,
—ভাইয়ার ওপর বিশ্বাস আছে না?
মিষ্টি আর কিছু বলল না সেদিন রাতে গায়ে হলুদের কাপড়েই মিষ্টির বিয়ে আবিরের সাথে হয়ে গেলো।

চলবে….
সামিয়া খান মায়া

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here