হঠাৎ হাওয়া, পর্ব:৫+৬

#হঠাৎ_হাওয়া (৫)

হিমালয় আর আবির পাশাপাশি দাঁড়িয়ে, হিমালয় সবসময় আবিরকে সাপোর্ট করেছে সবটা ক্ষেত্রে হিমালয় কে কিছু না বলতে দেখে আবির একটা সিগারেট জ্বালালো,লম্বা একটা টান দিয়ে আকাশে ধোয়া ছেড়ে বলল,
—কিছু বলবি?
—বুঝতে পারছি না, মানে তুই বিয়ে করে ফেলেছিস তুই!
—বিশ্বাস হচ্ছে না তাইনা?অথচ আমার পক্ষের সাক্ষী তুই।
—হচ্ছে,
তারপর কিছুক্ষন দুজনেই চুপচাপ থাকার পর হিমালয় বলল,
—তুই সবটা মানিয়ে নিতে পারবি,সবটা ভুলে নতুন করে শুরু করতে?
—সিগারেট খাবি?
—কথা চেঞ্জ করিস না, তুই জানিস আমি এসব খাই না।
—তুই তো আমাকে আমার চেয়ে বেশি চিনিস তুই বল পারব কি না?
হিমালয় চুপ করে থেকে বলে উঠলো
—আমি জানি তুই পারবি।চল মিষ্টির কাছে যাবি।

প্রায় মাঝরাত দিহান ওদের রিসোর্টের সামনে একটা বেঞ্চে বসে আছে। পাশে মিষ্টি নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলছে দিহানের খুবই কষ্ট হচ্ছে মিষ্টির কষ্ট ও কিছুতেই সহ্য করতে পারে না।কিছুক্ষণ বাদে মায়া,হিমালয় আর ওর বন্ধুরা সবাই ওদের কাছে এলো আবির মিষ্টির কাছে গিয়ে ওর সামনে আবিরের ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বলল,
—আমার আব্বু তোমার সাথে কথা বলতে চায় তুমি কি একটু কথা বলবে?
মিষ্টি হাত বাড়িয়ে ফোন টা নিয়ে কানের কাছে ধরলো কান্না সামলে বলল,
—হ্যালো
ওপাশ থেকে আবিরের আব্বু বলল,
—কি কারণে কি হয়েছে আমি কোনোদিন জানতে চাইবো না, আমার একটাই ছেলে ওর জীবনেও দূর্ঘটনা ছিল, আমার মা বেচে নেই এতই হতভাগ্য ভেবেছিলাম একটা মেয়ে হলে তাকে মা ডাকবো তা বাদ দিয়ে ওই গাধার বাচ্চাটা জন্ম নিলো,
মিষ্টি হেসে ফেললো সাহস নিয়ে বলল,
—গাধা টা তবে কে?
এপাশ থেকে সবাই মিষ্টির মুখের দিকে তাকিয়ে আছে,আবিরের বাবা বলল,
—আমার মা তো খুব কথা জানে,তুই হবি আমার মা?
মিষ্টি এবার কেদে ফেললো
—উহু কান্নাকাটি করা যাবে না চোখ মুছে ফেলো সময় নাও তারপর তোমার বাড়ি ফিরে এসো আমি আমার মায়ের জন্য অপেক্ষায় থাকবো।
কল কেটে মিষ্টি মাথা নিচু করে রইলো,ধ্রুব একটু রসিকতা করতে বলল,
—পরিবেশ দূষণ হচ্ছে এত মানুষের কার্বন ডাই অক্সাইডে তোমরা সবাই একটু জায়গা টা খালি করে দাও আবির আর মিষ্টি একটু অক্সিজেন নিক।
দিহান কিছু না বলে আস্তে উঠে দাড়ালো সবকিছু এমন একটা পরিবেশ তৈরি করেছে যে আসলেই বিব্রতকর।দিহান আবিরের সামনে দাড়িয়ে বলল,
—আমি জানি না ঠিক করেছি না ভুল প্লিজ আমাকে ভুল প্রমাণ করে দিও না, ছোট থেকে ওকে কক্ষনো কোনো কষ্ট দেই নি ওর কষ্ট আমি সহ্য করতে পারি না।
হিমালয় এবার এগিয়ে দিহানের কাধে এক হাত রেখে বলল,
—ও জীবনে এত বড় কষ্ট পেয়েছে যে আর কাউকে কষ্ট দেওয়ার ক্ষমতা ওর নেই।
কথা এগিয়ে গিয়ে বলল,
—চলো আমরা বরং ভেতরের দিকে গিয়ে কথা বলি।

দিহানের সাথে এতক্ষণ সবাই ভাব জমিয়ে ফেলেছে, কথায় কথায় জানা গেলো পুষ্প আর দিহান দুজনেই উত্তরা ৯ নং সেক্টরে থাকে অথচ পরিচিত হলো এখানে এসে। নিরব আড়চোখে দেখছে পুষ্প ওর দিকে একবারো তাকাচ্ছে না মেয়েটা খুব জেদী।সবাই কথা বলছে শুধু মায়া চুপচাপ, একফাকে মায়া উঠে পাহাড়ের কিনারে গিয়ে দাড়ালো ওর দৃষ্টি বহুদূরে ভাবনা এলোমেলো, ওর খুবই কান্না পাচ্ছে।হিমালয় মায়ার পাশে গিয়ে দাড়ালো, মায়ার বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ করছে, হিমালয় আশেপাশে থাকলেই ওর এরকম লাগে কেমন জানি হিমালয়ের সামনে ওর কষ্টগুলো ঝেড়ে ফেলতে ইচ্ছে করে।
—এখানে কি করো
—দাঁড়িয়ে আছি
—ও আচ্ছা আমি তো দেখতেই পাই নি দাড়িয়ে আছো।
মায়া চুপ করে রইলো, হিমালয় মায়ার দিকে তাকালো,তারপর বলল,
—তোমার হাতটা দাও তো
মায়া ঘাড় ঘুরিয়ে হিমালয়ের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো,
হিমালয় মায়ার হাত ওর হাতের মধ্যে নিয়ে দেখলো খুবই ঠান্ডা, হাত ছেড়ে দিয়ে বলল,
—কোনো সমস্যা?টেনশন করছ কেন?
মায়া জোড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
—টেনশন করছি না, ভাবছি।
—ও আচ্ছা, টেনশন করছ না ভাবছো খুবই ভালো।
—আপনি কি ডাক্তার?
—কেন বলো তো?
—না তখন দেখলাম মিষ্টির ভাইকে কি যেন সাজেস্ট করছিলেন মিষ্টি সেন্সলেস হয়ে গেছে বলে, যদিও তখন স্পষ্ট শুনিনি।
হিমালয় হালকা হেসে বললো,
—আমরা ছয় জনই ডাক্তার একই মেডিকেল কলেজ থেকে গতবছর পাশ করেছি।
মায়া অবাক হয়ে হিমালয়ের দিকে তাকালো, তারপর বিস্ময় নিয়ে পেছনে ঘুরে আড্ডায় মশগুল হিমালয়ের বন্ধুদের দিকে তাকালো
হিমালয় হাসিমুখে বলল,
—এত অবাক হচ্ছ কেন! কোনোদিন ডাক্তার দেখো নি?
মায়া আড়চোখে তাকিয়ে বলল,
—আমি কাল থেকে এতগুলো ডাক্তারের সাথে আছি!
—তুমি এমন ভাবে বলছ যেন তুমি খুনীদের সাথে আছো!
মায়া মুখ ফিরিয়ে খুশি খুশি ভাব নিয়ে বললো
—যাক সারাজীবনে আর চিকিৎসার জন্য কোনো খরচ করতে হবে না।
হিমালয় অদ্ভুত ভাবে মায়ার দিকে তাকিয়ে রইলো এই মেয়েটার কণ্ঠে অদ্ভুত মাদকতা আছে, হিমালয় প্রতিবার চুম্বকের মত মেয়েটার দিকে আকর্ষিত হয়, এই মেয়েটার সঙ্গ পেতে ওর ভালোলাগে মেয়েটার বাচ্চা স্বভাব মেয়েটার গুরুগম্ভীর কথা সব হিমালয়ের ভালো লাগে!

মিষ্টি কাচা হলুদ রঙের জামদানী পড়েছিল চিকন সবুজ পার, ম্যাচিং ব্লাউজ, হাত ভর্তি সোনার চুড়ি,কানে ছোট্ট সোনার দুল ব্যাস এটুকুই ওর বিয়ের সাজ! কত্ত দামী শাড়ি কত ভারী গহনা কত্ত সরঞ্জাম বিয়ের জন্য কত্ত প্লান অথচ ওর বিয়েটা নাকি এভাবে হলো! নিজের জন্যেই ওর মুখে এক টুকরো তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠলো, শাড়ির আচল ঘাড়ের উপর তুলল একটু কেমন ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে। আবির পাশে বসা মেয়েটাকে এবার চেয়ে দেখলো,
—তোমার কি ঠান্ডা লাগছে?
মিষ্টি মাথা নিচু করে বসে রইলো, এমনিতে আবির রগচটা খুব অথচ একটা মেয়ে সমানে ওকে ইগনোর করছে আর ওর রাগ হচ্ছে না অদ্ভুত!
—মিষ্টি আমি তোমার সাথে কথা বলছি
—বলুন, আমি শুনছি
—তোমার কি ঠান্ডা লাগছে?
মিষ্টি খুব কান্না পেয়ে গেলো গলায় কান্না আটকে দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
—না।
—ঘরে যেতে চাও?
—আমি আপনার বাসায় যেতে চাই
—তুমি আমার বাসায়ই যাবে, আমরা এখানে ৪ দিনের প্লান করে এসেছিলাম আজ সকালেই এলাম, আমি যদি কাল চলে যেতে চাই ওদেরও ফিরে যেতে হবে।
—বেশ তাহলে চারদিন পরই যাবো।
—ধন্যবাদ
মিষ্টি শব্দ করে হেসেই কেদে ফেললো তারপর বললো
—আপনাকে ধন্যবাদ আমার পরিবারের সম্মান বাচানোর জন্য আমাকে দয়া করার জন্য।
আবির মিষ্টির দিকে তাকিয়ে বলল
—আমি কাউকে দয়া করি নি
—তাহলে কি করেছেন? একপলক দেখেই নিশ্চয়ই আপনি আমাকে ভালোবেসে ফেলেন নি।
—না।এমনকি আমি আর কোনোদিন কাউকে ভালোবাসতেও পারব না।
—তাহলে?
—আমি জানিনা।
—বেশ কোনোদিন জানলে অবশ্যই আমাকে জানাবেন।
—আমি জানি অল্প কিছু সময়ে তোমার পুরো পৃথিবীটাই পালটে গেছে স্পব মেনে নিতে তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে
—অদ্ভুত! আপনার সব মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে না!
—না আমার আর কষ্ট হয় না।
মিষ্টি এবার আবিরের দিকে তাকালো ওর পাশে বসে থাকা লোকটি এখন ওর স্বামী দেখতে নিঃসন্দেহে সুপুরুষ,ব্যাক্তিত্বও অসাধারণ লোকটির! অথচ তার চারপাশে অদৃশ্য দেয়াল সে তুলে রেখেছে যা কেউ অতিক্রম করতে পারে না!আবির পরিবেশ হালকা করতে রসিকতার সুরে বললো
—এভাবে তাকিয়ে থেকো না প্রেমে পড়ে যাবে।
মিষ্টি চোখ ফিরিয়ে নিলো না দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করে তাকিয়ে রইলো।

চলবে….
সামিয়া খান মায়া

#হঠাৎ_হাওয়া (৬)

জাফলং ডাওকি নদীর দিকে এক মনে চেয়ে আছে মায়া,নদীর তলানি পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে,হিমালয় মায়াকে ডেকে বললো
—চলো যাবে না?
—কোথায়?
—চা বাগান দেখে আসি
মায়া ছোট্ট করে একটা নিঃশ্বাস ফেললো। হিমালয় ভ্রু কুচকে বলল,
—আবার কি হলো?
—আপনার চিন্তা হচ্ছে না?
—কি জন্য?
—এই যে পুষ্প আপু আমাদের সাথে এলো না ওর তো জ্বর
—তুমি ভুলে যাচ্ছ ও নিজেই একজন ডাক্তার, তাছাড়া…
মায়া হিমালয়ের সামনে থেকে হাটা ধরলো, হিমালয় বড়সড় একটা লেকচার দিবে ভাবছিল ও একটু আহতই হলো মেয়েটা ওকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে চলে গেলো! হিমালয় আহমেদ কথা বলছে সে কথা শেষ হওয়ার আগেই মেয়েটা চলে গেলো!হিমালয় মায়ার পাশে হাটতে হাটতে বললো
—কি হলো!?
—আপনার যুক্তি তর্ক দিয়ে বোঝানো কথা এই মুহুর্তে আমার একটুও শুনতে ইচ্ছে করছে না লেকচার শোনার মুডে আমি মোটেও নেই।
হিমালয় মেয়েটার দিকে তাকালো,আর ভাবলো এরকম অনেক লেকচার ও কথার সামনে দিয়েছে কথা কোনোদিন বলে নি হিমালয় থাম আর শুনতে ইচ্ছে করছে না! আর এই মেয়েটা কিনা ওকে সরাসরি বলছে! অথচ মায়ার এই ক্যারেক্টার টাই ওর ভালোলাগছে! এই মেয়েটার সাথে হিমালয়ের কথা বলতে ইচ্ছে করছে! মায়ার তাচ্ছিল্য কে অগ্রাহ্য করে হিমালয় বললো
—তুমি এখন কিসের মুডে আছো?
—ওই কাচের নদীতে নৌকা নিয়ে ভাসতে।
বলেই মায়া দৌড়ে কথার সাথে হাটতে লাগলো, কথা আর দিহান টুকটাক আলাপ করছিলো,
দিহানের আব্বু আম্মু আজ সকালেই ঢাকায় চলে গেছে মিষ্টি দিহানকে যেতে দেয় নি দিহান নিজেই অবশ্য মিষ্টি কে এভাবে একা রেখে যেতে চায় নি।দিহানের আব্বু আম্মু যাওয়ার পরই ওরা জাফলং এর জন্য বেরিয়েছে, শুধু পুষ্প আসেনি, পুষ্প বললো ওর নাকি জ্বর ও আজ কোথাও বের হবে না অল্প রেস্ট নিলেই ঠিক হয়ে যাবে আর কেউ যেন ওর জন্য ঘোরাঘুরি বাদ না দেয় তবে ও রেস্ট না নিয়ে সবার সাথে যাবে এতে যা হয় হবে, সাধারণত পুষ্প কখনো কঠিন কথা বলে না তবে আজ ওর কথাগুলো খুব কঠিন লাগছিল।
মায়া ওদের পাশে গিয়ে হাটতে হাটতে বললো,
—তোমরা কি কথা বলো?
কথা দিহান দুজনেই হেসে ফেললো, কথা বললো
—আমরা বলছিলাম আমাদের দেশে যেমন এই যে পাথর তোলা হচ্ছে এখান থেকে এভাবেই খনি থেকে সোনা তোলা হয়।
মায়া মুখ বাকিয়ে বলল,
—ওও এই কথা
দিহান হেসে বললো
—তুমি কি কথা বলতে চাও?
—আমি বলতে চাই মিষ্টি এই পাথর, বালি পার হয়ে হাটতে পারছে না,আবির ভাইয়া মিষ্টি আপুকে হাত ধরে নিয়ে এই পথটুকু চাইলেই পাড় করতে পারে,পুষ্প আপুর জ্বর হলো নিরব ভাইয়া চাইলেই আমাদের কিছু না বলে হুট করে রিসোর্টে ফিরে যেতে পারে, অদ্ভুত এসব কিছুই হচ্ছে না!
কথা আর দিহান একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগলো। দিহান কথাকে অতিক্রম করে একবার মায়ার দিকে তাকালো ওর চিন্তাভাবনা সীমিত ও সারা বিশ্ব নিয়ে ভাবছে না ও ভাবছে ওর আশেপাশের মানুষগুলো নিয়ে! ওর চিন্তাভাবনা বিস্তর নয় কাছের মানুষগুলোর কষ্টটাই ওর কাছে বিশাল!ধ্রুব মায়ার পাশে এসে বললো
—কি ব্যাপার আমাদের চুমকি রাগ কেন?
—রাগ নয় বিরক্ত
—কেন বিরক্ত কেন?
—খুবই বাজে অবস্থা বুঝেছ ধ্রুব আমরা মানুষ খুবই স্বার্থপর প্রাণী এই যে আমরা যা কিছু করি নিজের জন্য করি।
ওরা সবাই চা বাগানের পাশে এসে একসাথে দাড়ালো, বাগানে কেউ ঢুকছে না সবাই মায়ার কথা শুনছে, মায়া ধ্রুবের দিকে তাকিয়ে বলল,
—আমরা সহজ জিনিসও খুব জটিল করে ফেলি দু কদমের দূরত্ব আমরা কিছুতেই পাড় হতে পারি না! অল্প একটু আত্নমর্যাদা বিসর্জন দিয়ে আমরা পাশের মানুষটার হাতটা ধরতে পারি না! কাঙ্খিত মানুষটাকে আপন করার জন্য আমরা ঠুনকো নিয়ম ভাঙতে পারি না বরং ইট কাঠ পাথর জোগাড় করে দেই সামনের মানুষটাও যাতে ভাঙতে না পারে।আমরা তাই করি যা করতে চাই বাদবাকি কোনো কারণ ই কারণ নয় ওগুলো সব বাহানা।অদ্ভুত! খুবই অদ্ভুত!
সবাই নিজ নিজ জায়গা থেকে মায়ার কথাগুলো কানে ঢুকালো এক বার করে নিজের সাথে মিলিয়ে নিলো,মেয়েটার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।নিরব ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ভাবলো ও চাইলেই পুষ্পকে একটা অন্তত কল করতেই পারে। আবির মিষ্টি চোখাচোখি হতেই চোখ ফিরিয়ে নিলো।কথা হিমালয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো।হিমালয় পকেটে দুটো হাত ঢুকিয়ে মুখ ফিরিয়ে রইলো অন্যদিকে মনোযোগ মায়ার কথাগুলোতে ও ভেবে নিয়েছে কি করতে হবে।
মায়া বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধ্রুবর হাতে ক্যামেরা টা দিয়ে বাগানের মধ্যে দৌড় লাগালো,
—অযথা হা করে তাকিয়ে না থেকে ছবি তোলো, ধ্রুব।

চা বাগান থেকে ঘুরে ওরা নৌকা করে নদী পার হলো পাশের মার্কেট এ ঢুকলো, নিরব উশখুশ করছে তবে ফিরে যাওয়ার কথা কাউকে বলতে পারছে না।মিষ্টি দিহানের পাশাপাশি হাটছে, দিহানের জ্যাকেটের হাতা দুহাতে ধরে বলছে
—এই ভাইয়া
—বলতে থাক শুনছি
—ওই
—আরে বল, খুত খুত করছিস কেন?
—ওয়াশরুমে যাবো।
—কিইহ!
—হুউ
—এখানে ওয়াশরুম কোথায়?
—তুই দ্যাখ,
—তোর বরকে বল যা ফোট
মিষ্টি দিহানের হাত ছেড়ে দিল। কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে বের হওয়ার সময় ওদের খেয়াল হলো মিষ্টি সাথে নেই! দিহানের মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল একটা স্রোত বেয়ে গেলো ও জানে মেয়েটা কত জেদী কত অভিমানী, আবির আর দিহান কেউ কারো দিকে তাকাচ্ছে না দুজনেরই খুব অপরাধবোধ হচ্ছে,কোথায় খুজবে ওরা বুঝতেও পারছে না।মায়ার মেজাজটা চরম খারাপ হচ্ছে এদের সাথে ওর একটুও থাকতে ইচ্ছা করছে না প্রত্যেকটা মানুষ খুব ভণিতা করতে পারে এরা কেন সহজ হতে পারছে না! মিষ্টি কিছুক্ষণ বাদে হাতে দুটো ব্যাগ নিয়ে ফিরে গেলো।দিহান খুব রেগে মিষ্টির মাথায় টোকা মেরে বলল
—কই গেছিলি?
মিষ্টি দিহানের দিকে না তাকিয়ে বললো
—আমার না বিয়ে হয়ে গেছে?সো তুই আর আমার সাথে কথা বলবি না, তোকে আমি কোনো উত্তরই আর দেব না আমার থেকে দূর হ।
আবির এগিয়ে এসে মিষ্টির সামনে দাড়ালো মিষ্টি মাথা নিচু করে ফেললো, আবিরেরও খুব রাগ হচ্ছে ও রাগ দমিয়ে শান্ত কণ্ঠে বলল,
—আমায় বলো কোথায় গেছিলে?
—প্রথমে গেছিলাম পাশের একটা হোটেলে ওয়াশরুমে যেতে, তারপর ফেরার পথে আমার ছেলের জন্যে আর তার বউয়ের জন্যে দুটো শাল কিনলাম।
সবাই হা হয়ে মিষ্টির দিকে তাকিয়ে রইলো! দিহান চেচিয়ে বললো
—তোর আবার ছেলে কিসের!
মিষ্টি মুখ ঘুরিয়ে রইলো
আবির বললো,
—বুঝিয়ে বলো
—আপনার আব্বু আম্মুর জন্য।
আবির এবার খুব লজ্জা পেয়ে গেলো, ওর আব্বু আসলে একটু বাচ্চাসুলভ কেউ কোনো গিফট দিলে খুব খুশি হয় অথচ ও কখনোই বাবার জন্যে কিচ্ছু কেনে না এই মেয়েটা কিনেছে! মায়া এবার অধৈর্য হয়ে বললো,
—ধ্রুব তুমি কি একবার পুষ্প আপুকে কল করবে?আমার কাছে নম্বর নেই।
মায়ার কন্ঠে রাগ স্পষ্ট। ধ্রুব অনেকবার কল করলো কিন্তু পুষ্প রিসিভ করলো না। নিরব অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।মায়া সকলের দিকে একবার নজর দিয়ে বললো,
—আপনারা তো এখন নাস্তা করবেন তাই না? প্লিজ কন্টিনিউ।আমি রিসোর্টে ফিরে যাচ্ছি।
বলেই মায়া আর কাউকে কিচ্ছু না বলে সেখান থেকে চলে এলো।
হিমালয় অনেকবার মায়াকে ডাকলো মায়া কথা শুনলো না।হিমালয় দৌড়ে মায়ার হাত ধরে বললো,
—কি সমস্যা তোমার?
—কোনো সমস্যা নেই
—তুমি কি ভাবছ, পুষ্পের জন্য তোমার একারই কষ্ট হচ্ছে? তুমি কি বাড়াবাড়ি করছ না?! তুমি ভুলে যাচ্ছ পুষ্প আমাদের বন্ধু তোমার কেউ না, তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে না মায়ের চেয়ে মাস্যার দরদ বেশী?
মায়া অবাক হয়ে হিমালয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো এত কঠিন কথা ও কোনো দিন শোনে নি ওর মাথা ঝিমঝিম করতে লাগলো, নিঃশ্বাস ফেলতেও কষ্ট হচ্ছে, সবার সামনে হিমালয় ওকে এতগুলো কথা বললো! হিমালয় মায়ার হাত তখনো ধরে ছিলো, হুট করে মায়া সব শক্তি হারিয়ে ফেললো ওর শরীর অবশ হয়ে মায়া জ্ঞান হারিয়ে ফেললো।হিমালয় মায়াকে পড়ার আগেই ধরে ফেললো, মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে ওর খুব মায়া হলো ও একটু বিব্রত বোধ করলো আসলেই তো ও এতগুলো কথা মায়াকে কেন বললো!ওর বন্ধুরা সবাই ছুটে এলো, সবাই বিশেষ করে মিষ্টি মায়ার জ্ঞান ফেরানোর জন্য অস্থির হয়ে পড়লো।হিমালয় সবাইকে সরিয়ে হালকা করে পানির ঝাপটা দিলো মায়ার মুখে।কিছুক্ষণ পর মায়া জ্ঞান ফিরে নিজেকে হিমালয়ের বাহুতে আবিষ্কার করলো।ও আস্তে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
—আমি ঠিক আছি, প্লিজ আমি ফিরতে চাই।
ধ্রুব কিছু বলতে গেলেই মায়া থামিয়ে বলল,
—প্লিজ ধ্রুব, প্লিজ।

রিসোর্টে ফিরতে ফিরতে বিকাল প্রায় শেষের পথে ওরা দেখলো পুষ্প একটা কম্বল গায়ে জড়িয়ে বাইরে বেঞ্চিতে বসে পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে চা বা কফি জাতীয় কিছু খাচ্ছে।নিরব ব্যাস্ত ভঙ্গিতে পুষ্পের কাছে গিয়ে বললো,
—কি ব্যাপার তুই ফোন কেন রিসিভ করছিস না?
পুষ্প নিরবের কথা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে চায়ের কাপে চুমুক দিতে লাগলো।মায়া এগিয়ে গিয়ে দেখলো পুষ্পের চোখমুখ ফুলে লাল হয়ে আছে।মায়ার হঠাৎ খুবই কান্না পেয়ে গেলো ও পুষ্পকে জড়িয়ে ধরে কেদে ফেললো, কে তা ও নিজেও বুঝলো না! পুষ্পও মায়াকে দু হাতে জড়িয়ে ধরলো ঠোঁট বাকিয়ে হেসে বলল,
—তুমি কি জানো মায়া যখন কথা তোমাকে নিয়ে ট্রেনের কামড়াতে ঢুকলো আমার খুব রাগ হচ্ছিলো!আজব তো! তুমি কাদছ কেন পাগল মেয়ে?
মায়া ফোপাতে ফোপাতে বলল,
—তুমি আগে বলো তুমি কেনো কেদেছো?
নিরব এবার পুষ্পের মুখের দিকে তাকালো এতক্ষণে বুঝলো ওকে কতটা ক্লান্ত লাগছে!
— তুমি আমার থেকেও বেশি বাচাল আমার থেকেও তুমি বেশি ছেলেমানুষ,মায়া, এই মায়া?
মায়া কিছু বললো না অবিরত কাদতে লাগলো, হিমালয় বুঝলো মেয়েটা খুব অভিমান করেছে সহ্য করতে পারছে না। হিমালয়ের বন্ধুরা সবাই অবাক হয়ে মায়াকে দেখছে মেয়েটা এমন কেন!

চলবে…
সামিয়া খান মায়া

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here