অঙ্গারের নেশা
নাঈমা হোসেন রোদসী
পর্ব~৭
ব্যালকনির দোলনায় বসেই প্রানেশা ঘুমিয়ে পড়লো রাতের বেলা। সুফিয়ান ডাকতে নিয়েও আর ডাকেনি। চাদর মুড়ে দিয়ে প্রানেশাকে জড়িয়ে ধরে বসে ছিলো।
কিন্তু নিজে ঘুমায়নি, শান্ত চোখে তাকিয়ে থাকলো। ভোরের দিকে ঘুম ভাব ধরা দিলো। তখন প্রানেশাকে কোলে শুইয়ে দিলো নাহলে পড়ে যাওয়ার সম্ভবনা আছে। প্রানেশার থুতনিতে একটা খাঁজ আছে। যা চেহারার সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে। সুফিয়ান থুতনিতে আলতো করে চুমু খেয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো-
‘ যদি আমার ভালোবাসার এক বিন্দু পরিমাণ তোমার হৃদয়ে আমার জন্য তৈরি হয় তাহলে পৃথিবীর সকল সুখ তোমার চরণে লুটিয়ে দেবো প্রাণ ‘
সূর্যের তীক্ষ্ণ রশ্মি চোখে মুখে পড়তেই প্রানেশার ঘুম ভাঙলো। চোখমুখ কচলে উঠে সোজা হয়ে বসে লম্বা হাই তুললো। হঠাৎ খেয়াল হলো এটা বিছানা নয় ব্যালকনি। বড় বড় চোখ করে পাশে তাকাতেই দেখলো সুফিয়ান পাশে হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছে। বড় দোলনা হওয়ায় তেমন অসুবিধা হয়নি। প্রানেশা অবাক হয়ে তাকিয়ে বললো-
‘আরে! এ তো এখানেই ঘুমিয়ে আছে। আর আমিই বা কখন দোলনায় বসলাম। ‘
চিল্লাতে নিয়ে মুখ বন্ধ করে ফেললো প্রানেশা। এতক্ষণে ভুলেই গেছিলো যে সে নতুনভাবে সম্পর্কটা তৈরি করবে। প্রানেশা মনে মনে ভাবলো যতই সে মুখে বলুক কিন্ত নাটক বেশিক্ষণ টেকে না।একজন জীবন থেকে গেলে আরেকজনকে ভালোবাসা যায় কিন্তু একইসাথে মনে দুইজনকে স্থান দেয়া যায়না।সুফিয়ানকে এখনো ভালোবাসতে পারেনি সে,একজন মানুষকে ভালোবাসতে হলে আগে তার ভেতরটা জানতে হয়। মাত্র দুইদিন একঘরে থেকে তো আর ভালোবাসা সম্ভব না। তাই এবার মনে মনে একটা সিদ্ধান্ত নিলো প্রানেশা। নাটক করে জীবন চলে না। উঠে দাড়িয়ে চাদরটা সুফিয়ানের গায়ে জড়িয়ে দিলো।
হাত মুখ ধুয়ে এসে সুফিয়ানের সামনে দাঁড়িয়ে গম্ভীর গলায় বললো –
‘শুনছেন, এই যে উঠুন ‘
সুফিয়ানের ঘুম পাতলা হওয়ায় কিছুক্ষনের মধ্যেই উঠে গেলো৷ প্রানেশাকে দেখে মুচকি হেসে বললো –
‘শুভ সকাল প্রাণ’
প্রানেশা মাথা নাড়লো কিন্তু হাসলো না। সুফিয়ান ব্যাপারটা খেয়াল করলো। কিছু বুঝতে পারলো না, কাল রাতে ভেবেছিলো প্রানেশা বোধ হয় তাকে মেনে নিচ্ছে। কিন্তু প্রানেশার এহেন আচরণে মনে ভয় জমাট বাঁধছে। প্রানেশা বললো-
‘আপনি হাত মুখ ধুয়ে আসুন। কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে ‘
সুফিয়ানের ভেতরটা অজানা ব্যাথায় চিনচিন করে উঠলো। তাহলে, প্রাণ কী তার কাছ থেকে চলে যাওয়ার প্ল্যান করছে! যদি তা-ই হয় তাহলে তার প্রাণকে বেঁধে নিজের সাথে রাখবে। তবুও চলে যেতে দেবে না। প্রানেশা সরতেই সুফিয়ান ওয়াশরুম থেকে হাত মুখ ধুয়ে আসলো। শার্ট প্যান্ট পড়ে রেডি হতেই প্রানেশা বিছানায় বসতে বললো। সুফিয়ানের বুক ধকধক করছে। হসপিটালের সবাই যার ভয়ে থরথর করে কাপে সেও কাউকে হারানোর ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে। সুফিয়ান ধীর পায়ে বসতেই প্রানেশা হাঁটুগেড়ে নিচে বসে পড়লো। সুফিয়ান অবাক হয়ে বললো-
‘এসব কী করছো!’
প্রানেশা আঙুল মুখে দিয়ে চুপ থাকতে বললো। লম্বা একটা শ্বাস টেনে সুফিয়ানের হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নিলো। সুফিয়ান ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে। প্রানেশা সুফিয়ানের চোখে চোখ রেখে বলা শুরু করলো –
“আমি জানি আপনি আমায় ভালোবাসেন। কতটা বাসেন আমি তা জানিনা, আপনার ঐ দু চোখে নিজের জন্য অজস্র ভালোবাসা দেখেছি আমি৷ আমিও ঠিক করেছিলাম সব মেনে নিয়ে আপনার সাথে নতুন করে সব শুরু করবো৷ কিন্তু বিশ্বাস করুন, মনের উপর জোর দিয়ে আমি তা পারছিনা৷ আপনার কাছে গেলে আমি তেমন কোনো অনুভূতি পাইনা। কিশোরী বয়সের প্রথম প্রেম আমাকে আপনার কাছে আসতে দেয়না। একই চেহারা হওয়ায় আমি যতবার আপনাকে দেখি ততবারই রেয়ানের কথা মনে পড়ে। হয়তো, শারীরিক ভাবে আমাদের মাঝে একসময় সম্পর্ক হবে কিন্তু একসময় যখন আমরা বুড়ো হয়ে যাবো, হাত মুখ কুঁচকে যাবে তখন আমাদের বিরক্তি এসে যাবে।
আমরা যখন কাউকে ভালোবাসি তখন তার পরে কী হবে তা চিন্তা করিনা। তাকে ভালোবাসতেই থাকি, আর মুখে বলি ‘ আমি একতরফা ভাবেই ভালোবেসে যাবো’ কিন্তু এক না একসময় মনে হবে ‘আমারও একটু ভালোবাসার প্রয়োজন’ । মনে হবেই, কারণ এটাই নিয়ম। তাই আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ”
সুফিয়ান চোখ এদিক ওদিক করলো। চোখ থেকে এই বুঝি জল গড়াবে। এ হতে দেয়া যাবে না। হাতুড়ি পেটার শব্দ হচ্ছে বুকে৷ প্রানেশা মৃদু হেসে সুফিয়ানের গাল ধরে নিজের দিকে ফেরালো।সুফিয়ানের ঠোঁট কাঁপছে। চোখ লাল হয়ে আসছে। কোনো রকম সামলে বললো-
‘কী.. সিদ্ধান্ত?’
প্রানেশা মলিন মুখ করে বললো –
‘ আগে কথা দিন আমায়, যা বলবো তাই হবে’
সুফিয়ানের ভেতরটা ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। মুখ পাশে ফিরিয়ে হাত দিয়ে চোখ কচলে বহু কষ্টে করে বললো –
‘ হু ‘
প্রানেশা বললো-
‘আপনি চোখ বন্ধ করুন নাহলে সহ্য করতে পারবেননা’
এবার যেনো সুফিয়ানের আত্মা বের হয়ে যাবে। এমন কী কথা! যা সে সহ্য করতে পারবে না৷ তবুও, জানার জন্য বিনাবাক্যে চোখ বন্ধ করলো। মনে মনে আল্লাহর নাম নিচ্ছে। শুধু একটাই দোয়া ‘আমার থেকে আমার প্রাণকে ছিনিয়ে নিওনা ক্ষোদা’। এমন সময় প্রানেশা কানের কাছে ফিসফিস আওয়াজে বললো-
‘ আমাকে নিয়ে হানিমুনে যাবেন?’
শোনা মাত্রই তড়িৎ গতিতে চোখ খুলে ফেললো৷ হা করে তাকিয়ে দেখলো প্রানেশা হাসতে হাসতে ফ্লোরে শুয়ে পড়েছে। পেটে হাত দিয়ে খিলখিল করে হাসছে। সুফিয়ান উঠে দাঁড়ালো। টিস্যু দিয়ে নিজের কপাল মুছে ঘন ঘন শ্বাস নিলো৷ প্রানেশার দিকে তাকিয়ে জোড়ে জোড়ে বললো-
‘আর ইউ ম্যাড! দিস ইজ টোটালি রাবিস।স্টপ প্রাণ ‘
প্রানেশা হাসি থামিয়ে উঠে দাড়িয়ে গেলো। সুফিয়ানের
কাছে এসে হাত ধরে বললো-
‘সরি, কিন্তু আমি সত্যিই চাই এটা৷ একজন মানুষকে জানতে হলে তার সাথে সময় কাটাতে হয়। একঘরে সারাজীবন থেকেও দুজন অজানা থেকে যায়। তাই, আমি চাই দূরে কোথায় যেতে। যেখানে, সমাজ, রেয়ান সবকিছু একটু ভুলতে পারি।আমি এটাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যদি আমি দুই মাসের মাঝে আপনার জন্য কিছু অনুভব করি তাহলে আমি এখানেই থাকবো কিন্তু যদি মনে হয় ভালোবাসা সম্ভব না তাহলে আমরা আলাদা হয়ে যাবো। আমি চাই নিজেকে, আপনাকে আর আমাদের এই সম্পর্কটাকে একটা সুযোগ দিতে। সাহায্য করবেন না আপনার প্রাণকে?’
সুফিয়ান মুচকি হেসে মাথা নাড়িয়ে কপালে চুমু খেলো। প্রানেশার বাহু ধরে বললো-
‘ করবো প্রাণ, অবশ্যই করবো। বেশি না তুমি শুধু আমার ভালোবাসার এক বিন্দু দিও তা নিয়ে সারাজীবন কাটাবো আমি। ‘
চলবে…..