অঙ্গারের নেশা, পর্ব: ৫+৬

‘অঙ্গারের নেশা’
নাঈমা হোসেন রোদসী
পর্ব~৫

[বিঃদ্রঃ এটি আমার লেখা এই পর্যন্ত সকল গল্প থেকে ভিন্ন ও রোম্যান্টিক হবে সাথে কিছুটা থ্রিলারও।তাই সবাইকে অনুরোধ যারা রোম্যান্টিক গল্প সহ্য করতে পারেন না তারা এটা পড়বেন না]

সদর দরজার দিকে সবার দৃষ্টি গেলো। ট্রলি হাতে দাঁড়িয়ে আছে রেয়ান। প্রানেশা উঠে দাড়িয়ে রেয়ানের কাছাকাছি যেতে নিলে সুফিয়ান হাত ধরে ফেললো৷ প্রানেশা দেখলো সুফিয়ানের মাঝে কোনো প্রকার অবাকের ছাপ নেই৷ এ যেন স্বাভাবিক একটা বিষয়৷ সুফিয়ান আগের মতোই চুপচাপ বসে কাটা চামচ দিয়ে চাওমিন খাচ্ছে। কিছুটা পানি পান করে চুপচাপ নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বসে রইলো৷ কিন্তু প্রানেশার হাতটা ছাড়লো না৷ রেয়ান রাগী মুখে এগিয়ে এলো। জোরে চেচিয়ে বললো -‘এসবের মানে কী?’
তারপর বাবা মার সামনে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে বললো-‘ তোমরা আমার সাথে এমন কী করে করতে পারলে! তোমাদের বড় ছেলে তো সবসময়ই তোমাদের অতি প্রিয় তাই বলে ছোট ছেলের কোনো মূল্যই নেই!’
মিস্টার রাহাত কিছু বলার আগেই সুফিয়ান ঠান্ডা গলায় বললো -‘সবাই খেতে বসো ‘
এক কথায়ই সবাই চুপচাপ বসে পড়লো৷ এতক্ষণ যেন কিছুই হয়নি৷ প্রানেশা সবার এহেন কান্ডে হতভম্ব হয়ে রইলো৷ এ কেমন রহস্য পরিবার! সুফিয়ানের এক কথাই মনে হয় শেষ কথা৷ সুফিয়ান চুপচাপ বসে কিছু ফাইল দেখছে ৷ প্রানেশা সবার এই নির্লিপ্ততা সহ্য করতে পারছেনা, নিজের একটা প্রশ্নের জবাবও সে পায়নি। সুফিয়ানের ধরে থাকা হাতটা ছাড়িয়ে দৌড়ে রেয়ানের সামনে দাঁড়ালো প্রানেশা। রেয়ানের দৃষ্টি উদ্ভ্রান্তের ন্যায় এলোমেলো। প্রানেশা রেয়ানকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলো। বহুযুগ পর যেন আপনজনকে খুঁজে পেলো সে৷ রেয়ান প্রানেশার মাথায় হাত রেখে বললো –
‘বিয়ে কেনো করলে প্রানেশা? আমার ভালোবাসা এত ঠুনকো ছিলো তোমার কাছে? ‘

প্রানেশা কাঁদতে কাঁদতে মাথা নাড়িয়ে না বললো৷ হিচকি ওঠা গলায় বললো –
‘বিশ্বাস করো রেয়ান, আমি কাল তোমাকে ফোন করার আগ পর্যন্ত কিছুই জানতাম না । জানলে কখনো বিয়ে করতাম না ‘

রেয়ান প্রানেশার হাত ধরে বললো-
‘চিন্তা করো না, দ্রুত তোমার তালাক করিয়ে আমরা বিয়ে করে নেবো’
প্রানেশা হা করে কিছু বলতে নিলেই সুফিয়ান এসে একটানে রেয়ানের কাছে থেকে ছিনিয়ে নিলো প্রানেশাকে। তারপর হাত ভাজ করে রেয়ানের সামনে দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে বললো –
‘সে আশা ভুলে যা রেয়ান৷ এই আশা কখনো পূরণ হওয়ার নয় ‘ তারপর রেয়ানের কানের কাছে হালকা আওয়াজে বললো-‘ কী জানিস তো, অগাস্টিন বলেছেন- দুর্বলেরা ভাগ্যে বিশ্বাসী হয়, আর সবলেরা তা ছিনিয়ে নেয়’

বলে সুফিয়ান দূরে সরে আসলো। রেয়ানের মুখ লাল হয়ে আছে৷ দুজনের চোখে যেন এক নিশ্চুপ যুদ্ধ চলছে৷ একজনের চোখে জিতে যাওয়ার জ্যেতি আর আরেকজনের মধ্যে চাপা ক্ষোভ। রেয়ান ফসফস করতে করতে নিজের রুমের দিকে হাঁটা ধরলো। প্রানেশা সেই দিকে তাকিয়ে আছে। মনে মনে অনুশোচনায় দগ্ধ হচ্ছে। নিজেকে বেইমান মনে হচ্ছে তার। ভালোবাসার মানুষটাকে ধোঁকা দিয়ে কী করে সুখী হবে সে! যদিও সে সেচ্ছায় কিছুই করেনি। কিন্তু ভেতরে ভেতরে ভেঙে গুড়িয়ে যাচ্ছে। সুফিয়ান এতক্ষণ হাসলেও এখন চোখ লাল করে তাকিয়ে আছে প্রানেশার দিকে। সাহস কী করে হয়, পরপুরুষকে জড়িয়ে ধরে স্বামীর সামনে! প্রানেশার হাত ধরে নিজের রুমের দিকে নিতে ধরলেই রাহাত সাহেব বললেন -‘ আহা, মেয়েটাকে ছেড়ে দাও। ওর কী দোষ! ‘

সুফিয়ান চোখ লাল করে রাহাত সাহেবের দিকে তাকালো। ঘাড় বাকিয়ে বললো- ‘আমার এবং আমার স্ত্রীর মাঝে তৃতীয় কোনো ব্যাক্তিকে কথা বলার অনুমতি দেইনি আমি। আমার জীবনের সিদ্ধান্ত আমি একা নিতে শিখেছি বহু আগেই ‘

রাহাত সাহেব মুখ নিচু করে রাখলেন৷ সুফিয়ান প্রানেশাকে ধরে উপরে নিজের রুমে নিয়ে গেলো৷ দরজা খুলে প্রানেশাকে ফ্লোরে ছুড়ে ফেললো। সুফিয়ান দরজা লক করতেই প্রানেশা উঠে দাড়িয়ে গেলো। ভয়ে তার গলা শুকিয়ে আসছে। লোকটা যে ছেড়ে দেয়ার পাত্র নয় তা একদিনেই বুঝতে পেরেছে প্রানেশা। সুফিয়ানের মুখটা অস্বাভাবিক লাগছে প্রানেশার কাছে, কেমন যেন উন্মাদের মতোন৷ ঘাড়ের নীল রগটা ফুলে আছে৷ চোখের পলকও যেন আটকে আছে। প্রানেশার কপালে কপাল ঠেকিয়ে পেছনে হাত বাকিয়ে ধরলো সুফিয়ান৷ প্রানেশার মুখ চোখ কুচকে এলো ব্যাথায়৷ সুফিয়ান জোরে হাসা শুরু করলো, এমন পরিস্থিতিতে কেউ এভাবে হাসতে পারে তা প্রথম দেখলো প্রানেশা , ভয়ে গা গুলিয়ে আসছে তার । ভেতরের সব যেন এখনই বেরিয়ে আসবে। সুফিয়ান প্রানেশার কপাল ছুয়ে হেসে বললো –

-‘এত ভয় পাও তাহলে ওই কাজ কেন করলে প্রাণ?’

প্রানেশা থরথর করে কাপছে। সুফিয়ান আরও জোরে চিৎকার দিয়ে জিজ্ঞাসা করলো-

-‘ কেনো করলে বলো? সাহস কী করে হলো অন্য কারো ছোঁয়া শরীরে মাখার!’ বলে সুফিয়ান ঘন ঘন শ্বাস নেয়৷ তারপর মুখটা এমন করলো যখন কোনো বাচ্চার মাথায় চমৎকার বুদ্ধির আবির্ভাব ঘটে। এমন ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বোকা হেসে বললো –
-‘পেয়েছি! চলো আমার সাথে ‘

প্রানেশার মাথা পুরো ফাঁকা ফাঁকা লাগছে৷ এতক্ষণে সে বুঝে গেছে, সুফিয়ান স্বাভাবিক মস্তিষ্কের মানুষ নয়। সাইকোলজিক্যাল কন্ডিশন ভালো না তার। নাহলে এমন ব্যবহার নরমাল কেউ করেনা। সুফিয়ান বাথরুমের ভেতরে তাকে ঢুকাতেই প্রানেশার ভেতরটা ধক করে উঠলো, তাহলে কী এবার বাথটাবে চুবিয়ে মারবে! মানুষ সব কিছু হারাতে পারলেও প্রাণ হারাতে চায় না। প্রানেশা ভয়ে মুখ চেপে কেঁদে উঠলো। সুফিয়ানের দিকে তাকিয়ে বললো-
‘প্লিজ, ছেড়ে দিন আমায়। আর কক্ষনো এমন হবেনা। মারবেন না আমাকে ‘

সুফিয়ান কোনো উত্তর দিলো না। প্রানেশাকে রেখে রুম থেকে একটা সোবা নিয়ে এলো। যা দিয়ে থালা বাসন মাজা হয়। ভীষণ রুক্ষ, মাঝে মাঝে বেশি ঘষা লাগলে হাত ছুলে যায়। প্রানেশাকে বাথটাবে বসিয়ে হাতের চুড়ি খুলে একনাগাড়ে ঘষতে থাকলো। হাত থেকে শুরু করে গলা পর্যন্ত অনবরত ঘষে গেলো। প্রানেশার মুখ যখন ব্যাথায় লাল হয়ে গেলো তখন সুফিয়ান থামলো৷ মুখের অভিব্যাক্তি এখনও স্বাভাবিক নয় তার, প্রানেশা প্রায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে তখন সুফিয়ান প্রানেশার মুখটা আজলায় নিয়ে নরম গলায় বললো -‘ আমার জিনিসে আর কখনো অন্য কারো ছোঁয়া লাগাবে না প্রাণ। দেখলে তো কত কষ্ট হয় ছোঁয়া মুছতে! আমি একবার হারিয়েছি আর হারাতে দেবোনা। ‘
প্রানেশা সুফিয়ানের পাগলামিতে তাচ্ছিল্য করে হাসলো৷ ভেঙে যাওয়া গলায় ধীরে ধীরে বললো-
‘আপনি একটা পাগল। মানুষ খুন করতেও আপনার হাত কাঁপবে না ‘
সুফিয়ান প্রানেশার চুলের মুঠি ধরে কানের কাছে বললো-‘ খবরদার প্রাণ! আজ বলেছো ক্ষমা করলাম , দ্বিতীয়বার আমায় পাগল বললে ক্ষমা পাবেনা। আর খুন করতে পারি আমি কিন্তু তোমায় শেষ করা আমার সাধ্যের বাইরে। নিজের প্রাণকে শরীরের থেকে আলাদা করা কী এতই সহজ! ‘
প্রানেশা জ্ঞান হারিয়ে ফেললো। সুফিয়ান কোলে করে উঠিয়ে বেডে নিয়ে শুইয়ে দিলো৷এসির সাথে এডজাস্ট ফ্যান অন করে, টাওয়াল দিয়ে প্রানেশার হাত পা মুছে নিলো। ব্যাথা কমার একটা ক্রিম নিয়ে হাতে আর গলায় লাগিয়ে দিলো। তারপর বেডে বসে ফোনটা হাতে নিয়ে হসপিটালে কল করলো –
‘ আসাদ, তুমি আজকের প্যাশেন্টগুলোকে অন্য কোনো ডাক্তারের কাছে পাঠিয়ে দাও। আমি আজ আসবো না৷ প্যাশেন্টদের কিছু ফাইল আছে এসে নিয়ে যেও, দেখে রেখেছি ‘
বলে ফোনটা সুইচ অফ করে দিলো৷ সে পেশায় একজন সিনিয়র হার্ট সার্জেন। বর্তমানে সে নিজের একটা হাসপাতাল বানানোর একটা প্ল্যান করছে। সেটার কাজ কমপ্লিট হলে সেখানে জয়েন করবে সে।
প্রানেশার মুখের দিকে তাকিয়ে সুফিয়ান দেখলো মুখ লাল হয়ে গেছে।একটা চিনির পুতুল প্রানেশা, ছোট খাটো ব্যাথায়ও তার নাজেহাল অবস্থা হয়। সুফিয়ান যে ঔষধ দিয়েছে তাতে রাতের আগেই ব্যাথা কমে যাবে। কিন্তু এখন সুফিয়ানের নিজেরই চিন্তা হচ্ছে, নিজের ডাক্তারিতেও ভরসা করতে পারছেনা। তাই, হসপিটালে মানা করে দিলো। কিছুর যদি প্রয়োজন হয়! প্রানেশাকে জড়িয়ে ধরে সেও পাশে শুয়ে পরলো। প্রানেশার হাতটা মুখের সামনে নিয়ে বিরবির করে বললো-
” প্রাণ, এই পৃথিবীতে প্রেমিক অনেকেই হয় । কিন্তু পাগল প্রেমিক সবাই হতে পারে না। পাগল প্রেমিক হওয়া সহজ নয়, কারণ পাগলদের ভালোবাসার সীমা বোঝে না ”

অঙ্গারের নেশা
পর্ব~৬
নাঈমা হোসেন রোদসী

ঘুমের ইনজেকশনের কারণে সারা রাত ঘুমিয়ে ছিলো প্রানেশা। সকাল আটটায় ঘুম ভেঙে গেলো। শরীর বেশ ফুরফুরে মনে হচ্ছে। আড়মোড়া ভেঙে বসতেই
রাতের কথা মনে পড়লো তার। চোখজোড়া দিয়ে সুফিয়ানকে খুজতেই দেখলো প্রানেশার কোমড় জড়িয়ে শুয়ে আছে। প্রানেশা ঘুম থেকে উঠে তেমন কিছু মনে থাকে না, সুফিয়ানকে দেখে প্রানেশার ভেতরটা উথলে উঠলো। সুফিয়ানের ঠোঁট লাল নয় বাদামী বর্ণের। প্রানেশার মনে প্রশ্ন জাগলো ‘লোকটা কী সিগারেট খায়?’
খেতেও পারে যে বদ! হঠাৎ করে রাতের কথা মনে পড়ে গেলো তার। কি নিষ্ঠুরের মতোন আচরণ করে ছিলো তার সাথে! হাত গুলো চোখের সামনে নিতেই প্রানেশা হা করে তাকিয়ে রইলো। তার ধারণা মতে হাতে অসম্ভব ব্যাথা হওয়ার বা চামড়া ঝলসে যাওয়ার
কথা। শুধু মাঝে হালকা লালচে ভাব ছাড়া কিছুই নেই।
লোকটা কী জাদু করলো নাকি! প্রানেশা গালে হালকা চাপড় মেরে সুফিয়ানকে উঠানোর চেষ্টা করলো। ঘুম ভাঙছেনা দেখে প্রানেশার মন চাইলো গলা টিপে দিতে। প্রানেশা তো আর জানেনা তার সেবা যত্ন করে সুফিয়ান তিনটার দিকে ঘুমিয়েছে৷ প্রানেশার রাতে তীব্র জ্বর এসেছিলো, সেটাও সুফিয়ানের সেবায় সেরেছে। সত্যি সত্যি গলা টেপার জন্য গলায় হাত রাখতেই সুফিয়ান মাথা এপাশ ওপাশ করলো। কিছু খাওয়ার মতো মুখ নেড়ে গাল ফুলিয়ে প্রানেশার পেটে মুখ গুঁজে শুয়ে রইলো৷ প্রানেশার কেন জানি খুব মায়া লাগলো। গভীর টান অনুভব হলো। কীসের জন্য এই টান বুঝতে পারলো না। এই মানুষটাকে সে কষ্ট দিতে পারবেনা তা ভালোই বুঝতে পারলো। সুফিয়ানের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রানেশা মনে মনে ভাবলো
‘ চেহারা এক হলেও সুফিয়ান সম্পূর্ণ ভিন্ন। ভাব ভঙ্গি থেকে শুরু করে সবকিছু। ‘
প্রানেশা কাল খেয়াল করেছে রেয়ানের সঙ্গে দাঁড়ালে সুফিয়ানকে বেশ খানিকটা লম্বা মনে হয়। অর্থাৎ, সুফিয়ানের হাইট ছয় ফুট না হলেও এর কাছে। তাছাড়া হাঁটাচলায় রাজকীয় একটা ভাব আছে। শরীরটা আরেকটু ভালো করে খেয়াল করলে বোঝা যায় শারীরিক গঠনে সুফিয়ান বেশ স্বাস্থ্যবান। জিম করায় হাতের মাসেল গুলো ফুলে থাকে সবসময়। কিন্তু, একটা প্রশ্নের উত্তর কিছুতেই বুঝতে পারেনা প্রানেশা, রেয়ান যদি সুফিয়ানের ছোটই হয় তাহলে দুজনের চেহারা কী করে এক রকম হয়। ভাইয়ের সাথে চেহারার মিল থাকতেই পারে তাই বলে হুবুহু কপি! এসব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে প্রানেশা খেয়াল করেনি যে সুফিয়ান ঘুম থেকে উঠে গেছে। সুফিয়ান দুষ্টু স্বরে বললো –
‘কী ব্যাপার প্রাণ? জেগে থাকলে ফিরেও তাকাও না আর ঘুমিয়ে থাকলে চোখ দিয়ে সব গিলে খাও!’

প্রানেশা চোর ধরা পড়ার মতো মুখ করে আমতা আমতা করে বললো –
‘কী..কীসব উল্টো পাল্টা কথা! আমি আপনাকে দেখতে যাবো কোন দুঃখে? ‘

বলে কোনোরকমে পালিয়ে যাওয়ার জন্য খাটের থেকে নামতেই সুফিয়ান পেছনে থেকে জড়িয়ে রাখলো। চুল সরিয়ে ঘাড়ে নাক ঘষে বললো-
‘ দুঃখে কেনো প্রাণ! সুখে দেখবে। এত সুন্দর বর পেয়ে তো তোমার উচিত সুখে সারাক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকা। আদরও করতে পারো আমি মাইন্ড করবো না ‘

প্রানেশার ভেতরে সব যেনো এলোমেলো হয়ে গেলো। শরীর অসাড় হয়ে আসলো৷ সব ভর সুফিয়ানের উপর ছেড়ে দিলো। রেয়ানের সঙ্গে সম্পর্ক থাকলেও সুফিয়ানই তাকে প্রথম এভাবে ছুঁয়ে দিলো। এর আগে কোনো অভিজ্ঞতা নেই তার, কিন্তু একুশ বছরের যুবতী সে। তার অনুভূতিও খুব প্রখর। সুফিয়ান প্রানেশার অবস্থা বুঝতে পেরে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখলো। কোমড় চেপে কানের নিচে চুমু খেতেই প্রানেশা দিকবিদিকশুন্য হয়ে সুফিয়ানকে আঁকড়ে ধরলো। এখন তার মস্তিষ্কে শুধু সুফিয়ানের নাম চলছে।পৃথিবীর সকল কিছু থেকে সে যেনো বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লো কয়েক মূহুর্তের জন্য। সুফিয়ানকে জড়িয়ে ধরে লম্বা শ্বাস ফেলতে থাকলো সে। এমন সময় দরজায় কে যেনো কড়া নাড়লো। সুফিয়ান প্রানেশার মাথায় আলতো চুমু খেয়ে বললো-
‘যাও, হাত মুখ ধুয়ে এসো ‘

প্রানেশার মস্তিষ্ক সচল হলো৷ এতক্ষণের সব কিছু একে একে চোখের সামনে ভেসে উঠলো। অপরাধ বোধও নিজের দাপট বাড়িয়ে দিল। সুফিয়ানের থেকে নিজেকে এক ঝটকায় দূরে সরে দৌড়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো। সুফিয়ান উঠে দরজা খুলতেই দেখলো মিসেস অদিতি দাঁড়িয়ে আছে। নিজের মাকে দেখে বললো-
‘কী হয়েছে মা?’

মিসেস অদিতি সুফিয়ানের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন –
‘ তোমার না হাসপাতালে যেতে হবে , এসে খেয়ে নাও। আর প্রানেশা উঠেছে?’

‘হ্যা, ফ্রেশ হচ্ছে ‘

‘ঠিক আছে, ওকে নিয়ে খেতে এসো ‘

‘মা শুনো’

‘কী হয়েছে?’

সুফিয়ান শক্ত গলায় জিজ্ঞেস করলো –

‘ফুপি কী নিচে বসে আছে? সে থাকলে খাবারটা উপরে পাঠিয়ে দাও, আমি চাইনা প্রাণ বিনা দোষে কারো কটু কথা শুনুক’

মিসেস অদিতি মুচকি হেসে বললেন-

‘না, সে তো কাল সন্ধ্যায়ই নিজের বাসায় চলে গেছে।তুমি চিন্তা করোনা, এখন শুধু তোমার মামাতো বোন লিজা আছে মেহমানদের মাঝে। ‘

‘লিজা তো আরও বড় সমস্যা মা’

‘ আমি বলে দিয়েছি যেন সে কোন প্রকার অযৌক্তিক আচরণ না করে। লিজা আর ওমন করবেনা বলেছে ‘

‘না করলেই ভালো । আমার প্রাণের সামনে যদি কোনো প্রকার ছেঁচড়ামো করে তাহলে জান হাতে আর ফিরবেনা তোমার ভাগ্নী ‘

‘আহা! তুমি এসো তো’

বলে মিসেস অদিতি সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেলো। প্রানেশা বের হতেই সুফিয়ান ভেতরে চলে গেলো। ফ্রেশ হয়ে গায়ে হোয়াইট শার্ট প্যান্ট চাপিয়ে নিলো৷ প্রানেশার চুল আঁচড়ানো হলে সুফিয়ান প্রানেশার মাথায় আলতো চুমু খেয়ে হাত ধরে নিচে নামলো। প্রানেশা প্রথমে ছাড়িয়ে নিলেও সুফিয়ানের চোখ রাঙিয়ে দেওয়ায় আর সাহস পায়নি। নিচে গিয়ে টেবিলে বসতে নিতেই প্রানেশার চোখ গেলো রেয়ানের দিকে। এতক্ষণ ধরে রেয়ান ওদের দিকেই তাকিয়ে ছিলো। দুজনকে একসাথে দেখে রেয়ান চোখ মুখ লাল করে তাকিয়ে আছে। মনে মনে সুফিয়ানের থেকে প্রতিশোধ নেয়ার পণ করছে। এর মাসুল সে নিয়েই ছাড়বে।
প্রানেশা করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো রেয়ানের দিকে। এতক্ষণ ধরে তার মনেই ছিলো না যে রেয়ানও এখানে থাকবে৷ দম বন্ধকর হাসফাসে মারা যাচ্ছে সে। বার বার মনে হচ্ছে সে ধোঁকা দিচ্ছে তার প্রথম প্রেমকে। সুফিয়ান ব্রেডে হালকা বাটার লাগাতে লাগাতে বললো -‘প্রাণ,বসে খেয়ে নাও’

প্রানেশা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে চেয়ার টেনে বসলো। দ্বিধায় আছে সে। বিয়ের মতো পবিত্র সম্পর্ক নিয়ে প্রানেশা সিরিয়াস। বিয়ে কোনো ছেলেখেলা নয়, যে চাইলে ভেঙে আরেকটা করে নিলাম। আবার, জীবনের প্রথম অনুভতি যার জন্য তাকেই বা কী করে ছেড়ে মুখ ফেরাবে সে! এসব ভাবলে প্রানেশার মাথা ঘোরে। ব্রেড মুখে নিয়েও গিলতে না পেরে পানি খেয়ে নিলো। মুখে দিতেও ইচ্ছে করছে না। প্লেটটা সরিয়ে উঠতে নিলে সুফিয়ান বললো-
‘খাবার নষ্ট করতে নেই, খেয়ে তারপর ওঠো’

প্রানেশা বিরক্তিকর কন্ঠে বললো –

‘ বমি পাচ্ছে আমার, আমি খেতে পারছি না ‘

পাশের থেকে লিজা হেঁসে হেঁসে বললো –

‘এ বাবা! বিয়ের দুইদিন হলো না তার মাঝেই বমি পাচ্ছে। অবশ্য, অস্বাভাবিক তো নয়। রেয়ানের সঙ্গে সম্পর্ক তো ছিলো তোমার। এই সুফি, কেন বিয়ে করলে এমন কাউকে বলোতো! ‘

প্রানেশা ভ্রু কুঁচকে তাকালো৷ ভীষণ বিরক্ত হলো প্রনেশা। সে হিন্দি সিরিয়ালের নাইকার মতোন ছিচকাদুনে, ইমোশনাল নয়। যথেষ্ট পজিটিভ মাইন্ডের। সামনে বসা লিজার মুখে এসব বেশি বিরক্ত হলো সে৷ কারণ এই রকম কথা যদি লিজাকে বলা হতো তাহলে হয়তো বিশ্বাস করা যেতো, লিজার গায়ে হাতাকাটা টপ, পায়ে এঙ্কার হিল জুতা, গোরালির থেকে উঁচুতে একটা স্কার্ট। প্রানেশাকে তাচ্ছিল্য করে লিজা মনে মনে পৈশাচিক সুখ অনুভব করছিলো কিন্তু তাতে এক বালতি জল ঢেলে দিয়ে প্রানেশা আবারও চেয়ার টেনে বসলো। ব্রেড হাতে নিয়ে বললো-

‘ লিজা আই থিঙ্ক, তোমার কমন সেন্সের অভাব আছে। ইউ নিড প্রপার ট্রিটমেন্ট । বমি হলেই যে একজন মানুষ প্রেগন্যান্ট হয়ে যাবে এটা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। বমি সাধারণত দুর্বলতা, সিকনেস,জ্বর আরও অনেক কিছু হতে পারে। তুমি করে বললাম বলে কিছু মনে করো না, একচুয়েলি বড় হলেও সম্পর্কে তুমি আমার ছোট তাছাড়া হাতে পায়ে বড় হলেই তো আর বড় হওয়া যায় না । একটা সুস্থ মস্তিষ্কেরও প্রয়োজন ‘

পুরো কথাটা বলে প্রানেশা ব্রেড চিবোতে থাকলো। সুফিয়ান মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো প্রানেশার দিকে। দারুণ জবাব দিলো লিজাকে। লিজাকে তাচ্ছিল্য করে হেসে বললো –
‘তো লিজা, কী যেন জিজ্ঞেস করছিলি! আমি কেন প্রানেশার মতোন মেয়েকে বিয়ে করলাম। এতক্ষণে নিশ্চিয়ই জবাব পেয়ে গেছিস’

লিজা অপমানে ফুঁসে উঠলো৷ খাবারের প্লেটটা ধাক্কা দিয়ে বিরবির করতে করতে উপর চলে গেলো। ছোট বেলা থেকে সুফিয়ানের জন্য পাগল হয়ে আছে লিজা, কিন্তু অপমান ছাড়া আর কিছুই পায়নি।

সুফিয়ান খাওয়া শেষ করে এপ্রোন পড়ে নিয়ে প্রানেশাকে সাবধানে থাকতে বলে চলে গেলো।
এভাবেই নিজের ঘরে বসে বসে বোর হয়ে যাচ্ছে প্রানেশা, তাই রান্নাঘরে গিয়ে দেখলো মিসেস অদিতি রান্না করছেন। বেশ সুন্দর দেখতে, এত বড় ছেলে আছে বোঝাই যায় না। সুফিয়ানের মুখের গড়ন তার মায়ের মতোন হয়েছে। মিসেস অদিতি প্রানেশাকে দেখতেই মুচকি হেসে বললেন-
‘এসো, তোমার সাথে তো কথাই হলো না ‘

প্রানেশাও হালকা হেসে ভেতরে এসে তার পাশে দাঁড়ালো। কী কাজ করবে বুঝতে পারছেনা। রান্না পারে সে কিন্তু অন্য কারো রান্নাঘরের তেমন কিছুই জানেনা তাই মিনমিন করে জিজ্ঞেস করলো –
‘মা, আমি কি কাজ করবো? ‘

মিসেস অদিতি হাসতে হাসতে বললেন-

‘তোমাকে কাজ করতে হবে না মা, তুমি পাশে দাঁড়াও অথবা গরম লাগলে নিজের রুমে চলে যাও’

প্রানেশা এত সুন্দর নির্লিপ্ত কথায় খুশি হলো। এখানে আসার পর নিজের মা বাবাকেও মিস করছিলো। এখন মনে হলো এটা বুঝি আরেকটা মা। সংকোচ নিয়ে প্রানেশা বললো-

‘মা একটা কথা জিজ্ঞেস করি? ‘

‘পাগলি মেয়ে! মাও বলছে আবার জিজ্ঞেস করতেও ভয় পায়! বিনা সংকোচে যা ইচ্ছে বলো’

প্রানেশা উৎসাহ নিয়ে বললো-

‘ মা, আমি কিছু বুঝতে পারছি না। সুফিয়ান কেনো আমাকে বিয়ে করলো এটা জানা সত্ত্বেও যে তার ছোট ভাইয়ের সাথে আমার সম্পর্ক আছে? তাছাড়া, সুফিয়ান আর রেয়ানের চেহারায় এতো মিল কী করে!’

মিসেস অদিতির মুখ মলিন হয়ে গেলো। প্রানেশার হাত ধরে বললো-

‘ শোনো প্রানেশা, আমি জানি তুমি রেয়ানকে ভালোবাসতে। তারপরও সুফিয়ান তোমায় বিয়ে করেছে এ নিয়ে তুমি খুব চিন্তায় আছো, কিন্তু একটা কথা বলি সুফিয়ান যেমন খুব কঠোর তেমনি মনের দিকে ভীষণ নরম। ছেলেটা আগে এমন ছিলো না, নিজের অতি প্রিয় এক জিনিস হারিয়ে এমন হয়ে গেছে। তাকে একটু ভালোবেসে দেখো সে তোমায় মাথায় করে রাখবে, জানি এটা তোমার পক্ষে কঠিন কিন্তু অসম্ভব নয়। জানো তো মেয়েদের সম্মান তাদের কাছে সবার আগে, সমাজকে আমরা যতই পরোয়া না করি কিন্তু দিন শেষে এখানেই থাকতে হয় আমাদের। তাই, আলাদা হওয়ার চিন্তা না করে তাকে আপন করার চেষ্টা করো। দেখবে সে নিজেই তোমার সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দেবে’

কথাগুলো বলে তিনি প্রানেশাকে আদর করে মাথায় চুমু দিয়ে ঘরে যেতে বললেন। প্রানেশা মাথা নাড়িয়ে ঘরে গেলো। এভাবে এক সপ্তাহ কেটে গেলো। প্রতিটি মুহূর্ত মিসেস অদিতির কথা ভেবে গিয়েছে সে। সুফিয়ানের এতো ভালোবাসা আর কেয়ার তাকে বাধ্য করে ভাবতে। তার বুকে মাথা রেখে ঘুমানো। সকালে উঠে সুফিয়ানের দুষ্ট কথা, হাসপাতাল থেকে ক্লান্ত হয়ে ফিরেও তার খেয়াল রাখা সবকিছু তাকে ভাবায়। এতদিনে সে বুঝতে পেরেছে সুফিয়ান তাকে অতিরিক্ত মাত্রায় ভালোবাসে। মনে মনে সে ভাবে-
‘মানুষটাকে কী একটা সুযোগ দিয়ে দেখবো!’

কলিং বেল বাজতেই ভাবনায় ছেদ ঘটে। প্রানেশা বুঝতে পারলো সুফিয়ান এসেছে। আজ নিজে থেকেই একটা লাল শাড়ি পড়ে নিলো প্রানেশা। সুফিয়ান ঘরের দরজায় নক করতেই গেট খুলে একগাল হেঁসে ভেতরে আসতে বললো। সুফিয়ান শক হয়ে গেলো, এত পরিবর্তন কী করে হলো। প্রানেশা তো তার সাথে কথা বলতেও দ্বিধা কাটিয়ে উঠতে পারে না। তাহলে আজ লাল শাড়ি পড়ে তার অপেক্ষা করছে কী করে!
প্রানেশা নিজেই সুফিয়ানের এপ্রোন খুলে দিয়ে পানি এগিয়ে দিলো। সুফিয়ান বোকার মতো কিছুক্ষণ তাকিয়ে প্রানেশার হাত থেকে পানি নিয়ে খেয়ে ফ্রেশ হতে গেলো৷ প্রানেশা ঠোঁট চেপে হাসলো। এবার থেকে সে চেষ্টা করবে এই মানুষটাকে মেনে নিতে। সময় লাগলেও এরকম ভালোবাসা সে পায়ে ঠেলার মতো বোকা নয়। সুফিয়ান বের হয়ে দেখলো প্রানেশা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে। চুল গুলো মুছে টাওয়াল পাশে ছড়িয়ে দিয়ে ব্যালকনির দিকে গেলো। পাশে দাঁড়াতেই প্রানেশা তাকে আরও অবাক করে দিয়ে হালকা করে জড়িয়ে ধরলো। সুফিয়ান অবাক হওয়ার পালা চুকিয়ে হেসে নিজেও জড়িয়ে ধরলো। গাল হাত রেখে পরিবেশটা আরও সৌন্দর্যে মুড়িয়ে দিতে মোহনীয় কন্ঠে বললো –

দেখো, নিয়ন বাতির ঝাপসা আলোয়
সব যেনো আলোকিত,
বুকের পাশে চুপটি করে
শুনছো তুমি কী এতো?
দেখো, ভালোবাসার চাদর মুড়ে
মাখছো গায়ে উষ্ণ ছোঁয়া,
অনুভূতির সংবিধানে
বুঝতে পারো মনের কথা?
গেলে সেদিন দৌড়ে কোথায়?
ভরিয়ে দিয়ে রঙিন ব্যাথায়!
লুকোচুরির অন্ত হলে,
এসে পড়ো মনের কোঠায়।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here