“আকাশী”
পর্ব ১
আচমকা কোথা থেকে যেন কান্নার রোল ভেসে এলো। হঠাৎ এই বাড়িতে সকাল সকাল কান্না! কারো কিছু হয়েছে নাকি? আকাশী চোখ মুছে পাশে চেয়ে দেখে বিভা নেই। সে তড়িঘড়ি করে উঠে পরিষ্কার হয়ে বাইরে গেল। একটু আগে মনে হয়েছিল এই বাড়িতে অনেকজন কাঁদছে। দোয়ারে বড় আপাকে দেখে সে থমকে দাঁড়ায়। তিনি ম্লানমুখে দাঁড়িয়ে আছেন। এই সকালে তিনি শ্বশুরবাড়ি থেকে কেন এসেছেন? আকাশী কিছুই বুঝে উঠতে পারল না। সে একছুটে তার কাছে যেতেই আপা নিজ দায়িত্বে বলল, মাম্মা আর এই দুনিয়ায় নেই।
‘দুনিয়ায় নেই’ এর মানে কী? যেই বুড়িটা হুইলচেয়ার থেকে উঠতে পারে না সে আবার কোথায় যেতে পারে? এর মানে কী তা বড় আপার কাছ থেকে জিজ্ঞেস করতে তার মন বলছে না। তিনি আবার চিৎকার করে উঠতে পারেন। তাই সে নিঃশব্দে কান্নার মৃদু আওয়াজকে অনুসরণ করে বাইরে বেরুয়।
বাইরে অনেক লোক ভিড় জমিয়েছে। কী হয়েছে সে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। মাম্মার কোলে তো সে কালরাতও বসেছিল। হঠাৎ এই দশটার মাঝে কী হয়ে গেল? ভিড়ের কাছে সে অনিককে দেখতে পেল। অনিকও যেন আকাশীর প্রশ্নসূচক দৃষ্টিকে বুঝতে পেরেছে।
‘কী হয়েছেরে অনিক?’
‘বুড়িটা মারা গেছে।’
‘কি!’, কিছুটা চেঁচিয়ে উঠে সে দৌড়ে সামনের একটা বাড়িতে ঢুকতে যায়। বাইরের তুলনায় অন্দরেই লোক যেন বেশি। পুচকে আকাশী সবাইকে ঠেলে ভেতরে ঢুকল। সদ্য স্নান করিয়ে আনা হয়েছে মাম্মার শরীরকে। আশ্চর্য! এই মহিলার কোলে বসে সে কালরাতও গল্প শুনছিল। পেছন থেকে অনিক এসে তাকে টানতে লাগল। সেই টানে আকাশী বেরিয়ে গেল। সে অস্ফুট একটা শব্দ করে বলল, ‘মাম্মা কীভাবে মরতে পারেন? উনি বলেছিলেন, আমাকে বিবিজানের রূপের বর্ণনা দেবেন। এতো তাড়াতাড়ি চলে কেন গেলেন? কবে গেলেন?’
‘ভোর চারটায়।’ কিছুটা বিরস হয়ে অনিক বলল, ‘হঠাৎ হাঁপানি তীব্রতর হলো। অপূর্ব ভাইয়ের সামনেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল। মরে যাওয়ার আগে নাকি তোকে একটু দেখতে চেয়েছিল। তুই যে সবসময় তাঁর আশেপাশে ভোঁ ভোঁ করে বুড়িকে মাতিয়ে রাখতি! ওঁর যত্ন তো কেউ করতেও পারত না। সবাইকে দূর দূর করে তাড়াত। এক অপূর্ব ভাই আর এক তুই, বুড়ি তো তোদের দু’জনকেই বেশি ভালোবাসত। অপূর্ব ভাইও যে তাকে… আচ্ছা, ভালো কথা, তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। সবাই খুঁজতে খুঁজতে শেষ। সে যে কোথায় গেল কেউই বুঝতে পারছে না।’
আকাশীর চোখ থেকে তখন সদ্য নির্গত হয়ে গড়িয়ে পড়া ফোঁটাখানেক পানির রেখা শুকায়নি। সে বলল, ‘আমি জানি।’
অনিক কিছু বলার আগেই সে দৌড় লাগাল। ভেতরের লোকেরা সবাই মাম্মাকে ঘিরে বসে কাঁদছে। তার কাছে যারা বসে আছে, তারা অনেকেই কোরআন তেলাওয়াত করছে। পাশে আগরবাতির ধোঁয়া উঠে মিলিয়ে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। অপূর্ব ভাইয়ের রুমটা দ্বিতীয় তলায়। ওইদিকে একটা পিঁপড়েও নেই। সিঁড়ি বেয়ে উঠে সে অপূর্বের রুমে ঢুকল। ভাইয়া অন্যান্যদের মতো তেজি নন। এতো বড়লোকের ছেলে, অথচ রাগ উঠলে ভাঙচুর করেন না। শান্ত থাকেন, তবে চোখ ফুলে একাকার হয়। রাগ করলে বোঝাও যায় না। আকাশীর জানা আছে সে কোথায় থাকবে। সে বাথরুমের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ভাইয়া, আছেন কি? ভাইয়া, ভাইয়া।’ ক্রমশ ডেকেই চলল। তারপর সাহস করে সে দরজায় ধাক্কা লাগাল। দরজাটা এক ধাক্কায় অনেকটুকু ফাঁকা হয়ে গেল। তার মানে ভাইয়া এটা বাঁধেননি। অপূর্বের শার্ট-প্যান্ট ভিজে চপচপ করছে। সে ফ্লোরে পড়ে আছে দেয়ালের সাথে ঠেশ দিয়ে। উপর থেকে ক্রমাগত ঝর্ণাধারা বয়ে যাচ্ছে। তার চোখগুলো বন্ধ। আকাশী ভেবেই আঁতকে উঠল, ভাইয়া হয়তো চারটার পর থেকে এতক্ষণ এইভাবেই আছেন। সম্বিত ফিরে পেতেই সে ডাকাডাকি করে ভেতরে ঢুকল, ভাইয়া, ভাইয়া উঠুন।
আকাশী ঝর্ণার কলটা ঘুরিয়ে বন্ধ করে দিল। এরপর অপূর্বকে ডাকতে গিয়ে দেখল, তার শরীর ঠান্ডা হয়ে গেছে। তার ধারণাই সঠিক ছিল। সে অনেক আগে থেকে ভিজছে। আকাশী অপূর্বকে টানতে চাইল, সে একবিন্দুও নড়ল না। অগত্যা দৌড়ে নিচে গিয়ে চাচিকে বলল অপূর্বের বাথরুমে ভিজে পড়ে থাকার কথা। কয়েকজন চাচা এসে অপূর্বকে ধরাধরি করে বাথরুম থেকে বের করিয়ে আনলেন। তারপরেরগুলো দেখা যায়নি। হয়তো ভাইয়ার কাপড় পাল্টানো হচ্ছিল। মাম্মাকে কবর দিতে যাওয়ার আগে অপূর্বকে দেখা যায়। তার ফোলা ফোলা চোখ থেকে আর পানি ঝরছিল না। সে তার দাদির খাটিয়া নিয়ে আরও তিনজনের সাথে কাঁধ মিলিয়ে কবরস্থানের দিকে চলে গেল। আকাশী উৎসুক দৃষ্টিতে সেইদিকে চেয়ে রয়েছে। কবরটা তার বাড়ি থেকে কিছুদূরে ক্ষেত পেরিয়ে বড় একটা জায়গা জুড়ে বিস্তৃত। সরাসরি সবকিছুই দেখা যাচ্ছে। খোঁড়া কবরের উপরে একটা বড় পর্দা টাঙানো হয়েছে ছায়া পড়ার জন্য, যাতে কবর খুঁড়তে সুবিধা হয়। সেই ছায়াতলে এখন অনেক ভিড়। মাম্মার শরীরকেও দেখা যাচ্ছে না। মাঝখানের প্রায় পোশাকই সাদাটে। অদ্ভুত চোখে আকাশী এই দৃশ্য চেয়ে রইল। একটু বোঝ-ব্যবস্থা হওয়ার পর থেকে সে কারো মরার পরের ঘটনা স্বচক্ষে দেখেনি। মাম্মার মরে যাওয়াটা কোনোভাবেই সে নিতে পারছে না। তাহলে বুড়িটা কি এখন থেকে আর তাদের মাঝে থাকবে না? সে এতো বড় হয়েছে পড়ুয়া করতেন না। তবু কোলে নিতেন। এখন থেকে কি… ক্রমে তার গাল বেয়ে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। কেন পড়ল তা সে বুঝতে পারছে না। তবে লাগছে বুড়িটাকে সে আর কখনও দেখতে পারবে না। ঝিম ধরে সে অপূর্বের রুমে একাই বসে ছিল। যাবতীয় আত্মীয়রা নিচেই আছে। হঠাৎ আবারও হইচই শোনা গেল। আকাশী বেরিয়ে সিঁড়ির কাছে আসতেই দেখল, মিজান চাচা ভাইয়াকে কোলে করে আনছেন। এত বড় গড়নের ভাইয়াকে তার কোলে একটা ঘুমন্ত শিশুর মতোই লাগছে। আরও কয়েকজন ছেলেমানুষ তাঁর সাথে ব্যস্ত হয়ে পড়ে অপূর্বকে রুমে ঢুকিয়ে বিছানায় শুয়ে দিল। পরবর্তীতে কোলাহলে জানা গেল, ভাইয়ার তুমুল গায়ে জ্বর উঠায় অজ্ঞান হয়ে পড়েছেন। ডাক্তারকেও ডাকিয়ে আনা হলো। তিনি বললেন, অতিরিক্ত ভেজার কারণেই জ্বর বেঁধেছে। আকাশী এককোণে দাঁড়িয়ে অপূর্বের হাতের দিকে দেখছিল। আঙুলগুলো ঝরঝরে হয়ে গিয়েছে। দীর্ঘক্ষণ পুকুরে গোসল করার দরুন তার নিজের হাতের যে অবস্থাটা হয়, ভাইয়ারও তাই হয়েছে। সে মিনমিন করে বলল, ‘ভাইয়া ভোর চারটা থেকে ভিজছিলেন বাথরুমে ঝর্ণা ছেড়ে দিয়ে।’
‘তাইতো বলি!’, ডাক্তার ব্যস্ত হয়ে পড়ে ছোটচাচুকে বললেন, ‘ধরুন, আমি এতে ওষুধের নাম লিখে দিয়েছি। আপনাদের এই কঠিন সময়ে অপূর্বের অসুস্থ হয়ে যাওয়া…যাক, সারতে দেরি লাগবে না। একটা কাজ করুন, কাউকে আমার সাথে পাঠিয়ে দিন। আমি নিজেই ওষুধগুলো পাঠিয়ে দিব।’
আকাশী বলে উঠল, আঙ্কেল, আমি যাব।
ডাক্তারের সাথে আকাশী গিয়ে ওষুধ নিয়ে এলো। সময়মতো কিছু খাইয়েও দেওয়া হলো অপূর্বকে। রাতের দিকে দশটা নাগাদ সে চোখ একটু ভালোভাবে খুলে তাকাতে পেরেছিল। পুনরায় জ্বরের বেগে চোখজুড়ে ঘুম এসে গেল তার।
বাড়িতে এখন কেউই নেই বাবা ব্যতীত। মায়েরা সকলেই অপূর্ব ভাইয়ার বাড়িতে রয়ে গেছে। ছোটচাচু আর বড়চাচুকে সকলে সান্ত্বনা দিয়ে চলেছেন। মা’কে হারিয়ে বড়চাচুই বেশি কাঁদছেন। কারণ তিনি কয়েক বছর যাবৎ এখানে থাকছেন না। মায়ের বিদায়ের আগেও মা’কে জীবিত অবস্থায় দেখার ভাগ্যটা হয়নি বলেই হয়তো এতো বেদনা তার মনে। ঘড়িতে ঘণ্টার কাঁটা এগারোটা ছুঁইছুঁই। বড়চাচুর ভসভস গলার কান্না খোলা বারান্দা পর্যন্ত আসছে। আকাশী রেলিঙের সাথে হেলান দিয়ে চুপটি করে বসে রইল। একটা সুদর্শন ছেলে এগিয়ে এলো। তাকে আসতে দেখে সে ফ্রকটা আরেকটু নামিয়ে খোলা পা ঢেকে জবুথবু হয়ে বসল। ছেলেটা এসে নিচু গলায় বলল, ‘কে তুমি? এই শীতে এখানে কী করছ? পায়ে ঠান্ডা লাগছে না?’
‘আমার কাছে ঠান্ডা লাগে না।’ আকাশী উঠে দাঁড়াল।
ছেলেটার ফোলা চোখগুলোতে কিছুটা বিস্ময় খেলছে, ‘কেন?’
‘কারণ আমি নিজেই ঠান্ডা।’
‘ও তাই? কে বলল এই কথা?’
‘ভাইয়া। অপূর্ব ভাইয়া।’
‘অপূর্ব? ওর সাথে তোমার কিসের কানেকশন?’
‘আমি ভাইয়ার কাছে পড়ি।’
‘ওহ্ আই সি। তুমিই বুঝি বিভা?’
‘বিভা তো আমার সেজ আপা। আমি আকাশী।’
‘আকাশী? বাহ্! তুমি তো দেখছি বেশ বড় হয়ে গিয়েছ।’
আকাশী এহেন কথায় ভ্রূ কুঞ্চিত করে গলা কিছুটা চওড়া করে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কে?’
‘আমাকে চেন না? তুমি যাকে বড়চাচু বল, তার বড় ছেলে, জয়। আহ্! চিনবেই বা কী করে? কয়েকবছর আগেই যে শহুরে বাসিন্দা হয়ে গিয়েছিলাম!’
আকাশী তার বড় গড়ন দেখে তার বয়স অনুমান করার চেষ্টা করল। হয়তো অপূর্ব ভাইয়ার চেয়ে বছর দুয়েক বড় হবেন। ভাইয়ার বয়স আকাশীর জানামতে আঠারো বছর। তাহলে ইনি আঠারো প্লাস..
অপরিচিত এই ছেলেটির সামনে আকাশী বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। বেরিয়ে একবার অপূর্বের রুমে গেল সে। সে এখনও কিছু খায়নি, যার ফলে কেউ ওষুধ খাওয়াতে পারছে না। আকাশী গিয়ে অপূর্বের বিছানা থেকে খানিক দূরের সোফায় বসে রয়েছে। মিনিট দশেক পর অপূর্ব চোখ খোলার পর তার চোখের কোণ বেয়ে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। আকাশী উঠে এলো, ‘কিছু লাগবে?’
মৃদু হাসল অপূর্ব, ‘আমার পাশে বসো। আমার কপালে হাত বুলিয়ে দাও।’
আকাশী তাই করল। অপূর্বের উত্তপ্ত কপালে ধীরে ধীরে তার কোমল হাতটা দিয়ে বুলিয়ে দিল।
‘আকাশী, কাল দাদু আমাকে বলেছিল ভালো থাকিস। আমি ওইজন্য তেমন কাঁদছি না। এই, জানো, তুমি বরফের একটা টুকরো।’
অপূর্ব গম্ভীর গলায় বললেও আকাশী একগাল হাসল। ভাইয়ার হয়তো হুঁশ তেমন একটা নেই, তবু তাকে বরফ বলছে। হয়তো আরাম লাগছে। আকাশী বুদ্ধি করে কপাল থেকে নিয়ে শুরু করে চারিদিকে তার ঠান্ডা দুটো হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। অপূর্ব চোখ বাঁধার পর আকাশী অন্যান্য জায়গায় বুলিয়ে এসে হাতদুটো অপূর্বের শার্টের ভেতর নিয়ে যেতেই শিউরে উঠল। তার ওখানে অজস্র লোম! এমন সময় অপূর্বও শার্টের ওপর থেকে তার হাত ধরে ফেলল, ‘এটুকু থাক, আর নিচে যেও না।’
(চলবে…)
লেখা: ফারিয়া কাউছার