রঙহীন জীবনের রঙ,পর্ব:১১

0
377

গল্প: #রঙহীন_জীবনের_রঙ
পর্ব ১১
লেখনীতে: #স্বর্ণা_সাহা (রাত)

এভাবে বেশ ক’টা মাস কেটে গেছে। দিশানী সেই একই রকম চঞ্চল আছে, তবে নীলাদ্রি ভেজা বেড়াল থেকে জংলী বেড়াল হয়েছে।আজ দিশানীদের স্কুলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত। নীলাদ্রি একটা কালো রঙের খাদি কাপড়ের পাঞ্জাবী পড়েছে,সাথে সাদা চোজ পায়জামা, হাতে কালো রঙের ঘড়ি। নীলাদ্রি কাজ করছে এমন সময় ওর চোখ যায় গেটের দিকে, একটা মেয়ে যার পরনে ছাঁই রঙা গোলাপি পাড়ের কটনসিল্ক শাড়ি, কানে ঝুমকো, হাতভর্তি চুড়ি। মেয়েটি স্কুলের ভেতরে ঢুকছে আর নীলাদ্রি তার দিকে এক ধ্যানে চেয়ে আছে। মেয়েটা আর কেউ নয় দিশানী,ওর চুলে আজ দুইবেনির জায়গায় খোঁপা করে ফুল লাগানো। দস্যিনী মেয়েটাকে আজ অপরূপা লাগছে। নীলাদ্রির চোখ এখনো দিশানীতেই আটকে আছে। সৌম্য নীলাদ্রি কে এভাবে দেখে নীলাদ্রিকে একটা ধাক্কা দিয়ে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
—কিরে নীলাদ্রি যে মেয়েকে সহ্যই করতে পারিস না তাকে কি এতো দেখছিস,ব্যাপারটা কিন্তু ঠিক লাগছেনা?
নীলাদ্রি মাথা চুলকিয়ে উত্তর দিলো,
—না তেমন কিছুনা, ভাবছি এই দিশানী সেই দস্যি দিশানীই তো।

অনুষ্ঠান চলাকালীন কিছুক্ষন পর পর নীলাদ্রি দিশানীর দিকে তাকাচ্ছে, না চাইতেও তাকাচ্ছে চোখগুলো যেনো বড় অবাধ্য হয়ে গেছে। দিশানী শুধু একবার নীলাদ্রির দিকে তাকিয়েছে।

এই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পর থেকে নীলাদ্রির মনে দিশানীর প্রতি আলাদা একটা অনুভূতি কাজ করে।
—————
নীলাদ্রি ওর ক্যামেরাতে একটা ছবি খুব যত্নসহকারে দেখছে, এই ছবিটা সেই ছবিই যেটা নীলাদ্রি ফুলের জায়গায় তুলে ফেলেছিলো।মানে এটা দিশানীর ছবি।এভাবে দিন যেতে যেতেই একদিন নীলাদ্রি ওর অজানা অনুভূতিকে অনুভব করতে পারলো,এই অজানা অনুভূতির নাম “ভালোবাসা”।কিন্তু দিশানী কে এসব বলে লাভ নেই ও কি বুঝবে এসবের কিছু, আবার পঁচা ডিম বা টমেটো ছুড়ে মারবে না তো??

নীলাদ্রি একদিন দিশানী কে প্রপোস করে, দিশানী ওখানেই অবাক হয়ে যায়। ও কিছু না বলে ওখান থেকে চলে আসে, দিশানীর কেনো জানি নীলাদ্রি কে কোনো শাস্তি দিতে ইচ্ছে করছে না।
নীলাদ্রি কোনো উপায় না পেয়ে দিশানী কে চিঠি লেখা শুরু করে, একের পর এক চিঠি দিতে থাকে নীলাদ্রি দিশানীকে। দিশানীর মনও গলতে শুরু করে।

প্ৰিয়,
শুধুই প্ৰিয়?ওহ না দিশুপাখি এটা বলে ডাকবো তোমায় এখন থেকে, তোমাকে এই নামে কিন্তু শুধু আমি ডাকবো।প্ৰিয় দিশুপাখি আচ্ছা তুমি আমার উপরে ঠিক কি জাদু করেছো বলোতো?যে ছেলেটা তোমাকে সহ্য করতে পারতো না সেই এখন তোমার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। তোমার টানা টানা চোখদুটো আমায় মাতাল করে ফেলে, তোমার টোল পড়া গালের হাসিতে আমি হারিয়ে যাই, তোমার দস্যিপনাগুলোকে দেখতে এখন বড্ড বেশি করে ভালো লাগে,তুমি কি জানো তোমার বিরক্ত হয়ে ভ্রু কুঁচকে থাকা মুখটা দেখতে বড্ড মিষ্টি।তুমি কি জানো তোমায় শাড়ি পড়লে কতটা বেশি সুন্দরী লাগে। আরেকটা কথা আমার সাথে প্রেম না করলেও চলবে শুধু অপেক্ষাটুকু কোরো আমার জন্য যেনো আমি উপযুক্ত হয়ে তোমার হতে পারি, শুধু বোলো “অপেক্ষা করবো তোমার জন্য” ব্যস তাহলেই হবে। ভালোবাসি দিশুপাখি তোমায়, অনেক বেশি ভালোবাসি।

ইতি—
নীলাদ্রি

চিঠিটা পড়ে দিশানীর মুখে হাসির রেখা ফুটে ওঠে।দিশানীর নিজেও বাধ্য মেয়ের মতো চিঠির অপর পৃষ্টায় লিখে দিলো “অপেক্ষা করবো”। এটা দেখে নীলাদ্রির মুখেও হাসির রেখা ফুটে উঠলো।

এভাবে দিনের পর দিন কাটতে লাগলো। দিশানীর এসএসসি পরীক্ষা, নীলাদ্রির এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হলো।
ওদের দুজনের মধ্যে আজকালকার সো-কল্ড প্রেম চলে না,নীলাদ্রি রাতে একটা ভয়েস মেসেজ পাঠায়, সকালে দিশানী একটা ভয়েস মেসেজ পাঠায়, ব্যস এইটুকুই চলে ওদের মধ্যে।
নীলাদ্রির মেডিকেলে এডমিশন হয়। আর এইদিকে দিশানী ইন্টার পড়তে থাকে। ভালোই চলছিলো সবকিছু কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই দিশানীর বাবা মারা যায়। তারপরেই নিজের মানুষগুলো বদলাতে থাকে। দিশানীর বড় ভাই দিশানীর পড়াশোনার দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করে দেয়, কোনোরকমে দিশানী এইচএসসি পাশ করে, তারপরই ওর বড় ভাই নির্ঝরের সাথে ওর বিয়ে দিয়ে দেয়। বিয়ের আগে শুধু দিশানী নীলাদ্রি কে বলেছিলো যেনো ও ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে ওঠে তারপর দিশানী নীলাদ্রির সাথে আর যোগাযোগ করার সুযোগ পায়নি।নীলাদ্রি দিশানীর বিয়ের পর খুব ভেঙে পড়েছিলো কিন্তু দিশানীর শেষ মেসেজের কারণে ও নিজেকে শক্ত করে তোলে।
এভাবেই দিশানী আর নীলাদ্রির ভালোবাসার ইতি ঘটে।

আচ্ছা সত্যিই কি ইতি ঘটেছে নাকি নতুন কিছুর সূচনা হতে চলেছে ওদের জীবনে?

—————
বর্তমানে নীলাদ্রির চেম্বারে নীলাদ্রি আর দিশানী বসে আছে, দিশানী নীলাদ্রি কে জিজ্ঞেস করলো,,
—-আপনি কেনো ডেকেছেন আমায় এখন বলুন?

নীলাদ্রি বললো,,
—এমন পাল্টে গেছো কেনো?
দিশানী নিচের দিকে তাকিয়ে বললো,,
—কোথায় পাল্টে গেছি, আগের মতোই তো আছি
—প্লিজ মিথ্যা কথা বোলোনা, আমি শুনেছি তুমি তোমার সংসারে সুখী নও, গত এক বছর ধরে তোমার শশুরবাড়ির লোক তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করে।

—আপনি এসব কি করে জানলেন?
—মেঘার থেকে শুনেছি।
—ওহ, মেঘা আপনাকে সব বলে দিয়েছে।
—আগে এটা বলো তুমি ওদের অন্যায়ের প্রতিবাদ কেনো করোনা?
—আগের মতো সাহস পাইনা, কোথায় জানি আমার সাহসগুলো সব হারিয়ে গেছে, তবুও দিন দুয়েক হলো মুখ খুলেছি, তাদের সকল খোঁটার উত্তর দেই।
—সাহসগুলো আবার ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করো।
—হয়তো আর পারবো না
—কেনো পারবে না? পারতে হবে, জানো তোমাদের মেয়েদের জন্যই আজ সমাজে মেয়েদের এতো করুণ পরিস্থিতি, তোমরা মেয়েরা নিজেদের প্রতিবাদ নিজেরা করতে পারোনা বলেই এতোটা অত্যাচারিত হও। আর কত এরকম থাকবে, আগের দিশানীকে ফিরিয়ে আনো আর তার সাথে আরো সাহস যুক্ত করে প্রতিবাদ করো। আর একদিন তোমার হাসবেন্ডকে নিয়ে আমার চেম্বারে এসো দেখি আমি তোমাদের জন্য কি করতে পারি

দিশানী হেসে বললো,,
—লাভ নেই, অলরেডি ডিভোর্স ফাইল হয়ে গেছে, কোর্ট আমাদের তিনমাস সময় দিয়েছে আর আমি নিজেও চাইনা এই সম্পর্ক আর ঠিক হোক।তবে নীলাদ্রি আমি আপনার কথা রাখার চেষ্টা অবশ্যই করবো, আমার সেই প্রতিবাদীরূপটাকে আবার জীবন্ত করে তুলবো।

—এইতো এটাই তো চাইছিলাম। আর শোনো তোমার ননদিনীটি নিজেকে অতিমাত্রায় চালাক মনে করে ওকে আমার থেকে দূরে থাকতে বলে দিও।

দিশানী নীলাদ্রিকে পিঞ্চ মেরে বললো,,
—আপনি ভয় পাচ্ছেন নিরা কে?
—ভয় না, আসলে এই ধরণের মেয়েদের থেকে যতটা দূরে থাকা যায়, ততই মঙ্গল।

চলবে

অতীত শেষ!
হ্যাপি রিডিং

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here