শ্রাবণ_দিনের_বৃষ্টিতে পর্ব ১১

#শ্রাবণ_দিনের_বৃষ্টিতে🖤
#পার্ট_১১
#Writer_Liza_moni

মায়ের মাথার পাশে বসে আছে আয়রা।মা চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। চোখের কোনা বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে বালিশে। আয়রা মায়ের চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো,,
আমি তো এখনো বেঁচে আছি আম্মু। তুমি এই ভাবে কান্না করলে তো অসুস্থ হয়ে পড়বে। আমার দিকে তাকাও,,দেখো আমি বেঁচে আছি। তোমার আয়রু বেঁচে আছে।

মা পিট পিট করে চোখ মেলে আয়রার দিকে তাকালেন। টেবিলের উপর খাবার রাখা।গত কাল রাত থেকে কিচ্ছু মুখে দেয়নি আয়রার মা।

শোয়া থেকে উঠে তিনি আয়রা কে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলেন। আমি কী পাপ করছি বল না আয়রা ? আমার আয়জা ও আমাকে ছেড়ে পরপারে চলে গেল। আমার হিতৈষী ও চলে গেল।

আয়রার খুব কান্না পাচ্ছে। কিন্তু মায়ের সামনে কান্না করা যাবে না। মায়ের সামনে নিজেকে শক্ত রাখতে হবে।

আয়রা মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,,গত কাল রাত থেকে কিচ্ছু খাও নাই। এমন করলে তো আর ওরা কেউ ফিরে আসবে না।

আয়রা মায়ের চোখের পানি মুছে দিয়ে টেবিলের উপর থেকে খাবারের প্লেটটা হাতে নিয়ে ভাত মাখিয়ে মাকে জোর করে খাইয়ে দিল।
মাকে খাইয়ে দিয়েছে অথচ সে নিজেই এখনো কিচ্ছু খায়নি।
.
.
আয়রাদের বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে প্রান্ত। মনের মাঝে কেমন একটা অশান্তি কাজ করছে তার।এই পরিবারের কেউ তার আপন না। তবুও এই পরিবারের সবার জন্য কেমন খারাপ লাগছে।
অনেক মেয়ের ক্রাশ প্রান্ত।৬ ফুট লম্বা,ফর্সা গায়ের রং, মুখে চাপদাড়ি,, আর হালকা সবুজ চোখের মণিতে যেনো মেয়েরা তাদের হারিয়ে ফেলে প্রান্তর মাঝে।কোনো কালেই মেয়েদের প্রতি প্রান্তর তেমন কোনো আকর্ষণ ছিল না। কিন্তু সেই শ্রাবণ দিনের বৃষ্টিতে যখন হিতৈষী কে দেখেছিল এক অন্যরকম অনুভুতি কাজ করে ছিল তার মনে। এটাকে ঠিক প্রেম বলা যায় কিনা জানা নেই তার। হিতৈষীর মৃত্যুর দিন প্রান্ত জানতে পারে যে হিতৈষী হিন্দু। অদ্ভুত না ব্যাপার টা,,?সে এক হিন্দু মেয়েকে দেখে ক্রাশ খাইছিলো।

প্রান্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।তবে যাই হোক হিতৈষী মেয়েটা অনেক লাকি ছিল। হিন্দু হওয়ার পর ও আয়রার মা বাবা তাকে নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসেন।কখনো কাউকে বুঝতে দেননি মে হিতৈষী তাদের মেয়ে না।
এমন মানুষ এখন ও পৃথিবীতে আছেন।
ভালোবাসার মানুষটিকে এই দুনিয়ায় আপন করে নিতে না পারলে ও ঐ দুনিয়ায় আপন করে নিতে পারবে।এক সাথে বাঁচতে না পারলে ও এক সাথে মরতে তো পেরেছে।

ছাদের দরজা মেলার আওয়াজে ধ্যান ভাঙল প্রান্তর। পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখে আয়রা আসছে।রাত প্রায় ১টা বাজে।
আয়রা ভ্রু কুঁচকে এগিয়ে এসে বললো,,

এখন ও জেগে আছেন যে ?ঘুমান নাই?

নাহ,, ঘুম আসছে না।

তুমি এত রাতে এখানে?

আয়রা কিছু বললো না।প্রান্ত ও আর জিজ্ঞেস করল না।

ঝি ঝি পোকার ডাক আসছে চার দিক থেকে।গা শিউরে উঠার মতো পরিবেশ। আকাশে চাঁদ নেই।মেঘে ঢাকা আকাশ। মেঘের গুড়ুম গুড়ুম শব্দ ভেসে আসছে মাঝে মাঝে। বৃষ্টি আসবে মনে হয়।
পাহাড়ি এলাকায় এত রাতে কেউ তেমন জেগে নাই।সবার বাড়ির লাইট অফ করা।মাকে ঘুমের ঔষধ খাইয়ে ঘুম পারিয়ে ছাদে আসছে আয়রা। বাবাকে দেখেছিল ড্রইং রুমের সোফায় বসে বসে হিতৈষী আর আয়জার ছবি দেখতে।

উপর থেকে বাবা মানুষটা অনেক শক্ত। ঠিক ডাবের মত। উপরে যেমন শক্ত।ভেতরে ঠিক ততটাই নরম।বাবারা হয় তো ছেলের থেকে ও মেয়েকে বেশি ভালোবাসেন। আয়রার কোনো ভাই নেই। আল্লাহ দেননি। তার পর ও আয়রার বাবার কোনো অভিযোগ ছিল না। তিনি শুধু বলতেন,,

ছেলেরা এখন যা করতে পারে না মেয়েরা তা করে। আমার মেয়েরা ও বড় হবে। অনেক বড় কিছু করে আমার মুখ উজ্জ্বল করবে। ছেলে দিয়ে কী হবে? আমার দুই টা রাজকন্যা আছে ওরাই আমার সব।
.
.
জানেন,,
আমার যখন ঘুম আসতো না,
তখন আমি হিতৈষীর আপুর ঘুম ভাঙ্গিয়ে ছাদে নিয়ে আসতাম। অনেক সুন্দর চাঁদ থাকতো আকাশে। এমন অন্ধকার থাকতো না চারপাশ।ওর কোলে মাথা রেখে ছাদের মাঝে বিছিয়ে রাখা পাটিতে ঘুমিয়ে পড়তাম। হিতৈষী আপু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতো। এমন ও সময় গেছে আমরা ছাদেই রাত কাটিয়ে দিতাম।

আপু কখনো বিরক্ত হতো না। আমার সব সিক্রেট আপু জানতো।এতটা বিশ্বাস করতাম আমি তাকে।ওর কাছে আমার সব আবদার ছিল।

আয়রার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে। আয়রা প্রান্তর দিকে তাকিয়ে বললো,,
আপুর শরীরের আর কিছুই হয়তো অবশিষ্ট নেই।সব আগুনে পুড়ে গেছে। অথচ দেখুন গতকাল সকালে ও এই পৃথিবীতে ছিল। সুস্থ ছিল।আর সময়ের ব্যবধানে দেখুন,,
আপু আর আমাদের মাঝে নেই। হিতৈষী আপু কখনো আয়জা আপুর অভাব অপূর্ণ রাখেনি।

আয়রার কথায় প্রান্তর ভ্রু যুগল আপনা আপনি কুঁচকে গেলো।
প্রান্ত শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,,
আয়জা কে?

আয়রা হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে বললো,,
আমার আপন বোন।

সে কোথায়?

মারা গেছে আজ থেকে ছয় বছর আগে।

প্রান্তর বুকের মাঝে চিন চিন করে উঠলো।সে বুঝতে পারছে এই পরিবার তাদের দুজন আপন মানুষ কে চিরতরে হারিয়ে ফেলেছে।

প্রান্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
কী হয়ে ছিল আয়জার?

আয়রা নির্দ্বিধায় বলল,,
ধর্ষণ,,,

প্রান্ত নড়েচড়ে উঠলো। প্রশ্নের উত্তর যে এটা হবে তা ভাবতেই পারেনি সে।
প্রান্ত আর কিছু জিজ্ঞাসা করলো না।

অনেক রাত হয়েছে।এত রাতে ছাদে দাঁড়িয়ে থাকার দরকার নেই।নিচে আসো।আর শুনো,,
নিজেকে শক্ত করো। তোমার আব্বু আম্মুর এখন তুমি ছাড়া আর কেউ নেই।নিজে যদি শক্ত না হও তাহলে তাদের কে সামলাবে? তাদের যাওয়ার ডাক এসেছিল তাই তাদের যেতে হয়েছে। একদিন না একদিন আমাদের সবাইকে যেতে হবে।সেই ডাকের সাড়া দিতে হবে।হতে ও তো পারে,,
আজ রাতে ও সেই ডাক এসে গেছে।

প্রান্তর দিকে তাকালো আয়রা।লোকটা সত্যি কথাই বলছে। নিজেকে শক্ত করতে হবে।

চলে আসো।এত রাতে ছাদে দাঁড়িয়ে থাকার দরকার নেই।
প্রান্ত চলে গেল সেখান থেকে। আয়রা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। হঠাৎ চার দিকে শো শো করে বাতাস বইতে লাগলো। বিদ্যুৎ চমকাতে লাগলো। আয়রার চুলের বাঁধন খুলে চুল গুলো বাতাসে উড়তে থাকে। হঠাৎ আবহাওয়ার এমন পরিবর্তনের কারণে কিছুটা ঘাবড়ে গেল আয়রা। দুই হাত দিয়ে চুলের খোঁপা করে ছাদ থেকে নিচে নেমে আসলো।

ভয় পেয়েছে সত্যি।মনে হচ্ছিল কেউ তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। মনের ভয় আরকি। আয়রা তড়িগড়ি করে রুমে এসে জানালা সব বন্ধ করে দিলো।লোড সেডিং হয়েছে। কারেন্ট চলে গেছে। অন্ধকার ঘরে আয়রার দম বন্ধ হয়ে আসছে।ভয়ে বুক ধড়ফড় করছে। অন্ধকার কে খুব ভয় পায় সে।

খুব করে হিতৈষীকে মনে পড়ছে তার। বিদ্যুৎ চমকানোর আলোয় বেলকনিতে কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা মনে হচ্ছে আয়রার।কেউ একজন সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। কোনো অবয়ব,,,

বাতাসের শো শো শব্দ যেনো কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। আয়রার ভয়ে খিঁচুনি উঠে যাওয়ার উপক্রম।গলা থেকে একটা শব্দ ও বের হচ্ছে না তার।

বিদ্যুৎ চমকানোর আলোয় আবার বেলকনির দিকে তাকালো আয়রা। কেমন যেন লাগছে তার। হাত পা আসাড় হয়ে আসছে। অন্ধকার ভয় পায় বলে সে সব সময় লাইট অন করে ঘুমায়। আয়জার মৃত্যুর পর থেকেই অন্ধকার কে খুব ভয় পায় আয়রা।

বেলকনিতে কারো অবয়ব দেখতে পেয়ে ভয়ে বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠে। আয়রা একটু এগিয়ে যাবে ঠিক এমন সময়,,একটা বিড়াল মেউ মেউ করে উঠলো।বিড়ালটা সেখান থেকে যাবার সময় এটা মাটির ফুলের টব ফ্লোরে পড়ে ভেঙ্গে যায়।আর সেই আওয়াজ শুনে আয়রা সেখানেই জ্ঞান হারিয়ে ফ্লোরে পড়ে যায়। প্রচন্ড ভয় এবং দুশ্চিন্তা,আর না খেয়ে থাকার জন্য জ্ঞান হারায় সে।
.
.
চলবে,,,, 🍁

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here