“আকাশী”
পর্ব ৭.
অনিক আর আকাশী পাশাপাশি বসে আছে। আকাশী বলল, ‘ফুটবলে কি ছেলেদের নাম লেখা থাকে?’
ওরা দু’জন রেলিঙে বাইরের দিকে মুখ করে বসে পা দোলাচ্ছিল। আকাশীর কথায় অনিকের পা দোলানো থেমে যায়। আচমকা মেয়েটি এমন এমন প্রশ্ন করে না…
সে বিরক্ত হয়ে বলল, ‘কেন?’
‘মেয়েরা ফুটবল কেন খেলে না?’
অনিক চুপ থাকবে নাকি হাসবে বুঝতে পারছে না। আকাশীর মেয়েদের ফুটবল খেলার কথা বলায় হাসা উচিত। কিন্তু তার কথাও সঠিক, এই ভেবে চুপ হয়ে রইল। হঠাৎ তার চোখ আকাশীর শাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা ফর্সা পায়ে পড়ল। যেটুকুতে আঙুল দেখা যাচ্ছে তা দেখে অনিকের ভালো লাগছে। হয়তো এটাকেই বলে আকর্ষণ। অথচ এই মুহূর্তে আকাশী যদি কোনো ছেলে হতো, তবে এই আকর্ষণ অনিক মোটেই ফিল করত না। ভেবেই মৃদু হাসল। কিন্তু এই আকর্ষণটা আকাশীকে সে কি করে বুঝায়!
‘হাসছিস কেন? বল্ না।’
‘না, লেখা থাকে না। তবে ওটা মেয়েদের খেলা না।’
‘মেয়েদের-ছেলেদের ভাগ আছে নাকি? আমি খেলি না? যেটা খেলতে ছেলেরা কমফোর্ট ফিল করে, সেটা মেয়েরা কেন খেলতে পারবে না? হ্যাঁ, হয়তো মেয়েদের গায়ের জোর একটু কম। তাই বলে এই খেলা মেয়েরা মেয়েরা খেলতে পারে না?’
কিছু কিছু প্রশ্নের জবাব দিতে অনিকের হিমশিম খেয়ে যেতে হয়। এখনও সেই অবস্থা।
‘দেখ, লিঙ্গ নামেও একটা ভেদ আছে। ওই ভেদাভেদটা সবসময় থাকবে। আর এই ভেদাভেদের কারণে পৃথিবীতে অনেক বৈচিত্র্য। ভেদাভেদ আছে বলেই মেয়েদের কাপড় আর ছেলেদের কাপড় আলাদা। ওদের আবেগ-অনুভূতিও আলাদা। সেই হিসেবে ওদের খেলাও আলাদা।’
‘ভেদাভেদের কথা আমাকে শিখাস না। কিছু মূর্খ লোক এগুলোকে প্রথা বানিয়ে ফেলেছে। ছেলে আর মেয়েকে এক পর্যায়ে থাকতে দেওয়া হয় না বলেই এই ভেদাভেদের সৃষ্টি হয়। সংসারের পাশাপাশি মেয়েদের এমন কাজ করা উচিত, যাতে ছেলেরা তাদের কম কিছু না ভাবে। ছেলেরা ওদের দুর্বল লাজুক মেয়ে ভাবে বলেই তো ওদের মাঝে আকর্ষণের সৃষ্টি হয়। রক্ত-মাংস কিন্তু একিই। কেবল দৃষ্টিভঙ্গির একটা দেয়াল সৃষ্টি হয়েছে। একটা ছেলে যদি মনেপ্রাণে উপলব্ধি করে যে, তার জন্য তৈরি তার জীবনসঙ্গী একদিন তার জীবনে আসবেই, তবে সে একাধিক মেয়েদের দিকে তাকানোর চেষ্টা করবে কেন, তার আশেপাশে শত মেয়ে থাকুক? একটা মেয়েকে মানুষ হিসেবে না দেখে কেবল লোভাতুর জাতি মেয়ে হিসেবে দেখবে কেন? একটা মেয়ের মন পর্যন্ত না পৌঁছিয়ে সে কেবল তার দৈহিক সৌন্দর্য কেন উপভোগ করবে?’
অনিক থতমত হয়ে ঠায় বসে রইল। ক্ষণিকের জন্য লেগেছে, এই কথা তাকে উদ্দেশ্য করেই আকাশী বলেছে। পরক্ষণে তার লজ্জা কমে গেল। আকাশী যাই বলুক, একটা মেয়ের সৌন্দর্য উপভোগ করা ঠিক নয়, এ কেমন কথা!
‘আচ্ছা, যদি এতই আপত্তি থাকে, তবে ঘরে কেন বসে থাকিস না? এভাবে শাড়ি পরে চুল খোলা রেখে কাজল দিয়ে কেন বসে থাকিস? এক বছর যাবৎ তোকে দেখছি। এভাবে সাজলে যেকোনো ছেলেই তো না তাকিয়ে পারবে না।’
আকাশী মৃদু হেসে বলল, ‘আমি জানতাম, ঘুরেফিরে কোনো একটা তীর আমার দিকেই ছুঁড়বি। আমি এসব নিজের শখের জন্যই করি। কোনো ছেলেকে দেখানোর জন্য নয়। তবে হ্যাঁ, পরীক্ষা করার জন্য। তোকে একটা কথা বলি, তুই ধর, কোনো মার্কেটে গিয়েছিস। অনেক সুন্দর একটা সাইকেল দেখে তোর মন উড়ুউড়ু করতে লাগল। কিন্তু তোর কাছে ওটা কেনার সামর্থ্য নেই। তখন তুই কি করবি? ওটার দিকে এমনিতেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা হা করে চেয়ে থাকবি?’
‘না, কেন? জিনিসটা ভালো লাগলে কিছুক্ষণ দেখে সামর্থ্যের কথা ভেবে নজর ফিরিয়ে নেব। জিনিসটা আমার নয় বলেই দেখা উচিত নয়। ওটা আমার হবে এমন কোনো গ্যারান্টিও দেওয়া যায় না বলে আমি চোখ ফিরিয়ে নেব।’
‘ঠিক এটাই আমি তোকে বুঝাতে চাইছি। এই সাইকেলের জায়গায় মেয়েদের ভাবা যায় না? সাইকেলটা তোর জন্য তৈরি না জেনে কিছুক্ষণ পর চোখ ফিরিয়ে ফেলবি, কিন্তু একটা মেয়েকে সারাদিন দেখতে দিলে সারাদিন দেখতে পারবি। এমন কেন? এটাই নিশ্চিত, মেয়েটা তোর জন্য তৈরি নয়।’
অনিক জবাব দিতে পারছে না। উল্টাপাল্টা যুক্তিগুলো তার ভালো লাগছে না। শত হোক, সে নিজেই একটা ছেলে। একটা সাইকেলের দিকে দুই মিনিটের বেশি তাকিয়ে থাকতে না পারলেও, একটা মেয়ের দিকে দুই ঘণ্টার অধিক তাকিয়ে থাকতে পারবে।
আকাশী কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে মাঠের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুই কি খেলছিস না?’
‘আরে না। বলিস না, এই হাকিমপাড়ার ছেলে কতগুলো এসে জায়গাটা কবজা করে ফেলেছে। খেলতেই পারছি না।’
‘তা কেন? মাঠটা তো আমাদের বাড়ির। হাকিমপাড়া তো পাশের গ্রাম ফেলে।’
অনিক তার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সবই তোর কারণে হচ্ছে।’
‘কি! আমি আবার কী করলাম?’
‘এভাবে সুন্দরি সেজে ঘুরিস কেন? এই ছেলেগুলো তোকে দেখার বাহানায় এসেছে। সবাই তা ইতোমধ্যে ধারণা করে ফেলেছে। এর আগেও খুব কম ছেলে আসেনি। তোর নানা কিছু নিয়ে প্রতিবাদের কথাগুলো হাকিমপাড়াসুদ্ধ দুই-তিনটা পাড়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। এখনও অনেক মহিলা তো এদিকের মাসিমার কাছ থেকে কোমরের ব্যথার ওষুধ নিতে এলে তোর বাড়ি ঘুরে যায়। জিজ্ঞেস করে, সেলিনা নামের একটি মেয়েকে নাকি একটা বদ ছেলের কাছ থেকে আকাশী নামের মেয়েটি বাঁচিয়েছে? কথাটি সত্যি নাকি? মেয়েটা এখানে থাকে নাকি? নানান কথা। এই ছেলেগুলোও অনেক উৎসুক হয়ে এসেছে। তারা জানে এখানে খুব সুন্দর একটা মেয়ে শাড়ি পরে মেহেদি পরা হাতে চুড়ি পরে ঘুরে। একবছর যাবৎ এগুলো হচ্ছে দেখছিস না?’
‘আমি কি করে জানব!’
‘তুই ছেলেদের দিকে তাকাস নাকি যে, ওদের হাবলার মতো তোর দিকে চেয়ে থাকাটা তুই টের পাবি? ওই ছেলেগুলো খেলা করতে এসে সুযোগ খুঁজে, কবে ওরা খেলা শেষ করে এদিক দিয়ে হাকিমপাড়ায় যাওয়ার সময় তোর দেখা পাবে। শালা, ওরা আমাদের বড় বলে আজ হাতে হাত রেখে গুটিয়ে গেছি। দেখ, দেখ।’ অনিক মাঠের দিকে ইশারা করে বলল, ‘ইতোমধ্যে ওখান থেকে ওরা তোকে চেনে ফেলেছে। দেখ, কেউ কেউ সময় সময় এদিকে উঁকিঝুঁকি করছে।’
আকাশী ফোঁস করে উঠল। ছেলেরা আকর্ষণীয় পোষাক পরলে সে তো হাবলার মতো চেয়ে থাকে না। তবে তারা কেন তাকাবে? ছেলেরা স্বাধীনভাবে সবকিছু করতে পারলে মেয়েরা কেন সামান্য ঢেকেঢুকে একটা শাড়ি পরতে পারে না!
‘কিরে তুই নেমে গেলি কেন?’
আকাশী অনিকের হাত ধরল, ‘এদিকে আয়।’
অনিক কিছুই বুঝতে পারল না। আকাশী তাকে নিয়ে ছাদ থেকে নেমে পেছনের মাঠে চলে এলো। তাকে দেখে খেলাটা প্রায় বন্ধই হয়ে গেছে। কিছু ছেলে এখনও ফুটবল ছুঁড়ছে। তারা হয়তো জানেই না, বাকি ছেলেগুলো এখানে অন্য কোনো কারণে খেলতে এসেছে।
আকাশী ভ্রূদ্বয় চোখের কাছে নামিয়ে ঠোঁট চেপে বলল, ‘খেলা থামালেন কেন?’
কিছু কিছু ছেলে একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। তারা যেন কেবল আকাশীর সৌন্দর্যটা দেখতে এসেছিল, কিন্তু ফ্রি’তে তার তেজটাও দেখতে পাচ্ছে।
‘কী? জবাব দেন না কেন? মাঠটা তো আমাদের বাড়ির। আপনারা কেন খেলতে এলেন?’
একজন বিনয়ী হয়ে কিছুটা রসিকতা করে বলল, ‘মাঠে কি আপনাদের বাড়ির নাম লেখা আছে?’
এই কথায় সমবয়সী ছেলেগুলোর অট্টহাসিতে ফেটে পড়ার কথা। কিন্তু সামনে অতীব সুন্দরি একটা মেয়ে থাকায়, তারা স্রেফ মার্জিতই হাসল।
আকাশী ভদ্রভাবে বলল, ‘আপনারা আমাকে দেখতে চাওয়ার কথাটা আমার কাছে পৌঁছালেই হতো। আমি নিজেই দেখা করতে আসতাম। এত কষ্ট করে অন্যকে কষ্ট দিয়ে কেন এভাবে মাঠ দখল করে রাখতে গেলেন, বলুন!’
ওর কথায় সবাই বিপাকে পড়ে গেল। তারা ভেবেছিল, সুন্দরি এই মেয়েটা হয়তো মিনমিন করেই কথা বলবে। হয়তো এমনেই ঘুরতে জানে। ছেলেদের সাথে মুখোমুখি কথা বলতে জানে না। কিন্তু তারা অচিরেই বুঝতে পেল, আকাশীর সাহসিকতা সম্বন্ধে শোনা ঘটনাগুলো গুজব ছিল না। কিছু ছেলের চোখ বড় হয়ে উঠল। আকাশীর জন্য শ্রদ্ধা জমল সেই চোখে। কিন্তু বাকি ছেলেগুলোকে লাইনে আনতে হবে।
একজন বলল, ‘আরে সুন্দরি, একবার ঢোল পেটাতে, আমরা আর খেলার অজুহাত দেখাতাম না। ভাবলাম, ঘুরতে জানলেও ঘরকুনো মেয়ে, দেখা দিবা না।’
‘ঘরকুনো মেয়ে? মেয়েদের এই তো এক উপাধি, যেটা আপনারা দেন। আর এই কারণেই আপনাদের আর মেয়েদের মাঝে বৈষম্য সৃষ্টি হয়।’ অনিকের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে সে বলল, ‘দেখছিস, মেয়েরা কনফিডেন্টলি কিছু করে না বলেই আজ এই ছেলেরা তাদের ডিস্টার্ব করে ফিরে।’
একজন বলল, ‘ওই ম্যাডাম, মেয়েদের না সত্যিই আমাদের সাথে বরাবরি করার মতো শক্তি নেই। ওরা চুলার পাশে বসে থাকার জন্য তৈরি।’
‘ওহ্ আচ্ছা, তাই নাকি? তবে একটা হেস্তনেস্ত আজ হয়েই যাক। আজ আমি আপনাদের সাথে ফুটবল খেলব। যারা আমাকে দেখতে আসেনি, আমি তাদের দলেই। আমি আপনাদের হারালে আজকে আমাদের ঘরে “চুলার পাশে বসে” রান্না করে খাওয়াবেন। আর এই মাঠ ছেড়ে দেবেন। আমি হারলে আমি মেয়েদের আপনাদের দৃষ্টিভঙ্গির সাপেক্ষে চিরাচরিত নিয়মে চুলার পাশে রান্না করে খাওয়াব। শর্ত মঞ্জুর?’
অনিক একবার করুণার চোখে ছেলেগুলোর দিকে তাকালো। অন্য কোনো খেলা হলে ওরা রেহাই পেত। কিন্তু ফুটবলে আকাশীকে হারানো আদৌ সম্ভব? এক বছর যাবৎ সে অনিকদের সাথে খেলছে। সে দেখেছে, তার মধ্যে স্পিডে দৌড়ার যে ক্ষমতা আর বুদ্ধি খেটে খেলার যে ক্ষমতা আছে আর দশটা ফুটবলারের মধ্যে কি আছে? নিশ্চিত আজকেও আকাশী দুই গ্রামকে একত্রে করবে।
ছেলেগুলো আমেজে ফেটে পড়ল। শুরু হয়ে গেল খেলা। অনিকও অংশ নিয়েছে আকাশীদের দলে। আকাশী ঘের বড় করে শাড়ি পরে, যাতে কোনো আপত্তি না বাধে। তাই সমস্যার আশঙ্কা নেই, শাড়ি গিড়ের ওপরে তোলার প্রয়োজনও নেই। শাড়িও আঁচল ঢেকে দিয়ে গুছাল।
আকাশীর মতে এই শাড়ি পরিধানে কোনো ত্রুটি নেই। কারণ ঢিলেঢালা করে শাড়ি পরলে একটা মেয়ের শরীরের অনেক ভাঁজই ভরে যায়, যা সেলোয়ার কামিজের ওড়না দিয়ে ঢাকিয়ে পরলেও কমতি রয়ে যায়। আকাশী পাকাপোক্ত একটা খেলোয়াড়ের মতো প্রস্তুত হয়ে পড়ল। মুহূর্তেই তার সকল ইন্দ্রিয় জেগে উঠল। যে করেই হোক, আজ এই ছেলেদের শিক্ষা দিতেই হবে। আজ এসব ছেলেদের কারণেই যে, মেয়েরা বিলাসের বস্তু হয়ে থেকেছে! এখন আর নয়।
আকাশী তার দলের ছেলেগুলোর সাথে বোঝাপড়া করল। তাদের প্রায়ই অনিকের সমবয়সী। আকাশী বুঝিয়ে দিলো, কী করে বল পাস করবে। তারা মন্ত্রমুগ্ধের মতো আকাশীর খেলার কৌশল শোনে রইল। এরপর খেলা আরম্ভ হয়ে গেল। খেলার প্রথম দিকটায় সবার মধ্যে একটা দ্বিধাবোধ কাজ করছিল। কারণ তারা একটা মেয়ের সাথে খেলছে। কিন্তু পরক্ষণে সেই ভাব উধাও হয়ে গেল আকাশীর দক্ষতা দেখে। আকাশী খেলাটাকে সিরিয়াসলি নিয়েছে দেখে ছেলেরাও আর সঙ্কুচিত হয়ে রইল না। খেলা জমে উঠল। পরপরই তারা ভুলে গেল, তারা একটা মেয়ের সাথে বাজি নিয়ে খেলছে।
আকাশীর দৌড়ের গতিতে ছেলেরা হতভম্ব রয়ে গেল। শাড়ি পরেই একটা মেয়ে কি স্মুথলি’ই না দৌড়ছে! অথচ শাড়ির কিঞ্চিত সমস্যা হচ্ছে না। এটি অবোধগম্য হওয়ারই কথা। প্রথম গোল আকাশীদের দল থেকেই হয়েছে। কেননা ছেলেরা সংকুচিত ছিল আর আকাশীকে মেয়ে ভেবে ছাড় দিয়েছিল। কিন্তু এখন আর দেওয়া যাবে না। মেয়েটাকে মেয়ে ভেবেই তারা ভুল করেছে।
ওরা আকাশীকে মেয়ে হিসেবে ভুলে গিয়ে একনিষ্ঠ হয়ে খেলার চেষ্টা করল। যাইহোক, আজ মানসম্মানের প্রশ্ন। মেয়েটি হয়তো সত্যিই আজ তাদের মানসম্মানে ভাগ বসিয়েছে। এটা না বুঝে ভুল করেছে। বিপক্ষীয় ছেলেদের মাঝে জোর আসায় পরিবর্তি গোল তারাই দিলো। আকাশী এখন আরও সতর্ক হয়ে পড়েছে। নিজের দলের সাথে সে শলা পরামর্শ করে নিয়ে আবার খেলতে আরম্ভ করে।
খেলার শেষদিকে যখন টানটান আমেজ, তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। ইতোমধ্যে মাঠের পাশে অনেক লোক জড় হয়েছে। অনিকের মাধ্যমেই কথা ছড়িয়েছে, আজ ছেলেরা হারলে তাদের কাছে মেয়েদের মতো রান্না করে দেখাতে হবে। এজন্যই আমেজে এসে গেল কিছু দর্শক। আকাশীর কাছে যখন বল এসে পৌঁছাল, তখন দর্শকের মাঝে আরও কৌতূহল। সামনে গোলপোস্ট। বিপক্ষীয় ছেলেরা আকাশীকে ঘিরে ধরেছে। আকাশীর সামনেই গোলপোস্ট। সে বলটাকে পেছনে কিছুটা দূরে কিক করলো।
ছেলেরা কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। কারণ আকাশী ওদের মাইন্ডের বিপরীতই খেলছে। বাঁ পাশে আসা বিরোধী ছেলেটি বল কেঁড়ে নেওয়ার আগে আকাশী ডানদিকে বলকে কিছুটা পাস করলো এবং ইচ্ছাকৃতভাবেই মাথার লম্বা বেণীটা দিয়ে বাঁ পাশের ছেলেটিকে বিপরীতে আক্রমণ করল। বুঝুক ছেলেরা, মেয়েদের অস্ত্র হিসেবে অনেককিছুই আছে। তাদের সাথে বাজি না করিয়ো।
আকাশী আবারও গোলপোস্টের উদ্দেশ্যে বলকে নিয়ে যেতে চাইল। ছেলেরা সামনের দিক থেকে বাধা হয়ে দাঁড়ালো। আকাশী সুযোগ বুঝে বলটাকে ডানপাশে কিক করে। বলটা দুই পক্ষের থেকে একটু দূরত্বে চলে গেলে আকাশী তার পরিকল্পনা মোতাবেক শক্তি সঞ্চয় করে দ্রুত দৌড়ে ছেলেরা পৌঁছার আগেই বলের কাছে পৌঁছে সকল ইন্দ্রিয়কে গোলপোস্ট স্রেফ গোলপোস্টের সম্মুখে রেখে দিলো বলটা ছুঁড়ে। ছেলেরা কাছে এসেও হা হয়ে বলের চলে যাওয়া চেয়ে রইল। তাদের সামনেই গোলটা হয়ে গেল।
কিছুক্ষণ আগের টানটান নিস্তব্ধ পরিবেশটা মুহূর্তেই ঝকঝকে উঠে উঠল। আকাশীর দলের সকলেই উল্লাসিত হয়ে চিৎকার-প্রতিধ্বনি করে উঠল। হাতেগোনা দর্শকগুলো অভিভূত হয়ে গেছে। বিপক্ষীয় ছেলেদের দেখিয়ে আকাশী জয়ের হাসি হাসছে। তথাকথিত অর্থে অনেক ছেলে একটা মেয়ের সুন্দর হাসি দেখার জন্য অনেক কিছু করতে পারে। আকাশীর আজ প্রথম মনে হচ্ছে, বিপক্ষীয় ছেলেগুলো তার এই হাসি সহ্য করতে পারছে না। তাহলে সে ওদের আর মেয়েদের মাঝের হেয়ময় পার্থক্যটা ওদের মন থেকে দূরীভূত করতে পেরেছে।
আকাশী তাদেরকে বাড়িতে আসতে বাধ্য করল। ছেলেগুলো নিজের বাড়িতে যেতে পারল না। কেননা আকাশী তাদের মনে লজ্জা ঢুকিয়ে দিয়েছে। হেরে যে মানসম্মানটা খোয়া গেছে, তা আকাশীর শর্ত পূরণ করেই অর্জন করা সম্ভব। এমন সময় আকাশীর কাছে অপূর্ব ভাইয়ের কথা মনে পড়ে গেল। একসময় এই ভাইয়াটা তাকে অনেক প্রশ্নের চিরাচরিত উত্তরই দিয়ে যেত। আজ তিনি থাকলে দেখতেন, সে বৈষম্য অন্তত কিছু ছেলের মন থেকে দূর করতে পেরেছে। অপূর্বের চেহারা তার এখন তেমন একটা মনে নেই। সেই একবছর আগে তিনি গ্রাম থেকে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু তার সেই চাহনিটা আকাশীর এখনিও মনে আছে। একটা ছেলের প্রীতির চোখ কেমন হয় তা আকাশী জানে না। তবে অপূর্ব ভাইয়ের চোখে প্রীতি কম দেখলেও এমন একটা ভাব দেখা গিয়েছে, যে বৈধ ভাবটা পুরুষদের কাছে সাধারণত আশা করা যায় না, যে ভাবটা প্রশংসনীয় কম হলেও নিন্দনীয় মোটেই নয়।
(চলবে…)
লেখা: ফারিয়া কাউছার