“আকাশী”
পর্ব ১২.
পুকুরঘাটে বসে আকাশী মেয়েদের গোসল করা দেখছে। তাদের মাঝে কিছু কিছু হাসাহাসি আর গালগল্প করায় মত্ত। আকাশীর পুকুরে গোসল করার খুব শখ। সাঁতার কাটা যায় আর পানিরও কমতি থাকে না। এই আনন্দ টিউবওয়েলের পানিতে গোসল করে পাওয়া যায় না। মিষ্টি দেখলে মানুষের জিভ যেমন বেরিয়ে আসে, তেমনই করে মেয়েদের পুকুরে গোসল করা দেখে আকাশী বেরিয়ে এসেছে। যারা গোসল করছে, তাদের বেশিরভাগেরই ঘরে টিউবওয়েলের ব্যবস্থা নেই কিংবা পানির ব্যবস্থাই ঠিক নেই। অগত্যা পুকুর তাদের সহায়। আকাশীদের এই সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় না বলে সে দুই বছর আগেই পুকুরে গোসল করা ছেড়েছে। এখন নিজেকে কেন যেন বড় বড় লাগে। সবাই তো বড় মনে করে, নইলে তার শাড়ি পরা নিয়ে অনেকে বিরূপ মন্তব্য করে কেন?
এখানে গোসল করাও কেন যেন লজ্জার ব্যাপার। কারণ গোসল করলে শরীরের সাথে কাপড় লেগে থাকে। সেই সময়ে মনে হয়, গায়ে কাপড় নেই, বরং গা’টাই কাপড়ের রং ধারণ করেছে। আর এদিকের বাড়িতে এটাই একমাত্র বড় পুকুর। আজকে আবার জুমার দিন। ছেলেরা গোসল করতে আসার আগেই মেয়েদের সেরে ফেলতে হয়। বাই চান্স, অনেক সময় মেয়েরা গোসল করার সময়ই ছেলেরা এসে পড়ে। তখনও মহাপ্রলয় হয়। ছেলেদের কোনো একদিকে গিয়ে অপেক্ষা করতে হয়। এতবড় পুকুর, অথচ একসাথে কিছুই করা যায় না। ভেজা গায়ে কোনো ছেলের সামনে পড়ে যাওয়ার মতো অস্বস্তিকর পরিস্থিতির শিকার আকাশী হতেই চায় না। তাই ছোটখাটো ইচ্ছার মতো পুকুরে গোসল করার ইচ্ছেটাও মাটিচাপা দিতে হয়েছে। আকাশী তাদের আমোদ আর দেখতে না পেরে ঘাট ছেড়ে রাস্তায় চলে এলো।
ভবঘুরে আকাশী কখনও বিষণ্ণতা বোধ করে না। এদিক-ওদিক এগ্রাম-ওগ্রাম ঘুরে তার সময় দিব্যি ভালো কেটে যায়। কিন্তু আজ ভালো লাগছে না। ইশ, আজ যদি শুক্রবার না হতো! গতকালই মাত্র নাইনের ক্লাস শুরু করেছে। আর আজ কিনা বন্ধ। এক জায়গায় স্থির থাকার মতো মেয়ে আকাশী নয়। কার বাড়িতে যাবে ভাবতে ভাবতে তার মনে পড়ল, গতকাল তো ছোটচাচুরা এসেছে। তাদের বাসায় যাবে। ওঁদের সাথে তো অনেকদিন দেখা হয়নি। ভেবে আকাশী অনতিবিলম্বে তাঁদের বাসায় গিয়ে পৌঁছে। সানজিদাকে সে দেখতে পেল না। ওঁদের এতো বড় বাড়িতে তিন-চারটে লোক বেশ বেমানান। কারো দেখা সহজে মিলে না। আকাশী সানজিদার রুমে গিয়েও তাঁকে পায়নি। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এসে রান্নাঘরে অবশেষে তাঁর দেখা পাওয়া যায়। তিনি রান্নার কাজ করছেন। আকাশী সালাম দিয়ে ভেতরে ঢুকল।
তিনি হাস্যমুখে বললেন, ‘আমার আকাশী মা যে। কেমন আছিস?’
‘এইতো ভালো। শুনলাম পরশু এলেন। কালকেও স্কুলে যাওয়ার কারণেই আসা হয়ে উঠেনি।’
‘এসে ভালো করেছিস।’
তিনি কথা বলছেন। আকাশী পূর্বের অভ্যাসের বশেই তাঁর কাজে হাত দিলো। এসবকিছু তাকে কেউ বলে না। সে স্বেচ্ছায় কারো বাড়িতে গেলে গৃহিণীদের কাজে হাত দেয়। হাত দেওয়ার কথা মনে আনতে হয় না। হাতটা যেন স্বয়ংক্রিয়। আপনা থেকেই কাজে লেগে পড়ে। সানজিদা প্রতিবারের মতো তাকে নিষেধ করলেন না। বলতে লাগলেন, ‘তুই এসে ভালো করেছিস। আমরা এসেছি শুনে অনেকেই দেখা করতে কাল এসেছে। কিন্তু আজ কেউ এলো না। একা একা ভালো লাগছিল না।’
‘আঙ্কেল কোথায়?’
‘কোথায় আর থাকবেন? উনার একমাত্র পবিত্র স্থানে।’
‘দুপুর হয়ে গেছে, এখনও রান্নাবান্না আপনার শেষ হয়নি কেন?’
‘আর বলিস না। তখন তো পরিচারিকা ছিল। কামচোর একটা! একটু-আধটু তাও সাহায্য করে দিত। সুগন্ধায় থাকতে কাজের মেয়েই সবগুলো করত। আমার কিছু করা লাগত না। সেই থেকে হাতের তেজ কমে গেছে। সবই দেরি হচ্ছে। এখানে এক সপ্তাহও থাকব না ভেবে কাজের মেয়ে আনছি না। আমাকে কাল অপূর্ব সাহায্য করে দিয়েছিল। কিন্তু আজ সে নেই। বাইক নিয়ে কোথায় যেন গিয়েছে।’
‘ভাইয়া রাঁধতে পারেন নাকি?’, আকাশী বেসিনে জমানো বাসন-কোসন ধুতে লাগল।
‘পারে মানে? উনি না কাজের মেয়ের হাতের রান্না ভালো লাগত না বলে আমার হাতের রান্না খেতে অনুরোধ করতেন। অপূর্ব আমাকে কষ্ট না দেওয়ার জন্যই অতিশীঘ্র শেখে নিয়েছে।’
‘বাহ্, ভালোই তো। মেয়ের কমতি তো আর অনুভব না হওয়ারই কথা!’
আকাশী কথাটা বলার পর পাশ থেকে আর কোনো কথা শোনা গেল না। সে ফিরে তাকিয়ে দেখল, ছোটচাচি বেশ গম্ভীর হয়ে গেছেন। একটা হাসিখুশিতে কথা বলা লোকের মুখের ভাব মুহূর্তেই এতো পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে তা আকাশীর জানা ছিল না। আর কোনো কথা হয়নি রান্না শেষ হওয়া অবধি। কিছুক্ষণ পর সানজিদা বললেন, ‘আমার মাথা ব্যথা করতে শুরু করেছে। ঘরের চারিদিক অগোছালো হয়ে আছে। তাতে একটু হাত দিবি?’
আকাশী হাসল, ‘তাও কি বলার কথা? এমনিতেই বাইরে যাচ্ছিলাম, অগোছালো দেখলেই ঠিক করতাম। কারো বলা লাগত না।’
সানজিদা চমকালেন না। তিনি জানেন, আকাশীর স্বভাব এমনই। মাথায় একটু এসেছিল, এই মেয়ে যে-ঘরের বউ হবে, সেই ঘর আলোকিত করবে। আকাশী তাঁর সাথে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ওপরের তলায় লাইব্রেরি। আকাশী সিঁড়ি ভেঙে ওখানে চলে গেল। লাইব্রেরিতে আলো জ্বলছে। ওই রুমটায় অদ্ভুত এক গাম্ভীর্য আছে, এলে বোধ হয় দুনিয়ায় আর কোনো জায়গা নেই। দুনিয়ায় আর কোনো মানুষ নেই। শুধু আছে এই রুমটা। বাহিরের একটা মানুষের কাছে খুবই বিরক্তিকর লাগার কথা। আকাশী যেতে উদ্যত হতেই তার উঠন্ত পা’টা যেন স্ট্যাচু হয়ে গেল। দাঁতে জিভ কেটে আকাশী জুতো খুলে ফেলে। মুহূর্তের জন্য ঝিলিক দিয়ে উঠেছিল ছোটকালের একখণ্ড স্মৃতি। সে জুতো পায়ে নিয়ে খেলতে আসায় মাহমুদ তাকে বকাঝকা করেছিলেন। অপূর্ব এসে বাবার কাছে ক্ষমা চেয়ে আকাশীকে নিয়ে যায়। মনে পড়তেই তার মুখে একটা হাসির রেখা দেখা যায়। সে ভেতরে গিয়ে ছোটচাচুকে সালাম দিলো। তাকে তিনি অনেকক্ষণ চেয়ে রইলেন। কারণ এই জায়গায় কোনো মেয়ে আসে না। এলেও জুতো বাইরে রেখে আসার কথা কেউই জানে না। আকাশী কিছুক্ষণ নীরব রইল। কোনো পরিচিত লোক তাকে না চিনলে তার খুব মজা লাগে। এর একটাই তো ইঙ্গিত, আকাশীর শারীরিক বৃদ্ধির সাথে চেহারারও পরিবর্তন হয়েছে।
আকাশী বলল, ‘আমি আজমের মেয়ে, আকাশী।’
‘ওহ্, কেমন আছ?’
আকাশী মাথা নেড়ে সায় দেয়। লোকটা ডিস্টার্ব করা পছন্দ করেন না বলে আকাশী এই সায় দেওয়ার পর বেরিয়ে গেল। ওখানে যাওয়া-না যাওয়া একই। তবু গিয়েছে। কারণ মানুষের হাবভাব বিশেষ করে পরিবর্তিত হাবভাব দেখতে তার মজাই লাগে। যে-রুমগুলোর দরজার খোলা ছিল, তাতে গিয়ে আকাশী টুকটাক গোছগাছ করল। অপূর্বের রুমটাও বাদ যায়নি। সবচেয়ে বেশি অগোছালো থাকে এই রুমটা।
সিঁড়ি দিয়ে উঠে উপরে এলে এক কোণায় রুমটা। কাউকে ঢুকতে দেওয়া অপূর্ব ভাইয়া পছন্দ করতেন না। যখন এখানে থাকতেন, তখন সে ঢুকতে পারত। কারণ সে ছাত্রীও ছিল, আবার গোছগাছ করে অপূর্বের বোঝাও কমাত। কি জানি, এখনের সময়ে উনার এসব পছন্দ হবে কিনা। যা-ই হোক, পরিণাম দেখে আকাশী কখনই কাজ করে না। বর্তমানকে নিয়ে ভাবে সে। কারণ পরিণাম ভেবে কাজ করতে গেলে অনেক কাজই করা হয়ে উঠে না। বাথরুম দেখে আকাশীর একটা দিনের কথা মনে পড়ে গেল। একসময় অপূর্ব ভাইয়ার খারাপ লাগলে এই জায়গায় ঝর্ণার কল ছেড়ে দিয়ে দীর্ঘক্ষণ ভিজতেন। মাম্মার মৃত্যুর দিনেও ভিজে জ্বর বাধিয়েছিলেন। এখন ওমন আছেন কিনা কে জানে! বেডের নিচে লুকিয়ে রাখা ড্রয়িং খাতাগুলো এখনও আছে। বিভাকে আড়ালে তিনি লুকিয়ে রাখতে বললে সে লুকিয়ে রাখত না, যাতে করে আকাশীর পড়ালেখা কম হয়। এসব অপূর্বও ঢের ভালো বুঝেছিল। তাই নিজেই চলে যাওয়ার সময় আকাশীর ব্যাগ থেকে নিয়ে লুকিয়েছিল, যাতে সে ড্রয়িংয়ের চক্ষরে লেখাপড়ায় না গোল্লা পেয়ে বসে। আকাশী জানত বেডের নিচে রাখার কথা। কিন্তু নেয়নি। সেই থেকে আকাশী আর ড্রয়িং করতে পারেনি। বাবা কিনতে বললেও মা কেনে দিতেন না। আকাশী দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কিছু কলা চর্চায় না থাকলে ক্ষয়ে যায় না।
আকাশী বাইরে বেরুতেই অপূর্বকে বাইকে দেখতে পেল। এইমাত্র এসেছে। গতবার সে আকাশীকে স্কুল ড্রেসে দেখেছিল। আজ হা করে তার শাড়ির দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
‘আগে কি কখনও শাড়ি পরিহিতা মেয়ে দেখেননি?’
‘দেখেছি, তবে গ্রামে অবিবাহিতাদের তো দেখিনি। বিয়ে হয়ে গেল নাকি?’
‘বিয়ে ছাড়া কি শাড়ি পরা যায় না? আর আপনি কি জানেন না, এখানে মেয়েদের এসএসসি পাস করা ব্যতীত বিয়ে দেওয়া নিষেধ?’
অপূর্ব থ হয়ে বাইক থেকে নামল, ‘বলো কি! কবে হলো এটা?’
‘আমার এক ফ্রেন্ডের মৃত্যুর পর।’ আকাশীর মন খারাপ হয়ে গেল।
‘ওহ্, আরও অনেক কিছুই তো দেখছি। মেয়েদের আগে বাইরে বেশি দেখা যেত না। এখন প্রায়ই…’
আকাশী প্রসঙ্গটা পাল্টাবার জন্য নিজেকে সতেজ করে বলল, ‘ভাইয়া, আমাকে বাইকে চড়াবেন?’
‘মানে?’
‘আমি আগে সাইকেলে উঠলেও বাইকে কখনও উঠিনি। আমাকে নিয়ে একটা রাইড দেবেন? যাস্ট একটা। প্লিজ।’
‘না, অসম্ভব।’
আকাশীর মনে পড়ে গেল অপূর্বের গতকালের রূপটার কথা। সে হাতের ওপর হাত রেখে বলল, ‘দেখি কীভাবে না নেন। আমি এখনই ছোটচাচুকে আপনার সিগারেট খাওয়ার কথা বলছি।’ আকাশী যেতে উদ্যত হলেই অপূর্ব তার হাত ধরে ফেলল।
আকাশী মুখ ঘোরানো অবস্থায়ই হাসল। ঢিল ছোঁড়ার পর সেটা সঠিক জায়গায় পড়বে, সে- নিশ্চয়তা ছিল না।
আকাশী মুখ ফেরালে অপূর্ব মুখ বাঁকিয়ে বলল, ‘চল।’
সে ভেবে পায় না, আকাশী তার লুকিয়ে সিগারেট খাওয়ার কথা জানল কী করে। বাবা এসব মোটেও পছন্দ করেন না। তাই বাইক নিয়ে এসে রাস্তায় খেতে হয়েছিল। এই মেয়েটার বুদ্ধিমত্তার কথা সে ভুলেই গিয়েছে। দু’তিন বছর আগে মা’ই বলেছিলেন, একা একা সংগ্রাম করা মেয়েগুলো হয়তো আগেভাগে সবকিছু জেনে ফেলে। অপূর্ব বসার পর আকাশী ইতস্তত করে। কিভাবে বসবে বুঝছে না। অনিক থাকতে ওর সাইকেলে উঠার সময় শাড়ি না পরায় সহজেই পা’দুটো দু’দিকে দিয়ে নিশ্চিন্তে বসা যেত। এখন শাড়ি পরে কিভাবে কি!
অপূর্ব বিরক্ত হয়ে বলল, ‘আরে একপাশ থেকে বসলেই হবে। দু’পা দু’দিকে দেওয়া লাগে না।’
আকাশী সেভাবেই বসে পড়ল। কিন্তু পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। তখন তো সাইকেলে অনিকের বসা সিটের নিচের দিকে ধরলেই দায়মুক্ত হওয়া যেত। এখন একপাশ থেকে পেছনের হ্যান্ডেল কি করে ধরে!
অপূর্ব তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, ‘আমার ফ্রেন্ডরা না একহাতে বাইক ধরে আরেকহাতে ব্যাগ সহজেই ক্যারি করতে পারে। আর তুমি কিনা গ্রামের খ্যাঁত অন্যান্য মেয়েদের মতোই।’
আকাশী রাগে ফোঁস করে ওঠে আরেক হাত অপূর্বের কাঁধে রেখে ফেলল। অনিকের বাসায় টিভি’তে চিনেমায় দেখেছে, নায়ককে নানাভাবে নায়িকার ধরার কৌশল। কেউ দুই হাত দিয়ে একেবারে জড়িয়ে ধরে। কেউ বা কেবল একহাত নায়কের কাঁধে রাখে। শেষেরটা সে করতে চেয়েছিল। সংকোচ লাগছিল। অপূর্বের কথায় সে-সংকোচটা তেজে পরিণত হয়ে যাওয়ায় অপূর্বকে খলনায়ক হিসেবেও সে পরোয়া করল না।
(চলবে…)
লেখা: ফারিয়া কাউছার