#প্রণয়ের_পরিণতি
#পর্ব_১৮
#writer_sadia_afrin_nishi
তনয়ার বিয়ের দু’মাস হয়ে গেছে। এখন পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক। তনিমা এখন তাদের বাড়িতে থাকে একা একা। তৃপ্তি এখনো কিছু জানে না তার মায়ের মৃত্যুর ব্যাপারে।তনয়ার বিয়ে হলেও সে এখন অফিসে যায়। এতে বাড়ির কেউ কোনো আপত্তি করেনি।বরং তনয়ার মতো একজন দক্ষ মেয়েকে তারা হারাতে চায় না। তনয়ার জন্য অফিসে অনেক উন্নতি সম্ভব হয়েছে।
সকাল সকাল সবার জন্য নাস্তা তৈরি করছে তনয়া। অফিসের কাজের পাশাপাশি সে বাড়িটাও খুব ভালো ভাবে সামলায়। এই দুমাসে তনয়া শ্বশুড়-শ্বাশুড়ীর চোখের মনি হয়ে উঠেছে।ঘরে বাহিরের কাজে সুনিপুণভাবে দক্ষ এমন মেয়েকে তো সবাই চায়।সবকিছু ঠিকঠাক চললেও ঠিক নেই রিশান তনয়ার সম্পর্ক।তাদের মধ্যে কোনো প্রকার সামেলা নেই কিন্তু আবার কোনো ভাব ও নেই। এই বিয়ের পরে তাদের সম্পর্ক আরও খারাপ হয়েছে। আগে তনয়া রিশানকে বন্ধুর মতো সবকিছু শেয়ার করত,সব কথা শুনত।কিন্তু এখন তনয়া দরকার ছাড়া রিশানের সাথে একটি কথাও বলে না। সবসময় রিশানকে এড়িয়ে চলে। এতে রিশানের খুব কষ্ট হয় কিন্তু সে তনয়াকে কিছুই বলে না।
নাস্তা তৈরি শেষ হলে তনয়া ঘরে চলে যায়। গিয়ে দেখে রিশান এখনো ঘুমিয়ে আছে। সে কিছু না বলে ওয়াশরুম গিয়ে শাওয়ার নিয়ে অফিসের জন্য তৈরি হতে লাগে।অফিসের সময় এগিয়ে আসছে অথচ রিশান এখনো উঠছে না দেখে তনয়ার খুব রাগ হয়।সে রিশানকে ডাকতেও পারছে না। তনয়া অনেক ভেবে জগ থেকে এক গ্লাস পানি নিয়ে রিশানের মুখে ছুরে মারল।রিশানও লাফিয়ে উঠে বসে পরল।রিশানের অবস্থা দেখে তনয়ার বেশ হাসি পেল তবুও সে হাসল না। বরাবরের মতো গম্ভীর মুখ করে রিশানের দিকে এলার্ম ক্লক টা এগিয়ে দিয়ে নিজে তৈরি হতে লাগল।রিশান টাইম দেখে তাড়াতাড়ি উঠে ওয়াশরুম চলে গেল। তারপর ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে দেখে তনয়া রেডি হয়ে বসে আছে।সেও তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নেয়।তারপর নিচে গিয়ে সবাই একসাথে ব্রেকফাস্ট করে রিশি,রিশান আর তনয়া বেড়িয়ে পরে অফিসের উদ্দেশ্যে।আতিক চৌধুরী এখন অনেক খুশি। তাকে আর বেশি অফিসে যেতে হয় না। দুই ছেলে আর ছেলের বউই সবটা সামলে নেয়। এবার ছোটো ছেলেটাকেও একটা বিয়ে দিতে হবে তনয়ার মতো আরও একটা লক্ষীমন্ত মেয়ে দেখে।
_________
অফিসের জন্য তৈরি হয়ে বেড়িয়ে পরল তনিমা। আজকের ঘুম থেকে উঠতে অনেক দেড়ি হয়ে গেছে। রাতে মায়ের ঘরে গিয়ে মায়ের জিনিসপত্র ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতে দেখতে সেখানেই ঘুমিয়ে গিয়ছিল।সকালে উঠে দেখে নয়টা বেজে গেছে। দশটার মধ্যে অফিসে পৌঁছতে হবে। নয়তো তার নিমফল তাকে গিলে খাবে।আজকে তাড়াহুড়োতে নাস্তাটাও করা হল না তনিমার।রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে খুবই বোর হচ্ছে তনিমা। একে তো আজ দেড়ি হয়েছে তার ওপর এই রিকশাগুলোও সব গায়েব হয়ে গেছে। চরম বিরক্তি নিয়ে এবার তনিমা হাঁটা শুরু করল।খুবই ব্যস্ততার সাথে হেঁটে চলেছে তনিমা। হেঁটে হবে না এবার সে দৌড় লাগাল।দৌড়তে দৌড়তে সে কারো সাথে সজোরে ধাক্কা খেয়ে নিচে পরে গেল।প্রচন্ড রেগে সামনের লোকটির দিকে তাকাতে তনিমা তো পুরোই অবাক। তনিমা যার সাথে ধাক্কা খেয়েছে সে তনিমার ছোটো বেলার বন্ধু। নাম তার প্রিন্স। ছোটবেলা থেকে তারা খুব ভালো বন্ধু ছিল। তনিমা যখন নাইনে পরে তখন হঠাৎ করে একদিন জানতে পারে প্রিন্সরা সপরিবারে বিদেশ চলে গেছে।তনিমার তখন খুব কষ্ট হয়। তার বেস্ট ফ্রেন্ড তাকে ফেলে চলে গেল কিন্তু তাকে একটিবার বলেও গেল না। এতো বছর পর দুজনে সামনাসামনি পরে দুজনেই খুব অবাক হলো সাথে খুশিও হলো।
তনিমা:প্রিন্স তুই এখানে।এতোবছর পর কোত্থেকে এলি?(গম্ভীর স্বরে)
প্রিন্স:এই তো দুদিন হলো কানাডা থেকে বাংলাদেশ এসেছি।তোর কী খবর বল?
তনিমা:আমার আর খবর। এই তো আছি।
প্রিন্স:মানে ঠিক বুঝলাম না
তনিমা:ছাড় তো এসব,এখন বল হঠাৎ করে উধাও হয়ে গেলি অথচ একটি বার বলেও গেলি না?
প্রিন্স:কী করে বলতাম বল? আমি নিজেও তো কিছুই জানতাম না। আমি বিদেশে যেতে চাইবো না বলে বাবা আমাকে কিছুই জানায় নি।
সেদিন বিকেলে কোচিং থেকে ফেরার পর বাবা বললো বাহিরে নিয়ে যাবে।খুশি মনে বাবার সাথে চলেও গেলাম। গিয়ে তো দেখি এয়ারপোর্ট নিয়ে গেছে। তারপরও আমি অনেক জেদ ধরেছিলাম কিন্তু মা অনেক বুঝিয়ে নিয়ে গেছে। বলতে পারিস ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে।
জানিস তোকে খুব মিস করতাম। এতোদিন অনেক কষ্ট পেয়েছি তোর জন্য। তাই এবার আর বাবার কোনো কথা বা শুনে সোজা চলে এসেছি।
তনিমা:হুমমম ভালো করেছিস।এই যা আমার তো অফিসের লেট হয়ে গেল।
প্রিন্স:তুই জব করিস
তনিমা:হুমম একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে পিএ এর পোস্টে আছি।এবার আমাকে যেতে হবে পরে কথা বলবো।
প্রিন্স:তুই কোথায় যাবি বল আমি তোকে ছেড়ে আসছি।আমার বাইক সামনেই আছে।
তনিমা:না না তার দরকার নেই তুই যা।
প্রিন্স:তুই আমার সাথে ফর্মালিটি করছিস ইটস নট ফেয়ার(মন খারাপ করে)
তনিমা:আরে আরে তোর কাজ আছে না কি সেজন্যই তো বললাম।
প্রিন্স:আমি কী বলেছি আমার কাজ আছে? তুই কী যাবি আমার সাথে নাকি আমি চলে যাবো(রাগ করে)
তনিমা:আরে রাগছিস কেন? আচ্ছা চল আমি যাচ্ছি।
তনিমা প্রিন্সের বাইকে চেপে অফিসে যেতে লাগল।কিছুদুর যেতেই বাইকটা একটা গর্ত ওভারটেক করতে গিয়ে জোরে ধাক্কা খেল।তারপর তনিমা গিয়ে পরল প্রিন্সের ওপর। তারপর আবার বাইক ঠিক হতে তনিমাও ঠিক হয়ে বসল।তনিমা প্রিন্সের গাঁয়ে পরায় প্রিন্সের কেমন জানি একটা ফিলিংস হলো কিন্তু তনিমার তেমন কিছুই হলো না। সে ঠিকঠাক বসে রইল।অফিসের সামনে তনিমাকে নামিয়ে দিয়ে প্রিন্স তনিমার কাছ থেকে ফোন নম্বর নিল যাতে পরবর্তীতে দেখা করতে পারে। তারপর সে চলে গেল। আর তনিমা চলে গেল অফিসে।উপরে জানালায় দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখছিল এতক্ষণ কাব্য।এসব দেখে চট করে কাব্যর মাথায় আগুন জ্বলে উঠল।এতক্ষণ কাব্য তনিমার জন্যই অপেক্ষা করছিল আর বার বার জানালায় এসে দেখছিল তনিমা আসে কি না। আসল কথা হলো তনিমা না থাকলে কাব্যর কোনো কাজেই মন বসে না। কিন্তু এ কথা সে নিজে মানতে চায় না। তনিমাকে অন্য ছেলের সাথে বাইক থেকে নামতে দেখে কাব্য রাগে কী করবে বুঝতে পারছে না। একে আজকে লেট করে আসার জন্য একটা শাস্তি দিতেই হবে(মনে মনে)
এরই মধ্যে তনিমা কাব্যর কেবিনে নক করল।
কাব্য বাঁকা হেসে তনিমাকে ভেতরে আসতে বললো।
তনিমা ভেতরে এলে কাব্য আজ তনিমাকে কোনো কড়া কথা শুনালো না। তনিমা ভাবলো কাব্য হয়তো তার প্রতি সদয় হয়েছে।কিন্তু কাব্যর মনে যে কী আছে তা তো শুধু কাব্যই জানে।
কাব্য তনিমাকে বলল,আজকে তোমার অফিসের কাজে এক জায়গায় যেতে হবে।
তনিমা:কোথায়?
কাব্য:এখানে ঠিকানা লেখা আছে (একটা কার্ড দিয়ে)
একটা জরুরি ফাইল ওখানে পৌঁছাতে হবে।
তনিমা:জ্বী, স্যার আমি যাচ্ছি।
কাব্য :হুমম তাড়াতাড়ি বেড়িয়ে পরো।
তনিমা চলে যায়। কাব্যও লুকিয়ে লুকিয়ে তনিমার পেছন পেছন যায়।
কাব্য :আজ মজা বোঝাব তোমায় মিস.ধানি লঙ্কা (মনে মনে)
_________
অফিসে বসে ল্যাপটপে প্রজেক্ট তৈরী করছিল রিশান । এরই মধ্যে তার ফোন বেজে উঠল।ফোনের স্কিনে মায়ের নম্বর দেখে সাথে সাথে রিসিভ করল রিশান।ওপাশ থেকে বলা কথা গুলো শুনে সে একটু চিন্তিত হয়ে পরল।পরক্ষণেই আবার নিজেই মনে মনে ভাবল, আর কোনো বিপদ হবে না ইনশাল্লাহ। তনয়াকে সবটা খুলে বলার সময় এসেছে এখন। তনয়াকে এভাবে অন্ধকারে রাখলে তো তার কাজটা পুরোপুরি সম্পন্ন হবে না। তাছাড়াও ভালোবাসার মানুষের কাছে ঘৃণার পাত্র হয়ে থাকাটা খুবই কষ্টের।তনয়াকে সে সবকিছু খুলে বললে তনয়া নিশ্চয়ই বুঝবে সবটা।সে চায় তনয়াকে নিয়ে সুখে সংসার করতে। আসন্ন বিপদ যে করেই হোক তনয়াকে সাথে নিয়ে সে লড়বেই।এসব চিন্তার মাঝে সে ফোনটা যে এখনো কাটেনি তা ভুলেই গিয়েছিল। রিশান মাকে শান্তনার বাণী শুনিয়ে ফোনটা কেটে দিল। রিশানের মাথাটা প্রচন্ড যন্ত্রণা করছে এবার। সে কী করে তনয়াকে সবটা খুলে বলবে?তনয়া যদি তাকে সার্থপর ভাবে তাহলে?সে তো তনয়াকে ভালোবাসে। ভালোবাসার মানুষের মুখ থেকে যদি সার্থপর উপাধি নিতে হয় তাহলে এবার আর সে সহ্য করতে পারবে না।
চলবে,