#বর্ষার_এক_রাতে
#সাদিয়া
পর্ব : ১১
দুঃখ কষ্টের মাঝে দিন গেলেও সময় থেমে থাকে না। দিন দিনের মতো যেতে থাকে। সময় কারো বন্ধু নয় যে থেমে থাকবে।
আহফিনের প্রতি তূবার পিনপিনে রাগ টার পাশাপাশি আলাদা এক অনুভূতি জন্মেছে। কেমন যেন একটা টান অনুভব করে লোকটার প্রতি। তার সামনে আসলে সে নাম না জানা অনুভূতি তে হারিয়ে যায়। ইদানীং এটা খুব খেয়াল করছে তূবা। এই তো সেদিনই গিয়ে দেখতে পেল আহফিন মদ খেতে খেতে একদম নাজেহাল অবস্থা। ফ্লোরে নিথর হয়ে পড়ে ছিল। এই দৃশ্য দেখে তূবার ভেতর সহ মুচড় দিয়ে উঠে ছিল। চোখের কোণায় এক দুই ফোঁটা পানিও জমেছিল কষ্টে। সেদিন থেকে আরো বেশি করে টান অনুভব করে আহফিনের প্রতি। এরপর মানুষটা তাকে কিছু বলতে চেয়েও বলেনি। তূবাও জোর দিলও না এতে। কারণ মানুষটা কে তার আলাদা রকম ভাবে ভালো লাগে। মানুষটার কাছাকাছি গেলে সেই অনুভূতি হয়, সেই উথালপাতাল ঢেউ, সহস্র সাগরের ঢেউ হতে থাকে।
এসব ভাবতে ভাবতে আয়নার সামনে বসে তূবা হেসে উঠল। আজ অনেক দিন পর সে চোখে কাজল দিয়েছে। নিজের মৃগনয়না চোখ গুলি কে কাজল কালোয় সাজিয়ে তুলেছে। কি ভেবে যেন তূবা আবার হেসে উঠল।
“আপা তুমি কাজল দিয়েছো?”
তূবা পিছন ফিরে তাকাল। তুসির কথায় সে মুচকি হাসল। এগিয়ে গিয়ে তুসি কে এনে হাটু পেতে নিচে বসতে বসতে বলল
“কেন তোর বোন কে ভালো লাগছে না?”
“আরে আমার বোন কে পরীর চেয়ে বেশি সুন্দর লাগছে বলেই বলছি। আমার তো এখন ভয় হচ্ছে পরী না তোমাকে তুলে নিয়ে যায়।”
তূবা হাসল। সাথে তুসিও হাসল।
বলল
“আপা তুমি কত গুলি মাস হাসো না বলো তো।”
তূবা হাসির মাত্রা কমিয়ে আনল।
“জানো তোমার হাসি দেখার জন্যে আমি কত অপেক্ষা করি। তুমি হাসলে আমার সব কষ্ট দূর হয়ে যায়।”
তুসির মুখে এমন কথা শুনে তূবা তাকে জড়িয়ে ধরল। গালে কপালে চুমু দিল। সে জানে এই মেয়ে টা তাকে নিজের চেয়ে বেশি ভালোবাসে। সেও চেষ্টা করে তুসি কে নিজের সবটা দিয়ে ভালোবাসতে।
“তুসি আমার লক্ষ্মী বোন টা।”
“আপা একটু দাঁড়াও।”
“কেন?”
তুসি হুইল চেয়ার টেনে গোলাপি কালার লিপস্টিক টা আনল।
“এদিকে আসো।”
“কেন?”
“আরে আসো না।”
“দেখ তুসি পাগলামি করিস না। আমি কিন্তু এখন এসব দিবো না।”
“আরে তুমি আসোই না।”
“তুসি..”
“যাও তোমার সাথে রাগ করছি।”
“ওরে বাবা রে আমার বোন টা খুব রাগ করে ফেলেছে? আচ্ছা এই নে।”
তুসি দাঁত বের করে দিয়ে হেসে তূবার ঠোঁটে হাল্কা গোলাপি লিপস্টিক টা দিয়ে দিলো। তুসি নিজের বোন কে দেখে প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তূবা হেসে তুসির নাক টেনে ধরল। ওপাশ থেকে শিরিন বেগম দুই মেয়ের ভাব দেখে আনমনে হেসে উঠলেন। তূবার সুন্দর মায়াবী মুখটার দিকে অপলক তাকিয়ে রইলেন তিনি।
“আম্মা কিছু বলবে?”
তূবার প্রশ্নে শিরিন বেগম মুখের ভাব ভঙ্গি ঠিক আর কঠিন করে ভেতরে ঢুকলেন।
“হো কইতাছি ঘরে চাউল শেষ হইয়া গেছে। বাজারও তেমন নাই।”
“আচ্ছা আমি আসার সময় নিয়ে আসব।”
তুসি বলল “আপা আসার সময় আচার এনো?”
“আচ্ছা আনব।” গালে আদর করে বলল তূবা।
তূবা ব্যাগ নিয়ে চলে যাওয়ার সময় শিরিন বেগম বললেন “সাবধানে যাইছ।” তূবা পিছন ঘুরে তাকাল শিরিনের দিকে। স্লান হেসে বের হয়ে পড়ল।
তিনি ভাবতে লাগলেন “কি ভাগ্য নিয়ে এসেছে। কতটা কপাল পুড়া হলে এমন কথা বলতে হয় তাকে এই কাজে যাওয়ার সময়।” শিরিন বেগমের বুক ভরে কান্না চলে আসল।
সেদিনের পর থেকে রনির আবার দেখা মিলে না। ছেলেটা অদ্ভুত রকমের পাগল। এভাবে আড়ালে থাকতে থাকতে হঠাৎ একদিন এসে আবার না জানি কোন দুর্ঘটনা ঘটায়। ভয় হয় তূবার। সে এত ভয়ের মাঝেও আহফিন কে মনে করে। হেসে উঠে সে। আজ দেখলে কি বলবে মানুষটা? অবাক হবে নাকি স্বাভাবিক ভাবেই নিবে? রিকশায় বসে বসে ভাবতে থাকল তূবা।
কলিংবেল বাজাতেই ফরিদা আন্টি খুলে দিল দরজা। তূবা কে দেখে তিনি মিষ্টি করে হাসলেন। “আজ কত দিন পর আপনাকে দেখলাম আন্টি।”
“হ্যাঁ মা তোমাকেও অনেকদিন পর দেখছি।”
“কেমন আছেন আন্টি?”
“ভালো। তুমি কেমন আছো মা?”
“আলহামদুলিল্লাহ।”
“ভেতরে আসো। আহফিন বাবা একটু বাহিরে গেল কি যেন দরকারে।”
তূবা আর কিছু বলল না।
ঘড়ির কাটা ৭ টায়। আহফিনের গাড়ির আওয়াজ পাওয়া গেল। তূবা মুচকি হেসে তার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল রুমে।
তাড়াহুড়া করে আসছিল আহফিন। তূবা কে দেখে থমকে গেল সে। এক মুহূর্তের জন্যে মনে হয়েছে নিশ্বাস থমকে গেছে তার। পা আর বাড়াতে পারল না আহফিন। সেখানেই আটকে রইল। হাতে থাকা গ্লাসটাও নিচে পড়ে শব্দ হলো। তার চোখ গুলির পাতা নড়ছেই না। সামনে থাকা মোহিনীর দিকে অদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। তূবা তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে। কাজল কালো চোখ গুলি বুকের ভেতরে ছুরির মতো আঘাত করছে আহফিনের। গোলাপের পাপড়ির ন্যায় গোলাপি ঠোঁট গুলি তাকে বড্ড টানছে। আহফিনের শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। তার এমন হাল দেখে তূবা এবার না হেসে পারল না। তূবার হাসি দেখে আহফিনের মস্তিষ্ক যেন কাজ করা থামিয়ে দিয়েছে। সে মাথা ঝাকায় চোখ বন্ধ করে। আবার তাকায় তূবার পানে। নেশাতুর চোখ গুলি নিয়ে এগিয়ে গেল তূবার দিকে।
“কি দেখছেন?”
“তুমি তূবাই তো? নাকি তার যমজ বোন?”
তূবা এবার খিলখিল করে হেসে উঠল। আহফিন তখনো নিজের ঘোর থেকে ফিরতে পারেনি। সে আচমকা তূবার গালে হাত রাখল। বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে তূবার গালে হাত বুলিয়ে দিল। তূবার মাথা এগিয়ে এনে গভীর ভালোবাসা দিল কপালে। তারপর বুকের গহীনে শক্ত করে জাবড়ে ধরল। কেন যেন তার চোখ গুলি চিকচিক করে উঠছে।
আহফিনের এমন কান্ডে তূবা হতবাক। শান্ত হয়ে মাথা পেতে রেখেছে আহফিনের বুকে। কি শীতল বুক!
আহফিন তূবা কে তুলে আবারো চুমু দিতে লাগল কপালে। অন্য হাতে তূবার আরেক গাল স্পর্শ করল। আহফিনের দুই হাতের তালুতে তূবার মুখশ্রী আরো বেশি মায়াবী লাগছিল। ডাগরডাগর চোখ গুলি তাকিয়ে আছে আহফিনের চোখের দিকে। মুখ ফুসকে বলেই ফেলল
“কি দেখছেন আহফিন?”
“সুহহ। আমার চোখের তৃষ্ণা মিটাতে দাও তোমার ওই কাজল কালো চোখের গভীরতায় তাকিয়ে থেকে। যদি পারতাম এই চোখ বুকের গভীরে লুকিয়ে রাখতাম। আমার সাধ্য নেই। তাই তোমাকেই চোখের সামনে রাখতে চাই আজীবন। লুকিয়ে রাখতে না পারি। সামনে রেখে দিব যত্ন করে।”
“আমি কি সারাজীবন আপনার কাছে থাকব আহফিন?”
“হ্যাঁ।”
“যদি না থাকি?”
“জোর করে রাখব।”
“জোর করে কি রাখা যায়?”
“হ্যাঁ চাইলেই পারা যায়। আমার চোখের তৃষ্ণা নিবারণের জন্য হলেও তোমাকে আমি বেঁধে রাখতে রাজি আছি।”
তূবাতূবা হুট করে আহফিন কে জড়িয়ে ধরল। কেন ধরল তা জানে না। আজকাল অনুভূতি গুলি বড্ড অবাধ্য হয়েছে। তারা কিছুতেই তার লাগামে থাকতে চাইছে না। সেগুলি এখন বেহায়া বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তারা শুধু আহফিন কে চায়।
আহফিন তূবাকে শক্ত করে আগলে নিল। তার মাথায় ঠোঁট স্পর্শ করল। আহফিন বিড়বিড় করল
“তোমাকে এভাবে জড়িয়ে ধরে আমি শতশত বছর পাড়ি দিতে চাই। আমার বুক হীম করার জন্যে হলেও তূবার শীতল পরশ চাই।”
তূবা চোখ বন্ধ করে নিল। মনে মনে বলল
“আমিও আপনার এই শীতল বুকে মাথা রেখে নিজের দুঃখ ভুলতে চাই আহফিন। তবে সেটা কি আদৌও সম্ভব?”
—-
তূবা তাড়া দিচ্ছে তুসি কে তাড়াতাড়ি তৈরি করিয়ে দিতে। ডক্টর দেখানোর সময় হয়ে গিয়েছে। এক মিনিট দেরি করলেও সিরিয়াল সবার লাস্টে চলে যাবে। তূবা না খেয়েই তুসি কে নিয়ে বের হয়ে গেল। শিরিন বেগম যেতে চাইলেও তূবা বলল “আম্মা তোমার যেতে হবে না। আর ওখানে দেরিও হতে পারে। তুমি বাসায় থাকো।”
তুসি কে নিয়ে তূবা বের হয়েছে। আহফিন বলেছিল আসবে। তূবা না করলেও তাকে না আসার জন্যে রাজি করাতে পারে নি। পরে নিজেই ফোন করে বলল তার কাজ পড়ে গেছে। তূবা মনে মনে খুশিই হলো। তা নাহলে তুসি কে কি বলত সে?”
তুসিকে হুইল চেয়ারে ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় গলি থেকে অনেক দূরে হঠাৎ রনির সাথে দেখা হয়ে গেল। ভয়ে তূবার কলিজা শুকিয়ে গেছে। আবার কোনো অঘটন ঘটতে চলছে নাকি? রনি কে দেখে তূবার স্বাভাবিক মনে হলো না।
তুসি ঘাড় কাত করে তূবা কে দেখল। কিন্তু কিছু বলল না। তূবা ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল
“তুই এখানে কি? পথ আটকে দাঁড়িয়েছিস কেন?”
“…
রনি কিছু বলল না। শুধু লাল ফোলা চোখ গুলি তূবার উপর নিক্ষেপ করল। দেখতে কেমন নেশাখোরের মতো লাগছে। গা থেকে বাজে গন্ধও বের হচ্ছে। তূবা কিছু বলতে যাবে তখনি..!
চলবে♥
(লম্বা বিরতি নেওয়ার কারণে একাধারে তিন দিন গল্প দিয়েছি। এখন নিজেকে কিছু সময় দিতে হবে। একদিন বা দুইদিন পরপর গল্প দিব ইনশাল্লাহ। আশা করি একটু বুঝবেন সবাই। আর হ্যাঁ ৭.৩০ এ গ্রুপে লাইভে আসছি। দাওয়াত রইল আড্ডার❤️)