#বিলম্বিত_বাসর
#পর্ব_১
#Saji_Afroz
.
.
.
-আমি এখন ঘুমাবো। তুমিও ঘুমিয়ে যাও। আজ যে ধকল টা গেলো আমাদের উপর, টানা সাত দিন ঘুমোতে হবে মনে হচ্ছে।
.
কথাটি বলেই বিছানার উপরে শরীরটা এলিয়ে দিলো আবেশ।
.
ছয় বছর প্রেম করার পর আজ বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছে আবেশ ও আদুরে।
কিন্তু বাসর রাতেই আবেশের মুখে এমন একটা কথা শুনে বিষ্ময়ের শেষ পর্যায়ে চলে গেলো আদুরে।
যে রাত নিয়ে তাদের এতো স্বপ্ন ছিলো সেই রাতেই আবেশের এমন ব্যবহারের কারণটা কি হতে পারে!
.
.
বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো আদুরে৷ ভারী শাড়ি, গহনা, সাজসজ্জা সবমিলিয়ে অস্বস্তি লাগছে তার। আরো বেশি অস্বস্তি লাগছে আবেশের কথা শুনে৷
কতো স্বপ্ন দেখেছিলো সে এই দিনটি নিয়ে! ঘুপটি মেরে বসে থাকবে ফুলে সাজানো বিছানার উপরে। আবেশ এসে তার ঘোমটা তুলবে। তাকে দেখে কপালে আলতো করে চুমু খাবে। অনেকক্ষণ সময় নিয়ে গল্প করবে দুজন দুজনের হাত ধরে। এরপর….
না আর ভাবতে পারছেনা আদুরে। ঘরটা ফুলে সাজানো হলেও আবেশের এমন ব্যবহার কিছুতেই মানা যায়না!
মাথার ঘোমটা হাতে নিয়ে মেঝেতে ছুড়ে ফেললো আদুরে।
ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে নিজেকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতে লাগলো সে। তাকে কি খুব বেশি খারাপ লাগছে দেখতে? কিন্তু বিয়ের আসরে আবেশ বলেছিলো তাকে দেখতে কোনো অপসরীর চেয়ে কম লাগছেনা!
তাহলে?
ধীরেধীরে গহনাগুলো খুলতে লাগলো আদুরে।
বুক ফেটে প্রচন্ড কান্না আসছে তার!
.
.
.
-ভাইয়ার বিয়েটা হয়ে গেলো। আমার লাইন এখন ক্লিয়ার। এখন আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারবো।
.
ফোনের ওপাশে আয়ানের কথা শুনে লামিয়া বললো-
বেকার কোনো ছেলেকে আমি বিয়ে করছিনা!
-আমি বেকার অবস্থায় তোমাকে আনছিও না। তোমার যে ডিমান্ড! আমাকে ভিক্ষা করতে হবে।
-কি বললা তুমি!
-যা শুনেছো।
-আজকে রাতে আর তোর সাথে কথা বলছিনা আমি। তোর ভাই বাসর করবে তুই দুঃখে মর। রাখলাম।
-লাম্মু? এই লাম্মু?
.
ফোনের লাইন কেটে সুইচড অফ করে দিলো লামিয়া।
রাগ উঠলেই এমনটা করে সে, শাস্তিস্বরূপ এক রাত কথা বন্ধ রাখে আয়ানের সাথে৷ কিন্তু আজও তার এমনটা করার প্রয়োজন ছিলো! পাশেই ভাই বাসর করছে আর সে ফোনে কথাও বলতে পারবেনা! লামিয়া যেই মেয়ে, বিয়ের পর রাগ উঠলে এক রাত অন্য রুমে গিয়ে কাটাবে। আর যদি বাসর রাতে রাগ উঠে? না না, কিছুতেই তাকে বাসর রাতে রাগানো যাবেনা। নাহলে সেই রাতটাও ভেস্তে দিবে এই মেয়ে।
এসব ভেবে নিজেরমনে হাসতে লাগলো আয়ান।
.
.
.
ড্রেসিং টেবিলের একপাশে বসে ফুপিয়ে কেদে চলেছে আদুরে। মা বাবার বড্ড আদরের মেয়ে সে। তার পছন্দের কথা ভেবে আবেশের হাতে তুলে দিতে দ্বিধাবোধ করেননি তারা। কিন্তু এই আবেশই তাকে বিয়ের প্রথম রাতেই অবহেলা করছে! কেনো?
৬বছরেও কি একটা মানুষকে চেনা যায়না!
.
-আদু?
.
হঠাৎ আবেশের গলার স্বরে চিন্তার জগতে করা বিচলন থেমে গেল আদুরের।
আবেশ ধীরেধীরে এগুলো তার দিকে। আদুরের পাশে হাটু গেড়ে বসে সে বললো-
ঘুমোবেনা?
.
কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারছেনা আদুরে। কথা বলতে গিয়েও কান্না আসছে তার।
আবেশ তার দিকে হাত বাড়িয়ে বললো-
আসো? চলো ঘুমোবে।
.
অভিমানী স্বরে আদুরে বললো-
আমার ঘুম আসছেনা।
-আমার বুকে ঘুমানোর কথা ছিলোনা তোমার এই রাতে?
.
ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে আদুরে বললো-
আরো অনেক কিছুই কথা ছিলো। হয়েছে কি?
.
কোনো জবাব দিতে পারলোনা আবেশ। মুখটা অন্য দিকে ঘুরিয়ে ভাবতে লাগলো কি বলা যায়। তখনি আদুরে প্রশ্ন করলো-
কি হয়েছে তোমার?
.
মৃদু হেসে আবেশ বললো –
আরে পাগলি আমার খারাপ লাগছে তাই শুয়ে পড়েছি। তাই বলে তুমি কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলবা! দেখি উঠো। আসো বলছি!
.
.
আবেশের বুকের উপর মাথা রেখে শুয়ে আছে আদুরে।
এর থেকে বড় পাওনা আর কি হতে পারে! কিন্তু আবেশ কিছু একটা লুকোচ্ছে। যা তার আচরণেই প্রকাশ পেয়েছে। প্রশ্ন হলো কি লুকোচ্ছে আবেশ!
.
.
.
খুব ভোরেই ঘুম থেকে উঠেছেন ফাতেনা বেগম। নতুন বউ বাড়িতে এনেছেন তিনি। আজ দুপুরে বউ ভাতের অনুষ্ঠান করা হবে। সেই আয়োজনে কোনো যেন কমতি না থাকে, এটা ভেবেই দম ফেলানোর সময় টুকু নষ্ট করতে নারাজ তিনি। কিন্তু শত কাজের মাঝেও বারবার মন টা কেপে উঠছে তার। তার বড় ছেলের সুখের কথা ভেবেই আজ এত সব আয়োজন। সুখী হতে পারবে তো সে? প্রেমের বিয়েতে যে তিনি একেবারেই বিশ্বাসী নন।
.
-আপা নতুন বউ উঠছে?
.
কাজের মেয়ের প্রশ্নে ফাতেমা বেগম বললেন-
এতো সকালে উঠে কি করবে সে?
-এখন থেকাই অভ্যাস কইরা নেন আপা। নাইলে এই মাইয়া আপনের হাতের নাগালের বাইর হইয়া যাইবো। আমাগো আবেশ তারে ভালোবাইসা বিয়া কইরা আনছে। তাই তার রাজ এই বাড়িতে চলবো। বুঝবার পারছেন কি বলতে চাইছি?
-পেরেছি। কিন্তু বেশি অতিমাত্রায় কথা বলো। এসব আর কারো সামনে বলবেনা। আদুরে খুব ভালো মেয়ে। আমার কথা নিশ্চয় মেনে চলবে সে।
আর মাত্র বিয়ে হলো। কতো ধকল গেল তাদের উপর। এতো তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠার কোনো দরকার নাই। উঠুক আস্তেধীরে।
.
মুখে কথাটি বললেও ফাতেমা বেগমের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে নানাধরনের প্রশ্ন। শহরের বড় ঘরের মেয়ে পারবে কি রাজশাহীর এই নাচোল নামের গ্রামের পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে?
.
.
.
গোসল সেরে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসলো আদুরে। আবেশ এখনো বেঘোরে ঘুমোচ্ছে।
আবেশের সাথে তার সম্পর্কের ছয় বছর চলছে। এর মধ্যে আদুরে তার মাঝে কোনো খুঁত খুঁজে পায়নি।
একটা ছেলে কি করে এতো নিখুঁত হয় তা জানা নেই।
অন্য আট দশটা প্রেমিকের মতো আবেশ তার জন্য কবিতা লিখেনি কিংবা রাগ ভাঙ্গানোর জন্য বাসার সামনে আইসক্রিম নিয়ে দাঁড়িয়েও থাকেনি, তার দিকে তাকিয়ে কখনো বলেনি তুমি আমার দেখা সেরা সুন্দরী অথবা তার চুলের দিকে তাকিয়ে হারিয়ে যায়নি৷ কথিত প্রেমিক সমাজের কাতারে সে মোটেও ছিলো না।
আদুরে নিয়ম করে রোজ এসব নিয়ে ঝগড়া করলেও পাত্তা দিতোনা আবেশ আবেশ অন্য রকম।
ভীষণ রকম ধৈর্য্যশীল। এমন ম্যান্দামার্কা স্বভাবের ছেলে যে কি করে হয় আদুরের জানা নেই।
তার মতো একটা অগোছালো, উদ্ভব মেয়েকে সহ্য করা কোনো সাধারণ ছেলের কাজ নয় কিন্তু!
তবে বিয়ের আগে দূরে থাকার কারণ বুঝতে পারলেও বাসর রাতে আবেশের এমন আচরণের কারণ বুঝে উঠতে পারছেনা আদুরে। কি চলছে আবেশের মনে!
.
জানালার গ্রিলের পাশে দাঁড়িয়ে চুলে পেঁচানো গামছাটা খুলে নিচ্ছে আদুরে।
এমন সময় ঘুম ভাঙ্গে আবেশের। জানালার দিকে চোখ পড়তেই আদুরের দেখা পায় সে।
হালকা ক্রিম কালারের সুতির শাড়ি পরেছে সে।
সকালের মিষ্টি রোদ্র স্নানে
ছোট্ট কিশোরীর মত চুল ডানে এলিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আদুরে।
চোখে ঘুম থাকা স্বত্তেও উঠে পড়লো সে। ধীরপায়ে আদুরের দিকে এগিয়ে এসে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো তাকে।
আচমকা কারো স্পর্শ পেয়ে হতভম্ব হয়ে গেলো আদুরে। আবেশ তার চুলের মাঝে নাক ডুবিয়ে বললো-
শুভ সকাল।
.
এই ছয় বছরে আবেশ তাকে ছয় বার জড়িয়ে ধরেছে কিনা সন্দেহ! তাই আবেশের ছোঁয়া অচেনাই বলা যায় আদুরের কাছে। তার উপর কাল রাতে যেমন ব্যবহার আবেশ করেছিলো এই সকাল বেলা তাকে সে জড়িয়ে ধরবে এমনটা ভাবেনি।
.
আদুরের ঘাড়ে আলতো করে ঠোঁট জোড়া ছুইয়ে দিতেই কেঁপে উঠলো সে।
নিজের হাত দিয়ে তার ভেজা চুলগুলো সরিয়ে গভীর চুম্বনে লিপ্ত হয়ে পড়লো আবেশ।
জানালার গ্রিল নিজের হাতে শক্ত করে চেপে ধরলো আদুরে। এই প্রথম আবেশের এমন ছোঁয়ার সাথে পরিচিতি হচ্ছে সে। আবেশ এর আগে কখনোই তার সাথে এমন কিছু করেনি। যতবার দেখা করেছে দুরুত্ব বজায় রেখেছে। মাঝেমাঝে কপালে চুমু এঁকেছে।
সামান্য চুমুতেই এক ভালো লাগা কাজ করতো আদুরের মাঝে। আর আজ আবেশ তাকে আরো কাছে টেনে নিয়েছে। এই যেনো এক অন্যরকম অনুভুতি!
.
আদুরেকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিতেই আবেশ দেখতে পেলো সে কাঁপছে। যেনো আদুরের ঠান্ডা লেগেছে। তাকে নিজের বুকে টেনে নিয়ে শান্ত গলায় আবেশ বললো-
জ্বর তো আসেনি, এভাবে কাঁপছো কেনো তুমি?
.
মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরিয়ে আসছেনা আদুরের।
তার অবস্থা দেখে মৃদু হাসলো আবেশ। নিজের কাছ থেকে আদুরেকে সরিয়ে তাকে কোলে তুলে নিয়ে আবেশ বললো-
এখুনি তোমার কাঁপাকাঁপি বন্ধ করছি আমি।
.
তাকে কোলে নিয়ে বিছানার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে আবেশ। এদিকে আদুরের প্রায় জান যায় যায় অবস্থা।
তাহলে কাল রাতে সত্যিই খারাপ লেগেছিলো আবেশের? যে কারণে সে এমন আচরণ করেছিলো?
তবে কি কাল রাতে যা হয়নি তা কি আজ হতে চলেছে!
ভাবতেই মুখখানা লাল হয়ে গেলো আদুরের।
.
(চলবে)