#সবটাই_তুমিময়
#লেখনিতে-মিথিলা মাশরেকা
পর্বঃ৫
-আমি চাই আমার বাচ্চার মা আপনি হবেন।শুধুমাত্র এই কারন,আমি চাই!আমি চাই বলেই,আমার বাচ্চার সেরোগেট মাদার আপনাকেই হতে হবে মিস অদ্রি!অন্য কেউ নয়!
আমার প্রশ্ন শেষ হওয়ার সাথেসাথেই অঙ্কুরের জবাব!ঘাড় ঘুরিয়ে ওনাকে পাশেই দেখতে পেলাম।চোখটা হাতের মোবাইলে তার।একটু ভরকে গেলাম।রোহান ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে দেখি সে স্বাভাবিকভাবেই দাড়িয়ে।অঙ্কুর মাথা তুলে বললেন,
-তোকে বলেছিলাম রোহান,ওনার সাথে বেশি কথা না বলতে!
….
-এতো বেশি সেন্সিটিভ কেনো তুই আমাকে নিয়ে?এসব কবে বন্ধ করবি বলতো?
রোহান ভাইয়া কিছু না বলে সোফায় গিয়ে বসলেন।টিভি অন করলেন উনি।অঙ্কুর আমার দিকে এগোলেন দুপা।বললেন,
-এভাবেই সবাইকে কথার জালে ফাসিয়ে নিজের কাজ হাসিল করে নেন আপনি রাইট?এক্সপার্ট হয়ে গেছেন একদম!রোহান আমার দেখা টাফেস্ট পার্সোনগুলোর মধ্যে একজন!ওকেও নিজের কথায় ফাসালেন?আপনি সত্যিই আলাদা মিস!
কথার জালে ফাসানো,কাজ হাসিল করানো,এসব ভাষা আজোবদি কোনোদিনও শুনতে হয়নি আমাকে।আজ অঙ্কুরের কাছে এসব শুনে তার প্রতি ঘৃনাটা আরো গাঢ় হলো।বললাম,
-এক্সপার্ট হলে হয়তো সব উত্তরগুলো পেয়ে যেতাম।কিন্তু আমি আমার উত্তর এখনো পাইনি!
-ডোন্ট এক্সপেক্ট সো মাচ!
উনি মোবাইলের দিকে তাকিয়ে চলে যাচ্ছিলেন।কিছুটা উচুস্বরে বললাম,
-আপনার কাছে এক্সপেক্টেশন?হাহ!হাসালেন!
উনি থেমে গেলেন।পিছন ফিরে মোবাইলটা পকেটে পুরে বললেন,
-যদিও আপনাকে উত্তর দিতে এএসএ বাধ্য নয়,তবুও শুনে রাখুন,আমি চাই আপনাকেই মানতে হবে আমার শর্ত,যারমানে আপনাকেই মানতে হবে।আপনাকে সিলেক্ট করার কারন,নিতান্তই আমার চাওয়া।নাথিং এলস্!
-আমি আপনার চাওয়া পুরনে বাধ্য নই!
-হ্যাঁ,তা নন!কিন্তু আপনার কর্মফল?সেটা আপনি ভোগ করতে বাধ্য তাইনা?
বিস্ময় বাড়লো।তার চাওয়ার কোনো গুরুত্বপুর্ন কারন আছে সেটা আন্দাজ করেছিলাম।এবার হিসেব মিলছে। কর্মফল।তার কাছে আমার কর্ম মানেই তার সত্যিটা জানা।এবার সবটা পরিষ্কার।বললাম,
-তারমানে বলতে চাইছেন,শুধুমাত্র আপনার বিষয়ে সেদিন ওসব জেনে গেছি বলেই আপনি….
-আপনি আমার বিষয়ে একটু বেশিই জেনে গেছেন।তবে আমি কিন্তু….
-অঙ্কুর?
রোহান ভাইয়া ডাক লাগালেন।টিভির দিকে তাকিয়ে সোফা থেকে দাড়িয়ে গেছেন উনি।অঙ্কুর এগোলেন।পিছন পিছন আমিও গেলাম।অঙ্কুরের আগেরদিন ম্যাচ হারা নিয়ে নিউজ হচ্ছে।ব্রেকিং হিসেবে হেডলাইনে বড়বড় করে লেখা,এএসএ’র নতুন রেকর্ড!জিরো রান,ওয়ান বলে আউট!আর লাইভ নিউজে দেখাচ্ছে তার সমর্থকরা হৈ হুল্লোড় লাগিয়েছে।অঙ্কুর ফ্যান তার পরবর্তী আন্তর্জাতিক ম্যাচে তার আগের মতোই সেঞ্চরী নিয়ে কামব্যাক আশা করছে।অঙ্কুর তাচ্ছিল্যে হাসলেন।বললেন,
-এটা তো কালকের নিউজ!আজকের আপডেট কি?চ্যানেল পাল্টা!
রোহান ভাইয়ার কাছ থেকে রিমোট নিয়ে চ্যানেল পাল্টালেন উনি।রোহান ভাইয়া একধ্যানে তাকিয়ে রইলেন অঙ্কুরের দিকে।হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রইলাম আমি।এতোগুলো মানুষের এতো আশা ওনাকে নিয়ে।আর উনি?সবটাই মুল্যহীন মনে করছেন!এতো আশা,বিশ্বাস ভরসার যোগ্যই নয় এই মানুষটা।তাদের আবেগ উপেক্ষা করতে চ্যানেল পাল্টাচ্ছেন।টিভিতে কিছু একটা দেখে আগ্রহ নিয়ে সোফায় কুশন কোলে নিয়ে বসলেন উনি।
অঙ্কুরের অতিমাত্রার আগ্রহ দেখে কপাল কুচকে এলো আমার।একপলক টিভির দিকে তাকালাম।যা দেখলাম,তাতে হতবাক না হয়ে পারলাম না।একপ্রকার তব্দা মেরে গেছি।প্রদীপ সরকারের সব কুকর্মের সঙ্গী,তার ডানহাত দীপক তালুকদার কালোটাকার ব্যবসায়ী হিসেবে প্রমানসমেত ধরা পরেছে।আর তার থেকেও বড় কথা!প্রমানগুলো সব আমারই ডকুমেন্টারি থেকে নেওয়া।খবরগুলো দেখে জমে যেতে লাগলাম যেনো।আস্তেধীরে এগোতে লাগলাম।আমাকে এগোতে দেখেই অঙ্কুর টিভি বন্ধ করে দিয়ে বললেন,
-এসব বিষয়ে ইন্টারেস্টটা একটু কমান মিস অদ্রি!রুমে যান!
অনুভুতিশুন্য হয়ে তারদিকে তাকালাম।দীপক তালুকদার বিশিষ্ট সমাজসেবক হিসেবে নাম করেছেন ঠিকই,কিন্তু এই লোকটা মুলত কালোটাকার ব্যবসায়ী।টানা দুমাস ফলো করে,তার বিরুদ্ধে সব প্রমান জোগার করেছিলাম।এখানে আটকে পরার আগেই এসব ডকুমেন্টস্ ভোরের বাংলা খবরকাগজের এমডিকে মেইল করেছিলাম আমি।যা চারদিন আগেই পেপারে প্রিন্ট হওয়ার কথা ছিলো।সেগুলো আজকে কেনো প্রচার হচ্ছে?আর তো আর,টিভি চ্যানেলে কেনো?
-আপনাকে রুমে যেতে বলেছি মিস অদ্রি!
-এসব….
-রুমে যান।
-এ্ এক মিনিট মিস্টার অঙ্কুর,এই ডকুমেন্টস্…..
উনি উঠে দাড়িয়ে চিৎকার করে বললেন,
-জাস্ট গো টু ইউর রুম ড্যামিট!
কেপে উঠলাম কিছুটা।আজ প্রথমবার এতো উচু গলায় কথা বলেছেন উনি আমার সাথে।মাথা ফাকা ফাকা লাগছে।রোবটের মতো রুমে চলে আসলাম ওখান থেকে।এমডি স্যার নিজেও আমাকে চেনেন না।তার কাছে তো শুধু কাজটাই মানে রাখে।আমার দেওয়া প্রতিটা রিপোর্ট পেপারে প্রিন্ট করায় তাকে প্রতিবারই ধমকি শুনতে হয়েছে।এমনকি লাইফরিস্কও ছিলো তার।তবুও উনি সবগুলো নিউজ কভার করেছেন।কিন্তু আজকে খবরটা অন্য কোথাও কেনো?উনিই কি চ্যানেলে পাঠিয়েছেন এইসব?এই খবর ওনার পেপারে প্রিন্ট হলে ওনার পেপারের আরো নামডাক হতো অনেক বেশি।তবে?
চিন্তা হচ্ছে!খবরটা ঠিক কোথায় থেকে কোথায় গড়িয়েছে?এমডি স্যার ডকুমেন্টসগুলো অন্যকোথাও দেওয়ার লোক নন।আর এসব উনি ছাড়া অন্য কারো কাছে থাকারও কথা না।তাহলে ঠিক কি ঘটেছে?কেউ কোনোভাবে ওনাকে ধমকে ওগুলো হাতিয়ে নিয়েছে?কে?দীপক তালুকদারের লোকজন?কিন্তু যদি তার লোকজনই হবে তবে তা নিউজে আসবে কেনো?না!এ অন্যকেউ!আর সে চায়নি এই খবরটা ভোরের বাংলায় প্রিন্ট হোক।রিপোর্টার অদ্রি নামে দীপক তালুকদারের সত্যিটা সবার সামনে আসুক।কিন্তু কেনো?কেনো কেউ এসব করবে?কে সে?
.
সারাদিন রুমেই কাটলো।দরজা লক ছিলো না আজ।আমিই ইচ্ছা করেই বেরোইনি।সকালে ভেবেছিলাম অঙ্কুর বেরোলে পালানোর উপায় খুজবো।কিন্তু দীপক সরকারের খবরটা দেখার পর কেমন যেনো ঘটকা লাগছে সবকিছুতে।চারদিন পর খবর বেরোনো,তাও টিভি চ্যানেলে,তাও আমারই সব ডকুমেন্টারী দিয়ে,আমার নাম ছাড়া।সবকিছুতে গুলিয়ে যাচ্ছি।তাছাড়া অঙ্কুরের ব্যবহার নিয়ে ভাবতে না চাওয়া সত্ত্বেও বারবার তার ধমকের কথা মনে পরে অস্থির লাগছে।
-এভাবে ছাড়া পেয়েও ঘরবন্দি হয়ে আছেন কেনো?
দরজায় তাকিয়ে অঙ্কুরকে দেখতে পেলাম।হাতে খাবারের ট্রে।চুপ রইলাম।উনি ভেতরে ঢুকে বললেন,
-দুপুরে খেতে যাননি কেনো?
…..
-খাবারটা খেয়ে নিন।
-খিদে নেই।নিয়ে যান ওটা!
-খিদে না থাকাটা আপনার ব্যাপার।কিন্তু আমার বাসায় কেউ না খেয়ে থাকবে সেটা আমি দেখতে পারবো না সেটা আমার ব্যাপার।সো,খেয়ে নিন।
-দেখুন মিস্টার অঙ্কুর….
-আপনাকে হাত ধরে বিছানায় নিয়ে আসি এমনটা না চাইলে চুপচাপ এসে বসুন!
মেঝে ছেড়ে উঠে বিছানায় এসে বসলাম।উনি আমার সামনেই বসে খাবার মাখাতে লাগলেন।বললাম,
-আমি বলেছি আমি খাবো না!
-আমি শুনেছি।নিন হা করুন!
-আজব তো!আমি….
কথা শেষ করার আগেই খাবার মুখে পুরে দিলেন উনি আমার।যে আমার কোনো কথার দাম দেয়না,যার কাছে জীবনে প্রথমবার আমাকে ধমক শুনতে হয়েছে,সে এসেছে আমাকেই খাবার খাওয়াতে।কটমটে চোখ তাকিয়ে খাবার চিবোতে লাগলাম।উনি নিজের কাজে মনোযোগ রেখেই বললেন,
-আপনার অগ্নিদৃষ্টি দেখে এএসএ ভয় পাবে না!ইউ শুড নো দ্যাট!
চোখ নামিয়ে নিলাম।উনি বললেন,
-কি ব্যাপার বলুনতো মিস পর্বতশৃঙ্গ?কোনো বিষয়ে টেন্সড্ মনে হচ্ছে আপনাকে।
…..
-সকালে ওই নিউজটা দেখার পর রিয়্যাক্ট করছিলেন আপনি।আবার ওটা দেখার পর থেকেই রুমে এভাবে কপাল কুচকে বসে আছেন।এনি প্রবলেম?
কিছুটা হচকিয়ে গেলাম।সত্যিই তো!ওনার সামনে ওমন করাটা ঠিক হয়নি আমার।নিজেকে একটু সামলে বললাম,
-আপনিই বা আমাকে ওই নিউজের বিষয়ে কম ইন্টারেস্ট দেখাতে বললেন কেনো?
-নট ব্যাড হা?আমার তীর আমাকেই তাক করছেন?
-আই উইশ,সে তীর যেনো লক্ষ্যভ্রষ্ট না হয়।আন্সার মি!আপনি কেনো ওই কথা বললেন?নিউজও দেখতে দেননি পুরোটা।
-আপনি ওই নিউজের সাথে জড়িত না রাইট?
ওনার ঠোটে বাকা হাসি।চোখ সরিয়ে নিলাম।উনি বললেন,
-হা করুন!
-আর খাবো না!
-পুরোটাই খেতে হবে আপনাকে!
-জোর করবেন?
-না।তবে ওইযে,বলেছি তো।একবেলা না খেলে পরের দুদিন খাওয়া জুটবে না।আর তারপর কি হবে আপনি ভালোমতোই জানেন!
-আমাকে দিন।আমি খেয়ে নিচ্ছি!
-এএসএ খাবার হাতে লাগিয়েছে,তার একটা দাম আছে।ফিনিশ ইট!
বিরক্তি নিয়ে খেতে লাগলাম।এর সাথে তর্কে যাওয়া বেকার।উনি বললেন,
-মানলাম আপনি সিক্রেট রিপোর্টার!কিন্তু তা বলে সব বিষয়েই আগ্রহ?ওটা তো টিভি নিউজ ছিলো।আপনার সো কলড্,ভোরের বাংলা পত্রিকার খবর না।তাছাড়া,নিউজে রিপোর্টার হিসেবে তো অদ্রি ছদ্মনামটাও ইউজ হয়নি।আমি তো দেখলাম না।তারমানে আপনার সম্পৃক্ততা কোনোভাবেই থাকতে পারে না।এমনিতেও এখানে থেকে পড়াশোনা হ্যাম্পার হচ্ছে আপনার।সে বিষয়ে ভাবুন না!সেটাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখুন!নতুন,অন্যকিছুতে আগ্রহ দেখান!তা না,ওই নিউজ নিয়ে ইন্টারেস্ট দেখাবেন কেনো?
-এতোসব আপনাকে কে ভাবতে বলেছে?
খাওয়ানো থামিয়ে উনি কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে।বললাম,
-হোয়াট?বলছেন না কেনো?আমাকে নিয়ে এতো ভাবতে বলেছে কে আপনাকে?আপনার আমাকে ধমক দেওয়াটাই মানায়।
-আমার অনাগত বাচ্চার মা আপনি।এটুকো তো ভাবতেই হয়!
আবারো রাগ উঠলো।দাতে দাত চেপে বললাম,
-আমার আপনার কোনো কথা শুনতে ভালো লাগছে না।নাইবা আপনার হাতে খেতে ভালো লাগছে।আপনি আসুন!
-বুঝলাম।
-কি?
-এই,যে আপনার ভালো লাগছে না।
-বোঝেন আপনি?আপনি তো….
আবারো খাবার দিয়ে আমাকে থামিয়ে দিলেন উনি।বললেন,
-হোয়াই নট?বুঝবো না কেনো?আমাকে কি অবুঝ মনে হয়?
…
-যাই হোক,ভালো না লাগার কারনটা কি আমার শর্ত?এজ অলয়েজ?
-যা কোনোদিনও মানবো না,তা নিয়ে খারাপ লাগাকে কেনো পাত্তা দেবো?আপনার শর্তকে অনেক আগেই এভোয়েড করেছি আমি।
-তাহলে?তাহলে আর কি কারনে আপনার মন খারাপ?
….
-আমার ব্যবহার?আইমিন,সকালের ধমকটা?
ওনার দিকে তাকাতেই প্লেটের দিকে ইশারা করলেন উনি।খাবার শেষ হয়নি।অন্যদিক ঘুরে বসে বললাম,
-প্লিজ একা থাকতে দিন আমাকে!প্লিজ!
-আপনাকে ধমক দেওয়ায় সরি বলার প্রয়োজনবোধ করছি না।ভুল করিনি আমি।বাট ইয়েস,যেটা হয়,ভালোর জন্যই হয়।আজ দ্বিতীয়বার মনে হলো কথাটা।খাবার পুরোটা খেলেন না।পানিটা খেয়ে নেবেন।আর হ্যাঁ,ডিনার টাইমে যেনো ডাকতে না হয়।আসছি।
উনি বেরিয়ে গেলেন।দরজা খোলা রেখেই।ঢকঢক করে গ্লাসের পানি শেষ করলাম।আজকের সবগুলো ঘটনা বারবার মনে পরছে।অঙ্কুরের অতীত,তার ব্যবহার,সবকিছু।কিন্তু আমি তো তার বিষয়ে ভাবতে চাইনা!ঘৃনা করি তাকে।তবে তাকে নিয়ে ভাবছি কেনো?তার ধমক দেওয়া নিয়ে তার উপর অভিমান হচ্ছিলো কেনো?কোনোভাবে কি আমি তার উপর দুর্ল হতে শুরু করেছি?না!উনি শুধু নিজের স্বার্থে সবটা করছেন।আর তাই আমার দুর্বলতা নয়,ঘৃনাই প্রাপ্য তার।ঘৃনা করি আমি তাকে।তার জন্য শুধু ঘৃনাই থাকবে আমার মনে।অন্য কিছু নয়!
#সবটাই_তুমিময়
#লেখনিতে-মিথিলা মাশরেকা
🎁সারপ্রাইজ পর্ব🎁
-এভাবে চোরের মতো চুপিচুপি আমার রুমে ঢুকে সবকিছু ওলোটপালোট করছেন যে?কিছু সরিয়েছেন নাকি?এটা জানেন তো?এএসএ’র ঘরে চুরির দায়ে আপনাকে ঠিক কতোবড় মাশুল দিতে হতে পারে মিস অদ্রি?
চমকে উঠলাম অঙ্কুরের গলা শুনে।সকালে ব্রেকফাস্ট শেষে ওনাকে বেরিয়ে যেতে দেখেছিলাম।নিচে ড্রয়িংরুমের চারপাশে গার্ডসরা ছিলো বলে বিরক্তি নিয়ে উপরে করিডোরে পাইচারি করছিলাম।হুট করে মনে পরলো ক্যামেরা আর ফাইলগুলোর কথা।ওগুলো অঙ্কুরের কাছেই আছে।আর উনি অবশ্যই তা নিজের ঘরেই লুকিয়েছেন।তাই সাহস জুগিয়ে চুপচাপ ঢুকে পরেছিলাম তার রুমে।এতোএতো ট্রফি,ব্যাচ,মেডেলের ভীড়ে খুজতে লাগলাম ওগুলো।ছিমছামভাবে সাজানো পুরো ঘরটা এলোমেলো করে ফেলেছি একদম।ভেবেছিলাম ওনার আসতে দেরি হবে,গুছিয়ে নেবো।কিন্তু এবার ওনার গলা শুনে ভয়ে গলা শুকিয়ে আসলো আমার।পিছন ফেরার সাহসটাও হলো না।
-পেয়েছেন?ফাইলগুলো?
ওড়না খামচে ধরে চোখ খিচে বন্ধ করে রইলাম।উনি বুঝে গেছেন সবটা।আর এর ফল মোটেও ভালো হবে না তা বেশ আন্দাজ করতে পারছি আমি।
-চোখ খুলুন।
মাথা নাড়িয়ে না বোঝালাম।উনি আরো গম্ভীরভাবে বললেন,
-চোখ খুলতে বলেছি!
একটা শুকনো ঢোক গিলে চোখ খুললাম।উল্টেপাল্টে থাকা বিছানার উপর বসে জুতো খুলতে ব্যস্ত উনি।বললেন,
-এটা কিন্তু বোকামো।মানে বড়সড় বোকামো।আপনার কি ধারনা?ওগুলো আপনার হাতের নাগালের মধ্যে রাখবো আমি?
নিজের গালে নিজের অদৃশ্য বিবেক ঠাটিয়ে চড় লাগিয়ে বললো,এই লোক দুশো পার্সেন্ট ঠিক বলেছে,এমনিতে তো নিজেকে চালাক দাবি করিস।আর আজ তোর মাথায় এটুক ঢুকলো না?আস্তেধীরে পিছোতে লাগলাম।উনি উঠে দাড়িয়ে ঘড়ি খুলতে খুলতে বললেন,
-রুমের বাইরে গেলে শাস্তিটা আরো বেশি হবে।
পা থেমে গেলো আমার।দরজা ঘেষে দাড়িয়ে রইলাম।অঙ্কুর শান্তশিষ্টভাবে তোয়ালে কাধে ঝুলিয়ে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালেন।দরজায় থেমে গিয়ে আমার দিক ফিরে বললেন,
-আমি বেরোনোর পর পুরো রুম একদম আগের মতো গোছানো চাই।একবিন্দু এদিক ওদিক হলেই….
কথা শেষ করেননি।ভেতরে ঢুকে গেলেন উনি।এই লোকের এই একটা চরম বদঅভ্যাস!কথা শেষ করেন না!সবসময় এই কাজটার জন্য ভয় হাজারগুন বেড়ে যায় আমার।কপাল চাপড়ে তাড়াতাড়ি সব গোছাতে লাগলাম।ওনার বেরোনোর আগেই হয়ে গেছে সবটা।জোরে শ্বাস নিয়ে আরো ভালোমতো খুতিয়ে খুতিয়ে দেখতে লাগলাম তবুও।দরজা খোলার শব্দে সেদিক তাকাতেই হাত মুঠো করে চোখ বন্ধ করে নিলাম।অঙ্কুর শাওয়ার নিয়ে শুধু ট্রাউজারটা পরে একদম উদোম গায়ে বেরিয়েছেন ওয়াশরুম থেকে।আওয়াজ আসলো,
-এইসব লজ্জাটজ্জা পরে পাবেন!এখানে এই ট্রফিটা আর মেডেলটা একসাথে রাখা ছিলো।উল্টে দিয়েছেন।তাছাড়া বুকশেলফে উপরের তাকে হুমায়ন আহমেদের চারটে বই ছিলো।দুটো নিচের তাকে রেখে দিয়েছেন।আরো অনেক ভুল করেছেন আপনি মিস অদ্রি!এবার এসবের জন্য বোনাস শাস্তিভোগ করুন!
-দ্ দেখুন মিস্টার অঙ্কুর,আমি তো….
-হেডেক হচ্ছে।কফি বানিয়ে আনুন আমার জন্য।
-কিহ্?
-ঠিকই শুনেছেন।একদম কফি নিয়ে রুমে ঢুকবেন।তার আগে নয়!বেরোন রুম থেকে!বেরোন!
এমনভাবে আদেশ করছে,যেনো আমি তার কাজের লোক!রাগে চোখ মেললাম।কিন্তু আবারো বন্ধ করে নিতে হলো চোখজোড়া।এখনো উনি শুধু ট্রাউজার পরেই আছেন।রাগী গলাতেই বললাম,
-আমি আপনার বাসার কাজের লোক নই!
-একবারো তা বলেছি?
-এভাবে ওর্ডার করতে পারেন না আপনি আমাকে!
-ওর্ডার নয়,শাস্তি!
-হোয়াটএভার!পারবো না!
-ও।তারমানে এর থেকে বেটার শাস্তি চাইছেন আপনি?বেশ!তাহলে এক কাজ করুন!মাথা ব্যাথা করছে,মাথায় হাত বুলিয়ে দিন!ঘুমাবো আমি।
-হোয়াট?
-এবারও ঠিকই শুনেছেন!আর হ্যাঁ,দুটোর একটা আপনাকে করতেই হবে মিস অদ্রি!নইলে….
আবারো অসমাপ্ত কথা!মাথায় হাত বুলাতে পারবো না তার।কোনোভাবেই না।কিন্তু কফিও তো বানাতে পারি না।চুলোই জ্বালাতে পারবো না হয়তো।আগুনে ফোবিয়া বলে মনিমা তো কিচেনের ধারেকাছেও ঘেষতে দিতো না কোনোদিন আমাকে।চোখ বন্ধ রেখেই আমতা আমতা করে বললাম,
-আ্ আমি কফি বানাতে পারি না!
অনেকক্ষন নিরবতা।আস্তে আস্তে চোখ খুললাম।অঙ্কুর বেডে বসে।গায়ে টিশার্ট দেখে শ্বাস নিলাম।কিন্তু ওনার চাওনি দেখে মনে পরলো কি বলেছি।জোর করে হাসি ফুটালাম মুখে।বললাম,
-ইয়ে আ্ আসলে মনিমা আমাকে কোনোদিনও….
-নায়েব কাকা!
আমার দিকে তাকিয়ে বেডে বসে থেকেই ডাক লাগালেন অঙ্কুর।একটুপরেই একজন বয়স্ক লোক ভেতরে আসলো।আগেও দেখেছি ওনাকে।পরিচয় জানার আগ্রহবোধ হয়নি শুধু।উনি কাধের গামছা হাতে নিয়ে হাত মুছতে মুছতে বললেন,
-কি হইলো অঙ্কুর বাবা?
অঙ্কুর আমাকে দেখিয়ে বললেন,
-মনিমার এই ননীর পুতলটাকে এক্ক্ষুনি কিচেনে নিয়ে যাও!এর হাতের রান্না খাবো আজ!সব রান্না আজ একে দিয়ে করাবে!
বড়বড় চোখ করে তাকালাম তারদিকে।বললাম কফিটাও বানাতে পারি না,আর উনি সোজা আমার হাতের রান্না খেতে চাইছেন?চেচিয়ে বললাম,
-কিইইই?আমি?রান্না?
-গেট লস্ট ফ্রম হেয়ার!মেয়ে নামের কলঙ্ক আপনি!কফিটাও বানাতে জানেন না?আজ রান্না শিখবেন আপনি!যতোক্ষন লাগে লাগুক!লান্চ না জুটলে দরকার পরলে ডিনার করবো একদম!তবুও আপনাকেই রান্না করতে হবে আজ!গেট আউট!
আবারো ধমক!আবারো ধমক দিলেন উনি আমাকে।প্রচন্ড রাগ হলো।অগ্নিদৃষ্টি তাক করে রাখলাম অঙ্কুরের দিকে।আর উনি বিরক্তি নিয়ে মাথা ধরে বেডে বসে।কোনো গুরুত্ব পায়নি আমার রাগী চাওনি।পা ছুড়ে বেরিয়ে এলাম রুম থেকে।নায়েব কাকা বললেন,
-চলো আহানিতা মা,অঙ্কুর বাবা যহন কইছে,তুমিই রান্না করবা,তোমারই রান্না করোন লাগবো আইজ!
-কিন্তু আমি তো….
-রান্না জানো না তাইতো?আরে এই বাসায় মস্ত মস্ত সব রাধুনি আছে!ওই কি জানি নাম?শাফ!শাফ!
-শেইফ?
-হ!হ!ওইডাই!ওরাই রান্না কইরা দিবো!আমি কমুনে অঙ্কুর বাবারে,তুমিই রান্না করছো!ওর মাথাব্যথা হইতাছে না?এক কাপ কফি দিলেই ওহনই ঘুমায়া পরবো ও!নিচে আসবো না আর!কে রান্না করলো হেইডাও বুঝবো না!
চোখ চকচক করে উঠলো আমার।খুশিমনেই কিচেনে আসলাম।কিচেনের যেপাশে স্টোভ বসানো,সেদিকটা ড্রয়িংরুমের সাথেই।ড্রয়িংরুম আর কিচেনের মাঝে ছোট দেয়ালের উপর স্টোভ।নায়েব কাকা ড্রয়িংয়ের এপাশেই অনেকটা দুরে দাড় করিয়ে দিলেন আমাকে।বললেন,
-তোমার রান্নাঘরে যাওন লাগবো না।এইহানেই থাকো!খালি দেইক্খা রাখো,ওরা কেমনে কি করে।যাতে অঙ্কুর বাবা কিছু জিগাইলে কইতে পারো।বুঝছো?
মাথা ঝাকিয়ে হ্যাঁ বুঝালাম।যাক!কিছুতো উপায় হলো!কুকিং এপ্রোন পরে দুজন শেফ কাটাকাটি করছিলেন কিছু।নায়েব কাকা ওনাদের কিছু বুঝিয়ে দিতেই তারা মাথা নাড়াতে লাগলো।শুরু হলো তাদের রান্না।বেশ আগ্রহ নিয়ে দেখছিলাম সবটা।তবে আগুন ছেড়ে দুরেই ছিলাম।আচমকাই একজন শেফের চুলোয় ধরে রাখা ফ্রায়িং প্যানের একদম উপরে আগুন ধরে গেলো।অনেকখানি জুরে উপরে উঠেছে আগুনটা।সাথেসাথেই কোনো এক বিস্ফোরনের দৃশ্য ভেসে উঠলো চোখের সামনে।আম্মু বলে চিৎকার করে মেঝেতে লুটিয়ে পরলাম।আবছা হয়ে আসলো চারপাশ।
.
জ্ঞান ফেরার পর ড্রয়িংরুমের মেঝেতেই খুজে পেলাম নিজেকে।মাথার নিচে কুশন দেওয়া।আশেপাশে তাকিয়ে শেইফ দুজন আর নায়েব কাকাকে দেখতে পেলাম।গলায় স্থেটোস্কোপ আর এপ্রোন পরিহিতা একজন মহিলাও আছেন।ডক্টর!আমার পাশেই হাটুগেরে বসে উনি।মাথাটা ধরে আস্তেধীরে উঠে বসলাম কোনোমতে।অঙ্কুরকে দেখলাম বুকে হাত গুজে অনেকটা দুরে চিন্তিতভাবে দাড়িয়ে আছেন।ডক্টর বললেন,
-এখন কেমন ফিল করছেন মিস আহানিতা?
-জ্বী,ঠিকাছি।তবে একটু ব্যাকপেইন হচ্ছে।
উনি অঙ্কুরের দিকে তাকিয়ে বললেন,
-আপনাকে বলেছিলাম মিস্টার অঙ্কুর, ওনাকে কোলে তুলে রুমে নিয়ে যেতে!দেখুন,মেঝেতে ছিলেন বলে ব্যাকপেইন হচ্ছে ওনার!
-উনিই বলেছেন ওনাকে স্পর্শ না করতে।
সরু চোখে তাকিয়ে রইলাম অঙ্কুরের দিকে।আমি অসুস্থ্য হয়ে পরেছি,আমার ওই দশাতে তার এই স্পর্শ না করার কথাটাই বড় হলো?ডক্টর ঠোট টিপে হাসলেন।তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
-আপনার অন্যকোনো….
-না!ঠিকাছি আমি!
উনি উঠে দাড়ালেন।এগিয়ে গিয়ে অঙ্কুরকে বললেন,
-আমি আসছি মিস্টার অঙ্কুর।আই হোপ,আপনার কাজে লাগতে পেরেছি!
-ইয়েস ডক্টর।থ্যাংক ইউ!
-মাই প্লেজার!
ডক্টর বেরিয়ে গেলেন।গলার ওড়না ঠিকঠাকমতো টেনে গায়ের ময়লা ঝেরে মেঝে থেকে উঠে দাড়াতে যাবো,অঙ্কুর দুটো কাগজ আমার কোলে ছুড়ে মারলেন।
-এটা কি?
-আপনার মেডিকেল রিপোর্ট!
-এটুকোর জন্য আবার মেডিকেল রিপোর্ট?আপনাকে না বলেছি,আমাকে নিয়ে না ভাবতে!আগুনে ফোবিয়া আছে আমার।তাই সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিলাম।আর কিছু না!
-এটা আগের রিপোর্ট!
একটু আশ্চর্য লাগলো।ভ্রুকুচকে বললাম,
-কবেকার?
-যেদিন আপনাকে এ বাসায় আনা হয়।সেদিনও তো সেন্সলেস ছিলেন আপনি।ওইদিনই কিছু টেস্ট আর চেকাপ করা হয়েছিলো আপনার।রিপোর্টগুলো আজই দিয়েছে ডক্টর।
ধপ করে গায়ে আগুন ধরে গেলো আমার।রিপোর্ট মেঝেতে ফেলে উঠে দাড়িয়ে বললাম,
-হাউ ডেয়ার ইউ?আমার অজ্ঞান হওয়ার সুযোগ নিয়ে আপনি চেকাপ করিয়ে ফেললেন আমার?টেস্টও করিয়েছেন?একবারও আমার অনুমতি….
-সেরোগেশনের আগে আপনার মেডিকেল হিস্ট্রি জানাটা জরুরি ছিলো।তাই…
-হোয়াট দ্যা হেল?কিসের মেডিকেল হিস্ট্রি?আমি তো কোনো সেরোগেশন করাবোই না!ইউ নো দ্যাট!আর….
এতোক্ষনে আমার দিকে ফিরলেন উনি।চোখদুটো রক্তিম হয়ে আছে তার।যা দেখেই থেমে গেলাম আমি।হাতদুটো মুঠো করে রেখেছেন।ফর্সা গলার রগগুলো জেগে উঠে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে।অঙ্কুর চোয়াল শক্ত করে বললেন,
-আপনি করাতে চাইলেও তা সম্ভব না মিস অদ্রি।কারন রিপোর্টে স্পষ্ট বলা,সেরোগেশনের জন্য ফিজিক্যালি রেডি নন আপনি!
আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো খুশিকে দিয়ে যদি সর্বোচ্চ আনন্দটাকে বোঝানো হয়,তবে আমি যেনো সেই আকাশের চাঁদটাকেই হাতে পেলাম।ভেতরটা আনন্দে নেচে উঠলো।মনপ্রান জুড়ে প্রশান্তি বয়ে গেলো আমার।ঠোটে খুশির হাসি।খুশিতে কি বলবো ভেবেই পাচ্ছি না।তবুও চকচকে চোখে অঙ্কুরের সামনে দাড়িয়ে বললাম,
-দ্ দেখেছেন?দেখেছেন মিস্টার অঙ্কুর?আ্ আমি…আমি ফিজিক্যালি ফিট নই সেরোগেশনের জন্য!ফিট নই!তারমানে আপনার বেবির জন্য সেরোগেট মাদার আমি হতে পারবো না!আমাকে আর আপনার শর্ত মানতে হবে না!এবার তাহলে আমাকে ছেড়ে দিন?যেতে দিন এখান থেকে?আমি তো….
-খুব তাড়াতাড়িই আমাদের বিয়ে হচ্ছে মিস অদ্রি!গেট ইউরসেল্ফ রেডি!
আমাকে শেষ করতে না দিয়েই কথাটা বললেন অঙ্কুর।কথাটা কর্নগোচর হয়ে কানে বাজতে লাগলো কয়েকবার।কথাটার মানে গোছাতে মস্তিষ্কের নিউরনগুলো বেশ অনেকটা সময় লাগিয়েছে।কিন্তু বুঝ আসতেই মাথায় আকাশ ভেঙে পরলো আমার।এটা কি শুনলাম আমি?ঠিক শুনলাম?এটাই বললেন অঙ্কুর?থমকে আছি যেনো।চারপাশও আটকে গেছে বলে মনে হচ্ছে।অত্যন্ত শান্তভাবে এটুক বলে সিড়ি বেয়ে উপরে চলে গেলেন অঙ্কুর।ধপ করে আবারো মেঝেতে বসে পরলাম।আবার কি ঘটতে চলেছে আমার জীবনে?বিয়ের কথা করনো বললেন অঙ্কুর?ঠিক কি করতে চাইছেন উনি?
#চলবে…
[