#এক_রক্তিম_ভোর
#প্রভা_আফরিন
#পর্ব_১৫
পুরো এক সপ্তাহ নাবিলা প্রয়াসকে এড়িয়ে চলেছে। ওকে কষ্ট দেওয়া, জেলাসি ফিল করানোর ফল হিসেবে দূরে থেকেছে। সকাল সকাল ক্যাম্পাসে চলে গেছে এবং দুপুরে ফিরে আবার বাবার অফিসে বসেছে। তারেক হোসেন নাবিলাকে একজন সাধারন নতুন কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। সেখানে পার্ট টাইম কাজ শিখছে। পুরোপুরি শিখে গেলে তারেক হোসেন নাবিলাকে বেতনভুক্ত কর্মচারী বানাবেন।
নাবিলাদের দুইটা গাড়ি থাকা সত্ত্বেও ওকে রিক্সা কিংবা বাসে করে চলাফেরা শিখিয়েছেন তারেক হোসেন। তিনি আর পাঁচটা বড়লোক সন্তানের মতো নাবিলাকে বড় করেননি। জীবনে সবকিছু না চাইতে পাওয়া গেলে তার কদর থাকে না। কিংবা কোনোকিছু পাওয়ার তীব্র আশা, আকাঙ্ক্ষা ধারন করে সেই লক্ষ্য পর্যন্ত পৌছানোর জন্য পরিশ্রম না করলে তার মর্ম থাকে না।
জীবন একটা সংগ্রাম। কারো ক্ষেত্রে বেঁচে থাকার সংগ্রাম, কারো ক্ষেত্রে ভালো থাকার, নিজের মনের সাথে সংগ্রাম আবার কখনো শরীরের জন্য। এখানে সব ক্ষেত্রে টিকে থাকতে লড়াই করা শেখা উচিৎ। কেননা অবস্থার পরিবর্তন কেবল সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। তাই আরাম ছেড়ে বেরিয়ে পৃথিবীর প্রকৃত স্বাদ গ্রহন করা উচিৎ। নাবিলা সেভাবেই থেকেছে সবসময়। যদিও দাদির আশকারায় মাঝে মাঝে মাথায় উঠে যেত। এবার সে বাস্তবিক লড়াইয়ের মাঠে নামতে চায়। তারেক হোসেন মেয়ের সিদ্ধান্তে খুব খুশি।
নাবিলা বিকেলের শেষ ভাগে বাড়ি ফিরে একবার বারান্দায় ঢু মারলো। প্রয়াস ওর বারান্দায় তখন গম্ভীর চোখে তাকিয়ে ছিলো। প্রয়াসের এমন চাহনির মানে জানে নাবিলা। রাতের বেলা বারান্দার দরজাটাও ভালো করে লাগিয়ে ঘুমায় নাবিলা। যার ফলে প্রয়াসের মন, চোখ সব ক্লান্ত, তৃষ্ণার্ত। প্রয়াস ভেবে পাচ্ছে না নাবিলা কেনো এমন হয়ে গেলো হুট করে। কেয়ারলেস একটা মেয়ে হুট করেই দায়িত্বজ্ঞান সম্পন্ন হয়ে উঠেছে। অবশ্য প্রয়াস এমনই চাইতো তবে এখন মনে হচ্ছে সেই কেয়ারলেস নাবিলাই ভালো ছিলো। নাবিলা চোরের মতো চলে যেতে নিতেই প্রয়াস বললো,
‘অমাবস্যার চাঁদ হয়ে গেছিস। আজকাল দেখাই পাওয়া যায় না।’
‘হ্যাঁ। দায়িত্ব নেওয়া শিখছি। তুমিই না বলেছিলে আমাকে আরো স্ট্রং হতে হবে। ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে হবে। তাই করছি।’
‘দায়িত্ব মাই ফুট। আমিও তো কাজ করছি তাই বলে ব্যাক্তিগত জীবন ভাসিয়ে দিয়েছি নাকি?’
নাবিলা ঠোট টিপে হাসলো।
‘ব্যাক্তিগত জীবন কোথায় ভাসিয়ে দিলাম। আমিতো দুপুর পর্যন্ত বেশ ভালোই সময় কাটাই বন্ধুদের সাথে। তারপর একটু অফিসের কাজে মন দেই।’
প্রয়াস তাচ্ছিল্য করে বললো,
‘আচ্ছা! আজকাল ভার্সিটি, বন্ধু এতো প্রিয় হয়ে উঠেছে বুঝি! বাড়ির মানুষদের সাথে একটু সময় কাটানো যায়না? ছাদে ওঠা যায়না? জেসি একা একটা মেয়ে বাড়িতে আছে। ওকে একটু সময় দেওয়া যায় না?’
‘আমিতো সবার সাথেই সময় কাটাই। তুমি জিজ্ঞেস করে দেখতে পারো। জেসি আপুর সাথে প্রতিদিনই কথা হয়। তাছাড়া তুমিতো আছোই। জেসি আপুর জন্য তুমিই যথেষ্ট।’
প্রয়াসের রাগ মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। তারমানে ও ছাড়া বাকি সবার সাথে কথা বলার সময় হচ্ছে নাবিলার। ওকে পাত্তাই দিচ্ছে না! মেয়েটা এতো নিষ্ঠুর হলো কিভাবে? জেসিকে নিয়ে জেলাসও ফিল করছে না।
প্রয়াসের রাগী মুখ দেখে নাবিলা নিজে থেকেই বললো,
‘কফি খাবে?’
‘তোর কফি তুই খা।’
প্রয়াস বারান্দা ত্যাগ করলো। নাবিলা বুঝলো একটু বেশিই হয়ে গেছে বোধহয়। এবার কিছুটা দূরত্ব ঘোচাতে হবে। কিন্তু এতো সহজে ধরা দেবে না।
__________
ক্রমশ গাঢ় হতে থাকা আধারে কফি হাতে দাঁড়িয়ে আছে প্রয়াস-নাবিলা। তবে আধার ওদের স্পর্শ করতে পারেনি। ছাদের একপাশে জ্বলা টিমটিমে সাদা বাল্বটা ওদের চারপাশে অল্পবিস্তর আলোময় করে তুলেছে। রেলিঙের ওপর একটা কফি মগের ধোঁয়া অবহেলায় উড়ে চলেছে। দুজনের দৃষ্টি অন্তরীক্ষে নিবদ্ধ।
নাবিলার ঠোঁটের কোনে এক প্রশান্তিময়, অনুভূতিময় হাসি। হাতে কফি মগ। ধুসর ঘোলাটে আকাশ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নাবিলা প্রয়াসের দিকে তাকালো। এখনো কফিতে চুমুক দেয়নি লোকটা। রামগরুড়ের ছানার মতো মুখ করে আছে। সেই মুখ অভিমানে টইটম্বুর। নাবিলা প্রয়াসের মনোযোগ পেতে শব্দ করে চুমুক বসালো মগে। প্রয়াস আগের মতোই রইলো।
‘তোমার সাথে থেকে থেকে এই জঘন্য তেতো কফি কবে যে প্রিয় হয়ে উঠলো বুঝলামই না।’
প্রয়াস তখনো নির্বিকার।
‘হ্যা আর আমি অপ্রিয় হয়ে উঠছি।’ মনে মনে ভাবলো প্রয়াস।
নাবিলা এবার তীক্ষ্ণ গলায় বললো,
‘কফি কি খাবে নাকি গরমটাই মুখে ঢেলে দেবো।’
প্রয়াস এবার ভ্রুবিলাস করে ওর দিকে তাকালো। গমগমে কন্ঠে বলে উঠলো,
‘দায়িত্বের সাথে সাথে তোর সাহসটাও একটু বেশিই বেড়ে যাচ্ছে না? তুই আমাকে ধমকাচ্ছিস?’
‘ইয়ে মানে রাগ করছো কেনো? আমিতো তোমার মৌনব্রত ভাঙার জন্য বললাম। হে হে।’
প্রয়াস আগের চেয়ে দৃঢ় গলায় বললো,
‘হাসি পাচ্ছে না! খুব হাসি পাচ্ছে! একসপ্তাহ উধাও থেকে আজ মানবসেবা করে কফি দিতে আসছে। লাগবে না তোর কফি। জেসি এর থেকে ভালো কফি বানায়। আজকাল তোর বারান্দার দরজাও বন্ধ থাকে দেখছি। আগেতো খোলা রাখতি।খুব কেয়ারফুল হয়ে গেছিস।’
নাবিলা হাসি চেপে বললো,
‘রাতে তো বন্ধ করাই উচিৎ তাইনা! যদি আবার বারান্দা টপকে চোর আসে। আমারতো ভুলেও ঘুম ভাঙবে না। বাই দ্যা ওয়ে বারান্দা বন্ধ রাখার সাথে তোমার রাগের কি সম্পর্ক? হুম?’
নাবিলা ভ্রু নাচালো।
প্রয়াস কিছুটা হকচকিয়ে গেলেও প্রকাশ করলো না। বললো,
‘ রাগের সম্পর্ক হবে কেনো? আগে খোলা দেখতাম তাই বললাম। নাথিং এলস।’
তারপর অন্যদিকে ফিরে বিড়বিড় করে বললো,
‘ এতো কেয়ারফুল হতে কে বলেছে। আমি কি মরে গেছি নাকি! ওই বারান্দায় কেউ পা দেওয়াতো দূর চোখ তুলে তাকালেই বৃন্দাবন দেখিয়ে দেবো।’
নাবিলা শুনেও না শোনার ভান করলো। অনুনয়ের সুরে বললো,
‘বলছি কি সারাদিনতো অনেক ধকল গেলো। তারপর বাড়ি ফিরে কফি বানালাম। আমার এই কষ্টের কি কোনো মূল্যায়ন করবে না? কফিটা খাবে না? এখন থেকে প্রতিদিন সন্ধ্যায় কফি করে দেবো প্রমিস।’
প্রয়াস এক ভ্রু উঁচিয়ে তাকালো। নাবিলা আদতেও কথাটা মানবে কিনা বুঝতে চাইছে।
‘ সত্যি প্রমিস। আমার বিয়ে হয়ে গেলেও শশুর বাড়ি থেকে এসে কফি বানিয়ে দিয়ে যাবো সত্যি। ওহহ! আমার আগে তো তোমার বিয়ে হবে এবার। সমস্যা নেই ভাবী থাকলেও আমিই কফি করে দেবো।’
প্রয়াসের ঠিক হতে থাকা মেজাজ টা আবার চটকে গেলো। এই মেয়ে হুট করে এমন বাদর কিভাবে হলো! ডান হাতটা বাড়িয়ে নাবিলার দুই গাল চেপে ধরলো প্রয়াস। কিছুটা ঝুকে দাতে দাত চেপে বললো,
‘আমার দশটা বাচ্চা হলেও তোকেই কফি করে দিতে হবে। বুঝলি?’
প্রয়াসের এহেন আচরনে নাবিলা কিছুটা ভরকে গেলো। প্রয়াসকে এড়িয়ে চলার একটা কারন হলো লজ্জা। নাবিলা যতই সাহস দেখাবার চেষ্টা করুক না কেনো, ভেতরে ভেতরে এই মানুষটার সামনে এলে লজ্জারা ঘিরে ধরে চারপাশ থেকে। তারা দুজনই দুজনের মনের খবর জানে। কিন্তু অপরজনকে জানাতে নারাজ। প্রয়াসের মনের খবর জেনে নাবিলা কিছুতেই আগে জানাবে না। তাই ঠিক করে নিয়েছে যতদিন না প্রয়াস নিজের মুখে শিকার করছে অনুভূতির কথা, নাবিলা জ্বালিয়েই যাবে অনবরত।
__________
জেসি মামা বাড়ির মানুষদের সাথে যোগাযোগ করেছে। অনেকবছর হলো মামা বাড়ি যাওয়া হয়না জেসির। যদিও ওর মা বছর দুয়েক পর পরই আসেন। জেসির দেশে আসার সুবাদে ওর মা ও দেশে ফিরছেন। তারা মা-মেয়ে মামা বাড়িতে থাকবে কিছুদিন। সেই নিয়েই খাবার টেবিলে কথা হচ্ছিলো। নাবিলাদের খাবার টেবিলে আড্ডা একদম জমে উঠেছে। জেসি সবাইকে জানালো সে সবাইকে খুব মনে করবে প্রয়াসের দিকে তাকিয়ে বললো,
‘তোমাকেও খুব মিস করবো প্রয়াস। তবে শেষের দিনগুলো এখানে থাকবো কিন্তু। এর মধ্যে বিয়ে নিয়ে ভাবো বুঝলে।’
প্রয়াস শুধু হেসে আড়চোখে নাবিলার দিকে তাকিয়ে ওর প্রতিক্রিয়া দেখতে চাইলো। নাবিলা হাসি হাসি মুখেই খাবার খাচ্ছে। সায়মা বেগম ওদের কথা শুনে ভেবে নিলেন প্রয়াস এবং জেসির মধ্যে হয়তো কিছু আছে। হয়তো ওরা এখন বিয়ে নিয়ে ভাবছে। তাই জেসির মা আসছেন।
নাবিলা প্রয়াসের সামনেই বসে ছিলো। জেসির কথা শুনে দাত কেলিয়ে বললো,
‘একটা কাজ করো আপু। ভাইয়াকেও সাথে নিয়ে যাও। তাহলে একসাথে ঘোরাঘুরি করতে পারবে আর মিসও করতে হবে না।’
নাবিলার কথায় প্রয়াস এবং জেসি একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলো। প্রয়াসের ঠান্ডা মেজাজ খিচে উঠলো মুহূর্তেই। যেই মেয়েকে জেলাস করাতে এতোকিছু সেই নাকি বলছে তাকে সাথে নিয়ে যেতে! প্রয়াসের মনে অন্য ভাবনা ঢুকে গেলো। নাবিলার মন হয়তো প্রয়াসের ওপর থেকে সরে যাচ্ছে। অনুভূতি বিলীন হয়ে যাচ্ছে। হয়তো ভাবছে জেসি আর প্রয়াস আসলেই দুজন দুজনকে ভালোবাসে। তাহলে তো সর্বনাশ! প্রয়াস ক্ষুব্ধ চোখে নাবিলার দিকে তাকিয়ে রইলো। নাহ। আর দেরি করা ঠিক হবে না। নাহলে এই মেয়ে উড়াল দেবে।
ঘুমানোর সময় বারান্দার দরজাটা খোলা রাখলো নাবিলা। পুরো সপ্তাহ ইচ্ছে করেই বন্ধ করে রেখেছিলো। বেডসাইট টেবিল থেকে পানির গ্লাস নিয়ে দুই ঢোক পানি খেলো। তারপর আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লো। শেষ রাতে হঠাৎই ধুপ করে একটা শব্দ হলো বারান্দায়। নাবিলার ঘুম ভেঙে গেলো। মুচকি হেসে ঘাপটি মেরে রইলো সে।
চলবে…