#বৃষ্টি_ভেজা_গোলাপ
#পর্ব_১৮
#নবনী_নীলা
আহান রুহিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে। রুহি নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে প্রচুর চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। রাগে পুরো গা জ্বলে যাচ্ছে রুহির।
” দেখুন আপনি আমায় ছাড়ুন বলছি নইলে একটা কামড় বসিয়ে দিবো বলে রাখলাম। আপনি আমাকে চিনেন না।”, শাসিয়ে বললো রুহি।
” তোমার কামড়ে আমি ভয় পাই? মোটেও না। আর কামড় কি তুমি একাই দিতে পারো নাকি?”, মুখ দিয়ে রুহির ঘাড়ের চুল গুলো সরিয়ে দিতেই রুহির গা শিউরে উঠলো। রুহি চোখ বন্ধ করে ফেললো। তারপর দাতে দাত চিপে বললো,” অসভ্যতা করবেন না। বলার সময় তো বলেন তোমার প্রতি অ্যামার কোনো ইন্টারেস্ট নেই। তাহলে এখন এসব কি করছেন?”
” ইন্টারেস্ট নেই বলেই তোমাকে ছেড়ে দিচ্ছি, থাকলে তো তোমাকে ..”, বাকিটা বলার আগেই রুহি কটমট করে তাকালো তারপর চোখ রাঙিয়ে বললো,” মুখ সামলে কথা বলুন। ছাড়ুন আমকে, ছাড়ুন। আমি ঘুমাবো।”
” শুয়েই তো আছো ঘুমিয়ে পড়।”, বলে জড়িয়ে রাখলো রুহিকে।
” মানে কি? ছাড়ুন বলছি। আমি কি এভাবে ঘুমাবো আপনার সাথে?”,
” এবার তাহলে বুঝো ঘুমে মাঝে জড়িয়ে ধরে তুমি আমার কত রাতের ঘুম নষ্ট করেছো। আজ তোমায় আমি ছাড়বো না। ঘুম নষ্ট হলে হবে। মনে রাখবে Tit for Tat.”,
রুহি পুরো ভেবাচেকা খেয়ে গেলো। এটা আবার কেমন লজিক! কি এক মহা মুশকিলে পড়া গেছে। রুহি আরো কত ভাবে চেষ্টা করলো কিন্তু আহান তাকে ছাড়লো না। শেষমেশ ক্লান্ত হয়ে আহানের বাহুতে ঘুমিয়ে পড়ল রুহি।
______
সকালের দিকে রুহির প্রচন্ড জ্বর এলো। রুহিকে জড়িয়ে ধরে রাখায় তার গায়ের তাপটা বুঝতে পারে আহান। রুহির মাথায় হাত দিয়ে দেখে আহান, বুঝতে বাকি রইলো না জ্বর এসেছে। রুহিকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে চাইলো আহান কিন্তু নানি কিছুতেই দিলো না। কারণ এটা সাধারণ, রুহি রাতে গোসল করলে জর আসে আবার দুপুরের দিকে জ্বর চলে যায়। আহান কিছুতেই মানছিল না সে হসপিটালে নিয়েই যাবো পরে নানী বললো দুপুরের দিকে জ্বর না কমলে তখন নিয়ে যেতে। নানী রুহিকে খাবার খাইয়ে ওষুধ দিয়ে দিয়েছে। রুহি আরামে ঘুমাচ্ছে।
আহান একবারের জন্যও ঘর থেকে বের হয় নি জ্বর আপাদত ১০২° আছে তাই চিন্তা কিছুতেই কমছে না তার। আহান রুহির মাথার কাছে বসে রইলো। রুহির ঘুমিয়ে থাকা চেহারাটা দেখছে সে। জ্বরে হয়তো অনেক কষ্ট পাচ্ছে। আহান বসে থেকে রুহির পুরো ঘরটা দেখতে লাগলো কাল ঠিক ভালোভাবে দেখা হয় নি। এদিক সেদিক তাকাতে গিয়ে রুহির টেবিলের একটা ডায়রির দিকে চোখ আটকে গেলো আহানের। মনে হচ্ছে রুহির লেখা ডায়রি। কৌতূহল সামলাতে না পেরে সে ডায়রিটা হাতে নিয়ে রুহির মাথার পাশে এসে বসলো।
পাতা উল্টাতে উল্টাতে হটাৎ একটা লেখা চোখে পড়লো,
✓ছোটো বেলায় কেনো জানি না আমার হাবিলদার হবার শখ ছিল। হাবিলদার জিনিসটা কি সেটা আমি বুঝতাম না তবে হাফ প্যান্ট আর শার্ট পরে তাদের ওভাবে হাঁটতে দেখলে আমার খুব আনন্দ হতো, সেখান থেকেই ইচ্ছে জেগেছিল হাফ প্যান্ট পরা হাবিলদার হবো আমি। যদিও সেই ইচ্ছে আমার অনেক আগেই ঘুচে গেছে।
আহান চোখ বন্ধ করে হেসে ফেললো। মেয়েটা সত্যিই অদ্ভুত। আহান ডায়রির পাতা উল্টাতে উল্টাতে থমকে গেলো একটি পাতায়।
✓আমার জন্ম! আমি জানি না আমার পৃথিবীতে আসাটা আশীর্বাদ নাকি অভিশাপ। জীবনের সবচেয়ে কঠিন সত্য জানার আগ পর্যন্ত আমার জীবনটা আমার কাছে আশীর্বাদ ছিলো। আমার তখন আঠারো বছর বয়স নানী রুমে ডেকে নিয়ে আমাকে আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন সত্যটা বললো।
মা বাবা কি সেটা আমি আমার নানী আর নানা কে পেয়ে বুঝেছি। কারণ মা বাবার ভালোবাসার ভাগ্য নিয়ে আমি হয়তো এই পৃথিবীতে আসিনি। জন্মের পর নিজের মায়ের মুখ দেখিনি আর বাবা? সে বেচেঁ আছে কিনা জানা নেই। বেচেঁ থাকলেও কোথায় আছে কেমন আছে জানি না। ছোট বেলায় যখন মা বাবার কথা জানতে চাইতাম তখনই নানী কথা ঘুরিয়ে ফেলতো আমি অন্য এক কষ্ট নিয়ে বড়ো হচ্ছিলাম। আমার কষ্টের পাল্লা আরো ভারী হলো যখন আমি জানতে পারলাম আমার মা আমাকে জন্ম দিয়েই আত্নহত্যার পথ বেছে নিয়েছিল। সব কিছু আমার থমকে গিয়েছিল এই কথাটায়। আমার মা…
খুব অভিমান হয়েছিলো তার উপর, আমার জন্য কি তার একটুও ভালোবাসা ছিলো না। যদি সে আমার জন্য বেচেঁ থাকতো।
কেনো আমার মায়ের এই পরিণতি তা শুনে নিজেকে সামলে রাখতে পারিনি সেদিন।
বাবা আর মায়ের বিয়ে অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ ছিলো। বাবা বলতেও ইচ্ছেও করছে না তাকে। আমার দাদু জোর করে মায়ের সাথে তার ছেলের বিয়ে দিয়ে দেন। কিন্তু দাদু জানতেন না তার ছেলের অন্য কারোর সাথে সম্পর্ক।আমার মা খুব ভালো একটা মানুষ ছিলেন, রুপ ও তার কম ছিলো না। বাবা আস্তে আস্তে মাকে ভালোবেসে ফেলে কিন্তু সেই ভালোবাসা আমার দাদুর মৃত্যুর সাথে সাথে মরে যায়। দাদুর ছেলে আবার সেই আগের মেয়েটির কাছে ফিরে যায়। আমার মাকে বাধ্য করে তাকে ডিভোর্স দিয়ে দিতে। শত কষ্টের পরও আমার মা সেটা দিয়েও দিলেন। তখন তিনি জানতেন না তার মধ্যে এই নতুন জীবনটি বেড়ে উঠছে তারপর ডিভোর্সের কয়েকমাস পর যখন পাড়া প্রতিবেশী মায়ের শারীরিক অবস্থার পরিবর্তন দেখলো তারা নানা কথা বলতে লাগলো। তারা কি বলতো আমি জানি না তবে নানির চোঁখের পানি দেখে কথাগুলোর ভার আমি একটু হলেও বুঝেছি। সে সব অপমান আমার মা সহ্য করতে পারিনি তাই আমাকে পৃথিবীর আলো দেখিয়ে তিনি অন্ধকারে চোখ বুজলেন।
হটাৎ আজ এই কথা গুলো লিখতে বসেছি কারণ কাল আমার বিয়ে, যদিও বিয়ে জিনিসটার প্রতি আমার কোনো কালেও কোনো আগ্রহ ছিলো না। শুধু নানীর কথা রাখতে করা বিয়েটা। আজ সকালে একজন লয়ার বাসায় এসেছে। নানি আর নানা ব্যাস্ত ছিলেন। যে লয়ার এসেছে তাকে আমার হবু বর, (যেই হোক, ওই লোকটা পাঠিয়েছে। বর নামক ঐ হুতুম পেঁচা আমার ঘাড়ে বসবে কালকে থেকে ভেবেই রাগ উঠছে)
লাইনটা পরে আহান ভ্রু কুঁচকে একবার রুহির দিকে তাকালো। তারপর মাথায় হাত দিয়ে দেখলো জর কমেছে কিনা। অনেকটা কমেছে। আহান আবার ডাইরীর পাতায় ফিরে গেলো।
√ সাত মাসের একটা কন্ট্রাক্ট নিয়ে এসেছে। এক মাস থাকার পর ডিভোর্স চায় সে আর আইন অনুযায়ী এতো অল্প সময় একসাথে থেকে ডিভোর্স নেওয়া যায় না তাই তারা ছয় মাস একসাথে থাকতে বলবে তারা, তাই সব মিলিয়ে সাত মাস। বিয়েটা আমি এই কারনে ভেঙ্গে দিতেই পারতাম। আমিও মুক্তি পেতাম, কাজটা করিনি শুধু তার দিদার জন্য। আমি চাই জীবনের শেষ সময়টুকু তিনি ভালো থাকুক। আমার কেনো জানি মনে হচ্ছে আমি আমার মায়ের পথ বেছে নিয়েছি। পার্থক্য শুধু একটাই, মা না জেনে ভুল করেছিলো কিন্তু আমি জেনে শুনে ভুল করছি।
কিন্তু আমার বিশ্বাস আমার পরিণতি কখনোই আমার মায়ের মত হবে না।
আমার আকাশটা আজ মেঘলা, কিন্তু মেঘলা আকাশটাকে আমি আর ভয় পাই না।
আহান এতটুকু পরে কিছুক্ষণ থমকে যায়। চুপ হয়ে যায় সে। নিজেকে কেনো জানি তার অপরাধীর মতন লাগছে। ডায়রিটা বন্ধ করে একটা নিশ্বাস ছেড়ে রুহির দিকে তাকিয়ে রইলো। কতটা কষ্ট বুকে চেপে বড় হয়েছে সে। আহানের কাছে তো বাবা ছিলো রুহির কাছে কেউ ছিলো না। রুহির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো আহান। তারপর কাছে গিয়ে কপালে অধর ছুয়ে দিলো আহান। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে, ডায়রির পাতাটা খুলতে গিয়ে সামনে পড়লো অন্য একটি পাতা।
✓ সেদিন রাতে বাড়ি ফিরছিলাম। কলেজের পর টিউশনের কারনে রাত হয়। নুড়ি থাকে প্রতিদিন আমার সাথে কিন্তু সেদিন নুড়ি কলেজে যায় নি। আমি একাই বাড়ি ফিরছিলাম, চারিদিকটা সেদিন কেনো জানি অন্ধকার আর থমথমে ছিলো। হটাৎ নিবিড় আর তার বন্ধুরা আমার সামনে এসে আমার পথ আটকে দাড়ালো। নিবিড় গতো দু বছর ধরে আমার পিছু নিয়েছে। বিড়ি সিগারেট খায়, চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দেয়, দুর্নীতি করে বেড়ায়। জানি না কোন কপালে আমি তার চোখে পড়েছি। যদিও সেদিনের আগ পর্যন্ত নিবিড় কোনোদিন আমাকে অসম্মান করে নি। তবে আমার পিছু পিছু কলেজে টিউশনে গিয়ে দাড়িয়ে থাকতো। সেদিন হটাৎ আমার সামনে এসে দাড়াতেই আমি ভয় পেয়ে গেলাম কারণ সাথে নুড়ি ছিলো না। রাস্তা ফাঁকা আশেপাশে কেউ নেই।
মুখের থেকে সিগারেট ফেলে দিয়ে পা দিয়ে সেটা চাপলো নিবিড় তারপর আস্তে আস্তে আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। ভয়ে আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেলো। জীবনে এমন কিছুর মুখোমুখি হতে হবে সেটা আমি দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি। আমায় হাত ধরে জোড় করে তুলে নিয়ে যেতেই আমি গলা ফাটিয়ে চিৎকার করেছি কারোর কান পর্যন্ত হয়তো পৌঁছানোর আগেই ওরা আমার মুখ আর হাত বেধে দিলো তারপর টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছিল। নিজেকে বাঁচানোর শেষ চেষ্টা করে আমি হাত ছাড়িয়ে ছুটে দৌড়াতে থাকি। দৌড়াতে দৌড়াতে হটাৎ রাস্তার পাশে একজনের বাইক দেখতে পাই। হেলমেট পরা এক যুবক নামছে বাইক থেকে আমি দৌড়ে গিয়ে ছেলেটার পিছনে লুকিয়ে পরি। এতো রাতে মুখ হাত বাঁধা কোনো মেয়েকে দেখলে হয়তো যে কেউ পালিয়ে যেতো, ছেলেটি সেটা করে নি। ব্যাস্ত হয়ে আমার হাত আর মূখের বাঁধন খুলে দিলো। কিছু বলে উঠার আগেই নিবিড় আর তার বন্ধুরা এসে হাজির। আমার ভয়ের মাত্রা বাড়তেই আমি ছেলেটার পিঠের শার্ট শক্ত করে চেপে ধরে দাড়াই।
” শোন ওকে আমি বিয়ে করবো। তাই তুইকোনো ঝামেলা না করে চলে যান।”, হুমকি দিয়ে কথাটা বললো কি নিবিড়। নিবিড়ের কথায় শুনে ভয় পেয়ে আমি ভেবেছিলাম সত্যিই যদি এই ছেলে চলে যায় তাহলে তার কি হবে। কিন্তু ছেলেটা যায় নি। নিবিড় আমার কাছে এসে হাত ধরতে চাইলো তখনি ছেলেটা নিবিড়ের পেটে জোড়ে লাথি মারলো নিবিড় মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে গেল সেটা দেখে নিবিড়ের বাকি বন্ধুগুলো ভয় পেয়ে পালিয়ে যায়। ছেলেটা নিবিড়ের কলার চেপে ধরে টেনে উপড়ে তুলে মুখে ঘুষি দিতে লাগলো। বেহাল অবস্থা হয়ে গেলো নিবিরের তবু ছেলেটার দিকে হাত তুলতে এগিয়ে আসতেই ছেলেটা হাত ধরে পিছনে নিয়ে লক করে বললো,” আজ তোর বিয়ে করার শখ সারাজীবনের মতো ঘুচে দিবো। মেয়েদের টিজ করতে খুব ভালো লাগে তাই না। নেক্সট টাইমে আমার সামনে পড়লে এমন হাল করবো উঠে দাড়াতে পর্যন্তও পারবি না।”, বলে ছেড়ে দিতেই নিবিড় খোঁড়াতে খোঁড়াতে পালিয়ে গেল।
নিজের কাছে সেদিন ছেলেটাকে নিরাপদ আশ্রয়ের মতন লেগেছিলো। ছুটে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে কাদতে লাগলাম। ছেলেটা কিছু বলে নি, ছেলেটার শার্ট ভিজিয়ে দিয়ে ছিলাম কেঁদে কেঁদে, মারামারির আওয়াজ পেয়ে চারপাশের মানুষ ছুটে আসতে লাগলো নানা ভাই আমাকে দেখে ছুটে এলো। এতো ভিড়ের মাঝে হটাৎ কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সেই অচেনা মানুষটা বাইকে করে চলে যায়। জীবনে প্রথম কোন ছেলে আমার মনে ছাপ ফেলে দিয়েছে। জানি না সে কেমন দেখতে, সে কোথায় থাকে কিন্তু নিজের আশ্রয় পেয়েছিলাম আমি তার মাঝে। এটি আমার জীবনে এমন একটা মুহূর্ত যা আমি কোনোদিন ভুলবো না।
অনেক খুঁজেছি আমি তাকে কিন্তু ধন্যবাদ দেওয়ার সুযোগটাও আমি পাই নি। সেই চোখ দুটো আর বাইকের নম্বরটা আমি আজও ভুলিনি ১২ – ১৮২৩।
#বৃষ্টি_ভেজা_গোলাপ
#পর্ব_১৯
#নবনী_নীলা
রুহি ঘুমের মাঝে নড়াচড়া করতে লাগলো। রুহির ঘুম ভেঙে গেছে ভেবে আহান তাড়াতাড়ি ডায়রিটা টেবিলে রেখে আসলো। মহারানী উঠে দেখলেতো হয়েছে কাজ। ডায়রীর শেষের কথাগুলো আহানের মোটেও ভালো লাগে নি। বাইকের নাম্বরটা আবার দেখতে হবে তাকে, বাইকটার মালিক কে? আর রুহি কি সেই ছেলেটিকে ভালোবাসে? ভেবেই আহানের পুরো শরীরে জ্বালা করছে। এভাবে না দেখে না চিনে ভালোবাসে ফেলবে? আহানের সাথে এতদিন আছে ভালোবাসা তো দূরে থাক ঝগড়া ছাড়া তো কথাই বলে না। আহান দাতে দাঁত চেপে রাগ কমাচ্ছে। ছেলেটার সাথে যদি তার চোখের মিল থাকে তাহলে কি সে নিজেই কোনোদিন…. বাকিটা ভাবার আগে রুহি ঘুম ঘুম চোখে উঠে বসলো।
বেশিক্ষণ ঘুমানোর কারণে চোখ ফুলে আছে রুহির। আহান এগিয়ে গিয়ে রুহির মাথায় হাত দিতেই রুহি ঘুম ঘুম চোখে আহানের দিকে তাকালো।
রুহির আপাদত জ্বর নেই। আহান রুহির পাশে বসে রুহির দিকে তাকিয়ে আছে। একদম ভদ্র বাচ্চার মতন বসে আছে রুহি। কিছুক্ষণ চুপ থেকে রুহি আহানের দিকে তাকিয়ে বললো,” আমি এতক্ষণ ঘুমিয়েছি কেনো?”
” কারণ তোমার জ্বর।”, বলে রুহির গালের পাশে ঝুলে থাকা চুলগুলো কানের কাছে গুজে দিলো।
রুহি হাত দিয়ে নিজের মাথা ধরে দেখলো জ্বর আছে কিনা। নাহ্ এখন নেই। কিন্তু নিজের হাতের দিকে তাকাতেই কনুইয়ে ব্যান্ডেজ দেখে প্রশ্ন সূচক দৃষ্টিতে আহানের দিকে তাকালো।
আহান রুহিকে তাড়া দিয়ে বললো,” উঠো গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নেও ভালো লাগবে। দুপুর গড়িয়ে এসেছে।”
” এইটা আপনি করেছেন?”, আহানের বলা কথাটাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে জিজ্ঞেস করলো রুহি।
” হ্যা, কেনো কি হয়েছে?”,
” আপনার মনে হচ্ছে না আপনি আমার প্রতি একটু বেশি ভালো ব্যাবহার দেখাচ্ছেন?”, আড় চোখে তাকিয়ে বললো রুহি।
” মানে!”, ভ্রূ কুচকে প্রশ্ন করলো আহান।
” মানে? ভুলে গেলেন প্রথম দিন কি করেছিলেন আমার সাথে। পানি ঢেলে ঘুম থেকে তুলেছেন, রুম থেকে বেড়িয়ে যেতে বলেছেন। সেই আপনি এখন সেবা করছেন। ব্যাপারটা ঠিক হজম হচ্ছে না, আপনার মতলবটা কি বলুন তো। নিশ্চই কোনো বড় মতলব আছে আপনার!”, সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল রুহি।
” হুম তা তো আছেই।”, বলে বাঁকা হাসি দিয়ে রুহিকে ভয় দেখলো আহান।
রুহি চোখ বড় বড় করে প্রশ্ন করলো,” কি মতলব বলুন তো?”
রুহিকে ভরকে দিয়ে আহান বললো,” দিদা একটা আবদার করেছে। নাতি হিসেবে সেটা যেমন আমার পূরণ করার দায়িত্ব আছে তেমনি নাত বউ হিসেবে তোমারও আছে।”
” আপনি কথা ঘুরাচ্ছেন কেনো? আপনি তো কথা ঘুরিয়ে বলেন না কখনো, সত্যি করে বলুন তো।”, সন্দেহের চোখে বললো রুহি।
” হুম, আমি তোমাকে পরে বুঝিয়ে বলবো আগে তুমি ফ্রেশ হয়ে এসো।”, বলেই উঠে দাঁড়ালো আহান।
” নাহ্, আপনি এক্ষণ বলবেন। বলুন বলছি।”, শাসিয়ে বললো রুহি।
” জ্বি না। আমি এখন বলছিনা। যাও তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হও।”, বলে আহান বেরিয়ে গেলো রুম থেকে।
রুহি পরে গেলো মহা চিন্তায়। কি এমন আবদার করেছে যার জন্য এই কুম্ভকর্ণ তাকে এতো তেল মালিশ করছে। রুহি চিন্তায় চিন্তায় ফ্রেশ হতে গেলো। শেষে একেবারে গোসল সেরে তোয়ালে মাথায় পেঁচিয়ে বের হলো রুহি। আহান ডায়রিটা খুলতে যাচ্ছিলো ওয়াশরুমের দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে আহান শুধু ঐ বাইকের নম্বরটার ছবি তুলে নেয়। তারপর চুপচাপ বিছানায় বসে মোবাইলের দিকে তাকিয়ে আছে। রুহিকে মাথায় তোয়ালে পেঁচিয়ে রাখায় আহান ভ্রু কুচকে বললো,” মাথায় তোয়ালে পেঁচিয়েছো কেনো?”
রুহি ভ্রু কুঁচকে আহানের দিকে তাকালো। তারপর মাথার থেকে তোয়ালে খুলে চুলের পানি ঝরাতে লাগলো।
” তোমার জ্বর আর তুমি এতো সময় নিয়ে গোসল করছিলে।”, রেগে গিয়ে বলল আহান।
” মানে? আমার কি আপনার কাছ থেকে পারমিশন নিতে হবে?”, রুহি আড় চোখে তাকিয়ে বললো।
এমন সময়ে রুহির নানী রূমে আসতেই সবটা শুনে ধমকের সুরে রুহিকে বললো,” অবশ্যই নিতে হবে। দিন দিন দেখি নিজের কান্ড জ্ঞান হারিয়ে ফেলছ তুমি। নিজের ভালো তো নিজে কোনোদিন বুঝতে শেখোনি।”
রুহি গাল ফুলিয়ে চুপ করে আছে। হটাৎ নানী চলে আসবে সে ভাবেনি। এই লোকটার সামনে বকছে আবার। আহান হাত বুকের কাছে ভাজ করে দাড়িয়ে রুহির দিকে তাকিয়ে আছে। কথাগুলো রুহির শোনা প্রয়োজন।
” ঘুম থেকে উঠে যে গোসল করতে গেলে , কাকে জিজ্ঞেস করেছ তুমি? আমাকে বলতে পারতে গরম পানির ব্যবস্থা করে দিতাম। নাকি আবার জ্বর বাঁধানোর ইচ্ছে জেগেছে।”,
নানীর বকা খেয়ে রুহি চুপ করে আছে। মুখটা কালো হয়ে গেছে তার। নানী এগিয়ে এসে রুহির মাথায় হাত দিয়ে জ্বর আছে কিনা দেখে নিলো। তারপর বলল,” নিচে এসো কিছু খেয়ে ওষুধ খেতে হবে।” বলে নানী চলে গেলো।
রুহি অগ্নি দৃষ্টিতে আহানের দিকে তাকালো। আহান বাকা হাসি দিয়ে তাকালো।
” সবাইকে কি আপনি জাদু টোনা করেছেন নাকি?”, রেগে দাতে দাত চিপে বললো রুহি।
” আমার ওসবের প্রয়োজন হয় না।”, তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল আহান। রুহির গায়ে যেনো কেউ মরিচ ছিটে দিয়ে দিয়েছে। রুহি গাল ফুলিয়ে চলে গেলো।
___________
রুহি আর নুড়ি বিকেলে একটু বের হয়ে হাটাহাটি করছিলো পাড়ায়। রুহির মেজাজ প্রচুর খারাপ হয়ে আছে।
” কিরে এমন মুখ করে আছিস কেনো?”, নুড়ি জিজ্ঞেস করলো।
” ইচ্ছে করছে কাউকে খুব জোড়ে জোড়ে কয়েকটা ঘুষি মারি।”, রেগে বলল রুহি।
” হটাৎ এমন অদ্ভুত ইচ্ছা জাগলো কেনো তোর?”,
” জানি না খুব রাগ হচ্ছে। কাউকে মারতে পারলে খুব ভালো লাগতো ওই কুম্ভকর্ণটাকে যদি মারতে পারতাম। কিন্তু আমি কি আর জন সিনার সাথে পারবো।”, রেগে গজ গজ করে বললো রুহি।
” এই কুম্ভকর্ণটা কে?”, আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করলো নুড়ি।
” আমার জামাই ছাড়া আর কে?”
” জামাইকে কুম্ভকর্ণ ডাকিস? এটা কেমন নাম, ওমন হ্যান্ডসম জামাইকে কেউ কুম্ভকর্ণ ডাকে? শুঁটকির মত পোলা গুলারেও বউরা বাবু, জান বইলা ডাকে। আর তুই কিনা কুম্ভকর্ণ বলিস।”, হতভম্ব হয়ে বললো নুড়ি।
” ওসব ঢং আমার দ্বারা হয় না। জানিস ওই কুম্ভকর্ণটার জন্য আজ কতো বোকা খেয়েছি।”,
রুহি আর নুড়ি কথা বলছিলো হটাৎ নিবিড়ের সামনে পড়লো ওরা। রুহিকে দেখে নিবিড় হাতের বিড়ি ফেলে রুহির সামনে এসে দাড়ালো। সাথে কেউ নেই আজ নিবিড়ের। নিবিড় এসেই রুহির হাত ধরে বললো,” রুহি তুমি কোথায় ছিলে? আমি তোমায় অনেক খুঁজেছি। চলো তুমি আমার সাথে চলো।”
” আবার আমার হাত ধরেছিস? ভুলে গেছিস সেদিনের মারের কথা। ভালো চাইলে ছেড়ে দে।”, হাত ছাড়ানোর জন্য চেষ্টা করতে লাগলো রুহি। এদিকে নুড়ি কাউকে ডেকে আনতে গেছে কারণ আশে পাশে শুধু খালি মাঠ ছাড়া কিছু নেই।
নিবিড় পাগলের মতন রুহির হাত ধরে নিয়ে যেতে লাগলো। রুহির কোনো কথাই সে শুনছে না। রুহির উপায় না পেয়ে চিৎকার করতে লাগলো। সেদিনের মত যদি সে আজও এসে তাকে বাঁচতো। হটাৎ রুহির অন্য হাত ধরে ফেললো কেউ একজন। নিবিড় বাধ্য হয়ে থেমে গেলো রুহি পিছনে তাকাতেই আহানকে দেখে। রুহির যেনো প্রাণ ফিরে এলো তবে আহানের চোখ মুখে দেখে রুহির ভয় লাগছে। নিবিড়কে মনে হচ্ছে আজ মেরেই ফেলবে। আহান সজোরে নিবিড়ের পেটে একটা লাথি মারতেই নিবিড় ছিটকে পড়ে গেলো। আহান রুহিকে টেনে একপাশে দাড় করালো। এর মাঝেই নিবিড় উঠে দাড়ালো, আজ সে কোনো ভাবেই হাল ছাড়তে পারবে না।
আহান শার্টের হাতা ভাজ করে উপরে তুলতে তুলতে এগিয়ে গিয়ে নিবিড় উঠে দাঁড়াতেই হাত মুষ্টি বন্ধ করে জোড়ে একটা ঘুষি মারতেই আরো ছিটকে যায় নিবিড়। আহানের রাগ তুঙ্গে উঠেগেছে। আহান মারতে মারতে দেওয়ালের সামনে দাড় করিয়ে নিবিড়ের কলার চেপে ধরেছে।
” ওকে টাচ করার সাহস হলো কিভাবে তোর? বাস্টার্ড। ও আমার ওয়াইফ। ওর দিকে কারোর চোখ তুলে তাকানোটা পর্যন্ত আমি এলাও করি না আর তুই…” দাতে দাত চিপে বলেই নিবিড়ের পেটে আরো জোড়ে একটা ঘুষি মারলো আহান। নিবিড়ের অবস্থা খুব খারাপ, নাক মুখ দিয়ে রক্ত পরছে। আহানের রাগ কিছুতেই কমছে না। রুহির মুহূর্তের জন্য মনে বিশ্বাস হয়েছিলো আহানই হয়তো সেইদিনের সেই ছেলেটা কিন্তু সেদিন ছেলেটা এতোটা হিংস্র হয় নি। রুহি দুরে দাড়িয়ে ছিলো এগিয়ে যেতেও পারছে না গেলে যদি আহান আরো রেগে যায়।
কি হুমকি দিচ্ছে কে জানে। রুহি আর দারিয়ে থাকতে পারলো না এগিয়ে গেলো। এগিয়ে গিয়ে নিবিড়ের নাকে মুখে রক্ত দেখে রুহি ঘাবড়ে যায়। হায় হায় মেরে ফেলবে নাকি? রুহি ছুটে গিয়ে আহানকে নিয়ে আসার চেষ্টা করছে। আহান নিবিড়ের কলার ধরেই আছে।
” ছাড়ুন ওকে। কি করছেন মেরে ফেলবেন নাকি? ও মরে যাবে তো ছেড়ে দিন প্লিজ।”রুহি নিবিড়ের কলার থেকে আহানের হাত সরানোর চেষ্টা করছে কিন্তু আহান কিছুতেই ছাড়ছে না।
” রুহি তুমি সরে যাও আজ ওকে আমি…”, বলে এগিয়ে যেতেই রুহি আহানকে শক্ত করে জরিয়ে ধরে ফেললো। সেই মুহুর্তে আহানের দৃষ্টি সরতেই, নিবিড় পালিয়ে যায়।
রুহি জড়িয়ে ধরায় আহান নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। সে আজ মেরেই ফেলতো বাস্টার্ডটাকে।
[ চলবে ]
🌼