#ওয়েডিং_স্টোরি
#পর্ব_২৩
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
— ” শাস্তিটা নাহয় বিয়ের পরের জন্যে তোলা রইলো, মিসেস মিনহাজ। ”
আরোহীর বন্ধ চোখের পাতা কেপে উঠলো জানা-অজানা শিহরনে। রক্তলাল ঠোঁট শুকিয়ে এলো অদ্ভুত এক তৃষ্ণায়। একে প্রেম তৃষ্ণা নাম দেওয়া যায় কি? মিনহাজ ধীরে ধীরে সরে এলো আরোহীর থেকে। আরোহী ইতিমধ্যে চোখ খুলেছে। তবে থুতনি এখনো নামিয়ে রাখা। চিবুক স্পর্শ করবে,করবে ভাব। মিনহাজ তা দেখে আলতো হাসলো। বড্ড সুন্দর দেখালো সেই হাসি!
— ” ভাই,আর কতক্ষন? মেয়ে দেখতে এসেছি আমরা। মান সম্মান রাখো, এটলিস্ট। বেরোও। ”
রুমের বাইরে থেকে আভার কণ্ঠস্বর ভেসে আসলো। মেয়েটা বড়ই অধৈর্য্য! ভাইয়ের শান্তি দেখতে পারলো না কখনোই। বেদ্দপ! মিনহাজের গলা শুকিয়ে তেতো হয়ে উঠলো। আরোহী মিনহাজের ওমন বিরক্ত ভাব দেখে ফিক করে হেসে ফেললো। মিনহাজ আরোহীর দিকে তাকালো। অকারণে হাসায় রেগে গেছে সে। আরোহী তাৎক্ষণিক চুপ হয়ে গেলো। মিনহাজের রাগ বাড়ানো আর রেললাইনে গলা দেওয়া, দুটিই এক। মিনহাজ শার্টের কলার ঠিক করলো। আরোহীর শাড়ির আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মুছলো। অতঃপর আস্তে ধীরে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলো। যাওয়ার আগে অবশ্য ছোটখাটো সতর্কবাণী দেওয়া হলো,
— ” ফারদার, তোমার মুখে কোনো ছেলের নাম যদি শুনি, তখন বিয়ের আগেই চট ঘর থেকে তুলে নিয়ে যাবো। বউয়ের বাপ আমার কিছুই করতে পারবে না। মাইন্ড ইট! ”
মিনহাজ বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। মিনহাজের আগ্নেয়গিরির বার্তা শুনে আরোহী থম মেরে গেলো। চোখ’দুটো বিশাল আকৃতির হয়ে গেলো। কি ভয়ানক ছেলে! আমার বাড়ি এসে আমাকেই থ্রেট!
বিয়ের কথা পাঁকা হলো, দশদিন পর। আভার অ্যাডমিশন ছদিন পর। অ্যাডমিশনে যেনো কোনোরূপ গাফলতি নাহয় সেজন্যেই এই সিদ্ধান্ত।
________________________
গত চারদিন যাবৎ আভা নিজের রুমে বন্দী হয়ে আছে। জব্বর পড়াশোনা চলছে ওর। সকালে একটা টিউসন, বিকেলে উদ্ভাস আবার সন্ধায় আরেক টিউশন। রাতে পুরোটা সময় নিজের পড়াশোনা। সব মিলিয়ে দমবন্ধকর অবস্থা।
এখন দুপুর দুইটা বাজে। আভা দুপুরের খাবার খেয়ে নিজের রুমে এলো। বাথরুম থেকে হাতে মুখে পানি দিয়ে বেরিয়ে এলো। অতঃপর রেডি হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। উদ্ভাসে পরীক্ষা আছে আজ।
আসরের আযান দিয়েছে। আভা মাত্রই উদ্ভাস থেকে বের হলো। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে রিকশা খুঁজছে ও। আচানক একটা বাইক ওর পাশে এসে থামলো। বাইকে বসা ছেলেটার দিকে তাকিয়ে আভা একটু বেশিই অবাক হলো। আহনাফ এসেছেন! আজ কতদিন পর দেখা! কতদিন হবে? এক সপ্তাহ? আঙ্গুলে দিন গুনতে গেলে,এক সপ্তাহ খুব বেশি দিন নয়। কিন্তু মনে হচ্ছে, আহনাফকে না দেখার তৃষ্ণা তাকে এতটাদিন কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিলো। আহনাফকে এতদিন পর সচক্ষে দেখে আভার মুখের সবত্রই গোলাপী হাসি ছড়িয়ে পড়লো। আভা এগিয়ে গেলো বাইকের দিকে।
— ” আপনি? এখানে? ”
আহনাফ হেলমেট খুলে হাতে নিলো। হেলমেটের বাঁধন থেকে ঘন চুলগুলো ছাড়া পাওয়ায় কয়েকটা চুল কপালে ছড়িয়ে পড়লো। চুলগুলোর এমন ছন্দপতন দেখে আভা ভারী মুগ্ধ হলো। আহনাফের মুখখান ক্লান্ত। শরীরের শক্তি নিঃশেষ হয়ে প্রায় নেতিয়ে আছে। মনে হচ্ছে আজকের দিনে আহনাফের উপর বিশাল ধকল গেছে। আহনাফ কোনো ভনিতা না করে আভার উদ্দেশ্যে বললো,
–” বাইকে উঠো। ”
আভা এখনো চেয়ে আছে আহনাফের দিকে। সাধারনত, ক্লান্ত থাকলে মানুষের মুখের সৌন্দর্য্য কমে যায়। কিন্তু সেক্ষেত্রে আহনাফ! ক্লান্ত মুখমন্ডল এত সুন্দর হয় সেটা আভা মাত্রই জানলো। আভাকে চুপ থাকতে দেখে আহনাফ আভার কাধ ধরে ঝাঁকালো।
— ” হেই? কি হলো? ”
আভা ধ্যান থেকে বেরিয়ে এলো। পরক্ষণে আহনাফের দিকে ওমন করে চেয়ে থাকতে দেখে ভারী লজ্জায় পড়লো। ইশ! আহনাফ ওকে কি মনে করলেন? নির্লজ্জ? আভা সাত চিন্তা করলো, পাঁচও চিন্তা করলো। তবে লজ্জা আড়াল করতে পারলো না। চুপচাপ আহনাফের কাধে হাত দিয়ে বাইকে উঠে বসলো। দুজনের মাঝখানে আভার স্কুলব্যাগ দিয়ে রাখলো, যাতে আহনাফের শরীর স্পর্শ না করতে পারে।
বাইক থামলো নদীর পাড়ের সামনে। আভা বাইক থেকে নেমে দাঁড়ালো। আহনাফ বাইক এক পাশে পার্ক করে নিজেও নামলো।
আভা চারপাশে একবার তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— ” আমরা এখানে কেনো? ”
আহনাফ বাইক ছেড়ে আভার ডান হাত ধরলো। আভার গায়ে শিহরণ খেলে গেলো। আহনাফের দখলে থাকা হাতের দিকে একবার চোরা চোখে তাকালো। তবে, আগেরকার মত এবার অস্বস্তি লাগলো না। বরং, ভালো লাগলো। শুধুই কি ভালো লাগলো? নাকি এই স্পর্শ সকল ভালো লাগার অনুভূতির উর্ধ্বে?
আহনাফ আভার হাত ধরে হাঁটা শুরু করলো। মুখে শুধু এটুকু বললো,
— ” আমরা এখানে মন চর্চা করতে এসেছি। ”
‘ মন চর্চা ! ‘ আভা এই শব্দ শুনে অবাক হলো। মন চর্চা আবার কি? এই অদ্ভুত নাম প্রথম শুনলো ও। তবে, কথা বাড়ালো না। আহনাফ যেদিকে নিয়ে যায়, ও বিনা দ্বিধায় সেদিকেই যাবে। এ দু’মাসে আহনাফ আভার এটুকু ভরসা অর্জন করতে পেরেছে, বৈকি।
ওরা এক গাছের নিচে এসে দাঁড়ালো। গাছের নাম কি জানেনা কেউ। তবে, গাছটা বিশাল আকৃতির। মাথার উপর ছায়া দিতে সক্ষম। আহনাফ আভাকে নিয়ে বসলো গাছের নিচে। আভা এ নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করবে তার আগেই আহনাফ আভার কোলে মাথা রেখে লম্বা করে শুয়ে পড়লো। আভা চমকে উঠলো। কি করছেন আহনাফ? আভা কণ্ঠে বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করলো,
— “আরে, শুয়ে পড়লেন কেনো? ”
আহনাফের চোখ বন্ধ। ক্লান্তমাখা গলায় উত্তর করলো,
— ” বউফ্রেন্ড, চুলটা টেনে দাও তো। বড্ড ক্লান্ত আজ। তোমার নরম নরম হাতে একটু স্বস্তি দাও তো! ”
‘ বউফ্রেন্ড ‘ শব্দটা আভার শিরদাঁড়া অব্দি কাঁপিয়ে তুললো। আজ কতদিন পর এই শব্দ শুনলো? জানে না! আভার কান্না পেয়ে যাচ্ছে। আশার চেয়ে বেশি কিছু পেয়ে গেলে, তখন চোখের কান্না আটকানো কঠিনের থেকেও কঠিন কিছু। আভার এই মুহূর্তে কেমন লাগছে, সে বুঝাতে পারবে না। তবে এটুকু বলতে পারে, আহনাফের কণ্ঠে এই ছোট্ট সম্বোধন শুনলে আভার হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে করে। মন চায়, আহনাফ সারাদিন তজবিহ পাঠের মত তাকে এই নামে ডাকতে থাকুক। আর সে শুধু শুনতেই থাকুক, শুনতেই থাকুক আর শুনতেই থাকুক।
আভা আহনাফের চুলে হাত দিলো। আস্তে করে চুল টেনে দিতে লাগলো। আহনাফ চোখ বন্ধকর অবস্থায় বললো,
— ” খাও না নাকি তুমি? জোরে টানো। ”
আভা আরো জোরে চুল টানলো। তবু আহনাফের পোষালো
না। আরো জোড়ে টানতে বললো সে। আভা এবার হাতের সর্বশক্তি দিয়ে চুল টানলো। এবার কিছুটা আরাম মিলছে আহনাফের।
বেশ কিছুসময় পার হয়ে গেলো। আহনাফের কোনো সাড়া-শব্দ নাই। ঘুমিয়ে গেছে, নাকি? আভা চুল টানতে টানতে আস্তে করে ডাক দিলো,
— ” হ্যালো, ঘুমিয়ে পড়েছেন নাকি? শুনছেন? ”
তবে, আহনাফের পক্ষ থেকে কোনো জবাব মিললো না। আভা আরো দুবার ডাক দিলো। নাহ! কোনো জবাব নেই। আভা হঠাৎ’ই আহনাফের মুখের দিকে ঝুঁকে এলো। আহনাফের মুখের একেকটা সূক্ষ্মতা লক্ষ্য করলো। চোখের পাপড়ি কয়টা, নিঃশ্বাসের শব্দ কেমন, ঠোঁটের ইঞ্চি কতটুকু, ভ্রু কতটা ঘন। এসব কিছু মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করতে লাগলো ও। কেনো করছে এসব, ও নিজেও জানে না। তবে আহনাফকে এভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে তার দারুন লাগছে। কখনো তো সেভাবে দেখার সুযোগ মিলে নি। আজ মিলেছে, তাই ও সুযোগের সদ্ব্যবহার করছে। আচ্ছা, মুহূর্তে আহনাফের নাম ধরে ডাকলে কি হবে? আহনাফ ত ঘুমিয়ে পড়েছেন। শুনতে পারবেন না। একবার নাম ধরে ডাকবে কি? আভা নিজের মনের প্রশ্ন করলো। উত্তর হ্যাঁ মিলতেই আভা আলতো কণ্ঠে ডাক দিল,
— ” আহনাফ! ”
— ” আই লাভ ইউ, বউফ্রেন্ড! ”
#ওয়েডিং_স্টোরি
#পর্ব_২৪
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
— ” অ্যাই লাভ ইউ, বউফ্রেন্ড! ”
হঠাৎ বলা এই ভয়ঙ্কর বাক্য শুনে আভা এক ছিটকে মাথাটা পিছিয়ে নিলো। আহনাফ ততক্ষণে চোখ মেলে তাকিয়েছে। তার শীতল চোখের দৃষ্টি আভাকে যেনো জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মারছে। ঠোঁটে চিরচেনা সেই গম্ভীর ভাব। আভা চোখ বড়বড় করে আহনাফের দিকে তাকিয়ে আছে। তার মানে, এতক্ষণ আহনাফ এক বিন্দুও ঘুমায় নি? সব অভিনয় ছিলো? আর, আভা আহনাফকে নাম ধরে ডেকেছে, আহনাফ সেটাও শুনেছে? কিন্তু, আহনাফ একটু আগে এটা কি বললেন? তিন ম্যাজিকাল ওয়ার্ড! মনে পড়তেই আভার বুক ‘ ধুকধুক ‘ করতে আরম্ভ করলো। আহনাফ আভার কোলে মাথা রেখে আভার দিকেই চেয়ে আছে। আভা কি করবে ভেবে না পেয়ে আহনাফের দিকেই পলকহীন তাকিয়ে আছে। আহনাফ আবারও বললো,
— ” ভালোবাসি, আকাশরানী। ”
আভার এই মুহুর্তে কেমন অনুভূতি প্রকাশ করা উচিৎ, ও জানে না। শুধু জানে, আহনাফের মুখে জাদুকরি তিনটি শব্দ শুনে ও নিথর হয়ে গেছে। শরীরের লোমকূপ অব্দি জেগে উঠেছে। বুকের মাঝে গুটিশুটি মেরে লুকিয়ে থাকা মন’টা গলা ছেড়ে চিৎকার করে বলছে, ‘ আমি এমন অসহ্য সুখময় বাক্য কখনো শুনিনি! এমন করে আমায় কেউ কখনো বলেনি! এজীবনে আপনার মত আমায় কেউ ভালোবাসে নি! ‘ তবে বলতে পারলো না। কেনো যেনো সব কথা, সমস্ত অনুভূতি গলার ঠিক মধ্যখানটায় দলা পাকিয়ে ধুম্রজাল সৃষ্টি করলো। আহনাফের বলা এই বাক্যের উত্তরে কি বলবে আভা? ‘ সময় দরকার? ‘ নাকি ‘ মিথ্যে বলবে? ‘ কিন্তু মিথ্যে বললে আহনাফকে ঠকানো হবে! আহনাফের অনুভূতিকে হেয় করা হবে! সেটা কি আদৌ উচিৎ?এসব ভেবে আভা হঠাৎ করে’ই ছটফট করতে আরম্ভ করলো। আরামে বসেও শান্তি পাচ্ছে না। মাথার উপর শীতল ছায়াটাও এই মুহুর্তে অসহ্য লাগছে। অদ্ভুত! আহনাফ আভাকে এমন ছটফট করতে দেখে উঠে বসলো। আভা যেনো এতে একটু স্বস্তি পেলো। আহনাফ আভার পাশে গাছে ঠেস দিয়ে বসলো। মাথাটা উপরের দিকে তুলে আকাশের দিকে তাকালো। কোথায় যেনো শুনেছিল,
” শূন্যতার আভিধানিক অর্থ, মেঘ! ” আজ আকাশের দিকে তাকিয়ে এই কথার অর্থ বুঝতে পারলো সে। আভা ঘাপটি মেরে চুপচাপ বসে রইলো আহনাফের পাশে। আহনাফ বেশ কিছুসময় চুপ থেকে হঠাৎ’ই বললো,
— ” বউফ্রেন্ড, একটা গল্প শুনবে? এক রাজার গল্প? ”
আভা চেয়ে রইলো আহনাফের পানে। গল্প! তবে আভা আপত্তি করলো না। সম্মতি জানাতে বললো,
— ” বলুন। ”
আহনাফ চোখ খুলে তাকালো। চোখের দৃষ্টি লাল, রক্তের মতোই রক্তাক্ত! মাথাটা গাছের সাথে ঠেস দিয়ে বলতে শুরু করলো,
— ” এক শহরে একটা রাজা ছিলো। যার রাজ্যে তার বাবা-মা ছিলেন। কিন্তু, সে ছিলো ভবুগুরে এক রাজা। রাজ্য নিয়ে তার বিন্দুমাত্র দুশ্চিন্তা ছিলো না। সারাক্ষণ তার বন্ধুদের সাথে ঘুরে বেড়াতো, এই রাজ্য থেকে ওই রাজ্য। তবে, একদিন সে রাজার পায়েও শিকল বাঁধলো। শিকলটা কে ছিলো, জানো? এক রাজকন্যা! সেদিন রাজার রাজ্যে মেলা বসেছিল। রাজা আর তার বন্ধুবান্ধব সেই মেলা দেখতে এসেছিল। সেই মেলায় কাকতালীয় ভাবে সেই রাজকন্যাও এসেছিল। একসময় মেলায় রং খেলা হয়। রাজকন্যা সেই হরেক রঙের ভিজে যায়। রঙের কারণে, কলাপাতা রঙের শাড়ি নষ্ট হয়। রাজকন্যা সেই অগোছালো শাড়ির কুচি সামলে হাঁটছিলো। তবে, রাজকন্যার হাতের ছোঁয়ায় শাড়ির কুচি গুছিয়ে গেলেও অগোছালো হয়ে গেলো সেই ভবুগুরে রাজা। রাজকন্যার কাজল মাখা চোখে সে নিজের সর্বনাশ দেখতে লাগলো। মায়াবী মুখে মাখামাখি হওয়া হরেক রং দেখে রাজার মন আলুথালু হয়ে উঠলো। প্রথম দেখায় রাজা সেই রংমাখা মেয়ের প্রেমে পড়ল! রাজার মন ভেঙে চুরমার হলো। সেই মেয়েকে পাওয়ার নেশা রাজার রন্ধ্রে রন্ধ্রে সঞ্চালিত হতে লাগলো। রাজা প্রতিজ্ঞা করলো, এই মেয়েকে সে নিজের করবে’ই! রাজার চলে এলো মেলা থেকে। বাবা-মাকে রাজি করিয়ে বাগদান করলো সেই রাজকন্যার সাথে। তবে,সেই রাজা তখনো জানত না তাদের ছোট্ট জীবনে আরো কারো অস্তিত্ব আছে। রাজকন্যার উপর নজর পড়ল আরেক দুষ্টু রাজার। দুষ্টু রাজা কেড়ে নিতে চাইলো রাজকন্যাকে। তবে, রাজা তা হতে দিলো না। তার আগেই, রাজকন্যার আঙ্গুলে নিজের নামের আংটি পরিয়ে দিলো। সেই থেকে রাজার অপেক্ষা শুরু হলো, রাজকন্যার মনে নিজের একটু জায়গা তৈরি করা। ”
এটুকু বলে আহনাফ থামলো। আভা এখনো অবিশ্বাস্য চোখে আহনাফের দিকে চেয়ে আছে। গল্প সম্পূর্ণ হয়নি তো! শেষে কি হয়েছিল? আভা প্রশ্ন করলো,
— ” কিন্তু, শেষ পর্যন্ত রাজা কি রাজকন্যার মন জয় করতে পেরেছিল? ”
আহনাফ হাসলো। মলিন, নির্মল সেই হাসি।এই হাসিতে কোনো প্রাণ নেই। শুধু ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলেই, মানুষ হাসে না। হাসি মন থেকে আসে। জোর করে কি কখনো হাসা যায়? আহনাফের ওমন হাসি দেখে আভার হঠাৎ করেই মন খারাপ হলো। মনে হলো, ‘ তার পাশে বসে থাকা এই মানুষটার মুখে মলিনতা মানায় না! একদমই মানায় না। মানুষটা হাসুক, প্রাণ খুলে হাসুক। সেটা’ই ও চায়! ‘ আভা সেই মন খারাপের রেশ ধরে বললো,
— ” আপনার কি মন খারাপ? প্লিজ মন খারাপ করবেন না। আপনাকে মন খারাপ হতে দেখলে আমার ভালো লাগে না।”
আহনাফ আভার কথা শুনে সোজা হয়ে বসলো। মুখ ঘুরিয়ে আভার দিকে চেয়ে শীতল গলায় প্রশ্ন ছুড়লো,
— ” আমায় ভালোবাসো, বউফ্রেন্ড? ”
আভা চমকে উঠলো সেই প্রশ্নে! কি বলবে, কি উত্তর দিবে ভেবে পেলো না। আহনাফ এভাবে সোজাসুজি প্রশ্ন করে বসবে সেটা সে ভাবতে পারেনি। এবার? কি বলবে আহনাফকে? আভা আমতা আমতা করতে আরম্ভ করলো। মনের মাঝে কথাগুলো সাজিয়ে-গুছিয়ে মুখ ছুঁড়ে বলতে গেলো,
— ” আসলে..আমি..আমি আপনাকে… ”
— ” ফরগেট ইট! ”
আভার কথার পিঠে আহনাফ ছোট্ট করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলে উঠলো। সে জানে, আভা এখন মিথ্যে বলবে। আভার মুখে মিথ্যে শোনার চেয়ে, তার কান দুটো গলে-পঁচে যাক! সেই শ্রেয়! আহনাফ উঠে দাঁড়ালো। শার্টের হাতার বোতাম খুলে কনুই পর্যন্ত গুটিয়ে নিল। আভা এখনো বসে আছে মাটিতে। ভাবছে বসে, বসে। আহনাফ আভার দিকে তাকিয়ে বললো,
— ” বউফ্রেন্ড,দেরি হচ্ছে। বাসায় যেতে হবে আমাদের। তোমার না একটু পর টিউশন আছে? ভুলে গেছো? ”
আভা আহনাফের দিকে তাকালো। তার দু’চোখে অপরাধবোধ! আহনাফকে নিরাশ করার অপরাধটা তার মনের ভিতরটা গুন পোকার মতো কুটকুট করে খেয়ে ফেলছে। আহনাফের চোখে চোখ রাখার সাহস হচ্ছে না। আহনাফ আভার এই দৃষ্টি খুব সহজে বুঝে ফেললো। সে আস্তে ধীরে আভার মুখোমুখি বসলো। আভার দুহাত পরম যত্নে নিজের হাতের মুঠোয় রাখলো। আলতো সুরে বললো,
— ” এখানে গিল্টি ফিল করার মতো কিছু হয়নি। আমি জানি, তুমি আমাকে ভালোবাসার চেষ্টা করছো। তবে, তোমার চেষ্টা না করলেও হবে। আমার একার ভালোবাসা’ই আমাদের দুজনের জন্যে যথেষ্ট! এতে কষ্ট পাওয়ার কিছু নেই। আমি তোমায় ভালোবাসি, আমাদের দুজনের কাছেই সেটাই সত্য এবং তুমি, আমি, আমরা দুজনেই সেটা মানি। ”
আভা অপলক চোখে আহনাফের দিকে তাকিয়ে আছে। আহনাফের এমন আদুরে কথা শুনে আভার চোখ ছলছল করছে। এত কেনো ভালোবাসে মানুষটা? একটু কম ভালোবাসলে হয়না? এই যে এখন আভার এই প্রেমিক মানুষটাকে জোরে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে, তার বেলায়। আভা কেনো মানুষটাকে একটু ভালোবাসতে পারলো না? কেনো? ও একটুও ভালোবাসলে তো আর মানুষটা আর কষ্ট পেতো না। ও কতটা পাষাণ! ধিক্কার তোমায়, আভা!
আহনাফ আভার হাত ধরে তাকে বাইকের কাছে নিয়ে এলো। আভা জড় বস্তুর মত চুপচাপ বাইকে উঠে বসলো। এতকিছুর কারণে, আজ দুজনের মাঝে ব্যাগ দেওয়ার কথা সে বেমালুম ভুলে গেলো। আহনাফ বাইক স্টার্ট করে আরো একবার পিছন ফিরলো। তাদের মধ্যে আভার স্কুল ব্যাগ না থাকায় সে ভারী অবাক হলো। কিন্তু, পরক্ষণে আভাকে নির্জীব হয়ে বসে থাকতে দেখে সে নিজেই দুজনের মাঝে স্কুল ব্যাগটা দিয়ে দিলো। অতঃপর, এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাইক চালু করলো। আজকের বাতাস এত ভারী কেনো?
#চলবে