#ওয়েডিং_স্টোরি
#পর্ব_২৯
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
হাসপাতালের দূষিত বাতাস নাকে-মুখে প্রবেশ করে বুকের ভিতরটায় হাহাকার তৈরি করছে। আহনাফ মাত্রই গোসল করে বের হলো। পরনে কালো ট্রাউজার আর সাদা-কালো টিশার্ট। হাতে ঝুলানো সেই নেভি ব্লু টিশার্ট। আহনাফ রক্তাক্ত সেই টিশার্টটা ধুতে গেলেও কি মনে করে টিশার্ট না ধুয়ে এমনই রেখে দিলো। হসপিটালের বাথরুম থেকে বেরিয়ে টিশার্টটা সুন্দর করে ভাজ করে একটা কাপড়ের ব্যাগে রাখলো। বরাবর, আহনাফ একজন গোছালো মানুষ! নিজের রুম থেকে শুরু করে পরিধেয় জামা-কাপড় সবসময় পরিষ্কার ফকফকা থাকে। সেক্ষেত্রে, আভা ব্যতিক্রম। নিজের ব্যবহার্য জিনিসপত্র আভার মা’ই গুছান। কিন্তু বলে না, বিপরীতে ভালো যুগলবন্দী হয়! আহনাফ-আভা বোধহয় তাই-ই।
আহনাফ ঔষধের প্যাকেট থেকে একটা ইনজেকশন বের করে তাতে মেডিসিন পুড়ে নিলো। ইনজেকশনটা হাতে নিয়ে আভার পাশের চেয়ার টেনে বসলো। আভার হাতে স্যাভলন লাগিয়ে আস্তে করে ইনজেকশনটা পুষ করে দিলো।এই ইনজেকশনটা জ্বালাময়ী! হাতে পুষ করার সঙ্গেসঙ্গে সম্পূর্ণ হাতে এক জ্বালা তৈরি হয়। সেই জ্বালা অনেকে সহ্য করতে না পেরে কেঁদে-কেটে হসপিটাল মাথায় তুলে।তবে, আভা এসবের কিছুই করলো না। করবেই বা কেমন করে? ও তো নির্জীব, নিশ্চল! এতকাল সবার চিৎকার শুনে আহনাফ বিরক্ত হলেও, আজ হঠাৎ করেই তার মনে হলো, আভার মুখে এই চিৎকারটা বোধহয় খুব বেশিই দরকার! অন্তত, তার বুকের ভিতর প্রবহমান এক চিনচিনে কঠিন ব্যাথাটা নিবারণের জন্য! আহনাফ তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো। চেয়ার থেকে উঠে এসে আভার দিকে ঝুঁকে কপালে চুমু দিয়ে বেড়িয়ে গেলো। আহনাফ বেরিয়ে যাওয়ার পর, একে একে বাকি সবাই আভাকে একবার দেখে গেলো।
বাহাত্তর ঘণ্টা হতে আর মাত্র এক ঘন্টা বাকি। কিন্তু, সবাইকে হতাশায় ফেলে, এখনো আভার জ্ঞান আসে নি। আহনাফ সেই কখন থেকে আভার পাশে চেয়ার টেনে বসে আছে। এই মুহূর্তে, প্রতিটা ন্যানো সেকেন্ড তার জন্যে বছরসমতুল্য! বারবার, আভার দিকে তাকিয়ে দোয়া, দুরুদ পড়ছে। দোয়া যতটা জানে ততটা তো পড়ছে’ই, সেই সাথে মসজিদের ইমামের কাছ থেকে শিখেও নিয়েছে কিছু দোয়া। এখন আল্লাহ-তায়ালা’ই শেষ ভরসা! কেবিনের বাইরে আভার পুরো পরিবার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। আহনাফ যেহেতু ডাক্তার, তাই ও’ই আইসিইউ রুমে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। আর আভার প্রতিটা মুহূর্তের রেসপন্স আহনাফই ভালো বলতে পারবে।
আর মাত্র আধা ঘন্টা বাকি! আভার পক্ষ থেকে কোনো সাড়া নেই। আহনাফ আভার দিকে তাকালো। চোখের কোণায় জল চিকচিক করছে তার! বুকের ভিতরটা আগুনে দাউদাউ করছে। প্রচন্ড জ্বালায় বুকটা প্রায় নেতিয়ে গেছে। আভাকে সে হারাতে পারবে না। কোনক্রমেই না! কিন্তু কি করবে ও? আহনাফ ত বাঁচানোর মালিক না। আল্লাহ যদি না বাঁচাতে চান, তবে তার বুকের দহন কেউ নিভাতে পারবে না। কেউ না! আহনাফ আভার হাত ধরলো। হাতের বাঁধন শক্ত, পাথরের ন্যায়। তার হাত কাঁপছে, স্পষ্ট! সে আভার হাতের উল্টোপিঠে ঠোঁট বসালো। হাতে ঠোঁটের উপস্থিতি বহাল রেখে, ধরা গলায় শুধু এটুকু বললো,
— ” প্ল.প্লিজ ডোন্ট গো, বউফ্রেন্ড! আমাকে এভাবে মেরো ফেলো না, তুমি। প্লিজ! ”
আহনাফের কণ্ঠ ভেজা। কন্ঠে স্পষ্ট হৃদয় নিংড়ানো কিছু কান্না! পুরুষদের চোখে কান্না বড্ড বেমানান। তবুও, তার চোখে জল। পুরুষালি নিয়মের বাইরে গিয়ে আহনাফের চোখ বেয়ে গড়ালো টসটসে দু’ফোঁটা জল।
সময় শেষ! সবাইকে দুঃখের সাগরে সাঁতার কাটিয়ে, বহুল প্রতীক্ষিত বাহাত্তর ঘণ্টা পেড়িয়ে গেছে। আহনাফ মাথা উচুঁ করে ঘড়ির দিকে তাকালো। ঘড়ির কাঁটা স্পষ্ট জানান দিচ্ছে, তার সব আশা শেষ। তার জ্যান্ত মরে যাওয়ার সময় এসে গেছে। তার সকল স্বপ্ন ধুলিস্মাৎ হয়ে গেছে। সে হেরে গেছে। হ্যাঁ, হেরে গেছে সে! আহনাফ ঘড়ি থেকে চোখ সরালো। তাকালো আভার দিকে। এতক্ষণ কান্না আটকানোর কারণে, ফর্সা নাক লাল টকটকে হয়ে গেছে। আহনাফ নাক মুছলো, চোখের জল মুছলো। আভার কপালে চুমু দিতে গিয়েও সরে এলো। বুকে আকাশসম পাথর চেপে আভার বুজে রাখা চোখে চোখ রেখে বললো,
— ” এই মুহুর্তে আমার তোমাকে ঘৃনা করা উচিৎ! কিন্তু আশ্চর্য! আমি তা একদমই পারছি না। হয়তো তোমার মত ওতটা পাষাণ দিল আমার নেই। আজ তোমার একটা বোকামির জন্যে, এতটা মানুষ কষ্ট পাচ্ছে। আমাকেও বাদ রাখো নি। ”
আহনাফ চেয়ার ছেড়ে উঠে গেলো। কেবিন দরজার হাতলে হাত দিতেই পিছন থেকে শোনা গেলো, কালার ডপলার মেশিনে টিকটিক আওয়াজ। আহনাফ সঙ্গেসঙ্গে পিছন ফিরলো। চোখের আকৃতি অবাকে বিশাল আকার হয়ে গেছে। আহনাফ তাড়াহুড়ো করে মেশিনের কাছে এলো। মেশিনে স্পষ্ট জানান দিচ্ছে, আভা একটু একটু করে রেসপন্স করছে! আহনাফ সঙ্গেসঙ্গে আভার পালস মাপলো। পালস ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে। খুশিতে আহনাফের চোখে জলের কয়েক বিন্দু জমলো। তার আভা রেসপন্স করছে, তার বউফ্রেন্ড ফিরে এসেছে।
একটু পর আভার হাত হালকা নড়ে উঠলো। তার কয়েক মুহূর্ত পর, আভার চোখের পাঁপড়ি কেঁপে উঠলো। কয়েক মিনিট পর, আভা আস্তে আস্তে চোখ খোলার চেষ্টা করলো। এসবই আহনাফ পাশ থেকে খুব সুক্ষভাবে লক্ষ করছে। অসম্ভব কাজ হঠাৎ করে সম্ভব হতে দেখে, তার মুখে উজ্জ্বল দীপ্ত খেলে গেলো।
আভা সম্পূর্ণ চোখ খুললো। তার চোখের দৃষ্টি সিলিংয়ের দিকে। আশপাশে কি হচ্ছে, কিছুই তার বোধগম্য হচ্ছে না। আহনাফ পাশ থেকে প্রচড শীতল গলায় ডাক দিলো,
— ” বউফ্রেন্ড..! ”
আভা পাশ ফিরলো। স্পষ্ট দেখলো, আহনাফ। তবে ওর মস্তিষ্ক ততটা সক্রিয় না থাকায় চিনতে পারলো না তাকে। আভা দু-একবার পলক ঝাপটালো। আহনাফ চেয়ে’ই আছে আভার দিকে। ওর দৃষ্টি গভীর, দ্বিধাহীন! আভা একসময় অস্ফুটসুরে বললো,
— ” আ.আ.আহনাফ! ”
বেশি পাওয়ারের ইনজেকশনের প্রভাবে আভা আর চেয়ে থাকতে পারলো না। ঘুমিয়ে গেলো। তবে, এখন ও বিপদমুক্ত! সেটাই শুকরিয়া!
____________________
আভাকে কেবিনে দেওয়া হলো। ইতোমধ্যে তিনটা দিন পেরিয়ে গেছে। আভা এখন পুরোপুরি সুস্থ না হলেও, মস্তিষ্ক সম্পূর্ণ সচল। কে আসছে, কে যাচ্ছে, সবই ও বুঝতে পারছে। কিন্তু, এই বুঝা’টাই যেনো ওর কাল হলো। গত তিনদিন ধরে আহনাফ একটিবারের জন্যেও আভাকে দেখতে আসেনি। একটিবারের জন্যেও না! সেদিন প্রথম চোখে খুলে এক বিধ্বস্ত আহনাফকে দেখেছিলো ও। যার চোখে-মুখ শুকিয়ে আধখান হয়ে গেছে। কিন্তু, তারপর! আর একবারের জন্যেও আহনাফকে দেখেনি! সেই বিধ্বস্থ আহনাফকেও না! আহনাফের এ কি নিষ্ঠুর অত্যাচার! আভার পাশে সবাই আছে। তার নিজের পরিবার, আহনাফের পরিবার। এমনকি মিনহাজ ভাইয়ের শ্বশুরবাড়ীর লোকজন এসেও দেখে গিয়েছে কয়েকবার। তবুও, আভার ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। উচ্ছল পরিবেশেও তার ছোট্ট হৃদয় শূন্যতার ভারে পিষে যাচ্ছে। সবশেষে মনে হচ্ছে, আহনাফ এলেন না কেনো? তার কি অসুস্থ আভাকে দেখতে মন চায়না? কিন্তু আভা তো ছটফট করছে! একটিবার আহনাফকে দেখতে মন চাইছে। শুধু একটিবার আহনাফের আদুরে কণ্ঠে শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে সেই শব্দ, ‘ বউফ্রেন্ড…! ‘
#ওয়েডিং_স্টোরি
#পর্ব_৩০
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
হাসপাতালের স্যাঁতস্যাতে পরিবেশে এতদিন ধরে পড়ে থাকা কারো জন্যেই সুখকর নয়। তেমনই, আভা। বছরে একবারও যে মেয়ে হাসপাতালের চৌকাঠে পা দিত না, সেই মেয়ে গত এক সপ্তাহ ধরে হাসপাতালে শুয়ে আছে। আভা এখন অনেকটাই সুস্থ। তার মাথায় আপাতত একটাই চিন্তা ঘুরছে, ও বাসায় যাবে। কেবিনে এখন শুধু মিনহাজ বসে আছে। বাকি সবাই বাসায় ফ্রেশ হতে গেছে। আভার মা যেতে চান নি। কিন্তু আভা’ই উনাকে বুঝিয়ে সুজিয়ে বাসায় পাঠিয়েছে। আভার মা বরাবর খুব পরিষ্কার মানুষ। হাসপাতালের বিষাক্ত জীবাণু তার কখনোই সহ্য হয়না। একটা গোসল নিতে পারলে ভালো লাগবে তার। মিনহাজ একটা চেয়ারে বসে ল্যাপটপে কাজ করছে। আভা সেদিকে তাকিয়ে ছোট্ট করে এক নিঃশ্বাস ফেললো। শুয়ে থাকতে থাকতে কোমর ধরে এলো, পুরো। আভা বসার চেষ্টা করলো। কিন্তু পায়ে আর কোমরে ফ্র্যাকচার হওয়ায় নিজে থেকে বসতে পারলো না। শেষ পর্যন্ত, হাল ছেড়ে দিয়ে বেডে গা এলিয়ে দিলো। মিনহাজের দিকে চেয়ে আভা আস্তে করে ডাক দিল,
— ” ভাইয়া..! ”
মিনহাজ আভার ডাক শুনে তাড়াহুড়ো করে ল্যাপটপ রেখে আভার কাছে এলো। জিজ্ঞেস করলো,
— ” কিছু লাগবে? শরীর খারাপ করছে? কিছু কি খাবি? ”
আভা অবাক হলো ভীষন! যে ভাই তার সাথে দিনের চব্বিশ ঘণ্টাই ঝগড়া করে, সেই ভাই এখন তার এত খেয়াল রাখছে। এটাই হয়তো, ভাই-বোনের মধ্যকার আদর,ভালোবাসা! আভার চোখে লাল-নীল মুগ্ধতা ছড়ালো। আভা আস্তে করে বললো,
— ” আমাকে উঠাও একটু। বসবো। ”
মিনহাজ আলতো করে আভার কাঁধ ধরে আভাকে আস্তে করে বসালো। আভার পিঠের দিকে একটা বালিশ দিয়ে দিলো। বসার সঙ্গেসঙ্গে আভার কোমর ব্যথায় কুঁকড়ে এলেও ও দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করলো। ডাক্তার বলেছে, আঘাতপ্রাপ্ত জায়গা যত বেশি নড়াচড়া করা যাবে, ততই ভালো। এতে তাড়াতাড়ি সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। মিনহাজ জিজ্ঞেস করলো,
— ” আর কিছু লাগবে? ”
আভা মানা করলো। না, কিছুই লাগবে না। মিনহাজ কব্জিতে থাকা কালো রঙের ঘড়ি’টায় চোখ বোলালো। আভার ঔষুধ খাওয়ার সময় হয়ে গেছে। মিনহাজ আর দেরি করলো না। বেডের লাগোয়া টেবিল থেকে একটা বক্স বের করে প্যাকেট থেকে ঔষধ খুললো। তিনটা গোল ঔষুধ আভার হাতে ধরিয়ে দিয়ে পানি এগিয়ে দিলো। আভা ঔষুধ খেয়ে পানি খেলো। মিনহাজ পানির গ্লাস টেবিলের উপর রেখে আভার দিকে ফিরলো। জিজ্ঞেস করলো,
— ” এখন শুয়ে পড়বি? ”
আভা এবারও মাথা ডানে-বায়ে নাড়ালো। যার অর্থ, না। আভা বললো,
— ” তুমি তোমার কাজ শেষ করে ফেলো। আমি ঠিক আছি।”
মিনহাজ আবারও সোফায় বসলো। ল্যাপটপ পুনরায় কোলের উপর রেখে কাজ করা শুরু করলো। বোনের অসুস্থতার কারনে, সাত দিনের ছুটি নিয়েছে ও। কিন্তু বসের কড়া নির্দেশ অনুযায়ী, ঘরে বসে অনলাইনে কাজ করতে হবে। নাহলে, এক সপ্তাহের বেতন কেটে যাবে। বেতন নিয়ে মিনহাজের কোনো কালেই মাথা ব্যাথা ছিলো না। কিন্তু সামনে বিয়ে তার। আরোহীকে একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ দিতে, এটুকু কষ্ট তো করতেই হবে।
আভার মন খারাপ। সেদিনের পর, আরো দুদিন কেটে গেলো। আহনাফ এখনো আসেনি। আভার রাগ লাগছে। সেই রাগটা ধীরে ধীরে দুঃখে পরিণত হচ্ছে। সেই দুঃখ বয়ে আনলো, এক উত্তাল-পাত্থাল কান্না! আভা বহু কষ্ট কান্না থামালো। বড় ভাইয়ের সামনে নিজের হবু স্বামীর জন্যে চোখের জল ফেলা, বড্ড লজ্জাজনক। আভা বেডের চারপাশ হাতড়ালো। ওর ফোন কোথায়? কিন্তু, ফোন পাওয়া গেলো না। হয়তো, সেদিনের অ্যাক্সিডেন্টের কারণে, ফোন নষ্ট হয়ে গেছে। এখন? আহনাফকে কল দিবে কি করে? আভা মিনহাজের দিকে তাকালো। মিনহাজ ভ্রু কুঁচকে খুব মনোযোগ দিয়ে কাজ করছে। ভাইয়াকে বলবে, তার ফোনটা দেওয়ার কথা? কিন্তু কি বলে ফোন চাইবে? মায়ের কথা বলা যেতে পারে। আভা মিনহাজকে ডাক দিলো। মিনহাজ ল্যাপটপ থেকে চোখ তুলে আভার দিকে তাকালে আভা জড়তা নিয়ে বললো,
— ” তোমার ফোনটা একটু দাও না। মা’কে কল দিবো। ”
মিনহাজ কোনোরূপ বাক্য ক্ষয় না করে, সোফার উপর থেকে ফোন নিয়ে আভার দিকে এগিয়ে দিলো। আভা এক ঢোক গিলে ফোন হাতে নিলো। কিন্তু, আহনাফের নাম্বার কি দিয়ে সেভ করা? এত এত নাম্বারে, খুঁজবে কি লিখে? একবার আহনাফ লিখে সার্চ দিলো। আহনা নামে আরও তিনটা নাম্বার দেখালো। এখানে কোন নাম্বারটা আহনাফের? ও নাম্বার তো মুখস্তও করেনি। ইস! বড্ড খারাপ হলো ব্যাপারটা। বাসায় যাওয়ার পর আহনাফের নাম্বার একদম মুখস্ত, টুতস্থ ,কণ্ঠস্ত সবশেষে আত্বস্থ করে ফেলতে হবে। কোনো ছাড় নেই!
— ” লাস্টে ৪৫ যেটা, ওটাই আহনাফের নাম্বার। ”
আভা চমকে তাকালো মিনহাজের দিকে। মিনহাজের চোখ এখনও ল্যাপটপের দিকে। যেনো, একটু আগে সে কিছুই বলেনি। আভা এক ঢোক গিললো। বড্ড লজ্জা লাগছে ওর। ইশ, ভাই কি ভাবলো? আভা খুঁজে আহনাফের নাম্বার বের করলো। কল বাটনে চাপ দিয়ে ফোন কানে লাগিয়ে বসে রইলো।
একটু পর, মিনহাজ সোফা ছেড়ে উঠে গেলো। ল্যাপটপ আবারও সোফায় রেখে আভার দিকে তাকিয়ে বললো,
— ” আমি একটু বাইরে যাচ্ছি। চা খাবো। ভয় পাস না। একটু পরই চলে আসবো। ”
আভা মাথা নেড়ে সায় দিলো। ও খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে, মিনহাজ কেনো আভাকে একা রেখে চলে গেলো। বড় ভাইয়ের সামনে আহনাফের সাথে কথা বলতে হয়তো আভার সংকোচ হবে। সেজন্যেই, খুব কৌশলে মিনহাজ বেরিয়ে গেলো কেবিন থেকে। বাহ্!
একটু পর কল রিসিভ হলো। ওপাশ থেকে আহনাফ ব্যস্ত গলায় বললো,
— ” আসসালামুআলাইকুম ভাইয়া, আভা কেমন আছে? ”
আহনাফের কণ্ঠস্বর শুনে আভার নিঃশ্বাস আটকে এলো। বুকের ভিতর’টা ধরফর করছে। আভা সামলাতে ঠোঁট কামড়ে ধরলো। আহনাফ কিছুক্ষণ নীরব থেকে আলতো সুরে ডাক দিলো,
— ” বউফ্রেন্ড..! ”
আভা যেনো কেঁপে উঠলো।ইস! এই ডাকটা কতদিন পর শুনলো আভা? এক বছর পর, নাকি কয়েক যুগ পর? আভার চুপ থাকার কারন আর ওর বড় নিঃশ্বাস ফেলার কারণ দুটোই আহনাফ জানে। তবুও, আহনাফ নিজেকে এক শক্ত খোলসের ভিতর আবৃত করে বললো,
— ” কেনো ফোন দিয়েছ, জলদি বলো। আমার একটু পর বাইরে যেতে হবে। ”
আহনাফের ওমন কঠোর ব্যবহারে আভা মোটেও অভ্যস্ত নয়। আহনাফ বরাবরই আভার প্রতি নম্র! কিন্তু, আজ কি হলো? কেনো করছে এমন উনি? আহনাফ কি জানেনা,তার এই শক্ত ব্যবহার আভাকে জ্বালিয়ে দিচ্ছে। আভা ভস্ম হয়ে, ছাই হয়ে যাচ্ছে। হয়তো আহনাফ জানে। জানে বলেই, সে এমন করছে। কারণটা মূলত আভার বেখেয়ালি আচরন, আভার নিজের প্রতি উদাসীনতা! আভাকে একটা কঠিন শিক্ষা দিতেই আহনাফ নিজেকে শক্ত চাদরে মুড়িয়ে রেখেছে। হয়তো আহনাফ জানে, তার এক শিক্ষা আভাকে আর কোনোদিন ইমমিচিউর কাজ করতে বাঁধা দিবে। আহনাফ বললো,
— ” কিছু বলবে? বলার হলে জলদি বলো, আমার বেরুতে হবে। ”
আভা এবার চোখ-মুখ মুছে শক্ত গলায় বললো,
— ” আপনার কাছে আমার প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গেছে, তাইনা? আজকাল, নতুন কাউকে মনে ধরেছে? আমি অসুস্থ। তা জানা সত্ত্বেও, আমি একবারও আমাকে দেখতে আসেন নি। এই আপনার ভালোবাসা? ”
আভার এমন মনোভাব আহনাফ হতবাক হয়ে গেলো। তার এই শাস্তি, আভা এমন করে নিচ্ছে? আহনাফ অবাকও হলো, বটে! তবুও সে অত্যন্ত শান্ত গলায় উত্তর করলো,
— ” তুমি খুব ভালো করেই জানো, তুমি আমার জন্যে কি? তবুও, এমন মনোভাব? ওকে, জাস্ট ফরগেট ইট। ঔষধ-গুলো ঠিকমতই খেয়ে ঘুমাও। রাখছি। ”
আভা যেনো তেঁতে উঠলো এমন উত্তরে। আহনাফের শান্ত উত্তরে আভা দ্বিগুণ তেজ নিয়ে বললো,
— ” একদম মিষ্টি কথায় আমাকে ভুলাবেন না। আপনি জানেন, এ কদিন আমি ঠিক কিসের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। না, আপনি জানবেন কেনো? আপনার তো অন্য কেউ জুটে গেছে। আমি অসুস্থ। আমাকে আপনার কি দরকার, তাইনা?”
আহনাফ আভার এমন কথায় নীরব থাকলো। এক রত্তিও কথা বললো না। প্রচন্ড শান্ত সুরে বললো,
— ” এতগুলো কথার শাস্তি পাই-পাই করে ফিরিয়ে দেবো। রেডি হও। আমি আসছি। ”
কথাটা বলেই আহনাফ ধাম করে ফোন কেটে দিলো। আভা ফোন কান থেকে নামিয়ে হতবাক হয়ে চেয়ে রইলো। এখন কি হবে? আবেগের বশে এত বড়বড় কথা বলে ফেললো! এবার? আহনাফের রাগ তো ওকে কাঁচা খেয়ে ফেলবে। ইয়া আল্লাহ! রক্ষা করো! রক্ষা করো!
#চলবে