#আকাশে_তারার_মেলা
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব -১০
কারণ,এত্তো ছোট মেয়ের প্রতি কেন আমার ভালোবাসার অনুভূতি জাগবে? এটা ভালোবাসা না আমার বয়সের দোষ। সব ঝেড়ে ফেলে পড়াশোনায় মনোযোগ দিলাম। বলতে গেলে মনের সাথে কঠোর যুদ্ধে নেমেছিলাম আমি। চাপা দিয়েছি জাগ্রত অনুভূতি।পাক্কা তিন বছর পর আম্মুর সাথে আবারও যাওয়া হল নানুর বাড়িতে। যেতাম না কিন্তু নানা ভাইয়ের অসুস্থতার খবর শুনে বসে থাকতে পারলাম না। সেখানে গিয়ে দেখা মেলল আবারও সেই মেয়েটার। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিলাম মেয়েটার দিকে। পুরোনো অনুভূতি জেগে উঠল নিমিষেই। মেয়েটা আগের মতো পিচ্চি ছিল না।অনেকটাই বড় হয়ে গিয়েছিল। সেই মুহুর্তে আমার অনুভূতি গুলো এক নতুন নাম পেয়েছিল। পরিণত হয়েছিল ভালোবাসায়। নতুন বললে ভুল হবে তা তো বছর খানেক আগেই হৃদপিণ্ডে সৃষ্ট হয়েছিল যাকে চাপা দিয়ে রেখেছিলাম আমি। নিয়তি যে আমায় আবার টেনে আনবে আমার হৃদয়ের গহীনে দমিয়ে রাখা ভালোবাসা জাগিয়ে তুলবে কখনও ভাবি নি। আগের চেয়ে ও বেশি পাগল পাগল লাগছিল নিজেকে। বার বার নিজের মনে প্রশ্নের উদয় হতে লাগল কেন এতো মেয়েদের ভালোবাসার প্রস্তাব পেয়ে ও আমার হৃদয়ে নিজের চেয়েও দশ বছরের ছোট মেয়ের জন্য ভালোবাসার সঞ্চার হল! মেয়েটার সামনে আমি কখনও ধরা দেয় নি। আড়ালে ভালোবেসে গিয়েছি। সময় দিয়েছি তুলি নামক মেয়েটা কে আরেকটু বড় হওয়ার।
কথাগুলো বলে সূক্ষ্ম একটা নিশ্বাস ছাড়ল আদ্র। তুলি ফটাফট বলে বসল,,,
–“এতো ভালোবাসেন অথচ আমার বিয়ে টা আহান ভাইয়ার সাথে হতে দিচ্ছিলেন।”
আলতো হেসে আদ্র তুলির মুখের দিকে তাকাল। নিজের মোবাইল টা বের করে কল লাগালো কারো নাম্বারে। চোখ ছোট ছোট করে চেয়ে রইল তুলি। অপর পাশ থেকে ভেসে এল চেনা কন্ঠস্বর। প্রচন্ড অবাক হল তুলি। আদ্রর ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি।
–“কেমন আছিস আহান?”
–“আলহামদুলিল্লাহ ভাই। তোমরা কেমন আছো?আর তুলি টা ঠিক আছে তো?”
—“একদম ঠিক আছে।”
–“তুলি আমার ফোন ধরে না। ভীষণ কষ্ট হয়। খালা মণি মারা যাওয়ার পর তোমার কথা মোতাবেক যতটুকু পেরেছি আগলে রেখেছি। নিজের ছোট বোনের চেয়ে ও বেশি স্নেহ দিয়েছি। ওকে সবটা খুলে ও বলতে পারছি না যতদিন না অব্দি তুমি তোমার মনের কথা ওর নিকট প্রকাশ করো। আমি পারতাম আগেই বিয়ে টা ভেঙে দিতে কিন্তু ওর কাছে মিথ্যা বলার তো একটাই কারণ আগে বললে মামা কখনও মানতেন না।যেভাবে হোক বিয়েটা করিয়ে দম নিতেন। তাই তো বিয়ের দিনই মুখ্য চাল টা চালতে হল। ”
বাকরুদ্ধ হয়ে গেল তুলি। তাহলে সব আদ্রর প্ল্যান মোতাবেক হয়েছে। আদ্রর হাত শক্ত করে ধরল তুলি। চোখ বুঁজে ফেলল আদ্র। তুলির নখ গিয়ে বিঁধছে হাতে। তবুও যেন ব্যাথার বদলে পরম শান্তি অনুভব করছে আদ্র। ধীর কন্ঠে তুলি শব্দ করে উঠল।
–“আহান ভাই! ”
–“তুলি?”
–“হুম”
–“তুই ভাইয়ার পাশে আছিস? তুলি ফোন কেন ধরছিলি না বোন?”
–“তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ আহান ভাই। সেদিন বিয়ে টা না ভাঙলে আমি হয়তো এই মানুষ টা কে কখনও ভালোবাসতে পারতাম না। অনেক ধন্যবাদ তোমাকে।”
চোখ জলে টুইটুম্বুর হয়ে উঠল তুলির। কন্ঠটাও ভেজা। আহান হালকা হেসে জবাব দিল,
–” সবই আদ্র ভাইয়ার কৃতিত্ব তুলি। ওনি তোকে খুব ভালোবাসে। তোকে পাওয়ার জন্য কখনও ব্যাকুল হয় নি। জোর করে কেড়ে ও নিতে চায় নি। ধীরে ধীরে আগলে রেখেছে দিনের পর দিন। তোর ঢাকা যাওয়ার পিছনে ও আদ্র ভাইয়ার হাত। মামা তো,,”
সমাপ্ত করতে দিল না আদ্র। গম্ভীর স্বরে বলে উঠল,,
–“আহান এখন রাখছি। সচেতন হয়ে কথা বলা উচিত ভাই। কাল ফোন দিব আমি।ভালো থাকিস।”
কল টা কেটে দিয়ে তুলির দিকে তাকাতেই চোখে পড়ল তুলির অশ্রুসিক্ত নয়ন। আলতো করে চোখের পানি মুছে দিল আদ্র।
–“ঘুমাবে না?”
–“উহু! আমার ভয় হচ্ছে আদ্র। ”
–“কেন?”
–“কেউ কেঁড়ে নিবে নাতো আমার ভালোবাসা গুলো?”
–“কারো পক্ষেই সম্ভব না। আদ্রর ভালোবাসা তুলার-ই প্রাপ্য।”
তুলা ডাকটা শুনে টলটলে চোখ নিয়েই ফিক করে হেসে দিল তুলি। তুলি কে হাসতে দেখে আদ্রর ঠোঁটে ও ভেসে এল এক রাশ প্রশস্ত হাসি। নিশ্চুপ হয়ে তুলি জরিয়ে রইল আদ্রর বুকে। এক সময় ঘুমিয়ে গেল। তুলির কোনো রেসপন্স না পেয়ে কোলে তুলে নিল আদ্র। নিজের রুমে এনে শুয়ে দিল তুলি কে। ফ্রেশ হয়ে নিজে শুয়ে পড়ল সোফায়। অজানা আশঙ্কায় ঘুম ধরা দিচ্ছে না আদ্রর চোখে। পাশ ফিরে তুলির দিকে তাকিয়ে রইল এক দৃষ্টিতে। ঘুমন্ত তুলি কে কোনো হরণকারী মনে হচ্ছে আদ্রর কাছে। এই যে নিজের ঘুমন্ত তৈলাক্ত চেহারায় হরণ করে নিচ্ছে আদ্রর হৃদপিণ্ড। দৃষ্টি স্থির করে রাখতেই মাঝ রাতের দিকে দু চোখ লেগে এল আদ্রর। আচমকাই নিজের উপর কারো ভর অনুভব করতেই হকচকিয়ে উঠল। সদ্য লেগে আসা চোখ দুটো টেনে খুলল বহু কষ্টে। ঝিম ধরে গেছে মাথা টা। চোখে ভাসমান হল তুলির ফ্যাকাশে মুখটা। কি সুন্দর করে মেয়েটা তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে! একটু নড়ে উঠল আদ্র। দু হাত তুলির পিঠে রেখে বলল,,,
–“এখানে কি করছো তুলি? বিছানায় যাও।”
–“উঁহু! ”
–“কেন?”
ঘুম ঘুম স্বরে তুলি জবাব দিল,,
–“আমি আপনার বুকে মাথা রেখে ঘুমাব আদ্র।”
গলা শুকিয়ে গেল আদ্রর। অসার হয়ে পড়ল হাত -পা।শুকনো কন্ঠে বলল,,,
–“এটা অন্যায় তুলি। প্লিজ খাটে গিয়ে ঘুমাও।”
–” আপনার বুকে ঘুমানো অন্যায়? ঠিক আছে আমি কখনও আপনার বুকে আসবো না। শূন্য থাকুক আপনার বাহু।”
স্তব্ধতা ঘিরে ধরল আদ্র কে। রক্তের ন্যায় টকটকে লাল হয়ে গেল দু চোখ। তুলি কে নিমিষেই মিশিয়ে নিল নিজের বাহুতে। চোয়াল শক্ত করে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,,
–” ফারদার এমন কথা বলবে না তুলি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তুমি আমার বুকেই থাকবে। আমি বেঁচে থাকা পর্যন্ত এ বুক কখনও শূন্য হতে দিব না। যদি কখনও তুমি বিহীন বুক টা শূন্য হয়ে যায় তবে নিঃশ্বাস টুকু ও হয়তো আমার সঙ্গ ছেড়ে দিবে।”
হতভম্ব হয়ে মাথা তুলে আদ্রর মুখ বরাবর মুখ তুলে চাইল তুলি। চোখে তার পানি চিকচিক করছে। হৃদয়ে ব্যাথা অনুভব হচ্ছে। আদ্র বিহীন যে এখন তুলি নিজেও বিলীন হয়ে যাবে। শত চেষ্টার পরেও চোখের জল বাঁধ মানে নি। টুপটুপ করে ঝরে পড়তে লাগল আদ্রর গালে। মাদকতায় ভরপুর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ঠোঁট প্রসারিত করল আদ্র।
–“এই ছিচকাদুনে মেয়ে। কান্না বন্ধ করো। মনের গহীনে তোমার কান্না গুলো রক্তের মতো ঝড়ে পড়ছে। রক্ত বর্ণ হয়ে উঠছে আমার হৃদপিণ্ড টা।”
নাক টেনে কান্না থামানোর চেষ্টায় তুলি। না পেরে আদ্রর বুকে নাক ঘষে চোখের পানি মুছল। কলিজা কেঁপে উঠল আদ্রর। যেই ছেলেটা একটু ডাস্ট দেখলেই পুরো বাড়ি মাথায় তুলত, কাপড় পরার ব্যাপারে সবসময় সচেতন থাকত, একটু খানি দাগ লাগলে মেজাজ চওড়া হয়ে যেত সেই গম্ভীর, সুন্দর, স্টাইলের ব্যাপারে সচেতন ছেলেটার বুকে হাঁটুর বয়সী একটা কিশোরী মেয়ে কতটা অবলীলায় নাকের পানি, চোখের পানি মুছতে ব্যস্ত। আদ্র নিজেও ভীষণ অবাক। আজ কেন তার শরীর ঘিনঘিন করছে না? কেন অসম্ভব রকম ভালো লাগা সৃষ্টি হচ্ছে? কেন ক্ষণে ক্ষণে কেপে উঠছে কলিজা? ভালোবাসার কি এতোই জোর? মানুষ কে কেমন বেহায়া করে তুলে! বরফের মতো জমে যাওয়া মন টা কে গলিয়ে তরলে রূপান্তরিত করে দেয়। কঠিন হৃদয় ও কাঁপিয়ে তুলে। আর ভাবতে পারছে না আদ্র। এই মেয়েটা কে হারালে নিঃশেষ হয়ে যাবে সে। বুকের মাঝে লুকিয়ে রাখা ছাড়া আর তো কোনো উপায় দেখতে পাচ্ছে না এ মুহুর্তে। প্রেয়সীকে নিজ বাহুতে চিরদিনের জন্য আবদ্ধ করে নিতে সামনে যে ভাঙতে হবে দেয়াল। তুলি নাক টেনে কাঁদতে কাঁদতে আদ্রর বুকটা ভাসিয়ে দিয়েছে। আদ্র রসাত্মক ভঙ্গিতে বলে উঠল,,
–“অল্প বয়সী মেয়েদের এই এক সমস্যা। কিছু হতে না-হতেই পড়ে যায় কান্নার রোল। আবেগে টুইটুম্বুর থাকে মন যার ফলে কান্না টা ও হয় দীর্ঘক্ষণ। তা তুলা কাঁদতে কাঁদতে আজ বুঝি আমার বুকেই নদী বানাবে নাকি সাগর?”
তীক্ষ্ণ চোখে চাইল তুলি। সাথে সাথেই ভেসে এল আদ্রর কন্ঠ,,
–“এভাবে দৃষ্টিপাত করবে না তুলা। হৃদয়ে লাগে খুব। শেষ মেশ একজন হার্ট সার্জন হয়ে নিজেই না হার্ট এট্যাকে অক্কা পেয়ে যাই।”
আদ্রর মুখ এক হাত দিয়ে বেশ শক্ত করে চেপে ধরল তুলি। কান্নামিশ্রিত স্বরে বলে উঠল,,
–” আপনি বড্ড বেশি বকছেন আদ্র। আর এমনটা বলবেন না প্লিজ। আপনি হীনা যে আমি হারিয়ে যাব। আমার কোমল হৃদয়ে আপনি কেন ভালোবাসা জাগালেন দূরেই যখন যাবেন? কোথাও যেতে দিব না আমি। শাড়ি পড়ব। পড়ে আঁচলে আপনাকে বেঁধে রাখব আর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলব। আপনার ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে থাকব চিরদিন, চিরকাল, প্রতিটা মুহুর্তে। লোকে দেখে যেন বলতে পারে ইশ্ কতো ভালোবাসা! গভীর প্রণয়। আর ছেলেটা বড্ড বউ পাগল।”
মুহুর্তেই আদ্রর চোখে মুখে ফুটে উঠল উজ্জ্বলতা। তুলি কে মুগ্ধ হাসি উপহার দিয়ে বলল,,
–“তাই নাকি?”
–“একদম।”
আদ্রর চেহারার দিকে কিছুক্ষণ মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থেকে বলল,,
–“আপনি হাসলে এতো সুন্দর লাগে কেন আদ্র? ছেলেদের হাসি এতো মুগ্ধ হয়? আপনি হাসলে আমার বুকের বা পাশ টা ধুক করে উঠে। হৃদপিণ্ডে অসহ্য পীড়ন হয়। আপনি তো হার্টের ডাক্তার। যন্ত্রণার উপশম নাহয় আপনিই হবেন।”
ভয়ংকর প্রলয় হতে লাগল আদ্রর ভিতর। তুলির ভালোবাসাময় মিষ্টি মিষ্টি কথা ভিতর থেকে নাড়িয়ে দিচ্ছে তাকে। ঝাপটে ধরে তুলি কে চেপে ধরল নিজের বাহুতে। মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে উচ্চারিত করল,,,
–“ঘুমোও তুলি। সকালে উঠতে হবে তো।”
–“হুম।”
_________
বসন্তের দুপুরে পাপড়ি মেলে থাকা শিমুলের রক্তিম আভা মন রাঙায় তো বটেই, ঘুম ভাঙায় সৌখিন হৃদয়ের। শিমুল বনের রক্ত রাঙা সৌন্দর্য দেখা মেলে বছরের একটি মাসে এবং তা হল–“বসন্ত। ” বসন্ত এলেই শিমুল গাছে ফুলে ফুলে ভরে উঠে। শিমুল বাগান যাদু কাটা নদীর তীরে অবস্থিত যা একশ বিঘার বেশি জায়গা জুড়ে বিস্তৃত। ওপারে ভারতের মেঘালয় পাহাড়, মাঝে যাদু কাটা নদী আর এপাড়ে শিমুল বাগান।সব মিলেমিশে গড়ে তুলেছে প্রকৃতির এক অনবদ্য কাব্য। এ যেন কল্পনার রঙে সাজানো এক শিমুল প্রান্তর।
প্রকৃতির চোখ ধাধানো এই সৌন্দর্য দেখে লাল শাড়ি পরিহিতা তুলি ও যেন মিশে যাচ্ছে প্রকৃতির রক্তিম আভায় ছেয়ে থাকা এই সৌন্দর্যের মাঝে। মিনিট দশেক হবে সবাই শিমুল বাগানে এসেছে। সাথে এসেছেন একজন গাইড। তখন থেকে তুলি চারপাশে তাকাচ্ছে ব্যস্ত ভঙ্গিতে। এতো সুন্দর ও কোনো জায়গা হয়? কখন থেকেই তুলির মন শুধু এটাই প্রশ্ন করে যাচ্ছে। পাশে শাড়ি পরিহিতা বাকি তিন রমণী ও ঘুরে ঘুরে দেখছে। হাতে টান পড়তেই সম্বিত ফিরে পেল তুলি। আদ্রর হাতে বন্দী তার একটা হাত। শিমুল গাছ গুলো থেকে চোখ সরিয়ে আদ্রর উপর স্থাপন করল তুলি নিজের দু চোখ। ড্যাবড্যাব চোখে চেয়ে রইল আদ্রর দিকে। মনে মনে বলে উঠল,,,
–“প্রকৃতি ও তো এমনভাবে টানে না আদ্র যেমন করে আপনার প্রতি টান অনুভব করি আমি। আপনি তো মোহময়। আপনাকে দেখলেই মনে শীতলতা অনুভব হয়। লাল রাঙা শিমুলের চেয়ে লাল রাঙা আদ্রই মনোমুগ্ধকর।”
তুলির দিকে অপলক নয়নে চেয়ে আছে আদ্র। তুলি কে শাড়ি তে লাল টুকটুকে বউ মনে হচ্ছে তার। শুধু ঘোমটা টাই বাকি। তুলি কে টেনে নিজের দিকে ফিরাল সে। শাড়ির আঁচল টা টেনে ঘোমটা দিয়ে দিল মাথায়। ভীষণ অবাক হল তুলি। পাশাপাশি লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠল। চোখে মুখে ও ফুটে উঠল লজ্জার ছাপ। আদ্রর সাথে আরেকটু ঘেঁষে দাঁড়াল। ফিসফিস করে বলল,,,
–“আপনি লাল পাঞ্জাবি কেন পড়েছেন আদ্র?”
তুলির ফিসফিস করে বলা বাক্যটা শুনে কিছুটা ঝুঁকল আদ্র। মেয়েটার কন্ঠস্বর টা ও আজকাল পাগল করে দেয় তাকে। আস্তে করে জবাব দিল,,,
–” তুলার সাথে একটু ম্যাচিং করে পড়ার চেষ্টা। ”
—” লাল শাড়ি, লাল পাঞ্জাবি-ই আনতে হলো আপনার? আপনি কি জানেন আপনি আমায় বিমোহিত করছেন, অভিভূত করছেন, এক রাশ মুগ্ধতায় জড়িয়ে নিচ্ছেন, নিজের মাঝে হারাতে বাধ্য করছেন?”
–“জানতাম না তবে এখন জানতে পারলাম।আমার মাঝে হারানোই তোমার মঙল। খুঁজে নিয়ে হৃদয় কুঠীরে লুকিয়ে রাখব যত্ন করে।”
আর কিছু না বলে তুলি আদ্রর এক হাতের বাহু জরিয়ে হাঁটতে লাগল। সবাই আলাদা আলাদা হয়ে ঘুরে ঘুরে দেখছে। আমরিন ও নিবিড় হাটছে পাশাপাশি। শাড়ি তে আমরিন কে একুশ বছরের যুবতি লাগছে নিবিড়ের কাছে। নীরবতা ভেঙে আমরিন বলল,,,
–“নিবিড় ভাই আমি কাকে ভালোবাসি আপনি কি জানতে ইচ্ছুক না?”
আবারও সেই কথা। মেয়েটার বড্ড বেশি সাহস। রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে এল নিবিড়ের। আমরিন কে ঠাটিয়ে একটা চড় মারতে পারলে হয়তো এ মুহুর্তে বেশ স্বস্তি পেত সে। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে অন্যদিকে চলে যেতে নিলে হাতটা ধরে বাঁধা প্রদান করল আমরিন। চমকে গেল নিবিড়। ফিরে তাকাতেই চোখে পড়ল চশমার নিচে লুকিয়ে থাকা আমরিনের মোহময় দৃষ্টি। দৃঢ় কন্ঠে আমরিন বলে উঠল,,,
–“যদি বলি আপনাকে ভালোবাসি?”
বিলম্ব না করে আমরিন কে টেনে নিজের কাছে নিয়ে এল নিবিড়। আমরিনের কপালে আসা অবাধ্য চুল কানের পিছনে গুঁজে হালকা হেসে বলল,,,
–“তবে আমাকেই ভালোবাসতে হবে চিরকাল। ”
আলতো হেসে আমরিন সায় জানিয়ে বলল,,
–“রাজি আছি।”
আদ্র ও তুলি কে পাশাপাশি হাঁটতে দেখে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রিমি। পাশ থেকে ভেসে এল পুরুষালি কন্ঠস্বর
–“জেলাস ফিল হয় না?”
রিমি আনমনেই উত্তর দিল,,
–“না। আমার কাছে ভালোবাসা মানে ত্যাগ। ত্যাগের মাধ্যমে যে এতো সুখ আছে এমন দৃশ্যটা না দেখলে কখনও উপলব্ধি করতে পারতাম না। ভালোবাসলেই কি পেতে হবে? থাকুক না আমার এক তরফা ভালোবাসা আমার মন মাঝারে। সুখী হোক ওরা দু’জন। ”
–“চিরকুমারী থাকবি?”
প্রশ্ন টা কর্ণগোচর হতেই হুঁশ এল রিমির। পাশ ফিরে তাকাতেই চোখে পড়ল সাগরের হাসোজ্জল চেহারা টা। ছেলেটা কিভাবে বুঝে গেল তার চাহনি? তার মনের কথা? মুখে হাসি বজায় রেখে বলল,,,
–” না। চিরকুমারী থাকব না। আমিও একটা সংসার চাই। একটা মানুষ কে বলতে চাই ডাক্তার আদ্র আহনাফ কে আমি কতোটা ভালোবাসতাম, কতটা বাসি। ”
–“আমার অর্ধাঙ্গিনী হবি?”–সাগরের সোজাসাপ্টা প্রশ্ন।
থমকাল রিমি। একটু হেসে বলল,,,
–“তোর মতো ইঁচড়েপাকার কাছে বিয়ে বসতে আমার বয়েই গেছে। প্রেম তো কম করিস নাই। তা তোর গার্লফ্রেন্ড গুলোর কি বিয়ে হয়ে গেছে? সেই বিরহে বুঝি আমাকে প্রস্তাব দেওয়া?”
—” প্রেম কম করি আর বেশি আজকাল হঠাৎ করে ভালোবাসার উদয় হয়েছে তোর প্রতি। আজকাল বললে ভুল হবে গত একটা বছর ধরে তোর ভালোবাসায় ঘায়েল হচ্ছি আমি। বিয়ে তো বসবি তাই না? অন্য কারো হওয়ার চেয়ে আমার হলে কি মন্দ হয় রিমি?
সাগরের কন্ঠে আকুলতা দেখে রিমি স্তব্ধ হয়ে গেল। একটু হেসে বলল,,,
–“ঢাকা ব্যাক করে প্রস্তাব পাঠিয়ে দিস বাসায়।”
_____
ভয়াবহ এক কান্ড ঘটিয়ে নাকের পানি চোখের পানি এক করে ফেলেছে তুলি। তুলির কান্নারত চেহারা দেখে অস্থির হয়ে পড়েছে আদ্র। রাগ ও হচ্ছে প্রচন্ড। কেন যে মেয়েটা এতোটা পাগলামি করে? রাগের মাত্রা ক্রমশ বেড়েই চলেছে আদ্রর। তুলির চোখের পানি ছুরির মতো গাঁথছে তার বুকে। নিজেকে শান্ত করে,,,
#আকাশে_তারার_মেলা
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব -১১
নিজেকে শান্ত করে হাঁটু গেড়ে নিচে বসল আদ্র। সবাই হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তুলির কান্ডে হাসবে নাকি কাঁদবে বুঝতে পারছে না। রাগ ঝেড়ে তুলির পায়ে হাত দিল আদ্র। সাথে সাথেই প্রচন্ড জোরে চিল্লিয়ে উঠল তুলি। ব্যাথায় চোখ খিঁচে পা সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতেই গম্ভীর স্বরে ধমকে উঠল আদ্র। ভয়ে চুপসে গেল তুলির মুখ। কিন্তু চোখে মুখে ব্যাথার প্রভাব স্পষ্ট। আদ্র আঁড়চোখে এক নজর তাকিয়ে হাত টেনে কোলে তুলে নিল । চোখ বন্ধ রেখেই আদ্রর গলা জরিয়ে ধরল তুলি। ভাবতেই ভীষণ লজ্জা লাগছে তার কি কান্ড টাই না ঘটল একটু আগে। কেন যে শুনল না আদ্রর কথা? অতিরিক্ত বেপরোয়া হলে হয়তো এমনটাই হয়।
কিছুক্ষণ আগে,,
আদ্রর সাথে পাশাপাশি হাঁটছিল। হুট করেই তুলি সামনে একটা পাখি দেখে দৌড় লাগাল। পিছন থেকে আদ্র অনেক ডেকেছে একটু ও শুনে নি মেয়েটা। বার বার চিল্লিয়ে বলেছে আস্তে দৌড়াতে নয়তো শাড়িতে পা ভেজে পড়ে যাবে। কিন্তু কথাগুলো যেন উচ্ছ্বসিত তুলির কর্ণধার হয় নি। আরেকটু বেগ বাড়াতেই ধপাস করে মুখ থুবড়ে পড়ল মাটিতে। নাকে ও পায়ে প্রচন্ড ব্যাথা পেল। জড়তা, লজ্জায় বুকের ব্যাথা ও তীব্র হল। ব্যাথার দাপটের চেয়ে লজ্জায় কাঁদতে লাগল ক্রমশ। সবাই একটু আকটু হাসলেও আদ্রর হাসির বদলে রাগটাই তীব্র।
আদ্রর রাগী ফেইস দেখে তুলির সেই স্মরণীয় থাপ্পড়ের কথা মনে পড়ে গেল। কেন অবাধ্য হল আদ্রর কথার? এখন নিশ্চয়ই রিসোর্টে নিয়ে আরও একটা স্মরণ রাখার মতো ঠাটিয়ে চড় মারবে। ভয়ে থরথর করে কাঁপছে তুলির পুরো শরীর। ভয় টা একটু কমানোর চেষ্টায় আদ্রর বুকে মাথা রেখে চুপ হয়ে রইল। বাকি সবাই এখনও থ মেরে দাড়িয়ে আছে। হঠাৎ অন্তু হেসে বলল,,,
–“যা হয় ভাই ভালোর জন্যই হয়। নইলে কি এমন রোমান্টিক দৃশ্য দেখার সুযোগ পেতাম?”
কপাল কুঁচকে তাকাল পায়েল। অন্তু চুপসে যেতেই এক রাশ হেসে বলল,,
–“এই প্রথম তুমি ভালো একটা কথা বলেছো অন্তু। ”
অট্টহাসিতে মেতে উঠল সবাই। পা চালিয়ে ছুটল আদ্র ও তুলির পিছু পিছু।
রিসোর্টে এনে তুলি কে ধপ করে বিছানায় বসাল আদ্র। ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠল তুলি। তাতে যেন কোনো খেয়াল নেই আদ্রর। ব্যাগ থেকে ফাস্ট এইড বক্স বের করে টুল টেনে বসল তুলির সামনে। সংশয় নিয়ে আঁড়চোখে চাইল তুলি। তার মন বলছে আদ্র বক্স টা দিয়ে তার মাথা ফাটিয়ে ফেলবে এখন। নিজের বাচ্চাসুলভ আচরণে এখন নিজেই প্রচন্ড বিরক্ত সে। নাক ও ফাটাল, পা টা হয়তো ভেঙেই গেছে আবার বিনা টিকেটে সবাই কে কমেডি শো দেখিয়ে দিল। সর্বশেষে এখন বোধহয় মাথা টা হারাতে যাচ্ছে। আদ্র হাত টা বাড়াতেই ভয়ে কেঁদে উঠল তুলি।
–“আমার মাথা ফাটাবেন না আদ্র। আমি আর কখনও আপনার কথার অবাধ্য হব না।”
তুলির ভাঙা গলায় অদ্ভুত এসব কথা শুনে রাগটা দ্বিগুণ হয়ে গেল আদ্রর। তুলো নিয়ে নাকের রক্ত টা ক্লিন করতে করতে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,,,
–“কান্না থামা। নয়তো আজ তোর কপালে শনি আছে। আমার ভালো-মন্দ দুই রূপ সম্পর্কেই তুই অবগত। এখনই কান্না থামা।”
আদ্রর কথা শুনে কান্না থামানোর আপ্রাণ চেষ্টায় লেগে পড়ল তুলি। শক্ত করে আঁকড়ে ধরল আদ্রর বুকের কাছের অংশ। দু চোখ বুঁজে ফেলল। তুলির স্পর্শ পেতেই হৃদয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল আদ্রর। নিমিষেই গায়েব হয়ে গেল রাগ টা। যত্ন করে তুলির নাকে অয়েন্টমেন্ট লাগিয়ে ফু দিল তুলির বন্ধ দু চোখের পাতায়। শিউরে উঠল তুলির সারা শরীর। আরেকটু শক্ত করে খামচে ধরে রাখল আদ্র কে। ঘন ঘন দু চোখের পলক ঝাপটিয়ে চোখ মেলে তাকাল আদ্রর দিকে। আদ্রর নীল বর্ণের চোখ জোড়া নিজের উপর সীমাবদ্ধ দেখে স্তম্ভিত হয়ে পড়ল তুলি। হৃদয় জুড়ে হতে লাগল ভয়াবহ ঝড়। আদ্রর বুক থেকে হাত সরিয়ে কিছুটা পিছে হেলে গেল। মুচকি হেসে আদ্র নিজের ঠোঁট ছোঁয়াল তুলির নাকে। একটা কথা মনে পড়তেই দাঁত কেলিয়ে তুলি বলে উঠল,,,
__”বান্ধবীদের কাছে শুনতাম বয়ফ্রেন্ড চুমু খেলে নাকি জ্বর ও চলে যায়। আপনি কি আমার নাকের ব্যাথা কমানোর জন্য চুমু খেয়েছেন আদ্র?”
বিস্ময়কর দৃষ্টিতে তাকাল আদ্র। তুলির মুখে এমন এক বাক্য শুনে অবাক হয়ে পড়ল। এই মেয়ে বয়সে মনের দিক সবদিক দিয়েই একদম বাচ্চা। নিজের ব্যাগ থেকে ইনজেকশন বের করতে করতে আদ্র ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে জবাব দিল,,,
–“যদি চুমু তেই ব্যাথা কমে যায় তাহলে ইনজেকশনের কি দরকার বলো? এজ অ্যা ডক্টর আমার মতে ইনজেকশন টা দিলেই ব্যাথা কমবে চুমু তে নয়।”
ইনজেকশন দেখে মাথা ঘুরে গেল তুলির। ভয়ে শুকিয়ে গেল গলা। আমতা আমতা করে বলল,,,
–“আমি ইনজেকশন দিব না। আমায় ইনজেকশন দিতে এলে খুব খারাপ হবে কিন্তু। ”
মুখে বাঁকা হাসি ফুটে উঠল আদ্রর। সাবলীলভাবে জিজ্ঞেস করল,,
–“কি হবে শুনি?”
–“আমি কামড়ে দিব আপনাকে। ছোট বেলায় আমি এক ডাক্তারের হাতে কামড় বসিয়ে দিয়েছিলাম। কারণ ওনিও আপনার মতো ইনজেকশন দিতে আসছিল।”
—“তা কোথায় কামড়াবে? গালে,ঠোঁটে? ”
কথা টা বলতে বলতে তুলির হাত টা চেপে ধরতেই সজোরে কামড় বসিয়ে দিল তুলি আদ্রর বুকে। বিস্ময়ে হতবিহ্বল হয়ে গেল আদ্র। সে তো ভেবেছিল তুলি হয়তো মজা করছে কিন্তু সত্যি সত্যিই কামড় বসিয়ে দিল। হাত থেকে ইনজেকশন টা পড়ে গিয়ে হালকা শব্দ করল। তুলির দুই বাহুতে ধরে টেনে বুক থেকে সরিয়ে আনল। বুকে প্রচন্ড বেগে দ্রিমদ্রিম শব্দ হতে লাগল তুলির। নিজের আচরণের উপর এখন নিজেই বিস্মিত তুলি। এখন মনে হচ্ছে বয়স যতই হোক মনে ম্যাচুরিটি আনা টা বেশ জরুরি। নয়তো এই যে এসব অদ্ভুত অদ্ভুত কান্ড করে বসে আদ্র হয়তো তাকে বেহায়া মেয়ের আখ্যায়িত দিতে পারে। নিজের মাথা তুলে তাকাতেও অস্বস্তি হচ্ছে তুলির। আদ্রর কথায় মাথা তুলতে বাধ্য হল। চোখে পড়ল আদ্রর রাগান্বিত দৃষ্টি। সাথে সাথেই অন্তর আত্মা কেঁপে উঠল।
–“আমায় কামড় দিয়ে দেখিয়ে দিলে তোমার দাঁত কতো দারালো তাই না?”
নিশ্চুপ হয়ে বসে রইল তুলি। আচমকা আদ্র কে শার্টের বোতাম খুলতে দেখে কলিজা মোচড় দিয়ে উঠল। চোখ ফিরিয়ে নিল লজ্জায়। কানে আসল আদ্রর রাগী কন্ঠের সুর,,
–“এই মেয়ে এদিকে তাকাও।”
এখনও নিশ্চুপ তুলি। লাল রাঙা মুখ নিয়ে ফিরে চাইল আদ্রর দিকে। প্রথমেই চোখ পড়ল আদ্রর ফর্সা উম্মুক্ত বুকে রক্তে কিছু টা লাল হয়ে যাওয়া স্থানে। বুক টা ধুক করে উঠল সাথে সাথেই। কি করল এটা? তুলির ছোট্ট মনে এক ফালি লজ্জা যেন উড়ে এসে জড়ো হয়ে বসল। বহু কষ্টে আদ্রর চোখের দিকে চাইতেই আঁতকে উঠল। আজ আর নিস্তার নেই। নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারল তুলি। তীক্ষ্ণ নজরে চেয়ে আছে আদ্র।
–“আমার বুক রক্তাক্ত করার শাস্তি তোমায় পেতে হবে।”
শাস্তির কথা শুনেই ঢোক গিলল তুলি। আদ্রর দিকে করুন চোখে তাকাতেই বলে উঠল,,
–” গুণে গুণে দশ টা চুমু দিবে তুমি আমার বুকের ক্ষত জায়গা তে। নয়তো আমি গুণে গুণে ঠিক দশটা থাপ্পড় লাগাব তোমার গালে।”
অবলীলায় কথা গুলো বলে চোখের দৃষ্টি তুলির উপর স্থির রেখেই বসে রইল আদ্র। বেলুনের মতো চুপসে আছে তুলির মুখটা। মনে হল যেন জোর করে তাকে কেউ করলার জুস খাইয়ে দিয়েছে। মনে মনে ভীষণ হাসি পেল আদ্রের। মেয়ে টা কে জ্বালাতে এখন খুব ভালো লাগে তার। ছোট্ট তুলি যখন লজ্জায় মুখটা কে নিচু করে ফেলে তখন তার খুব ইচ্ছে হয় নিজের সাথে মিশিয়ে নিতে। বুকের মাঝখানে লুকিয়ে ফেলতে। লুকাবে খুব শীগ্রই মেয়েটা কে আবদ্ধ করে ফেলবে নিজের বাহুদ্বয়ে। দরকার হলে সবকিছু ধ্বংস করে দিবে তবুও এই মেয়েটা কে চায় তার। তপ্ত একটা নিঃশ্বাস ছাড়ল। তুলির কানে আদ্রের কথাটা এখনও প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। চোখ জোড়া বুঁজে আদ্রর বুকের কাছে মুখ নিয়ে বলল,,,
–“আপনি কিন্তু তাকাবেন না আদ্র। আপনি তাকালে আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে। প্লিজ চোখ দুটো বন্ধ করে রাখবেন। কোনো ক্রমেই অবলোকন করবেন না আমাকে।”
তুলির শ্রুতিমধুর লজ্জিত স্বর কর্ণকুহর হতেই আদ্রর চোখ জোড়া বন্ধ হয়ে এল আবেশে। কিছু সেকেন্ডের ব্যবধানেই অনুভব করল নরম ঠোঁটের স্পর্শ। ঠোঁটের কোণে প্রতীয়মান হল এক তৃপ্ততার মৃদু হাসি। পর পর দশ দশটা চুমু দিয়ে সরে এল তুলি। নিজের দু হাত দিয়ে ঢেকে ফেলল শ্যামলা মুখশ্রী। আদ্র ও বসে থাকতে পারল না। মজা করতে গিয়ে নিজেই ফেঁসে গেল ভালোবাসার স্নিগ্ধ সম্মোহনে। ঘোর কাটতেই বেরিয়ে এল রুম থেকে। নিজের ফোন বের করে স্ক্রিনে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল আদ্র। মেসেজ ও কলের ভিড়। সায়েরা বেগম ফোন দিয়েছেন অনেক গুলো। ফোন ব্যাক করতেই ওইপাশ থেকে সায়েরা বেগম বলে উঠলেন,,,
–” তোর সেমিনার কবে শেষ হবে আদ্র? এই মাসে দু দু’বার সেমিনার। ইনশিতার বিয়ের ডেট ঠিক করতে আসবে পরশু রনকের ফ্যামিলি। তুই আসলে ভালো হতো। তুই তো জানিস,,,
–” বুঝেছি আম্মু। আর বলতে হবে না। কাল রাতে বাসায় থাকব। রাখছি।”
ভারী গলায় শেষ কথাটা বলে ফোনটা রেখে দিল আদ্র। বুক চিরে বেরিয়ে এল দীর্ঘশ্বাস। চোখে মুখে পানি দিয়ে তুলির কাছে আসল ফের। তুলি এখনও লজ্জায় মুখ ঢেকে রেখেছে। মিনমিন করে আদ্র বলে উঠল,,–
“তুমি আমার প্রশান্তির আরেক নাম তুলা। যতদিন পর্যন্ত এ হৃদয়ে তোমার বিচরণ চলবে ততদিন পর্যন্ত সুস্থ থাকব আমি। শান্তি বিরাজ করবে আমার অস্তিত্ব জুড়ে।”
পায়ে কারো স্পর্শ অনুভব করল তুলি। অনুভূতি গুলো মনে নাড়া দিতে লাগল অনবরত। এক হাত সরিয়ে আদ্র কে দেখতেই কিছু টা আওয়াজ করে বলল,,
–“কি করছেন আদ্র? পায়ে হাত দিবেন না প্লিজ। ”
–” এতো ফর্মালিটি অথবা সংকোচ বোধের কিছুই নেই তুলা। আমি তোমার পায়ে হাত দিতেই পারি। কারণ ফার্স্ট ইয়ার ফাইনাল এক্সাম শেষ হলেই বিয়ে করছি আমরা।তখন তো তোমার আঠারো হয়ে যাবে। হবু স্বামী বউয়ের সেবা করতেই পারে তাই না?”
“বউ” শব্দ টা এতো মধুর হয়? নাকি আদ্রর মুখেই এতো মধুর শুনাচ্ছে? চোখের পলকেই যেন তুলি এক সংসার কল্পনা করে ফেলছে। তবুও ভয় লাগছে তার। নরম কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,,,
–“খালা মণি, খালু সবাই মানবে তো?”
–“আমায় বিশ্বাস করো তো?”
পায়ে মালিশ করতে করতে প্রশ্ন টা তুলির দিকে ছুঁড়ে দিল আদ্র। তুলির ঠোঁটে প্রশস্ত হাসি। লম্বা একটা শ্বাস টেনে বলল,,
–“আপনাকে বিশ্বাস করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই আমার। যার প্রেমের মোহনায় হারিয়েছি আমি সেই তো আমার শেষ অবলম্বন। আপনি ঠকালে চিরতরে বিলীন হয়ে যাব। কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস আপনি কখনও ঠকাবেন না আমায়। আপনার ভালোবাসার তুলনায় আমার কিছুদিনের ভালোবাসা অতি নগন্য। বছরের পর বছর আড়ালে সার্থহীন ভাবে যে আমায় ভালোবেসেছে সে কখনও ঠকাতেই পারে না।”
–” আমরা আজ ঢাকা চলে যাব তুলি। একটা অনুরোধ থাকবে তোমার কাছে কেউ যেন না জানে আমি ও তুমি সিলেট ছিলাম। ”
–“কখনও বলব না। সিলেট শহর টা কে ও ভুলতে পারব না। আমাদের দু জনকে ভালোবাসায় সিক্ত করার অবদান কিন্তু এই শহরের অনেক। এই শহরের চেয়ে ও বেশি আপনার।”
তুলির কপালে আলতো করে ভালোবাসার স্পর্শ একে দিল আদ্র। কপালে কপাল ঠেকিয়ে ঘোর লাগা কন্ঠে বলল,,
–“ভালোবাসি তোমায় তুলি। খুব বেশি ভালোবাসি। ”
চোখের কার্ণিশে জমা হল জল। “ভালোবাসি” শব্দ টা তুলির তৃষ্ণা বাড়িয়ে দিল শতগুণ। সুখের জমায়িত পানি কোনো বাঁধা না মেনে গড়িয়ে পড়ল গাল বেয়ে। শুষে নিল আদ্র। গালে ও একে দিল ঠোঁটের গভীর ছোঁয়া। তুলির ইচ্ছে করছে সময় টা থমকে যাক। সারাজীবন আঁটকে থাকুক এই পরম শান্তির সময়টায়। ভালোবাসায় মেতে থাকুক সবটুকু প্রহর। থেমে গেলে কি খুব খারাপ হবে? থেমে যাক না সময়টা। লেপ্টে থাকুক তুলি সারাটা কাল এভাবেই আদ্রর বুকে।
—————–
রাতের আঁধারে ক্লান্ত তুলি ঘুমে মগ্ন আদ্রের বাহুতে। সিলেট থেকে ঢাকা এসে পৌঁছাল খানিকক্ষণ আগেই। লং জার্নি তে ক্লান্ত হয়ে পড়ে তুলি। গাড়ি এসে থামল সাগর দের বাসার সামনে। তুলি কে ধীর কন্ঠ ডাকল আদ্র। একটু নড়েচড়ে তুলি আবারও ঝাপটে ধরল আদ্র কে। ঘুমের ঘোরে যে মেয়েটা কি করছে সে যদি বুঝত তাহলে লজ্জায় মরে যেত। মাথায় হাত বুলিয়ে আবারও ডাকতেই আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসল তুলি। ঘুম ঘুম চোখে চারপাশে চোখ বুলাতেই গাড়ির বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল সবাইকে। জায়গা টাও বেশ অপরিচিত তার নিকট। আদ্রর দিকে তাকাল জিজ্ঞাসা সূচক দৃষ্টিতে। আদ্রর ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি বহমান। তুলির সচেতন মন বলে উঠল,,
–“তুলি তোর ডাক্তার সাহেব এতো হাসে কেন? ওনার তো গুমরো মুখো হওয়া উচিত ছিল। দেখিস এই হাসিতে ঘায়েল হয়ে কোন মেয়ে না জানি তোর কাছ থেকে কেঁড়ে নেই ওনাকে।”
ভাবান্তর হতেই তুলি হাত বাড়িয়ে শক্ত করে জরিয়ে ধরল আদ্র কে। ভ্রু কুঁচকাল আদ্র। কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,,
–“কি করছো তুলা? বাহিরে সবাই ওয়েট করছে তো পরী। আমাকে ছেড়ে একটু বাহিরে চলো।”
তুলির অবাধ্য মন বলে উঠল,,
–“আপনি এতো সুন্দর অথচ পরী ডাকছেন আমায়? ”
–“শ্যামবতী হলেও আমার হৃদয়ের গহীনে আবদ্ধ হওয়া রূপবতী কন্যা তুমি। তোমার এই মায়ায় জরিয়েই তো ডেকে এনেছি নিজের সর্বনাশ। তোমায় ছাড়া নিশ্বাস টুকু নেওয়া কষ্টকর হয়ে যায়। ”
লাজুক তুলি ছেড়ে দিল আদ্র কে। খুব করে বলতে ইচ্ছে করল,,–“এমন হৃদয় নাড়িয়ে দেওয়া কথা কেন বলেন আদ্র? আপনি কি দেখতে পান না আমার মনটা দিন দিন অসুস্থ হয়ে পড়ছে? কঠিন অসুখে ভুগছে।”
আদ্রর সাথে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এল তুলি। পায়েল ও রিমি তুলি কে জড়িয়ে ধরল শক্ত করে। মুচকি হেসে বলল,,
–“আবারও দেখা হবে কিউটি।”
আমরিন ইশারায় নিবিড় কে বিদায় জানাল। আদ্র আজ সাগর দের বাসায় থাকবে। ড্রাইভার কে ভালোভাবে পৌঁছে দিতে বলল ওদের।সবাই কে বিদায় জানিয়ে তুলি গাড়িতে উঠতে যেয়েও ফিরে তাকাল আদ্রর দিকে। কালই তো আদ্র বাসায় যাবে তবুও সামান্য একটু দূরত্ব যেন তুলি মেনে নিতে পারছে না। বার বার দ্বিখণ্ডিত হয়ে যাচ্ছে মন। আশঙ্কা জাগছে প্রিয় মানুষ টা কে হারিয়ে ফেলার। করুন চোখে চেয়ে দিক বিদিক ভুলে দৌড়ে গিয়ে ঝাপটে ধরল আদ্র কে। ফুপিয়ে কেঁদে উঠল। অস্বাভাবিক কন্ঠে বলে উঠল,,,
–“আমি যাব না আদ্র। আপনিও চলুন প্লিজ। আপনাকে ফেলে যেতে মন সায় দিচ্ছে না। এতটুকু দূরত্ব ও আমার মনে আঘাত করছে। ”
হতবুদ্ধি হয়ে গেল আদ্র।বুকের সাথে শক্ত করে চেপে ধরল তুলির মাথা টা। রিমি,অন্তু,নিবিড়, পায়েল,আমরিন,সাগর সবাই খুব বেশি বিস্মিত হল। মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে পিচ্চি মেয়েটা কত ভালোবেসে ফেলেছে আদ্র কে। ভালোবাসা আসলেই সময় বেঁধে হয় না। কখনও কখনও ক্ষণিকের দেখাতেও অচেনা,অজানা মানুষের জন্য ভালোবাসার উদয় হয় মনের পিঞ্জিরায়। আর সেই জায়গায় তুলি তো আদ্রের এতো বছরের জমানো ভালোবাসায় ডুব দিয়েছে যার ফলে আদ্রর প্রতি তার অনুভূতি, মায়া,ভালোবাসা আরও প্রখর হয়ে উঠেছে। মাথায় হাত রেখে মিহি সুরে আদ্র উচ্চারণ করল ভালোবাসাময় কিছু বাক্য।
“আমাকে কেঁড়ে নেওয়ার সাধ্য কারো নেই তুলি। একটা কথা কি জানো? তুমি ছাড়া তো আমিই জীবন্ত লাশ হয়ে যাব। তাই নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে পৃথিবীর যেই প্রান্তেই থাকি না কেন আমি তোমার কাছেই ছুটে যাব। ছুটে যাব স্নিগ্ধ প্রণয়ের গভীর রঙে নিজেকে রাঙিয়ে নিতে। নিজের ঠোঁটে একটু প্রাণোচ্ছল হাসি ফুটাতে। একটু তৃপ্ততার শ্বাস নিতে।”
আদ্র কে ছেড়ে দিয়ে গাড়িতে উঠে পড়ল তুলি। জানালা দিয়ে চেয়ে রইল অপলকভাবে। আদ্রের মুখে প্রশস্ত হাসি ও চোখে ফুটে আছে তুলির জন্য অসীম ভালোবাসা। আদ্র হাত দিয়ে ইশারা করল একটু হাসার। তুলিও ঠোঁটে ফুটিয়ে তুলল অমায়িক মুগ্ধ হাসি।
চলবে,,,
(