আকাশে তারার মেলা পর্ব ১২+১৩

#আকাশে_তারার_মেলা
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব -১২

বেশ গরম পড়ছে আজকাল। এতো লং জার্নি তার উপর আদ্র ও তার মাঝে সাময়িক দূরত্ব সবমিলিয়ে ক্লান্ত তুলি। হতাশা ঘিরে ধরেছে মন কে। সায়েরা বেগমের সাথে কথা বলে মাত্র রুমে আসল। লম্বা একটা শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে আসতেই তুলির ছোট্ট বাটন ফোন টা বেজে উঠল শব্দ করে। ফোন হাতে নিতেই চোখে পড়ল অচেনা একটা নাম্বার। ভ্রু কুঁচকাল তুলি। প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে ফোনটা রিসিভ করতেই আপনাআপনি খুশির ঝলক ভেসে উঠল চেহারায়।

-কি করছো?

আদ্রর মধুর স্বর কর্ণকুহর হতেই কেঁপে উঠল তুলি। মাত্র শাওয়ার নিয়ে আসার পর শরীরে শীতল বাতাস অনুভব করতেই ক্ষণে ক্ষণে মৃদু কাঁপছে। নরম কন্ঠে জবাব দিল,,

–কিছু না। আপনি?

-শুয়ে আছি।

–ওহ্।

–তুলি???

হৃদপিণ্ডের উঠা নামা দ্রুত হয়ে গেল তুলির। এভাবে কেউ ডাকে? সামান্য ডাকে এমন হৃদয় কাঁপানো অনুভব হয়? তুলি যেন নিজের মুখের ভাষা টুকু হারিয়ে ফেলল। তবুও বহু কষ্টে অস্ফুটস্বরে উচ্চারণ করল,,

–“হু।”

—“ভেজা চুলে থাকলে ঠান্ডা লেগে যাবে তুলা। তাড়াতাড়ি চুল গুলো মুছে নাও।”

স্তব্ধ হয়ে গেল তুলি। পা দুটো ভেঙে আসছে। আর না পেরে ধপ করে বসে পড়ল বিছানায়। বুকে অজস্র অনুভূতির ছড়াছড়ি। আদ্র কিভাবে জানল সে ভেজা চুলে দাড়িয়ে আছে? ঘাবড়ানো কন্ঠে প্রশ্ন করল,,

–“আপনি কিভাবে জানলেন?”

–“এই কয়দিনে তোমার আচরণ দিব্যি খেয়াল করেছি। তাই আন্দাজে বললাম।”–হালকা হেসে কথাটা বলল আদ্র।

তুলির যেন তবুও কথাটা বিশ্বাসযোগ্য মনে হল না। আলতো স্বরে আবারও প্রশ্ন করল,

–” সত্যি? ”

–“একদম সত্য। আচ্ছা ডিনার করে ঘুমিয়ে পড়ো। কাল কথা হবে।”

–“আপনি খেয়েছেন?”

–“না খাব।”

—“ঠিক আছে। আল্লাহ হাফেজ। ”

ফোনটা পাশে রেখে হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে চুল শুকিয়ে নিল তুলি। ওড়না টা গায়ে জড়িয়ে ডাইনিং টেবিলে আসতেই চোখে পড়ল আদ্রর বাবা কে। চেয়ারে বসে সালাম দিল তুলি।

–“কেমন আছেন খালু?”

তুলির দিকে এক পলক চেয়ে তিনি গম্ভীর স্বরে জবাব দিলেন,

–“আলহামদুলিল্লাহ। তুমি কেমন আছো? আর ট্যুর কেমন ছিল?”

–“আলহামদুলিল্লাহ খালু। কবে ফিরলেন? ”

–“আজ সকালেই। ”

আর কোনো কথা না বলে তুলি মনোযোগ দিল খাবার খাওয়ায়। আমরিন ও ইনশিতা ও পাশে বসে খাচ্ছে। খাবার শেষ করে আমরিন কে চেপে ধরে ছাঁদে নিয়ে এল তুলি। হতভম্বের চেয়ে রইল আমরিন। তুলির মুখে দুষ্টু হাসি। ছাদে পাতানো দোলনায় বসে আকাশের বুকে প্রশস্ত চাঁদের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল।আমরিন বেক্কলের মতো শুধু চেয়ে থাকল। তুলির হাবভাব ভালো ঠেকছে না তার। নিশ্চয়ই কোনো ফন্দি এঁটেছে নয়তো তাকে বাঁশ দেওয়ার চিন্তা করছে। ছোট্ট করে একটা নিশ্বাস ছেড়ে তুলির পাশে বসে পড়ল আমরিন। সোজাসাপ্টা প্রশ্ন করল,,

–“কি হয়েছে তুলো? এভাবে হাসছিস কেন পাগলের মতো?”

চাঁদের উপর থেকে নজর সরিয়ে আমরিনের দিকে দাঁত কিটে তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল। কপাল কুঁচকে প্রশ্ন করল,,

–“আমি পাগলের মতো হাসছি?”

–“তা নয়তো কি? শেষ পর্যন্ত আমার ভাই একটা পাগল কে ভালোবাসল। হায়! হায়!”

—” তাহলে নিবিড় ভাইয়া ও একটা পাগল মাইয়া রে ভালোবাসে। তুই তো পাগলই। আর পাগলেই পাগল চিনে।”

কটমট করে কথাটা বলেই দম নিল তুলি। আমরিনের মুখ হা হয়ে গেছে সাথে সাথেই। মশাও ঢুকতে পারবে অনাসয়ে। বিস্ময় তাকে ঘিরে ধরেছে আষ্টেপৃষ্টে। বিস্ময়কর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তুলির দিকে। মিটমিট করে হাসছে তুলি। গলা ঝেড়ে বলে উঠল,,

–“আমি কিভাবে জানলাম সেটাই তো? নিবিড় ভাইয়া যে তোর হাত ধরেছিল আর তোর চোখে মুখে হাসির ছাপ ছিল তখনই বুঝেছি কিছু তো চলছে। তা পুরোপুরি ক্লিয়ার হল তাহিরপুর শিমুল বাগানে। সবার দৃষ্টিতে না পরলেও আমার চক্ষুতে ঠিকি ধরা পেরেছে। আহারে কতো গভীর অনুভূতি নিয়ে তুই নিবিড় ভাইয়ার হাতটা আঁকড়ে ধরেছিলি। আহা কি প্রেম!”

একটু ও বিলম্ব না করে তুলির মুখ টা চেপে ধরল আমরিন। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিল। কোনো হেঁয়ালি না করে জিজ্ঞেস করল,,

–“কি চাই? ”

–“বেশি কিছু না। জাস্ট কাল কলেজ শেষে হসপিটালে যাবি আমার সাথে।”

চোখ বড় বড় করে তাকাল আমরিন। অবাক কন্ঠে বলল,,

–“আমি পারব না। ভাইয়া রেগে যাবে। রোগী দেখার সময় ডিস্টার্ব পছন্দ করে না।”

–“ঠিক আছে যেতে হবে না। আমি ওনাকে এখনই ফোন করে জানিয়ে দিচ্ছি তুই ওনার ফ্রেন্ড এর সাথে,,”

—“হয়েছে আর ব্ল্যাকমেইল করতে হবে না। আমি নিয়ে যাব।”

আমরিনের গাল টেনে মুচকি হাসল তুলি।
_______

কলেজ শেষে হসপিটালের সামনে চলে এল তুলি ও আমরিন। আজ হাফ ডে ছিল।দুপুরের কড়া রোদ এসে লাগছে চোখে মুখে।রোদের প্রখর টা একটু বেশিই। রোদের তাপে গরম ও লাগছে তীব্র। মনে হচ্ছে যেন চৈত্রের আগমন ঘটে গেছে। ফাল্গুন হোক আর চৈত্র তা নিয়ে বিশেষ মাথা ব্যাথা নেই তুলির। তার মন তো কাল রাত থেকেই ছটফট করছে আদ্র কে এক নজর দেখার জন্য। সকালে অবশ্য আদ্র মেসেজ দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে আজ তার জরুরি ওটি আছে নয়তো তুলির সাথে দেখা করতে আসত। তুলির ধারণা আদ্র আসতে পারে নি তো কি হয়েছে রাতের প্ল্যান মাফিক সে নাহয় চলে আসল। আমরিনের হাত ধরে হসপিটালের ভিতর ঢুকল। আদ্রর কেবিনের সামনে এসে দাঁড়াতেই আমরিন কে দেখে পরিচিত একজন নার্স বললেন,,

“স্যার তো রোগী দেখতে গিয়েছেন। আপনারা স্যারের কেবিনে অপেক্ষা করুন।”

ধন্যবাদ জানিয়ে ভিতরে গিয়ে বসল তুলি ও আমরিন। আজ দ্বিতীয় বারের মতো আদ্রর কেবিনে আসল তুলি। আদ্র তাকে দেখে হয়তো চমকে যাবে সেটা ভেবে খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠল। হঠাৎ কেবিনের দরজা খুলে কেউ প্রবেশ করতেই চোখ তুলে তাকাল দুজন। চোখে পড়ল নিবিড় কে। নিবিড় ও চমকে গেল দু জন কে। মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল,,

–“তোমরা দুজন এখানে? আদ্রর সাথে দেখা করতে এসেছো?”

মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বুঝাল তুলি। কিছুটা জড়তা নিয়ে আমরিন উঠে দাঁড়াল। তুলির দিকে তাকিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,,

–“তুলি ভাইয়া হয়তো এখনই চলে আসবে। আমি বোন হয়ে কাবাবে হাড্ডি হওয়া টা বেমানান। তার চেয়ে বরং আমি নিবিড় ভাইয়ার সাথে বাহিরে গিয়ে অপেক্ষা করি।”

আমরিনের কথায় সমর্থন জানাল তুলি। তবুও তার বেহায়া মন চুপিসারে বলে উঠল,,

“তুলি ইহা তো মাত্র বাহানা।”

আমরিন ও নিবিড় চলে গেল। তুলি গালে হাত দিয়ে অপেক্ষার প্রহর গুণতে লাগল আদ্রর জন্য। আকস্মিক তার মনে পড়ল প্রথম যেদিন এসেছিল একটা মেয়ে ভয়েস মেসেজ পাঠিয়েছিল। কে ছিল মেয়েটা?আদ্রর কাছ থেকে জানতে হবে। নয়তো খুব একটা স্বস্তি পাবে না। অবশেষে অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে দরজা ঠেলে প্রবেশ করল আদ্র। কোনোদিকে না তাকিয়ে গায়ের এপ্রোন টা খুলতে খুলতে বলল,

–“কখন আসলে?”

আঁতকে উঠল তুলি। আদ্রর সাবলীল কন্ঠ শুনে আদ্র কে চমকে দেওয়ার বদলে নিজেই প্রচন্ড পরিমাণে চমকে উঠল। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল,,

–“একটু আগে। আপনি চমকান নি?”

–“মোটেও না। আমার মন বলছিল তুমি আসবে। নার্স কে বলে গিয়েছিলাম আসলে যেন কেবিনে বসতে বলা হয়।”

চরম অবাক হল তুলি।দ্রুত গতিতে আদ্রর কাছে হেঁটে এল। মুখ ফুলিয়ে বলল,,

–“একটু চমকালে কি হতো ডাক্তার সাহেব? ”

জবাব না দিয়ে তুলির কোমর জরিয়ে ধরে নিজের কাছে টেনে আনল আদ্র। হার্ট বিট জোরে লাফাতে লাগল তুলির। নিজেকে সামলানোর জন্য আঁকড়ে ধরল আদ্রের কালো শার্টের কিছু অংশ। চোখে মুখে আছড়ে পড়ছে আদ্রের গরম নিশ্বাস যা তুলির কাঁপুনি বাড়িয়ে দিচ্ছে ক্রমশ। মুখ তুলে আদ্রর ক্লান্ত মুখে চাইতেই টুপ করে চুমু একে দিল আদ্র তুলির বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে থাকা কপালে। এসি চলছে অথচ তুলি ঘেমে যাচ্ছে অনবরত। নিশ্বাস টা ও ভারী হয়ে আসছে। চোখে ভাসছে আদ্রর মুখটা। খোঁচা খোঁচা দাড়িতে আদ্র কে অনেক সুন্দর লাগছে। নীলাভ চোখ দুটো তে মাদকতা যা শিহরণ জাগাচ্ছে তুলির সারা দেহে। এই দৃষ্টি যেন তুলির জন্য নিষিদ্ধ। তাকালেই বুঝি লজ্জায় মরণ হবে। দুরুদুরু মন নিয়ে আদ্রর বুকে মুখ লুকিয়ে ঝাপটে ধরল আদ্র কে। মুচকি হেসে আদ্র ও জড়িয়ে ধরল। কানের কাছে স্লো ভয়েসে বলল,,

–রাতে তো বাসায় যেতাম কষ্ট করে না আসলে হতো না? ক্লাস করে ক্লান্ত শরীরে চলে আসলে।

–আপনাকে দেখার তর সইছিল না আদ্র।

কথাটা বলে আদ্রর বুকে আবারও মুখ গুঁজে দিল তুলি। দু চোখ বন্ধ করে নিল আদ্র। ঘোর লাগা স্বরে তুলি কে আকড়ে ধরে বলে উঠল,,

–এভাবে বুকে মাথা রাখলে নিজেকে পাগল পাগল মনে হয় তুলা। ইচ্ছে করে বিয়ে টা এখনই করে ফেলি। সারাক্ষণ এই বুকে আগলে রাখি তোমায়। কয়েক মিনিটের জন্য বুকে মাথা রেখে আবারও দূরে গেলে প্রচন্ড কষ্ট হয় আমার। শূন্য শূন্য লাগে বুক টা। রক্তক্ষরণ হয় হৃদপিণ্ডে।

আদ্রর কথায় প্রচন্ড লজ্জা অনুভব করল তুলি। বুকের ধুকপুকানি বাড়তে লাগল ক্রমাগত। বুক থেকে মাথা তুলে সরে আসতে চাইলে নিজের সাথে মিশিয়ে নিল আদ্র। নেশাময় চোখ দুটো তুলির চেহারায় স্থির করে রাগী স্বরে ফিসফিস করে বলল,,,

–তোমার তো ভারী সাহস আমি এভাবে বলার পরও সরে যাওয়ার চেষ্টা করলে। আর কখনও এমন সাহস করলে মেরে ফেলব একদম।

আদ্রর কথার কোনো প্রতিউত্তর করল না তুলি। নিশ্চুপ হয়ে আদ্রর হৃৎস্পন্দন শুনতে লাগল। এতো দ্রুত গতিতে স্পন্দন হচ্ছে যা কানে যেতেই শরীর কাটা দিয়ে উঠছে তুলির। ছোট্ট মনে বাসা বাঁধা অনুভূতি গুলো ও ক্ষণে ক্ষণে জাগ্রত হচ্ছে। তুলির মনে হচ্ছে এই ভালোবাসা তার জন্যই গচ্ছিত রাখা। এই গভীর প্রণয় চিরকাল ছিল তারই অপেক্ষায়। কেন আরো আগে দেখা হল না তার আদ্রর সাথে। তাহলে তো আগে থেকেই পরিচয় হতে পারত অন্তর কাঁপানো এই ভালোবাসার সাথে। তুলির সুখ অনুভূত হচ্ছে। আজ সে ভীষণ সুখী। তার এই সুখের কারণ তার ডাক্তার সাহেব। আনমনে আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়াল আদ্রর বুকের বা পাশ টায়। আদ্র ও চুপ করে অনুভব করতে লাগল তুলি কে। কিছু না বলেও অনুভবে হাজারো কথা বলছে দু’জন। একে অপরের প্রতি অসীম ভালোবাসা বিলিয়ে দিচ্ছে অনুভবের প্রহরে।
_______

সময় যে কখন গড়িয়ে যায় টেরই পাওয়া যায় না। আজ ইনশিতার বিয়ের ডেট ঠিক করতে আসবে। গতকাল রাতে ইনশিতা, আমরিনের সাথে ভালোই আড্ডা দিয়েছে তুলি। ঘুমোতে ঘুমোতে প্রায় দুইটা বেজে গেছে। আড্ডা ছিল ইনশিতা কে কেন্দ্র করে। কথায় কথায় জানতে পারল রনক ইনশিতার বড় চাচার ছেলে।পাঁচ বছর ধরে প্রেমের সম্পর্ক তার রনকের সাথে। বিয়ে আগে থেকেই ঠিক করা। তুলির চোখে এখনও ঘুম। একটু তে ও ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়ে মেয়েটা। নিজেও বুঝে পায় না এতো অবসাদ কেন তাকে ঘিরে ধরে। চোখ কচলাতে কচলাতে কিচেনের কাছে এসে দাঁড়াল। সকাল দশটা বাজে কিন্তু এখনও সবাই ঘুমে। সকলে বললে ভুল হবে আদ্র বেরিয়ে গেছে সকালেই। সায়েরা বেগম সার্ভেন্ট দের সাহায্য নিয়ে সবকিছু রান্না করছেন। কারণ দুপুরের দিকেই গেস্ট চলে আসবে। আচমকা তুলি কে দরজায় দাড়িয়ে থাকতে দেখে আঁচলে হাত টা মুছে মুচকি হেসে এগিয়ে গেলেন তিনি। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,,

–এতোক্ষণে উঠার সময় হল? তাড়াতাড়ি আয় নাস্তা করে নিবি।

ইতস্তত করে তুলি জিজ্ঞেস করল,,

–আমরিন,ইনশিতা আপু,আদ্র ভাইয়া ঘুমাচ্ছে খালা মণি?

–আরে না। আদ্র তো প্রায় একঘন্টা হবে হসপিটালে চলে গেছে। দুপুরে ফিরবে। আর আমরিন,ইনশিতা এখনও ঘুমে।তুই খেয়ে গিয়ে ওদের উঠিয়ে দিস মা।

অভিভূত হয়ে দাড়িয়ে পড়ল তুলি। আদ্র তাকে না বলেই চলে গেল? সেটা ভেবে একটা চাপা কষ্ট অনুভব করল। খানিক বাদেই মনে হল হয়তো ঘুমিয়ে ছিল তাই আর জাগায় নি।মুচকি হেসে নাস্তা খেতে মনোযোগ দিল। খাওয়া শেষ করে আমরিন ও ইনশিতা কে ঘুম থেকে উঠিয়ে দিয়ে রুমে এল। ঘড়ির কাটার দিকে তাকাতেই দেখল এগারোটা বেজে গেছে। আলমারি থেকে নিজের জন্য একটা ড্রেস বের করে নিল দুপুরে পড়ার জন্য। ড্রেস টা আদ্র কিনে দিয়েছে। সেদিন হসপিটাল থেকে শপিং করতে নিয়ে গিয়েছিল। তিন টা ড্রেস কিনে দেয় তুলি কে। এর মধ্যে থেকে নীল রঙের লং ড্রেস টা বের করল তুলি। আলমারি লাগাতে গিয়ে নজর গেল একটা বক্সের দিকে। বিস্মিত হয়ে বক্স টা হাতে নিল। একটা মোবাইল ফোনের বক্স। তার নিচেই চাপা দেওয়া ছিল একটা চিরকুট। অতি আগ্রহ নিয়ে চিরকুট খুলতেই হাসি ফুটে উঠল তুলির ঠোঁটে।

~ “মোবাইল টা তোমার জন্য। ঘুমিয়ে ছিলে তাই ঘুম ভাঙায় নি তবে একটা ছোট্ট চুমু খেয়েছি তোমার কোমল ঠোঁট দুটো তে। জানি এখন লজ্জা পাবে তুমি কিন্তু দুঃখের বিষয় সেই লজ্জা রাঙা মুখ টা আমার দেখা হবে না। আমার বুকের বা পাশে চিনচিন ব্যাথা ও অনুভব করব না। তবুও কল্পনায় একে নিব তোমার সেই মুখ খানা যা প্রতি রাতে নির্ঘুম রাখে আমায়। এই মেয়ে আমায় মেরেই দম নিবে তাই না?”

চিরকুট টা বুকের সাথে জড়িয়ে মুচকি হাসল তুলি। কিশোরী তুলির কাছে একটা খুবই ভয়ংকর অনুভূতি। এ অনুভূতি গুলো শান্তিতে নিশ্বাস পর্যন্ত নিতে দেয় না। সারাক্ষণ বিচরণ করে বেড়ায়। আর ইচ্ছে করে সর্বদা মেতে থাকতে এমন মন মাতানো অনুভূতির মাঝে। তুলি জানে না এই অনুভূতি গুলোর শেষ পরিণতি কি হবে। কিন্তু তার দৃঢ় বিশ্বাস আদ্র ঠিক সামলে নিবে, জড়িয়ে নিবে তার হৃদয়ের গহীনে। লাজুক হেসে ধীর কন্ঠে বিড়বিড় করে বলল, ,–” আপনি অনেক অসভ্য ডাক্তার সাহেব। ”


ইনশিতার রুমে বসে বসে ইনশিতা কে রেডি হতে দেখছে তুলি। আমরিন নিচে গেছে। সায়েরা বেগম পাঠিয়েছেন। তিনি ও মেয়ে কে শাড়ি পড়িয়ে কপালে চুমু একে দিয়ে চলে গেলেন নিচে। ইনশিতা কে খুব সুন্দর লাগছে। বউ বউ লাগছে তুলির কাছে। লজ্জার ছাপ ও ফুটে আছে চেহারায়। তুলি ভাবতেই লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠছে একদিন সে ও ইনশিতার মতো শাড়ি পড়ে অপেক্ষায় থাকবে আদ্রর বউ হবার জন্য। আদ্র হয়তো বেশি অপেক্ষা করাবে না। তুলি মনে মনে বলে উঠল,,–” লোকটা যা পাগল আর বেহায়া দেখা যাবে তিনি নিজেই অপেক্ষা করবেন আমার জন্য। ” কথাটা ভেবেই ব্লাশিং করতে লাগল।

হঠাৎ কালো রঙের শাড়ি পড়া একটা মেয়ে রুমে আসতেই হালকা হেসে উঠল ইনশিতা। মেয়েটা সুন্দর। অনেক বেশি সুন্দর। চোখ গুলো কেমন টানা টানা। পিঠে ছড়িয়ে থাকা চুল গুলো কোমর ছুঁই ছুঁই। ঠোঁটে লেগে আছে হাসি। অবাক হয়ে তুলি মেয়েটা কে দেখতেই ব্যস্ত। ইনশিতা জরিয়ে ধরল মেয়েটা কে। অভিমানী সুরে বলে উঠল,,

—“নিজের বাড়িতে আসতে কারণ লাগে? যেই বাড়িতেই সারাজীবনের জন্য ঠাঁই হয়ে গেছে তোর সেখানেই আপনি আসতে বিলম্ব করলেন?”

—” আরে তুই তো জানিস ভাইয়ার সাথে লন্ডনে ছিলাম। চলে আসতাম কিন্তু ভাইয়ার কাজে আঁটকে গেলাম। বাই দ্যা ওয়ে ভাবী আপনাকে কিন্তু অপরূপ লাগছে।”

–“হয়েছে আর পাম দিতে হবে না। তোকে মোবাইলে বলেছিলাম না আমাদের বাড়িতে একটা কিউট মেয়ে এসেছে? আয় পরিচয় করিয়ে দেই।”

কথাটা বলেই তুলি কে ডাক দিল ইনশিতা। মুচকি হেসে তুলি ওদের দিকে এগিয়ে গেল। মেয়েটা তুলি কে অবলোকন করল ভালো করে। মিষ্টি হেসে বলল,,

–“বাহ্ বেশ মিষ্টি তো দেখতে।”

–হুম। তুলি পরিচয় হ এই বাড়ির আরো একজন সদস্যর সাথে। আমাদের ভাবী সামিরা। সম্পর্কে আমার ননদ ও।

তুলির চোখে মুখে ভয়ের ছাপ ফুটে উঠল। হারিয়ে ফেলার ভয়ে বুকে শুরু হল আর্তনাদ। ছোট্ট মনে নেমে এল বিষাদের ছায়া। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,,

–“ভভাবী মানে? ”

তীক্ষ্ণ নজরে তাকাল সামিরা। ইনশিতা হেসে বলে উঠল,,

—“আরে বুঝিস নাই? আদ্র ভাইয়ার বউ। আদ্র ভাইয়া তো,,

পুরো দুনিয়া থমকে গেল তুলির। পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট বাক্য টা হয়তো শুনেছে সে। চোখ ভর্তি হল জলে। কোনোমতে আঁটকে রাখার চেষ্টায় নেমে পড়েছে। আর কোনো কথা শুনার শক্তি টুকু নেই তার। পুরো শরীর অসার হয়ে পড়ছে। বুকে অসহনীয় ব্যাথা হচ্ছে। তীব্র থেকে তীব্রতর ব্যাথা। শ্বাস টুকু নিতে পারছে না।মাথা ঘুরে পড়ে যেতে নিলে কথা থামিয়ে পিছন থেকে আকড়ে ধরল ইনশিতা। আতংক কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,,

–“এই তুলি কি হয়েছে তোর?”

মুখ দিয়ে একটা কথাও উচ্চারিত করতে পারছে না তুলি। ইনশিতার হাতটা চেপে ধরে বহু কষ্টে বলল,,

–“আমায় রুমে দিয়ে আসো আপু।”

সাথে সাথেই চোখের কার্ণিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল এক ফোঁটা জল।
#আকাশে_তারার_মেলা
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব -১৩

শত শত তারার মেলা দেখানো মানুষ টা নিমিষেই তুলির কল্পনার আকাশ টা ঢেকে দিল মেঘে।

ফ্লোরে বসে বিছানায় হেলান দিয়ে বসে আছে তুলি। দু চোখের কার্ণিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অবাধ্য জল। এলোমেলো হয়ে আছে শরীরের কাপড় টা। চুল গুলোও কেমন ফ্লোরে গড়াগড়ি খাচ্ছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। আজ তুলি নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে। নিজের অস্তিত্বে যেই মানুষ টা কে মিশিয়ে নিয়েছিল সেই মানুষ টাই বিলীন করে দিল তুলির অস্তিত্ব। কোনো প্রতিক্রিয়া নেই তুলির। পাথর হয়ে পড়ে আছে মেঝেতে। ভিতর টা কাঁদছে চিৎকার করে অথচ সেই কান্নার কোনো আওয়াজ নেই। কি অবলীলায় শব্দবিহীন হু হু করে কেঁদে উঠছে মনটা। গভীর চিন্তায় নিমগ্ন তুলি। তাচ্ছিল্যের হাসি পাচ্ছে তার নিজের সতেরো বছরের জীবন টা কে নিয়ে। প্রত্যেক টা মানুষ তার হৃদয়ভঙ্গ করতে যেন সর্বদাই প্রস্তুত থাকে। ভালোবাসা কি এতোটাই বাজে নেশা? কেন এই নেশায় ডুব দিয়ে তুলি ভেঙে পড়ছে বার বার? কেন তুলির যন্ত্রণা হচ্ছে বুকের ঠিক মাঝখান টায়? কেন মরে যেতে ইচ্ছে করছে তার? সে তো বিশ্বাস করেছিল, ভালোবেসেছিল। তবে কেন আদ্র এতো যত্ন করে ভালোবাসা শিখিয়ে কঠোরভাবে ভেঙে দিল? এতো নিখুঁত অভিনয় হয়? এতো যত্নে গড়া মায়ায় জড়ানো তীব্র ভালোবাসা কখনও অভিনয় হতে পারে? প্রশ্নগুলো মনে আঁকড়ে ধরেই ডুকরে কেঁদে উঠল তুলি। এতোক্ষণের চেপে রাখা কান্না গুলো মুক্তি পেল। উচ্চশব্দে তুলির চিৎকার প্রতিধ্বনিত হতে লাগল চার দেয়ালের মাঝে।

–“ভালোবাসায় এতো যন্ত্রণা আদ্র? আগে কেন জানলাম না আমি? তবে তো আমি আমার মন টা কে বেঁধে রাখতাম। কখনও আপনার নিকট সঁপে দিতাম না। কেন এই অসহনশীল যন্ত্রণা আমার ভাগে ঢেলে দিলেন আদ্র? কোথায় আপনি? আমায় ডুবিয়ে হারিয়ে গেলেন? সারাটা জীবন এই যন্ত্রণা যে আমায় কুঁড়ে কুঁড়ে খাবে আদ্র। আমি পারছি না। আমার পক্ষে যে সহ্য করা সম্ভব না। কি করবো আমি? কি করব একটু বলে দেন প্লিজ। যেদিন থেকে আপনার ভালোবাসায় জড়িয়েছি প্রতিটা দিন, প্রতিটি মুহূর্ত ভয়ে ভয়ে কাটত আমার। মনে হতো এই বুঝি আমার আদ্র কে কেঁড়ে নিবে কেউ। অথচ আমার ভয় পাওয়া তো নিছক ছিল। আপনি তো কখনও আমার ছিলেন না আদ্র। কখনও আমার ছিলেন না। আপনি তো অন্য কারো। পাপ করেছি আমি। অন্য কারো স্বামী কেঁড়ে নিতে চেয়েছি।”

তুলির আত্ম চিতকার সারা ঘরময় ভেসে বেড়াচ্ছে। আবেগি মনে দু দু বার বেদনার সম্মুখীন হয়েছে মেয়েটা। একজন কে বিশ্বাস করে এবং অপরজনকে নিজের অস্বস্তিে মিশিয়ে। কষ্ট গুলো সময় বেধে বাড়তেই লাগল। সেই সাথে বেড়ে গেল কান্নার বেগ। এ বয়সে এতো ধাক্কা কিভাবে সইবে মেয়েটা? কাঁদতে কাঁদতে চোখ দুটো ও লাল আলতার মতো টুকটুকে লাল হয়ে আছে। যেই চোখে কল্পনায় কিছু সময় আগেও ফুটে উঠেছিল লজ্জার ছাপ, বউ সেজে আদ্রর জন্য অপেক্ষা করার মুহুর্ত ডাগরডাগর সেই আঁখি দু’টো তে সময়ের ব্যবধানে কষ্টের ছাপ। সময়ের সাথে কতকিছু বদলে যায়। কেউ কষ্ট কাটিয়ে সুখের আভাস পায় তো কেউ হারানোর যন্ত্রণায় ছটফট করে সারাক্ষণ।

হাতের নীল কাঁচের চুড়ি গুলোর দিকে তাকিয়ে হা হা কার করে উঠল তুলির বুকটা। চুড়ি গুলোও যে আদ্রর কিনে দেওয়া। নিমিষেই মনের মধ্যে জমে থাকা কষ্ট অভিমানে পরিণত হল। রাগে-কষ্টে, অভিমানে হাত টা আছাড়তে লাগল ফ্লোরে। রিমঝিম আওয়াজ তুলে একের পর এক ভাঙতে লাগল চুড়ি গুলো। সাদা ফ্লোরে গড়িয়ে যেতে দেখা গেল লাল তরল রক্ত। কাঁচের টুকরো গেঁথে গেছে তুলির কোমল হাতে। দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে নিচ্ছে মেয়েটা। এই ব্যাথা যে তাকে ব্যাথিত করতে পারছে না। সামান্য ব্যাথা টুকু কিভাবে ভাঙবে তুলি কে? সে তো পুড়ে যাচ্ছে। পুড়ে যাচ্ছে প্রণয়ের দহনে। এক সময় রক্ত দেখেও চিৎকার দেওয়া মেয়েটা নেতিয়ে পড়েছে কষ্টের ভারে।
_______

ইনশিতা রুমে পায়চারী করছে চিন্তিত হয়ে। খুব কান্না ও পাচ্ছে তার। তুলি কে রুমে নিয়ে যাওয়ার পর শরীর খারাপ লাগছে বলে রেষ্ট নিবে জানাল। তাই ইনশিতা ও সামিরা চলে এসেছে। কিন্তু ইনশিতার কিছুই ভালো ঠেকছে না। দুশ্চিন্তা হচ্ছে তুলির জন্য। আমরিন গিয়ে ঢেকেছিল অনেকবার কিন্তু তুলি দরজা মেলে নি। অজানা ভয়ে চোখ মুখ শুকিয়ে এল আমরিনের। ভুলেও নিচে গিয়ে জানানো যাবে না কোনো কিছু। তাই তড়িঘড়ি করে ফোন দিয়ে আদ্র কে জানাল। মিনিট দশেক অতিবাহিত হয়ে গেছে। আমরিন উপর থেকে সদর দরজার দিকে তাকাতেই দেখল আদ্র ঢুকছে হুড়মুড়িয়ে। পঁচিশ মিনিটের রাস্তা দশ মিনিটেই পার করে চলে এসেছে। অস্থির ভাব স্পষ্ট। সবাই ডাকলেন অথচ ফিরে ও তাকাচ্ছে না আদ্র। আদ্রর বাবা রাদিফ সাহেব রেগে গেলেন প্রচন্ড। আদ্র সবসময় ওনার কথার অবাধ্য হন তা আজ নতুন নয়। সায়েরা বেগম সামলে নিলেন কোনোমতে। ছেলের পিছু পিছু ছুটে চললেন তিনিও। ভাইয়ের দিকে এগিয়ে গেল আমরিন। একদমে বলল,,

–“তুলি কোনো সাড়া দিচ্ছে না ভাইয়া। আমি অনেকবার ডেকেছি। ভিতর থেকে দরজা লক করা।”

নিজেকে সামলে নিয়ে রুমে গেল আদ্র। সায়েরা বেগম মেয়ের কথায় বুঝতে পারছেন খারাপ কিছু ঘটেছে। যেতে নিলে আমরিন আটকে দিল মাকে।

–“তুৃমি যেও না আম্মু।”

–“তুলির কি হয়েছে আমরিন?”(চিন্তিত কন্ঠে)

–“একটু শরীর খারাপ। তুমি ইনশিতা আপু কে নিয়ে নিচে যাও। ভাইয়া ঠিক সামলে নিবে।”

একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ইনশিতা কে নিয়ে নিচে চলে গেলেন সায়েরা বেগম। আমরিন ও নিজেকে স্বাভাবিক করে সামিরার সাথে নিচে চলে আসল।


বারান্দা টপকে তুলির রুমে আসল আদ্র। মেঝেতে তরল রক্ত চাক্ষুষ হতেই আদ্রর চোখ থেকে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল সাথে সাথেই। অগ্নি বর্ষণ হতে লাগল দু চোখ থেকে। কপালের রগ গুলো ফুলে গেছে। রাগে থরথর করে কাঁপতে লাগল পুরো শরীর। চোখের পলকেই যন্ত্রণা গুলো হৃদপিণ্ডে ছুরি গাঁথতে লাগল। হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ করে দু হাঁটু গেড়ে বসল তুলির সম্মুখে। কারো আভাস পেতেই মেঝে থেকে অশ্রুসিক্ত চোখ সরিয়ে উপরের দিকে তাকাল তুলি। প্রচন্ড জোরে ধুক করে উঠল তুলির বুক টা। আদ্রর রক্তিম চোখে পানি টলমল করছে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আদ্র তার দিকে। তুলির কষ্ট যেন হু হু করে আরো বেড়ে গেল। কিছু বলতে চেয়েও অভিমানে আঁটকে যাচ্ছে সব কথা। হাতে আদ্রর স্পর্শ পেতেই জ্বলে উঠল হাতটা। নীল বর্ণের চোখে রক্তিম আভা, চোয়াল শক্ত, কপালের রগ ফুলে আছে তবুও সবকিছু উপেক্ষা করে আদ্র ব্যস্ত হয়ে পড়ল তুলির হাতে গেথে যাওয়া কাচ গুলো খুলতে। কোনো ব্যাথাই উপলব্ধি করতে পারছে না তুলি। অযাচিত নয়নে আদ্রর দিকে তাকিয়ে। চোখ থেকে ঝরে যাচ্ছে পানি। এতো রাগ আদ্রর চোখে মুখে অথচ তুলির কেয়ার করতে মগ্ন সে। তুলির মন বলছে আদ্রর এই রাগ, চোখে টলমল করা পানি তীব্র কষ্ট,যন্ত্রণার। ক্লেশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আদ্রর বুকে। এতটুকু ভালোবাসা পেয়ে যেন তুলির অভিমান গলে যাচ্ছে।ইচ্ছে করছে আদ্রর বুকে ঝাপিয়ে করতে। আদ্রর বুক ভিজিয়ে সব কষ্ট মুক্ত করে দিতে। কিন্তু! কিন্তু তুলির যে আর সেই অধিকার নেই। ইনশিতার বলা কথাটা কানে এসে বাজতে লাগল। প্রচন্ড ক্ষোভে হাতটা টেনে ছাড়িয়ে নিল আদ্রর হাত থেকে। ঢুলতে ঢুলতে উঠে দাঁড়াতেই ছিটকে পড়ল আদ্রর বুকে। এক হাতে আগলে নিল আদ্র। অন্য হাত দিয়ে গালে হাত রাখল। শরীরের অবশিষ্ট শক্তি দিয়ে আদ্রর বুকে হাত দিয়ে ঠেলতে লাগল তুলি। গলায় জোর দিয়ে চিৎকার করে উঠল,,,

–“হাউ ডেয়ার ইউ? কোন সাহসে আপনি আমায় স্পর্শ করছেন? আপনার অপবিত্র হাত দিয়ে আমায় স্পর্শ করবেন না। লজ্জা করে না স্ত্রী থাকা স্বত্তেও অন্য একটা মেয়ে কে এভাবে স্পর্শ করতে? চরিত্রহীন একটা!”

কথাগুলো কর্ণধার হতেই ধপ করে বিছানায় ফেলে দিল আদ্র তুলি কে। কোমরে ব্যাথা পেয়ে কুঁকড়ে উঠল তুলি। শব্দ করে কেঁদে উঠল ভীষণ জোরে। মাথার চুল গুলো টেনে মাথা নিচু করে বসে পড়ল আদ্র। চোখ থেকে টুপ টুপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে ফ্লোরে।নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে চেয়ে ও পারছে না। তুলির মুখের বিষাক্ত বাক্য টা শুনে রাগের মাত্রা বেড়ে গেল চরচর করে। তুলির কান্নার আওয়াজ অস্বাভাবিক করে তুলছে তাকে। পাশের ড্রয়ার থেকে ফাস্ট এইড বক্স বের করে ড্রেসিং করতে লাগল তুলির হাতে। তুলি এখনও চোখ বুঁজে কেঁদেই যাচ্ছে। কেন অন্য কারো স্বামী হয়েও আদ্র তার এতো কেয়ার করছে? হাতটা বেন্ডেজ করে দিয়ে অন্য হাতে টেনে তুলল তুলি কে। ঝাপসা দৃষ্টিতে আদ্রর দিকে চাইল তুলি। আদ্রর ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসি।

–” ভালোবাসি বললেই কি ভালোবাসা যায়? তুই ও পারিস নি। কারো মুখের কথায় তুই আমায় চরিত্রহীন উপাধি দিয়ে দিলি। কি বলেছিলি সিলেটে? আমার উপর তোর অটুট বিশ্বাস তাই না? এই তোর বিশ্বাস? ”

কথাগুলো বলে মৃদু হাসল আদ্র। যেই হাসির পিছনে লুকিয়ে আছে অজস্র বেদনা তীব্র আঘাত। তুলি নিশ্চুপ। রাগী স্বরে চিৎকার করে উঠল আদ্র।

–“তুই কি আদৌও অনুভব করতে পেরেছিলি আমার ভালোবাসা? যদি অনুভব করতে পারতি তাহলে বুঝতে পারতি তোকে ছাড়া কতগুলো কষ্টের প্রহর কাটিয়েছি আমি। তোকে নিজের কাছে আনার জন্য ওয়াদাবদ্ধ হয়েছি নিজের বাবা-মায়ের কাছে।একটুখানি বিশ্বাস রেখে আমাকে জিজ্ঞেস করতে পারতি না? বিশ্বাস করলি অন্য কারো কথায়।কান খুলে শুনে রাখ আমি বিবাহিত না। নিজের সবটুকু দিয়ে তোকে ভালোবেসেছি তুলি তার বদলে এই প্রতিদান দিলি তুই? কি বলেছিস আমি ক্যারাক্টারলেস? আজ তোকে বুঝাব চরিত্রহীন কাকে বলে।”

কথাটা বলেই তুলির ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিল আদ্র। চুলের পিছনে হাত গলিয়ে শক্ত করে চেপে ধরল নিজের সাথে। এতোক্ষণের জমানো রাগ ঝারতে লাগল ঠোঁটের উপর। আদ্রর ঘাড়ে খামচে ধরে কেঁদে দিল তুলি। ঠোঁট ছেড়ে দিয়ে গলায় সজোড়ে কামড় বসাল আদ্র। তুলির মাথাটা বুকে চেপে ধরে ভেজা কন্ঠে বলে উঠল,,,

–“তোমার জন্য নিজেকে শেষ করে দিতে রাজি আছি তুলি তাহলে তুমি কিভাবে আমার ভালোবাসা টা অবিশ্বাস করলে? আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। তোমার রক্ত গুলো দেখে জীবনে প্রথম হৃদয় টা কেঁপে উঠেছে আমার। কতো রক্ত দেখি প্রতিদিন এমন কষ্ট তো কোনোদিন হয় নি।তোমার কিভাবে সাহস হলো রক্ত জড়ানোর? তোমাকে খুন করে নিজে মরে যেতে ইচ্ছে করছে। আমার এতো বছরের ভালোবাসা কে এক নিমিষেই বিষিয়ে দিলে তুমি। আমি কখনও ক্ষমা করব না তোমাকে। কখনও না।”

নীরবে কেঁদে যাচ্ছে তুলি। উপলব্ধি করতে পারছে আদ্রর কষ্ট। ভুল করে ফেলেছে। আদ্রর ভালোবাসা অনুভব করতে অক্ষম সে। একটুখানি বিশ্বাস রেখে আদ্রর কাছ থেকে সত্যি টা জানতে চাইতে তো পারত। সব অভিমান নিঃশেষ হয়ে গেল তুলির। আদ্র কে আঁকড়ে ধরতেই টেনে বুক থেকে সরিয়ে দিল। সাদা শার্টে লেপ্টে আছে তুলির রক্ত। মেঝেতে রক্ত গুলোর দিকে চোখ পড়তেই দু চোখ বন্ধ করে নিল আদ্র। হাত মুঠ করে বলে উঠল,,

—“তুই আমার ভালোবাসার না ঘৃণার যোগ্য। আজ থেকে তুই শুধু আমার ঘৃণাটাই অনুভব করবি।”

বিছানা থেকে উঠল তুলি। আদ্রর কাছে দাঁড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল,,

–” আমার ভুল হয়ে গেছে আদ্র। এক সেকেন্ডের জন্য মনে হয়েছিল আমাকে কেউ শ্বাসরুদ্ধ করে মেরে ফেলেছে। ইনশিতা আপুর কথাটা আমায় স্বাভাবিক থাকতে দেয় নি আদ্র। আপনাকে হারানোর ব্যাথা টা আমি সহ্য করতে পারি নি। মনে হয়েছে আপনি বোধহয় আমায় ঠকিয়েছেন,,”

কথাটা শুনে পাশের দেয়ালে লাগাতার ঘুষি মারতে লাগল আদ্র। আজ যদি নিজের রাগ দমাতে না পারে তবে হয়তো সত্যি সত্যিই খুন করে বসবে তুলি কে। এতো ভালোবাসা দিয়েও আজ আঘাত পেতে হচ্ছে তার। বিরহ পাওয়ার জন্য তো সে এতোগুলো বছর অপেক্ষা করে নি। নিজেকে সংযত রেখে অপেক্ষা করেছে তুলির বড় হওয়ার। তবুও তুলি তাকে অবিশ্বাস করে নিজের ক্ষতি করল।আঁতকে উঠল তুলি। দৌড়ে গিয়ে থামাতে চেয়েও থামাতে পারছে না আদ্র কে। কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়ল আদ্রর পা জড়িয়ে। নরম স্বরে বলে উঠল-,,

–“আমি আর কখনও আপনাকে অবিশ্বাস করব না আদ্র। কোনোদিন ও আর নিজের ক্ষতি করার চেষ্টা করব না।”

আদ্রর হাত থেকে রক্ত ঝরছে। তুলির দিকে এক পলক চেয়ে এক হাত ধরে উঠিয়ে টেনে নিয়ে যেতে লাগল নিচে,,,

#চলবে,,,,

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here