আকাশে তারার মেলা পর্ব ১৪+১৫

#আকাশে_তারার_মেলা
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব -১৪

তুলি কে টেনে নিচে নিয়ে আসল আদ্র। সামিরার দিকে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করল।সবাই বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সবার দৃষ্টি গেল আদ্রর হাতের মুঠোয় থাকা তুলির হাতের দিকে। ছ্যাত করে উঠল সামিরার বুক টা। পানিতে ভরে এল আঁখি দুটো। ছেলের হাত থেকে রক্ত ঝরতে দেখে আঁতকে উঠলেন সায়েরা বেগম। দৌড়ে ছেলের কাছে আসতেই আদ্র হাতের ইশারায় থেমে গেলেন তিনি। তিনি বুঝতে পারছেন আজ এখানে প্রলয় হবে। স্বামীর দিকে অসহায় চোখে চাইলেন। রাদিফ সাহেব রেগে আছেন। প্রচন্ড রেগে গেছেন আদ্রর কান্ডে। আদ্রর বড় চাচা তীক্ষ্ণ নজরে তাকিয়ে রইলেন। রাদিফ সাহেব রাগী স্বরে ধমকে উঠলেন,,,

–“এসব কি হচ্ছে আদ্র? তুমি তুলির হাত ধরে রেখেছো কেন? ওর মুখ দেখে বুঝা যাচ্ছে ব্যাথা পাচ্ছে। ছাড়ো ওকে।”

ইনশিতা,আমরিন,রনক সবাই অবাক চোখে চেয়ে আছে আদ্রর দিকে। কেউই আদ্রর ভাবভঙ্গি বুঝতে সক্ষম হচ্ছে না।তুলির হাতে ব্যান্ডেজ দেখে আমরিনের বুঝতে বাকি রইল না তুলি কোনো পাগলামি করেছে যার কারণে তার ভাই এতোটা হাইপার হয়ে উঠেছে। আমরিন বয়সে ছোট হলেও তার মাঝে বেশ ম্যাচুরিটি লক্ষ করা যায়। কোনো কিছু বলা বা করার আগে ভেবে চিন্তা করে। সহজেই কোনো কিছুতে পা বাড়ায় না। বাচ্চামো স্বভাব ও তার মাঝে নেই। তুলির হাত টা দেখে কষ্টের জড়ো হলো মনে। মেয়েটা কয়েকদিনে কেঁড়ে নিয়েছে আমরিনের মনটা ও। বেস্ট ফ্রেন্ড কম বোন বলে আখ্যায়িত করে আমরিন। সূক্ষ্ম একটা উত্তপ্ত শ্বাস ছেড়ে আদ্রর দিকে মনোযোগ দিল। আদ্র এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রাদিফ সাহেবের দিকে৷ ওনার কথাটা কর্ণপাত হতেই তাচ্ছিল্য স্বরে বলে উঠল,,,

–“আপনি এই মেয়েটার সামান্য ব্যাথা টুকু অনুভব করতে পারছেন অথচ আমি যে বছর ধরে আগুনে পুড়ছি সেটা পরিলক্ষিত হয় নি আপনার? আমার বুকের তীব্র ব্যাথা কখনও বুঝতে চেষ্টা করেছেন বাবা হিসেবে? ছেলের আর্তনাদ বুঝার ক্ষমতা আছে আপনার? থাকলে এতো কঠিন হতে পারতেন না আপনি। আপনার পায়ে পড়ে কেঁদেছিলাম সেদিন কিন্তু আপনি তুলি কে আনার বদলে জুড়ে দিয়েছিলেন শর্ত। এ বাড়িতে ওকে নিয়ে তো আসলেন অথচ দেয়াল তুলে দিলেন ওর আর আমার মাঝে।”

রাদিফ সাহেবের ভিতরটা কেঁপে উঠল ছেলের কথা শুনে। তবুও তেজী স্বরে বলে উঠলেন,,

–“একটু বেশিই হচ্ছে আদ্র। এখন তুমি বাড়াবাড়ি কেন করছো? তুমি কিন্তু কথা দিয়েছ বিয়েটা তুমি করবে। সো এখন এসব বাদ দাও। সিন ক্রিয়েট করা বন্ধ করো।”

তুলি এতোক্ষণ চুপ করে সব শুনছিল। বুঝতে পারছে তার জন্য বাবা-ছেলের মধ্যে ঝামেলা বেঁধে যাচ্ছে। তাই আর চুপ না থেকে মাথা তুলে আদ্রর দিকে তাকাল। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল,,,

–“ঝামেলা বাঁধাবেন না আদ্র। খালু,,,

—“স্টপ,,,,,,!”
জোরে ধমকে উঠল আদ্র। ভড়কে গেল সবাই উচ্চ ধমকে। আদ্রর রাগ সম্পর্কে সবারই কম বেশ ধারণা আছে। তুলির শরীরের প্রত্যেক টা লোম খাঁড়া হয়ে গেল ভয়ে। কাঁপতে লাগল থরথর করে। তুলি কে সোফায় বসিয়ে দিল আদ্র। সামনের টেবিল থেকে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিল তুলির দিকে। ভয়ে শরীর এতো কাঁপছে যে গ্লাস টা পর্যন্ত ধরতে পারছে না মেয়েটা। তুলির পাশে বসে যত্ন করে পানি টা খায়ে দিল আদ্র। সবাই ফ্যালফ্যাল নয়নে চেয়ে রইল। এতো সিরিয়াস মোমেন্টে ও আদ্র তুলির জন্য শান্ত হয়ে গেছে। সবাইকে উপেক্ষা করে তুলির কেয়ার করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। কে কে উপস্থিত আছে তাতে যেন আদ্রর কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। তার কাছে যেন তুলিই প্রথম প্রায়োরিটি। গ্লাসটা টেবিলে রেখে নিজের পকেট থেকে রুমাল বের করে তুলির কপালের ঘাম গুলো মুছে দিল আদ্র। ভয়ে থরথর করে ঘামছে মেয়েটা। আদ্র গালে হাত রাখতেই লজ্জায় নুইয়ে গেল সাথে সাথে। শীতল হয়ে গেল আদ্রর বুক টা। এই মেয়েটার লজ্জামাখা মুখ আদ্রর রাগ কমানোর টনিক। হাত টা সরিয়ে কোমল স্বরে বলল,,

–” বড়দের মাঝে আর কথা বলবে না তুলি। বাবা আর আমাকে কথা বলতে দাও। বাঁধা প্রদান করা আমার একদম পছন্দ নয়। আর তোমার জন্য কোনো ঝামেলা বাঁধে নি। বাবা তোমাকে খুব পছন্দ করেন। ওনার সব প্রবলেম তো আমাকে নিয়ে। আমাকে খুব একটা পছন্দ করেন না তিনি। ওনার কথা মোতাবেক আমি ছোট থেকেই ওনার অবাধ্য।”

–“রিলেক্স থাকো। এতো ভয় পাচ্ছো কেন? আ’ম স্যরি উচ্চস্বরে ধমক দেওয়ার জন্য।”

আবারও নরম স্বরে কথাটা বলল আদ্র।

মনের মধ্যে ভালো লাগা ছেয়ে গেল তুলির। প্রকাশ না করতেই আদ্র সবসময় তার মনের কথা বুঝে যায়। এমন একরোখা, রাগী মানুষ এতো সুন্দর করে ভালোবাসতে পারে? তুলির নিজেকে এমুহূর্তে পেশেন্ট মনে হচ্ছে যার আদ্রর মতো বেস্ট একজন ডাক্তার সাহেব আছে। কথাগুলো শেষ করে রাদিফ সাহেবের সামনে এসে দাঁড়াল আদ্র। রাদিফ সাহেব গম্ভীর মুখে আদ্রর দিকে চেয়ে আছেন। হালকা হাসল আদ্র। দৃষ্টি স্থির রেখেই বলতে শুরু করল,,

–“আমি তো সিনক্রিয়েট করছি। আর আপনি বাবার অধিকার পেয়ে আমার জীবন টা শেষ করে দিচ্ছেন। আমি তুলি কে নিজের জীবনের চেয়ে বেশি ভালোবাসি জানা সত্ত্বেও আপনি আমায় বাধ্য করছেন অন্য কাউকে বিয়ে করতে। আসলে আপনি বললে ভুল হবে করছে তো আপনার ভাই। ”

আদ্রর কথা শুনে রাদিফ সাহেবের বড় ভাইয়ের দিকে ফিরে তাকাল সবাই। কারো মাথায় কিছুই ঢুকছে না। সামিরার চোখের পাপড়ি পানিতে ভিজে যাচ্ছে বার বার। আদ্রর মুখে তুলি কে ভালোবাসার কথা শুনে আর্তনাদ করে উঠল ভিতরটা।আদ্র ইনশিতার মাথায় হাত রাখল।

–“ভাইয়ের উপর বিশ্বাস আছে তোর? আমি তোর খারাপ চাইতে পারি কখনও?”

ভাই কে জরিয়ে ধরল ইনশিতা। কিছু না বুঝতে পারলেও আলতো হেসে বলল,,

–” কখনও না। আমরিন ও আমার কাছে তুমি শুধু একজন বড় ভাই না আমাদের ভালোবাসার আরেক নাম তুমি ভাইয়া। ”

স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল আদ্র। অনেক সহ্য করেছে। আর থাকতে পারবে না অশান্তির এই বেড়াজালে। বোনের জন্য চিন্তিত ছিল তাও যেন অনেকাংশে দূর হয়ে গেল। গত একটা বছর ধরে চিন্তা টা কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল তাকে। কিছুটা দূরে দাড়িয়ে থাকা রনকের দিকে তাকিয়ে বলল,,

–“আমি জানি তুই ইনশিতা কে অনেক ভালোবাসিস। ভালোবাসার মানুষ টার পাশাপাশি পরিবার ইম্পর্ট্যান্ট। কিন্তু তুই কি এটা জানিস তোর বাবা আমার ও সামিরার বিয়ের শর্ত রেখে তোর ও ইনশিতার বিয়ের জন্য রাজি হয়েছে? আমার বাবা কে বলা হয়েছে সামিরা কে আমি বিয়ে না করলে কখনও ইনশিতা কে তোদের বাড়ির বউ করে নিবে না।”

বিস্ময়ে থ মেরে রইল রনক। সায়েরা বেগম, রাদিফ সাহেব ও ওনার বড় ভাই বাদে সবাই রীতিমতো চমকে আছে। আদ্রর থেকে চোখ ফিরিয়ে সামিরা ও রনক তাদের বাবার দিকে তাকাল এক নজর। বিস্ময় কাটিয়ে সামিরা বলে উঠল,,

–“এসব সত্যি বাবা?”

অপরাধীদের মতো মাথা নিচু করে ফেললেন জুনায়েদ সাহেব।

–“হুম। তুই আদ্র কে ছোট থেকেই পছন্দ করিস। বয়সের সাথে ভালোবেসে ফেলেছিস সেটা জানতে পেরে আমি খুব খুশি হয়েছিলাম। কিন্তু দু বছর আগে যখন আদ্র তোর ভালোবাসা ফিরিয়ে দিয়েছিল আর তুই অশ্রু ঝরিয়ে আমার কাছে আদ্র কে চেয়েছিলি তখন বাবা হিসেবে নিজেকে ব্যর্থ মনে হচ্ছিল। রাদিফের কাছে সরাসরি তোর ও আদ্রর বিয়ের প্রস্তাব দেওয়াতে ফিরিয়ে দিয়েছিল আদ্র। অবশেষে রনক ও ইনশিতার সম্পর্ক জানতে পেরে আবারও প্রস্তাব দিলাম যে আদ্র তোকে বিয়ে করলেই আমি ইনশিতা কে রনকের বউ করব।”

মাথা নত করে একনাগাড়ে কথাগুলো বলে নিঃশ্বাস ছাড়লেন তিনি। সামিরার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ল মুহূর্তেই। অশ্রুকণা মুছে আদ্রর দিকে তাকিয়ে বলল,,

–” আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি আদ্র। তাই বলে জোর করে চাই না কখনও। জোর করে তোমাকে স্বামী তো বানাতে পারব কিন্তু কখনও তোমার ভালোবাসা টুকু পাবো না। বাবা কে ক্ষমা করে দিও। আমি বা রনক ভাইয়া কেউই জানতাম না এইসব। ইনশিতা আমারই ভাবী হবে।”

রনক ও সম্মতি জানাল সামিরার সাথে। তুলি চমকিত নয়নে চেয়ে রইল। সামিরা নিজের ভালোবাসা ত্যাগ করে দিচ্ছে। কতটা ভালোবাসলে এমনটা করা যায়? সামিরা কে দেখে তুলি ভাবতেই পারি নি ওর মনটা এতো সুন্দর। ইনশিতা তুলির কাছে এসে বসে হাতটা ধরল।

–” আমায় ক্ষমা করে দে তুলি। আমার জন্য তুই কষ্ট পেয়েছিস। আমি জানতাম না ভাইয়া তোকে ভালোবাসে। ”

–“তুমি ক্ষমা চাইছো কেন আপু? তোমার কোনো দোষ নেই। ”

এতোদিনের সব অবসাদ দূর হয়ে গেল আদ্রর। কথা না বাড়িয়ে তুলির কাছে গিয়ে বসল। এখন আর কোনো দুশ্চিন্তা নেই। ভাই হিসেবে বোনের জন্য ঠেকে গিয়েছিল কিন্তু সামিরা কে কখনও বিয়ে করত না সে। মনটা হুট করে বলল,,,

~”কোনো শর্তই আমি মানতাম না কারণ আমার জীবনের প্রথম শর্তই যে আমার তুলা।”

মুচকি হেসে মুগ্ধ কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,,

–” তুমি বিহীন শূন্য আমি। আমার জীবনসঙ্গীনি হবে তো তুলা?”

প্রচুর পরিমানে জড়তা-সংকোচ ঘিরে ধরল তুলি কে। মনের কোণো উদয় হল আবারও সুখের ঝলক। মুছে গেল সব অভিমান। বহু কষ্টে মাথা তুলে আদ্রর বাবার দিকে চাইল। সবার চোখে মুখে জানার আগ্রহ। একটু হেসে মাথা উপর থেকে নিচে করল তুলি। সাথে সাথেই কানে ভেসে এল করতালির শব্দ। নিজের পকেট থেকে একটা আন্টির বক্স বের করল আদ্র। আজ সকালে কিনেছিল আন্টি টা। ইচ্ছে ছিল তুলি কে সারপ্রাইজ দিবে আর সবকিছু ঠিক করে নিবে। কিন্তু এভাবে কিছু ঠিক করতে চাইনি সে তবুও হয়ে গেল। পরিবারের কাউকেই কষ্ট দেওয়া উদ্দেশ্য ছিল না তার। কিন্তু তুলির অবস্থা দেখে নিরুপায় ছিল সে। সামিরা ও রনকের কাছে ছোট করতে চাই নি ওদের বাবা কে। রিং টা তুলির আঙ্গুলে পড়াতেই হিমশীতল বাতাস বয়ে গেল তুলির পুরো দেহ জুড়ে। ভালোবাসার পরিণতির প্রথম ধাপ। তুলির চোখ ভরে এল।এই বুঝি আরেকটু সুখ পেলেই আষাঢ়ে বর্ষণ হবে দু চোখ থেকে। সবার মুখে ফুটে উঠল হাসি। সামিরার ঠোঁটের কোণায় হাসি লেগে থাকলেও চোখে জমে আছে জল।
___________

দুপুর গড়িয়ে বিকেল।বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যার প্রহর অতিবাহিত হওয়ার পথে। বেলকনিতে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে আদ্র। ব্যস্ত ভঙ্গিতে কিছু একটা ভেবে চলেছে। ইনশিতার বিয়ের ডেট ঠিক হয়েছে সামনের মাসের দুই তারিখে। বড় চাচা ক্ষমা চেয়েছেন অনেক বার। তবুও কিছু ভালো ঠেকছে না আদ্রর। সামিরার ব্যবহার আজ তাকে ভীষণ অবাক করেছে। মনে বাসা বেঁধেছে সন্দেহ। যেই মেয়ে সারাক্ষণ মেসেজ, কল দিয়ে জ্বালাতন করত বার বার ভালোবাসার দাবি নিয়ে উপস্থিত হতো তার এতো সহজে মেনে নেওয়া টা স্বাভাবিক লাগছে না আদ্রর কাছে। রনকের সাথে ভালো করে কথা বলা টা জরুরি। বোনের জীবন টা কে অবহেলায় নেওয়া যাবে না কোনো ক্রমেই। তুলি কে নিজের হবু স্ত্রী বানিয়ে তৃপ্তির শ্বাস ফেললেও বাবার সাথে এই প্রথম উচ্চস্বরে কথা বলে খারাপ লাগছে অনেক। আদ্র নিজেই মাঝে মাঝে ভীষণ চমকে যায় একটা পিচ্চি মেয়ের জন্য কতটা ডেস্পারেট হচ্ছে দিন দিন। সিগারেটে আরেকটা টান দিয়ে বিড়বিড় করে বলে উঠল,,

–“কি আছে তোমার মাঝে তুলা? ছোট্ট একটা মেয়ে তুমি অথচ ধারালো তোমার দৃষ্টি। যতবারই তোমার লজ্জায় রাঙা মুখটা দেখি নিমিষেই গায়েব হয়ে যায় আমার সব জেদ,রাগ,অভিমান। আমার মন বলে, মায়াবিনী তুমি।”

“এই যে হবু বর আপনি আবারও সিগারেট খাচ্ছেন? ”

অতি পরিচিত মধুর কন্ঠ শুনে সিগারেট টা হাতের মুঠোয় চেপে ধরল আদ্র। জ্বলে উঠল হাত টা। তুলি বেলকনি টপকে আসতে নিলে কোমড় আঁকড়ে ধরে নিজেই নিয়ে আসল আদ্র। বুকের সাথে জরিয়ে নরম স্বরে বলে উঠল,,

–” আবারও রিস্ক নিয়ে আসতে গেলে কেন? হাতে ব্যাথা ভুলে গেলে? ওষুধ খাইয়ে দিয়ে রেস্ট নিতে বলে আসলাম কিন্তু তুমি আমার কথা অমান্য করে চলে আসলে।”

আদ্রর বুকে মাথা রেখে তুলি জবাব দিল,,,

–“আপনি আমায় ক্ষমা করেছেন তো আদ্র? স্বস্তি পাচ্ছিলাম না আমি। এখনও খুব কষ্ট হয় কিভাবে পারলাম আমি আপনাকে অবিশ্বাস করতে।”

–” তুমি আমার অস্তিত্বে বাস করো তুলা। আমি যতই রাগ করি, অভিমান করি দিনশেষে একটাই সত্য আমি তোমায় অনিঃশেষ ভালোবাসি। আমার ভালোবাসা কখনও তুমি পরিমাপ করতে পারবে না। আমি কখনও না থাকলে স্মৃতির পাতায় ও তুমি অনুভব করতে পারবে আমার ভালোবাসা। মনে হবে এইতো বর্তমানে ও আমি তোমার অনুভবে তোমায় ভালোবেসে জরিয়ে নিচ্ছি আমার বাহুতে। ”

আদ্রর দেয়ালে ঘুষি মেরে ছিলে যাওয়া হাত টা নিজের হাতে নিল তুলি। আদ্রর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল আদ্রর ঠোঁটে প্রশস্ত হাসি। ভালোবাসা কখনও যন্ত্রণা দেয় তো কখনও আবার ছোট্ট একটা হাসি ফোটানোর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তুলির একটু ভালোবাসাই তার প্রমাণ। হাতের মুঠো খুলতেই চোখ পড়ল জ্বলন্ত জায়গা টা। তখন আদ্র যে সিগারেট চেপে ধরেছিল হাতে তা চোখ এড়ায় নি তুলির। মলিন হয়ে গেল চেহারা টা।মনে মনে বলে উঠল,,

–“আপনাকে শাসন করার বয়স আমার হয় নি আদ্র তবে আপনার যন্ত্রণা নিঃশেষ করার বুঝ টুকু আমার ঠিকি হয়েছে। নিজের সবটুকু ভালোবাসা দিয়ে কেঁড়ে নিব আপনার সবটুকু কষ্ট। ”

হাতের ভাজে গভীর একটা চুমু খেল তুলি। আদ্রের পায়ের উপর উঠে দু হাতে গলা জরিয়ে প্রশ্ন করল,,

–” আপনি আমায় এতো ভালোবাসেন কেন আদ্র?”

–” এক বিন্দু সুখ লাভের আশায় তোমায় ভালোবাসা টা ভীষণ জরুরী তাই! ”
#আকাশে_তারার_মেলা
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব -১৫

বাহিরে তুমুল বেগে বর্ষণ হচ্ছে। বারান্দা দিয়ে সুড়সুড় করে হিমশীতল বাতাস এসে ঢুকছে রুমে। পুরো রুম জুড়ে ঠান্ডা হাওয়া বিরাজ করছে। হঠাৎ করেই বৃষ্টির আগমনে কিঞ্চিত শীতল স্রোত অনুভব করলেও ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে যাচ্ছে তুলি। আদ্র তার সামনে বসে আছে স্কেল নিয়ে। হাত গুলো লাল হয়ে আছে বেচারির। এই নিয়ে পাঁচ বার স্কেলের বারি খেয়েছে। অপরাধ একটাই বায়োলজি বেঁটে খাওয়ালেও এই মেয়ের মস্তিষ্কে ঢুকবে না। কার্ডিয়াক চক্রের অংশ টা আদ্র অনেকবার বুঝিয়েছে কিন্তু তুলি পড়ায় মনোযোগ না দিয়ে গালে হাত রেখে ব্যস্ত ছিল আদ্র কে অবলোকন করতে। দু দিন পরেই ক্লাস টেস্ট কিন্তু এই মেয়ের পড়ালেখা নিয়ে কোনো মাথা ব্যাথা নেই। কোনোভাবেই আদ্র এটা মেনে নিতে পারছে না। প্রথম বার আদ্র ভালোভাবে বুঝিয়ে পড়ায় মনোযোগ দিতে বললেও বার বার সেইম কাজটাই করেছে তুলি। তুলির এহেন কান্ডে প্রচন্ড রেগে গেল আদ্র। আদ্রর রাগ মানেই তো মহা বিপদের সংকেত। অবশেষে তাই হলো যা হওয়ার। স্কেলের বারি খেয়ে এখন আহ্লাদী ভঙ্গিতে কাঁদতে ব্যস্ত তুলি। যদি একটু মায়া হয় আদ্রর আর তাকে রেহাই দেয় এই বায়োলজি নামক পেইন থেকে তাই কান্নার বেগ আরো বাড়িয়ে দিল। চোখ কটমট করে টেবিলে স্কেল দিয়ে জোরে একটা বাড়ি দিল আদ্র। কেঁপে উঠল তুলি। চেয়ার থেকে উঠে দৌড় মারার প্রস্তুতি নিল। এই লোক সাংঘাতিক। বনের হিংস্র বাঘ ও বোধহয় ওনার চেয়ে অনেক ভালো কথাটা ভেবেই পা বাড়াতে নিলেই হাতটা টেনে ধরল আদ্র। রাগী কন্ঠে বলে উঠল,,

–“পালানোর চেষ্টা করবে না তুলা। পড়া টা কমপ্লিট করো জলদি। দেখো রাত দশটা বেজে গেছে। পড়াটা শেষ করো।”

ছলছল চোখে আদ্রর দিকে চাইল তুলি। সাথে সাথেই দু চোখ বন্ধ করে নিল আদ্র। চোখ বুঁজেই টিস্যু এগিয়ে দিয়ে গম্ভীর স্বরে বলল,,

–” চোখ মুছে পড়ায় মনোযোগ দাও। আমি চোখ মেলে যদি তোমার চোখে এক ফোঁটা ও পানি দেখি এবার আর স্কেল দিয়ে মারব না সোজা ছাঁদ থেকে ফেলে দিব।”

আদ্রের হুমকি শুনে চোখ মুছে মিনমিন করে পড়তে লাগল। আঁড়চোখে আদ্রর দিকে চাইতেই চোখ আঁটকে গেল আদ্রর নীলাভ চোখে। ঠোঁটের কোণে প্রস্ফুটিত হাসি। মিইয়ে কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,,

–“আমায় দেখতে থাকলে পড়বে কখন তুলা?”

–“আপনি এতো সুন্দর হলে আমার চোখের কি দোষ বলেন তো ডাক্তার সাহেব! মন তো সারাক্ষণ আপনাকেই দেখতে চায়।”

তুলির সোজাসাপ্টা জবাবে চমকে উঠল আদ্র। তুলির আবেগময় কথা তার মনে সবসময় অস্বাভাবিক ঝর তুলে। এখনও হচ্ছে। ইচ্ছে করছে তুলি কে বুকের মাঝে চেপে ধরতে। কপালে ভালোবাসার পরশ একে দিয়ে আগলে রাখতে। নিজের হাতের মুঠোয় হাত টা আঁকড়ে ধরে বলতে,,

–“এতো আবেগী কথা বলবে না তুলা। সাতাশ বছরের যুবক টার জন্য কি তোমার একটুও মায় হয় না? সতেরো বছরের এক কিশোরী কন্যা তুমি অথচ আমাকে ভিতর থেকে নাড়িয়ে দেওয়া আমার জীবনে ধেয়ে আসা এক প্রকাণ্ড ঝড় তুমি।”

তুলি কে পড়া টা ভালোভাবে বুঝিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াল আদ্র। পা বাড়িয়ে দরজা পর্যন্ত গিয়ে ফিরে আসল আবারও। তুলি জিজ্ঞাসাসূচক দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই হাত টা টেনে লাল হয়ে যাওয়া হাতের ভাজে ঠোঁটের স্পর্শ বুলাল গভীরভাবে। তুলির হাতটা নিজের বুকের বা পাশে চেপে ধরল খুব যত্ন করে। ঈষৎ কেপে উঠল তুলি। শরীরের রন্ধে রন্ধে বয়ে গেল শিহরণ। আদ্রর হাতে নিবদ্ধ হাত টাও কাঁপতে লাগল প্রচন্ড। হাতটা আরেকটু শক্ত করে চেপে ধরে কোমল স্বরে বলে উঠল আদ্র,,

–” তোমার চোখের পানি ঠিক এখানটায় এসে আঘাত করেছে। এখনও মৃদু ব্যাথা হচ্ছে। একটু আধটু শাসন না করলে তুমি পড়ায় মন দিতে পারতে না তাই বুকে পাথর চেপে নিজের অস্তিত্বে একটুখানি ব্যাথা দিয়েছি। এখন মনে হচ্ছে তোমাকে শাসন ও করতে পারব না আমি। দিন দিন ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়ছে আমার হার্ট টা। হৃদস্পন্দন ও স্বাভাবিকভাবে হয় না।”

হাতটা ছেড়ে দিয়ে তুলির কপালে চুমু একে দিল আদ্র। স্তব্ধ হয়ে বসে আছে তুলি। তার হার্ট টাও যে দুর্বল হয়ে পড়েছে। আদ্রর কথাগুলো কানে ঝংকার তুলে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল বার বার। অক্ষি যুগল আটকে আছে আদ্রর যাওয়ার পানে চেয়ে। হাত টা এখনও কাঁপছে। আদ্র চলে যেতেই উঠে দাঁড়াল । আমরিনের রুমে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই তুলির চোখ গেল দরজায়। রাদিফ সাহেব দাড়িয়ে আছেন।তুলির মুখে হাসি ফুটে উঠল। আলতো হেসে বলল,

–“ভিতরে আসুন খালু।”

রাদিফ সাহেব এসে চেয়ারে বসলেন। তুলি বিছানায় বসে নম্র স্বরে বলল,,

–“কিছু বলবেন খালু?”

হালকা হাসলেন তিনি। তুলির মাথায় হাত রেখে জিজ্ঞেস করলেন,,

–“তুই কি আমার সাথে রাগ করেছিস মা?”

–“না খালু। রাগ করব কেন? আপনার সাথে আমার কোনো রাগ নেই। আমি জানি আপনি যা করেছেন সবার ভালোর কথা ভেবেই করেছেন।”

–“আমি আমার ছেলের ভালো টা বুঝতে পারি নি মা। সবসময় আমার সব ডিসিশন চাপিয়ে দিয়েছি ওর উপর। এতো একরোখা, রাগী মানুষ হয়েও আমার কথাগুলো অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে সর্বদা। কোনোদিনও আমার কোনো কথার অবাধ্য হয় নি। তোর বেলায় হয়েছে। তোকে পাওয়ার জন্য আমার সামনে মাথা নত করে চোখের জল ফেলেছে। কিন্তু আমি ওর এই একটা আবদার মেনে নিতে পারি নি। আমার জন্য অনেক কষ্ট পেয়েছে। আমি যে মেয়ের ভালো চেয়েছি এমনটা নয়। আমি আমার ছেলের ভালো চাইতে গিয়ে ওকে দিনের পর দিন কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। তুই তো আদ্রর থেকে বয়সে অনেক ছোট। আমার মনে হতো আদ্রর মনে তোর জন্য জেগে উঠা ভালোবাসা টা ভুল। নিজের ছেলের জন্য তো আমি তোর সাথে অন্যায় করতে পারি না। তোর ও ভালো লাগা আছে। তোর মনেও বয়সের সাথে কারো না কারো জন্য ভালোবাসা জাগতে পারে সেটা ভেবে পিছিয়ে পড়ি আমি। সামিরার সাথে বিয়ে ঠিক করি। আমি ভেবেছিলাম সামিরা কে বিয়ে করলে আদ্র ঠিক হয়ে যাবে। ভুলে যাবে তোকে। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম। তুই আমাকে ভুল প্রমাণ করে দিলি। আমি কখনও ভাবতেও পারি নি তুই আদ্র কে ভালোবাসবি। আমি অনেক খুশি হয়েছি। কিন্তু আমি ভালো বাবা হয়েও উঠতে পারি নি তুলি। নিজের ছেলের মনের কথা বুঝেও কঠোর হয়ে ছিলাম।

কথাগুলো বলতে বলতে কেঁদে দিলেন আদ্রর বাবা। গম্ভীর মানুষ গুলোকে সহজে কাঁদতে দেখা যায় না। কোনো চাপা কষ্টের কারণেই তাদের চোখে থেকে ঝরে পড়ে জল। মলিন চোখে তাকিয়ে রইল তুলি। বাবার বয়সী এই লোক টা কে কাঁদতে দেখে খুব কষ্ট হচ্ছে তার। কন্ঠে জড়তা নিয়ে বলল,,

–” নিজেকে সামলান খালু। আদ্র ভাইয়া আপনাকে খুব ভালোবাসে। একবার কাছে টেনে নিন দেখবেন আপনার ছেলের জমে থাকা সব কষ্ট, অভিমান উদাও হয়ে গেছে। আপনি তো আমার ও আদ্রর ভালোই চেয়েছিলেন। এখন শুধু দোয়া করবেন আমাদের জন্য। সব ঠিক হয়ে যাবে।”

–“তুই ঠিক তোর মায়ের মতো। তোর মা ও ঠিক এমন করেই শান্তনা দিত। যেদিন তোর খালার বিয়ের তারিখ নির্ধারণ হয়ে গিয়েছিল আমি প্রায় পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। তোর মা ভরসা দিয়েছিল আমায় যে তোর খালার বিয়ে টা হতেই দিবে না। বয়সে ছোট থাকলেও তোর মতই বেশ সাহসী ছিল। তোর খালা কে আমার সাথে পালাতে সাহায্য করেছে। ”

–“আম্মু বলেছিল। তারপর বড় নানা ভাই অনেক বকেছিল আম্মু কে। আর নানু তো অনেক মেরেছিল আম্মু কে। টানা সাত দিন গায়ে জ্বর ছিল আম্মুর। এসব শুনে সবাই তো হেসে কুটিকুটি। ”

–” আমি অনেক খুশি। মন থেকে খুশি যে রানুর মেয়ে আমার ছেলের বউ হবে। প্রথমে চিন্তা থাকলেও এখন সব চিন্তা দূর হয়ে গেছে। আমার ছেলে টা তোর জন্য জীবন দিতেও পিছুপা হবে না। ওকে কখনও কষ্ট দিস না মা। তোরা সুখে থাকলে আমি খুব শান্তি পাব।”

–” আপনার ছেলের ধারে কাছে ও কখনও কষ্ট, দুঃখ কে ঘেষতে দিব না খালু। দোয়া করবেন আমি যেন বেস্ট পুত্রবধূ হতে পারি।”

তুলির কথায় হেসে দিলেন রাদিফ সাহেব। তুলিও হাসতে লাগল তাল মিলিয়ে। আমাদের ভাবনা একটা গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ হয়তো নিষ্ঠুর হয়। কিন্তু কখনও কখনও আড়ালে নরম প্রকৃতির একটা রূপ ও লুকিয়ে থাকে।
__________
নীল একটা শাড়ি হাতে নিয়েই আয়নায় নিজেকে ঘুরে ঘুরে দেখছে তুলি। আজ রিমি ও সাগরের গায়ে হলুদ। সময় তো প্রবাহমান। কারো জন্যই থেমে থাকে না। দেখতে দেখতে কতোগুলো দিন কেটে গেল। শাড়ি টা আজ বিকালে এনে দিয়েছে আদ্র। শাড়ির আঁচল টা মাথায় দিয়ে লাজুক হাসল তুলি। সায়েরা বেগম দ্রুত পা চালিয়ে ছুটে এল তুলির রুমে। ঢুকতে ঢুকতে বললেন,,

–“বাহ! বেশ সুন্দর লাগছে তো আমার বউ মা কে। তা আঁচল মাথায় দিয়ে রাখলে চলবে? পড়তেও তো হবে। আদ্র তো চলে আসবে এখনই।”

লজ্জায় চুপসে গেল তুলি। শাড়ি টা সায়েরা বেগমের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,,

–“পরিয়ে দাও খালা মণি। আমরিন যাবে না?”

–“ওর শরীর টা একটু খারাপ। কাল যাবে বিয়েতে।”

শাড়ি টা পড়াতে পড়াতে জবাব দিলেন সায়েরা বেগম। খুব সুন্দর করে শাড়িটা পড়িয়ে দিয়ে তুলির দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকালেন।

–” তোকে একদম বউ বউ লাগছে তুলি। আমার তো এখনই ইচ্ছে করছে তোকে ধরে বেধে আমার ছেলেটার বউ বানিয়ে দিতে। শাড়ি তে তোর বয়স টাই ধরা যায় না।”

–” আমার লজ্জা করছে খালা মণি।”

হেসে উঠলেন সায়েরা বেগম। তাড়া দিয়ে চুল টা বেঁধে দিলেন সুন্দর করে। খোপায় গেঁথে দিলেন একটা সাদা গোলাপ। সম্পূর্ণ রেডি হয়ে তুলি নিচে নেমে এল হাতে মোবাইল টা নিয়ে। সোফায় বসে অপেক্ষার প্রহর গুণতে লাগল আদ্রর জন্য। বিকেলে এসে আদ্র আবারো হসপিটালে চলে গেছে। ফোনে মেসেজের আওয়াজ আসতেই উঠে দাঁড়াল তুলি। হাঁটতে হাঁটতে মেসেজ টা ওপেন করতেই মুখে ফুটে উঠল হাসির ছাপ। তুলি জানত মেসেজ টা আদ্রই পাঠিয়েছে। ” ঝটপট গাড়ির কাছে চলে এসো তুলা”। মেসেজ টা পড়ে পায়ের গতি আরও বাড়িয়ে দিল তুলি। গাড়ির কাছে আসতেই দরজাটা খুলে দিল আদ্র। ভিতরে বসে আদ্রর দিকে চোখ ফিরিয়ে চাইতেই থমকে গেল তুলি। নীল পাঞ্জাবি পড়েছে আদ্র। ফর্সা চেহারা তে নজরকাড়া হাসি। হয়তো হসপিটাল থেকেই রেডি হয়ে এসেছে। তুলির চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে বার বার। শত চেষ্টা করেও চোখ সরাতে পারছে না সে। আদ্র এক দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। গাড়ি স্টার্ট দিতেই ধ্যান ভাঙল তুলির। ধীর স্বরে বলে উঠল,,,

–“আপনি আমার দিকে তাকাচ্ছেন না কেন আদ্র?”

—” তোমার দিকে তাকালে যে ভয়ংকর কিছু ঘটে যাবে তুলা।”

দৃষ্টি সামনে রেখেই ঘোর লাগা কন্ঠে কথাটা বলল আদ্র। তুলি রোবটের ন্যায় চক্ষু স্থাপন করে রইল আদ্রের দিকে। আদ্রর কথার মানে বুঝার চেষ্টায় লেগে পড়েছে তার মস্তিষ্ক। সারা রাস্তাই আদ্রর দিকে কাটিয়ে পাড় করে দিল মেয়েটা। তবুও খুঁজে পেল না আদ্রের সেই কথার মানে। গাড়ি থেকে বের হতেই আদ্র মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করল,,,

–“চোখ ব্যাথা করছে নাতো?”

তুলি যেন এখনও কোনো ঘোরের মাঝে ডুবে আছে। আনমনেই মাথা নেড়ে না বুঝাল। আলতো হেসে তুলির এক হাত টেনে কমিউনিটি সেন্টারে প্রবেশ করল আদ্র। মেয়েটা বড্ড অবুঝ। রিমি তুলি কে দেখতে পেয়েই জড়িয়ে ধরল।

–“কেমন আছো তুলি?”

–“আলহামদুলিল্লাহ আপু। শুভ কামনা তোমার নতুন জীবনের জন্য। ”

–” তোমাকে ও অগ্রিম শুভ কামনা তোমার ও আদ্রের বিয়ের জন্য। ”

পায়েল, অন্তু,সাগর, নিবিড় ও শুভ কামনা জানাল। আফসোসের সুরে অন্তু আদ্রের দিকে তাকিয়ে বলল,,

–” ইশশ! কত কষ্টদায়ক যে অপেক্ষা করা। পিচ্চি মেয়েদের প্রেমে পড়লে এই এক জ্বালা। অপেক্ষা করতে থাকো। করতে করতে বুড়ো হয়ে যাও।”

অন্তুর কথা শুনে লজ্জায় মাথা নত করে ফেলল তুলি।আদ্র তুলি কে এক হাতে জড়িয়ে নিয়ে অন্তুর উদ্দেশ্যে বলল,,

–” মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ও আমি অপেক্ষা করতে রাজি।”

সবাই হই হুল্লোড় করে বলে উঠল,,–” ইহাই তো টুরু লাভ।”

আদ্র মুগ্ধ হাসি উপহার দিয়ে বলল,,–“দেখবি আমাদের প্রণয় কাহিনী একদিন তোরা তোদের নাতি-নাতনীদের শুনাবি।”

এক রাশ হাসি হাসল সবাই। মেতে উঠল অনুষ্ঠানে। তুলির এসব অনুষ্ঠানে ভীষণ অস্বস্তি লাগে। ক্লান্তি ও ঘিরে ধরে। শুধুমাত্র রিমির জন্যই আসা। বারোটা বেজে গেছে। সবাই কে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে এল সেন্টার থেকে। গাড়িতে বসেই তুলির খালি কোমরে আঁকড়ে ধরে নিজের একদম কাছে টেনে নিয়ে আসল আদ্র। আচানক হামলায় প্রচন্ড জোরে কেঁপে উঠল তুলির হৃদপিণ্ড। আদ্রর চোখে চোখ রাখতেই নিজেকে সামলানো বেগতিক হয়ে পড়ল তুলির। চোখ দুটো তে মুগ্ধতার ছাপ। ঠোঁটে লেগে আছে অমায়িক হাসি। দমবন্ধ হয়ে আসছে তুলির। এই হাসি তুলির মনে মাদকতার মতো কাজ করে। আদ্র নিজের গাল টা এগিয়ে তুলির গালে স্লাইড করল আলতো করে। তুলির কানের পাতায় ঠোঁট ছুঁয়ে দিল। শাড়িতে খামচে ধরল তুলি নিজের দু হাত। কানের কাছে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে আদ্রর স্লো ভয়েস।

–” বলেছিলাম না ভয়ংকর কিছু ঘটে যাবে?”

দু চোখ বুঁজে আদ্রর বুকে মাথা এলিয়ে দিল তুলি। নিশ্চুপ থাকা ছাড়া আর কোনো পথ দেখছে না সে। হৃদপিণ্ডের দ্রুত গতিতে উঠানামা ক্ষণে ক্ষণে কাঁপিয়ে তুলছে তাকে। এক হাতে তুলি কে জড়িয়ে গাড়ি স্টার্ট দিল আদ্র। সমস্যা বাঁধল মাঝ পথে এসে। গাড়ি বন্ধ হয়ে যেতেই ঘুম ঘুম চোখে মাথা তুলে তাকাল তুলি।

–“কি হয়েছে আদ্র?”

–” গাড়ির চাকা হয়তো পাঞ্চার হয়ে গেছে। এক্সট্রা চাকা ও তো নেই গাড়িতে।”

–” এখন আমরা বাড়িতে কিভাবে যাব আদ্র?”

আঁতকে উঠে কথাটা উচ্চারণ করল তুলি।

–” দেখি গাড়ি পায় কিনা!”

রাস্তার কিনারায় আদ্রর বাহুতে হাত জরিয়ে মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল তুলি। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পরও কোনো গাড়ি না পেয়ে বাড়ির ড্রাইভার কে কল করার জন্য মোবাইল টা বের করতেই একটা মেয়ে এসে বলে উঠল,,,

–” ওও স্যার পাশের মাইয়া ডার থাইক্কা আমি বহুত সুন্দর। আপনে আমারে লইয়া যান। কম টেকা দিলেও হইব। আপনি যা হ্যান্ডসাম,,

কথাটা তুলির কর্ণপাত হতেই চড়চড় করে রক্ত উঠে গেল মাথায়। কষিয়ে থাপ্পড় মেরে দিল মেয়েটার গালে। হতভম্ব হয়ে গেল আদ্র। কলে ব্যস্ত থাকায় ভালোভাবে খেয়াল করে নি সে। তুলির রাগী মুখ দেখে বিস্ময়ে থ মেরে গেল। থাপ্পড় মেরে ক্ষান্ত হয় নি তুলি। তেড়ে গেল মেয়েটার দিকে। গলা চিপে ধরতেই পিছন থেকে কোমর ধরে টেনে আনল আদ্র। তুলি লাগাতার চিল্লিয়ে বলতে লাগল,,

–” অসভ্য মাইয়া। তোরে আজ মেরে ফেলমু আমি। আমার আদ্রর দিকে তাকাইলি কেন? আমার আদ্র কে বাজে অফার করস? তোর চোখ খুলে ফেলমু আজ। হাত ভেঙে ফেলমু। জিহ্বা কেটে হাতে ধরিয়ে দিমু।”

কথাগুলো বলে হাত -পা ছুড়তে লাগলে অনবরত। হাতের কনুই গিয়ে বিধছে আদ্রর বুকে। ব্যাথা পেলেও দাঁত চেপে সহ্য করে নিচ্ছে। বড় বড় শ্বাস ফেলে মেয়ে টা ভয়ে দৌড় লাগাল কোনোদিকে না তাকিয়ে। তুলির ছুটাছুটি থামানোর কোনো উপায় না পেয়ে ঘুরিয়ে নিজের সাথে শক্ত করে চেপে ধরল আদ্র। আদ্রর বুকে মাথা রেখে ডুকরে কেঁদে উঠল তুলি
। বুকটা ধুক করে উঠল আদ্রর। অস্থিরতা ফুটে উঠল চোখে মুখে । তুলির মুখটা দু’হাতে আগলে নিয়ে বলল,,,

–“কাঁদছো কেন?”

–” আমি কখনও আপনাকে অন্য কারো হতে দিব না আদ্র। আপনি আমার থাকবেন সবসময়। থাকবেন তো?”

–” থাকবো। এখন কান্না অফ করো। বলেছি না তোমার চোখের পানি আমার হৃদয়ে রক্ত হয়ে ঝড়ে?”

–” হু।আরেকটা ভয়াবহ কান্ড ঘটে গেছে আদ্র। “( মলিন স্বরে)

—” কি?”(ভ্রু কুঁচকে)

–“শাড়ির কুঁচি গুলো বোধহয় খুলে পড়ে যাবে।”

করুন সুরে কথাটা বলল তুলি। আদ্রর ভীষণ হাসি পেল তুলির কথা শুনে। ঠোঁট দুটো প্রসারিত করে বলল,,,

–” কুঁচি গুলো ধরে রাখতে পারবে তো?”

–“হুম।কিন্তু! ”

–“ব্যাস! তাহলে আরকি। চলেন তুলা রাণী।”

তুলি কে কোলে তুলে নিল আদ্র। এক হাতে আদ্রর পাঞ্জাবি খামচে ধরে অন্য হাতে কুঁচি গুলো চেপে ধরে রাখল তুলি। এক নজরে তাকিয়ে রইল আদ্রর হাসোজ্জল মুগ্ধময় চেহারার দিকে। প্রশান্তির বাতাস ছেয়ে গেল মনে। তুলির ছোট্ট মনের একটাই প্রত্যাশা চিরকাল এই প্রশান্তির বসবাস থাকুক তার অন্তর জুড়ে।

#চলবে,,,,

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here