#ধূসর_রঙের_প্রজাপতি
#ফাতেমা_তুজ
#part_42
ভোর ছয় টা নাগাদ ঢাকার সায়েদাবাদ বাস কাউন্টারে বাস এসে থামলো। সারা রাত নির্ঘুম কেটেছে দুজনের। এই কয়েক ঘন্টায় নিজে দের বেদনার বিসর্জন দিতে হয়েছে। কিছু পেতে হলে কিছু ছাড়তে তো হবেই। আর সব কিছু অতি সহজে হবে এমন তো নয়। বাস থেকে নেমে মন মরা করে রইলো ঝিল।
প্রচন্ড মন খারাপ তাঁর । অভিনব নিজের মনের অবস্থা বোঝাতে ইচ্ছুক নয়। কারন এতে মেয়েটা আরো বেশি দূর্বল হয়ে যাবে। কোনো কথা বলছে না ঝিল । চোখের পানি গুলো গালে এসে শুকিয়ে রেখা হয়েছে।
অভিনবর অন্তঃকরনে ব্যথা অনুভব হলো। ঝিলের হাত দুটো মুঠো বন্দী করে নিলো। পর পর দু বার চুমু খেল। ডুকরে কেঁদে উঠলো মেয়েটা। আবেগ কে লুকায়িত করার শক্তি তাঁর নেই।
অভিনব কে ছাড়া কিছু ভাবতে পারছে না। সর্বশেষ ব্যাথাতুর অনুভূতি গুলো গলায় এসে দলা পাকিয়ে গেছে। একটু ছোঁয়া পেয়েই কান্না হয়ে ঝরে পরছে। অভিনব অনুনয়ের স্বরে বলল
_ আমরা আর কিছু দিন পরে ফিরে যাই ?
_ নাহহ। এতে করে আমাদের দূরত্ব আরো বাড়বে। যত সময় তোমার কাছাকাছি থাকবো আমি ততো পাগল হয়ে যাবো।
_ তাহলে কাঁদছো কেন ?
_কি করবো তাহলে ? অনেক বেশি জড়িয়ে গেছি আমি। তুমি বুঝো আমার ভালোবাসা?
_ এই মেয়ে কি সব বলছো? আমি বুঝি না তোমায় ? একদম কাঁদবে না। আমরা খুব তাড়াতাড়ি একে অপরের হয়ে যাবো।সবার সম্মতি থাকবে তাতে। তুমি কাঁদলে আমি কি করে ঠিক থাকি বলো তো ?
ঝিল ফ্যাচ করে কাঁদতে লাগলো। দ্বিগুন বেড়ে গেছে কান্নার বেগ। অদ্ভুত লীলা খেলায় অন্তর কাঁপছে। তবু ও পারছে না সামলাতে।
বেশ অনেক ক্ষন অভিনবর বুকে মুখ গুঁজে কাঁদলো।
ঝিলের কান্না থেমে গেলে পার্কিং স্পট থেকে সমস্ত ডিটেলস দিয়ে নিজের গাড়ি টা নিয়ে নিলো। গাড়ি ড্রাইভ করার সময় দুজনের মাঝে একটা কথা ও হলো না। মৌনতা ফোন করেছে ঝিল নিজেকে স্বাভাবিক করে রিসিপ করলো।
_ আজ ফেরার কথা তো ঝিল ?
_ হ্যাঁ । আমি চলে এসেছি , এখন বাসায় যাচ্ছি।
_ ফোন করবি তো আমায় ? আমি তো দেখা করতে চেয়েছিলাম।
_ কয়েক দিন যাক তারপর না হয় দেখা করবো।
_ একটা কথা ছিলো ঝিল। তোর মুড কেমন এখন ?
_ প্রচন্ড বাজে।
_আচ্ছা তাহলে পরে বলবো কেমন ?
_ সিরিয়াস হলে এখনি বল মৌন। এতো হেজিটেট করছিস কেন ?
_ আরে না সিরিয়াস কিছু না। বাসায় পৌছে ফোন করিস।
_ আচ্ছা।
ঝিল ফোন রেখে দিলো। মনের অবস্থা একদম ই ভালো নেই। তাই মৌনতার কথা টা গাঁয়ে মাখলো না।
হঠাৎ করে ব্রেক কষলো অভিনব। ঝিল অবাক চোখে তাকালো। অভিনব একটু হেসে বলল
_ ফুচকা খাবে ?
*
মির্জাপুরে প্রবেশ করতেই ঝিলের চিত্ত কেঁপে উঠলো। আর মাত্র কিছু সময়। অভিনবর থেকে দূরে যেতে হবে। বুকে শূন্য তা যেন খা খা করছে। অভিনবর চোখ মুখ কেমন কালচে হয়ে গেছে।
অনুভূতি ছাপানোর ক্ষমতা সে হারিয়েছে। জীবন নাটকীয়তার থেকে ও নাটকীয় । আজ যাকে নিয়ে পথ চলছি কাল সে পাশে নেই। ব্যাথা ভোলা কি যায় ?
প্রেমের ব্যাথা তো তর তর করে বাড়ে। বিচ্ছেদের নীল ব্যাথা কি করে সহ্য করে তাঁরা?
এতো সহজ ছেড়ে দেওয়া ?
সড়ু রাস্তার পাশে গাড়ি থামায় অভিনব। ঝিলের বাসা টা চকচক করছে। অভিনব এক পলক তাকিয়ে ফোঁস করে নিশ্বাস ফেললো। ঝিলের দিকে তাকাতেই বুকে চিন চিন ব্যাথা অনুভব হলো। হাতে মুখ গুঁজে কাঁদছে মেয়েটা।
অথচ আগের বার কতোটা হাসি খুশি ছিলো।
_ কেঁদো না প্লিজ।
_ কি করে থাকবো আমি ?
_ আমি তো আছিই। রোজ নিয়ম করে হাজার একটা কল করবো। দুদিন বাদে ঘুরতে ওহ যাবো প্রমিস।
ঝিলের মন গললো না। হুমড়ি খেয়ে পরলো অভিনবর গাঁয়ে। অভিনবর হৃদস্পন্দন গুলো যেন স্থির হয়ে গেছে। এই পাগলী মেয়ে টাকে ছাড়া থাকবে কি করে ?
_ প্লিজ ঝিল।
_ আমি পারছি না অভিনব। আমি পারছি না সামলাতে। কষ্ট হচ্ছে খুব।
ঝিলের মাথা টা উঁচু করে নিলো। চুল গুলো গুছিয়ে কপালে চুমু খেলো। মেয়েটার হিচকি উঠে গেছে। এভাবে অসুস্থ হয়ে যাবে। চোখের পানি গুলো গাল বেয়ে ঠোঁটে এসে লাগছে। তা দেখে অভিনবর বেশ হাসি পেল।
বিষয় টা খুব তাড়াতাড়ি ঘটে গেল যে ঝিল প্রতিবাদের সময় পেল না। অভিনবর আর্দ্র ঠোঁটের স্পর্শে কেঁপে উঠলো। দু হাতে জড়িয়ে ধরলো।
অভিনব নিজেই দিশাহীন হয়ে পরলো। ঝিলের গলায় মুখ গুঁজে নিশ্বাস নিলো। কি করে থাকবে ?
ঝিল আর কাঁদলো না। হাসি মুখে বিদায় দিতে হয়। তাই জোড় করে হাসি ফোটালো। যদি ও সে হাসি টা স্থায়ী হলো না। অভিনব বুকে হাত গুঁজে গাড়ির দরজায় হেলান দিয়ে রইলো।
এক পা দু পা করে আগাতে লাগলো ঝিল। ঝিলের চলে যাওয়া বুকে রক্তক্ষরণ করছে। তবু ও নিজেকে সামলে নিলো অভিনব। দীর্ঘশ্বাস গুলো লুকিয়ে গাড়ি নিয়ে চলে গেল।
মেইন গেট থেকে এক পলক তাকালো ঝিল। অভিনব চলে গেল ভাবতেই মাথা ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। সময় মানুষ কে কতোটা বদলে দেয়।
সময়ের আবর্তনেই আমাদের চলতে হয়। সব কিছুই থাকে হাতের বাইরে।
*
বাড়ির মেইন ফটক দিয়ে ঝিল কে আসতে দেখে দৌড়ে আসে আহনাফ। পুরো হতবাক হয়ে গেছে। কারন আর ও কয়েক দিন পর ঝিলের আসার কথা।
ঝিল একটু হাসে তবে হাসি হাসি মুখের বদলে ছলছল নয়নে তাকায়।
আহনাফের বুক ভারী হয়। আদুরে গলায় বলে
_ কি হয়েছে বনু ? কাঁদছিস কেন ?
_ কত দিন পর দেখলাম তোমাদের।
_ বনু।
ঝিল কে জড়িয়ে ধরে আহনাফ। নিজের কান্না আটকাতে পারে না মেয়েটা। ঝরঝরে কাঁদে, আহনাফ প্রচন্ড শকড। এর আগে ও ঝিল পালিয়েছে। আর অনেক দিন পর বাড়ি ফিরেছে তখন তো খুব রেগে থাকতো। অথচ আজ কাঁদছে। কোনো বিপদ হয় নি তো ?
অজানা ভয়ে বুক কেঁপে উঠে। ঝিলের মাথায় স্নেহের হাত রেখে বলে
_ ঠিক আছিস তুই ?
নাক টেনে উত্তর দেয় ঝিল।
_ হুমম।
বাগানের ডান পাশে দাঁড়িয়ে প্রচন্ড রেগে কারো সাথে কথা বলছিলো সজল। হঠাৎ চোখ যায় ঝিলের দিকে। ফোন রেখে ছুটে আসে।
_ বোন !
_ ভাইয়া।
সজল কে জড়িয়ে ধরে ঝিল। কাঁদতে কাঁদতে ছেলেটার শার্ট ভিজিয়ে ফেলে। সজল গলা উঁচিয়ে ডাকে
_ পাপা , মেঝো পাপা , ছোট পাপা রাফাত কোথায় তোমরা।
দেখো ঝিল ফিরে এসেছে।
আহনাফ ওর ফ্রেস হওয়ার ব্যবস্থা কর।
আহনাফ চলে যায়। সজল আদুরে গলায় ডাকে।
_ বোন ! আমরা খুব স্যরি। এভাবে পালিয়ে যাস কেন বল তো ?
বিয়ে টা করলে কি এমন হবে ?
_ আম স্যরি ভাইয়া।
_ থাক আর কোনো কথা নয়। এখন সব কিছু মাথা থেকে ঝেরে ফেল।
ঝিল নাক টেনে মাথা কাত করে। সজলের সাথে বাসার ভেতরে যেতেই পাপা দের দেখা মেলে। একে একে সবার সাথে কথা বলে। আশ্চর্যজনক ভাবে এবার ও কেউ রেগে নেই।
উল্টো সবাই সাফাই গাইছে। ঝিলের চোখ ভরে উঠে। কষ্টের অনুভূতি টুকু ভুলে যায়।
*
ধূসর আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে অভিনব। বুকের ভেতর শূন্যতা টা পোরাচ্ছে খুব। বাবা মা আজকে রাতের ফ্লাইটেই রওনা হবেন। অভিনবর বিশ্বাস মামা রা মা কে দেখলে মুখ ফেরাতে পারবেন না।
অভিনব ঠিক করেছে ভেজাল টা মিটে গেলেই ঝিলের বিষয় টা জানিয়ে দিবে। ঝিল কে ছাড়া সময় যেন কাঁটছেই না। পুকুর পাড়ে পা মেলে বসে পরলো। পাশে থাকা কংক্রিট গুলো পুকুরের পানি তে ছুড়তেই পেছন থেকে ডাক পরে ফুলের।
অভিনব পেছন ঘুরে তাকাতেই ফুল হাসি মুখে বলে
_ ইহান ভাইয়া তুমি এসে গেছো। বাসায় কেন যাও নি ?
_ যাবো তো ফুল ঝুঁটি । পুকুর পাড়ের হাওয়া নিচ্ছিলাম।
_ বনে বাঘ দেখেছো তুমি ?
_ দেখেছি। বাঘের সাথে বাঘিনী ওহ দেখেছি।
_ বাঘিনী !
_ হুমমম আমার পাশে বসো। আমি তোমাকে বাঘিনীর ছবি দেখাচ্ছি।
ফুল হাস্য উজ্জল মুখে অভিনবর পাশে বসে। ছবি তে বাঘ দেখলে ও বাঘিনী দেখা হয় নি। বাঘিনী বিষয় টা শুনে নি কখনো। ফোনের দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো অভিনব। ফুলের আড়ালে ছবি টা তে চুমু খেল।
ফুল বলল
_ বাঘিনী দেখাবে না ?
_ দেখাচ্ছি তো।
ফোন টা ফুলের হাতে তুলে দেয় অভিনব। ফুল ভ্রু কুঁচকে ছবি টা দেখে তাঁর ছোট্ট মস্তিষ্ক প্রশ্ন করে
_ এটা তো একটা আপি ,আপি টা কি করে বাঘিনী হয় ?
বিগলিত হাসে অভিনব। ফুলের হাত থেকে ফোন টা তুলে নিয়ে একটা ভিডিও অন করে। বিস্ময়ে ফুলের মুখ হা হয়ে যায়। অভিনব ফুলের চুল গুলো এলোমেলো করে বলে
_ বুঝেছো ?
ফুল উত্তর দেয় না। অভিনব ঝুঁকে ফুলের হাত মুঠো বন্দী করে আশে পাশে তাকিয়ে ফিস ফিস করে বলে
_ কাউকে বলবে না তো ?
_ আচ্ছা।
_ এই যে দেখলে আপি টা আমাকে বাঁচাতে কিভাবে ছুটেছিলো। বাঘিনী না হলে এতো সাহস কারে থাকে ?
ফুল মাথা দোলায় অর্থাৎ না। অভিনব ফুলের গাল টেনে দেয়। লুকিয়ে রাখা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে
_ এই আপি টা আমার বাঘিনী বুঝেছো। আমার জন্য দুনিয়া এফোর ওফোর করতে পারে। খুব ভালোবাসে আমায়।
_ ভালোবাসে ?
_ হুমমম। আমি ও খুব ভালোবাসি ।
ফুল ফ্যাল ফ্যাল করে তাকায় ফুল। একটু ভেবে খিল খিল করে হাসে। অভিনবর দৃষ্টি দেখে বলে
_ আমার ভাবি হবে তাহলে ?
_ হুমম। ভাবি হবে না অলরেডি তোমার ভাবি ।
_ সে কি করে হয় ? তুমি তো বিয়েই করো নি।
অভিনব উত্তর দিতে গিয়ে ও দেয় না। ফুলের ছোট মস্তিষ্ক এতো কিছু বুঝবে না। ফুল কে কোলে তুলে নেয়। একটা চকলেট হাতে দিয়ে বলে
_ বাসায় যাই আগে , কাল কে গেস্ট আসবে।
_ গেস্ট আসবে ?
_ হুমমম তোমার ফুপি মা আসবে।
_ সত্যি ?
_ হুমমম।
ফুল কে কোলে নিয়েই হাঁটে অভিনব। ফুলের মিষ্টি চেহারা ঝিল কে মনে করিয়ে দেয়। ঝিলের চেহারার আদল টা খানিকটা ফুলের মতো।
বাসায় যেতেই সবাই কে দেখতে পায়। মামাদি সাথে কথা বলে নেয়। তবে মামা দের দেখতে পেয়ে অবাক হয়। এতো আগে তো আসার কথা ছিলো না। ইববান শিকদার প্রশস্ত হেসে অভিনবর সাথে আলিঙ্গন করে।
_ কেমন আছিস ইহান ?
_ ভালো মামা। তোমরা এতো আগে ফিরে এলে যে ? কাজ কমপ্লিট হয়ে গেছে ?
_ হুমম।
অভিনবর যেন বিশ্বাস হলো না। তবু ও কিছু বলল না। আরফানের সাথে আলিঙ্গন করতেই আরফান পিঠ চাপরে বলল
_ কেমন গেল ট্যুর টা ?
_বেশ ভালো। তোমাদের কাজ কেমন হলো ?
_ হুম ঠিক ঠাক। বাঘ মামার সাথে দেখা হয়েছে ?
_ হুমমম।
_ ভাইয়ার সাথে তো বাঘিনীর ওহ দেখা হয়েছে।
ফুলের কথা অনুসারে সবাই তাকায়। অভিনব হতচকিয়ে যায়। ফুলের দিকে ইশারা করে যাতে কিছু না বলে। ছোট্ট ফুল বিগলিত হাসে।
_ ফ্রেস হয়ে আয়। এক সাথে লাঞ্চ করি।
_ তোমরা এখনো লাঞ্চ করো নি ?
_ না একটু কাজে ছিলাম। বাই দ্যা ওয়ে সুন্দরবনে তো ঘোরা হলো আমার জন্য কি এনেছিস ?
_ এনেছি তো , সবার জন্য গিফ্ট আছে। আগে ফ্রেস হয়ে আসি ?
_ আচ্ছা যাহহ।
অভিনব সবার সাথে আরেকটু কথা বলে চলে যায়। ঝিল এখনো ফোন করে নি। তাই নিজেই নাম্বার ডায়াল করে ফোন করলো। দু বার রিং হয়ে ফোন টা কেঁটে গেল। অভিনব বুঝতে পারলো ঝিলের পাশে কেউ আছে।
তাই আর ফোন করলো না। দ্রুত বাথরুমে গিয়ে সাওয়ার ছেড়ে দিলো।#ধূসর_রঙের_প্রজাপতি
#ফাতেমা_তুজ
#part_43
মেজাজের শীর্ষে চলে গেছেন ইববান শিকদার। রাগে গা ঘিন ঘিন করছে। তামিমের মুখে বিষাদের ছায়া। একটু দূরে দু হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে সাদাদ।শীতের মাঝে ও ঘেমে গেছে ছেলেটা। ক্লান্তি তে চোখ মুখ ডেবে গেছে। ইববান নিজের রাগ কে দমিয়ে অতিশয় শান্ত কন্ঠে বললেন
_ আরফানের অবস্থা কেমন ?
_ মাথা ফেঁটে গেছে কাকা , ডান সাইটে অল্প হেমারেজ হলে ও হাতের কব্জি তে বেশ ব্যথা পেয়েছে।
_ মির্জাপুর যেতে বারন করেছিলাম না ? কেন গেছে ?
লিটন শিকদার মাথা নিচু করে আছেন। ফোঁস করে দম ফেলে বললেন
_ শান্ত হও ভাই। ছেলেটার মাথা ঠিক ছিলো না ,না হলে মির্জাপুর কখনোই যেতো না।
_ কিসের মাথা ঠিক নেই ? বেঁচে ফিরেছে এতেই যাহহ। পুরো গাজীপুর জানে মির্জাপুরের সাথে শিকদার বংশের কলহ আরফান ভুল করলো কি করে ?
তামিম এতোক্ষনে মুখ খুললো।
_ কাকা শান্ত হও তুমি । জানো ই তো সামনেই নির্বাচন। মির্জা বংশের কেউ যেন ঝামেলা না করে তাই আরফান ভাই গিয়েছিলো । তোমাকে বলেই যেত তুমি তো কাছে ছিলে না।
প্রচন্ড খেপে যায় ইববান । সামনে থাকা গ্লাস টা ঠেলে ফেলে দেন। বিক্ষিপ্ত গ্লাস টা মেঝে তে গড়াগড়ি খেতে থাকে। শরীর কাঁপছে, মির্জা বংশ যে দোষ ত্রিশ বছর পূর্বে করেছে সেই দোষের কোনো ক্ষমা নেই। তাহলে কিসের সখ্যতা তাঁদের সাথে ?
দোতলা থেকে নেমে আসে অভিনব। সব কিছু তাঁর মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। মামনি কাঁদছে আর এ দিকে চেঁচামেচির শব্দ। প্রচন্ড রহস্যময় দ্বিধা দ্বন্ধ নিয়ে এগিয়ে যায় অফিস কক্ষে। দরজায় নক করে বলে
_ আসবো ?
অভিনবর মাত্রাতিরিক্ত শীতল কন্ঠে সবাই ঘুরে তাকায়। ইববান চোখ দিয়ে সবাই কে ইশারা করেন। অভিনব সেটা দেখে ফেললে ও কথা বাড়ায় না। হাসি মুখে তামিম এগিয়ে আসে।
_ আরে ভাই আসো না , নক করার কি প্রয়োজন।
_ না তেমন কিছু না। তামিম একটা কথা বল তো মামনি রা কাঁদছে কেন ?
তামিমের মুখ টা বিষাদে ভরে উঠে। ফোঁস করে দম ফেলে সে। মুখের অভিব্যক্তি মুহুর্তেই পাল্টে যায়। এক রাশ কষ্ট নিয়ে বলে
_ আরফান ভাই হসপিটালে।
_ হোয়াট !
লিটন উঠে আসেন। অভিনবর কাঁধে হাত রেখে বলেন
_ এক্সিডেন্ট করেছে। যাই হোক ওর বউ কে খবর টা দেওয়া হয় নি। তুই কি একটু রিমার বাপের বাড়ি থেকে রিমা কে নিয়ে আসবি ?
অভিনব মাথা ঝাঁকায় । লোকেশন নিয়ে চলে যায়। ইববান স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। লিটনের বুদ্ধি তে অভিনবর কাছে বিষয় টা ধামাচাঁপা দেওয়া গেল।
ছেলেটাকে এসব ভেজালে জড়াতে চান না ওনি।
*
” রাহেলা চাচি , রহিম চাচা কোথায় তোমরা এন্টি সেপটিক টা নিয়ে আসো। ”
রাফাতের ডাকে হুরমুরিয়ে আসে তাঁরা। মাহিন কে ধরে সোফায় বসিয়ে দেয় রাফাত। ছেলেটার হাতের অবস্থা নাজেহাল। কাঁচের বোতলের বেশ কিছু টা অংশ ঢুকে গিয়েছে।
এন্টি সেপটিক এনে দিতেই রাফাত যত্ন নিয়ে পরিষ্কার করতে থাকে।
ঝাঁঝালো ব্যথায় আহ করে আর্তনাদ করে উঠে মাহিন। প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে রাফাত বলে
_ কেন এমন টা করতে গেলে ? মারামারি করার মতো কিছু কি হয়েছিলো?
_ ভোট নিয়ে বলছিলো কিচ্ছু বলি নি। বিনয় তো নয় ই বরং অসভ্য দের মতো ভাষায় টান এনে কথা বলে ।
আমার বোনের নামে খারাপ কথা বলে ছেড়ে দিবো ?
_ হোয়াট ! ঝিলের নামে কি বলেছে ?
_ কোনো ভাবে জেনে গেছে প্রায় সময় ই বাসা থেকে পালিয়ে যায় ঝিল ।সেই কারনে দুটো নোংরা ভাষা ব্যবহার করেছে।
সহ্য হয় নি আমার। সামনে থাকা কাঁচের বোতল টা মাথায় ফাটিয়ে দেই।
রাফাত দাঁত কিরমির করে উঠে। চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে। আরফানের কল্লা টা কেঁটে ফেলতে পারলে শান্তি মিলতো। রাফাত হাক ছেড়ে বলে
_ রহিম চাচা বাবা কাকা দের খবর দাও। বলবে গাজিপুর নিয়ে ঝামেলা হয়েছে দ্রুত বাসায় আসতে।
রহিম চাচা চলে যান। রাফাতের হাঁক দেওয়া ডাকে ছুটে আসে ঝিল। করিডোর থেকে মাহিনের হাতের অবস্থা দেখে অন্তর আত্মা কেঁপে উঠে।
শত হাত দূরে থেকে ভাইয়া বলে আর্তনাদ করে উঠে। রাফাত হতচকিয়ে যায়। মাহিন নিজের হাত লুকাতে ব্যস্ত।
ঝিলের চোখে অজ্রস ধারার মেলা। রাফাত বলে
_ ভাইয়া ঠিক আছে।একটু খানি কেটেছে জাস্ট ।
_ থামো তুমি । এতো রক্ত ঝরছে আর বলছো একটু খানি কেটেছে ।
_ বনু আমি ঠিক আছি। একদম চিন্ত করিস না।
_ ভাইয়া
মাহিন কে জড়িয়ে ধরে ঝিল। চোখের পানি গুলো বুক ফাটা আর্তনাদ। ভাইয়ের হাত টা জড়িয়ে ধরে। রক্তে মেখে যায় শরীর। কিছুক্ষনের মাঝেই ডাক্তার এসে হাজির।
ঝিলের মাথায় হাত বুলিয়ে মাহিন বলে
_ পাগলামি হয়েছে ? রক্তে মাখামাখি হয়ে গেছিস। ফ্রেস হয়ে আয় ততক্ষণে আমার ব্যান্ডেজ টা করা হয়ে যাবে।
নাক টেনে চলে যায় ঝিল। মাহিন দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ঝিল সম্পর্কে আড়াল করতে চেয়ে ও পারছে না।
ছোট থেকেই ঝিল কে আড়ালে রেখেছে। যাতে করে ঝিলের স্বাধীনতায় ব্যাঘাত না ঘটে।
চারদিকে শত্রুর অভাব নেই। কে কখন ক্ষতি করে দেয়।
রুমে এসে ফ্রেস হয়ে নেয় ঝিল। ভাইয়ের কাঁটা হাত টা মনে হতেই বুক জ্বলে উঠে। কতোটা ক্ষত হয়েছে।
ফোনে নাম্বার ডায়াল করে ফোন দেয়। এক বার রিং হতেই ফোন রিসিপ হয়। যেন ফোনের ই অপেক্ষা করছিলো।
_ ঝিল !
_ হুমমম। কাল ফোন না দিতে পারার জন্য স্যরি। রাতে পাপার কাছে গিয়েছিলাম।
_ সমস্যা নেই। নাস্তা করেছো ?
_ হুমম। তুমি খেয়েছো ?
_ হ্যাঁ। শোনো আমি না হসপিটালে আছি , পরে কথা বলি?
_ হসপিটাল !
_ হুমম।
_ তুমি ঠিক আছো ? তোমার কিছু হয় নি তো ? হসপিটালে কেন ?
_ শান্ত হও। আমি ঠিক আছি , আমার এক ভাইয়ের এক্সিডেন্ট হয়েছে। মাথা ফেটে গেছে ।
_ কন্ডিশান কেমন ?
_ সেফ ই আছে। আমি রাখছি , আর আজ পাপা আর মম আসবে।
আই উইস সব কিছু ঠিক হয়ে যায়।
_ হুমমম সেটাই যেন হয়।
ফোন রাখে ঝিল। বুক ভারী হয়ে গেছে। মৌনতার আসার কথা। এখনো আসছে না কেন ?
দুপুরের দিকে এক হাত ভর্তি শপিং ব্যাগ নিয়ে আসে মৌনতা। ঝিলের অবস্থা তখন দেখার মতো।
সব থেকে বাজে বিষয় হলো মৌনতার বয়ফ্রেন্ডের সাথে ব্রেক আপ হয়ে গেছে। আর মেয়েটা এক গাঁদা শপিং করেছে।
_ মৌন এটা কি শুনছি ?
_ যা শুনেছিস তাই !
_ আজব। ব্রেক আপ কেন হলো তদের ?
_ বাজে মানুষের সাথে ব্রেক আপ ছাড়া আর কি হবে বল তো ?
_ মৌন !
_ কি করবো আমি ? অনেক চেয়েছিলাম, বহু চেষ্টা করেছি। কিন্তু ওহ থাকতে চায় না আমার সাথে। আমার থেকে ও সুন্দরী কে পেয়েছে কি না।
কথা গুলো চিৎকার করেই বললো মৌনতা। চোখ দুটো ভিজে গেছে। তব্ধ হয়ে বসে পরলো ঝিল। ডিবাইনে থাকা ফ্লাওয়ার ভাস টা ছিটকে পরলো পায়ে। খানিক টা ব্যথা পেলে ও টু শব্দ করলো না।
চোখ দুটো ভিজে গেছে মেয়ে টার। হঠাৎ করে মৌনতা কে জড়িয়ে ধরলো। ডুকরে কাঁদছে মৌনতা।
_ মৌন তুই একদম ভাববি না। যে তোর যোগ্য না তাকে সাথে রাখার মানেই হয় না।
_ ভালোবাসতাম খুব।
_ ঘৃনা কর , ঘৃনা করতে হবে।
_ ঝিল।
ঝিল কে জড়িয়ে ঝমঝম করে কাঁদছে মেয়েটা। নাকের পানি চোখের পানি একাকার হয়ে গেছে। দু বান্ধবীর কান্না দেখে রোহন থমকে গেল। না চাইতে ওহ রুমে ঢুকলো।
চোখ দুটো খুলেই রোহন কে দেখতে পেয়ে ছিটকে দূরে সরে গেল মৌনতা।
মৌনতার হঠাৎ এমন আচারনে ভ্রু কুঁচকে তাকায় ঝিল।
_ কাঁদছিস কেন ঝিল ?
_ ভাইয়া তুমি !
_ চোখে পানি কেন ?
_ আরে কাঁদবো না বলো ? বান্ধবীর সাথে কতো দিন পর দেখা ।
_ উফফ বনু সুন্দরবন থেকে এসেই ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে কাঁদছিস। বাঘের সাথে প্রেম হলো না তো ?
_ ভাইয়া।
রোহন হো হো করে হেসে উঠলো। ঝিল ও হাসলো। প্রচন্ড অস্বস্তি তে পরে গেল মৌনতা। হাসবে নাকি কাঁদবে ঠিক ঠাওর করতে পারলো না। পরিশেষে হেসেই ফেললো।
*
কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। একটু আগেই অহেদ সরকার আর ইহরিমা সরকার এসেছেন। মামা রা দরজা বন্ধ করে আছেন। ইহরিমা প্রচন্ড ভেঙে পরেছেন। অভিনব আশ্বস্ত করে বলল
_ প্লিজ মম। এভাবে হেরে যেও না। মামনি রা কতোটা খুশি হয়েছে দেখো ! মামা রা ও মেনে নিবেন।
_ ইহরিমা প্লিজ এভাবে কেঁদো না। গত ত্রিশ বছর ভাইদের জন্য কেঁদে ই চলছো।
_ কি করি বলি তো ? সবাই আমাকে দেখা মাত্র ই ঘরে গিয়ে ডোর লক করে দিলো। এত টাই ঘৃনা করে আমায় ?
_ ইহরিমা এমন কেন ভাবছো ? তোমার ভাই রা ও খুশি হয়েছে দেখো।
_ ভাবি তুমি দেখো ই না কতোটা ঘৃনা করে আমায়।
ইহরিমা মুখে হাত গুঁজে কাঁদতে লাগলেন। অহেদের বুক ভারী হয়ে গেল। ত্রিশ বছর পেরিয়েছে, ভালোবাসার কোনো কমতি রাখেন নি। তবু ও দিন শেষে ইহরিমার চোখে জল।
অভিনবর ফোন বাজছে। ঝিল প্রচন্ড টেনশনে আছে। অভিনব ফোন রিসিপ করলো না। টেক্সট করে জানালো পরে সব বলবে।
মিনিট পনেরো বাদেই দরজা খুলে গেল। বিস্ময়ে চেয়ে আছে সবাই। তিন ভাইয়ের চোখ মুখ শক্ত হলে ও চোখ দুটো বলে দিচ্ছে প্রচন্ড কেঁদেছেন।
ইহরিমা উঠে দাঁড়ান। আলগা পায়ে এগিয়ে যায়। ইববান হাত দিয়ে বাঁধা দেয় ইহরিমা শুনেন না। ভাইয়ের পায়ে লুটিয়ে পরেন।
অহেদ অবাক হন। তিনি তাঁর স্ত্রী কে সর্বোচ্চ ভালোবাসা আর সম্মানে রেখেছেন। যদি ও ইববান তাঁর বড় ভাই তবু ও বুকের ভেতর মোচর দিয়ে উঠে।
এক ভালোবাসার জন্য কতো টা কষ্ট পেতে হচ্ছে।
ত্রিশ বছর পরে ও কি মেনে নিবেন না ?
_ আমাকে মাফ করা যায় না ভাইয়া ?
_ রুবি
ইববানের গলা ধরে আসে। বোন কে আদর করে রুবি বলেই ডাকতেন। আড়ষ্ঠতা ছাড়াই আবেগের টানে বলে ফেলেছেন।
ইহরিমা উঠে দাঁড়ায়। লিটনের কাছে যায়। মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ও পারেন না ওনি। সবার সামনেই কেঁদে উঠেন। ইহরিমা ভাই কে জড়িয়ে হো হো করে কেঁদে উঠেন।
মুজাহিদের বুক ভারী হয়। অস্ফুটন স্বরে বলে
_ আপা !
ভাই বোনের মিল বন্ধনে অহেদ কেঁপে উঠেন। এই ভালোবাসা ছেড়ে চলে এসেছিলো ইহরিমা। ঠিক কতো টা ভালোবাসলে এমন কাজ করতে পারে মানুষ। ইহরিমার প্রতি আজ মাত্রাতিরিক্ত শ্রদ্ধা জেগে উঠে। ছলছল নয়নে বলে উঠেন
_ আমার জীবনে আসার জন্য ধন্যবাদ ইহরিমা।
কথা টা ধীরে বললে ও পাশে থাকা অভিনবর কর্নপাত হয়। বাবার দিকে তাকিয়ে চোখ ফেরায়। চোখ যেন থমকে গেছে এই ভালোবাসা তে। সত্যি ই তো পরিবারের ভালোবাসা কে উপেক্ষা করে অন্য একজনের হাত ধরে চলে আসা এতো সহজ ?
ঠিক কতো টা ভালোবাসলে মানুষ পরিবার ছাড়ে।
#ধূসর_রঙের_প্রজাপতি
#ফাতেমা_তুজ
#part_44
প্রেমালাপে মত্ত দুই হৃদয়। সময় তিনটার কাছাকাছি । অথচ ফোনের দু প্রান্তের মানুষ দুটির চোখে ঘুম নেই। একটু পর পর ই হাসছে দুজনে। ঘড়ির কাঁটা ঢং ঢং করে উঠলো।
অর্থাৎ রাত তিনটা বাজতে আর পাঁচ মিনিট। দাঁত দিয়ে জ্বিভ কাটে ঝিল। ফোন টা নামিয়ে দেখে 2 ঘন্টার ও বেশি সময় চলছে। ফিচেল হাসিতে মেতে উঠলো। কখনো ভাবা হয় নি এভাবে প্রেম হবে। তা ও আবার স্বামীর সাথে প্রেম।
_ এই শোনো !
_ হুমম বলো।
_ রাত তিনটা বেজে গেছে। এখনো ঘুম আসছে না কেন বলো তো?
_ আহহ তোমার যে স্বামীর সাথে সখ্যতার প্রয়োজন।
_ ধ্যাত।
_ সত্যি বলছি আমার একটা চুমু খেলেই ঘুম চলে আসবে।
_ থামো তো তুমি। এতো প্রেম ভালো না।
_ আসলেই এতো প্রেম ভালো না ?
_ উহহহু। ভালো তো , তবে
_ তবে কি ? ফোনালাপে মন ভরে না ?
_ ধ্যাত।
অভিনব হেসে উঠলো। যেই হাসির শব্দে ঝিলের অন্তর কাঁপে।
_ শোনো মেয়ে , একটু কষ্ট করে ছাঁদে আসো।
_ ছাঁদে আসবো ?
_ হুমম আসো।
_ কেন বলো তো ? আবার ছাঁদে চলে আসলে না তো?
ঝিলের রসিকতায় অভিনব দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
_ উহহহু। তোমার পাপা রা যে সিকিউরিটি দিয়ে রেখেছেন এতে করে একটা মাছি ওহ গলতে পারবে না।
_ তাহলে ছাঁদে কেন আসবো ?
_ আসোই না একবার।
ভ্রু কুঁচকে উঠে দাঁড়ালো। এই মধ্য রাতে ছাঁদে কেন যাবে ? অভিনবর খাম খেয়ালি পানায় দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো। কল হোল্ড করেই পা টিপে হাঁটা লাগালো। ভাগ্যিস ভাইদের ঘুম গভীর। না হলে সর্বনাশ হয়ে যেত। ঝিল এক পা দু পা করে ছাঁদে চলে আসলো।
ছাঁদ টা ঘুট ঘুটে অন্ধকার। সুইচ চেপে আলো জ্বালিয়ে নিলো। ফিস ফিস করে বলল
_ এসেছি তো !
_ চোখ বন্ধ কর।
_ কেন ?
_ আরে করোই না।
ঝিল আশে পাশে এক বার তাকিয়ে চোখ দুটি বন্ধ করলো। কানে থাকা ফোন এর মধ্য দিয়ে অভিনবর ঘনঘন শ্বাস শুনতে পাচ্ছে। বুকের ভেতর কেমন সুখ সুখ অনুভূতি হলো।
অভিনবর বুকে মাথা রাখার জন্য মন টা ছটফট করছে। পাগলামি করতে ইচ্ছে হচ্ছে।
হঠাৎ করেই ফোনের ওপাশ থেকে ধুম করে আওয়াজ হলো । ঝিল চমকে তাকালো, আকাশের দিকে তাকিয়ে হতবাক। ফানুসে ভরপুর পুরো আকাশ। যেদিকে তাকাচ্ছে শুধুই ফানুস। পুরো আকাশ যেন ফানুসের দখলে। ফোন টা কানে নিয়ে বলল
_ তুমি কোথায় বলো তো ?
_ তোমার বাসা থেকে পশ্চিমের যেই দিঘী আছে সেখানে।
_ সত্যি ?
_ হুমম। ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করেছিলাম । তবে তোমাদের স্পেশাল পাহাড়াদার আমাকে কামড়াতে এসেছিলো।
অভিনবর কথাতে খিল খিল করে হেসে উঠে ঝিল। বাড়ি তে এতো সিকিউরিটি দেওয়া সত্যি হাস্যকর। ফোস করে দম ফেলে অভিনব। অনুনয়ের সুরে বলে
_ একটু কর্নারে আসো না ঝিল। তোমাকে দেখবো আমি।
ঝিল কর্নারে আসে। লাল আলো তে ঝিল কে দেখতে পায় অভিনব। প্রান যেন ফিরে এলো। একটু করে হাসে ছেলেটা। অভিনব ঝিল কে দেখতে পেলে ওহ ঝিল দেখতে পায় না।
প্রচুর মন খারাপ হয়। পরক্ষনেই হাসি মুখে বলে
_ এই তুমি দাঁড়াও আমি আসছি ।
অভিনব কে কিছু বলার সুযোগ দেয় না তাঁর আগেই ছুট লাগায়। বাসা থেকে বের হয়ে ধীর পায়ে বাগানের দিকে এগিয়ে যায়। হঠাৎ কানে ভেসে আসে খটখট আওয়াজ। ঝিলের অন্তকর্নে পানি শূন্য অনুভব হয়। এই প্রথম পাপা আর ভাই দের ভয় হচ্ছে। ঝিল একটু ঝুঁকে তাকায়। রেস্ট হাউজে রোহন কে দেখতে পায়। রোহন ঘুরে তাকাতেই কেউ একজন তাকে ঘুরিয়ে নেয়।
_ ঝিল এখানে কি করিস তুই ?
_ মৌন তুই কখন ঘুম থেকে উঠলি ?
_ অনেক আগেই, তোকে রুমে না পেয়ে ছাঁদে যাই। আর ছাঁদ থেকেই দেখলাম নিচে আসতে।
_ আসলে কী হয়েছে বল তো , সুন্দরবন ঘুরতে ঘুরতে ঘরে মন টিকে না আর। শুধু প্রকৃতির সখ্যতা জাগে ।
_ হুমম বুঝলাম।তাহহ সুন্দরবনেই মন হারালি না তো ?
_ উফফ মৌন
মৌনতা ফিক করে হেসে উঠে। ঝিলের এক বাহু তে টান দিতেই পেছন থেকে রোহন এর কন্ঠ
_ কে ?
_ ভাইয়া আমি আর মৌন।
_ এখানে এতো রাতে ?
_ এমনি এসেছিলাম হাওয়া বিলাস করতে। তুমি গেস্ট হাউজে কেন ?
_ একটু দরকার ছিলো। ফাইল টাইল রেডি করতে হচ্ছে। খটখট আওয়াজ হবে তাই গেস্ট হাউজে চলে এসেছি।
মৌনতা একপলক তাকালো। পরক্ষনেই মুখ ফিরিয়ে নিলো। হাঁফ ফাঁস করতে করতে বলল
_ সাড়ে তিনটা বাজে ঝিল, চল এবার ঘুমোতে যাই।
ঝিল সম্মতি জানায়। মুখ টা একদম চুপসে গেছে। ফোঁস করে দম ফেলে। ফোন টা ভায়ব্রেট হচ্ছে। ফোন রিসিপ করার কোনো স্কোপ নেই। একটা টেক্সট পাঠিয়ে দিলো।
ইসসস অভিনব কে দেখার জন্য মন টা কেমন আকুপাকু করছে। কাল ই দেখা করতে হবে। না হলে হার্ট ব্লক হয়ে মারা যাবে মেয়েটা।
*
” পাপা আমি বের হবোই। আগে তো কখনো বারন করো নি এখন কেন বারন করছো ? ”
_ সেটাই তো মামনি আগে তো কখনো বারন করি নি। এখন বারন করছি মানে কিছু কারন আছে ।
_ আমি কোনো কারন শুনতে চাই না। আর্জেন্ট বের হতে হবে আমায়।
_ মামনি ।
হাতের কাছে থাকা গ্লাস টা ফেলে দেয় ঝিল। গটগট করে রুমে চলে যায়। কষ্ট গুলো কেমন কান্না হয়ে বের হচ্ছে। অভিনবর দেখা না পেলে নির্ঘাত কিছু একটা হয়ে যাবে। মৌনতা মাত্র ফ্রেস হয়ে আসলো। ঝিল কে সাজ গোঁজ করে বসে থাকতে দেখে বলল
_ এই ঝিল এই ভোর সকালে কোথায় বের হচ্ছিস ?
_ বের হতে দিলো না । ভালো লাগে না এই পরিবারে থাকতে। সারাক্ষণ মাথায় ভয় নিয়ে চলতে হবে।
এভাবে মানুষ বাঁচে বল তো ?
_ থাক না। আঙ্কেল রা যখন বারন করছেন নিশ্চয়ই কোনো
_ প্লিজ মৌন তুই জানিস না কতোটা জরুরি বের হওয়া।
কথা টুকু বলেই ঝরঝরে কেঁদে উঠে ঝিল
হতবুদ্ধি হারিয়ে ফেলে মৌনতা। সাধারন একটা বিষয়ে এভাবে কাঁদে কেউ ?
ঝিলের দিকে নিষ্পলক চেয়ে থাকে মেয়েটা। ঝিলের বের হওয়ার রহস্য উন্মোচন করতে গিয়ে দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে।
তবু ও বলে
_ তুই ঠিক কি কারনে বের হতে চাস বল তো ঝিল ?
এড়িয়ে যেতে গিয়ে ও পারে না। বেহায়া মন দমিয়ে রাখা ভালোবাসা টুকু প্রকাশ করতে চায়। এক পর্যায়ে সমস্ত কিছু বলে দেয় মেয়েটা। জ্ঞান হারানোর উপক্রম মৌনতার। এতো কিছু হয়ে গেল।
_ ভাইয়ার সাথে দেখা করবো আমি।
_ হচ্ছে না তো। পাপা তো যেতেই দিচ্ছে না।
_ আচ্ছা চল আমি বলে দেখি।
চোখ মুছে উঠে দাঁড়ায় ঝিল । সর্বকালের লেট মৌনতা আজ পাঁচ মিনিটেই তৈরি হয়ে যায়। মৌনতার উন্নতি তে ফিচেল হাসে মেয়েটা।
জাফরের পাশে বসে তোষামোদে করছে মৌনতা। মেয়েটার এমন আচারনে লজ্জিত জাফর। মৌনতার মাথায় হাত রেখে বলল
_ জানোই তো আমাদের শত্রুর অভাব নেই। এখন বের হলে যদি কিছু হয়ে যায় ?
_ আঙ্কেল কিছু হবে না। আচ্ছা আপনি ই বলুন মেয়েটা এই ভয়ের কারনে সারা জীবন ঘর বন্দি থাকবে ?
_ সেটা নয় মা কিন্তু
_ চলে আয় মৌন। এখানে বসে নিজের এনার্জি লস করে কোনো লাভ নেই। আমি যে শক্তিহীন মেয়ে তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো হচ্ছে। এতো দিনের বলা সব কথাই মিথ্যে।
ঝিলের কথাতে অবাক হলেন জাফর। মেয়েটার এমন অভিমানে বুক ভারী হয়। রোহন কে ডাইনিং এ যেতে দেখে বলল
_ রোহন শোন তো।
_ হুম ছোট আব্বু।
_ ঝিল বের হতে চাচ্ছে যেতে দিবো ?
_ হুমম দাও। প্রকৃতির সাথে ঘুরে ফিরে এসেছে এখন ঘরে মন টিকবে না।
খুশি হয়ে যায় ঝিল। ফোঁস করে দম ফেলে জাফর। দুই বান্ধবী বেরিয়ে যায়। রোহনের মনে খটকা বাজে। ঝিল কি কিছু লুকাচ্ছে ?
ফোন বেজে উঠে রোহনের। বিরক্তিতে মন তেতে উঠে। কল রিসিপ করেই বলে
_ আমাকে কল করার কথা ভাববি ওহ না তুই। যে আগুন তুই লাগিয়েছিস তাঁর জন্য তোকে প্রস্তাতে হবে। আমার বোনের নখের যোগ্য ও না তুই।
_ রোহন আমার কথা টা শোনো।
কোনো কথাই শুনে না রোহন। শরীর কাঁপছে তাঁর। সুমা নামক মেয়ে টি কে ভালোবেসেছে ভাবতেই গা গুলিয়ে আসছে। গাজীপুরে খবর টা সুমাই রটিয়েছে। কাল রাতে সমস্ত ডিটেলস পেয়েছে সে।
এই মেয়ের চরিত্র সম্পর্কে ও কিছু তথ্য পেয়েছে। অত্যন্ত নিকৃষ্ট এই মেয়ে। দ্রুত ফোন পকেটে পুরে নেয়।
বের হতে হবে। ঝিলের উপর নজর রাখতেই হবে।
মেয়েটার কোনো ক্ষতি হতে দিবে না। প্রয়োজনে জান দিবে তবু ও বোনের ক্ষতি হতে দিবে না।
*
রঙিন ছাতা দ্বারা সজ্জিত এক রেসট্রন। খানিক টা বিদেশী ধাঁচের। মূলত বাঙিলী রেসট্রনের মতো আপ্যায়ন হলে ও খাবার গুলো বিদেশী। উত্তরা মডেল টাউনে এসেছে ঝিল অভিনব আর মৌনতা। কোনো দিকে না তাকিয়ে অভিনবর কাছে ছুটে গিয়েছে মেয়েটা।
মৌনতার সামনে এমন আচারনে অভিনব ভারী লজ্জা পেয়েছে।
এক গাদা খাবার অর্ডার করে নিলো মৌনতা। মেকি হাসি দিয়ে বলল
_ আমি বাবা কাবাবের হাড্ডি হতে চাই না। তোরা কথা বল আমি খাবার খেতে থাকি।
ঝিল মুচকি হাসে। অভিনব ও ঝিল একে অপরের চোখের দিকে তাকায়। তৃষ্ণাময় দুটো চোখ যেন ঝলমল করছে। দুটো দিন কতো টা কষ্টে কেটেছে। হাজারো ভালোবাসার মাঝে ও খামতি ছিল। যে শূন্যতা দুজনের বুকে রক্তক্ষরণ করেছে।
_ কেমন আছো ঝিল ?
_ যেমন দেখছো ।
_ কেঁদে ছিলে ?
কেঁপে উঠে ঝিল। অভিনব কি করে বুঝলো বিষয় টা। শুকনো ঢোক গিলে মাথা নাড়ায়।
অভিনব তাঁর শক্ত হাতে মেয়েটার হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ।
পরপর কয়েক বার চুমু খায়। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলে
_ আজ ই আমি তোমার আর আমার কথা বাসায় জানাবো। সব কিছু যেহেতু ঠিক হয়ে গেছে তাই তোমাকে আর দূরে রাখতে চাই না।
_ সবাই মেনে নিবে তো অভিনব?
_ কেন নিবে না ? আমার স্ত্রী তুমি গার্লফ্রেন্ড নও যে যা বলবেই তাই হবে।
_ আমি সবাই কে নিয়ে ভালো থাকতে চাই অভিনব । একটা সুস্থ পরিবার চাই। আমি ক্লান্ত এই পৃথিবীতে।
_ চিন্তা করো না ঝিল। কথা দিলাম সবাই কে নিয়েই আমরা সংসার গড়বো।
মৃদু হাসে ঝিল। অভিনবর হাতে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয়। ওপাশ থেকে মৌনতা বলে
_ ভাইয়া প্রেম করার জন্য আলাদা স্পেস লাগবে নাকি?
_ না শালিকা আপনি বলেছেন এতে ই আমি খুশি। আমার জন্য এতো ভেবেছেন তাই আপনার হানিমুনের পুরো খরচ আমার।
অভিনবর কথায় মৌনতার দম বন্ধ করা হাসি। ঝিল চোখ রাঙিয়ে বলে
_ অসভ্য হয়ে যাচ্ছো তুমি।
_ অসভ্য তো হতেই হবে বউ।
_ আজব।
_ উহহুহ আজব না। আমাদের হানিমুন টা কোথায় হবে বলো তো ?
_ কোথায় ?
_ সাইবেরিয়া যাবো ভাবছি।
_ পাগল তুমি ? সাধারন তাপমাত্রায় আমি জমে যাই আর যাবো সাইবেরিয়া।
তুমি জানো সেখানের তাপমাত্রা কতো হয় ?
_কতো আর মাত্র – 50৹+
_এটা কে, মাত্র বলছো তুমি ?
_ তো।
_ তো মানে আমি যাবো না।
_ কামন ঝিল । তুমি না ট্রাভেলার্স, একজন প্রকৃতি প্রেমি হয়ে এতো ভয় পাও। ছিইই
_ রিতি মতো আমাকে অপমান করছো তুমি।
_ প্লিজ ঝিল।
মুখ গোমড়া করে নেয় ঝিল। পরক্ষণেই এক চিলতে হাসে মেয়েটা। চোখ দিয়ে আশ্বস্ত করে বলে সে যাবে।
হঠাৎ করেই পেছন থেকে এক গুমোট কন্ঠ ভেসে আসে।