ধূসর রঙের প্রজাপতি পর্ব ৩৯+৪০+৪১

#ধূসর_রঙের_প্রজাপতি
#ফাতেমা_তুজ
#part_39

সকলে এক সাথে আড্ডায় বসেছে। মাহেরার নাকি মাথা ব্যথা তাই সে চলে গেছে। ডিনার শেষ হয়েছে বিশ মিনিট আগে। আড্ডা চলবে রাত এগোরোটা অব্দি। এখন বাজে রাত নয়টার কাছাকছি। সবাই অভিনব আর ঝিলের বিষয়ে আগ্রহী। ওদের বিয়ে হয়েছে এটা জানলে ও কি করে হলো কিংবা পরিচয় কি করে সেটা সকলের অজানা।
সবাই বেশ খুশি খুশি ভাব নিয়ে আছে।
মাহের বেশ হাসি খুশি। মাহেরা যে কোনো ভেজাল করে নি এটাই অনেক।তাই সে নিজে ই প্রশ্ন করলো
_ অভিনব আর ঝিল তোমাদের বিষয় টি একটা রহস্য ঘেরা। আমরা কিন্তু কিছুই জানি না।
এখন একটু ডিটেলস এ বলো তো প্রেম টা কি করে হলো।

ঝিল আমতা আমতা করতে লাগলো। পাপড়ি হালকা হেসে বলল
_ এতো ভয় পাচ্ছে কেন ঝিল ? প্রেম ই তো অন্য কিছু তো নয়।

ঝিলের মস্তিষ্ক লজ্জায় পরলো। এরা সবাই কি কোনো ভাবে ওকে লজ্জা দিতে চাচ্ছে ?

অভিনব ঝিলের অস্বস্তি বুঝতে পারলো। তাই নিজেই সমস্ত টা বলবে বলে ঠিক করলো।
_ এটেনশন এভরিওয়ান। ঝিল নিতান্তই বাচ্চা যে আমাকে সেফটি পিন পুস করে মারতে পারলে ওহ প্রচন্ড ভয় পায়। আর কথা বলতে গেলে সব গুলিয়ে ফেলে। ওকে জিঙেস করে কোনো লাভ নেই।

_ কি করে এটা হলো ?

_ বলছি আমাদের প্রথম দেখা টা অস্বাভাবিক। তাছাড়া আমাদের বিয়ে টা ও জোর করে দেওয়া হয়েছে।

সবাই অবাক চোখে তাকালো। জোর গলায় বলল
_ হোয়াট!

ঝিল অস্বস্তি যে পরলো। এখন নিশ্চয়ই তাঁর পাগলামো গুলো ও ফাঁস হবে। অভিনব প্রথমে ভেবে ছিলো জোর করে বিয়ে হয়েছে এটা আড়াল করবে কিন্তু কয়েক দিনেই এরা সবাই খুব কাছের হয়ে গেছে। এদের কাছ থেকে কোনো কিছু লুকাতে ইচ্ছে হচ্ছে না।

_ বলছি। ঝিলের স্বভাব বিয়ের আগে বাসা থেকে পালিয়ে যাওয়া। সম্ভবত ওহ এখন বিয়ে করতে চায় না। ওর ফ্যামিলি ওকে খুব ভালোবাসে , যাকে অতিরিক্ত ভালোবাসা বলে ।
না হলে এতো বার বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে আসা মেয়ে বাসায় ফিরে তান্ডব চালাতে পারে ?

সবাই ঝিলের দিকে তাকালো। লজ্জায় মেয়েটা নেতিয়ে গেছে। সবার মুখে আফসোস এর রেখা। এমন ফ্যামিলি আদৌ কি হয় ?

অভিনব আবার বলল
_ দেড় বছর আগে ও পালিয়ে এসেছিলো। ঘটনা চক্রে মাঝ পথে আমার গাড়ির সামনে এসে পরে। আর ওকে নিয়ে সাহায্যের জন্য গ্রামে প্রবেশ করি। গ্রামের লোকে রা নানান কথায় আমাদের বিয়ে দিয়ে দেয়। তাঁদের ফালতু কালচার যে এভাবে আমার জীবন কে রাঙিয়ে দিবে ভাবতেই পারি নি।
এখন তো তাঁদের সালাম করতে ইচ্ছে হচ্ছে
ফেরার পথে ঝিলের পাগলামি ছিলো দেখার মতো। ভয় পেয়ে আমার হাতে পিন পুস করে দিয়েছে।
সব থেকে বড় কথা আমি যে ওকে বাঁচিয়ে একটা ধন্যবাদ অব্দি দেয় নি।

সবাই হতবাক হয়ে গেছে। ঝিল ভ্রু কুঁচকে তাকালো। অভিনব তাঁর সাথে লেক পুল করছে।
_ শোনো আমি তখন ধন্যবাদ দেওয়ার মুডে ছিলাম না।
কার না কার সাথে আমার বিয়ে হয়ে গেল আর আমি জানাবো তাকে ধন্যবাদ ।

ঝিলের কথা তে সবাই হাসলো। পাপড়ি ভ্রু নাচিয়ে বলল
_ তাহলে এখন এতো প্রেম কেন ?

ঝিল লজ্জা পেল অভিনব একটু করে হেসে বলল
_ দেড় বছর পর আমাদের দেখা। এটা তো জানোই সবাই। আর এখানে এসেই প্রেম। আসলে কারো সাথে না থাকলে ভালোবাসা অনুভব করা যায় না। আমাদের সাথে ও তেমন হয়েছে।

সবাই ওহ হো বলে উঠলো। অভিনব একটু করে হাসলো। আজকের বিশেষ আয়োজন ছিলো সাসলিক আর চিকেন চাপ। সবাই খেয়ে যে যার রুমে চলে গেল। কালকেই অভিনব আর ঝিল সবাই কে বিদায় জানাবে।

*

ঝিল হাত পা ছড়িয়ে বসে আছে। অভিনব নিজের ফোন টা এগিয়ে দিলো। ঝিল প্রশ্ন বোধক দৃষ্টি তে তাকাতেই অভিনব বলল
_ বাসায় ফোন করে কথা বলো। এজেন্সির সিম টা নিয়ে এসেছি।

ঝিল খুশি খুশি হয়ে ফোন লাগালো। দু বার রিং হতেই ফোন ধরলো রোহন। ঝিল কাঁপা স্বরে বলল
_ হ্যালো ভাইয়া।

_ ঝিল ! বোন কেমন আছিস ? তিন দিন ধরে তোর কন্ঠ শুনতে পাই না। জানিস কতো চিন্তা হচ্ছিলো ? ট্যুর কেমন যাচ্ছে ? কোনো অসুবিধা হয় নি তো ?

ঝিল ফ্যাল ফ্যাল করে তাকালো। এক সাথে এতো প্রশ্ন করলে উত্তর কি করে দিবে ?

_ এই বোন কথা বলছিস না কেন ? ঠিক আছিস তুই ?

_ না ঠিক নেই ।

_ কিহহ তুই ঠিক নেই ? তুই কোথায় আছিস বল। আমি এখনি রওনা দিচ্ছি । দ্রুত লোকেশন বল।

_ ভাইয়া তুমি থামবে ? এতো পাগল কেন হও বলো তো। তুমি এতো প্রশ্ন করলে আমি কি করে উত্তর দিবো ?

_ রিলাক্স হ এবার আমি চুপ করে যাচ্ছি ।

_ হুমম । আমি ঠিক আছি। খুব ভালো আছি । কোনো অসুবিধা হয় নি। এখন বলো তুমি কেমন আছো ?

_ হুমম ভালো আছি। তবে খুব চিন্তা হচ্ছিলো। তিন দিন ধরে ঘুম হয় নি।

ঝিল দাঁত দিয়ে জ্বিভ কাটলো। মাথা চুলকিয়ে বলল
_ কিন্তু আমি তো প্রচুর ঘুমিয়েছি।

ওপাশ থেকে দীর্ঘশ্বাস ভেসে আসলো। ঝিলের মন খারাপ হয়ে গেল। ভ্যাগা ভ্যাগা কন্ঠে বলল
_ স্যরি।

_ ধুর বোকা। বোন থাকলে ভাই দের চিন্তা হবেই । আর আমাদের তো একটাই বোন। একটাই ভালোবাসা।

ঝিলের চোখে পানি চিক চিক করে উঠলো। এতো ভালোবাসে কেন এরা ?

_ বোন !

নাক টেনে ঝিল বলল
_ হুম বলো শুনছি।

_ কাঁদছিস তুই ?

_ কই না তো। আরে এমনি তেই একটু ঠান্ডা লেগেছে। ঠিক হয়ে যাবে ।

_ নিশ্চয়ই পানি তে ভিজেছিস ?

_ আরে না । বাদ দাও এসব । আহনাফ ভাইয়া কোথায় ?
আর পাপা রা কেমন আছে।

_ সবাই ভালো আছে। আহনাফ গার্লফ্রেন্ড এর সাথে ডেটিং এ গেছে।

_ হোয়াট ! ভাইয়া সত্যি করে বলো ঐ ছাগল টা রুম ডেট করছে না তো?

রোহন হো হো করে হেসে উঠলো। আহনাফ আসলে পরে পরে ঘুমোচ্ছে। আজ সকালে দুজনের মাঝে রাগা রাগি হয়েছে।তাই রোহন ঠিক করেছে আহনাফ কে শাস্তি দিবে।
গলায় কাঠিন্য এনে বলল
_ হতে ও পারে। আমি কিছুই জানি না। শুধু জানি ডেটিং এ গেছে এত রাত যেহেতু বুঝতে ই পারছিস ।

_ ফিরে এসে দেখবো ঐ টাকে। এতো বড় সাহস , ঠ্যাং ভেঙে বাসায় ফেলে রাখবো।

রোহন প্রাপ্তির হাসি হাসলো। বড্ড ভালোবাসে বোন কে। নয়ন মনি যাকে বলে।

ফোন রাখতেই ঝিল দেখলো অভিনব ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে।

_ কি হয়েছে ?

_ কি হবে?

_ সেটাই তো। এভাবে তাকিয়ে আছো কেন ?

_ তুমি সবার কথা জিজ্ঞেস করলে আর তোমার আম্মুর কথা জিজ্ঞেস করলে না ?

মুহুর্তেই ঝিলের মন খারাপ হয়ে গেল। চোখ দুটো ছলছল করছে। অভিনব একটু অপ্রস্তুত হলো । ঝিলের বাহু টেনে কাছে নিয়ে আসলো। অপরাধীর মতো করে বলল
_ কি হলো ঝিল ? তুমি কাঁদছো কেন ?

হিচকি উঠে গেছে মেয়েটার। কথা বলতে পারছে না। অভিনব বুকে টেনে নিলো। দু হাতে জড়িয়ে ধরলো কোনো ভাবে ঝিল কি কষ্ট পেল।
বুকের ভেতর মোচর দিয়ে উঠলো। কোথাও একটা রক্ত ক্ষরন ঘটেছে। অভিনবর বুক থেকে মাথা উঁচু করে তাকালো ঝিল।
একটু হাসি ফুঁটিয়ে বলল
_ আমার আম্মু নেই।

_ ঝিল ! আমি আসলে খুব স্যরি। ভেরি স্যরি ঝিল।

ঝিল একটু হাসলো। অভিনবর বুকে মাথা রেখে বলল
_ আমার আম্মু সহ আমার কাকিরা কার এক্সিডেন এ মারা গেছেন।
তখন আমি খুব ছোট দেড় দুই বছর বোধহয়। কারো মুখ ই আমার মনে নেই। আমি খুব অভাগী তাই না ? সবার জীবনের কাল হয়ে দাঁড়াই ?

_ ঝিল । একদম এইসব বলবে না। তুমি আমার ভালোবাসা আমার ভাগ্য, আমার সুখ ।
তোমার মা কাকি দের মৃত্যু তোমার কোনো দোষ নেই । এটাই ছিলো নিয়তি।
একদম কাঁদবে না আর। না হলে আজ থেকে ই প্রাক্টিক্যাল শুরু হয়ে যাবে।

ঝিল হেসে ফেললো। অভিনব কে জড়িয়ে ধরলো। বুকে মুখ গুঁজে কাঁদতে লাগলো। অনেক দিন পর প্রান খুলে কাঁদছে সে।প্রশান্তির কান্না , প্রাপ্তির কান্না।

*

প্রচুর উত্তেজনা। টান টান ভাব নিয়ে আছে অভিনব আর ঝিল। মুভি দেখছে তাঁরা । যদি ও রেকর্ডেড মুভি বাট দুজনের কারো ই দেখা হয় নি। সিডি টা কালেক্ট করেছে এজেন্সি থেকে।
অভিনব ঝিল কে খোঁচা মারছে আর বলছে
_ দেখো ওরা কতো রোমান্টিক। আর তুমি একটা গাঁধা।

_ আমি গাঁধা হলে তুমি গাঁধার বর গরু।

_ ছাগল কোথাকার।

_ ঐ তুমি আমাকে মেল ভার্সনে বলছো কেন ? ছাগল তো তুমি !

_ আর তুমি ?

_ ছাগী।

কথা টা আনমনেই বলে ফেলেছে ঝিল। অভিনব হাসতে হাসতে বেডে শুইয়ে পরলো। ঝিল আমতা আমতা করতে লাগলো। অভিনবর জ্যাকেট চেপে ধরে বলল
_ অনেক পাঁজি তুমি । না জানি তোমার নেক্সট জেনারেশন কতো বড় হাঁদা আর ছাগল হবে।

_ ইসস ঢং এমন করছো যেন নেক্সট জেনারেশন টা আমি একটা ক্রিয়েট করবো।
তুমি ও সমান দোষী হবে।

_ আজব অন্য কেউ ও তো হতে পারে।

_ এই মেয়ে তুমি কি আমাকে সন্দেহ করছো ?

_ কেন হতে পারে না ?

_ ঠাটিয়ে মারবো এক চর।

_ ইসস মারবে চর। আমার বর তোমাকে ঘুষি মেরে নাক ফাটিয়ে দিবে।

_ আচ্ছা ঝগড়াটে তো তুমি। ঝগড়া করো এতো রোমান্স এর বেলায় এতো কৃপন কেন ?

ঝিল মৃদু হাসলো। ফট করে অভিনবর গাঁয়ে পরে গেল। অভিনব ও এক হাতে জড়িয়ে ধরলো। ঝিলের মাথায় হাত বুলিয়ে প্রান ভরে নিশ্বাস নিলো।

টিভি তে মুভি চলতে থাকলে ও তাঁতে কারো ই আগ্রহ দেখা গেল না। অভিনব টিভি অফ করে দিলো। ঝিলের কোলে মাথা রেখে বলল
_ সব ভালোবাসায় কি এতো সুখ আছে ঝিল ?

_ কেন নয় অবশ্যই আছে। তবে সুখের জন্য অনেক কষ্ট করতে হয় যে।

_ তুমি অনেক বুঝদার , তবে কিছু ক্ষেত্রে বড্ড ভিতু।
এভাবে তুমি নিজের শক্তি হারিয়ে ফেলবে।

ঝিল লজ্জা পেল। বিষয় টা তিতা সত্যি। কারন পাপা আর ভাই দের আদরে বড় হওয়া এক মাত্র মেয়ে ঝিল। এতো গুলো পুরুষ মানুষের মাঝে স্বাভাবিক মেয়ে দের মতো বেড়ে উঠতে পারবে না এটাই স্বাভাবিক। তবু ও এই অস্বাভাবিক এর মধ্যে স্বাভাবিক ভাবে বেড়ে উঠা টাই ইউনিক। যেটা সবাই চায়।

অভিনব নীরবতা ভেঙে বলল
_ তাই বলে ভেবো না আমি তোমাকে মেনে নিতে পারছি না বা অন্য কিছু।
তুমি যেমন ,আমার তেমন ই চলবে। এই যে বাচ্চা বাচ্চা ফুটফুটে একটা মেয়ে এতেই আমার শান্তি।
শুধু কিছু ক্ষেত্রে তোমাকে সাহসী হতে আর একটু পরিবর্তন হতে হবে।

_ কেমন ?

_ এই যে আমার উপর অনেক বিশ্বাস রাখতে হবে। তারপর অল্প তে ভয় পাওয়া যাবে না। নিজেকে ছোট ভাবা যাবে না। সবাই কে জবাব দিতে শিখতে হবে।

ঝিল মন খারাপ করে ফেললো। অভিনব কোল থেকে মাথা উঠিয়ে বলল
_ কি হলো ? তুমি কোনো কিছু নিয়ে আপসেট ?

_ উহুহহ

_ তাহলে আমার কোনো কথায় কষ্ট পেয়েছো ?

_ সেটা ও নয়।

_ তাহলে কি হয়েছে তোমার ? মুড অফ কেন ?

_ আসলে অভিনব একটা সত্যি কথা বলবো ?

অভিনব চোখ দিয়ে আশ্বস্ত করে সম্মতি জানালো। কাঠ হয়ে যাওয়া ঠোঁট দুটো জ্বিভ দিয়ে ভিজিয়ে নিলো ঝিল। অভিনব উৎসুক দৃষ্টি তে তাকালো। ঝিলের আড়ষ্ঠতা কারন কি ?

_ আমি আসলে

_ হুমম বলো।

_ আমি আসলে তোমাকে দেখলে সব গুলিয়ে ফেলি। তাই সেদিন বানর এর বিষয় টা নিয়ে কেঁদে ফেলেছি। আম ড্যাম সিউর তুমি না থাকলে সবাই কে সাইজ করে ফেলতাম।
কিন্তু তুমি যখন ছিলে আমি একটা কথা ও বলতে পারি নি।
বার বার তোমার দিকে তাকিয়েছি। অদ্ভুত আকর্ষন পাই।

কথা গুলো বলেই ঝিল মাথা নিচু করে নিলো। অভিনব হাসলো। মেয়েটা ফুল প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। ঝিলের দু বাহু ধরে নিজের কাছে নিয়ে আসলো। মেয়েটার দৃষ্টি তখনো নত। অভিনব তাঁর মাদকতা পূর্ন কন্ঠে বলল
_ এতেই হবে। আমার কাছে থাকলে পৃথিবীর কোনো শক্তি তোমায় স্পর্শ করতে পারবে না।
তবে আমি না থাকলে তোমায় স্ট্রং থাকতে হবে । বুঝেছো ?

ঝিল মাথা ঝাঁকালো। অভিনব মৃদু হেসে ঝিলের কোলে মাথা এলিয়ে দিলো। পলক হীন ভাবে তাকিয়ে রইলো। খুব তাড়াতাড়ি এই বিষয় টা পরিবার কে জানাতে হবে। যদি ও অভিনবর দিক থেকে কোনো অসুবিধা হবে না । তবে ঝিলের বিষয় টা ও একটু দেখতে হবে। যাই হয়ে যাক ঝিলের হাত টা ছাড়বে না।
#ধূসর_রঙের_প্রজাপতি
#ফাতেমা_তুজ
#part_40

ভোর হতেই উঠে বসেছে ঝিল। পারছে না এখনি বেরিয়ে যেতে। অভিনব কে নিয়ে প্রচন্ড ইনসিকিউর ফিল করছে। তাই তো ভোর পাঁচ টায় উঠে অভিনব কে খোচাচ্ছে। অভিনব ঘুমু ঘুমু চোখে তাকালো। আবার ঘুমিয়ে পরলো। ঝিল এবার রাগ করলো। অভিনব বিষয় টা খেয়াল করেছে তাই ঝিল কে বেডের সাথে চেপে ধরে আবার শুইয়ে পরলো।
_ আজব তোমার এতো ঘুম পাচ্ছে তো তুমি ঘুমাও । আমাকে কেন টানছো ?

_ তোমাকেই প্রয়োজন তাই তোমাকেই টানছি।

_ ছাড়ো বলছি।

_ ছাড়বো না।

ঝিল নিজেকে ছাড়াতে ব্যস্ত হয়ে পরলো। অভিনব না পেরে উঠেই গেল । ঝিল কে কাছে টেনে বলল
_ এতো ভয় পাও আমায় নিয়ে ?

_ অনেক বেশি।

_ তাহলে চলো পালিয়ে যাই।

_ পালিয়ে যাবো ?

_ হ্যাঁ বহুদূর। যেখানে আমি আর তুমি থাকবো। সবার উপস্থিতি নট এলাউ।

_ এমন হয় নাকি ?

_ কেন হবে না। তুমি চাইলে চাঁদ কে খন্ড করে দিবো।

_ ধ্যাত।

_ বিশ্বাস হচ্ছে না ?

_ হুমম হয়েছে বিশ্বাস। এখন শোনো আমার না খুব ভয় হচ্ছে। মাহেরা আপু একদম চুপচাপ ছিলো। যদি কিছু করে বসে ?

অভিনব দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে বলল
_ কিছু হবে না। তুমি এতো ভয় পেও না।
আচ্ছা ফ্রেস হয়ে এসো আমরা সবাই কে বলে মংলা থেকেই নেমে যাবো।

_ তাহলে রূপসা সেতুর কি হবে ?

_ সেটায় ওহ ঘোরাবো একদিন। তবে বাইকে চরে, হ্যাপি ?

ঝিল মাথা কাত করে সম্মতি জানালো। অভিনব ঝিলের কাঁধে নাক ঘষে বলল
_ তাহলে আমি কি পাবো ?

ঝিল লজ্জা হাসলো। অভিনবর পিঠে হাত বুলিয়ে বলল
_ যেটা আমি চাইবো।

_ তুমি কি চাও ?

_ যেটা তুমি চাও।

ঝিলের কথা অভিনব হাসলো। ফ্রেস হয়ে এসে সকলের সাথে নাস্তা সেরে নিলো। সবাই মন খারাপ করে ফেলেছে। অভিনব সবাই কে আশ্বস্ত করে বললো আবার আসবে এক সাথে । ঝিল পাপড়ি কে জড়িয়ে কেঁদেই ফেললো। বড্ড আপন হয়ে গেছে। তবে যেতে তো হবেই । পরিশেষে ঝিল আর অভিনব হাসি মুখে সবাই কে বিদায় জানালো।

মংলা সমুদ্র বন্দর থেকে সোজা ঢাকা চলে যেতে চাচ্ছে ঝিল। তবে অভিনব বললো এখানেই একদিন রেস্ট নিতে। ঝিল ও সায় জানালো। খুলনার একটা রিসোর্ট এ চলে আসলো দুজনে। রিসোর্ট টা বোধহয় কাপল দের জন্য ই করা।
পুরো রিসোর্ট জুড়ে রয়েছে প্রেমের ভাস্কর্য আর ফলক করা সংলাপ। ঝিল মনোযোগ দিয়ে প্রতি টি সংলাপ পড়ছে। কাউন্টার থেকে চাবি কালেক্ট করে বের হয়ে আসলো অভিনব । ঝিল কে মনোযোগ সহকারে পড়তে দেখে বলল
_ সারাদিন কি এখানেই পার করে দিবে ?

_ দিতেই পারি। বেশ ভালোই তো লাগছে।

_ রুম টা তো দেখে আসবে !

_ ওহহ হ্যাঁ । আচ্ছা চলো , আমাদের কটেজ কোন দিকে ?

অভিনব ঝিল কে দিক দেখিয়ে দিলো। এককদম এগিয়ে আবার পিছিয়ে গেল। অভিনবর হাত ধরে এক সাথেই হাঁটতে লাগলো।

কটেজ এ এসে ঝিল অবাক হলো। কটেজ এর রুম টা ভীষন সুন্দর। এক সাইটে বাঁশের তৈরি ঘরের মতো ডিজাইন করা। একটা ওয়াসরুম সাথে ছোট খাটো কিচেন ওহ রয়েছে। অভিনব ব্যাগ দুটো কাবাডে তুলে রাখলো । ততক্ষণে ঝিল ব্যলকনি তে চলে গেছে । অভিনব ব্যলকনিতে গেল না। ফ্রেস হওয়া দরকার তাই বাথরুমে চলে গেল।
একে বারে সাওয়ার নিয়ে ফিরেছে। ট্রাওয়াল দিয়ে মাথা মুছে আশে পাশে তাকালো । ঝিল এখনো ব্যলকনিতে আছে। ট্রাওয়াল হাতেই ব্যলকনিতে চলে আসলো।

পেছন ফিরে আছে ঝিল। অভিনব চার পাশে চোখ বুলালো। ব্যলকনি টা নদী বরাবর। এখান থেকে নদীর পানি গুলো বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে। অপর পাশে বিশাল ফুলের বাগান।
অভিনবর উপস্থিতি অনুভব করে ঝিল তাকালো। অভিনবর হাসি দেখে ঝিলের বুক ধুকপুকানি শুরু হয়ে গেল।
_ লজ্জা পাচ্ছো কেন ঝিল ? আমি তো কিছু করি নি।

_ তুমি হাসছো কেন ?

_ হাসলে বুঝি লজ্জা পেতে হয় ?

_ হুমম হয়।

_ কফি খাবে ?

ঝিল মাথা হেলালো। অভিনব কিচেনের দিকে পা বাড়ালো। যাওয়ার পূর্বে বলে গেল ফ্রেস হতে।

কফি বানাতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে অভিনব কে। কেটলি টা নষ্ট বোধহয়। ঝিল ফ্রেস হয়ে এসে ভাবলো কফি খাবে। কিন্তু সেটা হলো না। অভিনব অপরাধীর মতো তাকালো। সে দৃষ্টি লক্ষ্য করে ঝিল নাক ফুলালো।
_ এই রাগ করো না। বাইরের থেকে খেয়ে আসি ?

_ উহুহহ। তাহলে তো তোমার হাতের স্বাদ পাওয়া যাবে না।

_ বোকা মেয়ে চলো তো।

ঝিল কে টেনে নিয়ে গেল অভিনব। বাইরে এসে ধোঁয়া উঠা কফি খেয়ে নিলো।

*

শীতের প্রকোপে নেতিয়ে উঠেছে গাছ গুলো। কেমন রুক্ষ শুষ্ক দেখাচ্ছে। সূর্য যথাসম্ভব কিরন দিয়ে যাচ্ছে। তবে অভিমানী কুয়াশা সূর্য কে আসতে দিচ্ছে না। লেপ্টে রয়েছে আকাশের বুকে। ঘন ঘন শ্বাস ফেলছে ঝিল। পাশেই অভিনব ফোন হাতে গভীর মনোযোগ দিয়েছে। কয়েক ফিট দূরে গুটি কয়েক বাচ্চা খেলছে। গাঁয়ে ওলের জামা কাপড়।
তাঁদের পাশে ই জড়ো করে আছে বাচ্চা দের মা বাবা। সন্তান দের নিয়ে পার্কের এসেছে সুন্দর সময় কাটাতে।

_ একটা কথা কি জানো আমি আমার শৈশব এ সব পেয়ে ও কিছু পাই নি। বন্দী থাকতে হয় নি তবে সঙ্গির অভাব ছিলো। ভাইয়া দের সাথে খেলতাম ঠিক ই তবে মা নামক সঙ্গীর অভাব ছিলো। কখনো কাউকে মা ডাকা হয় নি। আদুরে গলায় কখনো কেউ বলে নি খাবার টা না খেলে খুব মারবো।
পাপা রা আমার প্রতি টা কথা অক্ষরে অক্ষরে মেনেছে। আমি ই যেন তাঁদের রাজ্যের এক মাত্র রাজকন্যা । আমি যা বলেছি সেটাই ঠিক। আমার চাওয়া গুলো ভিন্ন হয়ে গেছে। আমি চাইতাম কেউ আমাকে শাসন করুক।
কথায় আছে না যার যেটা অভাব সে সেটার প্রতি ই আকর্ষিত। আমার অভাব ছিলো মা।

খুব মনোযোগী শ্রোতা অভিনব। মেয়েটার কষ্টের পূর্ন অনুভব না হলে ও কিছু টা বুঝতে পেরেছে সে। ঝিলের আক্ষেপ কখনোই যাবে না। মায়ের স্থান কেউ কি পূরন করতে পারে ? তবু ও ঝিল কে আশ্বস্ত করে বলল
_ তুমি না চাইলে ও তোমার এক মা আছেন সেটা জানো ?

ঝিল একটু হাসলো । অভিনবর কথার মানে সে বুঝতে পেরেছে। অভিনব অভিজ্ঞদের মতো করে বলল
_ জানো ই তো আমি আমার মা বাবার এক মাত্র সন্তান। ছেলে থাকলে ও তাঁদের মেয়ের শখ ছিলো। কিন্তু আল্লাহ সেটা চান নি। কারন আল্লাহ চেয়েছেন তোমাকে আমার স্ত্রী হিসেবে। তোমার মায়ের অভাব আর মম এর মেয়ের অভাব পূরন করার জন্য।
সৃষ্টিকর্তার ভাবনা বিশাল। তাঁর ভাবনার পেছনের এক অংশ ও আমরা কল্পনা করতে পারি না।
কে জানতো আমার থেকে 10 বছরের ছোট্ট একটা মেয়ে হবে আমার বউ?

ঝিল ভ্রু কুঁচকে তাকালো। অভিনব প্রশ্নবোধক দৃষ্টি তে তাকিয়ে বলল
_ কি হলো ? ভ্রু যুগল এমন কুঁচকে গেছে কেন ?

_ তোমার বয়স কত ?

_ 29

চোখ পিট পিট করে তাকালো ঝিল । অবিশ্বাসের স্বরে বলল
_ মজা করছো ?

_ মজা কেন করবো ?

_ মাই গড। আমার সামনে বসে থাকা ছেলেটার বয়স 29 হয়ে গেছে। আমি তো 25 26 বছর ভেবেছি।

অভিনব গগন কাঁপিয়ে হাসতে লাগলো। ঝিলের চুল টেনে বলল
_ এখন কি ভাবছো , বুড়ো হয়ে গেছি আমি ?

_ ধ্যাত। সেটা কেন ভাববো ? একটা জিনিস ই মেলাচ্ছি যে, মেয়েরা কুঁড়ি তেই বুড়ি। দশ বছর পর দেখা যাবে আমার কপালে ভাঁজ পরে গেছে। চোখ দুটো স্থির , আর মুখে কোনো উজ্বলতাই নেই। আর তুমি পুরো ই উল্টো।

_ উহুহহ । মেয়েরা মা হয় , আর মা কখনো বুড়ো হয় না। তাঁদের সন্তানের কাছে সব সময় ই সুপার ওম্যান।

ঝিল খিল খিল করে হাসলো। অভিনব বাহু তে মাথা ঠেকিয়ে বলল
_ আইসক্রিম খাবো।

_ এখন ?

_ হ্যাঁ।

_ ঠান্ডা লেগে যাবে ।

_ লাগবে না। দেখো ঐ পিচ্ছি বাচ্চা গুলো ও কেমন আইসক্রিম খাচ্ছে।

_ তুমি কি পিচ্ছি ?

_ কোনো সন্দেহ ?

অভিনব একটু ঝুঁকে নিলো। ঝিলের মুখের দিকে কিছু ক্ষন তাকিয়ে থেকে বলল
_ বোধহয় না।

অভিনবর বাহু তে চাপর মেরে হাসলো মেয়েটা। আকাশ টা একটু একটু করে স্বচ্ছ হচ্ছে । বোধহয় বিকেল হতে চলেছে। কুয়াশা গুলো শিশির হয়ে ঘাস কে রাঙাতে লাগলো।

*

পাঁচ ছয় বছর বয়সী এক পিচ্ছি ঝিলের জামা ধরে টানছে। ঝিল পেছন ফিরে তাকালো। অভিনব আইসক্রিম নিতে আইসক্রিম পার্লারে গিয়েছে। সময় টা যেন একটু বেশি ই নিচ্ছে। হাঁটু ঘেড়ে পিচ্ছিটার সামনে বসলো। বাচ্চা ছেলেটা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে। ঝিল অধর কোনে হাসি ফুটিয়ে বলল
_ নাম কি তোমার ?

_ শিশির।

_ বাহহ ভারী সুন্দর তো তোমার নাম টা। তুমি দেখতে ও একদম শিশিরের মতো।

বাচ্চা টা খলবিলিয়ে হাসলো। ঝিল সে হাসি উপেক্ষা করতে পারলো না। টুপ করে চুমু দিয়ে দিলো। বাচ্চা টা যেন লজ্জা পেল । মাথা নিচু করে রইলো। অভিনব কে আইসক্রিম পার্লার থেকে বের হতে দেখে উঠে দাঁড়ালো । আবার জামায় টান অনুভব করলো। শিশির তাঁর জামা টেনে ধরছে। ঝিল হাঁটু গেড়ে বসতেই শিশির বলল
_ ক্ষিদে পেয়েছে।

_ তোমার ক্ষিদে পেয়েছে ? সকাল থেকে কিছু খাও নি ?

বাচ্চা টা মাথা ঝাঁকালো । অভিনব ততক্ষণে তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। বাচ্চা টাকে দেখতে একটু হাসলো।
_ কি কথা হচ্ছে ঝিল ?

_ ওর ক্ষিদে পেয়েছে।

_ আচ্ছা !

বাচ্চা টা মাথা ঝাকালো। অভিনব নিচু হয়ে হাঁটু মুরে বসলো। শিশিরের দু হাত মুঠো বন্দি করে বলল
_ তোমার মা বাবা কোথায় ?

বাচ্চা টা মাথা নিচু করে ইশারা করলো। অভিনব তাকিয়ে দেখলো বাচ্চাটা মা হিসেবে এক পাগলী কে দেখাচ্ছে। স্তব্ধ হয়ে গেল সে। ঝিল বলল
_ ঐ টাই তোমার মা ?

_ হুমম।

অভিনবর অন্তকর্নে ব্যথা অনুভব হলো। একজন পাগলী ও তাঁর সন্তান কে আগলে রেখেছে। মা বুঝি এমনি হয় ?
অভিনব কাউ কে ফোন করলো। কিছু কথা বার্তা বলে নিলো। ঝিল বাচ্চা টাকে আদর করে যাচ্ছে।
অভিনব বলল
_ ওদের একটা এন জি ও তে পাঠালে কেমন হবে ঝিল ?
বাচ্চা টা তো ইনসিকিউর।

ঝিল ও সম্মতি জানালো। ভাগ্যিস বাচ্চা টা ছেলে । মেয়ে হলে রাস্তার হায়না রা এই ছোট বাচ্চাটা কে ও কলঙ্কিত করে দিতো। শরীরে বসিয়ে দিতো কালো হাতের থাবা। ঝিলের চোখ বন্ধ হয়ে গেল। না জানি কতো শিশু প্রতি দিন অত্যাচারিত হচ্ছে। না জানি কতো মা তাঁদের সন্তান কে হারাচ্ছে কিছু বিষাক্ত হায়নার কাছে।

বাচ্চা টা কে নিয়ে একটা ফুড কোড এ চলে আসলো। ঝাল বিহীন নানা খাবার অর্ডার করে দিলো। কিন্তু শিশির খাবার খাচ্ছে না। ব্যস্ত হয়ে ঝিল বলল
_ এগুলো কি তোমার পছন্দ নয় ?

শিশির উত্তর দিলো না। অভিনব ভাবনায় পরে চকলেট অর্ডার করলো। আশ্চর্যজনক ভাবে চকলেট টা ও নিলো না সে। অভিনব শিশিরের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল
_ কেন খাচ্ছো না তুমি ?

_ আমার মা !

থম মেরে গেল ঝিল আর অভিনব। বিস্ময়ে হতবাক। ছোট এক বাচ্চা সে ও তাঁর মাকে রেখে খাবে না। ছলছল করে উঠলো ঝিলের চোখ। অদ্ভুত শিহরন অনুভব হলো। মা নামক মানুষ টার প্রতি এতো ভালোবাসা সত্যি ই অতুলনীয়। প্রতি টা সন্তানের কাছেই তাঁর মা বাবা সেরা। অথচ আজ ও এ দেশে বৃদ্ধাশ্রম রয়েছে। কিছু অমানবিক সন্তান দামী ফ্ল্যাটে থাকছে আর আস্তা কুড়ের মাঝে ফেলছে মা বাবা কে।
#ধূসর_রঙের_প্রজাপতি
#ফাতেমা_তুজ
#part_41

নির্জীব আকাশ। সারা দিনের কর্মব্যস্ততা কাটিয়ে আঁধার নামিয়েছে। ক্লান্ত সে , বোধ হয় একটু ঘুমাতে চায়। তাই তো চাঁদ টা ও মিলিয়ে গেছে । যাতে করে ক্লান্ত আকাশ টাকে কেউ দেখতে না পারে। ঘুটঘুটে অন্ধকার। শীতের প্রকোপ টা ও বেড়েছে। যেন সারা বছরের শীত আজ ই নেমে এসেছে। ঝিল কাঁপছে, অভিনব লক্ষ্য করলো মেয়েটার শরীর কেমন কুকুরে যাচ্ছে। খানিকটা চিন্তা গস্ত হলো। তিন দিন বনের ভেতরে যেমন তেমন করে থেকেছে। না ছিলো শরীরের যত্ন আর না মেনেছে ঠান্ডার ধাঁচ ।
সমস্ত কিছু ছাপিয়ে শুধুই প্রকৃতির সাথে মিশেছে।
অভিনব রিসেপশনে কথা বলে কাঠ নিয়ে এসেছে। আগুন জ্বালিয়ে ছোট খাটো উত্তাপ পোহাবে। যদি ও হিটার রয়েছে তাঁতে ভ্রমন ভ্রমন মজা পাওয়া যাবে না। প্রকৃতি প্রেমি রা বোধ হয় এমনি হয়। সহজ জিনিস পছন্দ নয়। কষ্ট করবে তবু ও প্রকৃতির সাথে ই লেপ্টে থাকবে।
_ ঝিল একটু ব্যলকনিতে আসো। আগুন জ্বালিয়েছি , দেখবে ভালো লাগবে।

ঝিল যেন চাঁদ পেয়েছে। ছুটে আসলো ব্যলকনিতে। অভিনব খুব সুন্দর করে আগনু জ্বালিয়েছে । সচরাচর নিয়মে দু পাশে দুটো টুল থাকার কথা। কিন্তু তা না করে এক পাশেই দুটো ঢোল রেখেছে। অভিনব একটু করে হেসে বলল
_ বসো ।

অভিনবর কথাটা যেন মেয়েটার কর্ণপাত হলো না। অভিনব ফোঁস করে শ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো । ঘুটঘুটে অন্ধকারে এক টুকুরো কাঠের মাঝে জ্বলন্ত আগুন। বিষয় টা পুরোই অদ্ভুত। আগুন বুঝি এমন ও সুন্দর হয় ?
আসলেই পরিস্থিতি অনুযায়ী সব কিছুই সুন্দর।

_ ঝিল !

আচমকা ধাক্কা লাগায় চমকে উঠে মেয়েটা। অভিনব একটু করে হাসে। পুরো পুতুলের মতো প্যাকেট হয়ে আছে। তাঁতে ও শরীর কাঁপছে। একে নিয়ে সাইবেরিয়া যেতে হলে মহা বিপদ হবে। অভিনব ভেবে নিলো আগে থেকেই ট্রেনিং দিবে । না হলে ঘুরতে যাওয়াই যাবে না। প্রকৃতির সাথে সখ্যতা যে একটু বেশিই প্রয়োজন।
প্রান ভরে শ্বাস নেওয়ার জন্য , কিংবা আল্লাহর সৃষ্টি কে দেখার জন্য হলে ও সখ্যতা বড্ড প্রয়োজন।
আর ঝিল কে ছাড়া কোথাও যাবে না। মেয়েটার হাতে হাত রেখেই তো আগাতে চায়।
থর থর করে কাঁপছে ঝিল । অভিনব এক হাতে জড়িয়ে বসলো। ছোট বিড়াল ছানার মতো লেপ্টে গেল। অভিনবর শরীরের উষ্ণতা যেন মেয়েটাকে শক্তি জুগিয়েছে। আসলেই মানুষের শরীরে উষ্ণনা অদ্ভুত ভাবে কাজ করে।
_ চাঁদ টা কি সুন্দর তাই না ?

_ চাঁদ !

_ হুমম। চাঁদ টা এতো সুন্দর কেন বলো তো ?

_ অদ্ভুত আমি কেন দেখতে পারছি না ?

_ চোখের ব্যামো হয়েছে তোমার ।

ঝিল ভ্রু কুঁচকে নিলো। সত্যি কি চোখের ব্যামো হলো তাঁর । এক হাতে চোখ ঢলে নিলো। বাকি সব তো ঠিক ঠাক ই আছে। তাহলে চাঁদ কে কেন দেখতে পাচ্ছে না ?
রাত কানা রোগ হয় , চাঁদ কানা রোগ ওহ কি আছে ?

_ শোনো চাঁদ কানা রোগ হয় ?

_ গাঁধা!

_ আজব তো। গাঁধার কি হলো ? তুমি ই তো বললে চোখের ব্যামো হয়েছে।

_ তো ?

_ তো মানে ? সব কিছু ই দেখছি, শুধু চাঁদ কেই দেখতে পাচ্ছি না।

ফ্যাল ফ্যাল করে তাকালো। ঝিলের মাথায় সাধারন বিষয় কেন যে ক্যাচ করে না। নাকি অভিনব ই একটু বেশি চালাক ?

_এই কথা বলো না কেন ? তোমার আবার কথার ব্যামো হলো না তো ?

_ হুসস।

নিভে গেল ঝিল। অভিনবর মুখে দুষ্টুমির ছায়া। একটু আগাতে ই ছটফট করে উঠলো মেয়েটা। অভিনবর বুকে হাত দিয়ে বলল
_ দেখো আমার শীত করছে। উল্টো পাল্টা কোনো ভাবনা মাথায় ওহ এনো না।

অভিনব মুখ ঘুরিয়ে নিলো। ঝিল কিছুই বললো না। পিন পতন নীরবতা দুজন দু দিকে তাকিয়ে।
_ আজব মানুষ দেখেছি , তবে গাঁধা মানুষ কখনোই দেখি নি। তবে সেটা ও আজকাল দেখতে পাচ্ছি।

_ আমাকেই বললে ?

_ তুমি ? কে তুমি ? তোমাকে কেন বলবো।

অভিনবর হেয়ালি পানায় বিরক্ত ঝিল। উঠে যেতে চাইলেই খপ করে হাত ধরে নিলো অভিনব । ঝিল অভিমানী গলায় বলল
_ বার বার গাঁধা বলো কেন আমায় ? আমি কি গাঁধা ?

_ উহহুহ আমার গাঁধী।

অভিমানের মাঝে ও হেসে ফেললো ঝিল। দুটো কিল মেরে অবভিনবর বুকে মাথা রাখলো।
পরম আবেশে চোখ বন্ধ করলো। অভিনব তাঁর শীতল হাতে ঝিলের চুলে গলিয়ে দিলো। ঠোঁটে হাসি নিয়ে বলল
_ চাঁদ কে বুকে নিলে এতো স্বস্তি পাওয়া যায় ?

_ চাঁদ ?

_হ্যাঁ আমার চাঁদ ই তো তুমি। আমার ব্যক্তি গত চাঁদ ।

ঝিলের ভেতর থেকে ভারী নিশ্বাস এলো। এতো ভালোবাসা কখনো ফিকে হয়ে যাবে না তো ?

*

প্রকান্ড শীতের মাঝে ভয়ঙ্কর ভাবে কাঁপছে ঝিল। অভিনবর দিকে রাগী চোখে তাকাচ্ছে। ফিচেল হাসি তে মত্ত সে। আগুনের কাছে হাত নিয়ে তাপ নিলো।শীত কমছে না। এই মাঝ রাতে সাওয়ার নিতে হয়েছে । সব দোষ অভিনবর। অভিনব ই তাঁর কাছাকাছি এসেছে। ছেলেটার চুল গুলো ছিড়তে ইচ্ছে হচ্ছে। কম্বল হাতে এগিয়ে এলো অভিনব । পেছন থেকে কম্বল নিয়ে পেঁচিয়ে জড়িয়ে ধরলো।
রগরগা কন্ঠে খানিক টা সুর তুলে বলল
_ স্যরি।

_ এখন বলে কি হবে ? আগে মনে ছিলো না ?

_ সব দোষ কি আমার ?

_ অবশ্যই তোমার। তুমি ই তো আমাকে কাছে টেনে নিয়েছো।

_ তুমি বাঁধা দিয়েছিলে ?

_ তো। এতে আমার দোষ। আমি তো

_ ইসসস বললেই হলো। শোনো মেয়ে আবার শাওয়ার না নিতে চাইলে কাছে আসো।

_ দূরে যাও। একদম কাছে আসবে না।

অভিনব ভ্রু কুঁচকে তাকালো। মেয়েটাকে টেনে বুকে নিয়ে নিলো। ভারী নিশ্বাস ফেলে বলল
_ এবার ঘুমাও।

ঝিল কথা বাড়ালো না , ঘুমিয়ে পরলো।

সকাল সকাল ঘুম ভাঙলো না। কলিং বেল বাজতেই অভিনব পিট পিট করে তাকালো। বিরক্ত হলো খুব। তবু ও উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলো।
সকালের নাস্তা এসেছে। এই নাস্তা গুলোই ওর জীবন কে এক ধাপ পিছিয়ে দিলো। বউ এর সাথে ঘুমিয়েছিলো সেটা ও সহ্য হলো না এই নাস্তার। আবার রোম্যান্স করবে তখন ও নাস্তার কল আসে। আজব দুনিয়া ।

দু ঘন্টা ঘুমিয়ে তারপর উঠে পরলো। ঝিলের ঘুম তখনো কাটে নি। অভিনবর ফ্যাচ ফ্যাচানি তে উঠে পরলো। মনে মনে এক গাঁদা গালি মেরে দিলো।
অভিনব নাক মুখ কুঁচকে বলল
_ এতো ঘুমালে মটু হয়ে যাবে। এমনি তেই তো আটার বস্তা।

_ দেখো অভিনব তুমি কিন্তু অনেক বেশি মজা করছো।

_ তো ? আমি ই তো মজা করবো। মাঝে মাঝে রোম্যান্স ওহ করবো। তুমি কি ভেবেছো খুব ভদ্র আমি ?

_ আসলেই একটা অসভ্য। কার ঘাড়ে এসে পরলাম।

বালিশ টা ছুঁড়ে অভিনবর গাঁয়ে ফেললো। অভিনব পেট চেপে হাসছে । অন্য দিকে রাগে গজগজ করতে করতে ফ্রেস হতে গেল ঝিল ।

রিসোর্ট টা কাল ঘোরা হয় নি। তাই আজ ঘুরতে বের হলো। সকালে নাস্তা করে আবার ঘুমিয়েছিলো। দুপুরে উঠে সাওয়ার নিয়ে লাঞ্চ করতেই বেজে গেল চারটা।
তাই এখনি বের হলো দুজনে। রিসোর্ট এ দোলনা সহ নানান খেলনা বসানো। রয়েছে সাইকেলিং এর ব্যবস্থা। ঝিলের চোখ চকচক করে উঠলো। সাইকেলিং করবে সে। অভিনব বাঁধা দিলে ও শুনলো না। অভিনব হাত চেপে বলল
_ কাপল সাইকেলিং করি ?

_ রিয়েলি ?

_ হ্যাঁ ।

প্রচন্ড খুশিতে লাফিয়ে উঠলো ঝিল । একটা সাইকেল নিয়ে দুজনেই বসলো। ছোট থেকেই সাইকেল চালাতে বেশ পারদর্শী ঝিল । তাই একটু ওহ ভয় হলো না। গোল গোল পাক খেতে লাগলো দুজনে । অভিনব কখনো কাপল সাইকেলিং করে নি। বার বার ব্রেক কষসে।
_ তুমি কাপল সাইকেলিং পারোই না।

_তো। আমার কি আরো বউ ছিলো যে আমি পারবো ?

_ থাকা দরকার ছিলো।

_ হোয়াট।

_ কিছু না। এমনিতেই বললাম । অন্য দিকে নজর দিলে চোখ গেলে দিবো । আমি আমার স্বামী কে ভাগ দিবো না।

অভিনব হেসে ফেললো। ঝিলের গাল টেনে দিয়ে লো স্প্রিটে সাইকেলিং করলো।

*

_ ব্যাগ গুছিয়েছো ঝিল ?

_ আমার ঘুম পাচ্ছে।

_ আচ্ছা তাহলে ঘুমাও । শোনো একটা ঘন্টা পরেই কিন্তু বের হবো আমরা।

_ বাস কখন ছাড়বে ?

_ রাত এগারোটায়।

_ ডিনার এখানেই করবো ?

_ অবশ্যই।

_ আচ্ছা রিসোর্ট এর বাইরে কোথাও গেলে হয় না ?

অভিনব টাইম দেখে নিলো। সন্ধ্যা সাত টা বাজে। অনেক টাইম আছে এখনো। ঝিলের দিকে তাকিয়ে বলল
_ তোমার না ঘুম পাচ্ছে ?

_ সমস্যা নেই এতে। আমি ম্যানেজ করে নিবো তো।

_ আচ্ছা তাহলে চলো। বাই দ্যা ওয়ে নিজের ব্যাগ নিজেই গোছাও।

_ প্লিজ গুছিয়ে দাও না।

_ অলসতা ভঙ্গুর মানসিকতার সৃষ্টি করে। গুছিয়ে নাও।

ঝিল আলসেমি ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো । রাগ দেখিয়ে অভিনবর ব্যাগের সব কাপড় বের করে নিলো। হতবাক অভিনব , কিছু না বলে গোছাতে গেলেই ঝিল বাঁধা দিয়ে বলল
_ দুটোই আমি গোছাবো।

অভিনবর সরে গেল । ঝিল যত্ন নিয়ে দুটো ব্যাগ ই গোছালো।

খুলনার ফুটপাত দিয়ে হাঁটছে দুজনে । খানিক টা অপরিচিত ভাব নিয়েই হাঁটছে । সেই প্রথম দিন গুলো ফিরে পেতে চায়। যখন ওদের বিয়ে হয়েছিলো। সেই দিন গুলো সত্যি ই খুব মনোমুগ্ধকর। শুধু অনুভূতি গুলো আলাদা। তখন চাইতো মুক্তি আর এখন দুজন দুজনার শক্তি । ভালোবাসা গুলো এমনি হয়। অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো নয় তবে ভালোবাসার ক্ষেত্রে সম্পূর্ন ভিন্ন। ব্যতিক্রম আছে তবে তাঁতে কি যায় আসে ?
ভালো খারাপ মিলিয়েই তো মানুষ ? যদি কেউ 51% ভালো হয় তাহলেই সে যোগ্য। কারন মানুষের ভালো দিক গুলোই বেঁচে থাকার অবলম্বন।

দুজনে একটা রেসট্রন এ চলে আসলো । রেসট্রন টা মূলত কাবাব নিয়ে। নানা রকমের কাবাব রয়েছে এতে। অভিনব মেনু কার্ড টা এগিয়ে দিলো। ঝিল বেশ ভেবে চিন্তে অর্ডার করলো। কোরাল মাছের কাবাব , জালি কাবাব , চিকেন পকোড়া আর রায়তা।
সাথে দুটো ধোঁয়া উঠা কফি ও নিয়ে নিলো। অভিনব এক গাল হেসে বলল
_ কাবাব কি শুধু শুধু খাবে ?

জ্বিভ কাটলো ঝিল । কথা কাটাতে বলল
_ আসলে আমি অতো টা ও খারাপ নই যে একাই অর্ডার করবো। তাই তোমার জন্য বাকি মেনু রেখে দিয়েছি।

_ কথায় হারাতে পারবো না তোমায়।

ঝিল বেশ ভাব নিয়ে হাসলো। অভিনব কাবাবের সাথে খাওয়ার জন্য বাটার নান আর লুচি নিয়ে নিলো।

মিনিট পনের পর খাবার দিয়ে গেল। দুজনে পেট পুরে খেলো। অভিনব বেশ অবাক হলো। কারন ঝিল আজ অনেক টা খেয়েছে।

বিল পে করে উঠে দাঁড়ালো। ঝিলের মন খারাপ। অভিনব সে দিকে পাত্তা দিলো না। কারন বাসে উঠতে হবে। ভাগ্য ক্রমে আজ ও বাসের লাস্ট সিট পেল । অবশ্য ভালো ই হয়েছে এতে। দম ফেলে ব্যাগ গুলো রেখে দিলো।
_ মন খারাপ কেন ঝিল ?

_আমরা আলাদা হয়ে যাচ্ছি অভিনব। সে দিকে খেয়াল আছে ?

_ এমন কেন বলছো ? আমরা মাস খানেক এর মধ্যে ই সম্পূর্ন এক হয়ে যাবো। মামা বাড়ির ভেজাল টা মিটিয়েই আমি তোমাকে নিয়ে যাবো।
দেড় বছর দূরে রেখেছি বলে ভেবো না এখন ছেড়ে দিবো।
একদম নিজের কাছে লুকিয়ে রাখবো তোমায়।

হাসি কান্নায় ভেঙে পরলো ঝিল । অভিনবর পেটে মুখ গুঁজে কাঁদতে লাগলো। কষ্ট হচ্ছে খুব । অভিনবর থেকে দূরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না। বড্ড মায়ায় জড়িয়ে গেছে।
বেঁচে থাকাই মুশকিল হয়ে গেছে। সারাক্ষণ ভয় হচ্ছে হারিয়ে ফেলার ভয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here