ধূসর রঙের প্রজাপতি পর্ব ৩৬+৩৭+৩৮

#ধূসর_রঙের_প্রজাপতি
#ফাতেমা_তুজ
#part_36

হাড়বাড়িয়া থেকে ফিরে এসেছে প্রায় ঘন্টা খানেক। পুরো সময় টাই সবাই রেস্ট নিয়েছে। যেহেতু ট্যুর টা চার রাতের আর আজ তৃতীয় দিন চলছে তাই আজকেই হবে সুন্দরবনের শেষ দিন। চতুর্থ দিনে সবাই কে নিয়ে খুলনার বিশেষ জায়গা গুলো তে যাওয়া হবে। অভিনব ভেবে রেখেছে সুন্দরবন পর্যন্ত ঘুরবে। কারন মাহেরা তাঁর প্রতি দূর্বল। যত কাছে থাকবে তত বেশি আকর্ষন হবে। শেষে বিপরীত না হয়ে যায়। মোটে ও রিক্স নিতে চায় না। ঝিল চেয়েছিলো সবার সাথে শেষ দিন অব্দি থাকতে কিন্তু মাহেরার কথা শোনা মাত্র ই নাকোচ করে দিয়েছে।
এখন তাঁর অবস্থা পালাই পালাই। ঝিলের ছটফট দেখে অভিনব হালকা হাসলো। প্রাপ্তির রেখা ফুটে উঠেছে পুরো মুখে। প্রিয় মানুষ কে হারিয়ে ফেলার ভয় যদি নাই থাকে তো সে তাঁর কিসের প্রিয় মানুষ।
কেবিনের পুরো অংশ জুড়ে পায়চারি করছে ঝিল। এতো টাই চিন্তিত যে প্রায় ই নখ কামড়াচ্ছে। বিষয় টা ভালো লাগছে না অভিনবর। চিন্তা করছে ঠিক আছে তবে নখ কামড়ানোর কি আছে।
অভিনব কিছু বলবে তাঁর আগেই ঝিলের কন্ঠ
_ আমার খুব ভয় হচ্ছে। আজ ই চলে যাওয়া যায় না ?

_ ভয় কেন পাচ্ছো? এমন তো নয় যে আমি তোমাকে ছেড়ে যাবো। দুপুরেই আমাদের সুন্দরবন ট্যুর এর লাস্ট স্পর্ট। আর কালকে সকালের মধ্যে জেলখানা ঘাট ফিরে যাচ্ছি।

_ কিন্তু

_ কোনো কিন্তু নয় এখন সাওয়ার নিয়ে আসো। আমি জেনে আসি দুপুরের লাস্ট স্পর্ট টা কোথায় ?

ঝিল ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। অভিনব এক পলক তাকিয়ে স্মিত হাসলো। মেয়েটার চিন্তিত মুখ দেখে কোথাও একটা কষ্ট অনুভব হচ্ছে। প্রেমে পাগল না হয়ে যায় মেয়েটা।
অভিনব চলে গেল। বড্ড ছটফট আর নরম মনের মেয়ে ঝিল। পরিবার থেকে স্বাধীনতা পেলে ও ভেতরের দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারে নি।
আর তাই প্রিয় মানুষদের হারানোর ভয় একটু বেশি।

মাহের এর চোখে মুখে বিষাদের ছায়া। মাহেরার এমন আচারনে লজ্জিত সে। অভিনবর কাছে ও যেতে পারছে না। এমন একটা পরিস্থিতি তে পরতে হবে কখনোই ভাবে নি। মাহেরার বোঝা উচিত ছিলো। এমন বাচ্চাদের মতো আচারন একদম ই কাম্য নয়।
ঝিলের সাথে অভিনবর কোনো সম্পর্ক আছে সেটাই বোঝাই গেছে। একটা সামান্য পরিচিত মানুষের সাথে একি কেবিনে থাকবে এমন টা কতো টা বিশ্বাস যোগ্য ?

_ মাহের , কি ভাবছো তুমি ? এতো চিন্তিত লাগছে ?

অভিনবর কন্ঠে পেছন ফিরে তাকালো। দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলো। নিজেকে ধাতস্থ করলো সব ঠিক আছে। তবু মনের শান্তি মিললো না। অভিনব আবারো ডাকলো। মাহের সামান্য হেসে বলল
_ আরে এই সময়ে এই দিকে আসলে যে ? কোনো সমস্যা অভিনব ?

_ না সমস্যা নেই। তবে জানতে এসেছিলাম আজ কের লাস্ট স্পর্ট কোথায় ?
যেহেতু কাল কেই আমরা চলে যাচ্ছি।

_ কালকে চলে যাচ্ছো মানে ?

অভিনব একটু করে শ্বাস নিলো। ঘড়িতে সময় দেখে বলল
_ আমি পার্কে সহ আশে পাশে যেতে আগ্রহী নই। সুন্দরবনেই ঘুরতে এসেছিলাম। আর এখানে তো আজকেই শেষ দিন।

_ অভিনব এটা কেমন কথা। অর্ধেক ট্যুর শেষ করেই চলে যাবে ?

_ ভাই একটু বুঝো বিষয়টা। আমি একটা পার্সোনাল ইস্যু নিয়ে ও এসেছি, সেটা তো জানোই । মামা দের বোঝাতে হবে। তাই একটু আগেই চলে যেতে চাচ্ছি ।

মাহেরের মন টা বিষিয়ে গেল। তাঁর বুদ্ধি সম্পূর্ন মস্তিষ্ক একটু হলে ও বুঝতে পেরেছে মূল কারন টা।
তাই খুব লজ্জা লাগছে। মাহেরের অস্বস্তি চোখে পরার মতো।অভিনব বেশ মনোযোগ দিয়ে তাকালো। কোনো ভাবে কি মাহেরার বিষয় জানতে পেরে গেছে? নাকি ওদের বিষয়ে জানতে পেরে গেছে। সব কিছু মিলিয়ে মাহের কি ভুল বুঝলো ?
অভিনবর ভাবনার ছেদ কাটলো শাকীল এর ডাকে। শাকীল হালকা হেসে অভিনব সাথে গলা মেলালো । অমিত কাগজ হাতে এদিকেই আসছে। অভিনব কে দেখে ঝরা হাসলো।
_ হে তোমরা সবাই এখানে জড়ো হয়েছো যে ?

_ এমনি এসেছি। তা তোমার হাতের কাগজ টা কিসের।

অমিত কাগজ টার দিকে একবার তাকালো। শাকীল এর দিকে বাড়িয়ে বলল
_ দেখ তো আজকের লাস্ট স্পর্ট কোনটা।

শাকীল মনোযোগ দিয়ে কাগজ টা দেখলো। অভিনব বলল
_ পেয়েছো ?

_ হুমম। মান্দারবাড়িয়া সমুদ্র সৈকত। যাক ভালো ই হয়েছে। শেষ টা না হয় সমুদ্র দিয়েই হোক।

অভিনব হালকা হাসলো। মাহের একের পর এক দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। অপরাধের দগ্ধে মরছে ছেলেটা।
বোনের আচরন তাঁর মাথা নিচু করে দিয়েছে। সবার উদ্দেশ্যে বলল
_ অভিনব খুলনা ঘুরবে না।

_ কেন ?

_ মামা রা বোধহয় এসে পরেছে। যত তাড়াতাড়ি যাবো তত সহজ হবে। জানোই তো বিষয় টা।

অভিনব নানান যুক্তি খাটালো। কেউ আর জোড়াজোড়ি করলো না। অভিনব মৃদু হেসে সবাই কে কথা দিলো আবার কোনো এক ট্যুরে এক সাথে আসবে।
সবাই বেশ খুশি হলো। অভিনবর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সবাই কেই মুগ্ধ করেছে। আচারনের দিক থেকে অভিনব সেরা।

*

_ ঝিল এবার তো সাওয়ারে যাও ?

_ আমি যাবো না।

_ এবার কিন্তু রাগ হচ্ছে খুব। এমন করলে আর কথাই বলবো না।

ঝিলের ভ্রু কুঁচকে গেল । কিছুক্ষণ অভিনবর দিকে তাকিয়ে রইলো। ছেলেটার মুখে অসহায়ত্ব। ঝিল তবু ও বলল
_ সমস্যা নেই আপনি যেতে পারেন। এমন নয় যে আপনি আমার কাছে বাঁধা। আপনার যখন ইচ্ছে হবে বলবেন আমি ডিভোর্স পেপার এ সাইন করে দিবো।

_ ঝিল !

_ আপনার দৃষ্টি এমন এলোমেলো কেন ?আমার তো মনে হচ্ছে আপনি আমাতে বিরক্ত।

_ ঝিল তুমি একটা সাধারন বিষয় নিয়ে

ঝিল তেতে উঠলো। খানিকটা জোড়েই বলল
_ কি করবো আমি ? ভালোবাসি তোমাকে। বুঝতে পেরেছো ,অতিরিক্ত ভালোবাসি। যা একদম ই উচিত হয় নি। আমি ঝলসে যাচ্ছি। তোমাকে হারানোর বেদনা আমি নিতে পারবো না।
কল্পনাতেই পাগল হয়ে যাচ্ছি। ভয় হয় আমার। আমি মানুষ তো ?

অভিনব কথা বলল না। তাকিয়ে দেখলো নব যৌবনে পা দেওয়া মেয়ে টাকে। সুশ্রী মুখে কান্নার ছাপ। নেতিয়ে যাওয়া ঠোঁট দুটো কাঁপছে। চোখ কোটরে চলে গেছে। এ কেমন বেদনা ?

_ এই মেয়ে পেয়েছো কি আমায় ? এভাবে আর কতো পুরাবে ? যন্ত্রনা কি আমার হয় না ? তোমার চোখের পানি আমার অন্তরে কেন বিধছে ?
ভালোবাসি বলে ? তবে এ যন্ত্রনা এতো সুখময় কেন ?

ঝিল ছলছল নয়নে তাকিয়ে আছে। অভিনব কে ঝাপসা দেখতে লাগছে। চোখের পানি গুলো গড়িয়ে পরছে না কেন ? অভিনব তার শক্ত হাতে মেয়েটাকে আলিঙ্গন করলো। অভিনবর জ্যাকেট খামচে ধরলো ঝিল। মাথা টা অভিনবর বুকের উপরে রেখে চোখের নির্লজ্জ ধারা নামিয়ে দিলো।
প্রেম , এই প্রেম এর জন্য মানুষ বৈরাগী হয়ে যায়। কে বলে ভালোবাসা মরন ব্যাধি? ভালোবাসা তো বেঁচে থাকার প্রয়াস।ভালোবাসা তো এক একটা বিশুদ্ধ নিশ্বাস। যার কারনে বেঁচে আছে পৃথিবীর সমস্ত মানুষ।
অনুভূতি শূন্য বলে কিছু হয় না। যা আছে তাহ চাঁপা অভিমান কিংবা আড়াল করার ব্যর্থ প্রচেষ্টা।

_ ঝিল

_ হুমম

_ এবার সাওয়ার নিয়ে আসো ? আমরা লাঞ্চ টা না হয় সবার সাথেই করি ?

ঝিল নাক টেনে সম্মতি জানালো। অভিনব ঝিলের কপালে ছোট করে ঠোঁট ছোয়ালে। ঝিল কেঁপে উঠলো। অভিনবর দিকে তাকিয়ে লজ্জা হাসলো। নিজেকে ছাড়িয়ে দ্রুত ওয়াসরুমে চলে গেল।

ট্রাভেল এজেন্সির টেলিটক সিম টা নিয়ে এসেছে অভিনব। বাসায় কথা হয় না তিন দিন। সবাই নিশ্চয়ই চিন্তা করছে।
ফোনে বাবার নাম্বার টা ডায়াল করে নিলো। বার কয়েক রিং হতে ফোন রিসিপ হলো।
_ হ্যালো । কে বলছেন ?

অভিনব ভ্রু কুঁচকালো। ফোনের ওপাশের ব্যক্তি টি তো তাঁর বাবা নয়।
_ পাপা আই মিন অহেদ সরকার কে খুঁজছিলাম ।

_ আপনি !

_ অভিনব সরকার ইহান।

_ আম স্যরি স্যার। আমি কন্ঠ টা চিন্তে পারি নি।

_ ইটস ওকে। পাপা কোথায় ?

_ স্যার তো মিটিং এ আছেন। আমি কি নিয়ে যাবো ?

_ নো । জাস্ট বলে দিবেন আমি ফোন করেছিলাম।

_ওকে স্যার।

অভিনব ফোন টা রেখে নিশ্বাস ফেললো। ঝিল সাওয়ার শেষে বের হয়েছে মাত্র । চুল ঝেরে নিয়ে বলল
_ কি করছিলে ?

_পাপা কে ফোন করেছিলাম। বাট মিটিং এ আছে।

ঝিল একটু করে হাসলো। অভিনব তাড়া দিয়ে বলল
_ লাঞ্চ এর জন্য ডেকে গেছে। চলো ,

_ হুমম

_ আর শোনো আজ সন্ধ্যা তে আমি সবাই কে আমাদের বিষয়ে জানিয়ে দিবো।

ঝিল চোখ বন্ধ করে নিলো। সম্মতি জানালে ও লজ্জা লাগছে। মৃদু হাসলো সে। অভিনব সে হাসি লক্ষ্য করে তাকালো। ঘড়ির কাঁটা টিট টিট করে বেজে উঠলো। অর্থাৎ একটা বাজে। অভিনবর মাথায় চরাও করে উঠলো। ঝিলের হাত টা ধরে কেবিন থেকে চলে আসলো।

সবাই খাবারের জন্য ছাঁদে এসে জড়ো হয়েছে। পোলাও এর আইটেম দেখে ঝিল নাক কুঁচকালো। পোলাও খেলেই অস্থির লাগে তাঁর। যদি ও লাইট খাবার পছন্দ নয় ঝিলের তবু ও পোলাও এর সাথে গাঢ় ঝাঝালো তরকারি খেতে পারে না মেয়েটা। ঝিলের অবস্থা দেখে অভিনব সামান্য চিন্তিত হলো।
_ কোনো সমস্যা ঝিল ?

_ আমার এসব খেলে অস্বস্তি হয়।অস্থির লেগে উঠে।

অভিনব একটু ভাবলো। বিফ আর ইলিশ মাছ টা বাদ দিয়ে ঝিলের জন্য পোলাও , স্টেক , রায়তা , রোস্ট আর চিংড়ি মাছ নিলো। সাথে একটু টক আচার।

ঝিল মাথা টা নিচু করে আছে। খাবারের প্রতি অনিহা দেখা দিলো। অভিনব একটা গ্লাসে করে রিফ্রেসিং ড্রিঙ্কস বানিয়ে নিলো।

প্রথমে সেভেন আপ নিয়ে নিলো, সাথে বরফ এর টুকরো, পুদিনা পাতা আর অল্প করে লেবুর রস , চিনি টা দিলো না। কারন সেভেন আপ এ চিনির পরিমান একটু বেশি ই থাকে।

_ এটা খাও।

_ এটা কি ?

_ রিফ্রেসিং ড্রিঙ্কস ।

_ ওহহ

ঝিল একুট মুখে দিলো। মুহূর্তেই শির শির করে উঠলো শরীর। অভিনব হালকা হেসে বলল
_ এটা ক্লান্তি দূর করবে। আর বিফ আর ইলিশ বাদ দিয়ে খাবার এনেছি। টক আচার দিয়েছি । এবার অতো অসুবিধা হবে না। যত টুকু পারবে তত টুকুই খেও।

ঝিল মাথা ঝাঁকালো । অভিনবর দিকে কৃতঙ্গতার দৃষ্টি রেখে টেবিলে বসলো। অভিনব সবার সাথে কথা বলতে চলে গেল। ঝিল একটু একটু করে খাচ্ছে। ঝিলের খাবার যখন অর্ধেক শেষ হয়েছে তখন অভিনব খেতে বসলো।
খাওয়া শেষে দুজনেই সবার সাথে আড্ডা দিতে ব্যস্ত হয়ে পরলো।

পাপড়ির কাঁধে মাথা রেখে বসে আছে ঝিল। পাপড়ি ভারী নিশ্বাস ফেলে বলল
_ এভাবে চলে যাবে ?

_ আবার দেখা হবে তো আপু।

_ কিন্তু ঝিল আর একটা দিন ই তো?

দীর্ঘ শ্বাস ফেললো ঝিল। পাপড়ির হাত দুটো মুঠোয় নিয়ে বলল
_ একটু সমস্যা আছে। আমাকে ও বাসায় ফিরতে হবে। এমনিতেই তিন দিন ধরে কারো সাথে কথা বলি না।
এখন একটা দিন ও খুব গুরুত্বপূর্ণ।

পাপড়ি অল্প করে হাসলো। মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল
_ আচ্ছা যাও। তবে ফোন করতে ভুলবে না কিন্তু ।

ঝিল অল্প করে হাসলো।এই একটা মানুষ যাকে ট্যুরে সব থেকে আপন লেগেছে। খুব করে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে অভিনবর সাথে সম্পর্ক টা।
তবু ও থেমে গেল ওহ। সঠিক সময়ে অভিনব তো জানাবেই সবাই কে।

কেবিনে এসেছে মিনিট দশেক। এখন সময় দুটো পেরিয়েছে। অভিনবর দেওয়া মেনু তে ঝিলের অস্থির লাগে নি। বরং রিফ্রেসিং ড্রিঙ্কস টা খেয়ে রিফ্রেস ই লাগছে। ঝিলের দিকে একটু করে তাকিয়ে আবার ব্যাগ গোছাতে লাগলো অভিনব।
ব্যাগ গোছানো শেষে ঝিলের পাশে বসলো। বেশ সাহস জুগিয়ে ঝিলের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিস ফিস করে বলল
_ কাল আমাদের সাথে থাকবে তুমি ?

ঝিল কেঁপে উঠলো। এই কথা বলার জন্য এতোটা কাছাকাছি আসার কি প্রয়োজন ? অভিনবর থেকে ছিটকে দূরে সরে গেল। অভিনব মৃদু হাসলো। ঝিলের হাত দুটো টেনে ধরে কাছে নিয়ে আসলো। অগোছালো চুল গুলো আরেকটু এলোমেলো করে দিয়ে বলল
_ ভয় নেই। আমি সংযত থাকতে পারবো।

ঝিল দাঁত দিয়ে জ্বিভ কাটলো। ছেলেটা কোন কথার সাথে কোন কথা মেলাচ্ছে। যত দিন যাচ্ছে তত বেশি লজ্জায় পরতে হচ্ছে।#ধূসর_রঙের_প্রজাপতি
#ফাতেমা_তুজ
#part_37

বোর্ট ছেড়েছে মান্দার বাড়িয়ার উদ্দেশ্যে। সুন্দরবনের দক্ষিন পশ্চিম কোনে এ অভয় অরন্য অবস্থিত । এখান কার গভীর অরন্যে ছোট ছোট ক্ষুদ্র জীব থেকে রয়েছে বাঘ , হরিন , বন্যশুকুর , বানর , কুমির কচ্ছপ , সাপ , কাকড়া ,ইত্যাদির সমরোহ।এছাড়া ও এই স্থানের আরো একটি আকর্ষনীয় জিনিস হলো সাগরের বড় বড় ঢেউ । এখানে সমুদ্র সৈকতে আছড়ে পরা বিশাল বড় বড় ঢেউ গুলো দেখতে সত্যি ই খুব মনোমুগ্ধকর। এছাড়া ও প্রকৃতির অপূর্ব সৌন্দর্য ও জীব বৈচিত্র্যের ভরপুর দুর্গম এ স্থানটি।

সবাই ঠিক করে নিয়েছে মান্দার বাড়িয়াতে কেউ গোসল করবে না। কারন ঢেউ গুলো বেশ বড় বড়। মাহেরার চোখে মুখে সামান্য বিরক্তি। অভিনবর পাশে ঝিল কে মেনে নিতে পারছে না। মাহের বেশ বিরক্ত মাহেরার আচরনে। আফরা কে চোখ দিয়ে ইশারা করলো মাহেরা কে বোঝাতে।
আফরা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। মাহেরা কোনো কালেই তাঁর কথা শুনে না। মাহের দীর্ঘ শ্বাস ফেলে আফরার সাথে জায়গা বদল করলো। মাহেরা কে বোঝাতে হবে । এভাবে মেয়েটা নিজে ও কষ্ট পাবে আর ভুল ও করে বসবে।

_ ঝিল

_ হুমমম

_ মান্দার বাড়িয়া তে সাঁতার কাটবে ?

_ আমি তো সাঁতার পারি না। আর সবাই বললো বেশ বড় বড় ঢেউ।

অভিনব আশ্বাস এর স্বরে বলল
_ ভয় পাচ্ছো কেন ? আমি আছি না ? আমি তোমাকে নিয়ে সাঁতার কাটবো।

_ কিন্তু

_ কোনো কিন্তু নয় শুধু বিশ্বাস টা রেখো।

ঝিল ভ্যাগা ভ্যাগা হয়ে তাকালো। অভিনব ভ্রু নাচিয়ে বলল
_ কি হলো ?

_ আমি তো চেঞ্জ আনি নি।

অভিনব দাঁত কেলিয়ে হাসলো। ঝিলের দিকে একটু ঝুকে নিয়ে ফিস ফিস করে বলল
_ আমি একটাই এনেছি দুজনে না হয় আমার জামা টাই পরে নিবো।

_ অভিনব!

হো হো করে হেসে উঠলো অভিনব। ঝিল যেন আহাম্মক বনে গেল। বিরক্তি তে চ এর মতো শব্দ করলো।
অভিনব বিষয় টা খেয়াল করে নি। তাই আরো জোড়ে হেসে চলেছে। ঝিল তেঁতে উঠলো।
হাতে থাকা জ্যাকেট দিয়ে অভিনবর গাঁয়ে বারি মেরে দিলো। তবু ও অভিনবর হাসি থামছে না।
পরিশেষে মেয়েটা মুখ ফিরিয়ে গোমড়া মুখ করে নিলো । সবাই সবার মতো ব্যস্ত। তাই ঝিল আর অভিনবর খুনসুটি টা কেউ ই লক্ষ্য করলো না।
হঠাৎ করেই ঝিলের সাথে মাহেরার চোখা চোখি হয়ে গেল। মাহেরা দৃষ্টি তে আগুন ঝরছে। কোথাও যেন পানির আভা নেমেছে। ঝিলের মন খারাপ হয়ে গেল। অভিনব হাসি থামিয়ে নিয়েছে। ঝিলের দৃষ্টি লক্ষ্য করে তাকালো। মাহেরার দিকে কেমন অপরাধীর মতো তাকিয়ে আছে ঝিল।
দাঁতে দাঁত চেপে নিলো। ঝিলের দৃষ্টি নত দেখে অভিনব বললো
_ কি হয়েছে ?

_ অভিনব!

_ হুমম বলো কি হয়েছে।

_মাহেরা আপু , কষ্ট পেয়েছে আমার ও খুব কষ্ট হচ্ছে।

ভারী নিশ্বাস ফেললো অভিনব। ঝিলের হাত মুঠো বন্দী করে বলল
_ কিছু সময় স্বার্থপর হতে হয় ঝিল । অতিরিক্ত ভালো কিন্তু ভালো নয়। অবশ্য এটা স্বার্থপরতা ও নয় । এটা উচিত কার্য। এমন তো নয় আমি মাহেরার সাথে রিলেশনে ছিলাম, কিংবা ওকে ধোঁকা দিয়েছি।
এর জন্য মন খারাপ হতেই পারে তাই বলে অতি দরদ দেখানোর কোনো প্রয়োজন নেই ঝিল।

ঝিল শিউরে উঠলো। গলায় দলা পাকিয়ে থাকা কান্না গুলো বাঁধ ভেঙে নিয়েছে। চাঁপা কান্না টা হৃদয় কে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছে। অভিনব হালকা করে শ্বাস ফেললো। খুব যত্ন করে মেয়ে টার চোখের কোনে জমে থাকা পানি টুকু মুছে নিলো।
একটু হেসে বলল
_ চোখের পানি এতো সস্তা নয় ঝিল। যখন তখন আবেগ প্রকাশ করা টা বোকামি।
আমি চাই না সে বোকামি টা তুমি করো। কিছু সময় নিজের ভালো দেখা টাই হয়ে উঠে শ্রেয়।

ঝিল একটু করে হাসার চেষ্টা করলো। ঠোঁট দুটো সামান্য প্রসারিত হলে ও মন টা থমকে গেছে। কোনো অন্যায় কার্য তো সে করে নি তবু ও মন কেন কু গাইছে ?

*

প্রায় চারটের দিকে সবাই মান্দারবাড়িয়া সমুদ্র সৈকতে এসে পৌছালো। সমুদ্র সৈকতের প্রধান আকর্ষন বড় বড় ঢেউ এর ছিটে ফোঁটা ও দেখা গেল না। সবাই মন খারাপ করে নিলো। তবে অভিনব মন খারাপ করলো না।
অভিনবর তীক্ষ্ম মস্তিষ্ক বলছে কিছুক্ষণের মাঝেই ঢেউ আসছে।
সবাই তীর ধরে হাটতে লাগলো । পরিচ্ছন্ন সমুদ্র সৈকত টা কে কক্সবাজারের শাখা সৈকত হিসেবে তুলনা করা যেতেই পারে।একটু দূরে রয়েছে বিশ্রাম করার জন্য কাঠের খাট।
কেউ কেউ সেখানে বসে ও রয়েছে। মিনিট দশেক যেতেই অভিনব বলল
_ চলো সমুদ্রে নেমে যাই।

_ আমি তো চেঞ্জ আনি নি।

_ আরে বোকা মেয়ে আমি চেঞ্জ এনেছি তো। দেখো তোমার ব্যাগে এক্সট্রা জামা ভরে দিয়েছি।

_ সত্যি?

_ আরে হ্যাঁ ।

ঝিল খুশি তে গদগদ হয়ে গেল। অভিনবর বাহু জোড়ে চেপে ধরলো। বোধহয় কিছু টা ছিলে ও গেছে তবু ও অভিনব হাসলো। ঝিলের দিকে মোহনীয় দৃষ্টি রেখে বলল
_ জল রাশির থেকে ও বেশি সুন্দর তুমি । আকাশের থেকে বেশি পরিচ্ছন্ন তুমি। হৃদয়ের থেকে ও বেশি দামি তুমি।

ঝিল মাথা নিচু করে নিলো। লজ্জা হাসি তে রাঙা হয়ে গেছে । অভিনব ঝিল কে একটু কাছে টেনে নিলো। মেয়েটার শ্বাস প্রশ্বাস যেন কয়েক গুন হয়ে গেছে। অভিনবর বুকে হাত রেখে মাথা নত করে রাখলো।
অভিনব অধর কোনে হাসি ফুঁটিয়ে একটু ঝুকলো। ঝিলের কানের উল্টো পিঠে হাত দিয়ে স্লাইড করে বলল
_ আমি তোমাকে ভালোবাসি ঝিল। তোমার জায়গা মাথা নত করে রাখা নয় মাথা উঁচু করে রাখা।

ঝিল তাকালো। অভিনব একটু ঘোর লাগা চোখে বলল
_আমার কাছে লজ্জার চরম পর্যায় তোমার জন্য হারাম হয়ে গেছে ঝিল। তুমি শুধু ই আমার। যার প্রতি টি শিরায় শিরায় আমার অধিকার।

ঝিল আর থাকতে পারলো না। নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে একটু দূরে সরে গেল। আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো। অভিনব তাঁর অন্তর কে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে। এতো ভালোবাসার যোগ্যতা আদৌ কি আছে ওর ?
হঠাৎ হাতে টান অনুভব হলো। পেছন ঘুরে তাকানোর সুযোগ হলো না। তাঁর আগেই অভিনব তাকে নিয়ে ছুট লাগালো।

একটু একটু করে ঢেউ হচ্ছে। সবাই সে দিকেই ছুটছে। অভিনব ঝিল কে লাইফ জ্যাকেট পরিয়ে দিলো। তারপর ই সমুদ্রে নেমে গেল। ঢেউ এর গতি বাড়ছে। ঝিলের আত্মা কেঁপে উঠলো।
_ অভিনব আমার খুব ভয় হচ্ছে।

_ আমি আছি তো ভয় কিসের ? আমার হাত টা ধরে রাখো।

_ অভিনব !

_ আচ্ছা আমি ই ধরছি।

অভিনব ঝিলের হাত শক্ত করে ধরলো। তাঁতে ও ঝিলের ভয় কাটলো না। অভিনব এক হাতে ঝিল কে জড়িয়ে ধরলো। অভিনবর স্পর্শ গায়ে লাগতেই ঝিল জমে গেল। প্রচন্ড অস্তিত্বে নেতিয়ে পরলো। অভিনব সেটা লক্ষ্য করে একটু হাসলো। মেয়েটা কে টেনে একদম কাছে নিয়ে আসলো। দুজনের নিশ্বাস একে আপরের চোখে মুখে এসে লাগছে । এতেই দুজনের মনে প্রেমের জোয়ার নেমে গেছে।
_ অভিনব !

_হুমম !

_আমি পাগল হয়ে যাবো । তুমি প্লিজ আমায় ছেড়ে দাও।

অভিনব ঘোর লাগা কন্ঠে বলল
_ আমাকে গ্রহন করার শক্তি সঞ্চয় করে নাও বউ। আমি বেসামাল হয়ে পরেছি।

_ অভিনব !

অভিনব ঝিলের দিকে আরেকটু এগিয়ে আসলো। নাকে নাক ঘষে বলল
_ তুমি আমার জীবনের সেরা অনুভূতি।যেই অনুভূতি তে মত্ত আমি। যার অস্তিত্বে থাকবে শুধু আমার বিচরন।

ঝিল চোখ বন্ধ করে নিয়েছে।বুকের ভেতর হাটুরি পেটার মতো শব্দ হচ্ছে। অভিনব তাঁকে পাগল করে ফেলবে। অভিনবর পিঠ খামচে ধরলো। মেয়েটার মস্তিষ্ক অভিনব তে হারিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ করে এক ভয়ঙ্কর কাজ করে ফেললো। অভিনবর গলা পেঁচিয়ে ধরে গালে চুমু খেয়ে নিলো। অভিনবর স্পর্শ ও গাঢ় হলো।
চোখ বন্ধ করে অভিনব কে অনুভব করতে লাগলো। প্রেম ময় তৃষ্ণা। ভালোবাসার অনুভূতি, যা ওদের জন্য হালাল।

ঢেউ যেন গর্জন তুলছে। সা সা করে বাতাস বইছে। সে বাতাস কানে এসে লাগছে। মুহুর্তেই বড় বড় ঢেউ খেলতে লাগলো। অভিনব ঝিল কে শক্ত করে ধরে রাখলো।
_ অভিনব !

_ ভয় পেও না। ঢেউ এর মাঝে হারানোর মজা রয়েছে।

_ কিন্তু

_লাইফ জ্যাকেট পরে আছো না ? একটু ও ভয় পেও না।

ঝিল মাথা ঝাঁকালো । বিশাল এক ঢেউ ওদের দিকে ধেয়ে আসতেই মেয়েটা চোখ বন্ধ করে নিলো । দু হাতে জড়িয়ে ধরলো অভিনব কে।
ততক্ষণে ঢেউ ওদের নিয়ে গেছে অনেক দূর।
_ ঝিল তাকাও । না হলে একটু ও মজা পাবে না।

_ আমার ভয় হচ্ছে অভিনব ।

_ তাকাও বলছি।

_না । আমার খুব ভয় করছে।

_ ছেড়ে দিবো কিন্তু।

ঝিল ভয় পেয়ে গেল । হালকা করে চোখ মেলে তাকালো। অভিনব ঝরা হেসে ঝিল কে ছেড়ে দিলো।
_ অভিনব !

_ ভয় পেও না। আমি তোমার হাত ধরে রেখেছি।

ঝিল তবু ও ভয় পেল। তবে এবার চোখ মেলেই রইলো। বিশাল ঢেউ এসে ওদের দোল খাওয়া তে লাগলো । পর পর কয়েক বার ঢেউ আসলো। ঝিলের ভয় একদম কেঁটে গেল। খিল খিল করে হেসে উঠলো। অভিনবর সাথে দারুন এক সময় উপভোগ করছে সে।
কিছু টা ছোট বেলার কার্টুন এর মতো। প্রায় বিশ মিনিট ঢেউ এর সাথে খেলা করে ঝিল ক্লান্ত হয়ে পরলো। অভিনবর শরীরে ক্লান্তির ছিটে ফোঁটা ও নেই। মেয়েটার অবস্থা বুঝতে পেরে তীরে এসে পরলো।
ঝিল বার বার মানা করলো । কারন সে আরো কিছুক্ষণ থাকতে চায়।অভিনব শুনলো না।

সবাই ওদের দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টি দিয়ে আছে।অভিনব একটু করে হাসলো। গায়ের জ্যাকেট টা প্রথমেই ঝিলের গাঁয়ে জড়িয়ে দিয়েছে ।
ঝিল কে ইশারা করে পাশেই দাঁড়াতে বলল। ট্রাভেল এজেন্সির একজন গার্ড বললেন
_ আপনি দেখছি বেশ দক্ষ। সচরাচর এই ঢেউ এ পা ফেলতে ও ভয় পায় সবাই। আর আপনি সাঁতার কেঁটে ও নিলেন। তা ও আরেক জন কে নিয়ে।

_ এটা আমার অভ্যাস । আমি বহু বার ঢেউ এর সাথে সাঁতার কেটেছি। এটা তো কম ই ছিলো।

_ আমাদের ও নিতে পারতে।

অমিত এর কথাতে অভিনব হাসলো। ঝিলের দিকে একপলক তাকালো। মেয়েটা লজ্জায় মাথা নিচু করে আছে।
_ প্রকৃতির সাথে আমার উঠা বসা। ঝিল মানেই তো বিশাল জল ধারা। তাই ওকেই নিয়ে গেলাম।

অভিনবর উত্তরে সবাই হাসলো। সবাই কে বিদায় জানিয়ে অভিনব হাঁটা লাগালো। পর পর দুদিন পানি তে সময় কাটালো। কনকনে শীতের মাঝে ঠান্ডা লেগে যাওয়ার আশংকা রয়েছে । এভাবে থাকলে নির্ঘাত নিউমোনিয়া হয়ে যাবে।
ঝিল কে নিয়ে চেঞ্জিং সেন্টার থেকে চেঞ্জ করে নিলো।

ঝিলের দিকে দুটো বোতল এগিয়ে দিয়ে বলল
_ এগুলো অনাবৃত অংশে মেখে নাও।

_ এটা কি ?

_ সান্স ক্রিম আর অলিভ অয়েল।

_আমি এগুলো মাখি না।

অভিনব ভ্রু কুঁচকে তাকালো। কিছু টা সান্স ক্রিম নিয়ে ঝিলের পুরো মুখে একটু করে লাগিয়ে দিলো ।

_ অভিনব !

_ কোনো কথা নয়। কনকনে শীতে এভাবে থাকলে স্কিন টাইপ একদম বাজে হয়ে যাবে। তুমি বনের মাঝে আছো বাসায় নও।

অভিনবর কথাতে ঝিল নুইয়ে গেল। হাতে যখন অলিভ অয়েল টা মাখিয়ে দিচ্ছিল তখন কি বিদঘুটে লাগছিল।
ঝিল ঠোঁট উল্টিয়ে তাকালো। অভিনব না তাকিয়েই বলল
_ চিন্তা করো না অলিভ অয়েল চিটচিটে নয়। এটা খুব দ্রুত গাঁয়ের সাথে মিশে যায়।

সমুদ্রের তীরে স্টপে করে চা বসানো হয়েছে । একটু দূরে আগুন ও জ্বালানো হচ্ছে। ঝিল অভিনবর দিকে তাকালো। অভিনব মৃদু হেসে ঝিল কে কাছে টেনে নিলো।
_ কিহ হচ্ছে টা কি ?

_ এখানে তো কেউ নেই ঝিল পাখি।

_ অভিনব!

_ আমার বউ , আমি চুমু খাবো না হয় জড়িয়ে ধরবো।
ইচ্ছে হলে টসটসে গালে কামড় ও দিবো। তোমার কি তাঁতে ?

_ ছিইই তুমি নির্লজ্জ হয়ে গেছে। আগেই ভালো ছিলে ।

_ বর কে উপেক্ষা করো না মেয়ে। ভালোবাসার গভীরতা সে ও উপলব্ধি করে নি। বুঝো তাহলে তাঁর মনের অবস্থা।

ঝিল অভিনবর বুকে হাত রেখে লজ্জা কন্ঠে বলল
_ তুমি লাগামহীন হয়ে গেছে।

_ আরো হবো ঝিল। পুরো লাগামহীন অসভ্য ভদ্র লোক।

ঝিল গগন কাঁপিয়ে হাসতে লাগলো। অভিনব স্বযত্নে ঝিলের মাথা টা বুকে চেপে ধরলো। অভিনবর বুক থেকে ভেসে আসা গুন গুন সুরে ঝিল যেন হারিয়ে গেল।
#ধূসর_রঙের_প্রজাপতি
#ফাতেমা_তুজ
#part_38

আগুন জ্বালানো হয়ছে। সবাই ঘেরাও করে বসেছে। যেহেতু আজ সুন্দর বনের শেষ দিন তাই একটু ভিন্ন আয়োজন। স্টবে করে চা বসানো হয়েছে। যে সে চা নয় মালাই চা। আগুনের উত্তাপে সকলের মুখ মোহনীয় লাগছে। আজ সবাই এক সাথে সূর্যাস্ত উপভোগ করবে। সৈকতে আঁচড়ে পরা ঢেউ গুলো এখন শান্ত। সূর্য প্রায় নিভু নিভু হয়ে আকাশে লাল আভা ছড়িয়েছে । তাঁর ই মাঝে প্রেম ময় অনুভূতি নিয়ে সময় কাটাচ্ছে অভিনব ঝিল । দুজনের মাঝে সামান্য দূরত্ব থাকলে ও হৃদয় রয়েছে খুব কাছাকাছি। প্রেমের তৃষ্ণা নিবারন করছে চোখে চোখে। অভিনবর দুষ্টুমি ভরা চাহনি তে ঝিল কুকরে যাচ্ছে।
তবু ওহ বেহায়া মন বার বার ফিরে তাকাচ্ছে। আর তাঁর ই মোক্ষম সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে অভিনব।

শাকীল উঠে দাঁড়ালো। একটা বোতল নিয়ে মাইক স্টাইলে মাঝে চলে আসলো । সবাই হাত তালি দিলো কেউ বা শিস বাজালো। ভাব নিয়ে শাকীল হাত নাড়ালো। ঠিক যেন কোনো দেশের সেলিব্রেটি।

খ্যাক করে কেশে বলল
_ গোপন সূত্রে জানা গেছে আমাদের মাঝে আরো এক জোড়া কাপল রয়েছে। কিছু পার্সোনাল কারনে বিষয় টা আড়ালে রেখেছিলো। তবে যেহেতু আজ আমাদের সুন্দরবনে শেষ দিন তাই তাঁরা চাচ্ছে বিষয় টা জানাতে।
আর ইউ এক্সাইটেড গাইস ?

সবাই চিৎকার করে বললো ইয়েস। ঝিলের চোখ কপালে উঠে গেছে। অভিনবর দিকে তাকাতেই অভিনব রহস্য হাসলো। সকলে আনন্দিত হলে ও মাহেরা আনন্দিত নয়। সব কিছু বিষাক্ত মনে হচ্ছে। এই মুহুর্তে অভিনব কে ও বিরক্ত লাগছে। পুরো বিষয় টাকে ন্যাকামো আর ভাব বলে মনে হচ্ছে।
সবার জন্য নিজেকে কন্ট্রোল রেখেছে। না হলে অনেক আগেই এখান থেকে উঠে যেত।

সবাই এক যোগে করতালি দিয়ে সুর তুললো। উদ্দেশ্যে নব দম্পতি কে দেখা।
শাকীল অভিনব কে ইশারা করলো। অভিনব ই তাঁকে বলেছিলো এ আয়োজন করতে।
ঝিলের ভীষন অস্বস্তি হতে লাগলো। অভিনব উঠে দাঁড়াতেই সবাই ওহহহ বলে চিৎকার করলো। বিষয় টা মোটামুটি বুঝে গেছে সবাই। তবু ও খুব আকর্ষিত হচ্ছে।
অভিনব ঝিলের দিকে আগালো। যত আগাচ্ছে ঝিলের মনে তত লজ্জা বেড়ে চলেছে। বুকের ভেতর ধিম ধিম আওয়াজ হচ্ছে। এই মুহুর্তে মৃত্যু ই যেন পারে তাকে বাঁচাতে।
অভিনব তাঁর সামনে এসে ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলো। হাত বাড়িয়ে দিয়ে ইশারা করলো।
হাজারো অস্বস্তি নিয়ে হাতে হাত রাখলো ঝিল। গোলের মাঝে এসে অভিনব হাঁটু গেড়ে বসলো।
সবাই চিৎকার করে উঠলো। মাহের নিজ হাতে ভিডিও করছে। তা দেখে মাহেরার ভীষন রাগ হলো।
হঠাৎ করে গোলের ভেতর আগুন জ্বলে উঠলো। ঝিল ভয় পেয়ে ব্যস্ত হলো। অভিনব চোখ দিয়ে আশ্বস্ত করতেই ঝিল দমে গিয়ে সামনে তাকালো। লজ্জায় তাঁর গাল কমলা রঙে পরিনত হয়েছে। অভিনব তাঁর পেছনে গুটিয়ে রাখা হাত টা সামনে নিয়ে আসলো। ঝিলের দিকে এক গুচ্ছ পদ্মফুল এগিয়ে দিলো। তারপর ই বললো অন্তকর্নে থেকে ভেসে আসা সেই বানী।
_শোনো মেয়ে তুমি ই আমার হৃদস্পন্দন, তুমি আমার ভুবন , তুমি ই আমার বুক ধুকপুকানি, তুমি ই আমার রঙিন আকাশের ধূসর রঙের প্রজাপতি প্রজাপতি ।

সবাই এক সাথে উঠে দাঁড়ালো । অভিনবর নামে বাহবা দিতে লাগলো। সবাই বলছে ফুল গুলো নিতে। ঝিল ছলছল নয়নে তাকিয়ে। অভিনবর চোখ দুটো যেন হাসছে ।ঝিল ফুল গুলো নিতেই অভিনব উঠে দাঁড়ালো।
কোনো আড়ষ্ঠতা ছাড়াই সবাই কে উপেক্ষা করে ঝিল কে বুকে জড়িয়ে ধরলো। ঝিলের মাঝে ও লজ্জার ছিটে ফোঁটা দেখা গেল না। দু হাতে খামচে ধরলো অভিনব কে। যেন ছেড়ে দিলেই পালিয়ে যাবে।

*

সূর্যাস্ত হচ্ছে সবাই সৈকতের দিকে ছুটে গেল। ঢেউ গুলো একটু একটু করে উথাল হচ্ছে। তাঁর ই মাঝে পা মেলাচ্ছে অভিনব ঝিল । জিন্স এর কিছু অংশ ভিজে গেছে। তবু ও দারুন এক অনুভূতি। অভিনব ঝিল কে সামন্য চেপে ধরলো।
_ কি হচ্ছে কি এসব ?

_ প্রেম চলছে।

_ আজব। এগুলো কে প্রেম বলে ? এটা তো রিতি মতো ছ্যছরামি , যাকে তুমি প্রেম বলে আখ্যায়িত করলে।

_ উহুহহ এটাই প্রেম। স্বামী স্ত্রীর হালাল প্রেম। বুঝেছো?

_ ধ্যাত। ছাড়ো তো আমার অস্বস্তি হচ্ছে।

অভিনব ভ্রু কুঁচকালো। অবিশ্বাসের স্বরে বলল
_ সত্যি ই অস্বস্তি হচ্ছে ?

ঝিল মাথা ঝাঁকালো। অভিনব যেন গভীর ভাবনায় পরে গেল। কিছুক্ষণ পর ড্রেভিল স্মাইল দিলো। যে হাসির মানে বোঝার আগেই ঝিল কে কোলে তুলে নিলো। বাচ্চাদের মতো হা পা ছুঁড়তে লাগলো। অভিনব লম্বা হাসি ফুটিয়ে বলল
_ যত ই করো হেলা ছাড়বো না তোমায় শেষ বেলা।

_ কি ভয়ঙ্কর কবিতা।

_ সত্যি ?

_ হ্যাঁ। তোমকে তো অস্কার দেওয়া উচিত। বাই দ্যা রাস্তা নবেল দিলে ও মন্দ হয় না।

ঝিলের রসিকতায় অভিনব হাবুলের মতো তাকালো। ঝিল খিল খিল করে হাসলো। অভিনব চোখ টিপে বললো
_ আজ তোমার রক্ষা নেই । ফিজিক্স , ম্যাথ , কেমিস্ট্রি সব শেখাবো আজ।

_ নো।

অভিনব ডেভিল স্মাইল দিয়ে হাঁটা লাগালো।

লঞ্চে ফিরে এসেই সবাই যে যার কেবিনে চলে গেল। রাতে সবার আড্ডা হবে। তাই রেস্ট করার জন্য দু ঘন্টা সময় দেওয়া হয়েছে। সন্ধ্যার নাস্তা সবার কেবিনে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। ঝিল ফ্রেস হতে গেছে। প্রায় আধ ঘন্টা পর বের হলো সে। অভিনব ফোঁস করে দম ফেললো।
_ এতো লেট করে কেউ ?

_ না মানে আমি আসলে

_ আসলে কি ?

_ জিপ ছাড়া জামা নিয়ে গেছি। কুর্তির জিপ টা কেঁটে গেছে। সেটার জন্য ই এতো লেট।

_ তাহলে এখন কি করে আসলে ?

_ ট্রাওয়াল পেঁচিয়ে।

_ আগে ও তো আসতে পারতে ?

_ ইয়ে মাথায় আসে নি।

অভিনব ঝরা হাসলো। ঝিলের কাছে এসে দাঁড়ালো। মেয়েটার শ্বাস ঘন হয়ে যাচ্ছে। অভিনব সে শ্বাস উপেক্ষা করে ঝিলের দু পাশে হাত দিয়ে আটকে ফেললো।
_ কি হচ্ছে কি অভিনব ?

_ ম্যাথ।

_ হোয়াট !

_ বলেছিলাম না ক্লাস নিবো আজ।

_ দেখো তুমি কিন্তু

অভিনব একটু ঝুঁকলো। আচমকাই ঝিলের পিঠ থেকে ট্রাওয়াল টা সরিয়ে নিলো। ঝিল চোখ বন্ধ করে নিলো । অভিনব ফিস ফিস করে বলল
_ দ্যাটস ফিজিক্স।

_ আমি

_ হ্যাঁ তুমি ?

_ দূরে সরো প্লিজ ।

_ কেমিস্ট্রি বাকি আছে তো ? অভিনব অর্ধেক ক্লাস পছন্দ করে না।

ঝিল চোখ মেলে তাকালো। চোখে মুখে অস্বস্তি। অভিনবর ঠোঁটের কোনে মৃদু হাঁসি । এক হাতে ঝিলের অর্ধ উন্মুক্ত পিঠে হাত ছোঁয়ালো। মুহুর্তেই ঝিলের শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল। রক্তে শীতল বাতাস অনুভব হলো। আকাশে মেঘের গর্জনের মতো করে বুকের ভেতর গর্জন হতে লাগলো। ঘোর লাগা চোখে অভিনব আরেকটু ঝুঁকে নিলো। ভেজা চুলে নাক ডুবাতেই ঝিল অভিনব কে খামচে ধরলো। অভিনব যেন নিজের মাঝেই নেই। ঝিলের গলাতে তাঁর উষ্ণ ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো। এবার ঝিল নিজে ও অভিনব তে হারিয়ে গেল। অস্বস্তির সাথে ভালো লাগায় মত্ত হয়ে গেল।
অভিনব তাঁর মাদক মেশানো কন্ঠে বলল
_ দ্যাটস কেমিস্ট্রি।

ঝিল চোখ মেলে তাকালো। অভিনব তাঁর এতো টা কাছে ভাবতেই লজ্জা লাগছে। তবু ও অভিনব কে খামচে ধরলো। অভিনব ঝিল কে একদম নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়েছে। ভেজা চুল গুলো ঘাড়ের এক সাইটে সরিয়ে ডিপলি কিস করলো। একটা ছোট করে লাভ বাইট দিয়ে বলল
_ বায়োলজি টা প্রাক্টিক্যাল ই

ঠিক তখনি কেবিনের দরজায় নক পরলো। অভিনবর প্রেম ময় রোমান্টিক মুহুর্তে ব্যাঘাত ঘটলো। ফুটুস করে ভেঙে গেল তাঁর হৃদয় ।
দরজার অপর পাশের ব্যক্তি টি কে ভয়ঙ্কর এক গালি দিলো সে।
ঝিল মুখ চেপে হাসছে। অভিনব রাগে কটমট করে তাকিয়ে বলল
_ শালার বউ এর সাথে প্রেম করবো তাঁর ও উপায় নেই। বি ডি তে রোম্যান্স এর সেফটি অব্দি নেই। ধ্যাত

ঝিলের ভাব ভঙ্গি দেখে বিরক্তি প্রকাশ করলো অভিনব। মেয়েটার মাঝে কি কোনো রোমান্টিকতা নেই ?

দরজা খুলে দিতে একজন স্টাফ লম্বা করে হাসলো। হাতে সন্ধ্যার নাস্তা। অভিনব বির বির করতে লাগলো । এই নাস্তার জন্য তাঁর রোম্যান্স এর বারো টা বাজলো ।
প্রচন্ড বিরক্তির মাঝে ও অভিনব হাসলো। নম্র ব্যবহার করে বিদায় জানালো । স্টাফ চলে যেতেই ঝিল আড়াল থেকে বেরিয়ে আসলো। অভিনব দাঁত কিরমির করতে করতে টেবিলে খাবার টা রাখলো। ঝিলের অবস্থা তখন যায় যায় । হাসি থামিয়ে রাখতে পারছে না সে। অভিনব রগচটা স্বরে বলল
_ খাবার টা খেয়ে উদ্ধার করুন আমায়। তুমি একটু ওহ রোমান্টিক নও ঝিল ।

_ আমি আনরোমান্টিক ?

_ তাহলে আমি আনরোমান্টিক?

ঝিল নাক কুঁচকালো। অভিনব তাকে আনরোমান্টিক বললো। আজ রোমান্টিকতা কাকে বলে বুঝিয়ে দিবে। হঠাৎ করেই অভিনবর উপর হুমড়ি খেয়ে পরলো। অভিনব এটার জন্য একটু ওহ প্রস্তুত ছিলো না। ঝিলের নিজের প্রতি খেয়াল নেই।
জামা কাপড় এলোমেলো। অভিনব ঝিলের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে। যে মেয়ে একটু আগে কাঁপা কাঁপি শুরু করেছিলো সে মেয়ের অবস্থা এখন পুরোই আকাশ পাতাল।
অভিনবর নাগাল না পাওয়াতে ঝিল নিজের উপর বিরক্ত হলো। 5’3 লম্বা হয়ে ও কোনো লাভ নেই। 6 ফিট বরের কাছে সে নিতান্তই পিচ্ছি। ঝিল বুদ্ধি খাটিয়ে অভিনবর পায়ের উপর দাঁড়ালো। লক্ষ্য করলো অভিনব ব্যথা পাচ্ছে কি না। অভিনবর মুখের ভঙ্গিমা স্বাভাবিক। অর্থাৎ ঝিলের ভর তাঁর কাছে তেমন কিছু ই না। সাহস সঞ্চয় করে ঝিল অভিনবর গালে চুমু খেল। অভিনব বেশ অবাক হলো। হঠাৎ ঝিল অভিনবর ঠোঁটের দিকে আগালো অভিনবর চোখ রসগোল্লা হয়ে গেছে।
হাত দিয়ে বাঁধা দিয়ে বলল
_ ছিই ঝিল রোমান্টিকতার নাম করে তুমি অশ্লীল হয়ে গেছো।

_ আমি অশ্লীল হয়ে গেছি ?

ভদ্র বাচ্চা দের মতো দু দিকে মাথা কাত করে সম্মতি জানালো। ঝিল ছিটকে দূরে সরে গেল। অভিনব নিজের চাঁপা হাসি টা রাখতে পারলো না। হো হো করে হেসে উঠলো।

মেয়েটা কে কিছু বুঝতে না দিয়ে কোলে তুলে নিলো। বেডে শুইয়ে দিয়ে তার দিকে ঝুঁকে নিলো। ঝিল ভয়ার্ত চোখে তাকালো। অভিনবর ঠোঁটে স্মিত হাসি। অভিনব তাঁর শীতল হাতে ঝিলের গাল শুইয়ে দিলো । অবেশে চোখ বন্ধ করে নিলো মেয়েটা। ধীরে ধীরে সে ঝিলের ঠোঁটের দিকে অগ্রসর হলো। অভিনবর অনভূতি তে ঝিল ওহ সায় দিলো।
তাঁদের ভালোবাসার গভীরতার প্রথম ধাপ। সোজা বাংলায় যাকে বলে ঠোঁটে চুমু খাওয়া। অভিনব ফিস ফিস করে বলল
_ আমার কাছে সব থেকে সুন্দর তুমি ঝিল। চাঁদ ওহ তোমার কাছে ম্লান।

ঝিল একটু হাসলো। অভিনব কে আঁকড়ে ধরে বলল
_ তুমি আমার সেই সুখের প্রথম অনুভূতি। ভালোবাসি খুব , খুব ভালোবাসি।

অভিনব লম্বা হাসলো। মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে যে শান্তি অনুভব হচ্ছে তার ছিটে ফোঁটা ও ছিলো না গত দেড় বছরে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here