#রংধনুর_রঙ_কালো
৭.
অরিন অন্বয়ের এপার্টমেন্ট থেকে বের হয়েই অপ্রত্যাশিত ঘটনার মুখোমুখি হলো। বাহিরে গাড়িসহ ইলহানকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে প্রায় আঁতকে উঠলো। তার বুকের বামপাশে ধুকপুকানির শব্দটাও যেনো থমকে গেল! ইলহান ঠিকই তাকে ফলো করতে করতে এতোদূর চলে এসেছে। এখন যদি ইলহান জিজ্ঞেস করে ‘তুমি এখানে কেনো?’ তখন অরিন কি জবাব দিবে? তাছাড়া অন্বয়ের সাথে যদি ইলহানের দেখা হয়ে যায়? তাহলে তো কেলেংকারী হবে। ইলহান নিশ্চয়ই অন্বয়কে চিনে ফেলবে। অরিনের কেনো যেনো মনে হচ্ছে এখন খুব বড় একটা ঝড় আসতে চলেছে। ইলহান তাকে ভুল বুঝবে। অন্বয়ের লেখা ডায়েরির কথাগুলো কোনোভাবে ইলহান জেনে যাবে। সে যদি এইসব তার বাবা-মাকে জানিয়ে দেয়? অন্বয়ের সাথে সাথে সবাই অরিনকেও ভুল বুঝবে। একসাথে সবাই তাদের তিরস্কার করবে। এইসব চিন্তা করেই ভয়ে কয়েক পা পিছিয়ে গেল অরিন। ক্রমাগত গলা শুকিয়ে আসতে লাগলো তার। আর ইলহান সামনে এগিয়ে এলো। ভ্রু কুচকে একবার এপার্টমেন্টের দিকে তাকালো। তারপর পুনরায় অরিনের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,
” এইখানে কে থাকে? তুমি এখানে কি করছো অরিন?”
ইলহানের প্রশ্নে অরিন থতমত খেলো।তার অপ্রস্তুত দৃষ্টি ইলহানের কৌতুহল আরও বাড়িয়ে দিল। সে আরও কৌতুহলী হয়ে জানতে চাইলো,
” বলো?”
অরিন জবাব দেওয়ার আগেই ঘটনাস্থলে অন্বয় উপস্থিত হলো। সে ইলহানকে খেয়ালই করলো না। অরিনের হাত টেনে ধরে কাতর গলায় বললো,
” অরিন, প্লিজ আমার কথাটা একবার শুনুন। যাস্ট ফাইভ মিনিটস লাগবে।”
অরিন ভয়ে হিঁচকি তুলতে লাগলো। অন্বয় এসেছে খালি গায়ে, মাথায় ভেজা চুল নিয়ে। ওকে এই অবস্থায় দেখে অরিন এতো বেশি ঘাবড়ে গেল যে ওর সম্পূর্ণ শরীর কাঁপতে লাগলো। ভীত দৃষ্টিতে একবার ইলহানের দিকে সে তাকালো। ইলহান কি ভাববে এখন? তারা খারাপ কাজ করছিল এটাই কি ভাববে? অরিন মনে মনে আওড়ালো,” এ কোনো দুঃস্বপ্ন হয়ে যাক। হে আল্লাহ রক্ষা করো।” অন্বয়ও এতোক্ষণে খেয়াল করলো ইলহানকে। সে আগে তাকে দেখতে পায়নি। অরিন লক্ষ্য করলো ইলহানের চোখ-মুখ অন্যরকম হয়ে গেছে। চোয়াল শক্ত করে অন্বয়ের দিকে তাকালো সে। তার গলার মধ্যমণি উঠা-নামা করছে অনবরত। এই অবস্থা তখনি হয় যখন ইলহান খুব বেশি রেগে যায়। ইলহান দৃষ্টি ঘুরিয়ে তাকালো অন্বয়ের ধরে থাকা অরিনের হাতটির দিকে। অরিন সেটা বুঝে নিজের হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু অন্বয় ছাড়লো না। জোর করে ধরে রেখেই বললো,
” ভয়ের কি আছে? আপনি তো তাকে ডিভোর্স দিচ্ছেন। তাহলে ভয় কেনো পাবেন?”
অরিন এই কথা শুনে চোখ বন্ধ করে ফেললো। মনে মনে দোয়া ইউনুস পড়তে লাগলো। তার চোখের পাপড়িগুলো সমানতালে কেঁপে উঠছিল। ইলহান এইবার কি করবে আল্লাহ মালুম। হঠাৎ খুব ভয়ানক গর্জন শুনতে পেল অরিন।” ইউ বাস্টার্ড.. “,
তারপর একটা বিকট শব্দ। অরিন চোখ মেলে তাকালো। ইলহান অন্বয়ের চোয়াল বরাবর ঘুষি মেরে তাকে উল্টে ফেলে দিয়েছে। অরিনের থেকে কয়েক হাত দূরে ঠোঁটে জমাট বাঁধা রক্ত নিয়ে অন্বয় উল্টো অবস্থায় রাস্তায় পড়ে গেল। তার অর্ধনগ্ন শরীরটা থরথর করে কাঁপছে। অরিন মুখে দুই হাত ঠেকিয়ে আতঙ্কে শব্দ করলো। এরপরের ঘটনা ছিল আরও ভয়ানক। অন্বয় আচমকা উঠে দাঁড়ালো এবং ইলহানকেও একইভাবে চোয়াল বরাবর ঘুষি মারলো। কিন্তু ইলহান উল্টে মেঝেতে পড়লো না। সে নিজের গাড়ির উপর গিয়ে পড়লো। অরিন দেখলো ইলহানের লাল টুকটুকে ঠোঁট দিয়ে রক্ত পড়ছে। তার চেহারা এতোটাই ভয়ানক হয়ে উঠেছে যে তাকে এখন রক্ত চোষকের মতো মনে হচ্ছে। যেনো সে কোনো প্রেতাত্মা। এইমাত্র কারো রক্ত শুষে এসেছে৷ এরপরের পরিস্থিতি কতটা লোমহর্ষক হতে পারে সেটা চিন্তা করেই অরিন ভেতর থেকে শিউরে উঠলো। অন্বয় দ্বিতীয়বার অরিনের হাত ধরে বললো,
” মিসেস অরিন, আপনি আমার সাথে ভেতরে চলুন।কাউকে ভয় পাবেন না।”
অরিন সহসা অন্বয়ের গালে ঠাসিয়ে চড় মারলো। অন্বয় হতভম্ব হয়ে গেল অরিনের আক্রমণে। অরিন চোখ-মুখ শক্ত করে বললো,
” আপনার সাহস কিভাবে হয় আমার হাসব্যান্ডের গায়ে হাত তোলার?”
অন্বয় নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারলো না। বিহ্বল কণ্ঠে বললো,” মিসেস অরিন? আপনি এই কথা বলতে পারলেন? দোষ কি আমার একার? আপনার হাসব্যান্ড নিজেই আগে আঘাত করেছেন আমাকে। আমি তো শুধু.. ”
ইলহান আগের চেয়েও দ্বিগুণ হিংস্রতা নিয়ে তেড়ে আসতে চাইলো অন্বয়ের দিকে। অরিন দুইহাতে ইলহানকে থামিয়ে অনুরোধ করে বললো,” প্লিজ ইলহান, দোহাই লাগে আর সিন ক্রিয়েট করো না। প্লিজ চলো আমরা বাসায় যাই?”
ইলহান অরিনের কথায় থামলো কিন্তু অন্বয়ের দিকে ‘খেয়ে ফেলবে’ এমন ধরণের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। এদিকে অরিনের ব্যবহারে অন্বয় পুরোপুরি অবাক। অরিন কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে অন্বয়কে বললো,
” কাজটা আপনি একদম ঠিক করেননি অন্বয়সাহেব।”
অন্বয় চমকে যাওয়া দৃষ্টিতে তাকিয়েই রইল। অরিন ইলহানের হাত ধরে গাড়িতে উঠলো। আর অন্বয় পেছন থেকে ছটফট করে বলতেই থাকলো,
” মিসেস অরিন, আপনি আমাকে ভুল বুঝবেন না প্লিজ। আমার লাস্ট কথাটা শুনে যান। প্লিজ একবার থামুন। অরিন!”
অন্বয় তাদের গাড়ির পেছনে দৌড়ে আসতে লাগলো। ইলহান যত দ্রুত সম্ভব গাড়ি চালিয়ে জায়গা ত্যাগ করলো। অরিন ভয়ে চুপসানো মুখ নিয়ে বসে রইল। একবার ইলহানের ঠোঁটের রক্তাক্ত জায়গাটা স্পর্শ করতে চাইল হাত দিয়ে। ইলহান ঝারি মেরে অরিনের হাত সরিয়ে দিল। অরিন আহত দৃষ্টিতে তাকালো৷ ইলহান বললো,
” সত্যি করে একটা কথা বলবে অরিন?”
অরিনের হার্টবিট বেড়ে গেল। সে আন্দাজ করতে পারছে ইলহান কি ধরণের প্রশ্ন করবে। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলো,
” কি?”
” তুমি সত্যি ডিভোর্স চাও আমার কাছে? এজন্যই ব্যারিস্টার অন্বয়ের কাছে গিয়েছিলে?”
অরিনের ভয় এবার কমলো কিছুটা। এর মানে ইলহান তাকে সন্দেহ করেনি। ডিভোর্সের কথা শুনেই সে ক্ষীপ্ত হয়েছে। কিন্তু তাহলে সে অন্বয়ের গায়ে কেনো হাত তুললো? শুধুই কি রাগ থেকে? নাকি অন্বয় তার হাত ধরেছিল বলে? ইশশ, ইলহান যদি এসব কথা কোনোভাবে বাসায় জানায় তাহলে আজীবনের জন্য অরিনের চরিত্রে দাগ লেগে যাবে। সবাই কি ভাববে তার সম্বন্ধে? সে কি কাউকে বুঝাতে পারবে যে এইখানে তার কোনো দোষ নেই? ইলহান তীব্র কণ্ঠে বললো,
” আমার কথার জবাব দাও অরিন?”
অরিন জবাব দিতে নিয়ে কেঁদে ফেললো। কান্নারত অবস্থাতেই বললো,
” তো আর কি করবো আমি? যে সম্পর্কে সত্যি’র কোনো বালাই নেই সেই সম্পর্ক টিকিয়ে রেখে কি লাভ? আমি তোমাকে বিশ্বাস করতে পারছি না ইলহান। দিনের পর দিন তুমি আমাকে মিথ্যে বলে ঠকাচ্ছো। কোন মেয়ে সহ্য করবে এইসব? আমি এই কষ্ট আর নিতে পারছি না। হয় তুমি আমাকে ডিভোর্স দাও নয়তো আমাকে মেরে ফেলো। তবুও এভাবে ঠকিয়ো না প্লিজ।”
ইলহান কোনো জবাব দিল না। চোয়াল শক্ত করে গাড়ি চালাতে থাকলো। স্পিড বাড়িয়ে দিল। অরিন আতঙ্কে জমে গেল। একহাত দিয়ে গাড়ির জানালা এবং অন্যহাত দিয়ে নিজের সিট চেপে ধরলো। সে ঠিকমতো বসে থাকতে পারছে না। ইলহান এতো জোরে কেনো গাড়ি চালাচ্ছে? যেকোনো মুহুর্তে এক্সিডেন্ট হতে পারে। অরিন অনুনয়ের স্বরে বললো,” ইলহান,প্লিজ আস্তে। আমার ভয় লাগছে।”
ইলহান শুনলো না অরিনের কথা। সে ক্রমাগত স্পিড বাড়াচ্ছে। অরিন ভয়ে কান চেপে ধরলো। আশেপাশের সবকয়টি গাড়ি পেছনে ফেলে তাদের গাড়িটা এগিয়ে যাচ্ছে। অরিন একাধারে আল্লাহ, আল্লাহ করতে লাগলো৷ হঠাৎ তার মনে হলো জায়গাটা অপরিচিত। তারা সঠিক জায়গায় যাচ্ছে না। অরিন কৌতুহল মেটাতে প্রশ্ন করলো,” এটা তো বাসার রাস্তা না। আমরা কোথায় যাচ্ছি ইলহান?”
ইলহান থমথমে কণ্ঠে বললো,” এদিকে আমার কাজ আছে।”
ইলহান একটা এনিমেল মার্কেটের সামনে গাড়ি থামালো। বের হওয়ার আগে গাড়ির দরজা লক করে গেল যাতে অরিন বের হতে না পারে। অরিন প্রশ্ন করলো,” কোথায় যাচ্ছো?” ইলহান পেছন ফিরেও তাকালো না। জবাবও দিল না। অরিন আশেপাশে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো এইরকম এই জায়গায় ইলহানের কি কাজ থাকতে পারে? একটু পর খাঁচায় বন্দি প্রায় আট-দশটা বিড়ালের বাচ্চা নিয়ে ইলহান গাড়িতে প্রবেশ করলো। খাঁচাটা পেছনের সিটে রাখলো। রঙ-বেরঙের বাচ্চাগুলোকে দেখতে চমৎকার সুন্দর! পারশিয়ান ক্যাট। প্রত্যেকটির চোখে অসম্ভব মায়া। গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করে দিতে ইচ্ছে করে। অরিন জিজ্ঞেস করলো,
” এগুলো দিয়ে কি করবে?”
” আগে বাসায় চলো তারপর বলছি।”
এরপর পুরো রাস্তা দু’জন নিশ্চুপ রইল। অরিন পেছনে তাকিয়ে বার-বার বাচ্চাগুলোকে দেখছিল। কি আদুরে, কি সুন্দর! ইলহান এপার্টমেন্টের সামনে গাড়ি থামিয়ে খাঁচাটা হাতে নিল। অন্যহাত দিয়ে অরিনের হাত ধরলো। তারপর লিফটে করে অষ্টমতলায় তাদের বাসায় আসলো। ইলহান সরাসরি কিচেনে ঢুকে গেল। খাঁচা থেকে বাচ্চাগুলোকে বের করে ডাইনিং টেবিলে রাখলো। তারপর ইয়া বড় একটা ছুড়ি এনে সবচেয়ে সুন্দর বিড়ালের বাচ্চাটির গলা কাটতে লাগলো। অরিন ভীষণ জোরে একটা চিৎকার দিয়ে মেঝেতে বসে পড়লো।
” ইলহান কি করছো এটা?”
ইলহান থেমে গেল। অরিন তাক লেগে চেয়ে রইল। তার মাথা থেকে পা অবধি কাঁপছে এমন ভয়ংকর দৃশ্য দেখে। ইলহান বললো,” ডিনার রেডি করছি। আজকে এগুলোই আমাদের ডিনার হবে যদি না তুমি সত্যি কথা বলো।”
অরিন ভ্রু কুচকে ফেললো,” কিসের সত্যি?”
” ব্যারিস্টার অন্বয়ের সাথে তোমার সম্পর্ক কি? খবরদার মিথ্যে বলবে না। কারণ তুমি যতবার মিথ্যে বলবে এই নিষ্পাপ বাচ্চাগুলো ততবার প্রাণ হারাবে।”
অরিন স্তব্ধ হয়ে গেল। তার মানে ইলহান ঠিকই তাকে ভুল বুঝেছে। কিন্তু তাই বলে সে এইরকম করবে? এতোটা জঘন্য সে?এতোটা নির্দয়?
চলবে
-Sidratul Muntaz