রংধনুর রঙ কালো পর্ব ৮

#রংধনুর_রঙ_কালো
৮.

ইলহানের চিৎকারে কম্পিত হলো অরিনের দেহ।
” টেল মি অরিন? হোয়াট কাইন্ড অফ রিলেশন বিটউইন ইউ এন্ড মি.অন্বয়? টেল মি দ্যা ট্রুথ! ডোন্ট ডেয়ার টু লাই।”
অরিন সত্যি স্বীকার করলো। আতঙ্কিত অবস্থায় সবকিছু বলে ফেললো। একটা মিথ্যা বানাতে গেলে আরও দশটা মিথ্যা বলতে হয়। তাই অরিন সমস্ত কথাই সত্যি বললো। ইলহান উপহাসের স্বরে বললো,
” ওয়ান্ডারফুল! প্রথমে তুমি আমার বাবা-মাকে মিথ্যে বলেছো। তারপর এইখানে এসে আমাকেও মিথ্যে বলেছো। মিথ্যেটা কি? তুমি নাকি তোমার ফিমেল ফ্রেন্ড আর তার হাসব্যান্ডের সাথে অস্ট্রেলিয়ায় এসেছো। অথচ তুমি এসেছো তোমার সো কল্ড বয়ফ্রেন্ড মি. অন্বয়ের সাথে! তাও কিজন্য? আমাকে সন্দেহ করে? এখন তো আমার মনে হচ্ছে তোমাকেই সন্দেহ করা উচিৎ।”
ইলহান ডাইনিং টেবিল পেরিয়ে অরিনের কাছে আসলো। অরিন মেঝেতে দুই হাঁটু পেছনে ভাজ করে বসেছিল। ইলহান খানিক অরিনের মুখের দিকে ঝুঁকে শীতল কণ্ঠে বললো,
” এখন যদি আমি বলি, সবকিছু একটা এক্সকিউজ? আসলে তোমার সাথে মি. অন্বয়ের অবৈধ সম্পর্ক চলছে। তাই আমার নামে মিথ্যে এলিগেশন আনতে চাইছো তুমি। আমাকে ডিভোর্স দেওয়ার বাহানা এইসব। যাতে মি. অন্বয় আর তোমার সম্পর্কে আর কোনো বাঁধা না থাকে। ঠিক বলেছি না?”
অরিনের চেহারা কঠিন হয়ে এলো। সে ইলহানের গালে চড় মারার জন্য হাত উঠালো কিন্তু সাথে সাথে ইলহান সেই হাত মুচড়ে ধরলো। অরিন ব্যথায় কুঁকড়ে উঠলো। ইলহান বললো,
” অনেক হয়েছে আর না। আমাকে চড় দেওয়ার অধিকার তুমি হারিয়ে ফেলেছো। আমি আর সহ্য করবো না এইসব। আমার সাথে বিট্রে করার শাস্তি তোমাকে পেতেই হবে ইউ ব্লাডি শিট!”
ইলহান রুঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। অরিন থমকে গেল ইলহানের কণ্ঠে গালি শুনে। নিস্তব্ধ চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে মুখ বিকৃত করে বললো,
” তুমি যেমন নোংরা, তোমার চিন্তা-ভাবনাও নোংরা।”
ইলহান উঠে ঘর কাঁপানোর মতো উচ্চশব্দ করে বললো,” হ্যাঁ এখন তো আমি নোংরাই হবো। আমার চিন্তা-ভাবনাও নোংরা হবে। কারণ আমাকে ছাঁড়ার একটা বাহানা চাই তোমার। যেভাবেই হোক আমাকে খারাপ প্রমাণ করতে হবে। কারণ আমাকে তোমার আর ভালো লাগছে না। এজন্যেই তো আমাকে কাছে ঘেঁষতে দিচ্ছো না। অন্বয়সাহেব নিষেধ করেছে তাই না?”
অরিনের কান গরম হয়ে গেল। দুইহাতে কান চেপে সে বললো,” ছি ইলহান তুমি খুব খারাপ।”
ইলহান শক্ত হাতে অরিনের গাল চেপে ধরলো। চোয়াল শক্ত করে বললো,” খারাপের দেখেছো কি? আমি এখন তোমাকে বুঝাবো খারাপ কি জিনিস। যাস্ট ওয়েট এন্ড সী।”
ইলহান হনহন করে বেডরুমের দিকে গেল। কি হতে চলেছে ভেবে অরিনের শিরা-ধমনীর রক্ত চলাচল স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে। সে একমনে শুধু আল্লাহকে ডাকতে লাগলো। এ কেমন বিপদে পড়লো সে? অনেক সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরও যখন ইলহান আসলো না তখন অরিন নিজেই বেডরুমে দেখতে গেল। ইলহান ল্যাপটপ হাতে বিছানায় বসে কি যেনো করছে। অরিন ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই আঁতকে উঠলো। ইলহান শায়িখ সাহেবকে ভিডিওকল দিচ্ছে। কিন্তু তিনি ধরছেন না। অরিন চেঁচিয়ে উঠলো,
” ইলহান কি করছো তুমি?”
ইলহান নিজের ঠোঁটে আঙুল ঠেঁকিয়ে বললো,” শশশ, এখন একটা শব্দও যদি করো বিড়ালের বাচ্চাগুলো সবকয়টি প্রাণ হারাবে। তাদের নির্মম মৃত্যু নিজের চোখে দেখতে পারবে অরিন?”
অরিন জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলতে লাগলো। সে যা ভাবছে ইলহান কি সত্যি তাই করবে?
” বাবা আসসালামু আলাইকুম, কেমন আছো?”
অরিন হাঁটু ভাজ করে মেঝেতে বসে পড়লো। লজ্জায় তার হাঁটু কাঁপতে লাগলো। মুখ ঢেকে ফেলতে ইচ্ছে করলো। না চাইতেও অরিনকে শুনতে হলো ইলহান তার বাবার সাথে কি ধরণের কথা বলছে। এই পর্যন্ত যা যা ঘটেছে সবকিছু ইলহান তার বাবাকে জানাচ্ছে। মাও এসে শুনতে লাগলেন। ইলহানের যতটুকু ভুল ধারণা ছিল সবটুকু ভুল সে তার বাবা-মাকেও বুঝিয়ে ফেললো। অরিনের মনে চাইলো মাটিতে মিশে যেতে। গলায় ফাঁস লাগাতে অথবা ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়তে। এতোটা লজ্জা ইলহান তাকে দিতে পারলো? ফোন রাখার আগে ইলহান একবার জিজ্ঞেস করলো,
” তোমাদের বউমা’র সাথে কথা বলবে না?”
নুসাইবা খ্যাক করে উঠলেন,” ওই মেয়ের মুখও দেখতে চাই না আমি। কথা তো দূর।”
তারপর ঠাস করে ফোন কেটে গেল। ইলহানের চোখেমুখে তৃপ্তি। অরিনকে অপমান করতে পেরে নিশ্চয়ই তার খুব ভালো লাগছে। শান্তি হয়েছে সে এইবার? কিন্তু অরিনের যে ভেতর থেকে সবকিছু পুড়ে যাচ্ছে। শ্যানিন যখন এইসব জানবে তাকে কি ক্ষমা করতে পারবে? কেউ কি বিশ্বাস করবে যে অরিনের এইখানে কোনো দোষ ছিল না। তবে ভুল অবশ্যই ছিল। সবাইকে মিথ্যে বলে অন্বয়ের সাথে তার বিদেশে আসাই ছিল সবচেয়ে বড় ভুল। দ্বিতীয় ভুল ইলহানের কাছে ধরা খাওয়া। এখন সবাই তার বিরুদ্ধে চলে গেল। ইলহানের অন্যায়গুলো অরিন আর কাউকে বলতে পারবে না। বললেও কেউ বিশ্বাস করবে না। সবাই ভাববে অরিন নিজের পিঠ বাঁচাতে ইলহানকে দোষ দিচ্ছে। কি থেকে কি হয়ে গেল এইসব! অরিনের চিৎকার করে কাঁদতে মন চাইলো। ইলহান ল্যাপটপ রেখে অরিনের কাছে এলো। এক হাঁটু ভাজ করে অরিনের বরাবর বসলো। অরিন ঘৃণাভরা দৃষ্টিতে ইলহানের দিকে তাকালো। ইলহান আলতো করে অরিনের কপালের একপাশ স্পর্শ করলো। অরিন একরাশ ঘৃণা নিয়ে ইলহানের হাত সরিয়ে দিল। ইলহান হেসে দিয়ে বললো,
” ভয় নেই। আমি তোমাকে টাচ করবো না। তোমার মতো মেয়েকে টাচ করতেও আমার ঘৃণা লাগবে। আই হেইট ইউ অরিন। আই যাস্ট হেইট ইউ।”
শান্ত কন্ঠে এসব বলে ইলহান রুম থেকে বেরিয়ে গেল। রাতটা সে ড্রয়িংরুমেই কাটালো। অরিনের চেহারা দেখতেও বেডরুমে এলো না। আর অরিনের রাত কাটলো বিছানায় শুয়ে কাঁদতে কাঁদতে। সকালে অরিনের ঘুম ভাঙার আধঘণ্টার মাথায় অরিন মায়ের ফোন পেল। অরিনের মা হালিমা ফোন করে তাকে একগাঁদা কথা শোনালেন। কান্নাকাটি করলেন। অভিশাপ পর্যন্ত দিলেন। অরিন কাঁদতে কাঁদতে মাকে বললো,” বিশ্বাস করো মা। ওই লোকের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। আমি তোমাদের জামাইকে ঠকাইনি।”
” তাহলে তুই আমাদের মিথ্যে বলে ওই ছেলের সাথে অস্ট্রেলিয়া কেনো গেলি? এতোবড় নাটক কেনো করলি?”
অরিন এই প্রশ্নের পিছে কোনো উত্তর খুঁজে পেল না। উত্তর দিতে গেলেও সেটা মা বিশ্বাস করবেন না। খুব ভালো হতো যদি এর আগে তার সাথে ঘটে যাওয়া দূর্ঘটনাগুলোর কথা সে অন্বয়কে না জানিয়ে আগে তার পরিবারকে জানাতো। তাহলে একটু হলেও কেউ তার কথা বিশ্বাস করতো। কিন্তু এখন অরিন যা বলবে সবাই সেটা বানোয়াট ভাববে। কি করবে সে? রাগারাগি করে মা ফোন রেখে দিলেন। এইসব কথা কি বাবাও জেনে গেছে? ভাইয়াও কি জানে? পরিবারের সামনে মুখ দেখানোর জো আর রইল না। অরিন ঠিক করলো এখন থেকে সে আর কারো ফোন ধরবে না। এদিকে অন্বয় তাকে একনাগাড়ে ফোন করে যাচ্ছে। ম্যাসেজ দিচ্ছে। অরিনের মনে একটা অদ্ভুত ইচ্ছা জাগলো। সে তার স্যুটকেস থেকে একটা সুন্দর সাদা রঙের জামা বের করলো। সাদা রঙ বের করার কারণ ইলহানের পছন্দ। ইলহান অরিনকে সাদা জামায় দেখতে সবচেয়ে পছন্দ করে। সাজ-সজ্জার জিনিসপত্র বিছানায় রেখে অরিন গোসলে ঢুকলো। গোসল শেষ করে সাদা লেহেঙ্গাটা পরে ইচ্ছেমতো সাজলো। ভেজা চুল পিঠময় ছড়িয়ে দিল। ঠোঁটে হালকা গোলাপি লিপস্টিক দিল। কাজলে চোখ রাঙালো। ইলহান যেভাবে তাকে শাস্তি দিয়েছে অরিন তার দ্বিগুণ শোধ তুলবে এবার। সবাই তো সব জেনেই গেছে। তাহলে অরিনের আর ভয় কিসের? অরিন এখন আরও বেশি করে অন্বয়ের সাথে মিশবে। ইলহান দেখুক,জ্বলুক,পুড়ুক,মরে যাক। অরিনের কিচ্ছু যায়-আসে না। সে যেই ভয়ে অন্বয়ের সাথে খারাপ ব্যবহার করেছিল সেই ভয়টা তো এখন আর নেই! ইলহানকে ভয় পায় না অরিন। পরিবারের কাছে নিজের মান-সম্মান হারানোর ভয় পেয়েছিল। এখন সেই মান-সম্মান হারানোর ভয় যেহেতু নেই তাহলে অরিন কেনো ইলহানের কথা শুনবে? সে নিজের স্বাধীনমতো চলবে। অরিনকে সাদা পোশাকে বের হতে দেখে ইলহান সামনে এসে বাঁধা দিল।
” এক মিনিট, কোথায় যাচ্ছো তুমি?”
” আমার কাজ আছে। সামনে থেকে সরে দাঁড়াও।”
” তুমি এইরকম ড্রেসে কোথায় যাচ্ছো? মি. অন্বয়ের সাথে দেখা করতে?”
” তাতে তোমার কি? তুমি তো আমাকে ঘৃণা করো। তাহলে আমি যার সাথেই দেখা করি তোমাকে কেনো সেই কৈফিয়ৎ দিতে হবে?”
ইলহান জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকালো। ক্ষীপ্ত হয়ে অরিনের গাল চেপে ধরে বললো,” ঘৃণা করলেও তুমি আমার, ভালোবাসলেও তুমি আমার। তুমি শুধুই আমার।”
অরিনের মুখে বিদ্রুপের হাসি ফুটলো। সে হাত ভাজ করে বললো,” চমৎকার! আমি শুধুই তোমার। আর তুমি সবার তাই না? ফালতু কোথাকার!”
ইলহানকে ধাক্কা মেরে সামনে থেকে সরিয়ে অরিন বের হয়ে গেল। ইলহান তৎক্ষণাৎ একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো। সে অন্বয়কে খুন করবে। প্রয়োজনে ফাঁসির দড়িতে ঝুলবে। তাও সে অন্বয়কে খুন করেই ছাঁড়বে।

চলবে

– Sidratul Muntaz

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here